সম্পাদকের অধিক আবুল হাসনাত

স্বাধীনতা-পরবর্তী বাণিজ্যিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনার ইতিহাস যেমন কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিতর্কিত হয়েছে; অপরদিকে এর সর্বোচ্চ ভালোটুকুও অর্জিত হয়েছে এ-সময়টাতেই। এবং এখনো পর্যন্ত সাহিত্য সম্পাদনার প্রাখর্য ও বস্তুনিষ্ঠতা যতটুকু অবশিষ্ট আছে তারও অনেকটা ওই সময়েরই ধারাবাহিকতা। তবে, নতুন শতাব্দীতে এসে নতুন নতুন পত্রিকা ও বিস্তর অবকাশ থাকায় সাহিত্য সম্পাদনায় যুক্ত হয়েছে নতুন পালকও। এর কৃতিত্ব নিঃসন্দেহে এ-সময়ের মেধাবী তরুণদের। তবে হাতেগোনা দু-একজন ছাড়া নির্লোভ অবস্থানে থেকে সাহিত্য সম্পাদনাকে ভালোবেসে তাকে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছেন এমন ঘটনা বিরল। কিন্তু আবুল হাসনাত ছিলেন তাঁর সময়ের বিরলদের একজন। একটি বৈরী ও প্রতিকূল পরিবেশে দেশে যখন ভালো সাহিত্য পত্রিকা ছিল না, তখন তিনি সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীর দায়িত্ব নিয়ে সাহিত্য সম্পাদনার ইতিহাসে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায় সৃষ্টি করেন। যে-ধারাবাহিকতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ধরে রেখেছিলেন। মাঝে শুধু পরিবর্তন হয়েছে এটুকুই যে, তিনি দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর সংবাদের সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করে ২০০২ সাল থেকে কালি ও কলম পত্রিকায় এসে থিতু হন এবং আমৃত্যু সেখানেই কাজ করেন।  

আমাদের জেনারেশনের কথা বলতে পারি যে, গত শতকের আশির দশকের মধ্যভাগে কবি আহসান হাবীবের মৃত্যুর পর আবুল হাসনাতের মতো প্রাজ্ঞ ও বর্ষীয়ান সাহিত্য সম্পাদক আমরা আর কাউকে দেখিনি, অন্তত বাংলাদেশে। আশির দশকের শেষ দিক থেকে যখন ‘সংবাদ সাময়িকী’ পাঠ করতাম, তখন এর সম্পাদক কেমন হতে পারেন তা আমাদের মাথায় আসত না। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকে সংবাদপত্রে চাকরি করার সুবাদে সেই ‘ধারণার বাইরের’ সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে ২০০৪ সাল থেকেই একত্রে কাজ করতে পারব বা তাঁর কাছ থেকে জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সম্পাদনাটা শিখে নিতে পারব, এটা ছিল তখন অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তখন থেকে দুই বৎসরাধিক সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ‘সংবাদ সাময়িকী’তে তাঁর সঙ্গে একত্রে কাজ করার এবং কাজের ধরন বা কৌশল শিখে নেওয়ার। মূলত সেই একসঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকেই এ-নিবন্ধে তাঁর সম্পাদনার কৌশল সম্পর্কে কিছু কথা লিখব। এবং তাঁরই কাছ থেকে হাতে-কলমে শিখে নেওয়া সম্পাদনার কৌশল দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনা জীবনে কতভাবে কাজে এসেছে সে-প্রসঙ্গেও কিছু কথা বিবৃত হবে প্রাসঙ্গিকভাবেই।

সমগ্র সাহিত্যাঙ্গনটার কথা যদি বিবেচনা করা হয়, তবে সেখানে এত এত অনুষঙ্গ একে অপরের পরিপূরক হয়ে কাজ করে যে, তখন মনে হয় একটা ব্যতীত অন্যটির দূরত্বের কথা একটি অকল্পনীয় ব্যাপার।

শুধু মৌলিক সৃজনশীল বা মননশীল বা গবেষণাধর্মী সাহিত্য দ্বারা এ-জগৎটাকে কল্পনা করা যায় না। উচ্চমার্গীয় মৌলিক সাহিত্য রচনা করেও তাকে প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। তার জন্য আরো কিছু অনুষঙ্গের অবতারণা অনিবার্যভাবে অবধারিত মানতে হবে।

একদিকে শিল্প বা সাহিত্য রচনা, এর পাঠক বা দর্শক, এর সম্পাদনা, এর সমালোচনা, এর উপস্থাপনা, এর আবশ্যকতা অনুধাবন করা কিংবা তাকে সময়োপযোগী বা অগ্রবর্তী নন্দনবিশ্ব কল্পনা করা ওইসব অনুষঙ্গের বিভিন্ন স্তর বলা চলে।

সাহিত্য রচনা যেমন একটি আর্ট, তেমনি তার সম্পাদনাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্পমাধ্যম। আমাদের মতো অনুন্নত, অবহেলিত দেশ বা ভাষার দেশের সাহিত্যের দুর্ভাগ্য যে, তা সচরাচর সম্পাদকের চোখ ফাঁকি দিয়ে অসম্পূর্ণভাবে বা ভুলভাল রেখেই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়, আবার কোনো কোনো পত্রপত্রিকায়ও দক্ষ সম্পাদকের অভাবে লেখক যা লিখে থাকেন, তাও বেশিরভাগ অসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়। কিন্তু উন্নত, অভিজ্ঞ বা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশের সাহিত্য সেদিক থেকে ভাগ্যবান, গ্রন্থাকারে প্রকাশের বেলায়ও সেগুলো বিজ্ঞ-পণ্ডিত কোনো সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। সেখানে এডিটোরিয়াল প্যানেল থাকে, যার সদস্যগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক বড়মাপের লেখক বা সাহিত্য-সমালোচক। আবার পত্রিকায় প্রকাশের বেলায়ও সব বাঘা বাঘা সম্পাদকের হাতে সুসম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয় লেখাগুলো।

প্রসঙ্গ এলো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আবুল হাসনাতের মতো একজন বিজ্ঞ-প্রাজ্ঞ সম্পাদকের প্রয়াণের সূত্র ধরে। তাঁর প্রস্থানমাত্রই আমরা বুঝতে পারছি তিনি কতটা অনিবার্য সম্পাদক ছিলেন, তাঁর অভাব এখন কীভাবে আমাদের তাড়িত করবে।

আবুল হাসনাতের মতো সম্পাদক এদেশে সচরাচর মেলে না। বুদ্ধদেব বসু, সিকান্দার আবু জাফর কিংবা আহসান হাবীবদেরই উত্তরসূরি বলা চলে তাঁকে। আমাদের সৌভাগ্য বলব, তাঁর মতো একজন সম্পাদক আমাদের সময়ে ছিলেন এবং তাঁর সম্পাদনায় দুটি পত্রিকা আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখতে পেরেছে এবং প্রবলভাবে তাদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।

তাঁর এই নিষ্ঠ কর্মতৎপরতাকে মনে করে বলা যায়, এদেশে প্রকাশনা শিল্প এবং পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদনার ক্ষেত্রে আবুল হাসনাতের মতো অসংখ্য সম্পাদক আমাদের প্রয়োজন রয়েছে। তাহলে আর অন্য দেশের প্রকাশনা বা পত্রিকা সম্পাদনা দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া হতো না।

আবুল হাসনাত এমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এদেশে; তিনি দেখাতে পেরেছেন, সম্পাদনার মাধ্যমে কোনো পত্রিকা বা প্রকাশনাকে কতটা উঁচুতে তুলে ধরা যায়। এবং উদাহরণ হিসেবে আমাদের হাতের কাছে রেখে গেছেন দৈনিক সংবাদের ‘সংবাদ সাময়িকী’ এবং মাসিক সাহিত্য পত্রিকা কালি ও কলম

দৈনিক সংবাদে দীর্ঘ আটত্রিশ বছরের কর্মজীবনে তিনি দীর্ঘ ঊনত্রিশ বছর ‘সংবাদ সাময়িকী’ সম্পাদনা করেছেন। এবং দায়িত্ব পাওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় সংবাদ সাময়িকীকে শিল্পোৎকর্ষের চূড়ান্তে পৌঁছে দিয়েছেন। দেশের কবি-লেখক এবং সাহিত্যপিপাসুদের মধ্যে অন্যতম আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছিল দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী। তখন সাহিত্য পত্রিকা বলতে উল্লেখ করার মতো কিছুই ছিল না। একমাত্র সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীই উল্লেখযোগ্যভাবে পাঠক-লেখকের মন জয় করেছিল। তখন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী এতটাই গ্রহণযোগ্যতা পায় যে, সংবাদে কারো কোনো লেখা প্রকাশ পেলেই তাকে লেখক হিসেবে স্বীকৃতি দিত লেখক-সমালোচকগণ।

পরে অবশ্য নব্বইয়ের দশকজুড়ে অনেক আধুনিক মান ও নতুনধারার পত্রিকায় সাহিত্য সাময়িকীগুলো আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে প্রকাশিত হওয়ায় সংবাদ সাময়িকীর এককত্ব কিছুটা বিভাজিত হয়। তখন লেখকদের লেখালেখি প্রকাশের জায়গাও বাড়তে থাকে। বেশ কিছু জাতীয় দৈনিক নিয়মিত সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করতে থাকে। তবে নতুন পত্রিকাগুলো যে-ধারায় সাহিত্য সাময়িকীগুলো প্রকাশ করত, বলতে দ্বিধা নেই, তা অনেকটা সংবাদ সাময়িকীর অনুসরণেই প্রকাশিত হতো। সংবাদকেই তারা আইডল মনে করত।

এরপর আবুল হাসনাত যখন মাসিক সাহিত্যপত্র কালি ও কলম সম্পাদনার দায়িত্ব পান; তখন তাঁর সম্পাদনায়ও নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। এবং সংবাদ সাময়িকীর মতো কালি ও কলমও একটি উচ্চমার্গীয় সাহিত্য পত্রিকার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। 

দুই

শুরু থেকে পুরো নব্বইয়ের দশকজুড়ে অন্যান্য পত্রিকা যেমন দৈনিক বাংলার বাণী, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হলেও প্রায় সম্পূর্ণ একক আধিপত্য দখল করে নেয় দৈনিক জনকণ্ঠ। দেশের চারটি বিভাগ থেকে একত্রে প্রকাশিত হয়ে পত্রিকাটি ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রায় এককভাবে প্রতিষ্ঠা পেতে শুরু করে। আমি ১৯৯৬ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে কাজে যোগ দিয়ে বুঝতে পারি পত্রিকার সেই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য। কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় সেই জনপ্রিয়তাও ধীরে ধীরে কমতে থাকে। নতুন শতকে এসে পত্রিকাটি অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়ে একরকম। এবং অনেক সংগ্রাম করে টিকে থাকার পরিস্থিতিতে চলে যায়। বেতন অনিয়মিত হতে থাকে। মনে মনে নতুন চাকরি খুঁজতে থাকি। তখন বেসরকারি একমাত্র টেলিভিশন একুশে বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বিশিষ্ট সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল সেখানে অফিস করেন। একদিন তাঁর কাছে চাকরি চাইতে গিয়েছিলাম। টেলিভিশন নতুন করে চালু হলে তিনি আমাকে চাকরি দেবেন বলেও আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু তার আগেই তিনি নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে তাঁর পুরনো কর্মস্থল দৈনিক সংবাদে যোগ দেন পুনরায়। পত্রিকাটি তখন নতুন করে আরো বড় পরিসরে প্রকাশিত হওয়ার প্রস্তুতি চলছে। তখন, অর্থাৎ ২০০৪ সালে, বুলবুলভাই আমাকে ডেকে সাহিত্যপাতার দায়িত্ব নিতে বলেন। আমি কিছুটা গড়িমসিও করি যে, যেহেতু আমি কবিতা লিখি তাই আমি সাহিত্যপাতায় কাজ করব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনস্থির করি। তার দু-বছর আগে ২০০২ সালে আবুল হাসনাত কালি ও কলমে যোগ দিলেও সপ্তাহে একদিন এসে তিনি সংবাদ সাময়িকীর মেকআপটা দেখে যেতেন। নির্বাহী সম্পাদক আমাকে হাসনাতভাইয়ের হাতে তুলে দিলেন। আমাকে দিয়ে কাজ করানো সম্ভব কি না তেমন একটা কিছু বলে দিলেন। আমি এই পরিস্থিতিতে হাসনাতভাইকে দেখে যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, তেমনি মনের মধ্যে দুরুদুরু ভয়ও কাজ করছিল যে, এত বড় সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে না জানি কত কী ভুল করে বসি। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমি আমার প্রতি আবুল হাসনাতের এক স্নেহসুলভ দৃষ্টি অনুভব করি। আমাকে প্রশ্রয় দেওয়ার মানসিকতা টের পাই।

আবুল হাসনাত আমাকে খুব সহজে গ্রহণ করলেন এবং ধীরে ধীরে কাজ বুঝিয়ে দিতে শুরু করলেন। তিনি সপ্তাহে একদিন আসেন। আর আমি প্রতিদিন সমস্যার সম্মুখীন হই অফিসে বসে। তিনি এলে সমস্যাগুলো তাঁর মাধ্যমে সমাধান করি। আমি বাংলা সাহিত্যের স্নাতকোত্তর এবং লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের মানুষ, নিশ্বাসে বিশ্বাসে যাপন করি কবিতা। তখন পর্যন্ত আমার সম্পাদিত লিটল ম্যাগাজিন শালুকের চার-পাঁচটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদনার যে একটি ভাষা আছে, সে-ভাষা যে অন্য কোনো সম্পাদনার সঙ্গে মেলে না, তা আমি সম্পাদনা করতে এসে আরো বেশি করে বুঝি। এ এক অন্য জগৎ। জানি না কতজন সম্পাদক আছেন, যারা জেনেশুনে বাণিজ্যিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনা করেন। আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমি হাসনাতভাইয়ের মতো বড় সম্পাদকের কাছ থেকে এই সম্পাদনার পদ্ধতি কিছুটা শিখতে পেরেছি। লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতে গিয়ে যেমন পেয়েছি অবাধ স্বাধীনতা, তেমনি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনায় দেখলাম, প্রতিটি মুহূর্তে নানান দিক বিবেচনা করে লেখা প্রকাশের সীমাবদ্ধতা। লেখা পেলেই দৈনিক পত্রিকায় ছেপে দেওয়া যায় না, যত বড় লেখকই হোন না কেন, তিনি যা লিখবেন সবসময় তাই প্রকাশ করা যায় না। এই বিষয়গুলো হাসনাতভাই আমাকে ধীরে ধীরে বোঝাতে লাগলেন।

সেই কাঁচা বয়সে তাঁর কাছ থেকেই স্পষ্ট জানতে পারলাম যে, কোনো লেখার যে-কোনো একটি লাইনের জন্যই পত্রিকার অস্তিত্ব এবং নিজের চাকরি অনিশ্চয়তার মুখে পড়তে পারে। বুঝতে পারলাম, এখানে দৈনিক পত্রিকায় সাহিত্য করার চেয়ে পত্রিকাটির স্বার্থকে সবার আগে বিবেচনা করতে হয়। যে-পদ্ধতিতে পত্রিকাটি টিকে থাকে এবং সুনাম অর্জন করে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হয়। দৈনিক পত্রিকাগুলো হয় বাণিজ্যিক পত্রিকা। তাই এখানে গ্রাহক বা পাঠকের রুচিকে মাথায় নিয়ে কাজ করতে হয়। অনেক সময় অপ্রিয় লেখকের লেখাও ছাপার প্রয়োজন পড়ে, আবার প্রিয় লেখকের লেখাও বাদ দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। পত্রিকার আদর্শগত দিক বিবেচনার ব্যাপারটি নিউজের মতো সাহিত্য সাময়িকীতেও মাথায় রাখতে হয়।

তিনিই আমাকে বোঝালেন পত্রিকার জন্য কোন কোন বিষয় স্পর্শকাতর, কার সমালোচনা কখনো করা যায় না, কার স্তুতি বা বিরোধিতা করলে পত্রিকার সুনাম বৃদ্ধি ঘটে, কীভাবে আপামর পাঠকের কথা মাথায় রাখতে হয়; কীভাবে পত্রিকার আদর্শ ধরে রাখতে হয়।

আসলে সাহিত্য সম্পাদনা যে একটি বিশাল দায়িত্ব মাথায় নিয়ে কাজ করা, তা আমি হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে দুই-তিন বছর কাজ করে শিখেছি। সাহিত্য সম্পাদক যে সাহিত্য সম্পাদকের চেয়েও পত্রিকার একজন দায়িত্বশীল কর্মী, সেটাও ধীরে ধীরে বুঝতে পারি। পাতার একজন নিয়মিত লেখকের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হয়, কার লেখাকে এবং কী ধরনের লেখাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হয়, কোন লেখা লিড করা যায় না, কোন ধরনের লেখা কম গুরুত্বপূর্ণ, কীভাবে শিল্পীকে দিয়ে ইলাস্ট্রেশন করাতে হয়, কীভাবে কবিতাকে গুরুত্ব দিতে হয়, কীভাবে গল্পকে মূল্যায়ন করতে হয়, ধারাবাহিক লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হয়, একটি সংখ্যার পূর্ণতার জন্য কোন বিষয়টি আবশ্যক, বিশেষ সংখ্যা সম্পাদনার ক্ষেত্রে কোন বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হয়, জেনেছি তাঁর কাছ থেকে বিস্তারিত।

এসব ব্যাপার যখন ধীরে ধীরে রপ্ত হতে থাকে; অতীতে পড়া ‘সংবাদ সাময়িকী’গুলো তখন মনের মধ্যে ভেসে উঠতে থাকে। তাঁর সম্পাদনার কৌশলগুলো-ধরনগুলো স্পষ্ট হতে থাকে।

একটি লেখার পরিমাপে একটি ইলাস্ট্রেশন বা একাধিক ইলাস্ট্রেশন কতটা জায়গা পেতে পারে, একটি লেখায় কতবার ইনসার্ট ব্যবহার করা যেতে পারে, কোথায় ইনসার্ট ব্যবহার সমীচীন নয়, কোথায় ছবি ব্যবহার করা দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়, চিত্র-সমালোচনা কেন সবসময় রঙিন ছাপাতে হয় এসব বিষয়ের যৌক্তিকতা-অযৌক্তিকতা বুঝেছি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে করতে। নিরেট সাহিত্য-সংস্কৃতির বাইরেও যে কোনো কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক ব্যাপার সাময়িকীতে জায়গা পেতে পারে, তারও যৌক্তিকতা তিনি তুলে ধরতেন। এরপর কালি ও কলমে কর্মব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ধীরে ধীরে তিনি সংবাদে আসা কমিয়ে দিতে থাকেন। তখন সংবাদ সাময়িকীর সম্পূর্ণ দায়িত্ব এসে বর্তায় আমার ওপর। এবং বলতে পারি, হাসনাতভাই আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন বলেই আজ পর্যন্ত এই ১৭ বছরে আমাকে সম্পাদনা করতে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি।

এরপর ২০০৮ সালে বুলবুলভাই বৈশাখী টেলিভিশনে চলে যান। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বিশিষ্ট সাংবাদিক খন্দকার মুনীরুজ্জামান। মুনীরভাই, যিনি নিজেও আপাদমস্তক একজন সাহিত্যপ্রেমী রাজনীতিক-সাংবাদিক, মাঝে মাঝে একটু চাপ দিয়ে হলেও তাঁর লেখা আদায় করে ‘সংবাদ সাময়িকী’তে প্রকাশ করি। কারণ বুঝতে পারি যে, এই বিষয়টির জন্য তিনিই উপযুক্ত ব্যক্তি। কারণ সংবাদে পুরনোদের মধ্যে তখন তিনি, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কাশেম হুমায়ূন এবং চিফ রিপোর্টার সালাম যোবায়ের কাজ করেন। এমন কিছু বিষয় প্রকাশ করা আবশ্যক যা হয়তো মুনীরভাই ছাড়া আর কেউ লিখতে পারবেন বলে মনে হয় না। তাছাড়া তিনি সাহিত্য লিখতে পছন্দও করেন। আমাকে সম্পাদনার যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছেন তিনি। আমার কাজের মূল্যায়ন করেছেন। কিন্তু এত স্বাধীনতার ভেতরেও যে প্রবল শৃঙ্খলা আছে, তা তো আমাকে শিখিয়ে দিয়ে গেছেন হাসনাতভাই-ই। তাই ইচ্ছা করলেই স্বাধীনতা নেওয়া যায় না।

এখনো প্রতি বৃহস্পাতিবার ‘সংবাদ সাময়িকী’ চার পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হচ্ছে, এর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব কর্তৃপক্ষের, সম্মানিত সম্পাদক আলতামাশ কবিরের। তাঁর প্রশ্রয়ে এখনো ‘সংবাদ সাময়িকী’ যথাযথ প্রকাশিত হয় এবং পাঠকের কাছে আগ্রহের বিষয় হয়ে আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখনো সংবাদ সাময়িকীকে অনেকে শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা দিতে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য করেন না। আর বিশাল বিশাল প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী প্রকাশ করতে গিয়ে ব্যবস্থাপনা সম্পাদক বিশিষ্ট সাংবাদিক কাশেম হুমায়ূন যেভাবে আমাকে সহযোগিতা করেন, তা মনে রাখার মতো।

যেদিন সংবাদ অফিসে চাকরি সূত্রে প্রথম ঢুকেছিলাম, সেদিন সম্পাদকীয় বিভাগ আলোকিত করে থাকতে দেখেছি অগাধ পাণ্ডিত্যের মানুষ মকবুলার রহমান, সাহিত্য সম্পাদক আবুল হাসনাত, সহকারী সম্পাদক সোহরাব হাসান, সহকারী সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন, সম্পাদকীয় সহকারী চিররঞ্জন সরকার এবং সর্বশেষ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সদ্য প্রয়াত মুনীরুজ্জামানকে। আর তাঁর একটা কক্ষ আগের কক্ষটি আলোকিত করে বসতেন সম্পাদক বজলুর রহমান। এঁরা কেউই এখন আর সংবাদে নেই। কিন্তু বজলুর রহমান, মকবুলার রহমান, মুনীরুজ্জামানের মতো হাসনাতভাইও যে আর কোনো দিন সংবাদে আসবেন না, তা কি মেনে নেওয়া যায়! রাজনীতি থেকে সাহিত্য সম্পাদনা ও লেখালেখি সর্বত্র আবুল হাসনাতের বিশিষ্টতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যায়। যে-সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের লিডারশিপে ছিলেন কিংবা সংস্কৃতি সংসদ পরিচালনা করেছেন, সেই ৬৬-৭০ বৈরী সময়ে তাঁর অবদান যেমন ছোট করে দেখার সুযোগ নেই; তেমনি এক প্রতিকূল সময়ে সংবাদ সাময়িকীর দায়িত্ব নিয়ে তাকে যে একটি বিশিষ্ট চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন তা এখন ইতিহাসের পাঠ। কালি ও কলম বাংলা সাহিত্যের চর্চায় যে এক নতুন আবির্ভাব হয়ে সবাইকে চমকে দিলো, একজন আবুল হাসনাত ছাড়া তা সম্ভব হতো কি না, ভেবে দেখার বিষয়। আবার দৈনিক সংবাদে আবুল হাসনাতের সম্পাদনায় প্রাপ্ত সৈয়দ শামসুল হকের ‘হৃৎকলমের টানে’ কিংবা সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘অলস দিনের হাওয়া’ আমাদের কাছে আজো যেন এক মিথিক্যাল পাঠ। তাঁর সময়ের স্বর্ণাভ উপস্থাপনা। এ-জাতীয় কাজ শুধু একজন নিরেট সাহিত্য সম্পাদকের পক্ষে কখনো করা সম্ভব নয়। আবুল হাসনাত একজন কবি কিংবা মৌলিক সাহিত্যস্রষ্টা ছিলেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছিল। সে-দৃষ্টিতে আবুল হাসনাতকে সম্পাদকের অধিক বিবেচনাই শ্রেয়।