হাসনাতভাইয়ের সাথে

সবাই হাসনাতভাইকে নিয়ে যখন কথা বলেন, তাঁরা শুরু করেন দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্যপাতা থেকে। আবুল হাসনাত একসময় ছিলেন সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক। সত্যি কথা বলতে কি, সংবাদের কালে হাসনাতভাইয়ের নামটাও জানতাম না। জন্ম থেকে আমাদের বাড়িতে দৈনিক পত্রিকা বলতে ইত্তেফাকই দেখেছি। ইত্তেফাকে যাঁদের লেখা ছাপা হতো তাঁদের নাম পড়েই বড় হয়েছি। আমার ছোটবেলায় তাই হাসনাতভাই ছিলেন না। ছোটবেলায় ছিলেন না; কিন্তু বড়বেলায় ছিলেন কি?

হাসনাতভাই মারা যাওয়ার পর ফেসবুকের টাইমলাইনে ক্রমাগত সকলের শোকগাথা পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল, অনেকগুলো বছর একসঙ্গে কাজ করেও হাসনাতভাইকে জানা হয়নি আমার!

দীর্ঘ আট বছর আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি কোনো বিরোধ ছাড়া। চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে মাহমুদ আল জামানের লেখা একটি বই স্বয়ং আবুল হাসনাতভাই দিয়েছিলেন আমাকে শিল্প ও শিল্পীর অফিসে বসে; বেশ কয়েক বছর আগে। পড়েওছি সে-বই। সেই তিনি মারা যাওয়ার পর যখন তাঁর লেখক নাম ‘মাহমুদ আল জামান’ জানতে পাই তখন আসলে কেমন বোধ হয়, বলুন তো?

এই যে এখন লিখতে বসেছি এই লেখা কিবা মূল্য যোগ করবে আমার কিংবা হাসনাতভাইয়ের জীবনে!

তবুও আমি মনে মনে লিখছিলাম এই লেখা। হাসনাতভাই যেদিন মারা গেলেন সেই দিন থেকে। ইমেইলে কদিন আগে কালি ও কলম পত্রিকার সহকারী সম্পাদক আশফাক খান যখন লেখা চেয়ে পাঠালেন, আমিও ভাবলাম মন থেকে লেখাগুলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে জায়গা পাক এবার। 

একটু পেছন ফিরে যাই। শিল্পের নানা শাখায় আমার আগ্রহ। কিছু আগ্রহ প্রফেশনে এসে ঠেকেছে কিছু আগ্রহ অকারণ থেকে গেছে। এই অকারণ থেকে যাওয়া আগ্রহ থেকেই একসময় নিয়মিত চিত্রকলা প্রদর্শনী দেখতে যেতাম। একসময় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনই চিত্র-প্রদর্শনীর আয়োজনে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। আমার তাই ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কে বেঙ্গলের আর্ট গ্যালারিতে প্রায়ই যাওয়া হতো। পত্র-পত্রিকা, সাময়িকী, লিটল ম্যাগাজিনও পড়তাম তখন খুব। সেই সূত্রেই কালি ও কলম কিনতাম। পত্রিকাস্ট্যান্ডের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কিংবা শাহবাগে বই কিনতে গিয়েও কিনেছি। বাড়ি গিয়ে পড়েওছি। কিন্তু এর সম্পাদক কে তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি তখন।

 একবার সেটা ২০০৩ বা ২০০৪ সাল হবে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ দিনব্যাপী এক সেমিনারে একটা পেপার পড়তে বলল। খুব খেটেখুটে লিখলাম সে-লেখা। প্রেসক্লাবের পাশে সিরডাপ মিলনায়তনে গিয়ে দেখি শ্রোতার সংখ্যা খুব কম! যাঁরা শুনলেন, মন দিয়েই শুনলেন। আলোচনাও হলো, ভালো। চা বিরতিতে দু-চারজন এসে প্রশংসাও করলেন। কিন্তু মনে মনে আমি একটু মনমরা হয়ে থাকলাম। অনুষ্ঠানশেষে বাড়ি ফিরেও মনের মধ্যে খচখচে ভাবটা রইল। এত খেটেখুটে লেখা প্রবন্ধটি এত কম লোকের কাছে পৌঁছল! আরো পাঠক চাই আমার। এরই সমাধান হিসেবে মাথায় এলো কালি ও কলমের নাম।

কালি ও কলমের প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হওয়া সম্পাদকীয় যোগাযোগের জন্য দেওয়া ফোন নম্বরে ফোন করে সম্পাদককে চাইলাম। ফোন ধরলেন সম্পাদক আবুল হাসনাত। তাঁকে খুলেই বললাম, আমার সঙ্গে পরিচয় নেই আপনার। আগে কখনো কথাও হয়নি আমাদের। আমি ‘চলচ্চিত্রে নারীর উপস্থাপনা’ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছি। মহিলা পরিষদের সেমিনারে পড়েওছি সে-লেখা। কিন্তু ওখানে খুব বেশি মানুষ ছিলেন না। আরো বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর জন্য আপনার কাছে লেখাটি পাঠাতে চাই। পড়ে ছাপানোর যোগ্য মনে হলে ছাপবেন। হাসনাতভাই সঙ্গে সঙ্গে বললেন, পাঠিয়ে দিন। আমি ইমেইল আইডি চাইলাম। তিনি তাঁর সহকারী কোনো একজনকে ফোন দিয়ে আমাকে ইমেইল আইডি দিতে বললেন। আমি সেই আইডিতে লেখা ফরোয়ার্ড করে দিলাম। এক বা দুদিন পরই হাসনাতভাইয়ের ফোন পেলাম। আমার লেখাটি ছাপা হবে কালি ও কলমের পরের সংখ্যায়।

তারপর থেকে যখন যে-লেখা নিজে থেকে লিখেছি হাসনাতভাইকে ইমেইল করেছি। ছাপা হয়েছে। হুবহু যা লিখেছি তা-ই ছাপা হয়েছে। তারপর থেকে উপরি যোগ হলো, কালি ও কলমের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় চলচ্চিত্রবিষয়ক একটি লেখা। কখনো বিষয় বলতেন না তিনি। চলচ্চিত্র বিষয়ে যা লিখতে ইচ্ছে হয়, যা লিখতে চাই, যত শব্দে লিখতে চাই লিখে ইমেইল করে দিতে বলতেন। সঙ্গে অবশ্য প্রাসঙ্গিক ছবিও দিতে হতো। আমিও লিখেছি। সম্পাদক আবুল হাসনাতভাইয়ের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বেশ কিছু লেখা আমার লেখা হয়েছে। আমি নিশ্চিত, হাসনাতভাই না চাইলে সেই সময়ে কালি ও কলমের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় ছাপা হওয়া লেখাগুলো আমার লেখা হতো না। আরো অবাক কাণ্ড যে, লেখা ছাপা হওয়ার পর নিজ উদ্যোগে বাহক-মারফত পত্রিকা ও লেখকসম্মানী বাড়িতে পাঠাতেন হাসনাতভাই! পুরানা পল্টন, কলাবাগান, ধানমণ্ডি এবং মোহাম্মদপুর পর্যন্ত বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের কর্মী এসে বাড়িতে আমাকে পত্রিকা এবং সম্মানী পৌঁছে দিয়ে গেছেন।

২০১২ সালে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন বের করল শিল্প ও শিল্পী। শিল্পকলার কয়েকটি মাধ্যম বিশেষত চিত্রকলা, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক এবং স্থাপত্যকলা বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা। পত্রিকা প্রকাশের আগেই হাসনাতভাই আমাকে ডাকলেন। তিনি চাইলেন শিল্প ও শিল্পীর চলচ্চিত্র বিভাগের দায়িত্ব আমি নিই। অফিসে গিয়ে বসে কাজ করার ব্যাপার নেই। কিন্তু প্রতি সংখ্যায় বিষয় পরিকল্পনা, লেখক নির্বাচন, লেখা হাতে পেয়ে দেখে নিয়ে হাসনাতভাইকে পাঠিয়ে দেওয়া এবং পেজ মেকাপ হয়ে যাওয়ার পর একবার দেখে দেওয়া হবে আমার কাজ। দেখলাম, পুরো কাজটাই ফোনে এবং ভার্চুয়ালি করে ফেলা যাবে। সম্মানী নিয়ে কোনো দরদস্তুর না করেই কাজে নেমে পড়লাম। প্রথম সংখ্যায় আমিই প্রিন্টার্স লাইনে আমার নাম ছাপাতে চাইনি। হাসনাতভাই আমার এই না-চাওয়াকে স্পেস দিয়েছেন। পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ছাপা হওয়ার পর আমার যোগাযোগের লেখকরা কোথাও আমার নাম খুঁজে না পেয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেন। বুঝলাম, এতে লেখা পেতে অসুবিধা হবে আমার। আমি তাই সিদ্ধান্ত বদল করি। জানাই হাসনাতভাইকে এই কথা। শিল্প ও শিল্পীর দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে প্রিন্টার্স লাইনে ফৌজিয়া খান আছে।

দীর্ঘ আট বছর একসঙ্গে কাজ করেছি। প্রতি সংখ্যায় যে-বিষয় পরিকল্পনা করেছি, সেই বিষয়ের জন্য যে-লেখক নির্বাচন করেছি হাসনাতভাই তার কোনোটাতে আপত্তি করেননি, দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া। দু-একটি সংখ্যায় অবশ্য আমার পরিকল্পনার বাইরেও দু-একটি লেখা পেয়েছি। আমিও তাতে আপত্তি বা কোনো প্রশ্ন কখনো করিনি। সম্পাদক হিসেবে নিশ্চয়ই তাঁর সে-এখতিয়ার ছিল।

হাসনাতভাই এত অপ্রকাশ্য ছিলেন, এত নির্জন ছিলেন যে আমার কাজ ভালো হচ্ছে নাকি খারাপ তার কোনোকিছু জানতে পারিনি! বলেননি কখনো। কখনো নিজের সম্পর্কে বলেননি আমাকে, আমার সম্পর্কেও জানতে চাননি কখনো! তাঁর কন্যা দিঠিকে নিয়ে বেশকিছু বিষয়ে আলাপ করেছেন, কিন্তু নিজের সম্পর্কে কোনোকিছু বলেননি। এত কম কথা বলতেন তিনি যে পরিচয় হওয়ার পর থেকে নিয়মিত যোগাযোগের পনেরো-ষোলো বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা পরস্পরের কাছে প্রায় পুরো অজানা থেকে গেছি। এখন তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর সম্পর্কে জানতে পারছি অনেক কিছু!

আর আমি ভাবছি বসে, মানুষে মানুষে আরো বেশি জানাবোঝার আর কি কোনো উপায় আছে?

শিল্প ও শিল্পীর শেষ সংখ্যার পেজ মেকাপ হয়ে আছে। সময়ে ছাপা হয়নি। লেখকরা আমার কাছে প্রায়ই জানতে চান, কবে হবে ছাপা? উত্তর আমার জানা ছিল না। হাসনাতভাই জানতেন কি? উনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঠিক দুই-তিনদিন আগে ফোন করেছিলাম। মিনু আপা ধরেছিলেন। আমার নাম শুনে হাসনাতভাইকে ফোন দিলেন। কণ্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম কফে ভর্তি হয়ে আছে বুক। ‘আমি ফৌজিয়া’ শুনেই বললেন, শরীর খারাপ। কথা অসমাপ্ত অবস্থায় লাইন কেটে যায়। তারপর শুনতে পাই, হাসনাতভাই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তারপর গত হলেন সেও তো মাস পেরিয়ে গেল!

শিল্প ও শিল্পীর শেষ সংখ্যায় চলচ্চিত্রবিষয়ক লেখকদের প্রশ্নের উত্তর আমার সম্পাদকের কাছ থেকে জানার সুযোগ হয়নি। এখন তো ওই নম্বরে আর কোনোদিন ফোন করা হবে না। উত্তর দেওয়ার মতো আমার চেনা আর কেউ নেই যে! হাসনাতভাই, যেখানে আছেন সেখানে আপনি ভালো থাকবেন।