বিচ্ছেদের আকাশপ্রদীপ

এই বছর শীতের পড়ন্ত দুপুর অন্যান্য বছরের তুলনায় একটু বেশি জড়োসড়ো যেন! রাতও কেমন অচেনা। রাতের খাবার সেরে কুট্টুশদের নিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে নির্বান্ধব শীতল কদমতলা পেরিয়ে যেতে যেতে মনে পড়ে, গত বছর এখানে এই সময় প্রবীণদের আড্ডাশেষে শুভরাত্রির আদানপ্রদান চলত। মাফলার সরিয়ে সোয়েটারের হাতার ভেতর থেকে হাত বের করতে করতে আমার সঙ্গে কুশলবিনিময় করতেন তাঁরা। এখন নিথর রাস্তায় স্পষ্ট শোনায় কুট্টুশদের শ্বাসের শব্দ আর বাদুড়ের আচমকা উড়ে যাওয়ায় ডানার ঝাপ্টা। অন্ধকারে কদম ফল খেতে আসে বাদুড়। বারোমেসে শিউলি ফুলের ঝরে পড়ার শব্দও শোনা যায়। ক্লাবে নিস্তব্ধ ক্যারম বোর্ড, ঝিমোচ্ছে রাতের ফুটবলের পার্ক, সিগারেট আঙুলে কলেজপড়ুয়াদের রাস্তার মোড়ের জটলা নেই, এমনকি, হলুদ বাড়ির কোণে রুটি বিক্রি করতেন যে মাসিমা, চপ ভাজতেন দাদা-বউদি সবাই কেমন সন্ধে নামার পরেই চারপাশ খালি করে ঘরে ফিরে যাচ্ছেন আজকাল, যেন অদেখা এক নোটিশ ঝুলিয়ে গেছে কেউ বাড়ির বাইরে থাকলেই বাঘে খাবে। আমরা যারা গ্যাস চেম্বার দেখিনি, ব্ল্যাক আউট, এনকাউন্টার, শূলে চড়ানো, ফাঁসি, মগের মুল্লুক কিছুই দেখিনি, দেশভাগও দেখিনি, এবারের হাড়হিম অদৃশ্য হানাদার ইতিহাসের পাতা উলটে উলটে তাদের দেখিয়ে যাচ্ছে মানুষের অন্যায়, অত্যাচার আর অসভ্যতার প্রায়শ্চিত্তের হিসেব শাসিয়ে যাচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকাই আমাদের ভবিতব্য, হয়তো সেইসব কারণেই এ-বছর শীত আসার আগেই অপ্রত্যাশিত স্মৃতিচারণের ভিড় জমেছে। হালকা হয়ে আসছে অন্তরের আড্ডাঘর। অপ্রত্যাশিত চলে যাওয়া হকচকিত করে দিচ্ছে। এরকম কথা লেখা  ছিল বুঝি অতিমারীর হালখাতায়!

কার্তিক মাসের শুরু থেকে আকাশপ্রদীপ জ্বলে চিলেকোঠায়। শবেবরাতও শুনেছি তেমনই এক স্মৃতিচারণের অনুষ্ঠান। পরিবারের পূর্বজদের সঙ্গে আলোর পথে যোগসূত্র তৈরির অছিলা। কেবল পরিবার? তার চেয়েও বেশি কিছু নয় কি? সেই এক কলকাতাপ্রাণ সাহিত্য-নিবেদিত আবুল হাসনাত, যে-মানুষটি একেবারে আমার বাবার বয়সী, কখনো ভালো লেখা খুঁজে বের করার আগ্রহে, অসুস্থ প্রবীণ সাহিত্যিকের সঙ্গে একবার সাক্ষাতের টানে, সুদীর্ঘ বন্ধুত্বের আকর্ষণে  অথবা কলকাতা কালি ও কলমের  উদ্বোধনে কিংবা বইমেলায় জলঝড় উপেক্ষা করে নিশ্চিত উপস্থিত হতেন এবার থেকে তাঁর কথা ভেবেও তো জ্বলবে আমার আকাশপ্রদীপ? তাঁকে পরিবারের বাইরে রাখিনি কোনোদিন, তিনিও তাঁর পরিবারেই শামিল করেছিলেন আমাকে স্নেহে, ভালোবাসায়। শুনেছি এক উত্তপ্ত সময়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের গুরুদায়িত্ব সামলেছিলেন! এত নরম, শান্ত, বিনয়ী, স্নেহশীল, নীরব অথচ প্রতিবাদী প্রবীণ আর একজনকেও চোখে পড়েনি আমার। হাসনাতভাইকে দেখে বিনয়ী হতে শিখতে হয়, মূল্যবোধের পাঠ নিতে হয়। কত সময় কাটিয়েছি ওঁর সঙ্গে! কত দিন অফিসে দুপুরের খাবার টেবিলে মুখোমুখি বসে মাছ-ভাত খেতে খেতে গল্প করেছি, এখন মনে হচ্ছে সেইসব দিনক্ষণ, ঘটনা, বিবরণ লিখে রাখা উচিত ছিল আমার! অসময়ের এ-স্মৃতিচারণে বারেবারে অসহায়তার বাধা পড়ত না তাহলে। কে ভেবেছিল এই লেখাও লিখতে হবে?

বাঙালি তো সে যার ভাষা বাংলা! যে ভাত, মসুরের ডাল আর আলুর ভর্তা পেলে নিজেকে রাজা-বাদশা ঠাওরায়, না পেলে নুন আর লংকা ডলেই তৃপ্ত? যে-অতীতের  সমস্ত যন্ত্রণা আর অন্যায়ের কথা মনে করে এখনো মাথা ঝাঁকিয়ে উঠে দাঁড়ায়, গলা ছেড়ে রবি ঠাকুরের গান গায়, একুশের সন্তানবিচ্ছেদের ব্যথায় গলা যার বুজে আসে প্রতিনিয়ত তেমনই এক আপাদমস্তক বাঙালি ছিলেন হাসনাতভাই, কাঁটাতার যাদের বুকের ওপর দিয়ে গেলেও এককণা ভালোবাসা চুরি করতে পারেনি। ভাগ করতে পারেনি হৃদয়ের জলজমি। একবার সাক্ষাতে বোঝা মুশকিল ছিল উনি আদতে ঢাকার মানুষ  না কলকাতার। কলকাতার প্রায় সমস্ত কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর ঠিকানা মুখস্থ ছিল ওঁর। বাঘা যতীন মোড়ের কাছে এক বন্ধুর বাড়িতে উঠতেন। আমি পৌঁছে দিয়েছি দু-একবার। ঢাকুরিয়াতেও এক বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন একবার। দুই হাতে দুই বাংলার ভালোবাসা জড়িয়ে রেখেছিলেন। 

দু-হাজার পাঁচের শেষ বা ছয়ের দিকে কুমারমামার চলে যাবার পর লুভাদির  অনুরোধে একটা লেখা লিখেছিলাম ঢাকা কালি ও কলমের জন্য। সেই প্রথম আলাপ। হাসনাতভাই সেই লেখা পড়ে এত খুশি হয়েছিলেন, বলেছিলেন এরকম লেখাই তো  চাই! জানি না কি সেই ‘এরকম’ বস্তুটি। তারপর থেকে শুরু হলো লেখার জন্য তাঁর নিয়মিত তাগাদা। আমার ততোধিক কুঁড়েমি লেখার ব্যাপারে। অবশেষে কলকাতা কালি ও কলমে গানের সিরিজ লেখার জন্য রীতিমতো ধমক-ধামক শুরু হয়েছিল নীরেন কাকার প্রশ্রয়ে। আমি প্রতিবার লেখা পাঠাতে দেরি করতাম আর হাসনাতভাইয়ের ফোন আসত। নরম গলার মিষ্টি আবদার, আর কিন্তু সময় নেই শুচিশ্রী, আপনি লেখাটি পাঠিয়ে দিন দ্রুত। ফটো ফিনিশে আমি লেখা পাঠিয়েছি। আবার এমনও হয়েছে পত্রিকার পাতা এলোমেলো সাজানো হয়ে গেছে, হঠাৎ বদলে গেছে প্রচ্ছদ, নতুন গুরুত্বপূর্ণ কোনো লেখা এসে হাজির হয়েছে শেষ সময়ে, আমি  ভয়ে ঘেমেনেয়ে একশা, এখনো বুঝিনি কীভাবে সে-সব সামলে যেত! কালি ও কলমের কলাকুশলী আর হাসনাতভাই মিলে সব সমস্যা সহজ করে ফেলতেন নিমেষেই। সকলকেই খুব মনে পড়ে। অনেককিছু শেখা বাকি রয়ে গেল আমার।  

একবার ওঁর কানে কিছু অসুবিধা দেখা দিলো। কলকাতায় আমার ইএনটি ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়া হলো। উনি সরাসরি এসেছেন ঢাকা থেকে, আমিও হাজির হয়েছি হাসপাতালে। সারাটা সময় উনি উচ্চারণ করেই গেলেন আমাকে কতখানি বিব্রত হতে হয়েছে। আমিও নাছোড়। ডাক্তার দেখিয়ে, ওষুধ বুঝিয়ে টেরেসের ক্যাফেতে খাবার খেলাম সেদিন। নাতনির কথা বললেন।  মেয়ে আর নাতনি বিদেশে  চলে গেছে তাই বড় মন কেমন। আমি শেষবার ঢাকার বেঙ্গল মিউজিক ফেস্টিভালে গেলাম যেবার,  খুব ইচ্ছে ছিল পরের দিন আমি ওঁর বাড়ি যাই। সময়ের কাজ সময়ে করি না কখনো তাই পরে কেবল আফসোস হাতে নিয়ে বসে থাকি।

কখনো কারো সামান্য সাহায্য নিতেও অত্যন্ত দ্বিধা বোধ করতেন। এদিক-সেদিক দৌড়ে বেড়াতেন কলকাতায় আসতেন যখন পত্রিকার কাজে, আমাদের গাড়ি কিছুতেই নেবেন না আমি ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব, আপনার অনেক সমস্যা হচ্ছে, সময় নষ্ট হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। হাসনাতভাইয়ের অভিভাবকত্বে কলকাতা কালি ও কলমের দায়িত্ব সামলেছি বছর-তিন। পত্রিকা ছাপা, গোছানো, প্রকাশনা সমগ্র বিষয়টিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক মেয়েকে একবারের জন্যও তার অদক্ষতা বুঝতে দেননি। কখনো উঁচুস্বরে ধমক দেননি। নীরেন কাকা (নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী), অলোকদা (অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত), স্যার (শঙ্খ ঘোষ) প্রত্যেকের সঙ্গে যখনই দেখা করতে গেছেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেছেন। বরাবর ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করেছেন সম্মান দিয়ে। গলার স্বর, হাঁটার ভঙ্গি, কথার মধ্যের শব্দচয়ন পরিষ্কার মনে আছে আমার। দূরভাষেই মূলত যোগাযোগ ছিল আমাদের। তাই অনুপস্থিতির আলাদা ইঙ্গিত পাইনি কখনো। সেটাই স্বাভাবিক ছিল। একেবারে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এর মধ্যেই, অকল্পনীয়! এই তো লকডাউনের গোড়ার দিকে আবার মাঝামাঝি সময় আমার সাথে ফোনে কথা হয়েছে দীপকবাবুকে বলুন না লেখা পাঠাতে। অতদিন  আমরা একসঙ্গে কাজ করলাম বড় মনে হয় আপনাদের কথা। আপনি একেবারে চুপ করে গেলেন কেন শুচিশ্রী? লেখা পাঠান। ঢাকায় আমাদের পত্রিকা চলছে কিন্তু  নিয়মিত

 আমি প্রতিবার বলেছি সাবধানে থাকবেন। বাইরে বের না হওয়াই ভালো।  বলেছি, নিশ্চয়ই লেখা পাঠাব। বিদেশ থেকে ফোন তো কিছু বিরতি নিয়েই আসে সেই ভেবে আমি আর ফিরতি ফোন করিনি গত কয়েক মাসের মধ্যে। আমার ভুল হয়েছিল।  আমাদের ছেলেবেলার বৃহত্তর পরিবারের কত ঠাম্মা দাদু কাকা পিসি আসলে রক্তের কেউ ছিলেন না। উদ্বাস্তু কলোনিতে চা পানি ভাত ভাগ করে খাওয়া আত্মীয়তা ছিল তাঁদের। সেই সম্পর্কের গিঁট রক্তের সম্পর্কের থেকেও শক্ত। আবেগে জড়ানো। আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেই আঘাত, সেই আদর, আত্মীয়তাও কেমন আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসছে। আমাদের চেয়ে অনেক ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে এপার-ওপার বিচ্ছেদের এই তীব্রতা হয়তো একেবারেই ম্রিয়মাণ। হাসনাতভাইয়ের মতো মানুষেরা সেই উজ্জ্বল দিনের মায়ার আলো আগলে রেখেছিলেন দুই বাংলায়। এখন আমাদের দায়িত্ব সেই আলোর উষ্ণতাকে উসকে রাখার। সাহিত্য বলি বা শিল্প আসলে তা মানুষের সঙ্গে মানুষকে বেঁধে রাখার ফন্দিই বটে, তাই প্রত্যেক আত্মীয়ের চলে যাওয়া বড় বেদনার। কার্তিক মাসের মরশুমি হিম আমাদের অন্তরের আকাশপ্রদীপের আলো নরম করুক। হাসনাতভাইদের স্মরণ করে জ্বলে উঠুক বছর-বছর।