রূপকথার মানুষরতন

গুরু যার হয় কাণ্ডারি        

গুরুপদে নিষ্ঠা-মন যার হবে।/ যাবে রে তার সব অনুসার/ অমূল্য ধন হাতে সেহি পাবে।।/ গুরু যার হয় কাণ্ডারি/ চালায় তার অচল তরি/ ভব-তুফান ব’লে ভয় কি তারি/ নেচে-গেয়ে ভব-পারে যাবে।।/ আগম নিগমে তাই কয়/ গুরুরূপে দীন দয়াময়/ অসময়ে সখা সে হয়/ অধীন হয়ে যে তারে ভজিবে ।।

লালন শাহ

এক মৌন-বনস্পতির সুবিস্তৃত, শীতল ও নিবিড় ছায়ায় জীবনের প্রায় সিকি-শতাব্দী সময় আমি কাটিয়ে দিয়েছি। দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি, মাথার ওপর থেকে আচানক ছায়াটা সরে যেতে পারে! কখনো ভাবিনি, একদিন সূর্যের তীব্র দাবদাহের তলায় আমাকে এভাবে দাঁড়াতে হতে পারে! ভাবিনি, খরতাপে দগ্ধ কোনো সবুজ-পাতার কুঁকড়ানোমুকড়ানো অসহায় অনুভবে আমাকেও পতিত হতে হবে।  ভাবনার রাজ্যে এসব না-থাকলেও আমি আমার মাথার ওপর ছায়া বিস্তার করে চলা সেই স্নেহশীল-বনস্পতির অন্তর্ধান ঠেকাতে পারিনি। আমার আকুল প্রার্থনাতেও কিছুই আমি রোধ করতে পারিনি। আমি তো জানিই, মানুষ বড়ই অসহায়। মানুষের হাত-পা বাঁধা প্রকৃতির নিষ্ঠুর সব সিদ্ধান্তের কাছে। তবুও কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছিলাম : যেন তিনি সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসেন। বাসসের এক সাংবাদিক বন্ধুর কাছে প্রথম শুনতে পাই তাঁর অসুস্থতার সংবাদ। শোনার পরে আমি বন্ধুর সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে ফোনটা রেখে দিয়েছিলাম। তারপর প্রতিদিনের প্রভাত-সন্ধ্যার মেডিটেশনে তাঁর জন্য আকুল প্রার্থনা জানিয়ে যাচ্ছিলাম। দিনকয়েক চারপাশের সবকিছুই ছিল কেমন সুনসান নীরবতায় ভরপুর। আমার মনে সাহস সঞ্চারিত হলো তিনি নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গিয়েছেন। আমি ঘুণাক্ষরেও মনে অশুভ কোনোকিছুর ঠাঁই দিইনি বা দিতে চাইনি। কারণ আমার কাউন্সিলর বলে দিয়েছেন, সবকিছুই শুভ ও পজিটিভ ভাবতে হবে। ভাবনাই নাকি মানুষকে তার নিজের পথে চালিত করে। কিন্তু আমার সমস্ত আকুল-প্রার্থনা সত্ত্বেও তাঁর চলে যাওয়া নিমিষে আমাকে একেবারে ভেঙেচুরে রক্তাক্ত করে দিলো তিনি লোকান্তরিত হলেন! আশ্চর্য! আমাদের ছেড়ে সত্যিই চলে গেলেন আমাদের সুজন!

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সকাল সকাল এই দুঃসংবাদ দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সমস্ত প্রার্থনাই কি না বৃথা হয়ে গেল পলকে! আশ্চর্য! বিধাতা কোনোদিন আমার কোনো প্রার্থনাই শুনলেন না! কিচ্ছু শুনলেন না তিনি! না-ই শুনলেন এই একটা প্রার্থনা তিনি শুনতে পারতেন। এই একজনের জন্য অন্তত শুনতে পারতেন। আরো কিছুটা দিন তাঁর ছায়ার নিচে আমাকে নিশ্চিন্ত থাকতে দিতে পারতেন! কী মন্দভাগ্য আমার! 

তিন-চারটা বাক্যেও ট্রিবিউট জানিয়ে আমি কোথাও লিখতে পারলাম না তাঁর জন্য। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে বোকার মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দিনরাত্রি পার করে দিতে লাগলাম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর সমস্ত কীর্তিগাথা নীরব অশ্রুজল হয়ে ঝরে পড়তে লাগল। হায়! কতশত মানুষকে যে তিনি ছায়া দিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন! দিয়েছেন সম্মান! তাঁর দেবার ধরনেও ছিল নীরবতা। ছিল এক ধরনের আভিজাত্য। বড় মানুষেরা তো তাই, ফলভারে যাঁরা মাটির দিকেই ঝুঁকে থাকবেন। তিনিও থেকেছেন আজীবন।

বলছিলাম, বিধাতা আমার কোনো কায়মনোবাক্যের প্রার্থনা কোনোদিনই তেমন করে শোনেননি। আমি কোনোদিনই আমার দুর্ভাগ্যের সঙ্গে লড়াই করে জিততে পারিনি। কিন্তু সম্পাদক আবুল হাসনাত প্রায়ই আমাকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেসব বিজয় ছিল আমার জন্য প্রচণ্ড সম্মানের, ছিল আমার কাছে ভীষণরকম আকাঙ্ক্ষার! সেসব বিজয় ছিল গৌরবে পরিপূর্ণ। তিনি

না-থাকলে আমার মতো প্রান্তিক ও ইন্ট্রোভার্ট লেখক কোন স্রোতে যে ভেসে যেত! ভেসে যেত একেবারে খড়কুটোর মতন। ঢাকা শহরের সাহিত্যের অত্যন্ত নোংরা রাজনীতির সঙ্গে পেরে ওঠা আমার কম্মো ছিল না। আমি কোনো ইঁদুরদৌড়ে শামিল হওয়ার জন্যও লালায়িত ছিলাম না। আমার ছিল শুধুমাত্র নীরবে কাজ করার প্রত্যয় আর ছিল পরিশ্রম যা বুঝতে পেরেছিলেন হাতেগোনা তিন কি চারজন পরম শ্রদ্ধেয় মানুষ। সম্পাদক আবুল হাসনাত ছিলেন তাঁদের মাঝে অন্যতম।

আমি সেসব কথা বলতেও শুরু করেছি, ‘পরস্পর অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা’য় আমার লেখা জার্নাল ‘একলা পথের সাথি’তে। এ-পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে তেরো পর্ব। পরস্পর অথরিটির কাছে জমা হয়েছে বিশ পর্ব পর্যন্ত। কিন্তু আমার সেইসব একান্ত-কৃতজ্ঞতা প্রকাশিত হওয়ার পূর্বেই হাসনাতভাই অলখে চলে গেলেন। কোনোদিন তিনি আর জানতেও পারবেন না ডালা পরিপূর্ণ করে রাখা আমার কৃতাঞ্জলির কথা। জানতে পারবেন না আমি কতভাবেই না তাঁর কাছে জমে থাকা আমার আসমুদ্র ঋণের বোঝা স্বীকার করে গিয়েছি।

আমার সমস্ত গোছানো-আয়োজন পণ্ড করে দেওয়াই তো আমার মন্দভাগ্যের কাজ। আমাকে প্রচণ্ড আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করা ছাড়া বিধাতা আর কিছুতেই তো তেমন  করে তুষ্টও হতে পারেন না।

রাখলেন সাঁই কূপজল করে

রাখলেন সাঁই কূপজল করে।/ আঁধেলা পুকুরে।।/ কবে হবে সজল বরষা/ রেখেছি ওই ভরসা/ আমার এই  ভগ্নদশা/ যাবে কত দিন পরে।/  এবার যদি না পাই চরণ/ আবার কি পড়ি ফ্যারে।।/ নদীর জল কূপজল হয়/ বিল বাঁওড়ে পড়ে রয়/ সাধ্য কি গঙ্গাতে যায়/ গঙ্গা না এলে পরে।/ তেমনি জীবের ভজন বৃথা/ তোমার দয়া নাই যারে।।

লালন শাহ

নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন সিরিয়াসলি লিখব বলে মনস্থির করি, আমি তখন নামহীন, গোত্রহীন এক লেখক। তদুপরি নারীলেখক! আমার দিকে ক্রমাগত ছুড়ে দেওয়া হচ্ছে তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ধারালো তূণ। দৈনিক সংবাদের ‘সাহিত্য সাময়িকী’ তখন ক্ল্যাসিক-সাহিত্যের ‘রোল মডেল’। এবং ওই পাতার সম্পাদক যথারীতি হাসনাতভাই। বড় বড় পত্রিকা হাউসে নানান কিসিমের সিন্ডিকেট। নানান রকমের দলবাজি। কিন্তু সাহিত্য সম্পাদকদের বেশির ভাগই হাসনাতভাইয়ের দেখানো পথ ধরে হাঁটছেন। তাঁরা হাঁটছেন, কিন্তু তা যেন খানিকটা চুপিসারে। বৃহস্পতিবারে সংবাদের সাহিত্যপাতাটা প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার পর, শুক্রবারে প্রকাশিত অন্য সাময়িকীগুলির পাতা দেখে আমরা যা বোঝার বুঝে নিতাম। ওই ‘রোল-মডেল’ পাতাটিকে সামনে রেখেই অন্যান্য সাহিত্য-সম্পাদকেরা নিজেদের তরীটিকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতেন।

ওইসময়ে কোণঠাসা-হয়ে-পড়া এক নামহীন, গোত্রহীন, প্রান্তিক লেখকের জন্য হাসনাতভাই যথাসাধ্য করছিলেন।

আমি যতটা পাওয়ার যোগ্য, তার চাইতেও বেশি তিনি আমাকে দিয়েছিলেন। বা দিতে চেয়েছিলেন।

আমি যে আমার ছাইপাঁশ লেখাপত্র নিয়ে কারো দুয়ারে কখনোই ধরনা দিতে যাব না, এটা তিনি হয়তো ভালো করেই ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি অবশ্যই জানতেন, আমার ভীরু কলমের নিভৃতে লিখে যাওয়ার কথা। জানতেন, আমার নিজেকে ক্রমাগত আড়াল করে রাখার প্রাণপণ চেষ্টার কথাও। তাই হয়তো তিনি আমাকে আমার বেষ্টনীর মাঝ থেকে প্রায়ই বের করে আনতে চাইতেন। কালি ও কলমের প্রায় প্রতিটি অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে আন্তরিক আমন্ত্রণ জানাতেন। প্রতিটি স্পেশাল ইস্যুতে লেখার জন্য ফোন করতেন। আজ অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মনে আমি  সমস্ত স্মৃতির উজ্জ্বল পৃষ্ঠাগুলি উলটে চলেছি, আর চোখের জলে সবই ঝাপসা দেখছি। কেন আমি আমার সমস্ত সংকোচের আবরণ ছিঁড়ে ফেলে তাঁকে একবারও ফরমাল ধন্যবাদটুকুও জানাইনি? আমি যখন সেসব জানাতে শুরু করেছি, সদ্য লিখতে শুরু করেছি, কিন্তু সেগুলো প্রকাশিত হওয়ার আগে, সেসব জানার আগে-পড়ার আগেই তিনি অন্তরালবর্তী হলেন। আমার গুরু লোকান্তরিত হলেন! কতই না মন্দভাগ্য আমার! আর কতই না বড়মাপের মানুষ তিনি! তিনি একেবারে নিঃশব্দে চলে গেলেন আমাকে কিছুমাত্র ঋণ স্বীকারের সুযোগ না দিয়ে! এবং প্রমাণ করে গেলেন চিরকালই তিনি এক বিস্তৃত জলনিধি। আমার মতো সামান্য শিশিরের কী সাধ্য আছে ওই জলনিধিকে কিছু দেবার?

আহা! আজ কতশত স্মৃতির পাখিদের অবিরাম পাখসাট আর ক্রন্দন আমাকে পর্যুদস্ত করে তুলছে! আমি কীভাবে বা কোন প্রাণেই বা এত শতসহস্র কথা লিখতে পারব? কীভাবে সেসব পারা যাবে? পারা যায়?

উপন্যাস লেখার কাজে ডুবে থাকার সময়টি একান্তই আমার নিজের সময়। আমি ওই সময়কালে অন্য কোনো লেখাই আর লিখতে পারি না। চৌপাশের কোনোকিছুতেই মন লাগাতে পারি না। আমার সমস্ত দিনমান যেন কোনো দামাল হাওয়ার টানে ভেসে যেতে থাকে। কিন্তু হাসনাতভাই আমাকে স্মরণে রেখে যথারীতিই ফোন করেছেন। বলেছেন, অত তারিখের মাঝে যেন একটা গল্প আমি পাঠাই। কিন্তু আমি বহুবারই অপারগ হয়েছি। আমি কিছুতেই পারিনি  লেখাটা তাঁকে পৌঁছে দিতে। আজ নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে, অত্যন্ত ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, নগণ্য, হীন মনে হচ্ছে আমার সকল কাজ ধুলায় লুটিয়ে দিয়ে ওই মহীরুহের কাছে আমার লেখাটা পৌঁছে দেওয়া দরকার ছিল। অবশ্যই আমার তা করা দরকার ছিল। তাঁর আশীর্বাদের ছায়ায় আরো কিছু সময় একান্তে কাটানোর প্রয়োজন ছিল। যে আমি ছোট হতে হতে নিজেকে একরত্তি বিন্দু করে ফেলতে চাই, তার কথা কে আর কোনোকিছুতেই স্মরণ রাখবে? কেই-বা অত গুরুত্ব দিয়ে, মমতামাখা গলায় বলবে পাপড়ি, ছোটগল্প সংখ্যার জন্য গল্পটা কিন্তু তাড়াতাড়িই পাঠাতে হবে।

আমার সমস্ত অপরাধ স্মরণ করে একেবারে বুকের গহিন থেকে উঠে আসা দুর্মর বেদনারাজি, নয়ন থেকে ঝরে পড়া অবিরল অশ্রুরাশি মুছে ফেলব তেমন কোনো শুষ্ক আঁচল আমি তো কোথাও তুলে রাখিনি। এমনকি খুলে রাখিনি সান্ত্বনার প্রলেপ দেওয়া যায় এমন একটি কবাটও, যে উন্মুক্ত গবাক্ষপথে এই ভয়াবহ শোকভারের কণামাত্রও উড়িয়ে দিয়ে আমি সামান্য নির্ভার হতে পারি!

জীবন থাকিতে যারে না দেখিলাম হেথা।।

মলে গুরু প্রাপ্ত হবো সে কি কথারই কথা/ জীবন থাকিতে যারে না দেখিলাম হেথা।।/ সেবা মূল কারণ তারি/ না পেয়ে কারে সেবা করি/ আন্দাজে হাতড়ায়ে ফিরি/ কথার লতাপাতা।।/

– লালন শাহ

২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ লখিন্দরের অদৃষ্টযাত্রা প্রকাশিত হলো। আমাদের সাহিত্যের নোংরা রাজনীতি সম্বন্ধে আমি তখন থেকেই ওয়াকিবহাল। আমার বইটির নাম পর্যন্ত কোনো উল্লেখযোগ্য পত্রিকায় ছাপা হলো না। আমি অত্যন্ত শরমিন্দিত হলাম। কেনই-বা আমি এইসব ছাইপাঁশ লিখতে যাই? কেনই-বা আমি লেখালেখির এই পিচ্ছিল পথে হাঁটছি? আমাকে ভারি অবাক করে দিয়ে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে  কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়ার করা একটা রিভিউ ছাপলেন হাসনাতভাই। তাও বইমেলা চলাকালে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে। ওই রিভিউ ছাপা হওয়ার পরে অনেক ব্রাহ্মণ সাহিত্য সম্পাদককেও দেখেছি আমার মতো নমশূদ্রের লেখার কদর করতে। আমার সামনাসামনি তাঁরা তা না-করলেও আমার আড়াল-আবডালে তা করেন বলে শুনেছি। আমার লেখার কথা বলতে বা আমার নাম উচ্চারণ করতে চারপাশে ‘জাত গেল জাত গেল’ বলে যে হায় হায় রব উঠতে দেখেছি, তাও যেন ক্রমে স্তিমিত হতে শুরু করল। আমার গুরু আমাকে উদ্ধার করলেন। হাসনাতভাইয়ের এইসব স্নেহচ্ছায়া না-পেলে আমি হয়তো লেখাই ছেড়ে দিতাম। সেটাই তো স্বাভাবিক ছিল। অনাদর আর অবহেলাতে কোন গাছই বা বনস্পতি হতে পারে? আমি নিজেকে দিয়েই জানি, এ-দেশ নারীবান্ধব নয়, কোনোদিন নারীবান্ধব হবে তেমন আশাও আমি করতে পারি না। এ-দেশের জনগণ নারীকে হেঁশেলের খুপরিতে দেখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। নারীর স্থান গৃহে ও সন্তান লালনপালনেই  তাঁরা সীমাবদ্ধ রাখতে চান। শিল্প-সাহিত্যের আঙিনায় নারীর পদচারণা তাদের কাছে বজ্রপাতের মতন। নারী তার অবগুণ্ঠনের বাইরে এলেই শুরু হয় নানান কটাক্ষ ও অপমানকর কথাবার্তা। সেসব কাঁটার আঘাত সহ্য করে শিল্প-সাহিত্যের পথে হেঁটে যাওয়া বড়ই পরিশ্রম ও ধৈর্যের কাজ। আমার আগে, পরে বা সময়ে যেসব নারীলেখকে হাসনাতভাইয়ের ছায়া পেয়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন।

২০০৮ সালে যখন আমার বয়ন উপন্যাস প্রকাশিত হলো, তখনো একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। আমার ইন্ট্রোভার্ট-স্বভাবের জন্য আমি যথারীতি বয়ন নিয়েও নীরব রইলাম। আমি নীরব থাকলেও হাসনাতভাই কিন্তু ঠিকই সরব হলেন। ফোকলোরবিদ শামসুজ্জামান খানকে দিয়ে বয়নের রিভিউ লেখালেন। এবং বহু যত্নে তা কালি ও কলমে ছেপে দিলেন।

এবং একদিন ফোন করে আমাকে সামান্য তিরস্কার করে বললেন আপনি এমন কেন? শামসুজ্জামান খানকে একটা ফোন করে ধন্যবাদ তো জানাবেন। উনি অপারেশন থেকে এসেই আপনার বইয়ের আলোচনাটা লিখেছেন।

হাসনাতভাইয়ের কথা শুনে আমি অত্যন্ত লজ্জিত বোধ করলাম। এবং সেদিনই জামানভাইকে ফোন করে কৃতজ্ঞতা জানালাম। এইসব বটবৃক্ষের সুবিস্তৃত ছায়াই আমাকে এতদূর হেঁটে আসার উৎসাহ দিয়েছে। নইলে কবেই আমি মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে ধুলায় মিশে যেতাম।

এই মানুষে সেই মানুষ আছে

এই মানুষে সেই মানুষ আছে।/ কত মুনিঋষি চার যুগ ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছে।।/ জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়/ ধরতে গেলে হাতে কে পায়/ আলেক মানুষ তেমনি সদায়/ আছে আলগে বসে।।/

আমার আব্বা গত হলেন ২০০২ সালের জুন মাসে। আর আমিও পতিত হলাম ভয়াবহ মানসিক সংকটে। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত টানাপড়েনে লেখালেখি থেকে ছিটকে সরে গেলাম বহুদূরে। কোথায় আমার লেখা আর কোথায়ই-বা আমি? ধূলির আস্তরণ জমতে লাগল আমার না-পড়া বইয়ের স্তূপ আর কাগজ-কলমে। মুমূর্ষুপ্রায় হয়ে উঠল আমার লেখক হওয়ার স্বপ্ন আর এমনকি আমার বেঁচে থাকাও! এসবের মাঝেও হাসনাতভাই ছিলেন স্থির ভরসার মতো। আর কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ছিলেন মায়ের মতো। পূর্বেই করে রাখা আমার দুই-চারটা অনুবাদের কাজ তখন হাসনাতভাই বড় মমতায় ছেপে দিয়েছেন। আর লেখা দেবার জন্যও আন্তরিকভাবে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। 

২০০১ সালে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পরে দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ২০০৭ সালে প্রকাশিত হলো আমার তৃতীয় গল্পগ্রন্থ অষ্টরম্ভা। আমার মতো নগণ্য মানুষ হাসনাতভাইয়ের মতো মহৎ মানুষকে কীই-বা দিতে পারে? তবে আমি বহুবার ভেবেছি হাসনাতভাইকে আমার যা সবচাইতে মূল্যবান সেটাই দেওয়া উচিত অষ্টরম্ভা গল্পগ্রন্থটি আমার গুরু সমীপে ডেডিকেট করেছিলাম। একজন সামান্য লেখকের সামান্য গ্রন্থের সামান্য ডেডিকেশনে অমন বড়মানুষকে তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া হলো   এরকম ভাবাও বাতুলতা। মায়েস্ত্রো, মনের ভুলেও আমি কিন্তু তেমনটি ভাবিনি।

Who is the happy Warrior? Who is he?

That every man in arms should to be?

Who, if he rise to station of command,

Rises by open means; and there will stand

On honourable terms, or else retire,

And in himself possesses his own desire;

(William Wordswoth)

দেখে শুনে জ্ঞান হলো না

দেখে শুনে জ্ঞান হলো না।/ কি করিতে কি করিলাম/ দুগ্ধেতে মিশালাম চোনা।।/ মদন রাজার ডংকা ভারি/ হলাম তাহার আজ্ঞাকারী/ যার মাটিতে বসত করি/ চিরদিন তারে চিনলাম না।।/

কোথায় কোন ভালো লেখাটি হচ্ছে, কে কোথায় ভালো লিখছেন সেসবই ছিল হাসনাতভাইয়ের নখদর্পণে। তিনি এতদিকে কীভাবে দৃষ্টি ধরে রাখছেন ভেবে অবাকই হয়েছি। বাংলাদেশের ক্ল্যাসিক সাহিত্যের ধারাটিকে বলতে গেলে তিনি যেন একহাতেই যত্ন করে আগলে রেখেছিলেন। মোটামুটি একটা বিশাল সাহিত্যকাননের পরিচর্যাকারী ছিলেন তিনি একাই। যে-বাগানের প্রতিটি গাছ, লতাপাতা, পুষ্পকোরকের সঙ্গে হাসনাতভাইয়ের ছিল নিবিড়-পরিচয়। আর ছিল ভালো লেখা আর ভালো লেখকদের জন্য নিভৃত ও ভালোবাসাময় নিরন্তর উষ্ণ-অন্বেষণ। হাসনাতভাই জানতেন, প্রকৃত-লেখক মাত্রই প্রচণ্ড অভিমানী। যে কোনো প্রকৃত-লেখকেরই একধরনের অভিমান থাকে। নিজের সেলফ রেসপেক্টের জায়গাতে একজন প্রকৃত-লেখক শিরদাঁড়া টানটান করেই দাঁড়িয়ে থাকেন। হাসনাতভাই অসীম ধৈর্যে, মমতায়, বড় ভালোবেসে, একাগ্রতায় তাঁদের সকলের কাছ থেকেই সেরা লেখাটি আদায় করে নিয়েছেন।

উপন্যাস পালাটিয়া (২০১১) প্রকাশের পর দীর্ঘ আট বছর নতুন কোনো উপন্যাসের জন্য আমি প্রস্তুত হতে পারিনি। পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ঝামেলায় সম্পৃক্ত থেকে উপন্যাস লেখার জন্য যে দীর্ঘ দমের প্রয়োজন হয়, ওয়ার্মআপ করতে হয়, তা আয়ত্তে আনতে পারিনি। অবশেষে বহু কষ্টের পরে নদীধারা আবাসিক এলাকার ভূমি প্রস্তুত হতেই সবিনয়ে হাসনাতভাইকে জানিয়েছি। চিরকালের স্বল্পবাক মানুষটি বলেছেন আগে লিখুন তো, লিখে শেষ করুন। পরে দেখা যাবে কী করা যায়?

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে শেষ করলাম এই উপন্যাস। শেষ করেই হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইমেইলে পাঠিয়ে দিলাম। উনি বললেন, আমাদের ফান্ডের অবস্থা তেমন সুবিধার নয়। আপনাকে আমি কিছুদিন পরে জানাচ্ছি বইটা আমরা করতে পারব কি পারব না।

এরই মাঝে উনি এক সাহিত্য-উৎসবে চলে গেলেন কলকাতায়। আর উনার ফোনের জন্য আমি অপেক্ষমাণ থাকতে লাগলাম। এদিকে বইমেলার আগমনী ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। হাতে সময়ও বেশি নেই। আমি টেনশনে একশেষ! কী না কী শুনব হাসনাতভাইয়ের কাছ থেকে? আমি অন্য কোনো প্রকাশককে এই উপন্যাস প্রকাশের বিষয়ে কিছুই বলিনি। বইমেলায় প্রকাশের জন্য নির্ধারিত সময় চলে গেলে কেউ-ই আর এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি নেবেন না। অর্থাৎ বইটি এ-মেলায় আর প্রকাশিত হবে না। দীর্ঘ অপেক্ষার শেষে হাসনাতভাই ফিরে এসে আমাকে ফোন করলেন। আগেই বলেছি, উনি আমাকে চিরকালই দিয়েছেন অঢেল-মর্যাদা আর স্নেহের এক অতুল্য-ভুবন।

বললেন, আপনার উপন্যাসের কিছু অংশ আমরা প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্পেশাল ইস্যুতে ছাপতে যাচ্ছি। আপনি এসে সিলেক্ট করে দিয়ে যাবেন কতটুকু অংশ আপনি ছাপতে চান।

আমি চোখের জলে ভাসতে ভাসতে কোনোরকমে বলতে পারলাম কবে আসতে হবে হাসনাতভাই?

তারিখ জানিয়ে বললেন, সকাল এগারোটার পরে আসবেন।

এর দিনকয়েক বাদে প্রচণ্ড শীতের কুয়াশায় সবকিছু ঝাপসা দেখতে দেখতে আমি হাজির হলাম কালি ও কলমের ধানমণ্ডিস্থ অফিসে। হাসনাতভাই যথারীতি ব্যস্ত। আমাকে দেখে তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে  দিলেন নির্ধারিত এক টেবিলে। বললেন, আপনার বই আসতে কিন্তু বিলম্ব হবে। কারণ আমাদের পত্রিকার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যা প্রকাশের পর আপনার বইটি আমরা মেলায় আনব।

কালি ও কলমের ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যায় নদীধারা আবাসিক এলাকা উপন্যাসের প্রায় অর্ধেক অংশ প্রকাশিত হলো।

সৌজন্যসংখ্যাটির সঙ্গে তিনি বেশ ভারী একটা এনভেলপও আমার বাড়ির ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলেন রাইটার অনারিয়াম।

এবং যথারীতি ২০১৯-এর একুশে ফেব্রুয়ারির বইমেলায় ২২ তারিখের পরে আমার বইটা মেলায় এলো। নদীধারা আবাসিক এলাকার প্রোডাকশন এতটাই মুগ্ধকর যে, আমি এই উপন্যাসটি লেখার সমস্ত কষ্ট-যন্ত্রণা বিস্মৃত হয়ে গেলাম।

বইমেলা চলাকালে একদিন এত পাঠক বইটি কিনল যে স্টলে আর বই ছিল না। বই না পেয়ে পাঠকেরা মন খারাপ করে ফিরে গেল। স্টলের লোকজন মলিন মুখে বসে রইল।

হাসনাতভাইয়ের কাছ থেকে সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ আশীর্বাদ হয়ে রইল বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে নদীধারা আবাসিক এলাকা উপন্যাসটি গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হওয়া। 

রঙ্গিলা বাড়ৈ এই ঘর বানাইছে কলে

রঙ্গিলা বাড়ৈ এই ঘর বানাইছে কলে।/ রঙ্গে রঙ্গে ঘর বানাইয়া, বসি ঘরে খেলে।।/ মাটি দিয়া ঘর বানাইয়া চামড়ার দিছে ছানি/ পত্তন করিয়াছে ঘর মূলধন তার পানি।।/

দেওয়ান হাছন রাজা

হাসনাতভাই কালি ও কলমের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে বরাবর একটা ইমেইল আইডিই ব্যবহার করেছেন। ওই আইডির কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্ধন ছিল না। হয়নি কোনোদিন। ওই আইডির অক্ষরগুলি কখনোই ভুলে যাইনি আমি, কারণ পত্রিকার নামের সাথে হাসনাতভাইয়ের নামটাও একেবারে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। [email protected] কালি ও কলমের সঙ্গে হাসনাতভাই এভাবেই একাত্ম ছিলেন। ওই আইডি থেকেই অজস্রবার কালি ও কলমের অফিসিয়াল দাওয়াতপত্র এসেছে। আমিও পাঠিয়েছি সহস্রবার নানান লেখাপত্র। সর্বশেষ ২০১৯-এর ছোটগল্পের বিশেষ সংখ্যার জন্য ‘হাওয়াকলের গাড়ি’ নামক একটা গল্প পাঠিয়েছিলাম একই আইডির ঠিকানায়। 

দিন কয়েক পূর্বে একটা ইমেইল এলো। একেবারে অপরিচিত আইডি থেকে। খুলে দেখি কালি ও কলমের সহকারী সম্পাদক আশফাক খানের ছোট্ট একটা চিঠি। সঙ্গে লুভা নাহিদ আপার এক অফিসিয়াল আমন্ত্রণপত্র। এমন পত্রের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না একেবারেই। মুহূর্তে আমার চোখের সম্মুখের সমস্ত কিছুই কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল! হায়! আজ এ-কোন চিঠি এসেছে আমার নামে? এ কেমন চিঠি? আমি কী লিখব তাঁকে নিয়ে? কেমন করে লিখব? আমার মাথার ভেতরে হাজার হাজার জোনাকির জ্বলা আর নেভা, নেভা আর জ্বলা ছাড়া আর কোনোকিছুই তো নেই।

ইতঃপূর্বে দুই-তিনটা পত্রিকা বলেছিল তাঁকে নিয়ে লিখতে, কিন্তু আমি সবিনয়ে মানা করে দিয়েছি। কারণ অবিশ্রাম অশ্রুমঞ্জরি আড়াল করতে হলে আমাকে কোনো শুষ্ক আঁচলের সন্ধানে বেরুতে হবে। সেজন্য আমার যে খানিকটা সময়ের প্রয়োজন।

আমার মাথার ভেতর অজস্র জোনাকির ক্রমাগত আলো জ্বলা আর নেভার ভেতর চিরপরিচিত সেই ইমেইল আইডিটা আমি তালাশ করে চলেছি। হায়! আমি ভাবতেও যা পারি না, আমাকে সেটাই করতে হচ্ছে! হাসনাতভাইকে আমার শেষ-শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে হচ্ছে!

আমি ভাবতেও পারি না, [email protected] এই ইমেইল আইডি থেকে আমার ইনবক্সে কোনো আমন্ত্রণলিপি বা কোনো কাজের বার্তা আর কোনোদিনই আসবে না …!

Make your last journey/ from this strange world./ Soar for the heights/ where there is no more/ separation of you and your home.

God has created/ your wings not to be dormant./ As long as you are alive/ you must try more and more/ to use your wings to show you’re alive. – Jalaluddin Rumi