সাঁকোপথে এক স্বপ্নজন

এক. বর্ণমালার সাঁকোপথে

শামসুর রাহমানকে প্রশ্ন করেছিলাম, আমরা আপনার বই এখানে পাই না কেন? আপনার মানে, আপনাদের। বাংলাদেশের লেখক-কবিদের বই কলকাতায় পাই না কেন? প্রশ্নটা করে ফেলার পর নিজেকে বেশ বোকা লাগল। আদতে যা। ভেবে-টেবে প্রশ্ন করিনি, পাশাপাশি হাঁটা ও গল্প করার মধ্যে হঠাৎই উঠে এসেছিল। তখন বিকেল। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বা আরো আগে। এটা ঘটনা, তখন চাইলেই শামসুর রাহমান বা আল মাহমুদ বা শওকত আলী বা ওয়ালীউল্লাহ্ বা আবু ইসহাকের বই পেতে পারি না।

পূর্ব কলকাতায় এক ঘরোয়া আসরে কবিতা পড়বেন শামসুর রাহমান। বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে বলবেন শিবনারায়ণ রায়। কলকাতার গুণী মানুষজন আসছেন আসরে। আমি যেন কীভাবে খবর পেয়ে জুটে গিয়েছিলাম। একটি সরকারি আবাসনের অন্তর্গত সিমেন্টের পথে শামসুর রাহমানের পাশাপাশি হেঁটেছিলাম। সে-সময় হঠাৎই বলে ফেলা।

আপনারা চান না, তাই পান না। চাইলেই পাবেন। চাওয়াটা জোরালো করতে হবে। উত্তরে বলেন শামসুর রাহমান। মুখে হাসির প্রসন্ন আলো। চোখে সমাদর। তিনি তখন আমাকে ‘আপনি’ বলতেন। কোনো কিছুই এমনি এমনি আসে না। চাইতে হয়। চাহিদা তৈরি করতে হয়। কলকাতায় যাঁরা বাংলাদেশের বই বিক্রি করার জন্য আনেন, তাঁদের বলতে হবে। বিক্রির ভরসা থাকলে তাঁরা আনবেনই। কথাগুলো নির্ঘাৎ হুবহু এরকম নয়, তবে এই কথাটাই বলেছিলেন।

মনে আছে, কবিতার সে-বিকেলসন্ধের ঘরোয়া বিস্তারে তিনি পড়েন নিজ বাসভূমে কাব্যগ্রন্থ থেকে। মনে থাকার কারণ, বইটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত। আমার সংগ্রহে থাকা একটি প্রিয় বই। মনে আছে, শুরু করেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ পড়ে। মাঝখানে পড়েন ‘একটি বালকের জন্য প্রার্থনা’। ‘আমরা সবাই বুড়ো, দৃষ্টির স্বচ্ছতা নেই কারো/ আমরা সবাই আজ একটি বালক চাই যার/ খোলা চোখে রাজপথে নিমেষেই পড়বে ধরা ঠিক/ সেই রাজসিক মিহি কাপড়ের বিখ্যাত ছলনা।’ প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে কেনা বইয়ে দাগানো জায়গাটা আজো প্রায় তেমনই, সামান্য আবছা।

সেই জবাব ছিল আমার কাছে শিক্ষামূলক। চাহিদা তৈরি করতে হয়। ১৯৮৩ কি ১৯৮৪ সাল থেকে ‘নয়া প্রকাশ’-এ যাওয়া-আসা শুরু বাংলাদেশের বইয়ের খোঁজে। বিধান সরণিতে শ্রীমানী বাজারের দোতলায়। সেখানে আছেন পার্থশঙ্কর বসু। সদাপ্রসন্ন উদ্যমী যুবক। এবং সহিষ্ণু ও আন্তরিক। তখন শুধু বই কিনতে যাওয়া। থাকলে কেনা। না-থাকলে কবে পাওয়া যেতে পারে জিজ্ঞেস করে ফিরে আসা। তখনো জোর দিয়ে বলা শুরু হয়নি যে ওই বইটা আনুন। এবার বলা শুরু হলো। পার্থশঙ্করের কাছে আমাদের আব্দার বা দাবিদাওয়া বেড়েই চলল। আগে যাওয়া ছিল মাঝে মাঝে, খেয়ালখুশিতে। এবার হয়ে উঠল নিয়মিত। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নিছক খদ্দের থেকে নিকট অগ্রজের জায়গা পাই। ১৯৯২ সালে ‘নয়া প্রকাশ’ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে গড়ে উঠল পার্থশঙ্করের ‘নয়া উদ্যোগ’। শ্রীমানী বাজারের ওই দোতলায় এক দরজা পরে। বাংলাদেশের বইয়ের জন্য আমার ও আমাদের একমাত্র ঠিকানা। বইয়ের ঠিকানা থেকে ক্রমে আড্ডার ঠিকানা এবং অবিস্মরণীয় কিছু যোগাযোগের ঠিকানা। যেসব যোগাযোগ আমার অকিঞ্চিৎকর জীবনকে মর্যাদা দিয়েছে। এঁদের মধ্যে প্রথমেই যে-দুজনের নাম করতে হয়, তাঁরা হলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও আবুল হাসনাত।

আজ মনে হয়, এই বইয়ের দোকান থেকে বইয়ের আশ্রয় হয়ে-ওঠা, এই যোগাযোগ, ঘনিষ্ঠতা সবটাই হতে পেরেছে বর্ণমালার হাত ধরে। ‘হে আমার আঁখিতারা দুটি উন্মীলিত সর্বক্ষণ জাগরণে।’

আবুল হাসনাতের সঙ্গে পরিচয় ওই আড্ডার সূত্রে। বর্ণমালার সাঁকোপথে। আমরা যাঁরা ছিন্নমূল এবং যারা ছিন্নমূল নই, যারা টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছি সীমান্তে ও রাষ্ট্রচিহ্নে, তাদের মেলবার একটা সাঁকো আছে, মাতৃভাষার সাঁকো, বর্ণমালার সাঁকো। 

দুই. নির্জন সাঁকোয় উন্মুখ স্বপ্নজন

বাংলাদেশের কয়েকজন লেখক-কবির বই এখানে মোটামুটি বিক্রি হয়। দু-একজনের বেশ। তাঁদের বই সহজেই চলে আসে। কিন্তু যাঁরা পড়তে চান নতুন লেখক-কবি, অন্যধারার লেখক-কবির লেখা, তাঁদের কি বঞ্চিত থেকে যেতে হবে? তাঁরা কি পাবেন না প্রার্থিত বই? পার্থশঙ্কর বসুর একরকম অভিযোগের সুরেই বলা হলো একদিন। তিনি বললেন, বিক্রির নিশ্চয়তা কী? খুব স্বাভাবিক। যে-বইয়ের খোঁজখবর কেউ করে না, সে-বই কেন আনবেন কোনো বিক্রেতা? কিন্তু আমরা একটু অবুঝ হয়েই পার্থশঙ্করের ওপর চাপ তৈরি করি।

ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে এক ভাষণে শিবনারায়ণ রায় বললেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-পরবর্তী বাংলা গদ্যের শ্রেষ্ঠ লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। মানতে সমস্যা হলো। কিন্তু বলি কী করে। লালসালু ছাড়া কিছুই যে পড়া নেই। পার্থশঙ্করকে চেপে ধরা হলো, ওয়ালীউল্লাহ্ যা পাওয়া যায় নিয়ে আসুন। আমরা কিনে নেব। সে-সময় এরকম একটা বোঝাপাড়ায় আসা যায় যে, আমরা কোনো টাইটেলের অন্তত পাঁচ কপি কিনে নেব। তাহলে এ-ধরনের বই আনার ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে। এরপর এমন অনেক বই আসতে থাকে যা আগে আসত না। স্পষ্ট মনে করতে পারি, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বই আমরা দলবেঁধে কিনেছি। পড়েছি। পড়িয়েছি। তখনো ইলিয়াসভাই এ-বঙ্গে বিখ্যাত হননি। দোজখের ওম বা দুধভাতে উৎপাত বা অন্যঘরে অন্যস্বর বা চিলেকোঠার সেপাই নিয়ে বলতে গিয়ে এ-বঙ্গের মাঝারি খ্যাতিমান লেখকের মন্তব্য শুনেছি, বাংলাদেশ নিয়ে তোমাদের আদেখলাপনা আছে। তর্ক করিনি। ইলিয়াস পুরস্কৃত হবার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্য বয়ান পালটে গিয়েছে।

নয়া উদ্যোগেই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সঙ্গে পরিচয়। ১৯৯৩ সালের ২০ এপ্রিল। অনেক বিষয়ের মতো সাল-তারিখেও গোদা আমি কীভাবে মনে রাখলাম এই তারিখ, যা সাতাশ বছর পরেও মনে করতে পারছি? ইলিয়াসের সেই সময় পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই আমার সংগ্রহে ছিল। সৌজন্যে সেই নয়া উদ্যোগ। দেখা হবে বলে সব বই নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে। প্রতিটি বইয়ে সই করে দেন অনুরোধে। বলেন, ঢাকায় কারো কাছে আমার সব বই আছে কি না সন্দেহ। কোথায় পেলেন? ঢাকায় গেছেন? পার্থ এনে দিলো নিশ্চয়? সইয়ের নিচে তারিখ আছে।

সাঁকো নির্জন করে দিলো ইলিয়াসভাইয়ের চলে যাওয়া। এবং, বিস্ময়করভাবে ঘটে গেল আরেকটি পরিচয়। স্বপ্নদেখা চোখ, মৃদুভাষী, মিতবাক মানুষের সঙ্গ পেলাম। তিনি আবুল হাসনাত। প্রথম আলাপেই পেলাম এক মেধাবী স্বজনকে।

আবুল হাসনাতের সঙ্গে পরিচয়ের সাল-তারিখ মনে নেই। এটুকু স্পষ্ট করে বলতে পারি, ইলিয়াসভাইয়ের শূন্যতা কিছুটা ভরাট হয়েছিল হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে পরিচয়ে।

তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচয় হয় আগে। প্রবন্ধ-নিবন্ধ নয়, একটি ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের গল্প শীর্ষক সংকলনের। সাধারণত ভূমিকায় কেজোকথা, তথ্য-সংবাদ বিবৃত হয়। ব্যতিক্রম আছে। কম। এই গ্রন্থে আবুল হাসনাতের ভূমিকা প্রথম লাইনেই টানটান করে দেয়। ‘বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ন’ মাস ছিল গৌরবের ও সাহসের। হাজার বছরের ইতিহাসে এমন দিন, এমন রাত্রি বাঙালি প্রত্যক্ষ করেনি। দেখেনি এত নির্যাতন, এত হত্যাকাণ্ড। নিজস্ব ভূখণ্ড নির্মাণের জন্য মুক্তযুদ্ধকালীন ন’ মাসে যে মূল্য দিয়েছে বাঙালি ইতিহাসে তার কোনো দৃষ্টান্ত নেই।’ মুক্তিযুদ্ধকে দেখা হচ্ছে হাজার বছরের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। এবং নিজস্ব ভূখণ্ড নির্মাণের তাগিদের শুরু তিনি চিহ্নিত করেন বাহান্নর ভাষা-আন্দোলনে। লেখেন, ‘উনিশ শ’ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বরূপ-চেতনা প্রখর হয়ে উঠেছিল।’ মনে পড়ে শামসুর রাহমানের কয়েকটা পঙক্তি : ‘দেখলাম সালামের হাত থেকে নক্ষত্রের মতো/ ঝরে অবিরত অবিনাশী বর্ণমালা/ আর বরকত বলে গাঢ় উচ্চারণে/ এখনো বীরের রক্তে দুঃখিনী মাতার অশ্রজলে/ ফোটে ফুল বাস্তবের বিশাল চত্বরে/ হৃদয়ের হরিৎ উপত্যকায়।’ (ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯)

আবুল হাসনাত পাকিস্তানকে বলতে পারেন ‘কৃত্রিম, আবেগসর্বস্ব রাষ্ট্র’। পাকিস্তান সম্পর্কে এ-ধরনের বিশেষণের ব্যবহার এই বাংলার কমিউনিস্ট তাত্ত্বিকদের লেখায় কখনো পড়েছি কি? উদ্ভট উৎকট দ্বিজাতিতত্ত্বের জিগিরে ছিন্নভিন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারেননি আমাদের নেতারা। সৎ ও সাহসী উচ্চারণে ব্যর্থ হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৯৭ সালে। হতে পারে এর দেড় কি দু-বছর পর কিংবা আরো বেশি, আবুল হাসনাতকে চাক্ষুষ দেখি। তিনি আমার অগ্রজ, কয়েক বছরের, জানা গিয়েছে পরে, কিন্তু ডাকতেন ‘মধুময়দা’, আর আমি ‘হাসনাতভাই’। আলাপের প্রথম দিন আমরা সংকলনটি নিয়ে কথা বলি। আমার বকবকানি, আর স্বল্পকথায় তাঁর সুনির্দিষ্ট কিছু বলা। হাজার হাজার গল্প থেকে বেছে একটি সংকলন প্রস্তুত করার শ্রম স্পষ্ট বোঝা যায় বইটি হাতে নিলেই। তাঁর বিনম্র দাবির সঙ্গে সহমত হতে হয়; এ-বই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ সংকলন বলা যায়। এই কারণেও পূর্ণাঙ্গ বলতে হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের সবটাই ভালো ছিল – এমন মিথের দ্বারা তিনি চালিত হননি। জাল যোদ্ধাদের অপকর্ম নিয়ে লেখা গল্পও গ্রন্থিত করেছেন সৎ সম্পাদকের সাহসে।

নয়া উদ্যোগে দেখা হয় দুপুরে। তখনো খাওয়া হয়নি তাঁর। খেতে যাওয়া হলো। বিবেকানন্দ রোড পেরিয়ে হেদুয়ার কাছাকাছি কোনো হোটেলে। যাবার পথে বললেন, এই জায়গার ঠিকানা আমি জানি না, কিন্তু এলাকাটা চেনা চেনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় এইখানে কোনো আশ্রয়ে ছিলাম কিছুদিন। অন্য জায়গায়ও থাকতে হয়েছে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকার সমস্যা ছিল। অন্য জায়গাগুলোও ভালো।  কিন্তু এই জায়গাটা যেন বেশি ভালো। বেশ ফাঁকা। আলো-হাওয়ার চলাচল বেশি। একাত্তরে তো আরো মনোরম ছিল। এখন ভিড় দেখি। মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে বলতে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কলকাতার স্মৃতিতে ফিরে যান তিনি।

এরপর হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে ঘন ঘন কথা হয় কালি ও কলম নামে সাহিত্য শিল্প সংস্কৃতির একটি মাসিক পত্রিকা করা নিয়ে। মনে আছে, কয়েকটি বৈঠক হয়। বৈঠকে কয়েকজন বন্ধু ছিলেন। গল্প-উপন্যাস-কবিতা তো থাকবেই। এছাড়াও থাকবে শিল্পসংস্কৃতির নানাদিক নিয়ে আলোচনা। গতানুগতিকের বাইরে। নতুনদের লেখা চাই বেশি করে। ভালো লিখছেন এমন তরুণদের বেশি বেশি অংশগ্রহণ তাঁর আকাঙ্ক্ষা। বোঝা গিয়েছিল, হাসনাত স্বপ্ন দেখেন, দেখতে জানেন। বই নিয়ে আলোচনা চাই। বাঁধা ছকের বাইরে। এই কাজ হতে পারে মিশন। পাঠক তৈরির ব্রত। আলোচনা যেন বইকে যথাযথ মর্যাদা দেয়। গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমন বই নিয়ে কথা না বলাই ভালো। আরো অনেক কথা। সব কি আর মনে থাকে? একটা কথা বিশেষ করে মনে আছে। সেটা হলো, এখানে  ইতোমধ্যে প্রকাশিত লেখা আমাদের প্রস্তাবিত কাগজে ছাপাবার জন্য পাঠাবেন না অনুগ্রহ করে। সেরকম অভিজ্ঞতা ছিল নিশ্চয়। না হলে বলবেন কেন? এই বাংলায় কালি ও কলমের প্রকাশ-অনুষ্ঠান হয়েছিল ঘটা করেই। যদি ভুল না বলি। আমার আমন্ত্রণ ছিল না। কাজ করে গিয়েছি। লেখা সংগ্রহ করা, পাঠানো। পত্রিকাটির কথা তরুণদের বলা। বলবার মতোই হয়েছিল। সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও প্রকৃত পাঠকের আদর পেয়েছিল। বড়ো একটা সময় পাঠকের আদর ধরে রাখতে পেরেছিল। তারপর কী হলো জানি না। হাসনাতভাই হয়তো কিছু সমস্যায় পড়েছিলেন। ঠিক জানা নেই। অনুমান। তাঁর সেই স্বপ্নদেখা চোখ ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না ভালো লেখার জন্য কাতরতা। সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেও গড়তে চেয়েছেন স্বপ্নপ্রাঙ্গণ।

তিন. একটি সাঁকোর নাম ‘জীবনানন্দ’

জীবনানন্দ দাশের লেখা নিয়ে আমার শৌখিন ঘটকালির দু-পাতার ইতিহাস আছে। সেখান থেকে দুটো ঘটনা বলা যেতে পারে।

১. সাল মনে থাকে না। জীবনানন্দ দাশের লেখার স্বত্ব-কাল তখনো শেষ হয়ে যায়নি। ঢাকা থেকে ‘অবসর’ প্রকাশনীর আলমগীর রহমান এসেছেন। তিনি স্বত্বাধিকারীর সম্মতি নিয়ে জীবনানন্দের বই প্রকাশ করতে চান। ইতিমধ্যে যা প্রকাশ করেছেন, তার জন্য প্রাপ্য স্বত্বমূল্য দেবেন। এবং চুক্তিপত্রে সই করাবেন। আলমগীরের হাতে যদি আইনসম্মত অধিকার থাকে, ঢাকা থেকে জীবনানন্দের বইয়ের যেমন খুশি প্রকাশ বন্ধ হতে পারে। চুক্তিপত্র কোথায় সই হবে? কে কে থাকবেন? তখন কলকাতা পুস্তকমেলা চলছে ময়দানে। মেলার মাঠেই সই হবে ঠিক হলো। একে একে সবাই এলেন। আসতে আসতে রাত হয়ে গেল। বেশিরভাগ চেনাজানা স্টল বন্ধ হয়ে গেল। টেবিল-চেয়ারে বসে সইসাবুদের কাজ করা যেতে পারে এমন জায়গা নেই। ময়দানের মেটাল রোড দিয়ে মেলায় ঢোকার পথের ডানদিকে একটা পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। সে-সময় বরাবরই থাকত। ঠিক হলো, পুলিশ ফাঁড়িতে বসেই বাংলাদেশে জীবনানন্দ দাশের গ্রন্থ প্রকাশের চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হবে। চুক্তি হলো প্রকাশক আলমগীর রহমান ও স্বত্বাধিকারী অমিতানন্দ দাশের মধ্যে। সাক্ষী হিসেবে সই থাকল ভূমেন্দ্র গুহ, পার্থশঙ্কর বসু ও এই অধমের। পুলিশ ফাঁড়িতে জীবনানন্দ সইয়ের ঘটনা কোনোভাবে জানতে পারেন হাসনাতভাই। বলেছিলেন, আর জায়গা পেলেন না। ঘাসের ওপর বসে সই করা গেলে মানানসই হতো। প্রিয় ঘাস কবিকে পেত আরেকবার তারাভরা আকাশের নিচে।

২. ভূমেন্দ্র গুহ সম্পর্কে এখানে নতুন করে কিছু বলছি না। জীবনানন্দ-বিশেষজ্ঞ বললে কিছু বোঝা যায় না। নিজেকে ভূমেন্দ্র গুহ বলতেন, জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপির লিপিকার। আমার মতে, তাঁর হাত ধরে জীবনানন্দ পড়তে হয়, বুঝতেও হয়। কেউ অন্যরকম ভাবতেই পারেন। তাঁর মতকে অশ্রদ্ধা করি না। আমরা জানি, জীবনানন্দের পুনরুজ্জীবন ঘটিয়েছিলেন তিনি। এবং মানতেই হয়, তাঁর আগে কিছুটা দেবেশ রায়। এই ভূমেন্দ্র গুহকে বাংলাদেশে নিয়ে যান আবুল হাসনাত। নিছক বেড়াতে যাওয়া নয়, শুধু সংবর্ধনা ও ভাষণ-কথোপকথন নয়, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের ব্যানারে বড়ো একটা কাজ করিয়েছেন তিনি ভূমেন্দ্র গুহকে দিয়ে। এক্ষেত্রে আমার একটা কয়েক মিনিটের ‘পার্ট’ বা দুটো অ্যাপিয়ারেন্স ছিল। আবুল হাসনাতের কাছ থেকে প্রস্তাব এলো, তাঁরা ভূমেন্দ্র গুহের সম্পাদনায় বাংলাদেশে সমগ্র জীবনানন্দ প্রকাশ করতে চান। যদি ভূমেনবাবুকে রাজি করানো যায়, খুব ভালো হয়। প্রস্তাব নিয়ে গেলাম ভূমেনদার কাছে। এককথায় খারিজ করে দিলেন। কী বলেছিলেন, তা আর বলছি না। ভূমেনদাকে বলি, ঠিক আছে। আপনি কাজটা না করলে কেউ জোরাজুরি করবে না। শুধু মনে রাখবেন, নির্ভুল জীবনানন্দ প্রকাশ হওয়া দরকার। আপনি নিজেই বলেন সে-কথা। অদ্যাবধি প্রকাশিত বইগুলোয় বিস্তর ভুল আছে। নির্ভুল কাজটা আপনার পক্ষেই করা সম্ভব। এরপরও যদি না করেন, করবেন না। হাসনাতভাই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আপনি একদিন কথা বলুন। তিনি রাজি হলেন। দিন ঠিক হলো দেখা করার। নয়া উদ্যোগে বসে হাসনাতভাইকে সব বললাম। তিনি চেয়েছিলেন আমাকে নিয়ে যেতে। যেতে পারিনি। আমার ‘পার্ট’ এখানেই শেষ। নিজেরই মুদ্রাদোষে সরে যাই বারবার। শুনি, ভূমেন্দ্র গুহ সম্মত হয়েছেন। বাংলাদেশ থেকে নির্ভুল জীবনানন্দ বেরোবে। কলকাতার ন্যাশনাল লাইব্রেরির সংগ্রহে থাকা জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপির ফটোকপি নেওয়া হয়। খরচ হয় চল্লিশ হাজার টাকা। দীর্ঘদিন ধরে ভূমেনদা কাজ করেন। বিপুল অঙ্কের অর্থের সমর্থন নিয়ে কাজের পাশে দাঁড়ায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশন। বই হয়। এই সবটাই হতে পেরেছে আবুল হাসনাতের একাগ্র আগ্রহে, তাঁর নিষ্ঠায় ও দক্ষতায়। এই সময়ের ঘটনা আমার সম্পূর্ণ অজানা। কেউ আমাকে কিছু বলেননি। নির্ভুল জীবনানন্দের নেপথ্য রূপকার হিসেবে হাসনাতভাই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সব কাজ সমান সমাদর পায় না। হয়তো তৎক্ষণাৎ পায় না। গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন আবুল হাসনাত। আগামী দিনে অনেকেই বুঝবেন।

চার. নির্জনতা নেমেছে আগেই, সাঁকো আছে

এবার আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলি, হাসনাতভাই।

মন্দিরা ভট্টাচার্যের বই ওই দেখা যায় বাড়ি আমার বেরোল ২০১৭ সালের মাঝামাঝি। মাসখানেকের মধ্যে আপনার ফোন এলো ঢাকা থেকে। জানালেন, গতকাল বইটি হাতে পেয়েই আপনি পড়া শুরু করেন। টানা পড়ে শেষ করতে অনেক রাত হয়ে যায়। পড়া বন্ধ করা যাচ্ছিল না। কারণ, আপনি বলেন, আমাদের বেড়ে ওঠার সময়টা এই বইয়ে ধরা আছে। ধরা আছে ঢাকার সেই সময়ের উজ্জ্বল অনেক ছবি। ধরা আছে বহু মেধাবী দরদি সাংস্কৃতিক মানুষের কথা। ধরা আছে আমাদের হারিয়ে-যাওয়া সময়ের বৃত্তান্ত। নন্দী পরিবারের (মন্মথনাথ নন্দী) এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া দুর্ভাগ্যজনক। হাসনাতভাই, আপনি বললেন, এই বইয়ের ভালো আলোচনা দরকার। ‘কালি ও কলমের ঢাকার সংস্করণে আমি আলোচনা করব। কলকাতার সংস্করণের জন্য কাউকে বলুন।’ আমি বলেছিলাম, ‘বিভাস চক্রবর্তী লিখতে পারেন।’ বিভাসদা লিখলেন। আপনি লিখলেন। মন্দিরাদির বই যথাযথ মর্যাদা পেল। আপনার স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহে। আপনার জানবার কথা নয়, ওই বইয়ের জন্য আমাকে কৈফিয়ত দিতে হয়েছিল। মালিক-প্রকাশক প্রশ্ন করেছিলেন, এ-বই কেন হলো? অর্থাৎ আর্থিক বা বৈষয়িক স্বার্থ না থাকলে কেন এ-বই ছাপা হবে? জবাবে বলেছিলাম, পার্টিশন লিটারেচার। পড়ুন, অখণ্ড বাঙালির জীবনের ছবি পাবেন। পার্টিশন লিটারেচারের নামে প্রচুর গালগপ্পো ছাপা হচ্ছে। একটা সত্যিকারের বই হলো। মালিক-প্রকাশককে দুটো রিভিউ দেখিয়েছি। তাতে তাঁর মনোভাবের খুব একটা বদল যে হয়েছে তেমন নয়। আমি তৃপ্তি পেয়েছি।

হাসনাতভাই, বাংলা কিশোর সাহিত্য নিয়ে কাজ করতে চেয়েছি। আপনি সম্মতি দিয়েছেন। একটি বই হয়েছে। ভারী সুন্দর প্রকাশনা। দু-কপি বই হাতে পেলাম।   কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বন্ধ হয়ে গেল। কেন জানি না।

আর কথা হয়নি আপনার সঙ্গে। খবর পেয়েছি, আপনি কলকাতা এসেছেন। কলেজ স্ট্রিটে আছেন। নয়া উদ্যোগে আছেন। আপনি কথা বলেননি। আমিও বলিনি। মনে হয়েছে, আপনি চান না। আমিও বিরক্ত করতে চাইনি। কোনো ভুল হয়তো করেছি। বছর-দেড়েক আগে হঠাৎ নীরবতা নেমে এলো।

শান্তিনিকেতনে ঘুরছি। আপনার ফোন এলো, হাসনাতভাই। বললেন, ‘বিশেষ সংখ্যার জন্য একটা গল্প দিন।’ আর বলেন না। বলবেন না।

ঢাকা থেকে ফোন এলো, ‘হাসনাত বলছি। ভালো বই আর কোনো পত্রিকার সংখ্যা বেরোলে পার্থকে জানাবেন। পার্থ আমাকে পাঠিয়ে দেবে।’ আর বলেন না। বলবেন না। হাসনাতভাই, আপনার মতো পাঠক আমাদের সময়ে বেশি নেই।

‘হাসনাত বলছি। পূর্ববাংলা থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় শরণার্থী ভারতে গিয়েছিল কোন সালে? যদি জানান। একটা লেখার জন্য লাগবে।’ আর বলবেন না কোনোদিন।

কলেজ স্ট্রিট থেকে সল্ট লেকে বইমেলায় যাবার পথে বাংলাদেশের সমকালীন গদ্যসাহিত্য নিয়ে জানতে চাইলাম। আপনি ধীরে ধীরে বলেছিলেন। অল্পকথায়। নির্দিষ্টভাবে।

আর বলবেন না। শোনা হবে না। আমাদের সাঁকোটা কিন্তু থাকবে, হাসনাতভাই! কারণ, সেটা কৃত্রিম ও আবেগসর্বস্ব নয়। বর্ণমালা দিয়ে নির্মিত।