কথাটা আপনাকে বলতে বড়ো দেরি হয়ে গেল।
সেদিন থেকেই আমার অস্বস্তি কাটেনি। সকালবেলায় আপনি আমাদের বাড়িতে এলেন। সুন্দর গল্প-কথাবার্তা হলো। আমার স্ত্রী ঢাকার মানুষ। ঢাকার মানুষজন পেলে তিনি কত খুশি হন। এক সময়ে হায়াৎ আমাদের বাড়িতে আসতেন। একে তো যাদবপুরের ছাত্র। তাছাড়া আমাদের সুবীরের বন্ধু ও তার সঙ্গে গবেষণা করা লোক। আমাদের বেশ আড্ডা ছিল একসময়ে। ওই ঢাকার সুবাদেই আমার স্ত্রীর সঙ্গে দেশের গল্প হতো তার। ভদ্রমহিলার মনে একটা ধারণা ছিল, যে-দেশ তিনি ছেড়ে এসেছিলেন ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বরে সে-দেশ বুঝি সেখানেই সেরকম আছে। তাঁর চেনা রাস্তাঘাট, পুকুর ও বটগাছের কথাও তিনি খোঁজ করেন ঢাকার কাউকে পেলে। হায়াৎ তাঁকে বলেছিল, ‘চলুন, একবার চলুন, ঘুরে আসবেন। দেখে আসবেন কত বদলে গেছে’।
আপনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আসুন, আমাদের ওখানে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। আর দিদির এত যাবার ইচ্ছে, চলে আসুন।’
আমি এতই আহাম্মক। আমাদের পাসপোর্ট নেই, এই অজুহাত তুলেছিলাম। এই অজুহাতে আপনার কাছে কোনো কাজ হবে কেন। আপনি বলেছিলেন, ‘সে ভাবতে হবে না। ও ওরা ঠিক করে দেবে।’ আমি মুখ নিচু করে বলেছিলাম, ‘সে তো দেবে জানিই।’ তখন আর আমার কিছু বলার ছিল না। মনে আছে প্রায় নিজের মনে মনে বলার মতো বারবার বলছিলাম, আমাকে বাদ দিন। আমার হবে না। তখনই আমি বুঝতে পারছিলাম সৌজন্যের সীমা ঠিকমতো রক্ষা করা যাচ্ছে না। কিন্তু তাও আপনার অনুরোধে আমি রাজি হতে পারিনি।
আপনার হয়তো খারাপ লেগেছিল। অন্তত খারাপ লাগার যথেষ্ট কারণ ছিল। এমনকি পরের দিন আমি নয়া উদ্যোগের পার্থবাবুকে বলেও ছিলাম আমার হয়ে আপনার কাছে মার্জনা চেয়ে নিতে, এবং আমার তরফে আপনাকে বলতে যে, আমার যাওয়া হবে না। পার্থবাবুকেও আমি হয়তো সব কথা বুঝিয়ে বলতে পারিনি।
ওঁর সঙ্গে যখনই দেখা হয় আপনার কথা হয়। চিন্ময় গুহের সঙ্গে আপনার কথা সেদিনও হলো। আপনার চলে যাবার খবর আমি একটু আগেই পেয়েছি। তার ঠিক পরেই চিন্ময়ের ফোন। ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি খবর পেয়েছেন?’ আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, পেয়েছি।’ আমার না যেতে পারার কথা চিন্ময়ও তুললেন। আমি আবারো একবার লজ্জা পেলাম। আমি কাউকেই ঠিক বোঝাতে পারি না। চিন্ময় বললেন, ‘সেবার আপনি গেলেন না, গেলে আবুল হাসনাতের সঙ্গে আরো বেশি আলাপ হতো। দেখতেন খুব আলাদা ধরনের মানুষ।’ আমি আবারো বললাম, ‘সে তো জানি, কিন্তু আমার হলো না।’
আসলে আমার কথাটা ঠিক কাউকে বুঝিয়ে বলার নয়। আমার পারিবারিক যা কাঠামো তাতে যাতায়াতের কিছু অসুবিধা আছে। তবে সেটা তেমন বড়ো কথা নয়। দুজনে একসঙ্গে গেলেই সে-সমস্যা মিটে যায়।
কিন্তু আর-একটু আছে। আমাদের দুজনেরই দেশ বলতে যা বোঝায় তা এখন বাংলাদেশের অন্তর্গত। বললাম তো, আমার স্ত্রীর দেশের বাড়ি ছিল ঢাকায়। আমার যশোরে। খুবই কাছে। শিয়ালদা থেকে বরিশাল এক্সপ্রেসে চড়লে যশোর পৌঁছোতে আর কতটুকু সময় লাগে। একদিন তাই ছিল আমাদের যাতায়াতের পথ। অবশ্য যশোরে নেমে পাঁজিয়াতে আমার গ্রামের বাড়িতে যেতে ঠেলা ছিল। বিশেষত বর্ষাকালে। কেশবপুর পর্যন্ত তবু বাস চলত। কিন্তু বর্ষায় তার পরে আরো প্রায় মাইলপাঁচেক এঁটেল মাটির কাদায় হেঁটে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। তাই বর্ষায় ছোটদের যাওয়া-আসা ছিল না। কিন্তু এসব তো গেল বাইরের কথা। আর এসব যে-সময়ের কথা তার সঙ্গে আজকের অনেক তফাত। তাই এসব কেবল অবান্তর কথা।
আমার ছিল এক ভিতরের বাধা। সেই যে চলে এসেছিলাম, আর তো আমি যাইনি। আমি কোনোদিন বাংলাদেশে যাইনি। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমরা কলকাতায় আবেগতাড়িত হয়েছি। পাকিস্তানের বীভৎস আক্রমণে ধিক্কার জানিয়েছি। চীনের পাকিস্তান নীতির বিরুদ্ধে তর্ক করেছি আমাদের চীনপন্থী বন্ধুদের সঙ্গে। ১৯৬২-তে আমরা চীনকে যে-চোখে দেখেছি ১৯৭১-এ আর সে-চোখে দেখতে পারিনি। মনে আছে তখন বসন্তকাল। হাওয়া অন্যরকম। চারদিকে গান বাজছে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সে একেবারে এক অন্য জাতের ব্যাপার। সন্ধ্যাবেলায় বেতারে শামসুর রাহমানের কবিতা। তাও আমার ভিতরের অন্যায়বোধ কাটে না। সে নেহাতই আমার নিজস্ব মুদ্রাদোষ। আমি যে একদিন হ্যাঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে চলে এসেছিলাম সে-কথা ভুলতে পারি না। হয়তো সে-আসায় আমার কোনো হাত ছিল না। তবুও। আমার সে-বয়সে কিছুই ছিল না আমার হাতে। থাকার কথাও নয়। কিন্তু যে-পরম্পরায় আমার অস্তিত্ব তার দায়ভাগ আমাকে বইতেই হবে।
এত কথা নিশ্চয় এই ভাবে একদিনে মনে আসেনি। আর তখন তো কিছু আসেইনি। কিন্তু পরে আস্তে আস্তে নিজেরই কাছে নিজের ছোট হয়ে যাবার এক রকমের গ্লানি আমাকে ধীরে ধীরে এমন গ্রাস করে যে, আমি আর মুখ তুলে ঠিক তাকাতে পারি না। চোখে চোখ রেখে কথা বলায় আমার অস্বস্তি কাটে না। আমি এসব কথা সেদিন বলতে পারিনি আপনাকে। বলা যায়ও না। সমস্তটাই একেবারে আমার ব্যক্তি-সমস্যা। হয়তো তাই।
বন্ধুরা, আত্মীয়েরা আমল দেন না। দেখেছি কথা বলে। আমার নিজের চিকিৎসা আমাকেই করতে হবে। তা বুঝেছি। নিজেকে নস্টালজিয়ায় পীড়িত হতে দিইনি কখনো। দেশের স্মৃতিকে আমি আঁকড়ে থাকিনি। তবে ভুলেও কিছু যাইনি এখনো। কথাটা আপনাকে বলতে পারলাম না। আমার নম্র বিদায় গ্রহণ করুন।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.