সম্পাদকের ব্যাপ্তি ও উচ্চতা

হঠাৎ তাঁর ফোন পেতাম। বুঝতাম লেখা চাইবেন। ঠিকই বিশেষ কোনো উপলক্ষে লেখার অনুরোধ জানাতেন এবং তারপর মাঝে মাঝে তাগাদা দিতেন। প্রথমে দৈনিক সংবাদের সাহিত্য পাতার জন্যে, তারপর গত সতেরো বছর ধরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত মাসিক সাহিত্যপত্র কালি ও কলমের জন্যে। যতদূর মনে পড়ে একসময় মাসিক গণসাহিত্যের জন্যেও চেয়েছেন লেখা।

হাসনাতভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় অনেক দিনের – সেই ১৯৬৭ সাল থেকে। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন, আমি চট্টগ্রাম জেলা কমিটিতে। তবে পরিচয়ই, তেমন আলাপ ঘনিষ্ঠতা হয়নি। তবে তাঁর সঙ্গে সম্পাদক-লেখক সম্পর্কের বাইরেও বাংলাদেশের উত্থান-পতনময় রাজনৈতিক আবহে সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সহকর্মী হিসেবে আরো কিছু কাজে ও সংগঠনে যুক্ত থেকেছি, যেমন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ। দেখা হলে কিছু কিছু বিষয়ে মতবিনিময় করেছি, কখনো তাঁর কালি ও কলম দফতরে নানা বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তবু এই দীর্ঘ অর্ধশত বছরের আলাপ, লেখালেখি কখনো আড্ডায় রূপ নেয়নি। কোনো আলোচনাই বহুমাত্রিক হয়নি, মূল কারণ তিনি যেন দীর্ঘক্ষণ আলাপে সচ্ছন্দ নন। অথবা হয়তো আমার সঙ্গে নন, এটাই ভাবতাম। তবে বরাবর তিনি সদালাপী, বিনয়ী, সজ্জন মানুষ। মনে হয়েছে স্বভাবতই তিনি নিভৃতচারী, অনেক জন ও অনেক কাজের মধ্যেও নিজের আড়াল বা নিভৃতি বাঁচিয়ে চলেছেন – ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে প্রদীপের আলো আড়াল করে বাঁচিয়ে রাখার মতো।

সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই মূল পরিচিতি তাঁর, সে- ভূমিকায় কেবল পরিচিত নন, প্রতিষ্ঠিতও। কিন্তু মূলে তিনি কবি, যে-সত্তার স্বকীয় টান নির্জনতার প্রতি, যে-সত্তা একাকিত্বের মগ্নতায়ই সচ্ছন্দ। অথচ তিনি পেশায় সম্পাদক যাঁকে দশজন কবি-লেখকের কাছে নিজের দাবি আদায় এবং এরকম অজস্র সংবেদনশীল মানুষের দাবি পূরণ করতে হয়। এ-চরিত্রে হৃদয়ের টান লাগে, তা বিশেষভাবে লাগে টানা লেগে থেকে মৌলিক মানসম্পন্ন চমকপ্রদ সৃষ্টি খুঁজে নেওয়ার জন্যে – তা তাঁর ছিল। কিন্তু তার সঙ্গে প্রয়োজন বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতা এবং নিরপেক্ষ কঠোরতায় তা প্রয়োগের সামর্থ্য। আমার মনে হয়েছে এক্ষেত্রে নির্বিবাদী প্রকৃতির মানুষটির একটা নিজস্ব কার্যকর কৌশল ছিল। তাঁর পছন্দের লেখক-কবিদের একটা তালিকা তাঁর ছিল। প্রধানত এই বৃত্তেই থাকতে চাইতেন তিনি। এঁদের কাছেই তিনি বিশেষভাবে লেখা চাইতেন, বারবার তাগাদা দিয়ে আদায় করেও ছাড়তেন। আবার নিজের পর্যবেক্ষণ থেকেও নতুন কবি-লেখকদের কাছে টেনেছেন, পত্রিকার পাতায় জায়গা দিয়েছেন। সব কাজই এক ধরনের নীরব কুশলতায় তিনি সম্পন্ন করতেন। তাতেও যে কখনো কখনো তালভঙ্গ হয়নি তা নয়, বেয়াড়া গোছের তরুণ কবির আত্মম্ভরিতা তাঁকেও সামলাতে হয়েছে, তার কিছু কিছু বেদনা ক্বচিৎ মুখ ফুটে বলেছেনও। হয়তোবা কালি ও কলম দফতরের করপোরেট চরিত্র তাঁর কাঙ্ক্ষিত নিভৃতি ও আড়াল তৈরিতে সহায়ক হয়েছিল। সাহিত্যপত্রিকা ও সম্পাদককে ঘিরে যেসব প্রাণবন্ত আড্ডার বহুবিচিত্র ঘটনা সাহিত্যিকদের লেখায় আমরা পড়ি, তেমন পরিবেশ তৈরিতে হাসনাতভাইয়ের ব্যক্তিপ্রবণতার ঝোঁক ছিল না। সমকাল, পরিচয় বা কবিতার মতো পত্রিকার দফতরে ও সম্পাদকদের ঘিরে সাহিত্যপাঠ ও আড্ডার যেসব জমজমাট নৈমিত্তিক আসরের খবর মেলে তা তাঁর ক্ষেত্রে ঘটেনি।

এই মানুষটিই কিন্তু রাজনৈতিক কর্মীও ছিলেন। অল্প বয়সেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের টালমাটাল সময়ে তিনি কলকাতায় সিপিবির দফতর সামলেছেন। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ের সিপিবি আজকের সিপিবি নয়। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির তখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, কারণ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়ক শক্তি ভারতের পেছনের খুঁটি তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন – জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে শক্ত ভূমিকার জন্যে যে দেশ – যা আজ বিলুপ্ত – এবং সে-সময়ের নেতৃত্বের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। আর চূড়ান্ত যুদ্ধে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের হস্তক্ষেপ ও দখলদার পাকিস্তানের পক্ষে গণচীনের সম্ভাব্য সামরিক তৎপরতা ঠেকাতে সোভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তির ভূমিকা খাটো করে দেখা যাবে না। তাদের ক্ষমতাসীন দলে বাংলাদেশি ছোট তরফ হিসেবে সিপিবি (তখনো অবশ্য এ-নামকরণ হয়নি) প্রবাসী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ছিল ও ভূমিকা পালন করেছে। সেই দলের একেবারে দফতরের দায়িত্বে থাকেন যে ব্যক্তি তাঁর যোগ্যতা এবং গুরুত্বও মানতে হবে। এ তো কোনো নরম প্রকৃতির নির্বিবাদী বিনয়ীর কাজ নয়। তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি অনালোচিত প্রায় অচেনা শক্ত কাঠামোর আভাস এখানে মেলে। তাছাড়া রাজনৈতিক ভাঙাগড়ায় অনেকের সঙ্গে তিনিও দল ছেড়েছেন বটে কিন্তু তাঁর মূল বৃহত্তর ক্ষেত্র সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় বরাবর একই আদর্শিক ধারায় পথ চলেছেন। হ্যাঁ প্রত্যক্ষ সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এলেও তিনি থেমে যাননি, পথ চলা বন্ধ হয়নি, পথান্তরে হাঁটেননি। রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে-পথ মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ চেতনাকে ধারণ করে সেই পথেই তিনি চলমান থেকেছেন। বাহ্য প্রকাশ তেমন না থাকলেও নানা ঘটনার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় তাঁর চিত্তচাঞ্চল্যের আলামত ঠিকই বোঝা যেত। তাঁর হৃদয় ছিল সংবেদনশীল, মনন ছিল সতেজ এবং নিজের অবস্থান ও করণীয় নিয়ে তিনি যেন নিঃসংশয়।

আবুল হাসনাতের মতো এত সুদীর্ঘ সময় ধরে সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব আর কেউ পালন করেছেন বলে জানা নেই – সওগাত সম্পাদক নাসির উদ্দীনের দীর্ঘজীবন ও তাঁর সাময়িকী সওগাতের কালিক দৈর্ঘ্য সত্ত্বেও এ-কথা বলা যায় মনে করছি, কারণ বর্ষীয়ান এই সম্পাদক মুসলিমসমাজে সাহিত্য সাধনাকে এগিয়ে নিতে অগ্রদূতের কাজ করলেও তাঁর ভূমিকা সম্পাদনার চেয়ে সাহিত্যের পথ-রচনা ও বিরূপ পরিবেশে নতুন এ-পরিসরটি টিকিয়ে রেখে এগিয়ে নেওয়াতেই ব্যয়িত হয়েছে প্রধানত। তিনি অগ্রদূতের মর্যাদা পাবেন, অভিভাবকের মূল্য পাবেন, কিন্তু ঠিক সম্পাদনার কাজ প্রত্যক্ষত তাঁকে তেমন করতে হয়নি। সেদিক থেকে বাংলাদেশে হাসনাতভাই আছেন এক ব্যতিক্রমী উচ্চতায়। হয়তো দুই শতাব্দীর বাংলা সাহিত্য সাময়িকীর ইতিহাসেও তাঁর সম্পাদনা জীবনের কালিক পরিসর অতিক্রমের মতো মানুষ কাউকে পাওয়া যাবে না।

বাংলাভাষার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকপত্র তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা। বাংলাভাষায় বিজ্ঞানসাহিত্য রচনার পথিকৃৎ অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-৬৬) এটি ১২ বছর সম্পাদনা করেছেন। জলধর সেন (১৮৬১-১৯৩৯) একজন বিখ্যাত সম্পাদক। অনেক সাময়িকপত্র সম্পাদনা করেছেন, দীর্ঘদিন, ২৬ বছর, সম্পাদনা করেছেন ভারতবর্ষ। আমরা জানি রবীন্দ্রনাথও সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন তবে টানা দীর্ঘদিন এ-কাজ করেননি। মুসলিম সাহিত্যসাধকদের মধ্যে মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮) প্রথম সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছিলেন – তাঁর সম্পাদিত মোহাম্মদীর প্রকাশকাল ১৯১০। তবে দৈনিক আজাদ প্রকাশ, রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ায় নেহায়েত সম্পাদনার কাজে বেশিদিন ব্যাপৃত থাকেননি তিনি। বিখ্যাত সবুজপত্র  সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী (১৮৬৮-১৯৪৬), পরিচয় পত্রিকার প্রথম সম্পাদক কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-৬০), কবিতা সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-৭৪), সমকাল সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর (১৮১৮-১৯৭৫) প্রমুখ বিখ্যাত সব সম্পাদককেও কালিক পরিসরে হাসনাতভাই ছাড়িয়ে যাবেন। তাঁর এ-পরিচয় দেশের বাইরে কলকাতা এবং বিশ্বের নানা স্থানের বাংলাভাষী সাহিত্য পাঠকমাত্রের অবিদিত নয়। সম্পাদনা তাঁর জীবনের এক মাইলফলক।

আমার মনে হয় কালি ও কলমে এদেশের একালের শ্রেষ্ঠ এক মননশীল ব্যক্তি প্রয়াত আনিসুজ্জামানকে মাথার ওপর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি হিসেবে পেয়ে তিনি সাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে কাজ করে যেতে পেরেছেন। এমন দক্ষ সক্রিয় এবং সংবেদনশীল মহীরুহের সুরক্ষায় তাঁর কাজের গতি এবং নিজের সৃজনশীলতাও বেড়েছিল। তিনি আড়ালে থাকতে ভালোবাসেন, নির্বিবাদে নিজের মতো কাজের পরিবেশেই তাঁর ভালোটা দিতে পারেন। তাছাড়া সাময়িকপত্রের বিড়ম্বনার ক্ষেত্র অর্থসংস্থান ও দাফতরিক ব্যয় নিয়ে সম্পাদককে একটুও ভাবতে হয়নি, সে-দায় কাঁধে নিয়েছিলেন প্রকাশক, নানা সাংস্কৃতিক কাজের উৎসাহী উদ্যোক্তা আবুল খায়ের। তাতে বিতর্ক, দ্বন্দ্ব যা তাঁর ধাতের বিষয় নয় সেসব এড়িয়ে চলতে পেরেছেন। এ-পর্বে লেখকদের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছেন, নতুন নতুন কবি-লেখকের সঙ্গেও পত্রিকার সংযোগ ঘটিয়েছেন, কলকাতায় বাংলাদেশের একটি পত্রিকার স্থান তৈরি করাও এ-পর্বে তাঁর একটি কীর্তি। পৃষ্ঠপোষকতা ছিল অবশ্যই, তার ওপর পত্রিকার সর্বোচ্চ পদের অধিকারী আনিস স্যার কেবল আলংকারিক শোভা ছিলেন না, সম্পাদনার কাজেও সক্রিয় অংশ নিতেন। ফলে তাঁর সহায়তা-ঔদার্যের নিশ্চিতিও হাসনাতভাইয়ের কাজ সহজ করে দিয়েছিল, তবে কাজটা শেষ পর্যন্ত হয়ে-ওঠা, কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গে সাহিত্যের নানা মহলে এর চাহিদা তৈরির কৃতিত্ব বোধহয় বিশেষভাবে তাঁরই প্রাপ্য।

সম্পাদকের বহু ব্যস্ত মুখ্য ভূমিকার নেপথ্যে যে-কবি, যে-লেখক সেই  সত্তার সৃষ্টিশীলতা থামেনি, তবে বড় পরিচয়ের আড়ালে প্রায় অপরিচিতই থেকে গেল তা। তাঁর মৃদু স্বভাবের মতোই সামান্য আঁচড় কেটে নিজের ভাবপ্রকাশ হয়তো সমকালের পরিচিত বৃত্ত পেরোয়নি, কিন্তু মনোযোগী পাঠে কবিতার অনেক পঙক্তি দাগ কাটে, গভীর বার্তাও দেয়। কিশোর সাহিত্যেও তাঁর গদ্য আরেকটু গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে। সেদিকে তাঁর জীবনকালে নজর দেওয়া হয়নি। আদতে সাহিত্য-সমালোচকরা তাঁর প্রতি ঔদাসীন্যই দেখিয়ে গেছেন, যা ন্যায্য কাজ হয়নি।

হাসনাতভাই চিত্রকলা ও সংগীতের উৎসুক গুণগ্রাহী ছিলেন। দীর্ঘকাল ধরেই, প্রায় প্রথম তারুণ্য থেকে আমৃত্যু দেশের  অগ্রণী সংগীতচর্চার প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এরই সহযোগী সংগঠন রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের কাজেও নানাভাবে অংশ নিয়েছেন। এই সূত্রে তাঁর গানের রুচি এবং শ্রোতা হিসেবে আগ্রহের ক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় তাতে। অবশ্যই রবীন্দ্রসংগীতসহ পঞ্চকবির গান এবং প্রমিত বাংলাগানের আরো অন্যান্য ধারাও যুক্ত হবে। চিত্রকলায় তাঁর আগ্রহ বোঝা যায় ছবির ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে, কিছু শিল্পীর সঙ্গে বন্ধুতায় এবং কোনো কোনো শিল্পীকে নিয়ে লেখা থেকে। একজন রুচিশীল সজ্জন নিপাট ভদ্রলোক হাসনাতভাই তাঁর সৌজন্যবোধ রক্ষা করে গেছেন আজীবন, তা রেখে গেলেন মৃত্যুতেও। মৃত্যুকে আলিঙ্গন করলেন রণচণ্ডী করোনার আড়ালে নিভৃতে, নীরবে, মৃদুল স্বাচ্ছন্দ্যে।