আবুল হাসনাত আমাকে লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন

হাসনাতভাই, এই তো মনে হয় সেদিনের কথা। এক সন্ধ্যায় আমাদের ঢাকার বাসায় বসে খুব আন্তরিকতার সঙ্গে পুরনো ঢাকার কিছু স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। বিশেষ করে বলছিলেন আপনাদের একসময়ের প্রতিবেশী ডাক্তার নন্দী, তাঁর শিক্ষিকা স্ত্রী এবং তাঁদের দুই কন্যা ইন্দিরা ও মন্দিরার কথা। প্রসঙ্গটা এলো কেননা ঢাকার স্মৃতি নিয়ে এত বছর পরে লিখিত মন্দিরার একটি বই সম্প্রতি আপনি পাঠ করেছেন। সেই বই পড়ে আপনার অনুভূতির কথাই বলছিলেন আপনি। সেদিন কথা বলতে বলতে আপনি আপনাদের সেই পুরনো বসতির বর্ণনা দিতে গিয়ে – ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করে অতি ধুমধামের সঙ্গে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপনের স্মৃতি রোমন্থন করছিলেন। সেসব দিনের অনেক খুঁটিনাটি ঘটনা ও তথ্যের আভাস ভেসে আসছিল আপনার মনে। আর সেসব কথাই বলছিলেন আপনি আমাদের। সেই সূত্রে ইন্দিরা-মন্দিরার কথা মনে পড়ছিল আপনার। মনে পড়ছিল আমার, মুনতাসীর মামুনের গ্রন্থে পড়েছি, ডাক্তার নন্দীর মতো অবিশ্বাস্য সফল ও জনপ্রিয় চিকিৎসককে কী নিষ্ঠুর  ও অন্যায়ভাবে আইয়ুব সরকার জোর করে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছিল ১৯৬৫-র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকালে ডা. নন্দীর সঙ্গে ভারতে নিজে দেখা করেছিলেন। ডা. নন্দীকে বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে এসে তাঁর নিজ বাড়িতে থেকে তাঁর প্র্যাকটিস আবার শুরু করতে অনুরোধ করেছিলেন। ডা. নন্দী আপ্লুত হয়েছিলেন এই ডাকে সন্দেহ নেই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তাঁদের কারো পক্ষে আর ঢাকায় বা ওয়ারীতে ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। হাসনাতভাই, এর কদিন পরেই দেখেছি মন্দিরা নন্দীর সেই ‘চাপা কান্নায়’ মোড়া বইখানির ওপর আপনার লিখিত একটি আলোচনা ছাপা হয়েছে, খুব সম্ভবত কালি ও কলমেই। 

আজ বারবার শুধু মনে পড়ছে, আপনার মতো ঢাকার আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা একে একে অনেকেই এভাবে আমাদের চোখের আড়ালে থাকতেই আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্যে চলে যাচ্ছেন। এখন দেশে গিয়ে বিকেল আর সন্ধ্যাগুলো কী দিয়ে, কাদের নিয়ে ভরাবো? মনিদাকে (হায়াৎ মামুদ) সেদিন বলেছি তাই, ‘এবার একটু সাবধান হও। ভালো থাকো। একটু এখন থামো তোমরা। আর যেও না। আমাকে – জ্যোতিকে – আমাদের বাঁচতে দাও।’ 

হাসনাতভাই, কালি ও কলমের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ‘ছোটগল্প সংখ্যা’ ও প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর  বিশেষ সংখ্যাতে বরাবর গল্প লিখেছি আমি ও জ্যোতি। শুধু এ-বছর আমরা দুজনের কেউ-ই পারিনি লিখতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে। জ্যোতির দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক অসুস্থতার কারণেই এই ব্যতিক্রম। এবার আরো বেশি লিখে সেই দোষ কাটিয়ে উঠব ভাবতে শুরু করতে না করতেই পৃথিবীজুড়ে করোনার তাণ্ডব দেখা দিলো। 

হাসনাতভাই, আপনার মতো দু-একজন বন্ধু ছিল বলেই আমি, জ্যোতি – আমরা আজো বেঁচে আছি। এই বৃদ্ধ বয়সেও সুদিনের স্বপ্ন দেখি। এত বছর দেশের বাইরে থাকা সত্ত্বেও আমাদের কথা, বিশেষ করে লেখক হিসেবে আমাদের কথা, যাঁরা মনে রেখেছেন, তাঁদের কাছে আমাদের ঋণ অনেক। আর সেই হিসাবে আপনার কাছে আমাদের ঋণের পরিমাণ অসীম। একটা কথা স্বীকার করতে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই। ছেলেবেলায় বাবার উৎসাহেই প্রথম চাঁদের হাট, কচিকাঁচার আসরে লিখতে শুরু করেছিলাম। কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার আগেই একজন প্রখ্যাত গল্পকারের সঙ্গে পরিণয় আমার গল্প লেখার স্বপ্নকে উস্কে দিয়েছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু পরিণত বয়সে লিখতে গিয়ে আপনার অনুপ্রেরণাই আমার লেখার সবচেয়ে বড় উৎস ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়বৈচিত্র্যে, লেখার উৎকর্ষে, দৃষ্টিনন্দন অঙ্গসজ্জা, উপস্থাপনা ও প্রকাশনায় দেশে বরাবরই এক ঈর্ষণীয় অবস্থানে রয়েছে সংবাদের সাহিত্যপাতা ‘সংবাদ সাময়িকী’।  আপনার সম্পাদনায় সংবাদের সাহিত্যপাতাতেই আমার অধিকাংশ লেখা প্রকাশিত হয়েছে।

তারপরে অন্যান্য কাগজ ও সাহিত্য ম্যাগাজিনে, বিশেষ করে কালি ও কলমে।  একটা কথা স্বীকার করতে কোনোদিন দ্বিধা করিনি। আজো করব না। আমার অতি সামান্য যেটুকু অর্জন বা অর্জনের-প্রচেষ্টা, তার অনেকটাই আমার ওপর – আমার লেখার ক্ষমতার ওপর আপনার অবিচল বিশ্বাসের জন্যেই সম্ভব হয়েছে। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। শুধু খবরের কাগজ আর সাহিত্য পত্রিকায় লেখা ছাপানোই নয়, আপনি আমার অনেক পরিশ্রম আর নিষ্ঠার ফসল, দুটি বিশাল আকারের নারীবাদী গ্রন্থ, যথেষ্ট নান্দনিক হয়েছে যাদের অঙ্গসজ্জা, বাঁধাই ও প্রকাশনা, আমার এ দেহখানি ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সন্ধানে নারী, বেঙ্গল থেকে প্রকাশ করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন বলেই ওগুলো বেঙ্গল পাবলিকেশন্স থেকে বেরিয়ে দুই বাংলাতেই সমাদৃত আজ। 

এই উপমহাদেশের দুর্ভাগ্য, মাঝে মাঝেই সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও জটিলতা বিশেষ করে আমাদের মতো মধ্যবর্তী বা নিম্নমধ্যবর্তী পরিবারের জন্যে একরাশ দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা ও শংকার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই সকল  দুর্যোগে-দুঃসময়ে,  হাসনাতভাই, আপনি ও আপনার মতো মানুষ কাছাকাছি ছিলেন বা আছেন বলেই কিছু কিছু ইন্দিরা, মন্দিরা, মালতী আর মিনতিদের আজো দেখা যায় আমাদের আশেপাশে – এখানে-ওখানে। আপনি ভালো থাকুন। আপনার জীবনসাথি ও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, বন্ধু, মিনু, ও আপনার প্রাণের টুকরো একমাত্র সন্তান দিঠি রইল আমাদের সকলের সঙ্গে। আপনার কথা সবসময় বলব আমরা যখনই পরস্পরের সঙ্গে দেখা হবে। কোনোদিন ভুলতে পারব না আপনাকে। আপনার কণ্ঠস্বর প্রতিদিন স্পষ্ট শুনতে পাই। কানে ভাসে আপনার নিম্নকণ্ঠের পরিচ্ছন্ন ও শোভিত শব্দে গাঁথা কথা বলার সেই প্রিয় ভঙ্গিটি। সারাজীবন প্রগতিশীল রাজনীতি করেও এমন খাঁটি ভদ্রলোক থেকে যাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। বিশেষ করে তা যখন চলায়, বলায়, পরায়, এবং প্রাত্যহিক ব্যবহারে ও কর্মে প্রতিনিয়ত প্রতিফলিত হয়। আপনাকে দেখে, আপনার কথা, আলোচনা, বক্তব্য শুনে বুঝেছি, বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে কোনো কিছুকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করতে হলে গলার আওয়াজ উঁচুতে নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। বক্তব্যের ধার ও তার স্বপক্ষে যুক্তি – উঁচুস্বরের গর্জনের চাইতে ঢের বেশি ফলপ্রসূ। 

এখনো বিশ্বাস হয় না ছায়ানটের কোনো সংগীতানুষ্ঠানে  বা  শিল্পকলা মিলনায়তনে কিংবা মহিলা সমিতি অথবা গাইড হাউসে  নতুন কোনো নাটক আর একসঙ্গে  দলবেঁধে কখনো দেখতে যাব না আমরা। দেশে যখন যাব, সময়ে, অসময়ে, পূর্বনির্ধারিত বা অনির্ধারিত আড্ডায় মেতে উঠব যখন ঘনিষ্ঠজনের সঙ্গে, তখন সেখানে কখনো আর থাকবেন না কালি ও কলমের দুই প্রধান ব্যক্তিত্ব – ড. আনিসুজ্জামান ও আবুল হাসনাত।  অসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আমার দেখা সবচেয়ে সজ্জন, সবচেয়ে বিনয়ী, স্বল্পভাষী হয়েও সবচেয়ে সবাক, আমার অতি  প্রিয় মানুষ – সাহিত্য সম্পাদক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চিত্রসংগ্রাহক ও চিত্র-সমালোচক এবং কবি মাহমুদ আল জামান, যিনি দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছে আবুল হাসনাত বলেই অধিক পরিচিত। 

আপনার স্মরণে আজ, নভেম্বর ৩, ২০২০, ফেসবুকে উৎপল কান্তি ধরের পোস্ট করা আপনার সহমর্মিতার স্পর্শে ভেজা একটি কবিতার অংশবিশেষ দিয়ে শেষ করছি।