সোঁদা মাটির ঘ্রাণ

এক সন্ধেবেলায় কোত্থেকে ফিরে এসে মা বলল, ‘এভাবে আর যে চলে না রে শুভ। এখানে থেকে আর কী হবে? তার চেয়ে চল আমরা গ্রামেই ফিরে যাই।’

হঠাৎ মায়ের মুখে গ্রামের কথা শুনে মনে হয়েছিল ভুল শুনছি বোধহয়। ফের একবার শোনার জন্য জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কোথায়?’

মা বলেছিল, ‘গ্রামে।’

আমি যেন একটা ঘোরে পড়ে গিয়েছিলাম, ‘গ্রাম? কোন গ্রাম?’

‘কেন? আমাদের গ্রাম। তোর বাবার গ্রাম।’

আমার চোখেমুখে বিস্ময়, ‘মানে সেই নিশ্চিন্দিপুর?’

‘হ্যাঁ, সেই নিশ্চিন্দিপুর। যেখানে তোর বাবার ছোটবেলা কেটেছে। সেই বাড়িঘর, পুকুর, গাছপালা, মাঠ, নীল আকাশ, তুলসীতলা -’

‘কিন্তু মা  -’

‘কেন রে? আবার কিন্তু কেন?’

‘ওইসব বাড়িঘর, মাঠ – সব তো বাবা ত্যাগ করে এসেছিল।’

‘সে তো তোর ঠাকুরদার ওপর রাগ করে। যার ওপর রাগ করা, সেই মানুষটাই তো নেই। তোর ঠাকুমাও গত হয়েছে। আর তোর বাবা  -’  

বলতে গিয়েও থেমে গেল মা। আবছা আলো-আঁধারিতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম মায়ের ভিজে আসা চোখ। আঁচলের কোনায় চোখ মুছলো মা। বোধহয় বাবার কথা মনে করেই। ভালো একজন মানুষ ছিল আমার বাবা। কারো সাতে-পাঁচে থাকতে দেখিনি কোনোদিন। ঠাকুরদার সঙ্গে কেন যে – 

আমায় অন্যমনস্ক হয়ে যেতে দেখে মা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ভাবছিস শুভ?’

মায়ের কথায় আর কিছু ভাবতে পারলাম না। উত্তর না দিয়ে উল্টো জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি কী মন থেকেই সেখানে যেতে চাইছো মা?’

মা বলল, ‘মন থেকে যাওয়া না যাওয়ার কী হলো? সে তো আমাদেরই গ্রাম। আমাদের বাড়িঘর। নিজেদের বাড়ি যেতে কারো অনিচ্ছা থাকে নাকি?’

‘না, মানে এতোগুলো বছর  -’

‘সে তো তোর বাবা যেতে চায়নি বলে। আসলে যেতে চায়নি বলা ভুল। বরং বলা ভালো, যায়নি। তবে যেতে যে তার ইচ্ছে হতো খুব, এটা বেশ বুঝতাম। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দেখতাম তোর বাবা জানালায় দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। কী ভাবছে জিজ্ঞেস করলেই বলতে শুরু করতো বাড়ির কথা। গ্রামের কথা। মাঠ, আকাশের কথা। শেষদিকে এসে ভেতরে ভেতরে যেন ভাঙতে শুরু করেছিল মানুষটা। তোর ঠাকুরদা মারা যাওয়ার পরে বলেছিলাম গ্রামে চলে যাওয়ার কথা। যায়নি। বলেছিল, এখন গেলে সবাই বলবে বাবা বেঁচে থাকতে এলো না। এখন মরে যেতেই এসেছে। আসলে সম্পত্তির লোভ। না, এই বদনাম ঘাড়ে নিতে চায়নি তোর বাবা।’

‘কিন্তু সে-বদনাম তো আমাদেরও দেবে।’

‘হয়তো দেবে। আবার নাও দিতে পারে। কিন্তু না গিয়েই বা কী করবো বল। এভাবে কতদিন চলবে? তোর বাবা যদি সরকারি কোনো চাকরি করতো তাহলে আমি পেনশন পেতাম। তা দিয়েই না হয় চালিয়ে নিতাম কোনোমতে। বেসরকারি কোম্পানির সামান্য কেরানি ছিল তোর বাবা। তেমন কিছু জমিয়েও যেতে পারেনি। তাছাড়া চলেও গেল বড়ো অসময়ে। টিউশনি করে সংসারের খরচ চালাতে গিয়ে তোরও পড়াশোনা হলো না। বিএ পাশ করে বসে আছিস। চাকরি-বাকরি পাওয়ারও নিশ্চয়তা নেই। তাহলে? কীসের আশায় পড়ে থাকবো বল তো?’

মনে হলো ঠিকই তো বলছে মা। তবু আমার মনের ভেতরে কোথায় যেন সংশয়। বললাম,‘কিন্তু মা কাকা যদি -’

মা বলল, ‘না রে, আমরা গেলে সে খুশিই হবে। তোর বাবা মারা যাওয়ার পর সে-ই তো আমাকে বলেছিল সেখানে চলে যাওয়ার কথা। বাড়িঘর, বিষয়-সম্পত্তি বুঝে নেওয়ার কথা। তপন বড়ো ভালো মানুষ রে। তাছাড়া বিষয়-আশয় কম তো আর নেই। কত জমিজমা। দুটো পুকুর। গোয়াল। ধানের গোলা। আম, নারকেলের গাছ। আর তেমনি বড়ো উঠোন। রাতের বেলায় ওই উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকালে কী সুন্দর যে লাগে। চারপাশে উড়ে বেড়ায় অসংখ্য জোনাকি। শিরশিরে হাওয়ায় ভেসে আসে ফুলের গন্ধ।’

বলতে বলতে একটু থামলো মা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আজো তোমার সে-বাড়ির কথা মনে আছে মা?’

আমার দিকে তাকালো মা। বলল, ‘থাকবে না? বউ হয়ে সেই বাড়িতেই তো উঠেছিলাম প্রথম। জানিস শুভ, মাত্র কদিনেই সে-বাড়ির গাছপালা, মাঠ, আকাশ – সব কেমন আপন করে নিয়েছিল আমায়। আর আমিও ওদের -’

‘সত্যিই তাহলে ওখানে চলে যাবে মা?’

‘না গিয়ে আর কী করবো বল। বাঁচতে হবে তো। তাছাড়া তোরও একটা ভবিষ্যৎ দরকার।’

আলতো একটা হাসি আপনা থেকে এসে ছড়িয়ে পড়লো আমার ঠোঁটে। আমার চোখে ভেসে উঠলো আমার না-দেখা বাড়িঘর। উঠোন, তুলসীতলা, আমের বাগান। গোয়াল। মাঠ। ধানক্ষেত। ঝিঁঝির ডাকে অল্প অল্প করে নামা সন্ধ্যা। জোনাকজ্বলা রাত। মায়াবী আঁধার। সেই ছোটবেলার মতো আরো একবার জড়িয়ে ধরলাম মাকে। তার বুকে মাথা রাখলাম। পরম আদরে আমায় বুকে টেনে নিল মা। মাথার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলল, ‘সব আঁধারেরই শেষ থাকে শুভ। দেখবি আমাদের এই আঁধারটাও একদিন কেটে যাবে।’

অগত্যা একদিন সব গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম গ্রামের উদ্দেশে। আমাদের গ্রাম। বিরাট একখানা নীল আকাশের নিচে প্রকৃতির এক অফুরন্ত সম্ভার। শহর ছেড়ে অনেকখানি দূরে নির্ভেজাল প্রকৃতি। এঁকেবেঁকে যাওয়া ইটের রাস্তা। আম, জাম, তাল, কাঁঠালের গাছ। রাস্তার দুপাশে টিন, টালির ছাউনি দেওয়া বাড়ি। দেহাতি মানুষজন। শহরে গাড়ির আওয়াজে কান  ঝালাপালা। আর এখানে হাজারো পাখির মন-মাতানো ডাকাডাকি। স্নিগ্ধ রোদ। মন সুখী করা হাওয়া।

কাকাকে ফোন করে আগেই জানিয়ে দিয়েছিল মা। কাকা বলেছিল, ‘এর চেয়ে ভালো খবর আর কী হয় বউদি? তা শুভ, শুভ কী বললো? রাজি হলো শেষমেশ?’

‘রাজি না হয়ে কী করবে বলো তো? আগে তো বেঁচে থাকা।’

‘আমার কী যে ভালো লাগছে বউদি।’  

‘আমারও খুব ভালো লাগছে তপন। নিজের মানুষের কাছে গিয়ে থাকবো। এমন সুন্দর একটা প্রকৃতির সান্নিধ্য পাবো। নিজেদের বাড়িঘর। নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকা। ছেলেটারও একটা ভবিষ্যৎ হবে।’

‘অবশ্যই এসো বউদি। আবার যেন মত পাল্টে ফেলো না।’

‘সেই সুযোগ কী আর আছে ভাই।’

মায়ের কথাটাই ঠিক। গ্রামের পথটা বাদে আর সব পথই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমাদের সামনে। খোলা ছিল কেবল গ্রামের পথটাই। শহরের সব মায়া ছেড়ে, সব বন্ধন মুক্ত হয়ে অবশেষে সত্যি সত্যিই পা রাখলাম গ্রামে। আমাদের বাড়িটাকে দেখে চমকে উঠলাম যেন। এতো বড়ো বাড়ি! এতোখানি জায়গা! আমাদের শহরের দু-কামরার ভাড়াবাড়ির সঙ্গে যার কোনো তুলনাই চলে না। কী ছিল সেখানে? পায়রার খোপের মতো ছোট ছোট দুটো কামরার একখানি ঘর। না আছে তার সামনে ফালি উঠোন, আর না চারপাশে খানিক ফাঁকা জায়গা। জন্ম থেকে ওখানে কাটাতে কাটাতে ভেবেছি ওটাই পৃথিবী। অমন করেই বেঁচে থাকতে হয়। কিন্তু গ্রামে এসে দেখলাম এক অন্য পৃথিবী। এক অন্য জীবন। বেঁচে থাকার ধারণাটাই পাল্টে গেল আমার।

আমায় দেখেই জড়িয়ে ধরলো কাকা, ‘কত বড়ো হয়ে গেছিস রে শুভ। তা হ্যাঁ রে, গ্রামটাকে কেমন লাগছে রে তোর?’

দু-ঠোঁটের ফাঁকে আলতো হাসির রেখা ঝুলিয়ে বললাম, ‘খুবই ভালো কাকা। আমি তো ভাবতেই পারিনি যে -’

কাকা বলল, ‘এটাই তো তোর সত্যিকারের ঠিকানা রে শুভ। নিজের ঠিকানাকে ভালো না লেগে পারে? এই বাড়িঘর, গাছপালা, উঠোন – এ তো  নিজেরই। দাদা যদি সেদিন রাগ করে চলে না যেত এতোদিনে তোরই তো দেখেশুনে রাখতে হতো এদের। যাক গে, একবার যখন এসে পড়েছিস তখন এখন থেকেই সব দেখেশুনে রাখ।’

‘কিন্তু কাকা, এই যে জমিজমা, চাষবাস – এর যে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই আমার।’

 ‘ওরে, এসব কি আর নিজের হাতে করা লাগে? লোকজন লাগাবি। ওরাই করে দেবে। তুই শুধু ওদেরকে দিয়ে করিয়ে নিবি। আর করাতে করাতে দেখবি একদিন নিজেই শিখে যাবি সব। তাছাড়া আমি তো রইলামই।’

তখন বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যা নামছে। ঝোপঝাড়ের গা পেঁচিয়ে উঠে আসা আঁধার একটু একটু করে দখল নিচ্ছে সারাটা গ্রামের। দ্রুত পাল্টাচ্ছে আকাশের রং।  কেমন একটা ক্লান্তির ছোঁয়া চারপাশে। ক্লান্তি আমাদের শরীরেও। এতোখানি পথ জার্নি করে এসেছি। ট্রেন, বাস, রিকশা করে আসতে গিয়ে হাঁপিয়েই উঠেছি একপ্রকার। আমাদের চোখেমুখে সেই ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট, যা দেখে এগিয়ে এলো কাকিমা। কাকাকে বলল, ‘তুমি কেমন মানুষ বলো তো? এতোখানি রাস্তা ভেঙে এলো আর এখনই এসব। একটু বিশ্রাম নিতে দাও। সময় তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না।’

কাকার বুঝি সম্বিত ফিরলো। বলল, ‘ও হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবে এলে, আগে খানিক জিরিয়ে নাও বউদি। তারপর না হয় সবাই এক জায়গায় বসে কথা হবে।’

সন্ধের আঁধার গাঢ় হতে শুরু করলে আকাশের গা বেয়ে নেমে এলো মায়াবী রাত। আধখানা চাঁদ উঠে এলো মাথার ওপরে। সেইসঙ্গে গাদাগুচ্ছের ছোট-বড়ো তারা। কী সব ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। ঝোপঝাড়ে জেগে উঠলো অসংখ্য জোনাকি। আশপাশে ঝিঁঝিপোকার ডাক। কেমন যেন নির্জন হয়ে এলো বাড়িটা। মানুষের হই-চিৎকার নেই      কোথাও। পাখিদের ডাক থেমে গেছে। ক্লান্ত গ্রাম বুঝি প্রহর গুনছে বিছানায় যাওয়ার।

ঘরের দাওয়ায় খেজুরপাতার মাদুর পেতে বসে আছি আমি, মা আর কাকিমা। কাকাও এসে বসলো আমাদের কাছে। বললো, ‘শোন শুভ, এতোদিনকার শহুরে জীবনটা এবার পুরোপুরি ভুলতে হবে তোকে। চাষাবাদ মানে হচ্ছে মাটির সঙ্গে ভালোবাসা। মাটিকে ভালোবাসতে না পারলে মন দিয়ে চাষবাস করা যায় না। প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা হবে বটে, তবে সেটা তোকেই সামলে নিতে হবে। মাটিকে যদি ভালোবাসতে পারিস, কদিনেই দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মা বলল, ‘নিজে থেকে কী আর ও পারবে তপন? তোমাকে হাতে ধরেই সব শিখিয়ে দিতে হবে। জন্ম থেকে যে-ছেলে শহরের ইট-কাঠের জঙ্গলটাই কেবল দেখে এসেছে, সবুজের ছোঁয়া চিনতে তার যে একটু সময় লাগবেই ভাই।’

‘সে তুমি ভেবো না বউদি। আমার ছায়াটা সব সময়ই ঘিরে রাখবে ওকে।’

‘আর একটা কথা ছিল ভাই।’

‘হ্যাঁ, বলো।’

‘বলতে খুব লজ্জা লাগছে ভাই।’

‘সে কী বউদি? লজ্জা? নিজের মানুষের কাছে বলবে, তাতে লজ্জার কী আছে?’

ঈষৎ ইতস্তত করতে করতে কথাটা বলেই ফেললো মা, ‘দ্যাখো, একপ্রকার খালি হাতেই তোমাদের কাছে আসা। এখন তোমরা যদি না দ্যাখো  –  আসলে তোমার দাদা বড়ো অসময়ে চলে গেল কি না। তেমন কিছু জমিয়ে যাওয়ার সময়-সুযোগ কোনোটাই পায়নি। সামান্য যেটুকু জমাতে পেরেছিল এ ক-দিনে পেট বাঁচাতে তাও শেষ। এখনই চাষবাস, ফসল বোনা -’

কাকার মুখে প্রসন্নতার ছোঁয়া। মাকে শেষ করতে না দিয়ে বলতে লাগলো, ‘টাকার কথা বলছো বউদি? ভাগের ভাগ বাইশ বিঘে জমি তোমাদের। আস্ত একটা পুকুর। এতোবড়ো গোয়াল। দাদা যদি লিজ দিয়েও রেখে যেত বছরে কত টাকা পেতো বলো তো? একটা টাকাও কী নিতে এসেছে কোনোদিন? সব তো এই আমিই ভোগ করেছি। তাই ওসব নিয়ে ভেবো না। টাকা যা লাগে আমি দিয়ে দেবো। আমারই বা এতো খাবে কে? দুটো মেয়ে। বিয়ে দিলেই তো চলে যাবে পরের ঘরে।’

আবছা আলো-আঁধারিতে ঘেরা দাওয়ায় বসে বুকের ভেতর থেকে আনা দীর্ঘশ্বাসটাকে খোলা আকাশের নিচে ছেড়ে দিলো মা। বদ্ধ জায়গা থেকে মুক্তি পেয়ে সেই দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে পড়লো চারপাশে। বাইরের আঁধারেই হয়তো সে খুঁজে নিল মুক্তির ঠিকানা। আমি তাকিয়ে রইলাম জোনাকজ্বলা সেই আঁধারের দিকে। একটু একটু করে ভুলে যেতে চাইলাম আমার অতীত। আমার শহরজীবন। আমার চেনা পরিবেশ।

অনেকটা রাতের দিকে শুয়েছিলাম বলে শুতে না শুতেই একটা গভীর ঘুম এসে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল আমায়। আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম ঘুমরাজ্যে। স্বপ্ন এসে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল বিছানায়। আমি স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছিলাম আমাদের সেই শহর। সেই বাড়ি। গাড়ির মিছিল। পিচঢালা রাস্তা। চেনা মুখের ভিড়। কখন যেন বাবাও এসে দাঁড়িয়েছিল সামনে। আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘এতোদিনে ভালো একটা কাজ করেছিস রে খোকা।’

অনেকটাই অবাক হয়েছিলাম বাবার কথায়। এমন করে বাবা তো কোনোদিনই বলেনি আমায়? আজ কী এমন করলাম

যাতে  – 

জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘কাজ? কী কাজ?’

বাবা বলেছিল, ‘এই যে শিকড়ের কাছে ফিরে আসা। এর থেকে ভালো কাজ আর কী কিছু হয় বল তো?’

‘কিন্তু এমনটা তো তুমিও করতে পারতে।’

‘না রে, সবাই সবকিছু পারে না। যে-শিকড়টাকে নিজেই ছিঁড়ে ফেলেছিলাম তাকে আবার জুড়তাম কেমন করে?’

আমি নির্বাক তাকিয়েছিলাম বাবার মুখখানির দিকে। ওই মুখে তখন একটা কষ্ট আর ভালো লাগা মিলেমিশে একাকার। বিকেলের বিষণ্নতার মাঝেও ভোরের স্নিগ্ধতা। আমার কানের কাছে যেন ডেকে উঠেছিল নাম-না-জানা একঝাঁক কীসব পাখি। তাদের ডানার বুনো গন্ধ এসে নাকে ঝাপটা দিয়ে গিয়েছিল।

আমি চুপ করে আছি দেখে বাবাই বলেছিল, ‘এই পৃথিবীতে আমাদের গ্রামের মতো এমন সুন্দর গ্রাম বুঝি আর দুটি নেই রে। এখানে পাখির ডাকে সন্ধ্যা হয়। আবার পাখির ডাকেই ভোর আসে। এখানে ঝিঁঝি ডাকে। জোনাক জ্বলে। আলো-আঁধার মাখামাখি হয়ে শুয়ে থাকে রোজ। মেঠো গন্ধমাখা বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায় মন ভালোলাগা পরশ নিয়ে। এখানে ফসল ফলে। শিশির ঝরে গাছের পাতায়, ঘাসের আগায়। এখানে কত ফুল, পাখি, গাছপালা।’

বলতে বলতে খানিক থেমে গিয়েছিল বাবা। তার চোখেমুখে স্পষ্টতই ফুটে উঠেছিল শৈশবের সারল্য। বুকভরে শ্বাস নিয়েছিল বারদুই। তারপর ফের বলতে শুরু করেছিল, ‘কত স্বপ্ন ছিল নিজের হাতে ফসল ফলাবো। মাটির গন্ধমাখা হাওয়ায় বুকভরে শ্বাস নেবো। জানিস শুভ,  ছোটবেলায় কেমন সাঁতার কাটতে পারতাম আমি। আমাদের ওই অতো বড়ো পুকুরটা এক সাঁতারে পেরিয়ে যেতাম। ভুবন ছিল আমার খেলার সাথি।  সে তো পেরেই উঠত না আমার সঙ্গে। চিৎসাঁতার, ডুবসাঁতার সবেতেই আমিই ছিলাম সেরা। পাড়ার লোকে সব আমাদের পুকুরেই আসতো স্নান করতে। আমাকে তারা বলতো জলের পোকা।’

বলতে বলতে থেমেছিল বাবা। তারপর ফের বলেছিল, ‘কেমন কথা বল তো? জলের পোকারাই যেন ভালো সাঁতার কাটতে পারে।’

বাবার মুখে কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছিল আমার। শুনতে শুনতে হারিয়ে যাচ্ছিল আমার কথারা। হঠাৎই যেন খেয়াল হয়েছিল বাবার। আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘হ্যাঁ রে শুভ  -’

‘উঁ।’

‘কিছু বলছিস না যে?’

‘কিছু তো বল। কেবল আমিই তো একা বলে যাচ্ছি।’

বাবার মুখের দিকে তাকালাম আমি। বললাম, ‘তাই-ই বলো। তোমার কথাগুলো শুনতে বেশ লাগছে আমার। আমি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার ছেলেবেলা। আলো-আঁধারি সন্ধে। উড়তে থাকা জোনাক। ক্ষেতভর্তি ফসল। খোলা মাঠ। নীল আকাশ। জল আয়নায় সেই আকাশের ছবি। বড়ো ভালো লাগছে গো।’

যেন খুশি হলো বাবা। বলল, ‘সে তো লাগবেই। নিজেদের বাড়ির কথা, মাঠ, আকাশ, ফসলের কথা শুনতে কার ভালো লাগে না বল তো? এসব যে তোর রক্তে মিশে আছে রে শুভ।’

আরো কীসব যেন বলতে যাচ্ছিল বাবা। তার আগে আচমকাই ঘুমটা ভেঙে গেল। পাশেই কোথায় কুকুর ডাকছে তারস্বরে। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। গলাটা শুকিয়ে কাঠ। ঘরজুড়ে আবছা আলো-আঁধারি। একটু জল পেলে বেশ  হতো।

দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। উঠোনে পা রাখতেই একরাশ নিশুতি আঁধার জাপটে ধরলো আমায়। বাইরে আলো বলতে কেবল গুটিকয় তারা। তাদের ঘুম ঘুম চোখে ক্লান্তির ঘোর। সন্ধেবেলায় মাথার ওপরে যে আধখানা চাঁদ ছিল সেও ডুব দিয়েছে পশ্চিমে। উড়ে উড়ে ক্লান্ত জোনাকি পাতার আড়ালে নিয়েছে শান্তির আশ্রয়। ঝোপঝাড়ের গায়ে গায়ে আঠালো আঁধার। আমি হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ালাম কলতলায়। হাতল চেপে জল খেলাম আধপেট। পাশের বেলগাছটার ডালে ঠিক তক্ষুনি ডেকে উঠলো রাতজাগা পেঁচা। মুহূর্ত সময়। সব শব্দেরা থেমে গেল ফের। একরাশ নির্জনতা এসে চেপে বসলো বাড়িজুড়ে। অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে  থাকা ঝোপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি হারিয়ে যেতে থাকলাম বাবার ছেলেবেলায়। সেই নীল আকাশ, খোলা মাঠ, ফসলের ক্ষেত, ছায়াঘেরা পুকুর আর সেইসব পড়ন্ত বিকেলে।

শেষ কার্তিকের রোদ একটু দ্রুতই যেন পড়ে আসছে। সে এখন কুমারী মেয়ের মতোই কোমল আর শান্ত। তার গায়ে হালকা একটা শীতের টান। মাথার ওপরে উপুর হয়ে থাকা আকাশটায় একফোঁটা মেঘ নেই বলেই আরো বেশি করে যেন ভালো লাগছে চারপাশ। পুকুরপাড়ের বড়ো শিমুলগাছটার নিচে দাঁড়িয়ে আছি আমি। সামনে পুকুর। পুকুরের জলে সাঁতার কাটছে আকাশ। হালকা হাওয়ায় ছোট ছোট ঢেউ। আমার পেছনে নিচু জমি। আমনের ক্ষেত। ধানের ভারে নুয়ে পড়েছে গাছ। আর দিনকতক পরেই ক্ষেত থেকে উঠে আসবে বাড়িতে। তারপর ধানগোলায় বাড়িতে নবান্ন হবে বলে দিয়েছে কাকা। এ-গাঁয়ে নাকি এটাই নিয়ম। এই ক্ষেত, পুকুর, একেবারেই আমার। আরো একান্তই আমার মাথার ওপরের এই আকাশটা। যার দিকে তাকালে আজো আমার মনে পড়ে আমাদের সেই দুই কামরার বাড়িটার কথা। ছোট্ট  একফালি ছাদ। পিচ রাস্তা। গাড়িঘোড়া, লোক চলাচল। আবার যখনই নিচের দিকে তাকাই – এই মাটি, পুকুর, ক্ষেত, গাছপালা আমায় ভুলিয়ে দেয় সব। আপন করে কাছে টানে। মন খুলে গায়ে মাখি রোদ। কান পেতে ঝিঁঝির ডাক শুনি। ফুলের গন্ধমাখা হাওয়ায় শ্বাস টানি বারবার। আজ বেশ কতগুলো মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি আমরা। বিষয়-সম্পত্তি সবকিছু ঠিকমতো ভাগ করে দিয়েছে কাকা। বলেছে, ‘তোর জিনিস তোকে বুঝিয়ে দিলাম শুভ। এবার একে ঠিকমতো দেখে রাখার দায় তোর।’ শুধু বলেই দায় সারেনি কাকা। সঙ্গে করে নিয়ে গেছে ক্ষেতে। নিজের হাতে ধরে শিখিয়ে দিয়েছে চাষবাস। চিনতে শিখিয়েছে মাটির গন্ধ।

মা বলেছে, ‘তোমার মতো কাকা যদি সব ছেলের থাকতো ভাই।’

কাকা হেসেছে, ‘অমন করে বোলো না বউদি। শুনে গর্ব হয় যে।’

‘গর্ব করার মতো হলে তো করবেই।’

‘না গো বউদি, এমন কিছুই আমি করিনি। তোমাদের অধিকারটাকে আমি কেবল আগলে রেখেছি।’

‘সেটাই বা কজন রাখে?’

‘বউদি -’

এখন আমি আর সেই আগের শুভ নেই। পর্ণমোচী বৃক্ষের মতো আমার গা থেকে একটু একটু করে খসে গেছে শহুরে সভ্যতার বাকল। মাটির সঙ্গে থাকতে থাকতে মাটির সঙ্গে মিশে গেছি। আমার গায়ে এখন মেঠোগন্ধ। এখন আমার সারাদিন মাঠ, ক্ষেত করে কেটে যায়। রাতে খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি। আকাশের চাঁদ-তারা দেখি। কান পেতে শুনি ঝিঁঝির ডাক। চোখ মেলে দেখি জোনাকির উড়ে বেড়ানো।

মা এসে ডাকে, ‘আর কতক্ষণ এভাবে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি শুভ? ঘরে আয়।’

আমি মাকে বলি, ‘অন্ধকারটাও কত সুন্দর, তাই না মা?’

মা বলে, ‘দেখার চোখ থাকলে সুন্দর তো বটেই।’

‘জোনাকগুলো কী সুন্দর আলো ছড়িয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে দ্যাখো।’

 ‘হুঁ।’

 ‘আর একটানা কেমন ছন্দ তুলে ডেকে চলছে ঝিঁঝিপোকা।’

‘তাও শুনছি।’

‘তোমার জোছনা গায়ে মাখতে ইচ্ছে হয় না মা?’

‘খুব হয়।’

‘ওই দ্যাখো পুবের আকাশটায় আধখানা চাঁদ উঠে এসেছে। একটু পরেই জোছনা ছড়াবে। আঁধার আর আলোর মাখামাখি খেলা শুরু হবে চারপাশে। এসো না মা, আমরা উঠোনে দাঁড়িয়ে আজ সারাগায়ে জোছনা মাখি।’

আমাকে সঙ্গ দেয় মা। কিংবা হয়তো দুজন দুজনকে। আমরা আকাশ দেখি। আঁধার দেখি। চাঁদ, তারা দেখি। আঁধারঘেরা ঝোপঝাড় দেখি। সেইসঙ্গে আরো কত কী যে দেখা হয়ে যায়।

আজকাল দেখতে আমার বড়ো ভালো লাগে। তাই রাতের বেলায় যেমন দেখি, তেমনি দিনের বেলাতেও দেখি। বিকেলের ফুরিয়ে আসা আলোয় আকাশ দেখি। মাঠ দেখি। ফসলের গায়ে ফসলের দুলে পড়া দেখি। পাখিদের ওড়াউড়ি দেখি। পুকুরের জলে মাছেদের ‘ফুট’-কাটা দেখি। আকাশের সাঁতার দেওয়া দেখি। আর এসব দেখার জন্যেই এখন আমি দাঁড়িয়ে আছি পুকুরপাড়ে। একটু আগেই পুকুরের জলে ছায়া ফেলে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেছে একঝাঁক সরাল। এখনো আমার নাকে ভাসছে তাদের ডানার বুনো গন্ধ। পেছনের মাঠটায় আলপথ ধরে হেঁটে যেতে যেতে গান ধরেছে কোনো এক কৃষক। আমি তাকিয়ে আছি জলের দিকে।

হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন মা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে খেয়াল করিনি। আমাকে ওভাবে আনমনে জলের দিকে তাকিয়ে

থাকতে দেখে মা ডাকলো, ‘শুভ -’

চমকে উঠে ঘুরে তাকালাম মায়ের দিকে, ‘মা, তুমি?’

মা বলল, ‘হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম।’

‘বসবে?’

‘না, দাঁড়িয়েই ভালো লাগছে।’

‘তোমার কি কিছু হয়েছে মা?’

‘মনটা ভালো নেই রে। তোর বাবার কথাটা বড্ড মনে পড়ছে আজ। বিয়ের আগে কত শখ ছিল এই জমিজমা নিজের হাতে চাষ করবে। গোয়ালভর্তি গরু পুষবে। মাছ চাষ করবে পুকুরে। জলে নেমে মাছ ধরবে। আর দিনরাত এই পুকুরের পাড়ে বসে হাওয়া খাবে। পুকুরের জলে মাছেদের সাঁতার কাটা দেখবে। ভেসে ওঠা আকাশের ছবি দেখবে। উড়ে যাওয়া পাখি দেখবে। অথচ দ্যাখ সেই শখ এতোটুকু পূরণ না করেই -’

মায়ের চোখে জল। আমার চোখেও বাষ্প জমতে শুরু করেছে। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার ভেতর থেকে। মায়ের চোখের দিকে তাকালাম আমি। মা বলল, ‘একটা কথা বলবো, রাখবি শুভ?’

‘বলো।’

‘তোর বাবার একটা মূর্তি গড়িয়ে আনবি?’

অবাক চোখে তাকালাম মায়ের দিকে, ‘মূর্তি? মূর্তি দিয়ে কী হবে মা?’

মায়ের চোখে একজোড়া টলটলে দিঘি। একটু ঢেউ উঠলেই যেন গড়িয়ে পড়বে জল। ঘাড়টাকে ঈষৎ উঁচু করে আকাশের দিকে তাকালো মা। তারপর বলতে লাগলো, ‘এই পুকুরপাড়ে এই শিমুলগাছটার নিচে একটা বেদি করে তার ওপর বসিয়ে রাখবো তাকে। তারপর এমনই কোনো কোনো সুন্দর বিকেলে কিংবা সন্ধেয় আমিও এসে বসবো তার পাশে। তারপর দুজনে আকাশ দেখবো। মাঠ দেখবো। ফুল, পাখি দেখবো। পুকুরের জলে মাছেদের সাঁতার দেখবো। আর -’

শুনতে শুনতে পুকুরের জলের দিকে তাকালাম। আর খুব চমকে উঠলাম তখনই। যে-জলের বুকে এতোক্ষণ কেবলই আকাশের ছবি ভাসছিলো, মাছেদের সাঁতার দেওয়া ভাসছিলো – সেই জলে একটু একটু করে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে একটা মুখের অবয়ব। বাবার মুখ। আর মুখজোড়া সেই সুন্দর হাসি – খুব খুশি হলে যেভাবে হাসতো বাবা।