অনুবাদ : সাঈদ সানী
[এই সময়ের একজন প্রখ্যাত নারীবাদী লেখক নাওমি আর উলফ (জন্ম ১৯৬২)। সামাজিক বিষয়াবলির একজন বস্ত্তনিষ্ঠ সমালোচক এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও খ্যাতিমান। দ্য বিউটি মিথ (১৯৯১) গ্রন্থের প্রকাশনার মাধ্যমে আমত্মর্জাতিকভাবে তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন এবং নারীবাদী আন্দোলনের তৃতীয় ধারার পুরোধা প্রবক্তা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন। এই বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন যে, ‘সৌন্দর্য’ নীতিবোধের মানদ- হিসেবে নয়, পুরোপুরি সামাজিকভাবে অবনির্মিত একটি ধারণা। পুরুষতন্ত্র নিজের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য এই নির্মাণ-বিনির্মাণের উপাদানগুলোকে নির্ধারণ করে দেয় এবং পুরুষতান্ত্রিক স্বার্থেই ব্যবহার করে। নারীও সৌন্দর্যের এই পুরুষতান্ত্রিক মিথের ফাঁদে পা দিয়ে পুরুষতন্ত্রকে বৈধতা দিচ্ছে, যা সার্বিক নারীমুক্তির অমত্মরায়। এখানে এই বইয়ের প্রথম অধ্যায়ের অনুবাদ করা হয়েছে।]
অবশেষে দীর্ঘ নীরবতার পর নারীরা রাজপথে নেমে আসে। দুই দশক ধরে আমূল সংস্কারমূলক আন্দোলনের পর ১৯৭০ সালের গোড়ার দিকে নারীবাদের পুনর্জন্ম হয়। পাশ্চাত্যেও নারীরা আইনি এবং প্রজননগত অধিকার লাভ করেন। খুলে যায় উচ্চশিক্ষার দ্বার, তাঁরা প্রবেশ করেন বাণিজ্য এবং পেশাগত দুনিয়ায়। নারীদের সনাতন সামাজিক ভূমিকা এবং বিশ্বাস আমূল পালটে যায়। তবু প্রশ্ন থেকে যায়। এর এক প্রজন্ম পরেও কি নারীরা নিজেদের স্বাধীন ভাবতে পেরেছিল?
পাশ্চাত্যেও ধনী শিক্ষেত, মুক্ত নারী – যারা আগে স্বাধীনতা পায়নি কিন্তু এখন সেটা উপভোগ করতে পারছে তারাও এখন যতটা স্বাধীনতা চায় ততটা অনুভব করে না। অবচেতন মনেও তারা ভাবছে, স্বাধীনতার এই খর্বতা, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে কিছু একটা করা দরকার। কিছু বিষয় আছে যেগুলো আপাত-অর্থে তুচ্ছ করার মতো। কিন্তু সেইসব বিষয় নিয়েও ভাবনা-চিন্তার অবকাশ আছে। অনেক নারীই আছে যারা এই ধরনের তুচ্ছ বিষয়গুলো স্বীকার করে নিতে লজ্জাবোধ করে। সে দেখতে কতটা রূপসী, তার শারীরিক গঠন কেমন, মুখশ্রী, চুল, পোশাক-আশাক কী ধরনের – এসব বিষয়কে বেশ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এর কারণ, লজ্জা, অপরাধবোধ আর প্রত্যাখ্যানের কারণে অনেকে এসবকে গুরুত্ব দেয়। তারা ভাবে কঠোর, ভারি এই প্রত্যাখ্যান তাদের হয়তো সণায়ুবৈকল্যের দিকে নিয়ে যাবে এবং তারা একা হয়ে পড়বে। কিন্তু আমার মনে হয় এসব নিয়ে না ভেবে নারী-স্বাধীনতা এবং নারী-সৌন্দর্যের মধ্যে যে-সম্পর্ক আছে, সেই বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিত।
নারীরা যতই আইনি এবং বস্ত্তগত বাধার শৃঙ্খল ভাঙছে, ততই নারী-সৌন্দর্যের ভাবমূর্তি আরো কঠোর, ভারি এবং নিষ্ঠুরভাবে তাদের ওপর গুরুভার হয়ে চেপে বসছে। অনেক নারীই মনে করেন, নারীদের সামষ্টিক উন্নতি থমকে গেছে। প্রথমদিকের সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দিনগুলোর তুলনায় এখন বড় হয়ে উঠেছে সংশয়, বিভেদ, নিন্দা সর্বোপরি দমন-পীড়নমূলক আবহ।
বছরের পর বছর কঠিন সংগ্রাম করে যাওয়া এবং সেই সংগ্রামের সামান্য স্বীকৃতি পাওয়ার পর বহু বয়স্ক নারী ভাবছেন যে, তাঁরা বুঝি শেষ হয়ে গেছেন। আন্দোলন-সংগ্রামের নিশ্চিত আলোকবর্তিকা বয়ে আনার পরও অসংখ্য তরুণী নতুন করে আলো জ্বালিয়ে পথ চলার ব্যাপারে এখন আর তেমন আগ্রহী নয়।
আমরা জানি, গত কয়েক দশকে নারীরা ক্ষমতাকাঠামোতে ভাঙন ধরাতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে আবার নারীর খাদ্যাভ্যাসে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে; কসমেটিক সার্জারির মতো দ্রম্নত প্রসারণশীল চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশেষ প্রবণতাটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। গত পাঁচ বছরে ভোগ্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ বেড়েছে; বৈধ চলচ্চিত্রকে ছাপিয়ে পর্নোগ্রাফি হয়ে উঠেছে গণমাধ্যমের প্রধান ধারা। এই প্রেক্ষাপটেই তেত্রিশ হাজার মার্কিন নারী গবেষকদের জানিয়েছে যে, গড়ে তাদের দশ থেকে পনেরো পাউন্ড ওজন কমেছে; কিন্তু অন্য কোনো লক্ষ্যই অর্জিত হয়নি। অনেক নারীই আগের তুলনায় প্রভূত সম্পদ আর বৈভবের অধিকারী হয়েছে, পেয়েছে সুযোগ, মিলেছে আইনি স্বীকৃতি। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে শরীরের ব্যাপারে আমরা কী অনুভব করছি, কী আমাদের অর্জন – তাহলে দেখা যাবে যে, আমাদের শৃঙ্খলিত বা পরাধীন নানি-দাদির চেয়েও আমাদের অবস্থা দিন-দিন আরো খারাপ হচ্ছে। ইদানীংকার বেশিরভাগ গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, পাশ্চাত্যেও আকর্ষণীয় সফল কর্মজীবী নারীর একটি গোপন ‘অপ্রকাশিত’ নিয়ন্ত্রিত জীবন আছে, যা সৌন্দর্য-তাড়নার কারণে আমাদের স্বাধীনতাকে বিষময় করে তুলেছে। এটা হচ্ছে আসলে আত্মধিক্কার, শারীরিক আচ্ছন্নতা, বুড়িয়ে যাওয়ার ভয় আর আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার মতো শিরশিরে একধরনের শঙ্কা, যা দ্বারা প্রতিনিয়ত আমরা আক্রামত্ম হচ্ছি।
এটা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয় যে, অসংখ্য সম্ভাবনাময় শক্তিশালী নারী এরকম ভয়ের মধ্যে থাকে। এখন আমরা নারীবাদের কোনো-কোনো বিষয়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বিশেষ করে যে-নারীবাদে নারী-সৌন্দর্যের ইমেজকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদমুখর। নারী প্রগতির পরিবর্তে আমরা এখন তৈরি করছি সৌন্দর্যপুরাণ।
সামাজিক বিষয়-আশয়ের এই হচ্ছে আধুনিক সংস্করণ, যা শিল্প-বিপস্নবের পর থেকেই বেগবান হয়েছে। গার্হস্থ্যায়নের মেয়েলি গূঢ়রহস্য থেকে মেয়েরা যত নিজেদের মুক্ত করতে চাইছে ততই সৌন্দর্যপুরাণ বা সৌন্দর্যের প্রতি আসক্তি সেই হারানো জায়গা দখল করে নিচ্ছে। বিষয়টি ব্যাপকতর হয়ে চূড়ামত্ম বৈধতা পাওয়ার চেষ্টা করছে, ছড়িয়ে পড়ছে কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক ক্ষেত্রে।
প্রতিবাদ প্রচ- হয়ে-ওঠা সত্ত্বেও পুরনো নারীবাদী আদর্শের সর্বশেষ ভাবাদর্শ হিসেবে এটি টিকে আছে। তবু সৌন্দর্যের এই ভাবনা এখনো সেইসব নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখে, যাদের নারীবাদের দ্বিতীয় ধারার মাধ্যমেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। সামাজিক আধিপত্যকে ছাপিয়ে সৌন্দর্যের আদর্শ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং এই সংঘাত মাতৃত্ব, ঘরকন্নার ধারা, সতীত্ব এবং নিষ্ক্রিয়তার মিথগুলোকে আর সামাল দিতে পারছে না। এই আদর্শ এই মুহূর্তে মনস্তাত্ত্বিকভাবে এবং নারীবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা যা কিছু অর্জন করেছি, সেটি প্রায় প্রকাশ্যে প- করে দিচ্ছে। এই বিরুদ্ধশক্তি পাশ্চাত্যে নারীদের জীবনের প্রতিটি সত্মরে নারীবাদের উত্তরাধিকারকে পরাজিত করার জন্য কাজ করছে। নারীবাদ জেন্ডারনির্ভর পেশার বৈষম্যকে চিহ্নিত করে আমাদের আত্মপ্রতিষ্ঠার আইনি অধিকার দিয়েছে। দৈহিক কারণে নারী যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে সেই ধরনের আইন পাশ হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক ধর্ম ধসে পড়েছে কিন্তু পুরনো ধর্মীয় প্রথা এবং ধর্মীয় আচার-আচরণকে ঘিরে মগজ ধোলাই করার আদিম কলাকৌশলের ব্যবহার আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নারীর বয়স এবং দৈহিক ওজনের ওপর গুরুত্ব পড়ায় ঐতিহ্যবাহী আচার-আচরণের উচ্ছেদ ঘটে গেছে। বেটি ফ্রিডানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নারীবাদীরা গৃহস্থালি পণ্যের জনপ্রিয় বিজ্ঞাপনের মরণকামড় ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বলা বাহুল্য, এ-ধরনের বিজ্ঞাপন মেয়েলি রহস্যময়তাকে উৎসাহিত করত। খাবার আর ত্বকের যত্নের কথা বলে যেসব শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছিল, সেইসব শিল্পকারখানা নারীর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি করছে বলে নারীরা এখন মনে করছে; আর এভাবেই আবির্ভাব ঘটে নতুন এক সাংস্কৃতিক পরিসরের।
সৌন্দর্যচর্চার যারা সমর্থক তাদের চাপে তরুণী মডেলদের চটকদার প্রভাবে সফল নারীদের যারা ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠতে পারত সেসব সুখী গৃহবধূ আড়ালে চলে গেছে, এককথায় তাদের উচ্ছেদ ঘটেছে। এর পরিবর্তে এখন রোগা, কৃশকায়, তারুণ্যে চনমনে মডেলরা নারীদের আদর্শ হয়ে উঠেছে। যৌন-বিপস্নব এভাবেই নারীযৌনতাকে আবিষ্কার করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে থাকে। ‘সৌন্দর্যের পর্নোগ্রাফি’ – নারীদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কৃত্রিমভাবে যৌনতার সঙ্গে সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে পণ্যায়িত ‘সৌন্দর্যে’র সংযোগ ঘটে। এর ফলে নারীদের মধ্যে যৌনতাকে কেন্দ্র করে আত্মমর্যাদার যে নতুন উপলব্ধি জেগেছিল তা মূলধারার সেই চেতনাকে আক্রমণ করে বসে। প্রজননগত অধিকার পাশ্চাত্য নারীদের নিজের শরীরের ওপর নিয়ন্ত্রণ এনে দিয়েছে। কিন্তু ফ্যাশন মডেলদের দৈহিক ওজন সাধারণ মেয়েদের তুলনায় তেইশ ভাগ নিচে নেমে গেছে। কম খাওয়ার সংস্কৃতি চালু হওয়ায় খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রে অরাজকতা উলেস্নখযোগ্যভাবে বেড়ে গেছে। এর প্রভাবের ফলে উদ্ভূত সণায়ুবৈকল্যকে এমনভাবে উৎসাহিত করা হচ্ছে যার মূলভাব হচ্ছে – যে করেই হোক খাবার কম খেতে হবে আর ওজন কম রাখতে হবে। এভাবেই আসলে ঘটেছে নারী-স্বাস্থ্যের রাজনীতিকরণ। টিস্যুকেন্দ্রিক সৌন্দর্যচর্চার বা সৌন্দর্যরক্ষার নতুন প্রযুক্তি, বিশেষ করে যা মৃত্যু ডেকে আনে, সেই ধরনের মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ একটি প্রযুক্তি ‘কসমেটিক সার্জারি’ পুরনো ধাঁচের চিকিৎসা পদ্ধতিকে সরিয়ে দিয়ে চিকিৎসাক্ষেত্রে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। অথচ দেখা গেছে, পুরনো ধাঁচের চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নারীর নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি ছিল।
১৮৩০ সালের পর থেকে প্রত্যেক প্রজন্মের নারীরা সৌন্দর্যের মিথ এবং এর নানা সংস্করণ নিয়ে সংগ্রাম করে আসছে। ‘আমার কাছে ভোটাধিকার বলেন, সম্পত্তির অধিকার বলেন, এসবের কোনো অর্থ নেই যদি না আমি আমার শরীরকে ঠিক রাখতে পারি, চূড়ামত্ম অধিকারের প্রকাশ হিসেবে এটাকে ব্যবহার করতে না পারি।’ ১৮৫৫ সালে এই উক্তি করেছিলেন নারী ভোটাধিকার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী লুসি স্টোন। এর আশি বছর পর নারীরা যখন ভোটাধিকার অর্জন করেছে আর নারী-আন্দোলনের প্রথম ধারাটি থিতিয়ে এসেছে তখন ভার্জিনিয়া উলফ লিখেছেন, আরো কয়েক দশক গেলেই কেবল নারীরা নিজেদের শরীর সম্পর্কে সত্য কথাটা বলতে পারবে। ১৯৬২ সালে আমেরিকান নারীবাদী বেটি ফ্রিডান মেয়েলিপনার ফাঁদে আটকেপড়া এক তরুণীর কথা তুলে ধরেছেন : ‘আজকাল আমি যখন আয়নার দিকে তাকাই তখন ভয় পেয়ে যাই এই ভেবে য়ে, আমাকে দেখতে মনে হয় মায়ের মতো লাগছে!’ এর আট বছর পর, নারীবাদের দ্বিতীয় ধারার সূচনা ততদিনে হয়ে গেছে, জারমেইন গ্রিয়ার ‘ছাঁচে ঢালা’ প্রিয়ার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে : ‘তার নিজস্ব বলতে যা কিছু আছে তা হলো সৌন্দর্য, এমনকি সেই বিশেষ শব্দ সৌন্দর্যও যেন তার একামত্ম নিজের নয় – সে আসলে একটি পুতুল – এই ধরনের ভান বা কৃত্রিমতা আমাকে অসুস্থ করে দিচ্ছে।’ দ্বিতীয় ধারার বিশাল বিপস্নব সত্ত্বেও, প্রকৃতপক্ষে এই বিউটি মিথের হাত থেকে আমরা রক্ষা পাইনি। আমরা এখন বিধ্বংসী বাধাগুলোর বাইরের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি : এক-একটি বিপস্নব এসেছে আর আমাদের বাধাগুলো একে-একে অপসারিত হয়েছে। ইতোমধ্যে অবশ্য অনেক পানি গড়িয়েছে, সেদিন যে শিশু ছিল, আজ সে পরিপূর্ণ নারী। কিন্তু এখনো যে চূড়ামত্ম অধিকার তার ওপর আমাদের পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
সৌন্দর্যপুরাণ একটি গল্প বলে : ‘সৌন্দর্য’ নামক গুণটি বাসত্মবে এবং সর্বজনীনভাবে বিরাজমান। নারীদের অবশ্যই উচিত তার বাসত্মব রূপদান করা এবং পুরুষের উচিত সেই নারীদের হসত্মগত করতে চাওয়া, যারা সেই সৌন্দর্যকে ধারণ করে। এই ধারণ করতে চাওয়াটা নারীর জন্য অপরিহার্য, কিন্তু পুরুষের জন্য নয়। এই বিভাজন প্রয়োজনীয় এবং প্রাকৃতিক। কেননা তা জীববিজ্ঞান-সংক্রামত্ম, কামজ এবং বিবর্তনবাদী : শক্তিশালী পুরুষ সুন্দরী নারীর জন্য যুদ্ধ করবে এটা সামাজিকভাবে একটি জনপ্রিয় ধারণা; সুন্দরী নারীরা প্রজননগতভাবে বেশি সফল; নারীর সৌন্দর্য অবশ্যই তার উর্বরতার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং যেহেতু এই ব্যবস্থা লৈঙ্গিক নির্বাচনের ওপর নির্ভরশীল তাই এটি অবশ্যম্ভাবী এবং অপরিবর্তনীয়।
‘সৌন্দর্য’ সর্বজনীন বা অপরিবর্তনীয় কোনো সূচক নয়; যদিও পশ্চিমারা ভান করে যে, সব মেয়েলি সৌন্দর্যের আদর্শ একটি নিষ্কাম আদর্শ নারী থেকে উদ্ভূত। মাওরি আদিবাসীরা পৃথুল যোনিদ্বারে মুগ্ধ এবং পাদুং অধিবাসীরা নিসেত্মজভাবে ঝুলমত্ম সত্মন দ্বারা; এমনকি সৌন্দর্য বিবর্তনেরও ফসল নয়; এর দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন প্রজাতির বিবর্তনের চেয়েও অনেক বেশি দ্রম্নতগতিতে পরিবর্তিত হয়। চার্লস ডারউইনও ‘সৌন্দর্য’ সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক নির্বাচনের সূত্র থেকে বিচ্যুত হয়ে ‘লৈঙ্গিক নির্বাচন’ থেকে ‘সৌন্দর্য’ উদ্ভূত হয়; ‘সৌন্দর্য’ নিয়ে নারীদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতা একটি উলটোমুখী পথ, যা সত্মন্যপায়ী প্রাণীদের প্রাকৃতিক নির্বাচনের ধারণার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব রাখে। সঙ্গী হিসেবে নির্বাচিত নারীদের অবশ্যই ‘সুন্দরী’ হতে হবে, নৃ-তত্ত্ব এই ধারণাকে উলটে দেয়; ঈভলিন রিড, এলেইন মরগান প্রমুখ এই সামাজিকবিদ্যাগত দাবি নাকচ করে দেন যে, পুরুষেরা সহজাতভাবেই বহুগামী এবং নারীরা একগামী; মনুষ্য প্রজাতি ছাড়া শ্রেষ্ঠ সত্মন্যপায়ী প্রাণীবর্গে স্ত্রীলিঙ্গরাই উদ্যোক্তা; শুধু যে তারা বহু সঙ্গীর সঙ্গে যৌনসঙ্গম করতে চায় এবং উপভোগ করে তাই-ই নয়, বরঞ্চ ‘গর্ভধারণ করেনি এমন প্রতিটি স্ত্রীলিঙ্গ তার দলের সবচেয়ে আকাঙিক্ষত পুরুষগুলোর সঙ্গে পালাক্রমে এই সম্ভোগ উপভোগ করে থাকে এবং এই চক্র যতদিন সে বেঁচে থাকে ততদিন পর্যমত্ম চলতে থাকে।’ বহু সামাজিক জীববিজ্ঞানী প্রায়শই এইসব প্রাণীর উত্তেজিত গোলাপি যৌনাঙ্গকে নারী-সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্পর্কায়িত মানুষের বিন্যাসকে তুল্য বিবেচনা করেন অথচ বস্ত্ততপক্ষে যখন তা একটি সর্বজনীন সত্মন্যপায়ী প্রাণীবর্গের আধিপত্যশীল স্ত্রীলৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্য। অথচ সৌন্দর্যপুরাণের শর্তগুলো সবসময় এরকম ছিল না। বৃদ্ধ ধনাঢ্য পুরুষের সঙ্গে তরুণ, সুন্দরী নারীর জোড় বাধাকে যেভাবেই হোক অপরিহার্য হিসেবে ধরে নেওয়া হলেও খ্রিষ্টপূর্ব ২৫,০০০ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় ৭০০ সাল পর্যমত্ম ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্যশীল মাতৃতান্ত্রিক দেবীদের ধর্মে এই চিত্র সম্পূর্ণ উলটো ছিল। প্রতিটি সংস্কৃতিতে দেবীদের বহু প্রেমিক ছিল – পরিষ্কার নকশাটি ছিল বয়স্ক নারীর সঙ্গে একজন সুন্দর কিন্তু ব্যয়সাধ্য তরুণ। যেমন, ইসথার এবং তম্মুজ, ভেনাস এবং অ্যাডোনিস, সিবের এবং এট্টিস, আইসিস এবং ওসিরিস। তাদের একমাত্র কাজ ছিল স্বর্গীয় ‘জরায়ুর’ সেবা করা। ঠিক তেমনি নারীদের সবসময় সুন্দর হতে হতো এবং পুরুষেরা তা অবলোকন করত, এমনটিও ছিল না : নাইজেরিয়ার আদিবাসী উদাবেদদের মধ্যে নারীরা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ছিল এবং এই আদিবাসীরা পুরুষের সৌন্দর্য দ্বারা আবিষ্ট থাকত; উদাবে পুরুষেরা বিশদ মেকআপ সেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করত এবং তাদের মধ্যে সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা হতো উত্তেজকভাবে রংচং মেখে, বর্ণিল পোশাক পরে, কোমর দুলিয়ে প্রলুব্ধকর অভিব্যক্তি দিয়ে এই সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা চলত যার বিচারক থাকত নারীরা। সৌন্দর্যপুরাণের কোনো বৈধ ঐতিহাসিক বা জীববিদ্যাগত যথার্থতা নেই; আজকাল নারীদের নিয়ে যা ঘটছে তা বর্তমানের ক্ষমতা কাঠামো, অর্থনীতি এবং নারীদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক শক্তির মহড়া ছাড়া আর কিছুই নয়। যদি সৌন্দর্যপুরাণ বিবর্তন, যৌনতা, জেন্ডার, নন্দনতত্ত্ব অথবা ঈশ্বরের ওপর ভিত্তি করে নয়, তাহলে কিসের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে? এটি শারীরিক ঘনিষ্ঠতা এককথায় যৌনতার অগ্রাধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষী্য গড়ে উঠেছে যা এককথায় নারীর আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন। এটি মূলত নারী-পুরুষের মধ্যে আবেগঘন দূরত্ব সৃষ্টি করে, যা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং যৌনতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নারীকে দমন করে। সৌন্দর্যপুরাণ একেবারেই নারীর নিজস্ব কোনো ব্যাপার নয়। এটি পুরুষের তৈরি একটি প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। একটি বিশেষ সময়ে নারীর সৌন্দর্যের সংজ্ঞা ছিল নারীর আচরণের প্রতীক, যা সেই সময়ে আকাঙিক্ষত বিবেচিত হতো : সৌন্দর্যপুরাণ সব সময়ে মূলত আচরণগত পরামর্শ ছিল এবং বাহ্যিক অবয়ব নয়। নারীদের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা এই পুরাণের ফসল যাতে করে নারীরা জোটবদ্ধ না হয়ে পরস্পরের শক্রতে পরিণত হয়। বয়স্ক নারীরা তরুণীদের ভয় পায়, তরুণীরা বয়স্কদের এবং সৌন্দর্য পুরাণের অবচ্ছেদন ঘটে তাদের সারাজীবন জুড়ে।
তারুণ্য এবং কুমারীত্বকে এখন পর্যমত্ম নারীর সৌন্দর্য হিসেবে গণ্য করা হয়। কেননা এগুলো অপরিপক্বতা এবং যৌনতা সম্বন্ধে অজ্ঞতাকেই নির্দেশ করে। নারীর বয়স বেড়ে যাওয়াটাকেই ‘অসুন্দর’ মনে করা হয়। কেননা, সময় এবং অভিজ্ঞতার সঙ্গে-সঙ্গে নারীরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে ফলে পুরুষের প্রতি তারা বশ্যতা হারায়। সবচেয়ে মারাত্মক হলো নারীর আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে তৈরি করা হয়ে থাকে সৌন্দর্যের ধারণাকে, যাতে করে আমরা পুরুষের অনুমোদনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি যা আমাদের আরো অরক্ষিত করে তোলে। আত্মসম্মানের অপরিহার্য সংবেদনশীল অঙ্গ আমরা বহন করি ঠিকই কিন্তু তা অলক্ষী্যই কেঁদে মরে অথবা নষ্ট হয়ে যায়।
যতদিন পুরুষতন্ত্র থাকবে ততদিন নিশ্চিতভাবেই সৌন্দর্যপুরাণ কোনো না কোনো আদলে বহাল তবিয়তে বিরাজ করবে। তবে সৌন্দর্যপুরাণের আধুনিক ধ্যান-ধারণা মোটামুটিভাবে সাম্প্রতিককালের আবিষ্কার। নারীর ওপর বস্ত্তগত নিয়ন্ত্রণ ভয়াবহভাবে শিথিল হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে এই মিথ বা পুরাণ বিকশিত হয়ে উঠেছে। ইউরোপে শিল্প-বিপস্নবের আগে ‘সৌন্দর্য’ সম্পর্কে গড়পড়তা নারীর অনুভূতি আধুনিক নারীর মতো ছিল না। গণমাধ্যমে প্রচারিত দৈহিক আদর্শের অবিরাম তুলনার ভিতের ওপর নির্মিত হলো সৌন্দর্যপুরাণের আদর্শ ছাঁচ। আধুনিক নারীরা সেই সৌধে আসীন হয়ে অর্জন করে এই মিথটির অভিজ্ঞতা। বহুমাত্রায় ও বিপুল পরিমাণে কপি সৃষ্টির প্রযুক্তিগত বিকাশের পূর্বে – দাগেরো চিত্র, ফটোগ্রাফ ইত্যাদির প্রচলন ছিল, যা সাধারণ নারীদের অধরা ছিল না। যেহেতু পরিবার ছিল একটি উৎপাদকযন্ত্র, সেহেতু নারীর কাজও ছিল পুরুষের পরিপূরক। তাই যারা অভিজাত বা গণিকা ছিল না, সেইসব নারীর মূল্য তাদের কর্মক্ষমতা, অর্থনৈতিক সামর্থ্য, শারীরিক এবং সৃজনীশক্তি দ্বারা নির্ধারিত হতো। অবশ্যই সেখানে শারীরিক আকর্ষণের ভূমিকা ছিল বিপুল; কিন্তু ‘সৌন্দর্য’ বলতে আমরা যা বুঝি তা বিয়ের বাজারে সাধারণ নারীদের ক্ষেত্রে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। শিল্পায়নের উত্থানের পর সৌন্দর্যপুরাণের আধুনিক
ধরন সুনির্দিষ্ট রূপ লাভ করে। শিল্পায়নের পর পারিবারিক কর্মপ্রভাব হ্রাস পেতে থাকে এবং শহরায়ন ও উদীয়মান শিল্পকারখানার বিকাশের সঙ্গে গড়ে ওঠে গার্হস্থ্যায়নের ‘ভিন্ন ভুবন’। এই ভিন্ন ভুবন ছিল সেইসব পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের ভরসার জায়গা, যারা যুগোপযোগী শ্রমে পারঙ্গম এবং যারা দিনের বেলায় বাড়ি ছেড়ে কর্মস্থলে যেতে প্রস্ত্তত ছিল। এভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিস্তার ঘটল, জীবনযাপন এবং শিক্ষার হার বাড়ল এবং পরিবারের আকার ছোট হয়ে এলো। এর পাশাপাশি একটি নব্যশিক্ষেত অথচ অলস নারী শ্রেণির উদ্ভব ঘটল, যাদের সমর্পণের কাছে পুঁজিবাদের বিকশিত ব্যবস্থা নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। ঊনবিংশ শতকের তিরিশের দশক থেকে নারীদের সৌন্দর্যের বেশিরভাগ ধারণা মূর্ত হয়ে ওঠে। বিশেষত যখন থেকে গার্হস্থ্যায়নের প্রথা শক্তি অর্জনের মাধ্যমে সৌন্দর্যসূচক তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথমবারের মতো, নারীদের দেখতে কেমন হওয়া উচিত – তা নতুন প্রযুক্তিগুলো – যেমন ফ্যাশন পেস্নট, দাগেরো চিত্র এবং খোদাই করা পেস্নটের মাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকল। ১৮৪০-এর দশকে প্রথমবারের মতো গণিকাদের নগ্ন ছবি তোলা হয়। এই শতকেরই মধ্যভাগে প্রথম সুন্দরী নারীদের ছবি ব্যবহার করে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। সমাজের সুন্দরীদের এবং অভিজাত গৃহিণীদের ধ্রম্নপদী শিল্পকর্ম, পোস্টকার্ড, কুরিয়ার, ঈভস প্রিন্ট এবং চিনামাটির আবক্ষমূর্তির নতুন জোয়ার সৃষ্টি হয় যে, বধ্যভূমিতে ক্রমশ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে মধ্যবিত্ত নারীরা। শিল্প-বিপস্নবের সময় থেকেই মধ্যবিত্ত পশ্চিমা নারীরা বস্ত্তগত চাপের মতোই আদর্শ এবং ছাঁচে ঢালা নমুনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। এই শ্রেণির কাছে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিশেস্নষণ করলে এই অর্থ দাঁড়ায় যে, এই ‘সাংস্কৃতিক ষড়যন্ত্র’ তাদের কাছে যেন আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিসঙ্গত বলেই মনে হয়। নারী ভুবনের প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে কৃত্রিমতার মোড়কে আবদ্ধ করা সামাজিক কল্পলোকের অনেকগুলো উদ্ভবের একটি, যার হাত ধরে উত্থান হয় সৌন্দর্যপুরাণের। নারীর মনন এই কৃত্রিম সৌন্দর্যবোধে বন্দি রাখার ব্যবস্থাও সৌন্দর্যপুরাণের একটি অংশ। এসবের পাশাপাশি সে-সময় একধরনের সংস্করণ দ্বারা নারীত্বের ধারণাকে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, তা হলো শৈশবে মায়ের নিরবচ্ছিন্ন তত্ত্বাবধান। আরও একটি ধারণা হলো যৌনত্বে নির্লিপ্ত থাকা নারীত্বের সৌন্দর্য। যৌনানুভূতির প্রতি সচেতনতা কিংবা যৌনত্বে আকর্ষণ যেন নারীর জন্য ভীষণভাবে সম্মানহানিকর ব্যাপার। নারী তার কাজের পরিসর সীমাবদ্ধ রাখবে একঘেয়ে, সময়সাপেক্ষ এবং বেদনাদায়ক সেলাই-জাতীয় হাতের কাজে। কিন্তু মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীদের ফ্যাশন এবং অ্যামব্রয়ডারির সৃষ্টিশীলতা এবং শিশু লালন-পালন সত্ত্বেও এক শতাব্দী পরে মফস্বলী গৃহবধূর ভূমিকা (যারা এই জাতীয় সামাজিক কল্পরূপকে বাসত্মবে রূপ দিয়েছে) তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার পরে এর প্রধান উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয়। দেড় শতাব্দীর অভূতপূর্ব নারী-আন্দোলন মধ্যবিত্ত নারীদের এই অধুনালব্ধ অবকাশ, সাক্ষরতা এবং বস্ত্তগত বাধ্যবাধকতা থেকে আকস্মিক মুক্তিলাভ কার্যকরভাবে এগুলোর পালটা জবাব দেয়। কিন্তু নারী-আন্দোলনের দ্বিতীয় ধারায় নারী-পত্রিকাগুলোতে গৃহসজ্জা এবং মফস্বলী পারিবারিক জীবনের ‘রোমান্স’, ‘বিজ্ঞান’ এবং ‘অ্যাডভেঞ্চার’গুলোর চিত্রায়ণকে নিজেদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে তখন সাময়িকভাবে এরা ব্যর্থ হয়। তথাকথিত ‘একত্রে থাকা’র অরুচিকর গার্হস্থ্য ফিকশন এর অর্থ হারিয়ে ফেলে এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা সামনের দরজা দিয়ে একযোগে হেঁটে বেরিয়ে আসে।
সুতরাং ফিকশনগুলো সরাসরি আরো একবার রূপামত্মরিত হয়। এসব ফিকশন পুরোমাত্রায় ছড়িয়ে পড়া সামাজিক নিয়ন্ত্রণের সব শর্ত ভেতরে থেকে শেষ অবলম্বন হিসেবে িআঁকড়ে ধরে ‘সৌন্দর্যপুরাণ’কে। এটি মুক্তিকামী নারীর মুখশ্রী ও শরীরের সীমাবদ্ধতা, দমনমূলক আইন তৈরি, ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা এবং প্রজন্মগত দাসত্বকে পুনঃআরোপিত করে। অশেষ কিন্তু স্বল্পস্থায়ী সৌন্দর্যকর্ম অসীম কিন্তু স্বল্পস্থায়ী গৃহস্থালি কাজের জায়গা দখল করে নেয়। একযোগে অর্থনীতি, আইন, ধর্ম, যৌন রীতিনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি নারীকে একধরনের মেয়েলি সচেতনতায় বন্দি করে ফেলে।
সৌন্দর্যের ধারণাকে ব্যবহার করে পিতৃতন্ত্র নিজস্ব আইন, অর্থনীতি, ধর্ম, যৌনতা, শিক্ষা এবং সংস্কৃতি দিয়ে পুনঃনির্মাণ করেছে একটি বিকল্প মেয়েলি জগৎ। এই উপাদানগুলো প্রত্যেকটি আগের চেয়ে বেশি দমনমূলক হয়ে ওঠার কারণে পশ্চিমা মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারীরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল হয়েছে এই ভেবে যে, বস্ত্তগতভাবে এখন তারা পুরুষের মনোরঞ্জনে বেশি শক্তিশালী। গত প্রজন্মে সৃষ্ট কনসেপ্ট ‘সৌন্দর্যপুরাণ’ বর্তমানে অতীতের চেয়ে বেশি প্রযুক্তিগত সূক্ষ্মতা এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিমত্তা অর্জন করেছে। এই মিথ ইদানীংকার প্রচলিত আদর্শের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও এই বিষয়টিকে সাধারণত একটি সমষ্টিগত যৌন ফ্যান্টাসি হিসেবে দেখা হয় কিন্তু এর মধ্যে খুব কমই যৌনতা রয়েছে। নারী-স্বাধীনতা দ্বারা হুমকিপ্রাপ্ত পুরুষ আধিপত্যবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা একত্রিত হয়েছে এবং আমাদের নিজস্ব মুক্তির বিরুদ্ধে মেয়েলি অপরাধবোধ এবং ভীতিকে ব্যবহার করছে। এই ভীতি সুপ্ত, নারীরা শঙ্কিত থাকে যে, তারা হয়তো সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রক্ষিপ্ত চিত্রকল্প একটি সমষ্টিগত প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভ্রম, যা নারী এবং পুরুষ উভয়ের দ্বারা বাসত্মবরূপ লাভ করেছে। কিন্তু দ্রম্নত রূপামত্মরিত লিঙ্গ সম্পর্কের এই ফাঁদ তাদের মধ্যে বিমূঢ়তা ও বিভ্রামিত্ম এনে দিয়েছে। আধুনিক নারীরা তাদের কর্মজীবন, স্বাধীন চলাচল, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ইত্যাদিকে যেভাবে প্রকাশ করছে তা জোগান দিচ্ছে এক অর্থে ‘সৌন্দর্য’ নিয়ে তাদের নতুন বিস্ফোরক ভাবনা। সৌন্দর্য ধ্বজাধারী হিসেবে আধুনিক নারীর এই একচেটিয়া প্রকাশকে পরস্পরবিরোধী বলা যায়। কেননা, একদিকে আধুনিক নারী ক্রমবৃদ্ধিশীল, সচল এবং তাদের স্বাতন্ত্র্যতাকে প্রকাশ করছে অন্যদিকে সংজ্ঞানুযায়ী ‘সৌন্দর্যপুরাণ’ নিষ্ক্রিয়, সময়-নিরপেক্ষ এবং শ্রেণিগত। যদিও এই দৃষ্টিবিভ্রম পুরুষের কাছে প্রয়োজনীয় এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিন্তু ‘সৌন্দর্য’ সরাসরি নারীর প্রকৃত অবস্থার সঙ্গে খাপ খায় না।
বর্তমানে সচেতনভাবে পুঁজিবাদী বাজার নারীদের নিজ স্বার্থে ব্যবহার করার কারণে এই অসচেতন বিভ্রামিত্ম অতীতের যে-কোনো সময়ের চেয়ে আরো বেশি প্রভাবশালী এবং সর্বগ্রাসী রূপ লাভ করেছে। বিপুল প্রভাবশালী বিশ্ববাজারের শিল্পকারখানায় বছরে তিন হাজার তিনশো কোটি ডলারের ডায়েট শিল্প, দুই হাজার কোটি ডলারের প্রসাধনী শিল্প, তিরিশ কোটি ডলারের কসমেটিক সার্জারি শিল্প এবং সাতশ কোটি ডলারের পর্নোগ্রাফি শিল্প এখন বাসত্মবতা। অসচেতন উদ্যোক্তাদের থেকে তৈরি হওয়া এই শিল্প ও বিনিয়োগ নতুন পুঁজি সৃষ্টি করছে এবং মানব-সংস্কৃতিতে এর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আর এই উদীয়মান অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য সৌন্দর্যপুরাণের ভ্রামিত্মকে ব্যবহার করেই গড়ে উঠেছে। মানুষকে পণ্যায়িত করার বিরাজমান বাজার অর্থনীতির বিপুল প্রভাব এই মিথকে আরো প্রণোদিত ও শক্তিশালী করেছে।
এটা কোনো ষড়যন্ত্রমূলক তত্ত্ব নয়, হওয়ার কথাও নয়। একজন ব্যক্তি এবং পরিবারের মতো সমাজও প্রয়োজনীয় ফিকশনগুলোর কথা বলে। হেনরিক ইবসেন এগুলোকে ‘অপরিহার্য মিথ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মনসত্মত্ত্ববিদ ড্যানিয়েল গোলম্যান একে বর্ণনা করেছেন, এগুলো পারিবারিকভাবে যেমন ঠিক, তেমনি সামাজিক সত্মরেও কাজ করে : ‘এই গোপন চুক্তিগুলো ভীতিকর বাসত্মবতা থেকে মনোযোগ সরাতে অথবা একটি গ্রহণযোগ্য আকারে এর অর্থগুলো পুনঃআলোচনা করার জন্য রক্ষা করা হয়ে থাকে।’ তিনি বলেন, এসব সামাজিক অন্ধ দাগগুলোর পরিণতি হলো বিধ্বংসী গোষ্ঠী বিভ্রম। নারীদের সম্ভাবনার দ্বার এত বেশি একাধিক সম্ভাব্য সমাধানের দিকে এগিয়ে গেছে যে, তারা পুরুষ আধিপত্যবাদী সংস্কৃতি যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করে, তা অস্থিতিশীল করে দিয়েছে এবং নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রে একটি সামষ্টিক ভীতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। নারীদের জন্য উদ্ভূত এই বিভ্রামিত্মর বাসত্মবায়ন খুব বেশি যেন বাসত্মব। এটা এখন আর কোনো ধারণা নয়, এটা ত্রিমাত্রিক হয়ে উঠেছে; এই কনসেপ্ট এই প্যাকেজ সরবরাহ করছে যে, কীভাবে নারীদের বাঁচতে হবে এবং কীভাবে নয় : এটা যেন একটি লৌহমানবী, আদি লৌহমানবী ছিল মধ্যযুগের জার্মানদের নির্যাতন যন্ত্র, শারীরিক আকৃতির একটি কাঠামো, যার ওপর রং করে বাহু এবং একটি চমৎকার হাস্যমুখর নারীর অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হতো। দুর্ভাগা শিকারকে ধীরে-ধীরে এই কৃত্রিম মানবীর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো; শিকারকে চলৎশক্তিহীন করার জন্য সবগুলো ঢাকনা বন্ধ করে তাকে অনাহারে অথবা তার শরীরে ধাতব কাঁটাগুলো ঢুকিয়ে মেরে ফেলা হতো। সৌন্দর্যপুরাণের আধুনিক এই ভ্রামত্ম বিশ্বাস অনেকটা এই লৌহমানবীর মতো একটি ফাঁদ অথবা বলা যায় মেয়েরা এই ফাঁদে নিজেদের আটকেছে যা একই রকম অনমনীয়, নিষ্ঠুর, সুভাষণ দ্বারা রং করা। সমসাময়িক সংস্কৃতি লৌহমানবীর প্রতিচ্ছবিকে আদর্শ মনে করে যা সত্যিকারের নারীর চেহারা, শরীরকে কাটছাঁট করে ফেলে। কেন সামাজিক এই বিন্যাস নারীর চেহারা, কণ্ঠস্বর এবং শরীরের সত্যিকার বাসত্মবতাকে এড়িয়ে নিজেকে এই ভ্রামিত্মর হাতে সঁপে দিয়েছে? যদিও অসচেতন ব্যক্তিগত উৎকণ্ঠাগুলো একটি অপরিহার্য মিথ্যা তৈরিতে একটি শক্তিশালী উৎস হিসেবে কাজ করে তবে বাসত্মবে অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা একে নিশ্চিত করে। একটি অর্থনীতি যা দাসত্বের ওপর নির্ভরশীল তার দরকার দাসদের একটি কৃত্রিম প্রতিচ্ছবিকে উৎসাহিত করা, যা দাসত্বের প্রতিষ্ঠানকে ন্যায্যতা দেবে।
আজকাল পশ্চিমা অর্থনীতিতে নারীকে কম মজুরি দেওয়া রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি এমন একটি রীতি, যা নারীকে নিজের কাছে মূল্যহীন করে দেয়, ব্যর্থ করে দেয় আশু প্রয়োজন; এভাবে নারীবাদ মেয়েদের আরো বেশি নিজেদের কাছে নিজেকে মূল্যবান ভাবতে সাহায্য করবে। এজন্য কোনো ষড়যন্ত্রের দরকার নেই, একটি আবহের প্রয়োজন মাত্র। বর্তমানে সমসাময়িক অর্থনীতি সৌন্দর্যপুরাণের ভেতরে নারীদের প্রদর্শনকে ন্যায্যতা প্রদান করছে। ‘গৃহসজ্জা’ একটি ‘স্বর্গীয় আহবান’ – এই দৃষ্টিভঙ্গির অনড় অবস্থানকে অর্থনীতিবিদ জন কেনেথ গলব্রিথ একটি অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন : তিনি মনে করেন, মেয়েলি গূঢ় মাহাত্ম্যের ফাঁদে আটকেপড়া নারী সম্পর্কে ধারণা, ‘জনপ্রিয় সমাজতত্ত্ব, পত্রিকাগুলো এবং ফিকশন দ্বারা নারীদের এই বাসত্মবতার ছদ্মবেশ ধারণ করতে বাধ্য করেছে, আমাদের শিল্পভিত্তিক সমাজের বিকাশের ভোক্তা হিসেবে নারীর ভূমিকা অপরিহার্য… অর্থনৈতিক কারণে যে আচরণ অপরিহার্য তা পরবর্তীকালে সামাজিক মূল্যবোধে রূপামত্মরিত হয়েছে।’ যখন নারীদের প্রাথমিক সামাজিক মূল্য এবং তথাকথিত মূল্যবোধসম্পন্ন গার্হস্থ্যায়ন অর্জন দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না, তখন সৌন্দর্যপুরাণ দ্বারা মূল্যবোধসম্পন্ন সৌন্দর্য অর্জনকে পুনঃসংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে একটি নব্য ভোক্তা আইন এবং কর্মক্ষেত্রে অর্থনৈতিক শোষণের একটি ন্যায্যতা প্রদানের বিকল্প হিসেবে, যেখানে পুরনো কেচ্ছা সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত নারীদের ওপর তার দখল হারিয়েছে। লৌহমানবী ধারণার সঙ্গে আর একটি ভ্রামত্ম বিশ্বাস যোগ করা হয় : নারী-আন্দোলনকে নিরুৎসাহিত করার জন্য কুৎসিত নারীবাদীর ক্যারিকেচার পুনর্জাগরিত করা হয়। ক্যারিকেচার বা ব্যঙ্গচিত্রটি কৃত্রিম; এটি ঊনবিংশ শতকের নারীবাদীদের উপহাস করার জন্য করা হয়েছিল। লুসি স্টোন, যাঁকে তাঁর সমর্থকরা ‘মেয়েলি মাধুর্যের মূলরূপ… সকালের মতো তাজা এবং সুন্দর’ হিসেবে দেখত, তাঁকে নিন্দুকেরা উপহাস করে ভিক্টোরিয়ান নারীবাদীদের সঙ্গে তুলনা করে : ‘একজন দশাসই পুরুষালি নারী, বুটজুতা পরিহিতা, ঠোঁটে সিগারেট, সৈনিকদের মতো অবিরাম গালিগালাজ দিচ্ছে।’ পুরনো ব্যঙ্গচিত্রটির বর্বর পুনর্গঠনের আগেই, বেটি ফ্রিডান, ১৯৬০ সালে ভবিষ্যৎদর্শিতার সঙ্গে বলেন, ‘আজকালকার নারীবাদীদের অপ্রীতিকর প্রতিচ্ছবি সত্যিকারের নারীবাদীদের মতো না দেখালেও এই ইমেজটি তাদের আগ্রহে লালিত হয় যারা অত্যমত্ম তিক্ততার সঙ্গে প্রদেশের পর প্রদেশ জুড়ে নারীদের ভোটাধিকারের বিরোধিতা করে।’ তিরিশ বছর কেটে গেছে, তাঁর সিদ্ধামত্ম বা মতামত কালাতীত সত্য : এই পুনর্জাগরিত ব্যঙ্গচিত্র যা নারীদের ব্যক্তিগত আত্মোপলদ্ধি পাওয়ার জন্য নারীকে সর্বত্র বিচরণের আকাঙক্ষায় একটি নতুন সীমা নির্ধারণের উদাহরণ। নারী-আন্দোলনের দ্বিতীয় ধারার সাফল্যের পর, ব্যক্তি নারীর জীবনের প্রতিটি সত্মরের ক্ষমতা বানচাল করে দেওয়ার জন্য নারীদের মধ্যে সৌন্দর্যপুরাণের ধারণাকে আমূল বসিয়ে দেওয়া হয়। মেয়েলি শরীর নিয়ে জীবনের আধুনিক সণায়ুবৈকল্য নারী থেকে নারীতে মহামারির আকারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ধীরে-ধীরে বুদ্ধির অগম্য পারে ক্ষয়ের মূল শক্তি সম্পর্কে সচেতন না হয়েই এই মিথটি দীর্ঘ মর্যাদাপূর্ণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে কর্মজীবী নারীরা যা অর্জন করেছিল তা ক্রমশ দুর্বল করে দেয়।
এখন পর্যমত্ম যত মেয়েলি গূঢ় মাহাত্ম্যের ধ্বজা তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে বর্তমানের সৌন্দর্যপুরাণ অলক্ষেতে সবচেয়ে অনিষ্টকর; এক শতাব্দী আগে, ডলস হাউসের নোরা ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল; এক প্রজন্ম আগে, নারীরা ভোক্তা হিসেবে বিবেচিত বিচ্ছিন্ন গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত বহুবিধ ছোটখাটো যন্ত্রপাতি সজ্জিত বাড়ির দিকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করেছে; কিন্তু বর্তমানে নারীরা যে-ফাঁদে বন্দি হয়েছে সেখানে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনো দরজাই আর খোলা নেই। সৌন্দর্যপুরাণের ক্ষতিকর প্রভাব নারীদের শারীরিকভাবে ধ্বংস করছে এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। যদি আমরা ওজনের এই মরণকামড় থেকে নিজেদের মুক্ত করতে চাই যা আরো একবার মেয়েলিত্বের ধারণা থেকে তৈরি করা হয়েছে, তাহলে ব্যালট নয় অথবা তদবিরকারী বা পস্ন্যাকার্ড নয়, নারীদের জন্য প্রথমে যা প্রয়োজনীয় বা দরকার তা হলো নতুনভাবে দেখতে শেখা।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.