স্বাধিকার

অগ্রহায়ণের শুরু। মাঠের ফসল উঁচু খামারে উঠতে শুরু করেছে। ঝাড়া-মাড়াইয়ের পরে সেই সম্পদ কয়েকদিন গেলেই গোলায় উঠবে। মুন্না ছোটখাটো চাকরি করে। সকালে বের হলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়। তাই বিঘেদুই জমি থাকলেও মাঠে যাওয়ার সুযোগ পায় না, যদিও জীবনের মূলস্রোতে সে চাষিবাড়ির ছেলে। তাই কি অগ্রহায়ণ এলেই মনের পরতে পরতে এতো বেশি খুশির আমেজে ভাসে ও? এও জানে, কয়েকদিন পরে বাঙালির ঘরে ঘরে নবান্নের আনন্দ-আয়োজন শুরু হবে।

চাকরিজীবী বলেই মুন্নার জীবন দৈনন্দিন রুটিনে আবদ্ধ। সবুজের মাখামাখি গ্রহণ করতে চাইলেও কিছুতেই তা সম্ভব হয় না। কলকাতার অফিসে ডি-গ্রুপের কর্মী। সকাল আটটা হলেই কর্মস্থলে যাওয়ার তাড়না শুরু হয়। সেই ব্যস্ততা চড়চড় করে বেড়ে আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে হাতঘড়িতে নটা বাজলেই। মুখে দুটো দিয়ে অটোতে চেপে বসে মথুরাপুর স্টেশনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা। নটা চল্লিশে ট্রেন। তাকে ধরতেই হবে। ফেল করলে সেদিনের মতো অফিস যাওয়া বন্ধ। টানা দশ বছর এমনি জীবনযুদ্ধের সঙ্গে চলতে চলতে বেশ মানিয়ে নিতে পেরেছে সে। অফিসের বড়বাবু কোনোদিন তার বিরুদ্ধে আঙুল তুলতে পারেননি দেরিতে কর্মস্থলে ঢোকার জন্যে।

সপ্তাহে ছটা দিন এমনি করেই চলে। অফিসের কাজে নিজেকে কলুর বলদ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারে না মুন্না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে সন্ধের পরে বাড়িতে ফিরলে দেহ-মনে নেতিয়ে পড়ার অবস্থা। এমনকি নিশ্বাস নিতে নিতে ইন্নার সঙ্গে কথা বলতে মন চায় না। এ নিয়ে ইন্নার মধ্যেও অন্য বিরক্তি ছিল। দুজনের সম্পর্ক শুধু পেটপূরণের জন্যে নয়, আরো অনেক কিছু। কিন্তু উপভোগের সেই অবস্থান নেই। কেবল রোববার সেই সুযোগটুকু এনে দেয়। চেটেপুটে শেষ করার তালে থাকে ইন্না।

মাসের শেষ শুক্রবার। একটু আগে সন্ধে নেমেছে বাড়ির পাশে ঢাউস মাঠে। মুন্না তখনো বাড়িতে ঢোকেনি। এতো দেরি হচ্ছে কেন? প্রশ্নের অশরীরী স্রোতে উতলা হলো ইন্না। অবশ্য মাঝে মাঝে এমনি করেই দেরিতে ফেরে। দেয়ালঘড়িতে চোখ রেখে দেখল, সাতটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আগে কোনোদিন এতো দেরি করেনি। একটু পরে মুন্না অন্ধকার ফুঁড়ে ইন্নার সামনে এসে দাঁড়াল।

এতো দেরি করলে যে?

সে অনেক কথা।

ট্রেন ফেল করোনি তো?

অফিসের কাজে ভীষণ লোড ছিল। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সেরে ওঠা সম্ভব হয়নি। সময়ের ট্রেন তো আমার জন্যে অপেক্ষা করতে পারে না।

ইন্না বুঝল বিলম্বের কারণ। হেঁসেলের দিকে যেতে যেতে তার পাঁচফোঁড়ন, এভাবে কতদিন চলবে শুনি? চেহারায় কালি পড়তে শুরু করেছে।

ঘুরিয়ে মুন্নার প্রশ্ন, আবার কালিঝুলি কোথায় দেখলে? বেশ তো রোজ যাচ্ছি-আসছি।

মানুষের শরীর তো লোহার ইঞ্জিন নয়, শুরু করে দিলেই চলতে থাকবে।

তোমার কথাটা প্রবাদ বাক্যের মতো।

যা খুশি ভাবতে পারো।

মুন্না আর কথা বাড়াল না। নরম বিছানায় শরীর মেলে দিতে মন চাচ্ছে; কিন্তু এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটাও তোয়ালে খুঁজে পাচ্ছে না। বাড়িতে দু-তিনটি তোয়ালে, গেল কোথায় সেসব? দূর থেকে ঢিল ছোড়ার মতো করে বলল, শুনছ ইন্না?

হ্যাঁ, বলো।

একটাও তোয়ালে খুঁজে পাচ্ছি নে।

আলনার বামদিকে রেখেছিলুম।

ও, পেয়েছি।

একটু চোখ খুলে দেখবে তো।

মুন্না প্রত্যুত্তর দিলো না।

হেঁসেলে ইন্না জোয়ারের স্রোতের মতো মুন্নার টিফিন তৈরিতে ব্যস্ত। এই সময়ে তাকে একটু ভারী টিফিন দিতেই হয়, আজ আবার অনেকটা সময় দেরি করে বাড়িতে ফিরেছে। ইন্না বোঝে, পেটের খিদে হ্যাঁচকা টান দিলে মেজাজ অকারণে খিটখিটে হয়ে যায়। তার এ-অভিজ্ঞতা হয়েছে মুন্নাকে দেখেই। বাড়িতে ফিরলে একেবারে অন্য মানুষ। সবকিছুতেই বিরক্তি। টিফিন তৈরির মাঝে এক টুকরো স্মৃতির ছবি ভাসছে ইন্নার মনের ইজেলে। টানা পাঁচ বছর মন আর মননের ভাঁজে ভাঁজে মুন্নাকে নিয়ে ইন্নার মানসিক চর্চা সত্যি সত্যি অনেকখানি শিল্প পর্যায়ে চলে গেছে। স্বামীকে শিল্পী ভাবতে পারলেই তো ভালোবাসার নিভৃত পর্যায় আপন নিয়মে শিল্পসম্মত হয়ে ওঠে। রোববার এলেই সেসব বেশ টের পায় ইন্না।

অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকে না মুন্নার। ভিড় ঠেলে ট্রেনের হ্যাপা সামলানোর অবস্থান নেই। একেবারে মুক্ত বাতাবরণ। একদিনের অঢেল সময়ে ইন্না মাঝে মাঝে ব্যস্ত হয়ে ওঠে অচেনা মুন্নাকে খুঁজে পেতে। মুন্নাও জানে ইন্নাকে কীভাবে উপযুক্ত সংগত দিতে হয়।

রোববারের নতুন সকালে মুন্না শুয়ে ছিল ইন্নার পাশে। বাইরে জাঁকানো শীত। মুন্নার গায়ে ঠেলা দিয়ে ডাকল, এ্যাই, ওঠো না, বেলা তো অনেক হলো।

বড় হাই তুলে মুন্না জামা পরে তার ওপর সোয়েটার চাপিয়ে উঠোনের এক ধারে মিঠে রোদে ইজিচেয়ারে জাঁকিয়ে বসল। হাতে খবরের কাগজ, দু-চোখ শব্দের মেলায়। রাজনীতি, সমাজ, খেলা, উপভোগ করার মতো অবস্থান। শীতের জড়তায় রয়েছে আমেজ উপভোগের কম্পন। প্লেটে কয়েকটা ভালো বিস্কুট আর চায়ের কাপ নিয়ে মুন্নার সামনে এসে দাঁড়াল ইন্না। তখনো সংবাদের গভীরে ডুবে ছিল মুন্না। ইন্নার দু-ঠোঁটের ফাঁকে মিষ্টি হাসি, চাপা বাঁকা মন্তব্য, অতো ডুবে থেকে গরম চায়ের আমেজ নষ্ট করো না গো।

উঠোনের মাঝে শিশিরস্নাত কুমড়োগাছের পাতায় পাতায় সোনালি মিষ্টি রোদের ঝলমলানি। উজ্জ্বল কিরণ ছড়িয়ে সূর্যিমামা জড়তাভঙ্গের কারুকার্যে উদ্বেল। পৃথিবীর প্রাচীনতম বন্ধু। মুন্নার দু-চোখ ফলফলে কুমড়ো গাছের দিকে। শিশিরে ভিজে আর সূর্যের সাতরঙে পাতাগুলোতে মনোরম দৃশ্য তৈরি হয়েছে।

অমন দু-চোখ ভরে কী দেখছ গো? ইন্নার প্রশ্ন।

রোদের বাহারে পাতাগুলো কী সুন্দর লাগছে।

তোমাকে ভোররাতে এই কুমড়ো গাছটার কথাই তো বলছিলুম। তখন কান দিলে না, আমাকে নিয়ে শুধু শুধু -। ডগায় ডগায় কত ফুল ফুটেছে দ্যাখো। আরেকটু যত্ন নিতে পারলে বোধহয় অনেক ফল পেতে পারি।

এতোদিন এসব বলোনি কেন?

সকালে বের হয়ে রাতে ফিরলে দেখার সুযোগ কোথায়? আজ রোববার বলে একটু সময় পেলে বলেই তো -।

মুন্নার দু-চোখ ইন্নার দিকে। দু-ঠোঁটের ফাঁকে অদ্ভুত হাসি। সারাদিন এমনি দিগন্তহীন মন নিয়ে দুজনে দিব্যি হারিয়ে যায়। প্রতি রোববার সকালে এমনি খুনসুটি শুরু হয়, চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

ইন্নার লজ্জাজড়ানো প্রশ্ন, অমন হাসছ যে?

ফলফলে গাছ দেখালে, যত্নের কথা বললে, সেজন্যে আমার করণীয় জানতে পারি কি?

কতটা জায়গা নিয়েছে দ্যাখো।

তা তো দেখতেই পাচ্ছি।

ভেতরে ঘাসের দঙ্গল তৈরি হয়েছে। তুলে দিতে পারলে ভালো হয়। একটু সার-ওষুধ দেওয়া খুব প্রয়োজন। তাহলে আরো বেশি ফলফলে হয়ে উঠতে পারে।

তুমি তো সারাদিন বাড়িতে থাকছ, একটু একটু করে সাফ করে দিতে পারছ না কেন?

বড় ভয় করে।

এতে ভয়ের কী আছে?

যদি শিকড়-বাকড়ে টান পড়ে, যদি গাছটার কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। দেখতে দেখতে বড় মায়ায় পড়ে গিয়েছি গো। তুমি কী পারো না রোববারের অবসরে একটু করে হাত লাগাতে? জানো  তো,  পরিষ্কার  হয়ে  গেলে  কুমড়ো  গাছটা  আরেকটু হাত-পা মেলার সুযোগ পাবে। রাতবিরেতে বাড়ির সামনে দঙ্গল থাকাও ঠিক নয়। সাপখোপ থাকতে পারে। আরো অনেক কিছু। ভয়ে একটা প্রসঙ্গ তোমাকে বলতে পারিনি। কদিন আগে মাঝরাতে জেগে উঠে বারান্দা পার হতে হতে ওই দঙ্গলের ভেতরে হিস্ হিস্ শব্দ শুনেছি, খুব ভয়ও পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল বিষাক্ত সাপ ফোঁপরানি ছাড়ছে।

তাহলে কি সাফের জন্যে লোক লাগাতে হবে?

কী যে বলো তুমি?

কিছু ভুল বললুম?

তা হয় না গো।

কেন বলবে তো?

ইন্না নিরুত্তর।

মুন্না চেয়ে থাকল ইন্নার মুখের দিকে। মনোলোকে ভিন্ন চিন্তার বিস্তার। কী বলতে চাচ্ছে মেয়েটা? সপ্তাহে মাত্র একটা রোববার, আমাকে দিয়ে সেই সময়টুকু ব্যয় করতে চাচ্ছে দঙ্গল পরিষ্কারের কাজে? কী বাড়াবাড়ি শুরু করল মেয়েটা? যা খুশি তাই বলছে?

ইন্নার স্বগতোক্তি, বুঝতে পারছি, আমার কথা শুনে তুমি অন্য কিছু ভাবছ। কেন ভাবতে পারছ না যে, অন্যের আনাড়ি হাতে শিকড়-বাকড় কাটা পড়তে পারে। ফলফলে কুমড়ো পাতার সৌন্দর্য উপভোগ করবে, অথচ এতোটুকু মূল্য দিতে চাইবে না? তাহলে কী আমাকেই লাগতে হবে?

ইন্নার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। মুন্নার মনের গভীরে পুলকের বিস্তার। আরেকটু পরে নিড়ানি হাতে লেগে পড়তেই ঘাসের দঙ্গল পরপর সাফ হতে থাকল। কুমড়ো গাছের ফলফলে পাতা সাত রঙের রোদে নতুন রূপে শিল্পিত হয়ে উঠছে। দেখতে দেখতে ইন্না নিজেকে আরো রাঙিয়ে তুলতে পারছে। ভেতরের বাসনার কূলে কূলে শুধুই মুন্নার উপস্থিতি।

সেই তাৎক্ষণিক আবেগ হঠাৎ থমকে গেল গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান বাবুলাল মারাণ্ডির অকস্মাৎ উপস্থিতিতে। মুন্নার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেক পুরনো। শুধু মুখে মুখে নয়, মনের গভীর উদ্বেলতায়ও। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে মারাণ্ডির আন্তরিক জিজ্ঞাসা, বাড়িতে আছে তো মুন্না?

এই তো দাদা, ঘাসের দঙ্গলে হাত ঢুকিয়ে বসে আছি।

শেষ পর্যন্ত লাগতেই হলো?

সম্রাজ্ঞীর হুকুম।

বাড়িতে পুরুষরা এভাবেই দুর্বল।

নেপথ্যের ঠিক কথাটা ধরতে পেরেছ দাদা।

কিন্তু রোববারেই লেগে পড়তে হলো কেন?

না হলে যে মনের মৌতাতে ঘাটতি পড়তে পারে।

মারাণ্ডি হো হো শব্দে হেসে উঠল। মুন্না যোগ না দিয়ে পারল না। দুজনেই জানিয়ে দিতে পারল যে, নারীর মোহিনীরূপের মোহমুগ্ধতায় পুরুষের এ-দুর্বলতা চিরকালীন।

ইন্না এতোক্ষণ হেঁসেলের নানা কাজ সারতে ব্যস্ত ছিল। তাকে উদ্দেশ করে মুন্না বলল, মারাণ্ডিদা এসেছে -।

দেখতে পেয়েছি।

চা করে দাও, সঙ্গে ক্রিমক্যাকার বিস্কুট দিও।

ইন্না তখনো রান্নাঘরে ঠায় দাঁড়িয়ে মুখ গুম করে। মারাণ্ডি আসার ফলে ক্ষতির বহরটা ভালোমতোই বুঝতে পারছে। দুজনের মধ্যে গভীর সম্পর্ক, একবার গল্পে মজে গেল কিছুতেই উঠতে চাইবে না।

অমন দাঁড়িয়ে থাকলে যে?

ইন্না জানালার ফাঁক দিয়ে দু-চোখ বড়ো করে আরেকবার দেখে নিল দঙ্গল সাফের জায়গাটুকু। কুমড়ো পাতাগুলোর সৌন্দর্য অনেকখানি বেড়ে গেছে। সূর্যের সোনালি আলোয় সেই দৃশ্য সত্যি মনোমুগ্ধকর। অনুশীলন সেরে ব্যায়ামবীর বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে যেভাবে বীরত্ব প্রকাশ করে, রোদের ঝলকানিতে কুমড়ো ডগাগুলোকে তেমনি প্রতিস্পর্ধী মনে হচ্ছে।

চা-বিস্কুট খেতে খেতে মারাণ্ডি দরকারি কথাগুলো সেরে ফেললেন। ব্যস্ত মানুষ। সময় কম। বসে বসে শুধু গল্পের মহড়ায় সময় ব্যয় করার অবকাশ তাঁর জীবনে নেই। চলে যাওয়ার সময় শুধু বললেন, যে-কোনো মূল্যে কাজটা সারতে হবে।

মুন্নার মুখে হাসি, ঠিক রোদঝলমলে কুমড়ো পাতার মতো।

মারাণ্ডি বললেন, তাহলে আসছি রে –

যেতে বলতে পারি কি?

শুধু শুধু ভনিতা করিস নে।

মুন্নার একগাল হাসি। সম্পর্কের পুলকমিশ্রিত প্রমাণের এক টুকরো ছবি।

মারাণ্ডি হাঁটতে শুরু করলেন। ইন্না এসে দাঁড়াল মুন্নার সামনে। একটাই প্রশ্ন, ওইটুকুন সারতে কদিন লাগবে শুনি? মারাণ্ডির সঙ্গে এতো কথা না বললে কী মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত?

প্লিজ, এভাবে রাগ করো না। পরের রোববার ঠিক সেরে দেব।

তাহলে আরেকটা অনুরোধ রাখতে হবে।

কী শুনি?

আগে রাখবে বলো?

দেরি করার জন্য জরিমানা?

ধ্যাৎ, কী যে বলো তুমি!

তাহলে কী বলতে চাচ্ছ বলো?

একটা পরিকল্পনা মনে পড়েছে।

সেটাই বলো।

কাল-পরশু অফিস থেকে ফেরার পথে এক কেজি ডিএপি কিনে আনলেই হলো।

কেন?

কুমড়ো গাছের গোড়ায় দেব।

একেবারে অভিনব ইচ্ছা।

ভাবছি, নিড়ানির পরে সার-ওষুধ দিলে দু-চারটে বেশি ফল পাওয়া যেতে পারে।

ম্যাডামের ইচ্ছা সবসময় লাভের দিকে।

সংসারের কথাটা ভাবতে হবে তো।

কথায় কথায় বেলা অনেক হলো, রোববারের ভারী টিফিনটুকু কই?

ইন্নার ঠোঁটে মিষ্টি হাসি। সে জানে, সপ্তাহের ছটা দিন কাজের জাঁতাকলে আটকে মুন্না শুধু হাঁসফাঁস করে না, মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে ওঠে। তাই রোববার এলে এভাবেই অতিরিক্ত অক্সিজেনটুকু সংগ্রহ করে নিতে চায়। স্বীকার করতে কোনো বাধা নেই যে, তাতেই মুন্নার দেহ-মনের ঘাটতি পূরণ অনেকখানি সম্ভব হয়ে ওঠে। মুন্নাও জানে, ইন্নার প্রাত্যহিক পরিচর্যা তার কাছে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যাপিত জীবনে মনের অনুষঙ্গে উদ্দীপনার নিহিত তাৎপর্য এমনিই। তাই সোমবার সকাল হলেই ধীরলয়ে মুন্নার জীবনে অপেক্ষার মনন-পর্ব শুরু হয়। একটি করে দিন পার হয়ে যায়। অপেক্ষায় থাকার ঘনত্ব বাড়তে থাকে। শনিবারের সন্ধেয় তার অবসান ঘটে।

পরদিন সকালে দেরিতে ঘুম থেকে ওঠার ফলে মুন্নার জীবন ব্যস্ততার সমুদ্র হয়ে উঠল। কয়েকটা জামা-প্যান্ট ইস্ত্রি করে নিতে হবে। তাতেই সারা সপ্তাহ চলে। তখনো শেভ করা হয়নি। তা দ্রুত শেষ করতে হবে। দেয়ালঘড়িতে নটা বাজার ঢং শব্দ শুনতে পেল মুন্না। প্রস্তুতিও প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। দ্রুততার সঙ্গে জামা-প্যান্ট পরছে মুন্না। ইন্না সামনে এসে বলল, হ্যাঁ গো, আজ কি সার ও ওষুধ কিনে আনবে?

কাল-পরশু হলে কেমন হয়?

যত দেরি করবে ততই ক্ষতি।

তাহলে কী আজকে কিনে আনতেই হবে?

কুমড়ো গাছটার ওপর খুব মায়া পড়েছে গো।

মুন্নার মুখে হাসি। একটা অদ্ভুত মেয়েকে নিয়ে ঘরসংসার করতে হচ্ছে। কোনো কিছু নিয়ে গোঁ ধরলে থামানো মুশকিল। এখন শুরু করেছে কুমড়ো গাছের যত্ন নেওয়া নিয়ে নিজস্ব সদিচ্ছার বায়নাক্কা। অবশ্য সবটাই সংসারের কল্যাণে। সেই কারণে ইচ্ছা না থাকলেও মুন্না কখনো না করতে পারেনি। দুজনের হৃদয়-বন্ধনকে আরো সুদৃঢ় করার তাগিদও ছিল এমনি ছোটখাটো অনুষঙ্গের মধ্যে।

সেদিন অফিসে গিয়ে মুন্না যে তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতা লাভ করল, তাতে হাঁপিয়ে না উঠে পারল না। ইলেকশন আর্জেন্ট, তাই অফিসের কেউ না বলতেও পারল না। বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত গো-খাটুনির পরে মুক্তি পেল মুন্না। আরো আধঘণ্টা গেল শিয়ালদহে  আসতে।  ট্রেনে  চেপে  বসতেই  মনে  পড়ল  ইন্নার কথা। একটা লতানো গাছ থেকে কত বেশি কুমড়ো পাওয়া যেতে পারে তার আগাম হিসাব যেন কেবল ইন্না নিখুঁতভাবে জানতে পেরেছে। ঢাউস সবুজ পাতা দেখে ইন্নার ভেতরে যে হিল্লোল তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে গভীর সৌন্দর্যতত্ত্বও রয়েছে। কুমড়ো গাছের প্রতি যত্ন নেওয়ার জন্য ইন্নার  যে আত্মিক চেতনা, তা অবশ্যই মনে রাখার মতো। মথুরাপুর স্টেশনে নেমে দেখল, সন্ধে গড়িয়ে বেশ রাত হয়ে গেছে। স্টেশনের পাশেই সার-ওষুধের দোকান। দোকানদারকে মুন্নার প্রশ্ন, কুমড়ো গাছের জন্য ইউরিয়া, না ডিএপি নেব?

গাছটাকে বড় করে তোলার জন্যে?

না না, ফুল এসেছে ডালে ডালে।

তাহলে ডিএপি দিতে হবে।

তাই দিন।

কত দেব?

বাড়ি থেকে এক কেজি কেনার কথা বলে দিয়েছে।

গাছটা কি খুব বড়?

চওড়ায় উঠোনের অর্ধেক জায়গা নিয়েছে।

তাহলে এক কেজি নিতে পারেন।

কুমড়ো উঠলে দোকানে একটা দিয়ে যাবেন।

মুন্না না হেসে পারল না।

ওষুধ দিতে হবে কী?

তা তো লাগবেই।

বিশেষ কোনো ওষুধের নাম বলে দিয়েছে কি?

তা বলেনি।

মুন্নাদা, ততোক্ষণ চা খান, সবকিছু গুছিয়ে দিচ্ছি।

কয়েক মিনিটের মধ্যে দোকানদারের হাত ঘুরে ডিএপি আর ওষুধের প্যাকেট মুন্নার সামনে চলে এলো।

কত দাম হয়েছে বলবেন?

পঞ্চাশ টাকা।

চুকিয়ে দিয়ে মুন্না দোকান থেকে বের হয়ে এলো। অটোতে চেপে মিনিট কুড়ি পরে ঘোড়াদল বাজারে নামল। কয়েক মিনিট হেঁটে বাড়িতে ঢুকে ইন্নাকে বলল, এগুলো রাখো।

তাহলে মনে ছিল?

প্রধান বিচারপতির আদেশ, অমান্য করি কী করে?

ইন্নার মুখে সলাজ হাসি। তার জীবনে মুন্নার রোমান্টিক আনুকূল্য খাঁটি পরশপাথরের মতো।

দুজনের পাঁচ বছরের সংসারজীবন। কোনো ছেলেমেয়ে নেই। বিয়ের তিন বছর পরে একজন এসেছিল; কিন্তু মাত্র কদিনের জন্যে। হারানোর কষ্ট দুজনের মধ্যে তখনো রয়ে গেছে। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন, আপাতত আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ইন্নার চিকিৎসাও শুরু হয়েছে। মুন্নার প্রবল ইচ্ছা, একটা সন্তান আসুক তাদের জীবনে। না হলে যে সংসারের পেছনে দেওয়া সব পরিশ্রমকে পণ্ডশ্রম বলে মনে হচ্ছে। উদাস ভাবনায় মুন্না হারিয়ে যেতে থাকল।

ইন্নার চকিত প্রশ্ন, এ্যাই, এতো কী ভাবছ?

কুমড়োর পাতাগুলো ছোট্ট শিশুর মতো কেমন সুন্দর হয়ে উঠেছে দ্যাখো।

ইন্নাও জানে, কোন অভাববোধের যন্ত্রণা রোজ মুন্নাকে কুরে কুরে খায়। চাপা স্বরে বলল, জানি তো সব। তোমার দুঃখ আমাকেও খুব স্পর্শ করে। প্রথম ছেলেটা মরে না গেলে এতদিনে বেশ বড় হয়ে যেত। কী সুন্দর দেখতে হয়েছিল। কুমড়ো পাতার মতো কী ফলফলে চেহারা। গায়ের রঙে ছিল অপরূপ সৌন্দর্য।

মুন্না গুম হয়ে বসে থাকল। ইন্না যেন তার একটা গোপন অভাবকে দারুণভাবে উস্কে দিতে পারল। তাহলে ইন্নাও তার অভাববোধের গভীরতাকে এতোটা স্পর্শ করতে পেরেছে?

কয়েক মুহূর্ত পরে বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল শিরীন, মুন্নার বড়দার ছেলে। একেবারে গোমরামুখে।

মুন্নার সাদর আপ্যায়ন, ওখানে দাঁড়িয়ে থাকলি কেন, ওপরে উঠে আয় না।

একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।

তোর বাপি কী বলে দিয়েছে?

না।

তাহলে কে?

মা জিজ্ঞেস করতে বলল।

বেশ তো বল শুনি।

উঠোনের কুমড়ো গাছটা নিয়ে চাচিমা চারদিকে বলে বেড়াচ্ছে, গাছটা নাকি তোমাদের?

তোর কী মনে হয়?

মা বলে দিয়েছে, গাছটা আমাদের ভাগে পড়েছে।

বুঝলি কী করে?

ডগাগুলো লতিয়ে তোমাদের উঠোনে বেশি চলে গেলেও মূল শিকড়টা আমাদের ভাগে রয়েছে। মুন্না রুষ্ট হয়ে বলল, তুই শুধু ভাগের কথা বলতে এসেছিস নাকি?

মা তো বলল, গাছটা আমাদের, যা কুমড়ো হবে আমরাই নেব।

মুন্নার রাগত কথা, এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা, যা বলার তোর বাপকে বলব।

কেন, মায়ের কথা পছন্দ হলো না বুঝি?

আবার মুখে মুখে তর্ক করছিস?

ভাগ চাইলে তা তর্ক হয়ে যায়?

নবম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে এতো কিছু শিখে ফেলেছিস?

ভাগের কথা অবোধ শিশুও বোঝে।

যা এখান থেকে, মুন্নার তাৎক্ষণিক হুমকি।

তাড়িয়ে দিয়ে ভালো করলে না কাকু।

বারান্দায় গুম হয়ে বসে থাকা মুন্নার মুখে অন্ধকারের ধূসর ছায়া। উদ্ভূত ঘটনায় সত্যি সত্যি স্তম্ভিত সে। কী করণীয় তা ভেবে স্থির করতে পারছে না। একটা সূক্ষ্ম সন্দেহ মাথার ভেতরে লাট্টুর মতো ঘুরছে। ছেলেকে পাঠিয়ে বড়দা এসব বলতে ইন্ধন জোগায়নি তো? কিন্তু তা বিশ্বাস করতে মুন্নার কষ্ট হচ্ছিল। অবশ্য শিরীনের মা ভয়ানক চরিত্রের। এ-বাড়িতে আসার পর থেকে ক্রমাগত বিভেদের দেয়াল তুলতে ব্যস্ত। কখনো পেরেছে, কখনো পারেনি। চাকরি পাওয়া নিয়ে তার মূল অভিযোগ ছিল, বড়দার আগে সুযোগ পাওয়া উচিত; কিন্তু সে-যাত্রায় বড়দা সোহাগ ভরে বলেছিল, আচ্ছা, ও চাচ্ছে যখন, চাকরিটা ও-ই করুক। আমাকে না দেখে পারবে কি?

পুরনো স্মৃতির ধাক্কা সামলে হতবাক মুন্না বারান্দায় বসে ছিল। ইন্না একবার মুন্নার ধূসর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল, বুঝল, সমাধানের সূত্র খুঁজে পেলে নিশ্চয়ই বলত তাকে।

শিরীন আবার ফিরে এসে বলল, তাহলে মায়ের দাবি মানবে না তোমরা?

বললুম তো, কাল সকালে তোর বাপের সঙ্গে কথা বলব।

আইন বলছে, কুমড়ো গাছটা আমাদের।

আগে আইন করে আয়, তারপর তোর মায়ের কথা শুনব।

শুধু শুধু গাজোয়ারি করে ঠিক করছ না কাকু।

ছোট মুখে বড়ো কথা!

বাধ্য হয়ে শিরীন মুখ ভার করে ফিরে গেল। যাওয়ার সময় বিড়বিড় করে বলল, চাচিমা কী ভীষণ ঝগড়ুটে।

মুন্নাকে ইন্নার প্রশ্ন, তাহলে কী করবে এখন?

মুন্নার রাগত জবাব, এইটুকুন ছেলের আইন দেখানোর কথা শুনে ভয় পাচ্ছ?

সবই তো ওর মায়ের শেখানো কথা। বড়দাকে বুঝিয়ে বললে সব ঘোর কেটে যাবে। অবশ্য বড়দা বিকেলে ছোট বোনের বাড়িতে গেছে।

রাত বাড়ছে পলে পলে। বিছানায় শুয়ে দুজনের মনের ছটফটানি বেড়েই চলেছে। দশটার পরে সেভাবে খেতে পারল না কেউ। হাত-মুখ ধুয়ে মুন্না বলল, জানো ইন্না, প্রথম প্রথম তোমার কথা শুনে সেভাবে ভাবিনি। এখন দেখছি, মনের অজান্তে কুমড়ো গাছটা আমার কাছে হারিয়ে যাওয়া ছেলের স্মৃতি হয়ে উঠেছে। দেখলেই বুক জুড়িয়ে যায়। এখন কী বুঝতে পারছ, কুমড়ো গাছের আড়ালে আমার মায়া-মমতার স্মৃতি কত গভীর হয়ে উঠেছে? ফলফলে পাতার ওপর চোখ পড়লেই একটা কচি মুখ দু-চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

ঝিল্লির শব্দে রাত গভীরতর হচ্ছে। অন্ধকারের বুকে স্তব্ধতার নীরব ঝাঁকুনি। অচেনা অস্থিরতায় দুজনেই কমবেশি কম্পিত হচ্ছে। ইন্নার সান্ত্বনা, ঠিক বলেছ তুমি, ওর বাপ তো কিছু বলেনি। তুমি বরং কালকের দিনটা অফিসে না গিয়ে দঙ্গল পরিষ্কারের কাজটুকু সেরে দাও।

বলছ যখন সেরে দেব।

বেশি রাতে ঘুমানোর ফলে সকালে উঠতে বেশ দেরি হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে দু-চোখ কচলাতে কচলাতে মুন্না বলল, তাহলে নিড়ানিটা দাও, কাজটুকু সেরে ফেলি।

সেই ভালো।

সূর্যের সোনালি আলোয় সামনের উঠোন ভরে উঠেছে। এক চিলতে চত্বরে দূর্বাঘাসের বুকে সজীব প্রাণচঞ্চলতার অনিন্দ্যসুন্দর প্রকাশ। কেবল কুমড়ো গাছটা নেতিয়ে পড়েছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল মুন্নার। পেছনে দাঁড়িয়ে ইন্না। তার হাত থেকে ডিএপির ছোট্ট প্যাকেটটা থপ্ শব্দে মাটিতে খসে পড়ল। মুন্নার মনে হলো, অকাল মৃত্যুযন্ত্রণায় গাছটা ভেতরে ভেতরে কেমন যেন ছফফট করছে। একটাই প্রশ্নে বিদ্ধ হতে থাকল – প্রকৃতি থেকে অবাধে জল, বাতাস আর রোদ পেলেও মানুষের চরম স্বার্থপরতায় খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত ভূমিস্বত্বের ওপরে কী নিজস্ব ভূমিপুত্র কুমড়ো গাছটার কোনো অধিকার নেই।