হীরালাল সেন : উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক

সময়টা তখন রেনেসাঁস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ-ভারতের অধিভুক্ত অবিভক্ত বাংলায় বিস্ময়কর উত্থান ঘটেছিল বাঙালির নবজাগরণের। রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত থেকে শুরু করে আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ, বেগম রোকেয়া, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, কাজী নজরুল ইসলাম পর্যন্ত প্রাতঃস্মরণীয় প্রায় সব বাঙালি মনীষীই বাংলার এই নবজাগরণ আন্দোলনের অংশ ছিলেন। বর্তমান বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ভূখ- নিয়ে গঠিত তখনকার ব্রিটিশ-শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের বিস্মৃতপ্রায় কিন্তু অবিস্মরণীয় এক অধ্যায়ের রচয়িতা ছিলেন বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বকজুরি গ্রামের সমত্মান হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)। গবেষণায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে হীরালাল সেন শুধু অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশেরই নন, সমগ্র এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা অঞ্চলেরও প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রকার।

মানিকগঞ্জ পৌরসভার আওতাধীন বকজুরিতে পৈতৃক বাড়ির পাশে হীরালাল সেন সড়কের নামফলক।

তখনকার মতো চলচ্চিত্র এখনো উপমহাদেশ জুড়ে বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হয়েই আছে। পৃথিবীর এ-অঞ্চলেই সবচেয়ে বেশি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এবং কাহিনিভিত্তিক পূর্ণ ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয় (বছরে তিন সহস্রাধিক)। এই উপমহাদেশেরই চলচ্চিত্রের জনক, চলচ্চিত্রের মূল এবং মৌলিক শেকড় হলেন হীরালাল সেন। দুর্ভাগ্য, ‘ঐতিহাসিক ভুল, হীনমন্যতা, সংকীর্ণতা আর ভূরাজনৈতিক কূটনীতি’র শিকার হয়ে কালের গর্ভে আজো বিস্মৃত, অবহেলিত, আচ্ছন্ন ও সমাহিত হয়ে আছেন আমাদের চলচ্চিত্রের সেই মহানায়ক হীরালাল সেন।

চলচ্চিত্র-মহীরুহ হীরালাল সেনই এই ভূখ– চলচ্চিত্র সংস্কৃতির জন্মদাতা, কারণ তিনি বাংলাদেশের এবং অবিভক্ত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা, তাঁরই হাত ধরে এদেশে চলচ্চিত্র সাধারণ্যে পরিচিত ও জনপ্রিয় হয়েছে। তাঁর নির্মিত উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্রের নাম The Dancing Scene from the Flower of Persia (১৮৯৮)। তিনি উপমহাদেশের এবং সারা পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র – Alibaba (১৯০৩) এবং প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র – Grand Patriotic Film (১৯০৫)-এর নির্মাতা। হীরালাল সেন পৃথিবীর সেই প্রথম চলচ্চিত্রকার, যিনি চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে রাজরোষে নিপতিত হয়েছিলেন এবং যাঁর নির্মিত চলচ্চিত্র – The Visit Film (১৯১২) বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে প্রথম রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।

নিরীক্ষা এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালিয়ে পৃথিবীতে হীরালাল সেনই প্রথম বৈদ্যুতিক পদ্ধতিতে প্রক্ষিপ্ত ছবির আয়তন বৃদ্ধির কৌশল আবিষ্কার করেন এবং বিশ্বচলচ্চিত্র সংস্কৃতির প্রসারে অবদান রাখেন। প্রায়োগিক নিরীক্ষার মাধ্যমে চলচ্চিত্র প্রদর্শনব্যবস্থারও তিনি যুগান্তকারী উন্নয়ন ঘটান। নিজস্ব উদ্ভাবন এবং লাগসই দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের মাধ্যমে সমগ্র উপমহাদেশে চলচ্চিত্রকে জনপ্রিয় শিল্পমাধ্যম হিসেবে পরিচিত করে তোলেন তিনি। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র শিক্ষক ও গবেষক। তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশের চলচ্চিত্রে তারকাপ্রথার উদ্ভব ঘটে (চ-ী মুখোপাধ্যায়, ২০১৮, পৃ ১৪)।

তিনি ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ কোম্পানি তথা প্রযোজনা সংস্থা ‘রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির উদ্যোগে একের পর এক চলচ্চিত্র ব্যবসায়ের বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করে। তখনকার বিভিন্ন
কাগজে (বঙ্গবাসী, দি স্টেটসম্যান প্রভৃতি) নিত্যনৈমিত্তিক বিজ্ঞাপনানুযায়ী কলকাতায় তখন রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানির দেখাদেখি তেইশটি ঘোষিত কোম্পানি গড়ে উঠেছিল (প্রভাত, পৃ ৯২; গৌরাঙ্গ, পৃ ১৭)

হীরালাল সেন উপমহাদেশে একাধারে প্রথম কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপনচিত্র ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তিনিই এদেশের প্রথম চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিবেশক, প্রদর্শক, আমদানিও রফতানিকারক। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গবেষক, উদ্ভাবক এবং চলচ্চিত্র-বিজ্ঞানী। চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে জনমানসকে সচেতন ও আধুনিকমনস্ক করে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তিনি। বিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে বাংলাদেশ ও তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের প্রত্যন্ত শহর ও গ্রামাঞ্চল নির্বিশেষে অভিজাত, মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনসাধারণের মধ্যে চলচ্চিত্র দেখিয়ে আধুনিকতা, দেশাত্মবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে উপমহাদেশে সত্যিকারের বিকল্পধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনেরও জন্ম দেন। সেই সময়ের পৃথিবীতে হীরালাল সেন ছাড়া দ্বিতীয় এমন কোনো চলচ্চিত্রকার ছিলেন না, যিনি চলচ্চিত্র সংস্কৃতির বিকাশে এককভাবে এমন বহুবিচিত্র, সৃজনশীল ও বর্ণাঢ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এসব কারণেই আমার বিবেচনায় তিনিই ইউরোপ এবং আমেরিকার বাইরে (এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের) পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্রকার।

 

হীরালাল-নির্মিত চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্র-গবেষক সৈকত আসগর, প্রভাত মুখোপাধ্যায়, কালীশ মুখোপাধ্যায়, সজল চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের গবেষণামূলক কাজের তথ্য-উপাত্ত থেকে এ পর্যন্ত হীরালাল সেন-নির্মিত বিজ্ঞাপনচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র সব মিলিয়ে মোট পঞ্চান্নটি চলচ্চিত্রের নাম উদ্ধার করা গেছে। তবে সম্প্রতি চলচ্চিত্র-গবেষক অনুপম হায়াৎ উলেস্নখ করেছেন – হীরালাল সেন ১৮৯৮ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের প্রায় একশ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। (জাহাঙ্গীর সম্পা., ২০১৬, পৃ ২৭)

এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে তাঁর নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে কাহিনিচিত্র বাইশটি (মঞ্চনাটকের খ-াংশ, কাহিনিভিত্তিক স্বল্প ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র), রাজনৈতিক চলচ্চিত্র ও সংবাদচিত্র ষোলোটি (সংবাদভিত্তিক চলচ্চিত্র, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র), তথ্যচিত্র চৌদ্দটি এবং বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র তিনটি। তিনি কথাসাহিত্য থেকে গল্প নিয়ে যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তেমনি গ্রামবাংলা ও শহরের চিত্রও ধারণ করেছেন ক্যামেরায়। পর্যবেক্ষণে দেখা যাবে – বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের তিনটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত ও মাইলফলক স্থাপন করেছিলেন হীরালাল সেন।

প্রথমত – ১৯০৩ সালে হীরালাল সেন নির্মাণ করেছিলেন বিশ্বের প্রথম পূর্ণদের্ঘ্য চলচ্চিত্র – আলিবাবা। তাঁরই প্রতিষ্ঠিত রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত হয় চলচ্চিত্রটি। এটি বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল (প্রভাত, ৩৫)। দ্বিতীয়ত – তিনি পৃথিবীর প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র – Grand Patriotic Film (১৯০৫) নির্মাণ করেন (ঘোষ, ২০১১, পৃ ১)। তৃতীয়ত – তিনি প্রথম সংবাদভিত্তিক তথ্যচিত্র – The Visit Film (১৯১২) নির্মাণ করেন। এই চলচ্চিত্রই ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্র, যা রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় (সজল, পৃ ২৪৬)। বিশ্বচলচ্চিত্র ইতিহাসে অনুলিস্নখিত এ-তিনটি বিষয় তাই গুরুত্বসহ আলোচনার বিশেষ দাবি রাখে।

 

ক. আলিবাবা (১৯০৩) : পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র

গবেষণায় জানা গেছে, ১৯০৩ সালে নির্মিত আলিবাবা (মুক্তির তারিখ : ২৩ জানুয়ারি ১৯০৩) চলচ্চিত্রই সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র। কারণ চলচ্চিত্রকার এডউইন এস পোর্টার-নির্মিত গ্রেট ট্রেন রোবারি (মুক্তির তারিখ : ১ ডিসেম্বর ১৯০৩) পৃথিবীর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র হিসেবে কথিত হলেও, তার দৈর্ঘ্য মাত্র বারো মিনিট দশ সেকেন্ড।

অপরপক্ষে তাঁর আগেই হীরালাল সেন দুই ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের আলিবাবা চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন এবং সারা বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তা প্রদর্শন করেন। শুধু ভারতবর্ষেই নয়, বহির্বিশ্বেও জনপ্রিয়তা লাভ করে এই চলচ্চিত্র (সজল, পৃ ১৫১-১৫২, ১৬৪)।

ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ-রচিত আলিবাবা (১৯০৩) নাটকটি প্রথমে ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয়েছিল। হীরালাল সেন এই নাটকেরই চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছিলেন। অপরপক্ষে The Great Train Robbery (১৯০৩) চলচ্চিত্রটিও Edwin S. Porter আমেরিকান নাট্যকার Scott Marble (১৮৪৭-১৯১৯) কর্তৃক ১৮৯৬ সালে রচিত The Great Train Robbery শীর্ষক মঞ্চনাটক দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মাণ করেছিলেন (প্রভাত, ৬৮-৭৩)।

তাই বলার সময় এসেছে, বাংলার আলিবাবা (১৯০৩) চলচ্চিত্রই সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিভিত্তিক চলচ্চিত্র, আমেরিকার The Great Train Robbery (1903) নয়।

 

খ. Grand Patriotic Film (১৯০৫) : পৃথিবীর খ. Grand Patriotic Film (১৯০৫) : পৃথিবীর প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে সারাদেশে বঙ্গভঙ্গবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ ও আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে। সারা ভারতে এ-সময় প্রায় পাঁচশো প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে বাঙালিদের বিক্ষোভ, সমাবেশ ও প্রতিবাদ অগ্নিগর্ভ করে তোলে দেশের পরিস্থিতি।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রতিবাদ করে ১৯০৫ সালে রাখীবন্ধনের ডাক দিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। শুধু রাখীবন্ধনের ডাক নয়, সেই সঙ্গে মহামিলনের আকাঙক্ষায় কবি রচনা করেছিলেন এক মহাসংগীত – ‘বাংলার মাটি, বাংলার জল পুণ্য হউক … এক হউক, এক হউক হে ভগবান।’ কলকাতার টাউন হলে বঙ্গভঙ্গবিরোধী মহাসমাবেশ ছাড়াও বিদেশি দ্রব্যে অগ্নিসংযোগ ও রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জির নেতৃত্বে শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। দেশব্যাপী পাঁচ শতাধিক প্রতিবাদ সমাবেশও ঘটে। দেশমাতৃকার ঘোর দুর্দিনে রবীন্দ্রনাথ রাখীবন্ধন কর্মসূচি পালন করে সর্বাত্মক জাতীয় ঐক্যের আহবান জানালেন, রচনা করলেন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’সহ একত্রিশটি প্রতিবাদী ও দেশাত্মমূলক সংগীত। এই আন্দোলনের কেন্দ্র – কলকাতা টাউন হলে অনুষ্ঠিত হয় পাঁচটি বিশাল প্রতিবাদ মহাসমাবেশ, শোভাযাত্রা ও মিছিল।

১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট টাউন হলে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয় বিদেশি দ্রব্য বর্জনের। এরপর ২২ সেপ্টেম্ব^র বঙ্গভঙ্গবিরোধী ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার টাউন হলে। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিশাল সমাবেশ হয়েছিল কলেজ স্কয়ার বা গোলদীঘিতেও।

পাশাপাশি এই সময়েই উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন দেশমাতৃকার আহবানে অসম সাহসের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর বীরত্বপূর্ণ ক্যামেরাযুদ্ধ। তিনি এই আন্দোলনের দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেন এবং নির্মাণ করেন ‘অ্যান্টি পার্টিশন মুভমেন্ট’ বিষয়ক তিন ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র Grand Patriotic Film (১৯০৫)। বিশ্বে এই প্রথম চলচ্চিত্র মাধ্যমে নির্মিত হলো রাজনৈতিক সংগ্রামের ঐতিহাসিক দলিল। তাই হীরালাল সেনই বিশ্বের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্রের নির্মাতা, আর Grand Patriotic Film-ই বিশ্বের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র (প্রভাত, ৭৩, ৮৫-৮৬)।

হীরালাল সেন এসব সভা, প্রতিবাদ, শোভাযাত্রা, সমাবেশ ও মিছিলের চিত্র গ্রহণ করে নির্মাণ করেছিলেন Grand Patriotic Film। টাউন হলের প্রতিবাদ সভা ও সমাবেশের চিত্রগ্রহণের জন্য তিনি ক্যামেরা বসিয়েছিলেন পুরনো ট্রেজারি ভবনের ছাদে ও দক্ষিণ দিকের বারান্দায়। এছাড়া তিনি রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রতিবাদ মিছিল ও শহরের বিভিন্ন অংশে যে-শোভাযাত্রা হয়েছিল তার ছবিও তুলেছিলেন। ছবির শেষে গাওয়া হয়েছিল ‘বন্দে মাতরম’। ১৯০৫ সালের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এ-ছবির বিজ্ঞাপনে একে অভিহিত করা হয়েছিল – ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশি সিনেমা’।

ছবিটি বিদেশে পাঠানোর প্রয়োজনে জনপ্রিয় নেতা সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা সবাক করতে হীরালাল সেন এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বক্তৃতাটি রেকর্ড করার পর রেকর্ডার চিত্রপ্রক্ষেপণ যন্ত্রের সঙ্গে বেল্ট দিয়ে যুক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দুটি যন্ত্র একই সঙ্গে সচল করার মাধ্যমে বায়োস্কোপকে সবাক করার নিরীক্ষা করেছিলেন তিনি। এখানে Grand Patriotic Film  চলচ্চিত্রের কয়েকটি বিশেষ তথ্য উলেস্নখ করা হলো –

*       Released on : 21 October 1905

*       Place of Release : Classic Theatre, Calcutta

*       Length : 3 hours

*       Language : Silent

*       Attempt was made to add sound

*       First Political Movie of the World

১৯০৫ সালের ২৫ নভেম্ব^র কলকাতায় ক্লাসিক থিয়েটার হলে এই চিত্রের প্রদর্শনীতে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও এসেছিলেন ময়মনসিংহের মহারাজা সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরী, নাটোরের রাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়সহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রদর্শনী দেখে খুবই প্রশংসা করেছিলেন। এমনকি তিনি হীরালাল সেনের পায়ের ধুলো মাথায় তুলে নিয়েছিলেন (প্রভাত, পৃ ৮৪-৮৫; সজল, পৃ ২০১-২০৬; সিদ্ধার্থ, পৃ ১৬৬-১৬৭)।

হীরালাল সেনই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম চলচ্চিত্রকার যিনি সিনেমাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কথা ভেবেছিলেন! বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তাঁর তিন ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র The Grand Patriotic Film বা পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের ভাষা অনুসারে Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905 শীর্ষক তথ্যচিত্রই ভারতের প্রথম রাজনৈতিক চলচ্চিত্র।

প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তখনকার দিনে তিন ঘণ্টা দৈর্ঘ্যের পৃথিবীর দীর্ঘতম এই চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিল বিস্ময়কর ও অকল্পনীয়। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের ওপর নির্মিত এই চলচ্চিত্রই তদানীন্তন পৃথিবীর কোনো দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা রাজনৈতিক আন্দোলনের ওপর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্র ইতিহাসের এত বড় একটি ঘটনা, বাস্তবে কিন্তু অবহেলিতই রয়ে গেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যচিত্র উপেক্ষিত থাকার নজির পৃথিবীর ইতিহাসেও বিরল (সজল, পৃ ২০২)।

 

গ. The Visit Film (১৯১২) : রাজনৈতিক কারণে নিষিদ্ধ ঘোষিত পৃথিবীর প্রথম চলচ্চিত্র

সম্রাট পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক ভারত আগমন উপলক্ষে ১৯১১-১৯১২ সালে সরকারি আমন্ত্রণক্রমে হীরালাল সেন তৈরি করেন The Visit Film (1912), যা সারাবিশ্বের প্রথম সংবাদচিত্র, আবার সরকারি বিধিনিষেধে যার প্রদর্শনী নিষিদ্ধও হয়েছিল (সজল, পৃ ২৪৭)। অমৃতবাজার পত্রিকার বিজ্ঞাপনানুযায়ী ৫ জানুয়ারি ১৯১২ তারিখে মিনার্ভা থিয়েটারে মুক্তি পায় হীরালাল সেনের এই বায়োস্কোপ The Visit Film। এর ছিল মোট সাতটি খ- (কালীশ, পৃ ৩৯২-৩৯৩; সজল, পৃ ২৪৫)।

ক্যান্সার রোগাক্রান্ত হীরালাল সেন ভগ্নস্বাস্থ্য, জনবল সংকট এবং তীব্র অর্থাভাব সত্ত্বেও সম্রাট দম্পতির ভারত পরিভ্রমণের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সব অনুষ্ঠান চিত্রায়িত করেছিলেন Visit Film-এ। নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে নিজের বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত রসায়নাগারে এই ছবির পরিস্ফুটন এবং সম্পাদনার কাজও তিনি সম্পন্ন করেছিলেন তাৎক্ষণিকভাবে। এ প্রসঙ্গে ওঁর জামাতা অবনীপ্রসাদ, যিনি প্রিনসেপ ঘাটে ছবির শুটিংও দেখেছিলেন, তিনি বলেন, ‘কাজে উনি সর্বদাই ছিলেন সময়ের আগে, ভালো দামি ঘড়ির চেয়েও নিয়ন্ত্রিত এবং দানবীয়ভাবে কর্মশীল।’ (প্রভাত, পৃ ১০৪)

এ প্রসঙ্গে T.M. Ramchandran-এর উদ্ধৃতিও উলেস্নখযোগ্য –

Apart from the first ever full-length feature film Alibaba, his most outstanding performance was in 1912 at the time of visit to India by His Majesty King George V and Queen Mary, when, almost single handed, ailing from cancer of the throat and standing on the verge of insolvency, he stood with competition with no less than four of the best cameramen from England working for the great Madans and a dozens of them working for the Government of India and beat them in their own game by being the first to release the ‘Visit Film’ with a wide coverage. (T.M. Ramchandran, 70 Years of Indian Cinema, p 52-53, উদ্ধৃতি সজল, পৃ ২৪৪)

রজত রায় জানিয়েছেন Visit Film মুক্তি পেয়েছিল ৫ জানুয়ারি তারিখে –

GRAND DELLHI CORONATION DURBAR AND ROYAL VISIT TO CALCUTTA (including THEIR MAJESTIES’ ARRIVAL AT AMPHI THEATRE, ARRIVAL AT HOWRAH, PRICEP’S GHAT, PROCESSION, VISIT TO BOMBAY EXHIBITION) (1912), Silent, B&W (Black and

 

White). First released on : 5th January, 1912. (Total length of these news reels were 2500 feet.). (রজত রায়, পৃ ৪-৫)

ভাবতে অবাক লাগে, কী ব্যাপক ছিল এই ছবির পটভূমি! কী দুঃসাহসিক ছিল – দিলিস্ন, কলকাতা ও বোম্ব^াই, ভারতের এই তিন প্রত্যন্ত নগরে বিত্তহীন, মৃত্যু-রোগাক্রান্ত এক চলচ্চিত্র স্রষ্টার বিপুল নিষ্ঠাসহকারে ছবি তোলার অভিযান! প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়ে, হীরালাল সেন যেহেতু নিজেই ফিল্ম ডেভেলপিং, প্রসেসিং, প্রিন্টিং ইত্যাদি ব্যাপারে স্বয়ম্ভর ছিলেন, তিনিই সবার আগে কলকাতায়, সম্রাটের অবস্থানকালেই, দিলিস্ন অধ্যায়টুকুর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন। মিনার্ভা থিয়েটারে আংশিক Visit Film ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ৫ জানুয়ারি ১৯১২ (সজল, পৃ ২৪৪-২৪৬)।

দিলিস্ন দরবারসহ Visit Film মুক্তি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই, অর্থাৎ ৫ ও ৬ জানুয়ারি মাত্র দুদিন দেখানোর পরই, রাজনৈতিক কারণে সরকারি বিধিনিষেধের ফলে ছবিটির জনসমক্ষে পুনঃপ্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায় –

His documentary on the Delhi Durbar (1912) was refused permission for public exhibition on political grounds. (Rajat Roy, p 2)

স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের ঘটনা নিয়ে নির্মিত রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত স্পর্শকাতর সংবাদচিত্র ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন’ (১৯০৫) বা GRAND PATRIOTIC FILM (1905) কিন্তু নিষিদ্ধ হয়নি, তা অনায়াসে প্রদর্শিত হয়েছিল। অথচ সরকারি আমন্ত্রণে সম্রাট পঞ্চম জর্জের সস্ত্রীক ভারত আগমন উপলক্ষে হীরালাল সেন-নির্মিত Visit Film ছবিটি, বিজ্ঞাপনে ‘চিত্রনির্মাতা ও তাঁর প্রতিষ্ঠান ভাইসরয়ের অনুগ্রহধন্য’ বলে উলেস্নখ থাকার পরও, মুক্তি পাওয়ার মাত্র দুদিনের মধ্যেই নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো! কিন্তু কেন, তার কারণই-বা কী? পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে মনে হয়, এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে –

১. GRAND PATRIOTIC FILM (1905) যখন প্রদর্শিত হয়, চলচ্চিত্র বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে – ব্রিটিশ শাসকদের মনে তখনো সেই আশংকা তৈরি হয়নি। শাসকদের কাছে ১৯০৫ সালে শিল্পমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র ছিল ধর্তব্যের বাইরে। কিন্তু Visit Film প্রদর্শনের সময় হীরালাল সেনের প্রচেষ্টার ফলে গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এবং দেশীয় চলচ্চিত্রের শক্তিমত্তা তখন শাসকের চোখে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তাই ভারতবর্ষে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও সেন্সরপ্রথার আবির্ভাব না ঘটলেও, ব্রিটিশ সরকার Visit Film নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘটনারই অনুবৃত্তিক্রমে ভারতীয় চলচ্চিত্রের জন্য ১৯১৮ সালে সেন্সরশিপ জারি করে ব্রিটিশ সরকার। পৃথিবীতে এভাবেই ‘চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ’ ধারণার জন্ম হয়েছিল।

২. দিলিস্ন দরবারে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ – সম্রাট পঞ্চম জর্জের মুখ দিয়ে ‘বঙ্গভঙ্গ রদ’-এর ঘোষণা করিয়েছিলেন বটে,
একই সঙ্গে ঘোষণায় – ক. ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী বাংলার কলকাতা থেকে দিলিস্নতে সরিয়ে নেওয়া, খ. পূর্ববঙ্গ ও আসাম টেরিটরি থেকে আসামকে বিচ্ছিন্ন করা এবং গ. বঙ্গপ্রদেশ থেকে উড়িষ্যা ও বিহারকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্তও অন্তর্ভুক্ত ছিল। Visit Film-এর দিলিস্ন দরবার খ– এই দৃশ্যের চিত্রায়ণ করা হয়েছিল – যা বাংলাদেশে প্রজাসাধারণের মধ্যে নতুন করে গণঅসমেত্মাষ ও বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলতে পারে, এই আশংকা জেগে উঠেছিল সাম্রাজ্য হারানোর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ও তটস্থ ব্রিটিশ শাসকদের মনে।

৩. Visit Film ভারতে শৃঙ্খলা বিনষ্ট করতে পারে, এই ধারণা জন্মেছিল শাসকদের মনে। ১৯১২ সাল নাগাদ ভারতে চলচ্চিত্র গণমাধ্যম হিসেবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। প্রচারমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র তখন তার জনপ্রিয়তা ও উপযোগিতা প্রমাণ করে ফেলেছে, তাই শাসকরা অগ্নিতে ঘৃতাহুতি সৃষ্টির মতো ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বিবেচনা করে Visit Film নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

৪. মূল বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে পরাজিত হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করেছিল ইংরেজরা। বাঙালির কাছে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবে পরোক্ষভাবে তারা চতুর বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জের নেতৃত্বে সম্রাট পঞ্চম জর্জের মুখ দিয়ে বাঙালিদের বিরুদ্ধে শাসিত্মই ঘোষণা করিয়ে নিয়েছিল। রাজধানী কলকাতার বাইরে ব্রিটিশ সম্রাটের দরবার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকারান্তরে কলকাতাকে তথা বাঙালি জাতিকে অপমান করার একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল এর মধ্যে। অন্যদিকে তখনো পর্যন্ত কলকাতা রাজধানী হিসেবে বিদ্যমান, রাজা ভারতে এসে রাজধানীতে না এলে তা সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করবে বলে সম্রাটের কলকাতা সফর ছিল অনিবার্য। তাই ৮ জানুয়ারি ১৯১২ তারিখে সম্রাটের কলকাতা সফরের সময় বাঙালিরা Visit Film দেখে আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়তে পারে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিও ঘটতে পারে, এই আশংকায় অগ্রিম সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবেও Visit Film (1912) নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়ে থাকতে পারে।

জীবনের শেষ অধ্যায়ে Visit Film নির্মাণ করে প্রভূত সুনাম অর্জন করলেও দুর্ভাগ্য ও ষড়যন্ত্র কিন্তু হীরালাল সেনের পিছু ছাড়েনি। রাজনৈতিক কারণে Visit Film নিষিদ্ধ ঘোষণা করার ফলে এই ছবির নির্মাণজনিত আর্থিক ক্ষতি হীরালাল আর সামলে উঠতে পারেননি। Visit Film নিষিদ্ধ হওয়ার মাত্র দুদিন পরই হীরালাল সেনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ী ধনাঢ্য ম্যাডানদের আয়োজনে ৮ জানুয়ারি ১৯১২ সালে কলকাতার লাটভবনে শুধু রাজকীয় অতিথিদের সামনে প্রদর্শন করা হয় হীরালাল সেনেরই নির্মিত ওই ৭ খ- বায়োস্কোপ। অমৃতবাজার পত্রিকার ভাষ্য অনুসারে –

প্রবেশপথের প্রায় পঞ্চাশ গজ দূরে এবং রাজভবনের দক্ষিণাঞ্চলে একটি পর্দা খাড়া করা হয়েছিল। সম্রাট দম্পতি এবং লর্ড ও লেডি হার্ডিঞ্জ প্রদর্শনী দেখেছিলেন প্রবেশদ্বারের ওপরে অবস্থিত অলিন্দ থেকে এবং দলের বিভিন্ন সভ্যবৃন্দ ও সান্ধ্য ভোজনের জন্য আমন্ত্রিত অতিথিরা বসেছিলেন নিম্নস্থিত বারান্দার দুই পাশে।

এটা সম্ভব হয়েছিল, তার কারণ হলো – রোগাক্রান্ত হওয়ায় ও অর্থকষ্টে ভুগতে থাকায় এবং Visit Film (1912) সাধারণ্যে প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হওয়ায় হীরালাল সেনের হতাশার সুযোগে তাঁর কাছ থেকে ছবিটি কিনে নেন ধুরন্ধর অবাঙালি ব্যবসায়ী জেএফ ম্যাডান। পরদিন ৮ জানুয়ারি ১৯১২ তারিখে লাটভবনে শুধু রাজকীয় অতিথিদের সামনে এই ছবি দেখিয়ে এবং ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত থেকেই ম্যাডান, সম্রাট দম্পতির কাছ থেকে মনোরম ছবি প্রদর্শনের জন্য প্রশংসা অর্জনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করেন (সজল, পৃ ২৪৫-২৪৬; প্রভাত, পৃ ১০৬-১০৭)।

কিন্তু বিশ্বচলচ্চিত্রের ইতিহাসে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, যুগান্তকারী ও মাইলফলক এই ঘটনার উলেস্নখমাত্র নেই। এমনকি ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেও তার ন্যূনতম স্বীকৃতি নেই। এই বঞ্চনার জ্বালা সহ্য করেই হীরালাল সেন আজীবন একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেছেন বায়োস্কোপের নেশায়, চলচ্চিত্রের শিল্পসাধনায় (সজল,
পৃ ২৪৯)।

 

বাংলা ছবিতে গল্প বলা ও তরুণদের মনে প্রেরণা জাগানো

হীরালাল সেনের হাত ধরেই বাংলা ছবিতে গল্প বলা শুরু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গল্প-অবলম্বনে তিনি নির্মাণ করেছিলেন ভ্যাগাবন্ড (১৯০৯) নামক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র (আসগর, ৬২)। তিনি সাতটি নাটকের খ-দৃশ্য ক্যামেরায় ধারণ করেছিলেন, এসবে অভিনয় করেন নেপা বোস, অমর দত্ত, গিরীশচন্দ্র ঘোষ, কুসুমকুমারী দেবী প্রমুখ। কলকাতায় ১৯০১ সালের ৯ ফেব্রম্নয়ারি এগুলোর প্রদর্শনী হয়। কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে ১৯০৩ সালের ৬ জুন দেখানো হয় হীরালাল-নির্মিত নৃত্যমুখর আলিবাবামনের মতন শিরোনামের দুটি ছবি (প্রভাত, ১৭।

আগেকার ছবিগুলোতে ক্যামেরা এক স্থানে বসিয়ে চিত্রগ্রহণ করা হতো। কিন্তু নৃত্যমুখর আলিবাবামনের মতন এই দুটি ছবিতে ক্যামেরার স্থান পরিবর্তন করে চলচ্চিত্রায়ণের নিরীক্ষা করেন হীরালাল। এভাবে কলকাতায় তরুণদের মধ্যে নতুন এই শিল্পমাধ্যমটি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। তাঁর একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা চলচ্চিত্রকে স্থানীয় রূপ দিলো, জনপ্রিয় করল এবং সাংস্কৃতিক স্বীকৃতি অর্জনে সহায়ক হলো। সবচেয়ে বড় কথা, বহু সমসাময়িক শিল্পীকে তিনি অনুপ্রাণিত করলেন, কাজ শেখালেন। চলচ্চিত্রের শিক্ষার্থী হীরালাল সেন হয়ে উঠলেন উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও চলচ্চিত্র-শিক্ষক।

হীরালাল সেনের কাছে হাতেকলমে চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনের কাজ শিখেছিলেন ইম্পিরিয়াল বায়োস্কোপের প্রতিষ্ঠাতা অনিল চট্টোপাধ্যায় ও নলিনী চট্টেপাধ্যায়; অরোরা ফিল্ম করপোরেশনের অনাদি বোস, দেবী ঘোষ ও চারুঘোষ; কালী ফিল্মস স্টুডিওর প্রিয়নাথ গঙ্গোপাধ্যায়, এনকে চ্যাটার্জি,  প্রমথনাথ গাঙ্গুলি, নারায়ণ বসাক, সত্যচরণ বসাক, সুরেশ রায়, শচীন রায়, উপেন মৈত্র, জীতেন মৈত্র এবং তাঁর নিজের ভাগ্নে কুমার গুপ্ত এবং আরো অনেকে (প্রভাত, ১৭-১৮; প্রভাত, ৮৭; গৌরাঙ্গ, ১৭; ইতিহাস, ২৮৬)।

 

বাংলাদেশের হীরালাল সেন

হীরালাল সেনের মৃত্যুর পর গত বছর, অর্থাৎ ২০১৭ সালে একশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পৃথিবী বদলেছে অনেক। ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীন হয়েছে। পৃথিবীর মানচিত্রে নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। কিন্তু উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেনকে কেউ মনে রাখেনি। পৃথিবীর কোথাও হীরালাল সেনের কাজের স্বীকৃতি মেলেনি। বাঙালি হীরালাল হয়েছেন অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের জনক হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দাদাসাহেব ফালকে ১৯১৩ সালে তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। অথচ হীরালাল সেন তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ১৮৯৮ সালে। হীরালাল সেন যখন তাঁর জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ শেষ করেছেন, তারও পরে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন দাদাসাহেব ফালকে।

মৃত্যুর একশ বছর পর ১ আগস্ট ২০১৭ মঙ্গলবার বিকেল চারটায় তাঁর জন্মস্থান বকজুরি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রথমবারের মতো হীরালাল সেন স্মরণে আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এরপর ২৪ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে ঢাকা এবং ২৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় ১৪৯তম মৃত্যুবার্ষিকীর অনুষ্ঠান। এ বছর ২ আগস্ট ২০১৮ বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় বকজুরি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হীরালাল সেনের সার্ধশতজন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মানিকগঞ্জ পৌরসভার অধীন বকজুরি গ্রামে হীরালাল সেন সড়কের নামফলক উন্মোচন, আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।

২০১৩ সালের ১ নভেম্বর বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকেই প্রচেষ্টা ছিল হীরালাল সেনকে তাঁর যোগ্য মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে। আফ্রো-এশীয় অঞ্চলে হীরালালের প্রতি অবহেলার, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক ধারা ও বিকল্পধারার ব্যবধান ভেঙে ফেলার আন্দোলন গড়ে তোলা এখন সময়ের প্রয়োজন।

 

তথ্যসূত্র

১. দীনেশচন্দ্র সেন (প্রথম মুদ্রণ ১৯২২, আধুনিক সংস্করণ ২০১১), ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা-৯।

২. দীনেশচন্দ্র সেন (ডিসেম্বর ১৯৩৯), বাংলার পুরনারী, ন্যাশনাল লিটারেচার কোম্পানি, কলিকাতা।

৩. ১৯১০ সালে প্রকাশিত তাওয়ারিখে ঢাকা (উর্দু বই), ঢাকা।

৪. দি বেঙ্গলি (পত্রিকা), ১৯ অক্টোবর ও ৮ ডিসেম্বর, ১৯০৫।

৫. কালীশ মুখোপাধ্যায় (প্রথম প্রকাশ ১৯৬৩, নতুন সংস্করণ ২০১২), বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস (১৮৯৭-১৯৯৭), পত্রভারতী, কলকাতা।

৬. কালীশ মুখোপাধ্যায় (১৯৬৭), ভারতীয় চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন, কলকাতা।

৭. গৌরাঙ্গপ্রসাদ ঘোষ (প্রথম প্রকাশ ১৯৮২, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০২), সোনার দাগ (শতবর্ষের আলোয় বাংলা চলচ্চিত্র : ১ম পর্ব), যোগমায়া প্রকাশনী, কলকাতা।

৮. Rajat Ray, Filmography of Sixty Eminent Indian Movie Makers, Calcutta.

৯. সজল চট্টোপাধ্যায় (১৯৯৮), আর রেখো না আঁধারে, যোগমায়া প্রকাশনী, কলকাতা।

১০. Alamgir Kabir (1979), Film in Bangladesh, Bangla Academy, Dacca.

১১. T.M. Ramchandran, 70 Years of Indian Cinema, Delhi.

১২. চ-ী মুখোপাধ্যায় (২০১৮), হীরালাল সেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রথম পুরু, অশোকগাথা, কলকাতা।

১৩. জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় (১৯৮৪), চলচ্চিত্রের আবির্ভাব, কলকাতা।

১৪. আলী ইমাম (১৯৮৭), ‘হীরালাল সেন’, মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন (সম্পাদিত : ১৯৮৭), মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস
(পৃ ৮০৪-৮১৬), মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস প্রকল্প, মানিকগঞ্জ, কথা মুদ্রায়ন, ঢাকা।

১৫. নিশীথকুমার মুখোপাধ্যায় (১৯৮৭), বাংলার চলচ্চিত্রকার, কলকাতা, পৃ ১৩-১৪।

১৬. শামসুজ্জামান খান ও সেলিনা হোসেন (সম্পাদিত : ১৯৮৫), চরিতাভিধান, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

১৭. মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন (সম্পাদিত : ১৯৮৭), মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস, মানিকগঞ্জ জেলার ইতিহাস প্রকল্প, মানিকগঞ্জ, কথা মুদ্রায়ন, ঢাকা।

১৮. অনুপম হায়াৎ (১৯৮৭), বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, ঢাকা।

১৯. সৈকত আসগর (১৯৯৩), হীরালাল সেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।

২০. প্রভাত মুখোপাধ্যায় (১৯৯৪), ভারতীয় চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ হীরালাল সেন, যোগমায়া প্রকাশনী, কলকাতা।

২১. রমাপতি দত্ত (১৩৪৮), রঙ্গালয়ে অমরেন্দ্রনাথ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা।

২২. A. Nicholas Vardac (1949), Stage to ScreenTheatrical Method from Garrick to Griffith, Harvard University Press, Cambridge, UK.

২৩. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন (২০১৩), বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ, রোদেলা প্রকাশনী, ঢাকা।

২৪. অনুপম হায়াৎ (২০১৪), প্রথম বাঙালী চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন ও অন্যান্য, বঙ্গজ প্রকাশন, ঢাকা।

২৫. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন (সম্পাদিত : ২০১৬), চলচ্চিত্র অধ্যয়ন ও প্রশিক্ষ, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

২৬. শরীফ রেজা মাহমুদ (২০১৭), হীরালাল সেন সত্যাগ্রহ : নবপাঠের সন্ধানে, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ (অপ্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৬-২০১৭), ঢাকা।

পরিশিষ্ট-১ : ভারতীয় রেনেসাঁসের সূচনাকারী বাঙালি মনীষীবৃন্দ

সমাজ-সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) –  ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা; হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
(১৮০৯-১৮৩১) – কবি, সংস্কারমুক্ত দার্শনিক, যুক্তিবাদী, চিমত্মাবিদ ও শিক্ষক; দানবীর ও সমাজ-সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
(১৮২০-১৮৯১) – বাংলার নবজাগরণ আন্দোলনের পুরোধা; মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) – বাংলার নবজাগরণ সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা, লোকনায়ক স্যার সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি (১৮৪৮-১৯২৫) – ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম যুগের অন্যতম প্রধান নেতা; বিশ্ববিশ্রম্নত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭) – পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিদ, জীববিজ্ঞানী ও কল্পবিজ্ঞান রচয়িতা; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) – নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বাংলা ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি, সাহিত্যিক, গীতিকার ও দার্শনিক; আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪) – জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ; স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩-১৯০২) – আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দার্শনিক, লেখক ও সংগীতজ্ঞ; রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেন (১৮৬৬-১৯৩৯) – শিক্ষাবিদ, গবেষক, লোক-সাহিত্যবিশারদ, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার; উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের জনক হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭) – অবিভক্ত ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং বিশ্বের প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য ও রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাতা; দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ (১৮৭০-১৯২৫) – প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা; নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন (১৮৮০-১৯৩২); ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮২-১৯২২) – বাঙালি কবি ও ছড়াকার, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু (১৮৯৭-১৯৪৫) – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কিংবদন্তি নেতা, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) প্রমুখ।

 

পরিশিষ্ট-২ : চলচ্চিত্র কোম্পানির তালিকা

১. রয়েল বায়োস্কোপ কোম্পানি (১৮৯৮), ২. লন্ডন বায়োস্কোপ, ৩. পাইওনিয়ার বায়োস্কোপ (১৯০৩), ৪. চ্যালেঞ্জ বায়োস্কোপ কোম্পানি (১৯০৩ : মি.এ. ঘোষ), ৫. মোটোস্কোপ অ্যান্ড বায়োগ্রাফ কোম্পানি (১৯০৩ সালে বাড়িতে বসে ছবি দেখার প্রজেকশন মেশিন ভারতেই তৈরি করে), ৬. ম্যাডান বায়োস্কোপ কোম্পানি (১৯০৩), ৭. এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ, ৮. প্যাথে কোম্পানি, ৯. অরোরা ফিল্মস, ১০. কালি ফিল্মস, ১১. টেকনিশিয়ানস স্টুডিও, ১২. মিনার্ভা বায়োস্কোপ, ১৩. ইম্পিরিয়াল বায়োস্কোপ, ১৪. আলফ্রেড বায়োস্কোপ, ১৫. ম্যাডানদের ইলেকট্রিক বায়োস্কোপ, ১৬. হীরালালের দুই শিষ্য চারু এবং দেবী ঘোষের সঙ্গে অনাদি বোস মিলিতভাবে প্রতিষ্ঠিত ‘অরোরা সিনেমা’, ১৭. ক্যালকাটা বায়োস্কোপ, ১৮. ওয়েলিংটন বায়োস্কোপ, ১৯. গেস্নাব ট্রটার বায়োস্কোপ, ২০. ক্যাপিটাল বায়োস্কোপ, ২১. অরোরা বায়োস্কোপ, ২২. ওরিয়েন্টাল বায়োস্কোপ, ২৩. বেঙ্গল বায়োস্কোপ, ২৪. মনার্ক বায়োস্কোপ।

 

পরিশিষ্ট-৩ : হীরালাল সেন-নির্মিত চলচ্চিত্রের তালিকা

কাহিনিচিত্র ও নাটকের খ-াংশ ২২টি

১. Fatimaan Indian Dance (১ জানুয়ারি ১৯০০, সজল পৃ ৭১);  ২. পারস্যপ্রসূন (১৮৯৮) – কাহিনি গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মুক্তির তারিখ : ৩ এপ্রিল; ৩. ভ্রমর – কাহিনি বঙ্কিমচন্দ্র; ৪. সীতারাম – কাহিনি বঙ্কিমচন্দ্র; ৫. মৃণালিনী – কাহিনি বঙ্কিমচন্দ্র; ৬. সরলা – কাহিনি তারকনাথ গাঙ্গুলী; ৭. আলিবাবা – কাহিনি ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ; ৮. ভ্যাগাবন্ড (১৯০৯) – কাহিনি শরৎচন্দ্র; ৯. বুদ্ধদেব; ১০. হরিরাজ; ১১. দোললীলা; ১২. দুটি প্রাণ – কাহিনি অমর দত্ত; ১৩. সোনার স্বপন – প্রফুল্ল মুখার্জি; ১৪. মনের মতন – গিরিশচন্দ্র ঘোষ; ১৫. লক্ষ্মণ বর্জন (১৯০১) – কাহিনি গিরিশচন্দ্র ঘোষ, মুক্তির তারিখ : ৩ জুলাই; ১৬. মজা – অমর দত্ত; ১৭. বধূ; ১৮. চাবুক; ১৯. গুপ্তকথা; ২০. ফটিকজল; ২১. দলিতা ফনিনী;  ২২. জেলের ছেলে (১৯০৪) – মূল : শকুন্তলা কাহিনির ভাবালম্ব^নে।

 

সংবাদচিত্র ১৬টি

১. কলকাতায় অনুষ্ঠিত করোনেশন দরবার (১৯০৩), ২. দিলিস্নতে অনুষ্ঠিত করোনেশন দরবার (১৯০৩), ৩. গ্র্যান্ড প্যাট্রিয়টিক ফিল্ম (১৯০৫), ৪. রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রসঙ্গে টাউন হলে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক প্রতিবাদ সভা – ‘Anti-Partition Demonstration and Swadeshi movement at the Town Hall, Calcutta on 22nd September 1905’, ৫. বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের নেতা রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে শোভাযাত্রা (১৯০৫), ৬. গঙ্গাস্নান ও রাখীবন্ধন (১৯০৫), ৬. লোকমান্য তিলকের কলকাতা আগমন (১৯০৬), ৭. গঙ্গাস্নান (১৯০৬), লোকমান্য তিলকের ওপর সংবাদমূলক তথ্যচিত্র-১, ৮. শোভাযাত্রা (১৯০৫) লোকমান্য তিলকের ওপর সংবাদমূলক তথ্যচিত্র-২, ৯. লোকমান্য তিলকের কলকাতা আগমন, গঙ্গাস্নান ও শোভাযাত্রা (১৯০৬), ১০. ৭ ডিসেম্বর দিলিস্নতে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও সম্রাজ্ঞী মেরির অংশগ্রহণ (১৯১১), ১১. দিলিস্ন ও কলকাতায় দরবারের ছবি (১৯১১-১২) প্রথম খ-, ১২. দিলিস্ন ও কলকাতায় দরবারের ছবি (১৯১১-১২) দ্বিতীয় খ-, ১৩. দিলিস্ন ও কলকাতায় দরবারের ছবি (১৯১১-১২) তৃতীয় খ-, ১৪. দিলিস্ন ও কলকাতায় দরবারের ছবি (১৯১১-১২) চতুর্থ খ-, ১৫. দিলিস্ন ও কলকাতায় দরবারের ছবি (১৯১১-১২) পঞ্চম খ-, ১৬. দিলিস্ন ও কলকাতায় দরবারের ছবি (১৯১১-১৯১২) ষষ্ঠ খ-।

 

তথ্যচিত্র ১৪টি

১. A Panaroma of Indian Scenes and Processions (1898), ২. পথের ছবি (১৯০০), ৩. গঙ্গার ঘাটের ছবি (১৯০০),   ৪. প্যাথে নৃত্যদৃশ্য (১৯০০), ৫. প্যাথে গুচ্ছছবি (১৯০০), ৬. চিৎপুর রোডের চলমান দৃশ্য (১৯০১), ৭. বকজুরিতে বিয়ে (১৯০২-০৩), ৮. ধলেশ্বরী নদীতে স্নান (১৯০২-১৯০৩), ৯. রাজেন্দ্র মলিস্নকের বাড়িতে বিয়ের উৎসব (১৯০২-১৯০৫), ১০. দুলিচাঁদ মলিস্নকের বাড়িতে বিয়ের উৎসব (১৯০২-১৯০৫), ১১. শিবচরণ লাহার বাড়িতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান (১৯০২-১৯০৫), ১২. রাজেন্দ্র মলিস্নকের বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠান (১৯০২-১৯০৫), ১৩. শিবচরণ লাহার বাড়ির বিভিন্ন অনুষ্ঠান (১৯০২-১৯০৫), ১৪. বাঙালি ধীবর (১৯০৪)।

 

বিজ্ঞাপনচিত্র ৩টি

১. বটকৃষ্ণ পালের এডওয়ার্ডস ‘এন্টিম্যালেরিয়াল স্পেসিফিক’, ২. সি. কে. সেনের ‘জবাকুসুম কেশতৈল’, ৩. ডবিস্নউ মেজর অ্যান্ড কোম্পানির ‘সার্সপেরিলা’ (সালসা পিল)।

(সূত্র : চ-ী, পৃ ১৬, ৪২-৪৩; প্রভাত, পৃ ৮২; জয়ন্ত, পৃ ৫৯-৬৩; গৌরাঙ্গ, পৃ ১৭; আসগর, পৃ ৬৩-৬৪)

 

পরিশিষ্ট-৪ : Visit Film (১৯১২)-এর সাত খ–র বিবরণ

খ–১. বোম্বাই প্রদর্শনীর শোভাযাত্রা (৬ ডিসেম্ব^র ১৯১১),

খ–২. The state entry of their Majesties’ King George the Fifth and Queen Mary into Delhi.

এবং দিলিস্নর দরবার (৭-১১ ডিসেম্বর ১৯১১),

খ–৩. ভারত সরকারের ‘সাদর সম্ব^র্দ্ধনা’, এবং বড়লাট, ছোটলাট, নিজাম, গোয়ালিয়র, পাটিয়ালা প্রভৃতি রাজন্যবর্গের শ্রদ্ধাঞ্জলি, Grand Coronation Durbar of their Imperial Majesties’ at Delhi. (৩০ ডিসেম্ব^র ১৯১১)

খ–৪. সম্রাট দম্পতির কলকাতা আগমন Their Imperial Majesties arrival in Calcutta (৩০ ডিসেম্ব^র ১৯১১),

খ–৫. সম্রাট দম্পতির প্রিনসেপ ঘাট পরিভ্রমণ (২ জানুয়ারি ১৯১২), খ–৬. কিংস কাপ রেসে সম্রাট দম্পতি এবং Proclamation and the Grant Pageant on the Calcutta Maidan before his Imperial Majesties. (২ জানুয়ারি ১৯১২)

খ–৭. কলকাতায় শোভাযাত্রাপূর্ণ প্রদর্শনী ও Departure of their Imperial Majesties from Calcutta … (৮ জানুয়ারি ১৯১২)

(সূত্র : কালীশ, পৃ ৩৯২-৩৯৩; সজল, পৃ ২৪৫)