সুন্দরবন

পৃথিবী এখানে ঘুমিয়ে থাকে – জেগে থাকে একটি নদী – ঝরনার ভাষায় সে-কথা বলে, পাখিরা এখানে বৃক্ষের মমতায় ডানা মেলে – জেগে থাকে একটি অরণ্য – পাতার বাঁশিতে সে সুর তোলে, প্রসব কাতর মাছেরা এখানে আশ্রয় খোঁজে – জেগে থাকে একটি জলঘুঘু – ক্ষুধার চোখে সে রোদ পান করে;

এখানে বাতাসের সাথে জলের কণারা কথা বলে, নারীদের কান্না নদীর কান্নার সাথে মিশে যায়, সন্ধ্যা হলে গাছেরা বনিতাদের মতো চুল বেঁধে অপেক্ষা করে নতুন কোনো প্রেমিকের, জোয়ার এলে মাঝনদীতে নৌকা দোলে কেবল, যেমন ওপারে ঝড় এলে প্রাচীন ঘরগুলো নড়বড় করে মাটির ওপরে দাঁড়ানো গাছেদের মতো, মানুষের মনও বিপদের সময় খুব বেশি উত্তাল হয়, সদ্য হাঁটতে শেখা শিশুটির মতো বারবার পড়ে যায় যেন, অথবা নতুন গজিয়ে ওঠা সেই লতাটির মতো যে সামান্য বাতাসে হেলে হেলে পড়ে যায় শুধু;

এখানে গভীর বনে কিশোর-কিশোরীর মতো আলো আর ছায়া খুনসুটিতে মেতে থাকে, অজস্র ফড়িং ওড়ে – বন্য ফুলেরা বিছিয়ে রাখে বেহেশতি বিছানা, কুমারী লতা লাজুক বধূটির মতো কেবল আনমনে দেখে চারপাশ, বহুবিধ লতারা ছড়িয়ে রাখে তাদের জীবন সংসার, মাংসাশি প্রাণিদের দেখে ব্যাঙেরা পথ করে দেয়; শত্রুর গন্ধ পেলে নিজেকে বদলায় বহুরূপী কীটেরা, ধ্রুপদী সুরে গাছের আড়াল থেকে গান গেয়ে চলে এক গায়ক পাখি; সবুজ পাতারা অনবরত হাসাহাসি করে সহোদর বোনেদের সঙ্গে;

এখানে বাঘের কামড়ে মারা যাওয়া হরিণের শেষ চিৎকার শোনা যায়, বহু দূর দেশ থেকে পণ্য নিয়ে আসে নতুন কোনো জাহাজ, সেই জাহাজের নাবিকের মনে পড়ে বাড়িতে রেখে আসা অভিমানী সঙ্গিনীর কথা, হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলে সেই রমণী ভিজে ভিজে শরীর জুড়ায়, কিন্তু, তার মনটি কেবল অস্থির হয়ে গর্জে ওঠে বজ্র মেঘের মতো, বিদ্যুৎ চমকায় বনের কোনো কোনো খাঁড়ির ওপর, মেঘ থামলে ঠিক তার বিপরীতে ভেসে ওঠে রংধনু;

এখানে আমার কুমারী মা জেগে থাকে, ধরিত্রীর মতো সন্তানের সব গ্লানি যে নীরবে সয়ে যায়, কেবল শুকনো পাতা ঝরার শব্দ শোনা যায়;