শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ও কাব্যবোধ

তাঁর প্রয়াণের প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় আগে কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘তথাকথিত পাপবোধ আমার নেই। যে কাজ অপরের অনিষ্ট করে তা অপরাধ। ধর্মীয় আচরণকে আমি অবহেলা করতে চাই, যে-কারণে আমার আঙুলে আংটি নেই, আমার গলা থেকে পইতে পরিত্যক্ত আর কিছুকাল বোহেমিয়ান জীবনযাপন করার পর অবশেষে একজন অসবর্ণ নারীর পাণিগ্রহণ করেছি।’ আর তার সঙ্গে তিনি এটুকুও যোগ করেছিলেন যে, ‘আমাদের বিবাহিত জীবন চল্লিশ বছর ছুঁয়েছে। আমাদের জীবনে কোনো বিরোধ নেই। তবে আজকাল আমি একটু একলা থাকতে  চাই।’ দাম্পত্যজীবনে বিরোধ নেই অথচ একা থাকতে চাইতেন কেন? এটাকে কি একজন কবির স্ববিরোধ বলে বিবেচনা করবো, নাকি আধুনিক কবির জীবনটাই এমন – সব স্ববিরোধ অনেকটা পরিধি জুড়ে থাকে?

পুরো চিত্রটা দেখার প্রয়াসে, আমরা তখন কবি থেকে কবিতায় চলে আসি। এ-প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসুর কথাগুলো মনে পড়ে। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি খানিকটা নির্দেশনা দিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘এই আধুনিক কবিতা এমন কোনো পদার্থ নয় যাকে কোনো-একটা চিহ্ন দ্বারা অবিকলভাবে শনাক্ত করা যায়।’ কবির জীবনটাও বোধহয় সেরকমই। কোনো-একটা প্রসঙ্গ ধরে তাঁর জীবনের অভিমুখ চিহ্নিত করতে চাওয়াটাও বোধহয় একটা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয় কবিতার সমালোচককে। কী সেই ঝুঁকি? ঝুঁকিটা হচ্ছে – কবির জীবনের সত্যটাকে ঠিকমতো আবিষ্কার করতে না-পারার ব্যর্থতা। শঙ্খ ঘোষ তো বলেইছিলেন, ‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।’ সেইসঙ্গে তিনি এটিও স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, ‘জীবিকাবশে শ্রেণীবশে এতই আমরা মিথ্যায় জড়িয়ে আছি দিনরাত যে একটি কবিতার জন্যেও কখনো-কখনো অনেকদিন থেমে থাকতে হয়।’ এই উপলব্ধিটুকুই যেন শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর কবিতায় এইভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন –

সেই লেখাটা লিখবো বলে বারো বছর কলম ঘষছি

বারো বছর, তিনশো পদ্য লিখে অনেক কলম ভাঙলো

                                    আঙুল ক্ষয়ে ঝাঁটার কাঠি,

বারো বছর রক্তক্ষরণ, জীবন-মরণ যুদ্ধ চলছে

                                     আমি ছাড়ার পাত্র নাকি?

(‘সেই লেখাটা’, না নিষাদ)

যাকে শরৎকুমার একপ্রকার রক্তক্ষরণ হিসেবে, জীবন-মরণ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করতে চাইছেন, অনেকটা তার কাছাকাছি এসে বুদ্ধদেব বসু একসময় বলেছিলেন, ‘কবিতা লেখার ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ সেই যুদ্ধটাই আরো অনেক কবির মতো তাঁর নিজস্ব ধরনে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়কে একাকী করে যেতে হয়েছে।

দুই

‘মত্ত অবস্থায় রচিত’ কবিতায় শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁদের বেশ কজনার জীবনযাপন নিয়ে থেকে শুরু করে রাত্রিযাপনের ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলেন : ‘রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক/ চৌরঙ্গী ভবানীপুর থেকে শ্যমাবাজার বদ্বীপ।’ কবিতার জগতের বন্ধুবৃত্তে আরো স্পষ্টভাবে যদি বলা যায়, তাহলে বলতে হয়, সুনীল-দীপক মজুমদার-আনন্দ বাগচীদের কৃত্তিবাসে শরতের আবির্ভাব অনেকটাই আকস্মিক। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এ-সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘এক সন্ধেবেলা বৃন্দাবন পাল লেনের বাড়ির বাইরের ঘরে বসে আড্ডা ও পত্রিকার প্রুফ দেখাটেখা চলছে, রাস্তার দিকে জানলার কাছে এসে দাঁড়াল এক যুবক, পুরোদস্তুর সুট-টাই পরা অফিসার-সুলভ চেহারা, তিনি জানালেন যে, কৃত্তিবাস পত্রিকার ঠিকানা খুঁজে খুঁজে এসেছেন, একটি কবিতা জমা দিতে চান।’ কে সেই কবি আর কী ছিল তাঁর নাম? সুনীল আরো জানিয়েছিলেন, সেই জমা দিতে চাওয়া কবিতার তলায় লেখা ছিল কবির নাম – নমিতা মুখোপাধ্যায়! যে-নাম কি না সুনীলদের কাছে অপরিচিত কোনো নাম নয়। কারণ এই নামে একজন নারীকবি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় নিয়মিত তখন লিখছেন। কে এই নমিতা মুখোপাধ্যায়?  সুনীলই জানিয়েছেন, ‘হাত বাড়িয়ে কবিতা নিতে গেছি, কিন্তু যুবকটি বললেন, তিনি কবিতার বাহকমাত্র নন, তিনিই ওই ছদ্মনামে লেখেন, তাঁর নিজের নাম শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, আমরা অট্টহাস্য করে উঠলাম।’ তারপরের ঘটনা হচ্ছে, সুনীলের ভাষায়, ‘প্রায় আক্ষরিকভাবেই, যেমন শরৎকুমারকে ঘরের মধ্যে এনে গলার টাই খুলে ফেলানো হল, তেমনই ছাড়িয়ে দেওয়া হল ছদ্মনাম।’ শরৎকুমারও নিজের সম্পর্কে জানিয়েছিলেন, ‘প্রথম থেকেই আমি পুরোপুরি চাকুরিজীবী। আমার সকাল ও দুপুর ছিল অন্যত্র বাঁধা। আর সব বন্ধুবান্ধব ছিলো ওই সময়ে মোটামুটি বেকার বা হাফ বেকার।’ সরীসৃপের খোলস পাল্টানোর মতো করে যেন নমিতা মুখোপাধ্যায়ের খোলস ফেলে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় তৈরি হয়ে কবিতার জগতে উঠে এলেন। একে কী বলে একজন কবির নতুন জন্ম?

হয়তো তা-ই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সোনার হরিণ (২৫ বৈশাখ, ১৩৬৪)-এর নাতিদীর্ঘ ভূমিকায় শরৎকুমার সেদিন লিখেছিলেন, “নমিতা মুখোপাধ্যায়’ – এই ছদ্মনামে কিছুকাল যাবৎ কবিতা অভ্যাস করেছি। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই দুর্বলতাকে প্রশ্রয় দিয়েছিলাম, সিদ্ধ হওয়া দূরে থাক, তা আজ আমার পরিণতির প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ কেন এই প্রতিবন্ধকতা? শরৎকুমার খুব চমৎকারভাবেই বলেছিলেন, ‘কাব্যচর্চা যে হৃদয়চর্চা – সেখানে ছদ্মবেশ যে অসম্ভব, এ চৈতন্য আমার প্রথমে উদ্রিক্ত হয়নি।’ একজন ‘কৃত্তিবাসী কবি’, যাঁদের কি না, সুনীলের ভাষ্যমতে, ‘সুনামের চেয়ে দুর্নামই ছিল বেশি’, যাঁদের কবিতার বিরুদ্ধে চেঁচামেচি, উচ্ছৃঙ্খলতা, অশ্লীলতার অভিযোগ ছিল ঘরে-বাইরে, তাঁদেরই একজন কবি কি না সহজভাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন, কাব্যচর্চা আদতে একধরনের  হৃদয়চর্চা!  একটু  অবাকই  তো  হতে  হয়!  অবশ্য কৃত্তিবাসের কবিরা যে-মানুষটিকে অসম্ভব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসতেন, সেই বুদ্ধদেব বসু অবশ্য মনে করতেন, ‘বিশ্বাস, উচ্ছ্বাস উদ্দীপনা – এ-সমস্ত জিনিশকে যাঁরা রোমান্টিক বলে এক পাশে সরিয়ে রাখেন, তাঁদের পক্ষে সাহিত্যচর্চা নিতান্তই অবৈধ।’   কৃত্তিবাস-গোষ্ঠীর অন্য কবিদের মতো শরৎকুমারও এটিকে মান্য করতেন। তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায় অন্তত সেসবের বিস্তর নমুনা দেখতে পাওয়া যায় –

কোমল রাগিণী কেউ আজ শুনবে না,

দুপুর বেলায় ভৈরবী কেন ধরো?

অসম্ভব যে গভীর প্রেমকে চেনা,

শিউলি বকুল রজনীগন্ধা হেনা –

এরা সব নাকি মিথ্যে কথায় কেনা;

তাই বলি, মন চুপ করো চুপ করো।’

(‘অবাধ্য মন’, সোনার হরিণ)

কৃত্তিবাস-গোষ্ঠীর আরো কয়েকজন কবির সঙ্গে শরৎকুমারকেও যদি ‘রোমান্টিক কবি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, তাকে খুব-একটা অনৃতভাষণ বলা যায় না। রোমান্টিক তো বলছি, কোন ধরনের রোমান্টিক ছিলেন শরৎকুমার? বুদ্ধদেব বসু রোমান্টিকতাকে বিশ্বসাহিত্যের একটি ‘বিরাট ঘটনা’ হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। সেইসঙ্গে তাঁর এটিও মনে হয়েছে, ‘মানবজাতির বড়ো একটি তথ্য, হিন্দু, গ্রীক, চৈনিক ও খ্রিস্টান শিল্পের পূর্ণোদ্যম সত্ত্বেও, যুগের পর যুগ প্রচ্ছন্ন থেকে গিয়েছে।’

সেটা কী? বুদ্ধদেব বসুর ভাষায়, ‘সেই ভাবটির নাম বিষাদ।’ বুদ্ধদেব তার সঙ্গে আরো একটু বিস্তারে গিয়েছেন, গিয়ে তারপরে বলেছেন, ‘বিষাদ, যা য়োরোপীয় রেনেসাঁসের একটি আবিষ্কার, যার প্রথম উদাহরণ পেত্রার্কার কবিতায়, তাকে মানুষের এক জন্মান্তরক্ষণে, দা ভিঞ্চি হাসির মধ্যে দ্রব করে দিলেন; কোনারকের বাদিনীমূর্তির হাস্য যেমন আনন্দময়, তেমনি মোনালিসার হাসি বিষাদে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট। এমনকি বত্তিচেল্লির ভেনাসের মুখেও আমরা নির্ভুলভাবে বিষাদের আভাস দেখতে পাই।’ শরৎকুমারের কবিতাতেও বিষাদের সেই সর্বব্যাপী একটা আবহ নানারূপে আমরা দেখতে পেয়েছি। তিনি সেই দিক থেকেই প্রবলভাবে রোমান্টিক ছিলেন। একটি নমুনা পেশ করছি –

কষ্ট একটা ঘুরছে ফিরছে পিঠের মধ্যে ব্যথার মতন,

যেন কোথায় আঘাত পেয়েছিলাম কাল রাত্রিবেলা

সে কার মুষ্টি, বন্ধু কিংবা ছদ্মবেশী বান্ধবী, কেউ

সহযাত্রী মজাপ্রবণ?

– আঘাত একটা পেয়েছিলাম।

হে নিরাকার জলস্তম্ভ, এর নাম কি জীবনযাপন?

(‘হে নিরাকার জলস্তম্ভ’, না নিষাদ)

একজন কবির মনের দিক থেকে, তাঁর ভাষা-ব্যবহারের দিক থেকে পরিণত হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়ায় ভীষণ রকম আস্থা রাখতেন শরৎকুমার। তাঁর নিজের কবিতাতেও আমরা সেই ক্রম-পরিণতি দেখতে পেয়েছি।

তিন

কবি ইয়েটস (William Butler Yeats, 1865–1939) নানাভাবেই বলেছেন যে, `A poet writes always of his personal life, in his finest work out of its tragedy, whatever it be, remorse, lost love, or mere loneliness‘ তাঁর উপলব্ধিকে মর্যাদা দিয়েই যেন কৃত্তিবাসের কবিরা তাঁদের কবিতায় ব্যক্তিগত জীবনকে মর্যাদা দিয়েছিলেন। এ-প্রসঙ্গে অবশ্য কৃত্তিবাস-গোষ্ঠীর প্রধান পুরুষ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বিদেশি ধাঁচে একটা কোনো নাম দিয়ে কাব্য আন্দোলন আমরা শুরু করিনি। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিরা নিজেদের মধ্যে কোনোরকম পরামর্শ না করেই যে নতুন রীতিতে কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাকে বলা যেতে পারে স্বীকারোক্তিমূলক কবিতা।’ এই কবিতার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘এই কবিতা শুধু সৌন্দর্যের নির্মাণ নয়, রূপকল্পের সন্ধান নয়, এইসব কবিতা যেন তাদের রচয়িতাদের জীবনযাপনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত।’ সুনীলের নিজের কবিতা তো বটেই, সেইসঙ্গে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তারাপদ রায়দের কবিতার দিকে তাকালেও সেই বৈশিষ্ট্যগুলো প্রতিভাত, প্রদীপ্ত হয়ে উঠতে দেখি। শরৎকুমারের কবিতাও তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু নয়। তবে এখানে একটি কথা বলে নেওয়া দরকার। সেটি হচ্ছে, সুনীল যতই বিদেশি ধাঁচ বা প্রভাবের কথা অস্বীকার করুন-না-কেন, তাঁদের এসব কবিতার সঙ্গে মার্কিন মুলুকের স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার (Confessional poetry) মিল দেখতে পাওয়া যায়। যেখানে কি না `extreme moments of individual experience, the psyche, and personal trauma, mental illness, sexuality, and suicide, often set in relation to broader social themes’- এই বৈশিষ্ট্যগুলো নানান মাত্রায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শরৎকুমারের কবিতার দিকে যদি তাকাই তাহলে সেইসব বৈশিষ্ট্য খানিকটা ভিন্ন ধাঁচে দেখতে পাবো –

ক. না, আপনি অমন করে হাসবেন না শ্রীমতি ঊর্মিলা/ নিতান্ত অশ্লীল জীর্ণ/ আপনার পুরনো দাঁতগুলি/ বিভ্রান্ত করেছে পিতৃপিতামহদের নিত্যকাল।

খ. আবাল্যবার্ধক্য এই আমাদের নিয়তি নিষ্ঠুর!/ প্রেম বলে অন্যবস্তু গছিয়েছে ঈশ্বর চতুর।

গ. বকুল দিদির মতো উলু দিয়ে চলে গেল আমাদের যৌবন বয়স/ উবু হয়ে দেখছি তুমি আমি – সজীব দুজনে;/ যেহেতু বাহান্নজন স্ত্রীলোক শতকে এই তথ্য জেনে গেছি/ অতএব/ দুঃখ নেই, গ্রাহ্যই করি না আমরা – কারা গেল, কারা কথা দিয়েও এল না।

ঘ. ‘ভালো লাগে না এই একঘেয়ে দাম্পত্য/ দুজন মানুষ একসঙ্গে সেঁটে থাকা, অথচ/ ঝগড়া নেই কোথাও। পাশাপাশি শোয়া কিন্তু/ ছোঁয়াছুঁয়ি হয় না অনেক দিন, কেননা,/ আকর্ষণ নেই শরীরের, তার উপর ভয়/ কখন কোন্ ব্যথায় হাত লেগে যায়।

শুধুই কবিতাতেই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত গদ্যেও শরৎকুমার তাঁদের দাম্পত্য জীবনের একঘেয়েমির কথা বলেছিলেন, অকপটেই তিনি যে আজকাল একলা থাকতে চান, সেসবও জানিয়েছিলেন। এটা থেকে আমরা বলতে পারি যে, জীবন ও শিল্পের মধ্যে বিরোধ নয়, বরং একরকম সমন্বয়ের প্রচেষ্টা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের মধ্যে ছিল। এখানেই তাঁর বিশিষ্টতা। একেই কেউ-কেউ তাঁর কবিতার ‘ব্যবহারিক স্বাচ্ছন্দ্য’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

কবি ও সমালোচক বার্ণিক রায় শরৎকুমারের কবিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তাঁর কবিতা ব্যক্তির মনের ও হৃদয়ের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে চেষ্টা করে।’ এছাড়াও ‘জীবন সম্বন্ধে কোনো পূর্ব নির্দিষ্ট ছক কেটে না লেখার ফলে’ শরৎকুমারের কবিতায় বিভিন্ন সময়ে ‘পরিবর্তন ও বৈচিত্র্য’ এসেছে। এতে তাঁর জীবনের বোধ যেমন বিস্তারিত হয়েছে, তেমনি কবিতার ভাব ও ভাষায় এসেছে আন্তরিকতা। এরই জের টেনে বার্ণিক রায় স্বীকার করেছিলেন যে, আন্তরিকতাই শরৎকুমারের লেখার মূলকথা। তাঁর মতে, ‘এই আন্তরিকতা থাকলে যে কোনো লেখাই সাহিত্য হয়ে ওঠে।’ এই আন্তরিকতার গুণেই শরৎকুমারের কাব্যসাধনায় এক ক্রমপরিণতি দেখতে পাওয়া যায়।

চার

এই বিষয়ে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় নিজেও খুব সচেতন ছিলেন। সে-কারণেই তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘মনের দিক থেকে, ভাষা ব্যবহারের দিক থেকে, ক্রমশ পরিণত হয়ে ওঠা কোনো কবির জীবনে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা।’ সেইসঙ্গে এর উল্টোপিঠকেও তিনি অস্বীকার করেননি। একইসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, এটি আবার কবির জন্যে ‘উদ্বেগজনকও বটে, কারণ এর মধ্যে কোন্ ফাঁকে তাঁর সুসময় আসে এবং চলে যায়, তিনি জানতে পারেন না।’ তাহলে কে পারেন? শরৎকুমার একজন আন্তরিক কবির মতোই এখানে কবিতার তন্নিষ্ঠ পাঠককে গুরুত্ব দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, সেটা বুঝতে ‘পাঠক পারেন। পাঠকের সামনে তাই মোটামুটি সব তাশ ফেলে খেলাই ভালো।’ এই যে পাঠককে গুরুত্ব দেওয়া, এটি তাঁর সাহিত্যের প্রতি সেই আন্তরিক অভিব্যক্তিরই আরেকটি চিহ্ন। পাঠক তো বটেই, সমালোচকের দিক থেকেও, কবির এই প্রবণতাকে সম্মান না-জানিয়ে কোনো উপায় থাকে না।

এতো কিছুর পরেও তিনি নানাভাবে উপেক্ষিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা খুব বেশি দেখা যায়নি। কবিতাসমগ্রের ভূমিকায় তিনি তাঁর তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘সর্বসাকুল্যে ন’টি কবিতার বই। তার মধ্যে সাতটি বই অনেকদিন হল পাওয়া যায় না। ইতিমধ্যে নতুন প্রজন্মের কবিতা-পাঠক তৈরি হয়ে উঠেছে। এককভাবে নিঃশেষিত বইগুলির পুনর্মুদ্রণ আর সম্ভবপর নয় দেখে কবিতাসমগ্র প্রকাশের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।’ তারপরই বলেছেন, ‘এক খণ্ডে সম্পূর্ণ গ্রন্থ প্রকাশ অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারসহ নানা জায়গায় আর্থিক অনুদানের জন্য আবেদন করেছিলাম। প্রত্যাশিতভাবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তখন মনে হল, মৃত্যুর আগে এই পরিকল্পনা কার্যকর করা যাবে না।’ (ডিসেম্বর, ১৯৯৪) আমাদের সৌভাগ্য যে, তিনি চলে যাওয়ার আগেই তাঁর সেই ইচ্ছে পূর্ণ হয়েছে। প্রথমে ‘অন্তরঙ্গ প্রকাশনা’ থেকে ও পরবর্তী সময়ে ‘সিগনেট প্রেস’ থেকে – এই দু-দফায় তাঁর কাব্যসমগ্র প্রকাশিত হয়।

পাঁচ

নিজের ‘জীবনবোধ’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শরৎকুমার জানিয়েছিলেন, ‘অল্পবয়সে আমি দারিদ্র্যকে ঘৃণা করতে শিখেছি। বিশেষ করে সেই রকম দারিদ্র্য যেখানে অনেকগুলি সন্তান। আমার ছোটো বোন আড়াই বছর বয়সে ডিপথেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়।’ এইসব দারিদ্র্য, বেদনা আর অপমানের মধ্যে দিয়ে কবিকে বেড়ে উঠতে হয়েছে। তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমি নিজে কলেজ জীবনের তিন বছর সময় এক ধনী মাসির বাড়িতে আশ্রিত থেকেছি। তারা সাহায্য না করলে আমার উচ্চশিক্ষা লাভ সম্ভব হত না, তবু তাদের প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধার বোধ জন্মায়নি।’ জীবন সম্পর্কে তাঁর এই বিতৃষ্ণার বোধ আগাগোড়া তাঁর সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলেছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, কবিতার পাশাপাশি তিনি গল্প-উপন্যাসও রচনা করেছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধও লিখে গিয়েছেন।

তাঁর বিশ্বাসের জগৎ সম্পর্কে পাঠককে একটি ধারণা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি পরজন্ম মানি না। … পরম শক্তিমান ঈশ্বরের প্রতিও আমার শ্রদ্ধা নেই, যেমন নেই কোনো মহাপুরুষের প্রতি আনুগত্য।’ তারপরও তিনি নিজের সম্পর্কে জানিয়েছেন, ‘সত্য ও মিথ্যা এই দুয়ের মধ্যে আমি তফাত করতে চাই। অন্যায় কাজকে এড়িয়ে চলি।’ তিনি নিজে না-বললেও আমরা বুঝে নিতে পারি যে, এটি হয়তো ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ধর্ম।

মৃত্যুর প্রায় এক যুগ আগে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘জরা-সংক্রান্ত অবসাদ কিছু আছে আমার শরীরে। তবে এখন যে-কোনো সময়ে আমি মৃত্যুকে স্বীকার করতে প্রস্তুত।’ শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি কাব্যগ্রন্থের নাম আছি সংযত, প্রস্তুত। মৃত্যুকে তিনি নির্ভয়েই জয় করবার সামর্থ্য অর্জন করেছিলেন। ‘রসুলপুর’ শীর্ষক একটি কবিতায় বলেছিলেন : ‘সমস্ত পাখি এক সঙ্গে ডেকে উঠল, কুরর, কুরর, কুরর -/ ট্রেন ছেড়ে দাও, ট্রেন ছেড়ে দাও।’

ছয়

ডিসেম্বর ২১, ২০২১ সালের মঙ্গলবার ভোর ৩টা ৩৫-এ শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের জীবনের শেষ ট্রেন তাঁকে নিয়ে মহাকালের গর্ভের দিকে চলে গেল। তিনি কবিতায়, তাঁর স্বপ্নের জগতের, একটি নিজস্ব সংসারের কথা বলতেন। এখন হয়তো সেই নতুন সংসার তিনি গুছিয়ে নিতে শুরু করবেন; কারুর সঙ্গে আর কথা বলবেন না।