নাসরীন জাহানের ছোটগল্পে মৃত্যুচিন্তা

আশির দশকের বাংলা ছোটগল্পে এক স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত নাম নাসরীন জাহান (জন্ম ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দ)। কৈশোর থেকে তিনি বিশ্বসাহিত্য মন্থন করে তিলে তিলে নিজেকে প্রস্তুত করেন। তাঁর পাঠস্পৃহা, শ্রম-নিষ্ঠা এবং সহজাত বিরল সৃজনক্ষমতা অল্প বয়সেই তাঁকে এক বিস্ময়কর পরিপক্ব লেখকের মর্যাদা দিয়েছে। তাই রূপমের সম্পাদক আন্ওয়ার আহমদ কিশোরী নাসরীনের লেখা পড়ে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘তোমার পুরুষ গল্প অনেক পুরুষকে লজ্জা দিয়েছে।’ সেই থেকে বৈচিত্র্যধর্মী ও নিরীক্ষামূলক বহু গল্প-উপন্যাস রচনা করে তিনি বাংলা কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন।

নাসরীন জাহানের চিন্তা-কল্পনার নিজস্ব ধরন ও ভাষা-সৌকর্য তাঁকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে। এই লেখক গল্পগুলোতে শুধু কাহিনি বয়ান করেন না বা কেবল চরিত্র সৃষ্টি করেন না – গভীর জীবনবোধজাত মানবচেতনার বিচিত্র অনুভব উঠে আসে তাঁর রচনায়। আবার তাঁর কিছু গল্প মুখ্যত চিন্তাপ্রধান – সেখানে বর্ণিত ঘটনা ও দৃশ্যকল্প পাঠকের মধ্যে অভূতপূর্ব এক শিহরণ সৃষ্টি করে। মৃত্যুভয়, রোগ ও মৃত্যুযন্ত্রণা, মৃত্যুর নির্মমতা, আত্মবিনাশ, জিঘাংসাবৃত্তি তাঁর বহু গল্পে দৃশ্যমান।

আমাদের প্রথম বিশ্লেষিতব্য ‘দাহ’ শীর্ষক গল্পটি যখন  রচিত  হয়  তখন  লেখক  উচ্চ  মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। অথচ এ-গল্পে অনুভবের তীক্ষèতা, জীবনদৃষ্টির গাম্ভীর্য আর ভাষার সৌকর্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়। ‘দাহ’ গল্পের যুবক হাফিজ গ্রামান্তরে গিয়ে ধান কাটার কাজ করে। ধানকাটা শেষে সেবার তার দায়িত্ব পড়েছিল প্রভাবশালী তালুকদারের ধান পাহারা দেওয়ার। একদিন রাতে স্তূপীকৃত কাটাধানে আচমকা আগুন লাগলে ঘুমন্ত হাফিজ ভীষণভাবে দগ্ধ হয়। গৃহকর্তা তালুকদার তাকে যথাযথ চিকিৎসা করানোর পরিবর্তে কোর্টে গিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। পোড়া শরীরের হাফিজ গ্রামে যেন এক দর্শনীয় প্রাণীতে পরিণত হয়। দগ্ধ শরীর নিয়ে হাফিজের যন্ত্রণার চিত্র :

শরীরের ক্ষতস্থানগুলো এমনভাবে জ্বলতে থাকে, মনে হয় – ওর শরীরটা কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে কেটে কুচিকুচি করে ফেলছে। আকাশের দিকে মুখ করে দম নেওয়ার চেষ্টা করে সে। এরপর শুরু হয় দেহের মর্মান্তিক কম্পন। সে যন্ত্রণায় ইটের গুঁড়ো চেপে বিড়বিড় করে – আল্লাহ মরণ দাও। আল্লা গো …। শরীরের সমস্ত যন্ত্রণা যেন ওর কলজের ভেতর এসে জমা হয়। (নাসরীন জাহানের একগুচ্ছ গল্প, পৃ ১৪)

হাফিজের স্ত্রী স্বামীর খবর নিতে তার কিশোর ভাই আবুুকে পাঠায় তালুকদারের বাড়িতে। দুলাভাইয়ের অবস্থা দেখে আবু রীতিমতো মুষড়ে পড়ে। বস্তুত ততোক্ষণে হাফিজ উপনীত হয়েছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। মৃত্যু ঘনিয়ে আসায় সে স্বপ্নকাতর হয়ে পড়েছে, অর্ধচেতনে অবলুপ্ত হয়েছে বাস্তব-অবাস্তবের ভেদ। নিরুপায় হাফিজ ঠিক করে আবুর সাহায্য নিয়ে রাতের আঁধারে জুলুমবাজ স্বার্থান্বেষী তালুকদারের বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবে; কিন্তু গভীর রাতে আবু পথের মধ্যে দুলাভাইকে রেখে চলে যায়। অবশিষ্ট সময়টুকু হাফিজ আহত পশুর মতো মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকে। চাঁদ হেলে পড়লে অস্পষ্ট আলোয় একটি কুকুর হাফিজের দগ্ধ-গলিত শরীরটাকে লোভনীয় আহার রূপে গ্রহণ করে। কুকুরটা প্রথমে জিভ দিয়ে ক্ষত চাটে, তারপর পায়ের ফোলা মাংসে জোর কামড় বসিয়ে দেয়। তখনো বাঁচার আশায় মাটি চেপে ধরতে চায় হাফিজ। কিন্তু – এক সময় ক্লান্ত হয়ে আসে শরীর। নিজের শরীরের দুর্গন্ধটাকেও নাকে লাগে না আর। শেষবারের মতো চোখ বোজার আগে হাফিজ লক্ষ করে, চাঁদ নেই, আবু নেই, শুধু একটা কুকুরের জ্বালাময়ী জিহ্বা আছে। কুকুরের কামড়ে মাংসে আর কোনো যন্ত্রণা হচ্ছে না। সমস্ত কষ্ট ক্রমশ শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে চারপাশে। এবং সেই বৃষ্টির সাথে সে বিশাল আসমানের নিচে একাকী লেপ্টে আছে মাটির সাথে। [প্রাগুক্ত, পৃ ১৫]

‘পুরুষ’ নামক গল্পে লেখক জন্মগতভাবে ল্যাংড়া নিগৃহীত যুবকের হীনম্মন্যতা ও বিক্ষোভ তুলে ধরেছেন, সেই সূত্রে এসেছে মৃত্যুপ্রসঙ্গও। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে সবাই বুলুকে উপেক্ষা আর অবহেলা করে – যেন সে কোনো মানুষই নয়। বস্তুত মগজে-চেতনায় সে বাইশ বছরের এক উদ্বেল-চিত্ত যুবক। ফলে চারপাশের উপেক্ষায় তার পুরুষত্ববোধে প্রবল আঘাত আসে। বৈমাত্রেয় যুবতী বোন শেলী তার সামনে বুকে ওড়না ছাড়া চলে, কামিজ তুলে সালোয়ারের ফিতা লাগায় অথচ অন্য ভাইদের সামনে সে সমঝে চলে। এমনকি তার সামনেই শেলী একদিন একজন পুরুষমানুষের সঙ্গে ঢলাঢলিতে লিপ্ত হয় :

যা ভেবেছিল, পাটশোলার মতো শুকনো ঢ্যাঙা ছেলেটা বোকার মতো শেলীর গালে চুমু খাচ্ছে। তাকে দেখে ছেলেটা অপ্রস্তুত হয়ে শেলীকে নাড়া দেয়। বুলু তখনো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। শেলী হকচকিয়ে তাকায়। বুলু বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে ওঠে। শেলী বলছে – ও বুলু, কিচ্ছু অইবো না, বলে সে নির্লজ্জের মতো তার মুখ দিয়ে পাটশোলার মতো ছেলেটাকে ঢেকে দেয়। (প্রাগুক্ত, পৃ ৪৫)

পরিপার্শ্বের এই আচরণ ক্রমান্বয়ে বুলুকে বিক্ষুব্ধ ও সহিংস করে তোলে। সে নিজেকে আঘাত করে, রক্তাক্ত করে; বাড়ির মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি দেখে তার মাথায় খুন চড়ে যায়। সে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় আত্মঘাতী হওয়ার :

বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। মাকে বিচলিত লাগছে। আজ রাতে আত্মহত্যা করবে বুলু। এই পঙ্গু জীবনের অবসান ঘটাবে। ঘরের প্রতিটি সত্তাকে, অস্তিত্বকে বোঝাবে সে একজন রক্তমাংসে গড়া অস্তিত্ব। (প্রাগুক্ত, পৃ ৪৬)

কিন্তু এই মৃত্যুর আগে বুলু চারপাশে ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে চায়, সে হয়ে ওঠে এক আহত পশু; তাই পরিণামে বৈমাত্রেয় বোন তার উন্মত্ত আক্রমণের শিকার হয়।

‘বিবসনা’ গল্পটি মূলত মৃত্যুবিষয়ক নয়। তবে গল্পটির সমাপ্তি ঘটেছে এরকম একটি বাক্য দিয়ে – ‘মৃত্যুর মতো চেপে বসা দেহের এক অলৌকিক ভার এক গভীর গহ্বরে ঢেলে অন্য এক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে হোসেন আলী নিঃসাড় হয়ে ওঠে।’ (প্রাগুক্ত, পৃ ৭০) এ-গল্পের নায়ক বাইশ-তেইশ বছরের পরহেজগার যুবক হোসেন আলী। শৈশব থেকে পিতা ও হুজুরের শাসনে সে ধার্মিক হিসেবে বেড়ে ওঠে। তারা মূলত সৃষ্টিকর্তা ও মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে হোসেনকে গণ্ডিবদ্ধ রেখেছিল। স্রষ্টাকে ভালোবাসতে শেখায়নি তারা। পিতা আর হুজুর তাকে বুঝিয়েছিল, ‘নামাজ বাদ দিলে সৃষ্টিকর্তার ফেরেশতারা কবরে যাওয়া মাত্রই জিভ টেনে পিঠের কাছে নিয়ে যান। নিয়মিত কোরান তেলোয়াত না করলে শুধু দোজখের আগুন, পুলসেরাতের ধারাল পুল এবং মানুষের থেঁতলে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া।’ (প্রাগুক্ত, পৃ ৬৮) কিন্তু যৌবনে পা রেখে নারীর প্রতি অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ জন্মে হোসেন আলীর। শত চেষ্টায়ও মাথা থেকে ঝাড়তে পারে না নদীতে ভেসে ওঠা, স্নানরতা নগ্ননারীর দৃশ্য। শেষ পর্যন্ত তৃষ্ণা নামক বেশ্যা আবির্ভূত হয় তার স্বপ্নরমণী রূপে, তারই কাছে নিজেকে সমর্পণ করে এতোদিনের অবদমিত চিত্তকে মুুক্তি দেয় সে। এ কি প্রকৃতই মুক্তি, নাকি একটি নিষ্কলুষ সম্ভাবনাময় সত্তার অপমৃত্যু – সে-প্রশ্ন জাগতেই পারে গল্পের শেষ বাক্য পাঠের পর।

‘রজ্জু’ নামক গল্পে সাতচল্লিশ বছর বয়সী চিরকুমার চাঁদউদ্দিনের মনস্তাত্ত্বিক সংকটের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই গল্পের সূচনাই হয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর চিত্র দিয়ে :

প্রাণপণে একটি মহিলার হাত চেপে রাস্তা পার হতে থাকা একটি শিশুসহ মহিলাটির সচল দেহ নিমেষেই রাস্তার সাথে মিশে গেল। যন্ত্রের মতো মাটিতে লাফিয়ে পড়ে চাঁদউদ্দিন। ভিড় জমে ওঠার আগেই দেখে – বীরদর্পে গাড়িটি পালিয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে থাকে তার। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে। মহিলাটির স্থির থেঁতলে যাওয়া মাথার অদূরেই শিশুটির কম্পমান রক্তাক্ত হাত বারবারই কাতর ভঙ্গিতে সূর্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। (প্রাগুক্ত, পৃ ৭১)

এই দৃশ্য খানিক সময়ের জন্য চাঁদউদ্দিনের চেতনালুপ্তি ঘটিয়ে দেয়। সে সেখান থেকে মুক্তি পেতে চাইলেও তার চেতনায় দীর্ঘ সময় রয়ে যায় ওই মৃত্যুদৃশ্য দর্শনের প্রভাব। ঘরে এসে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে। কেরোসিনের স্টোভে চা বানালেও তা মুখে দিতে পারে না। তার মনে হয়, চায়ের রঙের সঙ্গে মিশে আছে ওই দৃশ্যে দেখা ফিনকি-দেওয়া রক্তের রং। তখন তার পিতার মৃত্যুর কথা মনে হয়, ভাবে – হত্যার শিকার হওয়া তার পিতার রক্তের রংও এমনই ছিল।

চাঁদউদ্দিন শুনেছিল, ছেলেবেলায় তার বাবাকে কারা মেরে নদীতে ফেলে দিয়েছিল। সেটা জ্যোৎস্নাভরা রাত্রি ছিলকি না চাঁদউদ্দিন জানে না। একজন লোক ক্ষেত দিয়ে টেনে তার বাবাকে নদীর ধারে নিয়ে গিয়েছিল কি না, তারপর সেই লোক আকাশের দিকে মুখ করে কুত্তার বাচ্চা বলেছিল কি না, তা-ও জানে না চাঁদউদ্দিন। কোনো ঘটনার সঙ্গে সুন্দর একটা পরিবেশকে সাজিয়ে দেওয়া তার অভ্যাস। বাবার মৃত্যুপ্রসঙ্গ কেউ জিজ্ঞেস করলে, সে তেমনই সবুজ গ্রাম, জ্যোৎস্না, রক্তের রেখাকে মিলিয়ে গল্প করে। গল্প করতে করতে একসময় সেগুলোও সত্য হয়ে যায়। চাঁদউদ্দিনের মনে হয় না মৃত্যুর পাশের বর্ণনাগুলো তারই সাজানো কিছু। (প্রাগুক্ত, পৃ ৭৪)

স্বাধীনতা লুপ্ত হবে বলে চাঁদ সংসারের পাঁকে জড়ায়নি। কিন্তু সাতচল্লিশ বছর বয়সে এসে এজন্য তার ভেতরে ভেতরে খানিকটা অনুশোচনাও হয়। তাই বিকারগ্রস্ত অবস্থায় সে ভাবে, ‘কেন মনে হচ্ছে আমার আজ মৃত্যু হবে? ব্যাচেলাররা বাঁচে রাজার মতো, মরে কুত্তার মতো – কে বলেছিল কথাটা? আহ্! তৃষ্ণা পাচ্ছে। কে বলেছিল …?’ (প্রাগুক্ত, পৃ ৭৮) বস্তুত চাঁদ এক অবদমিত পুরুষ। তাই বৃদ্ধ নারীকে দেখেও তার যৌনচাহিদা জেগে ওঠে, নিজের নিয়ন্ত্রণ হারায়। তখন আফসোস করে – ‘তবে কেন এতদিন একা রইলাম?’

বন্ধু সতীনাথ ঘরে এক কদর্য চেহারার বেশ্যাকে নিয়ে আসে উপভোগের জন্য। মেয়েটিকে দেখে ঘা ঘিনঘিন করে চাঁদউদ্দিনের। কিন্তু খানিক বাদেই ওই ভয়াবহ কালো মেয়েটির থলথলে শরীর নিয়ে মেতে ওঠে সে। এরপর মনে হয় : ‘তার শরীর ঠান্ডা হয়ে জমে আসছে। তার আয়ত্তের মধ্যে থলথলে মোটা রমণীর বুক থেকে যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত উঠছে। এবং তার কতক্ষণ পরই আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটি রাজপথে পড়ে থাকা দোমড়ানো থেঁতলে যাওয়া নারীতে রূপান্তরিত হয়।’ (প্রাগুক্ত, পৃ ৭৯)

গল্পের এই পরিণতি বিমূর্ত – অস্পষ্ট। পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, তবে কি চাঁদউদ্দিন রমণীটিকে খুন করেছিল?  লেখক নাসরীন জাহান এ-প্রশ্নের উত্তরে বলেন : ‘রজ্জু? ৪০ বছর পর এই গল্পের একমাত্র পাঠক এর সম্পর্কে জানতে চাইল। না, না, বিবেকবান চাঁদউদ্দিনের কাছে ওই মহিলাকে দলা  দলা  মাংস  মনে  হয়েছিল।’ (অস্পষ্ট  মনে  পড়ছে (কথোপকথন : ১৭ এপ্রিল ২০২০, বিকেল ৪টা ২৩ মিনিট)

নাসরীন জাহানের ‘ল্যাম্পপোস্টের নিচে’ গল্প রচনার পেছনে সুবিমল মিশ্রের প্রভাব রয়েছে। এ-গল্পে তিনি খণ্ড খণ্ড চিত্রের কোলাজ সাজিয়েছেন, যার পরতে পরতে মিশে আছে জীবনযুদ্ধ, জীবনের দ্বন্দ্ব আর মৃত্যুবোধ। নিরীক্ষামূলক এ-রচনার প্রথম দৃশ্যে দেখতে পাই :একটা লাশ পড়ে আছে।

লম্বা ল্যাম্পপোস্টের নিচে জন্ডিস আক্রান্ত। সেটার পায়ের কাছেই স্তূপ করা ময়লায় সন্ধ্যাবেলায়ও মাছির ভন ভন, আঁশটে পচা গন্ধ। মাছিরা আশ্চর্য হয়ে ভাবে, আজকার ডাস্টবিনে মরা লাশও থাকে?

ময়লার স্তূপে মানুষের লাশ, কতক্ষণ একাকার হয়ে অনিবার্য দৃশ্য হয়ে ওঠে।  (প্রাগুক্ত, পৃ ১০৯)

একদিকে ল্যাম্পপোস্টের নিচের ডাস্টবিন, অন্যদিকে রয়েছে মুশতাক আহমেদের জীবনযাপনের বর্ণনা। সেখানে দেখি :

বিছানায় শুয়ে ঘুম আসে না মুশতাক আহমেদের। তার কেবলই মনে হতে থাকে, জীবনে খুব বেশি পাপ করা হয়ে গেছে। জন্ডিসে আক্রান্ত মৃত ছেলেটার মুখ মনে পড়ে। যন্ত্রণাদগ্ধ অনুভব নিয়ে উঠে বসেন তিনি। কী যে হিজিবিজি চিত্র চোখে ভাসছে, কাটা কাটা চোখ, হাত-পা … সব ছিঁড়ে টপ টপ ঝরছে হলুদ রক্ত, ভয়াবহ রাত্তির ডুবে যায় হলুদ রক্তের বিষাক্ত কষে। (প্রাগুক্ত, পৃ ১০৯-১১০)

আমরা পরে দেখতে পাই, ডাস্টবিনের লাশটি অনেকটা মানুষের মতো অদ্ভুত আকৃতি নিয়ে জীবিত হয়ে ওঠে। কাক, কুকুর, মশা-মাছির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। মুশতাকের পুত্র পাপ্পু জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল। এজন্য সে নিজের পাপকে দায়ী করে :‘স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে হতাশ গলায় মুশতাক আহমেদ বলে, জরিনা আমি কিছুতে আর শান্তি পাই না। জীবনে পাপ একটু বেশিই করা হয়ে গেছে। ছেলেটা মরে এটাই প্রমাণ করে দিয়ে গেল।’ (প্রাগুক্ত, পৃ ১১১) ল্যাম্পপোস্টের নিচের ওই অদ্ভুত প্রাণীটিকে দেখে মনে হয় তার পাপ্পুই। সে তাকে ঘরে নিয়ে তোলে; কিন্তু ওই প্রাণীটির গৃহপরিবেশ সহ্য হয়নি। সে ডাস্টবিনেই ফিরে যায়।

ল্যাম্পপোস্টের নিচের অদ্ভুত প্রাণীটির ব্যাখ্যা দেবেন একটু? এরকম কৌতূহলের উত্তরে লেখক জানান : ‘এই ব্যাখ্যা অসম্ভব। সুবিমল মিশ্রের গল্প দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লেখা। তাঁর সব বইয়ের গল্পই এই টাইপের। এটা জাদুবাস্তবতার গল্প। প্রাণীটি এই নগরের লক্ষ মানুষের ভেতর একটি অবহেলিত চরিত্র। মানুষ আর পশুর সমন্বয়ে এর আদল তৈরি। একটু বলতে পারি, পশু ডাস্টবিনে খায়, মানুষও। এই লোকটা দুটো চরিত্রের একক সত্তা।’ (কথোপকথন, এপ্রিল ১৫ ২০২০, রাত ৯টা ৫২ মিনিট) ‘বিলীয়মান হলুদ নীল স্বপ্নগুলো’ গল্পের সূচনায় দেখি একজন যুবক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে – চোখ মেলে দেখল আকাশ। ধবধবে সাদা। চোখ বুজল। আশ্চর্য! মৃত্যুর পরে আকাশ থাকে? সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে – শূন্য থেকে মাটিতে নিমজ্জিত হচ্ছে সে। তার পাশে সাদা কাপড় পরা কে এসে দাঁড়াল? এরাই কি তবে ফেরেশতা? মাঝে মাঝে আসছে আবার চলে যাচ্ছে। চোখ বুজে ভাবতে থাকে। মৃত্যুর পরে কিছু আছে তবে? আশ্চর্য। এতটি বছর এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি কেবল হাসিয়েছে তাকে। আবার তাকে শূন্যে ছুড়ে দিলো কেউ। সে নিমজ্জিত হচ্ছে। এরা তার জবানবন্দি গ্রহণ করছে না কেন? আবারও পায়ের শব্দ। এরা কি তার শরীরে সাপ বিচ্ছু ছেড়ে দেবে? (প্রাগুক্ত, পৃ ১১৮)

গল্পের এই যুবকটির একটি পা ছোট ছিল, সে-কারণে তাকে হেয় হতে হয়েছে। পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে মনে মনে সে গভীরভাবে ভালোবাসত। দু-বছর ধরে মেয়েটার সঙ্গে তার একটা কাল্পনিক দাম্পত্য সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু ‘বাজে মেয়ে’ আখ্যায়িত করে মা তার কক্ষের ওদের বাড়ির দিকে ফেরানো জানালাটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন। বস্তুত একমাত্র পুত্রকে পিতামাতা আজো বিশেষ শাসনের মধ্যে রেখেছেন। আত্মগ্লানিতে, ক্ষোভে সে নিজেকে মাঝে মাঝে পীড়ন করে। ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া যুবকটি ভাবে, যে-স্নেহের সন্তানকে নিয়ে পিতামাতার এতো ভয়, তাদের সে-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটাবে সে। তাই –  সেদিন রাতেই ঘরে গাঁজা নিয়ে বসে। সেদিন সত্যিকার অর্থেই তার মধ্যে মৃত্যুপিশাচ ভর করে। ফালি ফালি করে কাটে পা। এরপর এর মধ্যে নুন ছিটিয়ে অনুভব করে পৃথিবীতে নরক নেমে এসেছে। যেন এই খাটো পাটা তার মরণ শত্রু এইভাবে সে ওটাকে খতম করে দেওয়ার জন্য খুনির চোখে তাকায়। (প্রাগুক্ত, পৃ ১২২-১২৩)

এভাবে তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিতে গণিকার কাছে গিয়ে গুরুতর রোগ বাধায়। অবশেষে ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বাবা-মা হাসপাতালে নিয়ে তাকে বাঁচিয়ে  তোলে। তখন সে ভাবে :

কী যন্ত্রণা এই পৃথিবীতে! কী দুর্গন্ধ! মৃত্যু তবে কী? শূন্যে আবর্তিত হওয়া? এতদিন মৃত্যু সম্পর্কে যে ভয়াবহ ধারণা ছিল সেটা কি তবে ভুল? জীবনের ভয়ঙ্করতার চেয়ে মৃত্যু যে এত অধিক সুন্দর তা কি সে এতদিন জানত? (প্রাগুক্ত, পৃ ১২৫)

‘একটি দীর্ঘশ্বাসের ডালপালা’ বাংলা ভাষায় এক অদ্বিতীয় জাদুবাস্তব গল্প, যদিও আমরা এখানে প্রধানত এর মৃত্যুপ্রসঙ্গটিই বিশ্লেষণ করব। ওমর নামে এক যুবক তার দুই বন্ধু কায়সার ও টুলুর সঙ্গে রাতে গরুর গাড়িতে গ্রামের পথ ধরে যাচ্ছিল। পথে বৃষ্টি নামলে তাদের যাত্রাবিরতি হয়। তারা এক নির্জন মাঠে এসে দাঁড়ায়। তখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার কথা বলে ওমর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক জঙ্গলের ভেতর ঢুকে পড়ে। সেখানে সে সাক্ষাৎ পায় এক বৃদ্ধের। বৃদ্ধ তার জীবনের সকল কথা অকপটে ব্যক্ত করে ওমরের কাছে। ওমরের মনে পড়ে, বাল্যকালেও সে এই লোকটির কাছে বিচিত্র গল্প শুনতো। বৃদ্ধ কদাকার চেহারা, বিকৃত হাত-পা নিয়ে জন্মেছিল, তার চেহারা দেখলেই সকলের ঘৃণা হতো। বিয়ের রাতে তার কুৎসিত হাত বাড়ানো দেখে নববধূ দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। লোকটির একটি পুত্রসন্তান জন্মে তারই মতো কদর্য, তারই মতো বিশ্রী মুখ, কুৎসিত হাত-পা নিয়ে। বৃদ্ধ ওমরকে বলে, ‘মনে হয়, কেবল এখনই আমি আমাকে হত্যা করতে পারি  আমার সন্তানের মধ্য দিয়ে। তবে অন্তত পৃথিবীতে একটি মানুষ শূন্য হয়ে যাবে, কাঁদবে। কিন্তু সন্তান না হয়ে সে মৃত্যু যদি আমার হয়, তবে পুরো পৃথিবীতে স্বস্তি নেমে আসবে।’ (প্রাগুক্ত, পৃ ১৫০-১৫১)

তার কিছুদিন পর আমি আমার সন্তানকে হত্যা করি … বৃদ্ধের এরকম শীতল উচ্চারণে ঘেমে ওঠে ওমর … হ্যাঁ, তাইতো মনে পড়েছে … শিশুটিকে তার পিতা হত্যা করেছিল, শুধু তার পরের ঘটনাগুলি জানে না সে। (প্রাগুক্ত, পৃ ১৫১)

‘এ্যালেনপোর বিড়াল গুচ্ছ’ এই গুচ্ছ রচনার সবগুলোই শেষ হয়েছে ‘তার পায়ের কাছে একটি রক্তাক্ত কালো বিড়াল মরে পড়ে আছে’ – এই জাতীয় বাক্য দিয়ে। বলা বাহুল্য, এ-গল্পগুলো রচনায় মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো’র প্রভাব রয়েছে। এ নিয়ে নাসরীন জাহানের একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থই রয়েছে। এডগার অ্যালান পো’র বিড়ালটা ভৌতিক, রোমহর্ষক। আপনার বিড়ালগুলো ভৌতিক, প্রতীকী এবং নানা মাত্রিক। এই মন্তব্যের জবাবে নাসরীন জাহান বলেন : ‘কোথায় ভৌতিক? বিড়ালটাকে মেরে মালিক দেয়ালে ইটের পেছনে গেঁথে দেয়নি নিজের স্ত্রীর সাথে? এখানে বিড়ালটা কারো ক্ষতিও করেনি, ভয়ংকরও ছিল না। বিড়াল কোনো মারাত্মক প্রাণী নয়, আদুরে।’ অন্যদিকে নিজের সৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য সম্পর্কে তাঁর ব্যাখ্যা : ‘অ্যালান পো থেকে আমি বেরোতেও চেয়েছি। দেখাতে চেয়েছি, সব প্রাণীর চাইতে মারাত্মক মানুষ। একটা এক বছরের শিশুর দেহে কী থাকে? তাকে রেপের পর খুন করে। তাই মানুষ একটার পর একটা নির্দোষ বিড়ালকে খুন করে গেছে। কখনো স্ত্রীর অতি প্রিয় বলে ঈর্ষায়, কখনো কালো রং দেখে সন্দেহে, কখনো …। বিড়ালকে রক্তাক্ত করে মারা কঠিন। কিন্তু তেইশটা গল্পেই আমি সব বিড়ালকে যৌক্তিকভাবে রক্তাক্ত করেছি।’ (কথোপকথন, এপ্রিল ২১, ২০২০, সন্ধ্যা ৬টা ৭ মিনিট) ‘অবিশ্বস্ত পৃথিবী আমার’ গল্পের মূল উপজীব্য মৃত্যু। ক্যান্সার আক্রান্ত তরুণ কবি ইবনকে তার পিতামাতা সর্বস্ব দিয়ে বাঁচিয়ে তোলার সংগ্রামে লিপ্ত। আর মৃত্যুকে সামনে রেখে ‘ইবন এখন এক মোমবাতি। যার মস্তক থেকে শাদা কাগজে গলে গলে পড়ছে আগুন রক্ত।’ সে মাকে বলে, ‘কবরের হিমতলায় আমি ক্রমশ যৌবনপ্রাপ্ত হবো, সেখানেই আমার বাসর হবে।’ ইবনের আকাক্সক্ষা ছিল বড় কবি হওয়ার; কিন্তু যৌবনের প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই অদৃশ্য এক মহাশক্তি তার পা থেকে সামনে ওঠার মইটি কেড়ে নিতে চাইছে। এই ঘাতক ব্যাধি বুকে পুষেও কবিতা লেখার চেষ্টা করে, বাঁচার স্বপ্ন দেখে, শৈশবের নানা স্মৃতি তাড়িত করে ইবনকে; কিন্তু বারবার তাকে মৃত্যুভাবনাই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় : ‘মরণের পরেও নিস্তার নাই … মরণের পরে নিস্তার নাই কেনো? … মৃত্যু!

যেন বা ব্যাধিগ্রস্ত এইভাবে ইবন অস্পষ্ট আয়নার সামনে দাঁড়ায়। কী ভয়ংকর নিকৃষ্ট কালো এক মৃত্যু! … আঁধার কী, নারীসঙ্গ কী, সন্তানের জনক হবার অনুভব কেমন, কিচ্ছু না দেখে অসীম কবরের গভীর তলায় পৌঁছানোর জন্য কখনো নিজের মধ্যে সাহস তৈরি করছে। কখনো ডাক্তারের নিষ্পলক চোখে চোখ রেখে বাঁচার স্বপ্ন দেখছে।’

(প্রাগুক্ত, পৃ ২২৫) তার স্বপ্ন একটি কবিতার বই বের করার। জ্বরতপ্ত শরীর নিয়েও সে কলম ধরে যে-কবিতা লেখে তাও মৃত্যুময় :

মৃত্যুর চেয়ে বিশ্বস্ত আর কিছুই নেই

অবিশ্বস্ত পৃথিবী আমার! (প্রাগুক্ত, পৃ ২২৫)

‘পাপবোধ’ গল্পে পঞ্চাশ-পেরোনো কথকের চারপাশে মৃত্যু – অল্প কদিনের ভেতর বেশ কয়েকজন আত্মীয় ও কাছের মানুষ পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। তাই তাকেও মৃত্যুভাবনা পেয়ে বসেছে, তা থেকে পাপবোধ ও অনুশোচনা। কথকের মনে পড়ে, বহুকাল আগে তিনি বন্ধু অমলেন্দুর সাইকেল ধার নিয়ে শহরে চলে এসেছিলেন আর ফেরত দেওয়া হয়নি। এরপর কত কাল কেটে গিয়েছে, অমলেন্দু হারিয়ে গিয়েছে বিস্মৃতির অতলে। এতোদিন পরে তার মনে হয়, অমলেন্দু ক্ষমা না করলে তিনি তো মৃত্যুর পর শাস্তি থেকে রেহাই পাবেন না। সেই বাল্যবন্ধুঅন্বেষণে শীতরাতে তিনি এক স্টেশনে এসে নামেন। স্টেশনের খোলা প্ল্যাটফর্মে এক মৃত বা মৃতপ্রায় মানুষকে দেখতে পেয়ে তিনি ভাবেন :

গত কদিনে চারপাশের সব মৃত্যুতে মনে হচ্ছে এখন খালি নিজের জানটা নিয়ে অপেক্ষা। এমনই যোগসূত্র তৈরি হয়েছে মৃত্যুর সঙ্গে মৃত্যুর, এই রাত্তিরের ইস্টিশানে এসেও একটা মড়ার সাথে সাক্ষাৎ হলো? তুমুল উত্তেজনায় ভেতরটা গরম হয়ে উঠতে থাকে। পরক্ষণেই অশরীরী এক বোধ তাকে নিথর করে তোলে – তুমি এতটা নিশ্চিত কী করে, ও মৃতই ছিল? (প্রাগুক্ত, পৃ ২৪৮)

কথক সকালে অমলেন্দুর বাড়িতে উপস্থিত হলে তার স্ত্রী জানায়, সে রাতে বাড়ি ফেরেনি, স্টেশনে গিয়েছিল। তখন কথক অনেকটাই নিশ্চিত হন প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা লাশটি অমলেন্দুরই। সেই মুহূর্তে কেবল প্রাণ খুলে কান্না ছাড়া তার আর কিছুই করার থাকে না। 

‘জীবন্মৃত’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র আবুল হক শয্যাশায়ী, ক্ষয়িষ্ণু, হাড্ডিসার মানুষ। বাড়ির দ্বিতীয় মানুষ স্ত্রী আয়েশা সারাদিন স্বামীর সেবাযত্ন করে। মৃত্যুর প্রহরগোনা আবুল হককে একদিন তার স্ত্রী জানায় তার এক দরবেশ চাচার কথা, যিনি একটা ফুঁ দিয়ে দিলে রোগী সোজা হয়ে দাঁড়াতো। আয়েশা আরো পরামর্শ দেয় খতমে ইউনুস পড়ার। তাতে রোগী হয় সুস্থ হবে আর হায়াত না থাকলে তার মৃত্যু হবে – এভাবে বিছানায় থেকে পচবে না। তারা ভাবেন :

যদি মৃত্যুই হয়? তাছাড়া আছে খরচের ঝামেলা, আয়েশা কেমন থিতিয়ে আসে। থিতিয়ে আসেন আবুল হকও। ক্রমশ সেই নিস্পৃহতা এমন জায়গায় পৌঁছে, আবুল হক জীবন-মৃত্যুর কষ্টের কথা, আনন্দের কথা ভুলে পুরোপুরি নিজের সম্পর্কে নিস্পৃহ হয়ে পড়েন। (প্রাগুক্ত, পৃ ২৭৯)

রাতে আচমকা আয়েশার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। এর মধ্যে ঝিমুনি ভেঙে সে বলে, সে স্বপ্নে দেখেছে সেই দরবেশ চাচা আবুল হককে ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে, যার অর্থ সে সুস্থ হয়ে যাবে। আর আয়েশা নিজেই ভোরবেলা মারা যায়। তখন :

মৃতপ্রায় আবুল হক হঠাৎ অনুভব করেন, তাঁর হাত-পা শরীরের মধ্যে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অজস্র কম্পনের মধ্যে হাসনাহেনার গন্ধ আজ যেন আতর। লাশটির দিকে কঠিন চোখে তাকান তিনি। … রাতে এটা কি স্বপ্নের কথা বলল আয়েশা? তারপর তার এই আচমকা মৃত্যু? সব কি সেই দরবেশ চাচার কাজ? তবে কি এটাই সত্য, একটি মৃত্যুর বদলে তিনি বেঁচে উঠবেন? ভয়ে সম্ভাবনায় আবুল হকের হৃদপিণ্ড তেল নিঃশেষ কুপির মতো দপ্ দপ্ জ্বলতে থাকে। (প্রাগুক্ত, পৃ ২৮০)

‘সান্ধ্যমুখোশ’ গল্পের লোকটি শূন্যবাড়িতে কিশোরী গৃহপরিচারিকাকে ধর্ষণ করে। আক্রান্ত মেয়েটি যখন বলে সে সবাইকে বলে দেবে, তখন লোকটি মেয়েটিকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যা করে বাড়ির পেছনে পুঁতে রাখে। লোকটি এই কর্ম করেও ভাবে, ইডিপাস যেমন নিয়তির হাতে বন্দি, সেও তাই। এই পাপ সে করেনি, এটা যেন তার কোনো বইয়ে পঠিত কোনো কাহিনি। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড তাকে অনেকটা বিকারগ্রস্ত করে তোলে। সে তার পুলিশ বন্ধুকে মোবাইলে খবর জানায়, ‘আমি একটি বই পড়ছিলাম এক সন্ধ্যায়, সেখানে একটা খুন হয়েছিলো … সেই খুনি আজ বই থেকে বেরিয়ে এসে আমার মেয়েকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বঁটি দিয়ে খুন করে আমার বাড়ির পেছনে মাটিচাপা দিয়েছে … ও আমাকে মারতে এসেছে, তুই আমাকে বাঁচা।’ (নেচে ওঠে আদমের সাপ, পৃ ৪৯) এভাবেই প্রকারান্তরে ঘোরের মধ্যে লোকটি তার হত্যার কথা ফাঁস করে বসে। লোকটি এই হত্যাকাণ্ডের অপরাধকে ভিন্ন যুক্তিতে লঘু করার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু ধর্ষিতা কিশোরীর জায়গায় নিজের কন্যার কথা ভেবে সে বিমর্ষ হয়ে পড়ে। হত্যার পাপ তাকে প্রকৃতিস্থ করে তোলে।

‘গরঠিকানিয়া’ নামক গল্পের শুরুতে দেখি স্ত্রী ও পুত্রের হত্যাকারী কাদের আলি উদ্ভ্রান্তের মতো বনে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কাদের ভালোবেসে বিয়ে করেছিল হিন্দু মেয়ে পদ্মিনীকে। পদ্মিনী স্বামীর ভালোবাসার কারণে নিজের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে ভুলে নতুন সংসারের সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে চলছিল, প্রথমদিন থেকে স্বামীকেই ইহকাল-পরকাল, স্বামীকেই ধর্ম বলে জেনেছে। তাদের পুত্র আকবরের জন্ম হয়, আকবর বড় হয় – তার খৎনার সময় আসে। তখন পদ্মিনী জিজ্ঞেস করে ‘মুসলমানি’ কী? তা নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে তর্ক বেধে যায়। এতোদিন একসঙ্গে সংসার করা আয়েশা নাম গ্রহণকারী পদ্মিনীকে তার অচেনা মনে হয়। ততোদিনে উদার প্রেমিক থেকে কাদের একজন কট্টর হুজুর হয়ে উঠেছে। পদ্মিনী তার ধর্মের অবমাননা করেছে ভেবে ক্ষিপ্ত হয়ে সে স্ত্রীকে হত্যা করতে  উদ্যত   হয়।   মাকে   রক্ষা   করতে   আকবর   এগিয়ে  এলে  মা-ছেলে দুজনই কাদেরের কুঠারের আঘাতে নিহত হয়। উদ্ভ্রান্ত হত্যাকারী ঘুরে-ঘুরে যখন ভাবছে বাড়ি ফিরে যাবে : ‘সে এখন ঘরে যাবে, বাতি জ্বালিয়ে পাখা হাতে এগিয়ে আসবে স্ত্রী, বারান্দায় বসে নামতা পড়বে আকবর। না, সে খুন করেছে! সে তো আকবরকে মারতে চায় নি। কোপ বসিয়েছিল পদ্মিনীর উদ্দেশে। সে ধর্ম বাঁচাতে এ কাজ করেছে। কিন্তু ছেলেটা মাকে বাঁচাতে গিয়ে …।’  (কাঠপেঁচা)

যে-কোনো বড় লেখকেরই সাহিত্যে সাধারণত কোনো-না-কোনোভাবে মৃত্যুচিন্তা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। নাসরীন জাহানের গল্পের চরিত্রগুলো বাস্তব জগতে ঘোরাফেরা করলেও তাদের ভাবনা-কল্পনার একটি স্বতন্ত্র জগৎ থাকে। আবার তাঁর সৃষ্ট অনেক চরিত্রই জরা-অবসাদ ও বিকারগ্রস্ত। সেখানে মৃত্যু, জিঘাংসা, বেঁচে থাকার যন্ত্রণা, ধর্মভয়, পরলোক প্রভৃতি বিষয় প্রায়ই নানাভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নাসরীন জাহানের তীক্ষè কল্পনাশক্তি আর অনন্য ভাষাশৈলীর যুগপৎ সম্মিলন পাঠকের সামনে মৃত্যুভাবনাকে মর্মগ্রাহী রূপে তুলে ধরে। উপরন্তু প্রায়ই জাদুবাস্তব পরিবেশ সৃষ্টি এই মৃত্যুভাবনাকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যায়।

তথ্যসূত্র

১. নাসরীন জাহানের একগুচ্ছ গল্প, নাসরীন জাহান, লেখালেখি, ঢাকা, ২০১০।

২. নেচে উঠে আদমের সাপ, নাসরীন জাহান, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ঢাকা, ২০১৩।

৩.       কাঠপেঁচা, নাসরীন জাহান, অন্যপ্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৯। ৪.       লেখকের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথোপকথন।