ছোট গল্প

  • অস্তিত্ব

    মনি হায়দার   এগারোজন মানুষ আগুনের নীরবতায় একে অপরকে সহ্য করছে। তিনজন নারী, বাকি আটজন পুরম্নষ। আটজন পুরম্নষের মধ্যে পাঁচজন সৈন্য। দুজন বেসামরিক নাগরিক। পাঁচজন সৈন্যের একজন ক্যাপ্টেন দিদার। সুন্দর গোলগাল মুখ। নাকের নিচে হালকা কালো গোঁফ। ছিমছাম পেটানো শরীর। হাতে একটা ছোট্ট কিন্তু সুদৃশ্য লাঠি। মাঝে মাঝে হাতের লাঠিটি নাড়ানোয় নিঃশব্দ ক্ষমতার একটা দাপট…

  • কুরুক্ষেত্রের দিকে

    সুদর্শন সেনশর্মা   গোপাল লাল কাঞ্জিলাল সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। তাঁকে অনেক দূরে ফিরতে হবে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোড থেকে বেহালা চৌরাসত্মা কম দূর নয়। ফাঁড়ির হাজরা রোডের মুখ থেকে অটো ধরে যতীন দাস পার্ক, তারপর মিনি বা বাস… পৌনে ন’টা বাজে… এ-সময় দরজায় জলতরঙ্গ বেজে উঠল… মহাবিষ্ণু অস্থির গলায় বললেন, গোপাল দেখুন তো আবার কে…

  • মুখার্জি পরিবার

    হরিশংকর জলদাস অরিন্দম মুখার্জি বিয়ে করেছে। একটা গল্পের সূচনা-লাইন এরকম ম্যাড়মেড়ে হলে কি কেউ আর গল্পটা পড়তে চাইবে? এই লাইনে কোনো চমক নেই, ঠমকও নেই, নেই কোনো কৌতূহল – উদ্রেককারী তথ্য বা তত্ত্ব। পাঠকের কী দরকার পড়েছে সাদামাটা একটা পঙ্ক্তি দিয়ে শুরম্ন করা গল্পকে এতটা সময় দেওয়ার? মানুষের কাছে সময়ের এখন অনেক দাম। কোনো শিক্ষিত…

  • পাইন-পাতার রূপকথা

    সাত্যকি হালদার মানুষটা কবে থেকে এলো তা নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল অনেক। এক-একজন একেক রকম কথা বলত। কেউ বলত, পাশেই আলগরায় ওর জন্ম। পরে এদিকে চলে আসে। বুড়ো জুলে শেরপা বলত, আদতে ও এদিকের লোকই নয়। বাপ-মার সঙ্গে কখনো পাহাড়ে এসেছিল। কোনো একটা বোর্ডিং ইশ্কুলে নাকি ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল বাবা-মা। পরে যে-কোনো কারণে হোক খোঁজ…

  • জগন্নাথের হাত

    কৃষ্ণেন্দু পালিত   ট্রেনে উঠতেই কানে এলো কেউ একজন আস্ফালন করছে, আপনি আমাকে চেনেন? কথা বলতে-বলতে উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়েছে সে। বুঝলাম, কোনো একটা বিষয় নিয়ে অনেক আগে থেকেই চলছে। মাঝবয়সী ভদ্রলোক, লম্বা-চওড়ায় দশাসই, মাথায় কদমছাঁট চুল, দুদিনের না-কামানো দাড়িগোঁফ, পরনে ফেডেড জিনসের ওপরে লাল-সবুজের ডোরাকাটা টি-শার্ট। চোখমুখে অদ্ভুত একটা রুক্ষতা। দুপুরের বনগাঁ লোকাল এমনিতেই ফাঁকা…

  • অন্যলোক

    জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ভূলোক   এই চন্দ্রাতপে কোন সুখ আসে না। রাত্রির প্রথম প্রহরে অসংখ্য বিবর্ণ আলো আকাশের কোলে ফুটে থাকে। তখন কেবল ঘষা কাচের গায়ে অতিকায় অট্টালিকার সারি কি দূরে জ্বলে নেভে টাওয়ারের আলো। নিচে আরো দূরে নিশ্চয়ই বৃক্ষরাজি দিনমানে স্পষ্ট; কিন্তু তখন কেবল অন্ধকারের স্তূপ। এবং অকস্মাৎ ছড়ানো হলুদের সহস্র বিন্দু মুছে গেলে ফুটে…

  • কাপুরুষ

    হাসান ফেরদৌস আজ অনেকদিন পর আবু হোসেন সকাল-সকাল ঘুম থেকে উঠেছেন। অনেকদিন পর নয়, হিসাব করলে দেখা যাবে গত দশ বছরে এই প্রথম। রেস্তোরাঁর চাকরি, ক্যাশ গুছিয়ে, সবাইকে বিদায় দিয়ে, দোকানের শাটার নামিয়ে তবে ঘরে ফেরা। ঘর মানে এই রেস্তোরাঁর তিনতলা। শুতে-শুতে রাত দেড়টা-দুটো তো বটেই, কখনো-সখনো বড়সড় পার্টি থাকলে, তারও পরে। সকালে সূর্য ওঠা…

  • নতুন বাড়ি

    অর্ণব রায় ম্যাটাডর থেকে মাটিতে পা দিতেই জায়গাটা যেন গাছগাছালি, পুকুর, পাখির ডাক, ঝিরঝিরে বাতাস – সব নিয়ে এক পলকে একেবারে দশ হাতে আপন করে নিল। দুটো লম্বা লম্বা শ্বাস ফেললাম দাঁড়িয়ে। বেশ ছড়ানো-ছিটানো পাড়া। বা এখনো পাড়া হয়ে ওঠেনি সেভাবে। দুপাশে বেশকিছু কিনে রাখা প্লট। মাঝখান দিয়ে যে-রাস্তা ধরে আমরা এলাম, সেটা শেষ হচ্ছে…

  •  অন্ধকারের গন্ধ

    অভিজিৎ সেনগুপ্ত সকাল ছটায় হাত-মুখ ধুয়ে ফ্লাস্কে রাখা চা আর গোটা কয়েক বিস্কুট পেটে চালান করে দিয়েই লেখার টেবিলে এসে বসেছেন রাজা রায়। এখন দশটা বাজে। নিচ থেকে নীলা ক্রমাগত তাড়া দিচ্ছে জলখাবার খেয়ে তাকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু কাউকে উদ্ধার করার মতো সময় রাজা রায়ের হাতে নেই এখন। তাঁকে কে উদ্ধার করে তারই ঠিক-ঠিকানা…

  • উপহার

    বুলবন ওসমান   মেলামাইনের কোয়ার্টার প্লেটটা নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়েছে ফজল। থাকে ফ্ল্যাটবাড়িতে। বাড়িটা শহরের মাঝখানে, খুব একটা অভিজাত এলাকা বলা যায় না, আবার চারিদিকে যোগাযোগের ব্যবস্থাটা ভালো বলে অনেক অভিজাত এলাকার চেয়ে সে পছন্দ করে এই সেগুনবাগিচা। কখন এখানে সেগুনগাছ ছিল কে জানে! তবে নামটি রয়ে গেছে। রমনা পার্কের পাশে টেনিস কমপ্লেক্সে বেশকটা গাছ…

  • মাজাম ওস্তাগারের পোলা

    মাহবুব রেজা আমি মোজাম ওস্তাগারের পোলা। আমার দাদায় আছিল ঢাকা শহরের সেরা ওস্তাগার গো মইদ্যে এক লম্বর। হের নাম হুরমত। হুরমত ওস্তাগার। হের নাম হুনে নাই পুরান ঢাকায় এমন আদম খুঁইজা পাওন যাইব না। বেকতে অই হেরে চিনে-জানে। খুব নাম-ডাক আছিল হের। আমার দাদারা চাইর-পাঁচ পুরুষ ধইরা ওস্তাগারির কাম করে। আদি ঢাকার বহুত দালাল-বাড়ি হেগো…

  • পার্থিব-অপার্থিব

    ইমতিয়ার শামীম তখনো দিনের আলো ফোটেনি, তবু তার চোখে আলো ফুটে ছিল দিনের মতো। সারারাত ধরে অন্য সবার সঙ্গে জেগে আছে সে, জেগে জেগে কী যে দেখছে বুঝতে পারছে না। ক্ষুধায় শরীর ভেঙে আসছে, ঘুম ঘুম লাগছে, মাথা ঝিমঝিম করছে। কিন্তু চোখ দুটো এক আর হচ্ছে না কিছুতেই। কেউ কেউ অবশ্য দু-হাঁটুর মধ্যে মাথাটা গুঁজে…