ছোট গল্প
-

হাজার মাইল জুড়ে
বাস থেকে নেমে আধ ঘণ্টার মতো উত্তরে হাঁটতে হাঁটতে ডানপাশে একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প বাগেরহাটের সমেত্মাষপুর স্কুলটা সহজেই শনাক্ত করে রিপন। কিন্তু শহীদ বাবার কবর খুঁজে বের করার অস্থিরতার তোড়ে রওনার সময় তার মাথায় আসেনি যে, আজ সাপ্তাহিক ছুটি – স্কুল বন্ধ। গ্রামগঞ্জের স্কুলে তালা মানে এমন বিরল খা-খা অবস্থা যেন কেউ কোনোকালে এখানে আসেনি, স্কুলটা…
-

সুগার ডটার
জীবনের একটা বড় সময় সুইডেনে কাটিয়ে রাশেদুন্নবী চৌধুরী বা রাশেদ চৌধুরী বলতে গেলে প্রৌঢ়ত্বের শেষ বেলায় দেশে ফিরেছেন। বর্তমানে ওর বয়স প্রায় ষাট ছুঁইছুঁই। আর চুলে সাদা-কালোর মিশ্রণ তো ওর বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই শুরু হয়েছে। তবে মোটামুটি ভালো শারীরিক গড়নের কারণে ঢাকা শহরে ঘুরে ঘুরে নিজের কাজকর্ম রাশেদ চৌধুরী এখনো নিজেই করতে পারেন।…
-

দুর্লভ বিশ্রামালয়
বিশ্রামালয়ের অন্দরমহল নগরপ্রধানের ঘুম তখনো ভাঙেনি। সুশীতল ছায়ানিবিড় কক্ষর সামনে একে একে এসে জড়ো হয়েছেন নগরের প্রধান অধিকর্তা, প্রকৌশলী, পরিকল্পক, নিরাপত্তা আধিকারিক, রাজস্বকর্তা, পরিচ্ছন্ন বিভাগের অধিপতি, জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও শলাপরামর্শকেরা। তারা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছেন না। ঘরজুড়ে পাথরের নীরবতা। নগরের অলিগলির টিউবওয়েলগুলোয় পানি না উঠলেও তাদের কপাল বেয়ে ঝরা পানিতে ভিজে যাচ্ছে সুবিশাল কক্ষর…
-

কার্তিকের নীল কুয়াশায়
রাত দশটা। চা-বাগানের অফিস। ম্যানেজার কৈয়ারীলাল হেড টিলাবাবু আনোয়ারকে সজোরে ধমকে দিলেন। তার পর যা আসে মুখে তাই বললেন। পাতা কমে যাওয়ায় দোষারোপ করলেন। শীতের এই সময়ে চা-পাতা স্বাভাবিকভাবেই কমে আসে। কিন্তু তিনি মানতে রাজি নন। তিনি মনে করেন, এখানে হেড টিলাবাবুর গাফিলতি আছে। তাই নিজের আক্রোশটা ঝেড়ে দিলেন তার ওপর। বিরূপ আবহাওয়া, শ্রমিক সংকট…
-

অভিমানের দরজা
ঢাকার মোহাম্মদপুরে পুরনো একতলা বাড়ির জানালার ধারে বসে আছেন সরোজিনী। বয়স পঁচাত্তর ছুঁইছুঁই, কিন্তু শরীরটাকে এখনো যত্নে রেখেছেন। সাদা শাড়ি, হাতে কাঁপা কাঁপা চুড়ি, চুলে হালকা পাক ধরা। জানালার ওপাশে স্কুলছুট ছেলেমেয়েরা ঝগড়া করছে – কেউ বল কাড়ছে, কেউ কারো ঠোঁট বাঁকিয়ে তাকাচ্ছে। অথচ এই ছোট ছোট ঝগড়ার মধ্যেই আছে মিষ্টি মিষ্টি মান-অভিমান, অভিমানের দরজা…
-

টিফিন ক্যারিয়ার
শেফালী বেগমের বাস বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে, রোহিতপুর গ্রামে। গ্রামের ভেতর সরু গলির শেষ মাথায় দোচালা টিনের ঘর। ঘরের সামনেই একটা কদমগাছ, বর্ষাকালে সাদা ফুলে ভরে যায়। সকালের হাওয়া নদীর কোল ঘেঁষে আসে; কখনো কচুরিপানার পাতায় জমে থাকা শিশিরের গন্ধ নিয়ে, কখনোবা ভেজা কাদামাটির। এই গন্ধ তার ভালো লাগে, আবার কষ্টও দেয়। কারণ এই নদীই তাকে…
-

মহুয়া বনের পাখি
তাকে এখন খিদিরপুরের দিকে যেতে হবে। যেজন্য এসেছে এ-ঘটনার শুরু হয়েছে অনেক অনেক বছর আগে। একটা হ্যাপা। বলতে গেলে বড় হ্যাপাই আজ পোহাতে হচ্ছে দীপ্তকে। এটা সে ইচ্ছা করেই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। না নিলেও পারতো। কাউকে সে বলেনি। বলার কথাও নয়। সাত-আট দিন আগে কলকাতায় এসেছে একটা ব্যবসায়িক কাজে। দীপ্ত ঢাকায় একটা বায়োমেডিক্যাল রিএজেন্টের…
-

উড়ে যায় মনপাখি
তুমি যাবেই? বিছানার পাশে বসে সুপ্তি রাতের প্রসাধন সারছে। শরীরে হালকা লাল নাইটি। ভেতরে সাদা ব্রা। পুতুলের মতো সাজানো শরীর সুপ্তির। রাতের এই প্রসাধনের মুহূর্তে শাকিল যেখানেই থাকুক, সুপ্তির জন্য বসে থাকে। বেশ সময় নিয়ে প্রসাধন সারে নিজের। এই সময়টুকু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করে সুপ্তিও। আগামী সপ্তাহে চলে যাবে সুইজারল্যান্ড, এক বছরের জন্য। শাকিল হাসানের…
-

বিদীর্ণ দর্পণ
ঢাকা টু লন্ডনের ফ্লাইটগুলি সব সময়ই যাত্রীবোঝাই থাকে। আজ পর্যন্ত যতবার এই ফ্লাইটে উঠেছি, ততবারই সেই একই চিত্র – ফ্লাইট কানায় কানায় পূর্ণ। তাই আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম ফ্লাইট ছাড়ার আগমুহূর্তেও আমার পাশের সিটটা খালি পড়ে আছে। সম্ভবত সারা ফ্লাইটে এই একটি সিটই এখন পর্যন্ত বেদখল আছে। কেবিন ক্রুরা ব্যস্ত হয়ে সবকিছু দেখে নিচ্ছে ঠিক…
-

রায়েরবাজার পাল বংশের ইতিহাস
রায়েরবাজারে একসময় যখন ঘরে ঘরে পাল বংশের কুমার শিল্পীরা মাটি নিয়ে কাজ করেছে, তখন এরা কাদামাটির মধ্যে গলা পর্যন্ত ডুবে থাকত। সে হিসাবে এদের গায়ে, ঘামে ও রক্তে কাদামাটি মিশে গিয়েছিল। এখন রায়েরবাজার শেরেবাংলা রোড তার ১৫ ফুট প্রশস্ত ক্ষতবিক্ষত বুক থেকে যে ধুলোবালির জন্ম দেয় তা দুই পাশের হাইরাইজ বিল্ডিং হাউস অ্যারেস্ট করে রাখে…
-

ঘুমন্ত পাখি
বাজান খোলা বারান্দায় বইসা জাল বুনতাছে। আমারে ডাইকা কইল, এইদিকে একটু আয় মা। আমারে এক গ্লাস পানি দে। উর্মি একটা ইস্টিলের গেলাসে পানি দিয়া কইল, বাজান, জোনাকি ঘরে নাই। – ক্যান, কই গেছে ভরদুপুরে? – খালের ঘাটে পানি আনবার গেছে বাবা। বাজান হুঁক্কা খাইতাছে আর জাল বুনতাছে। – জাল বুনার সময় হুঁক্কা না খাইলে শরীর…
-

ডেথ সার্টিফিকেট
পরিবারটার ওপর যে একটার পর একটা এরকম বিপর্যয় নেমে আসবে এটা কেউই আগে ভাবতে পারেনি। প্রথমে মারা গেলেন এ-পরিবারের পিতা আবদুস সামাদ, যিনি পিডব্লিউডি অফিসের একজন হেড ক্লার্ক হলেও ধন-সম্পত্তি বেশ ভালোই করেছিলেন। পুরনো ঢাকার সূত্রাপুরে, যেখানকার ওরা আদি বাসিন্দা, সেখানে চারতলা একটা বাড়ি তৈরি করেছিলেন সামাদ সাহেব। নিজেরা একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন আর বাকি সাতটা…
