সৈয়দ শামসুল হক
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ৩৭ \ অর্জুনদের দল থানায় এসে হাঁপাতে হাঁপাতে সংবাদ দেয়, নদীর ঘাটে হিন্দু নারী! মোছলমানের হাতে! দলেবলে তারা ভোগ করিচ্ছে! পাকিস্তানের মাটিতে হিন্দু নারীর ইজ্জত আর নাই! অর্জুনদা পাঠেয়া দিলে থানায় সম্বাদ দিতে। – তুমি কে? – মুই সুগ্রীব। সঙ্গে সঙ্গে মন্মথ দারোগার মুখে খিস্তি ছোটে, শালার শালা রামের…
-
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ৩৬ \ গোপালের মা সর্পদংশনে তার গোপালের মৃত্যুটাকেই মনে রেখেছে, সর্পের কথা তার স্মৃতিতে নাই। সন্তানের মৃত্যুটাই কেবল জননীর কাছে সন্তাপ ও সত্যের, কীভাবে তার মৃত্যু জননী ভুলে যায় অচিরে। হাওয়ার ভেতরে তখন কেবল হাহাকার ভেসে থাকে – নাই, নাই, নাই। মানুষের এই আসা আর যাওয়া! জন্মের অনন্য একটিই মাত্র দরোজা,…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ৩৫ \ উন্মাদ কাল। উন্মাদ মানুষ। আমরাও এতাবধি এসে এক ধরনের ছন্ন কথক বটে। অধিক কী, নদীও উন্মাদ! কিন্তু না, সাতচল্লিশের এ আগস্ট মাসের শেষভাগে বর্ষাকালের ঢল নামা উন্মত্ততা আধকোশার এখন নয়। এখন ভরা ভাদ্র। আষাঢ়-শ্রাবণের উন্মত্ত পাটল পানির কাল শেষ। নদীর বুকে এখন টানের পানি, রোদ্দুর এখন সূর্যোদয় থেকেই দিনমান…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ৩৪ \ দাড়িতে মেহেদির রং লাগিয়ে, আয়নায় নিজের মুখখানা পরিপাটি দেখে নিয়ে, হাকিম নেয়ামতউল্লাহ নিচে নামেন। নেমে দেখেন মন্মথ দারোগা অস্থির হয়ে পায়চারি করছে বারান্দায়। বারান্দার নিচেই চমৎকার ঘাসের মাঠ। ভোরের আলোয় ঘাসের সবুজ পাতা ঝকঝক করছে। দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবার কথা, কিন্তু না! নেয়ামতউল্লাহ্র চোখ পড়ে দারোগার ঘোড়াটি…
-
গল্পের বয়ান ও বুনোন
সৈয়দ শামসুল হক গল্পের কি শেষ আছে? সেই কোন আদ্যিকাল থেকে মানুষ কত লক্ষ কোটি অযুত গল্প বলেছে, বানিয়েছে, লিখেছে। এখনো তো ফুরোয়নি সেই নেশা। কোনোকালে ফুরোবে বলেও মনে হয় না। নেশাই বটে। মহাতামাকের চেয়েও কঠিন এ-নেশা। গল্প না বলে মানুষ থাকতে পারে না। গল্প যেন আপনা থেকেই মনের মধ্যে উঠে পড়ে। চারদিকের দেখা-শোনার জীবন…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ৩৩ \ রাতের ঘন অন্ধকার, হারিকেনের দীপ্তিও তার চিমনির বাইরে বিস্তার লাভ করতে পারে নাই। বাঁশবনের ভেতরে হাওয়ার অবিরাম সরসর ধ্বনি। সেই ধ্বনিও এমন প্রবল যে তাকে ঠেলে মইনুল হোসেন মোক্তারের গৃহিণীর কণ্ঠস্বর শ্রুত হতে পারে নাই। এই ভ্যাপসা গরমকালেও সর্বাঙ্গ চাদরে মোড়া ওয়াহেদ ডাক্তার, অন্ধকারে প্রায় বিলীন, সে চাদরের…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ৩২ \ উন্মাদের উন্মাদ! পাগলের সাঁকো কোথায় যে কে নাড়ায়! সাতচল্লিশের দেশভাগ কাল। সেই উন্মাদকালে আকাশে বর্ষণ নাই, মাটিতে ফাটল, আধকোশা স্তিমিত, মানুষেরা চঞ্চল এই মতো যে কোথাও থেকে একটা ঢোলের বাড়ি শোনা যাচ্ছে – গাঁজা ঝাঁই ঝপর ঝপর – নির্ণয় নাই যে কোথায়! এইকালে নদী পেরিয়ে কি কেবল…
-
কানার হাটবাজার
সৈয়দ শামসুল হক কিছুদিন থেকে এক কিশোর আমাদের সাথ লয়েছে। পাছ ছাড়ালেও সে পাছ ছাড়ে না। আমরা যেখানে যাই, আমরাই তো যাই, সেও যে সাথে আছে ঠিকই ঠিক পাই, পাশ ঘুরলেই দেখি তাকে। মাথায় নারীর মতো লম্বা কেশ, লালিয়া তার রঙ, বুঝি তেল পড়ে নাই বহুদিন, সময়তে বটের ঝুরি ছিঁড়ে তাই দিয়ে বেঁধে কেশ পিঠের…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক ৩০ বুড়ির চরে রাত তখন কাঁথার মতো পুরু, হালকা শীতের দিনে পুরনো কাঁথার মতোই আরামে জড়িয়ে ধরে আছে বুড়ির চরের কুটিরে কুটিরে মানুষের ঘুমশরীর। নারী তার শিশুসন্তানের মুখে স্তন গুঁজে দিয়ে অকাতর হয়ে আছে ঘুমে, স্বামীটি তার কতকাল বৃষ্টি নাই সেই দুঃস্বপ্নের তাড়কা মাছিগুলো তাড়িয়ে চলে, বাপোদাদার সমৃদ্ধকালের স্বপ্ন দেখার চেষ্টায় কেবলই…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ২৯ \ নখের আঁচড়ের মতো নদীর চিকন একটানা একটি রব চরাচরের ওপর দাগ কেটে চলে, আঁকের পর আঁক মকবুলের মনে তার মেয়েটির উদ্ভ্রান্ত মুখ রচনা করতে থাকে, নক্ষত্রের আগুন রেখায় যেন বিন্যস্ত হয়ে ওঠে প্রিয়লির মুখ, রাতের সম্মোহিত গভীরে নদী নয় প্রিয়লিরই কান্না শুনে ওঠে মকবুল। কতকাল সে মেয়েটিকে…
-
নদী কারো নয়
সৈয়দ শামসুল হক \ ২৮ \ নদী কেঁদে চলেছে, একটানা তার সিঁ সিঁ কান্নার শব্দ মকবুল হোসেনকে বধির করে দিতে থাকে। সে নির্ণয় করতে চেষ্টা করে, কেন নদী কাঁদছে। তার মনে হয় তার বাবা মইনুল হোসেন মোক্তারের জন্যে কাঁদছে। আধকোশার পানিতে ডুবে মৃত্যু হয় তাঁর। কেন তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আধকোশার উন্মত্ত খলখল পানিতে? এই…