আমার জয়নুল আবেদিন

সৈয়দ শামসুল হক

আর সকলের জয়নুল আবেদিন, আমার তিনি আবেদিনভাই। রক্তের সম্পর্ক নয়, রক্তের চেয়েও গাঢ় যে শিল্প – যার কারণে সংসারে থেকেও সংসারি নই, সামান্য আপন সংসারের বদলে বৃহৎ এক সংসার পেয়েছি শিল্পে, আর এই শিল্পের প্রাঙ্গণে পরিবারের সবার অধিক আত্মার আত্মীয় যাঁদের বলে পেয়েছি, তিনি আমার জীবন-খাতার প্রথম পাতাতেই প্রথম নামটি হয়ে আছেন – আবেদিনভাই।

গত শতাব্দীর সেই পঞ্চাশের দশকের আমরা যারা, এ-কালের মতো আমাদের অভ্যেস ছিলো না, চট করে কাউকে ভাই বলা – অগ্রজ সবাইকে নামের প্রথমাংশে সাহেব লাগিয়ে সম্বোধন করাই ছিলো দস্ত্তর। কিন্তু কী স্বাভাবিকভাবেই না পরিচয়ের প্রথম দিন থেকেই জয়নুল আবেদিন হয়ে উঠেছিলেন আবেদিনভাই, কামরুল হাসান কামরুলভাই – বাংলার এই আরেক অনন্য রূপকার – কত স্বচ্ছন্দেই না এঁরা ভাইয়ের অধিক ভাই ছিলেন আমার।

শিল্প! আবেদিনভাইয়ের কাছে শিল্প মানে তাঁর চর্চিত আঁকার মাধ্যমটি কেবল নয়, মানবের যত প্রকাশমাধ্যম আছে, প্রত্যহের ও বাস্তবতার অনুরণনে অবিরাম ঝংকৃত সৃজনশীল মনের যে-প্রকাশগুলো রয়েছে – সাহিত্য, সংগীত, নাটক – সবই তাঁর কাছে এক হয়ে অনুভূত হতো। তাই দেখি তাঁর হৃদয়-বন্ধনটি ছিলো এই বদ্বীপের সকল সৃজনশীল মানুষের সঙ্গে। আত্মার আত্মীয় তাঁর ছিলেন তাঁরই সময়ের সমবয়সী এবং অনুজ সকল শিল্পী-সাহিত্যিক, এমনকি যাঁরা সৃজনশীল নন কিন্তু এই মাটি ও মানুষের অতীতের সঙ্গে লগ্ন এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিমান, তাঁরাও তাঁর ছিলেন সহোদরের অধিক।

দেশ-স্বপ্নবান এক বিরাট সংসার ছিলো আবেদিনভাইয়ের। এঁদের নিয়েই তিনি পথ চলেছেন। অবিরাম এঁদের সঙ্গেই ছিলো তাঁর জীবনের অতিবাহন। বেঁচে থাকলে আজ একশ বছরে পৌঁছতেন তিনি। নশ্বর শরীরটি তাঁর পতিত হয়েছে বটে, যেমন সবারই হয় ও হবে, কিন্তু তিনি শতবর্ষ পেরিয়ে বাংলার সহস্র বৎসরেও জীবিতের অধিক জীবিত হয়ে আছেন। তাঁর এ কাল অতিক্রমী জীবন কেবল চিত্রকরদের সারিতে নয়, চিত্রের অধিক যে চিত্র আমরা সকলেই দেখে উঠি সাহিত্যে, সংগীতে তথা বাঙালির জীবনচর্যায়, তার ভেতরেই তিনি আছেন তাঁর দীপ্তি ও প্রণোদনা নিয়ে।

আবেদিনভাইকে নিয়ে তাঁর জন্মশতবর্ষে একটি লেখার অনুরোধ আসে, আমি ভেবে পাই না কী লিখবো? লিখবো কি সেই অনন্য চিত্রকরের কথা যিনি শুধু বাংলার নয়, এই দক্ষিণ এশিয়ার নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই এবং পৃথিবীর পূর্বাপর চিত্রকলার ইতিহাসেই প্রথম শিল্পী যাঁর তুলিতে ক্ষুধার নিষ্করুণ চিত্রমালা হতে পেরেছিলো। তাঁর আগে তো নয়ই, পরেও ক্ষুধাকে বিষয় করে, ক্ষুধায় মানুষের মৃত্যুকে ক্রোধের কালো রঙে ছবি এঁকেছেন এমন একজনকেও আমি আর দেখি না।

এখনো যখন আবেদিনভাইয়ের হাতে-করা সেই দুর্ভিক্ষ, পঞ্চাশের সেই মন্বন্তর কালের চিত্রমালার দিকে দৃষ্টিপাত করি, শিউরে উঠি, অবসন্ন হই, আবার উত্তোলিতও হই। মানবের হাতেই মানবের এমন বিপর্যয় যে চিত্রের বিষয় হতে পারে – যখন আমরা চিত্র মানেই দৃষ্টির কোমল আলো কি নিসর্গ বিস্তার কি সুমন মনোবেদনা কি স্বর্গীয় অথবা ঐতিহাসিক ঘটনা মুহূর্তের চিত্রণ বুঝতাম – তখন আবেদিনভাইয়ের চিত্ত টংকারটিকে নির্মম ক্ষুধার দিকে রণিত হতে দেখে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। উচ্চারণ করে উঠি, জননী পৃথিবীর মহত্তম এক   সন্তান এই জয়নুল আবেদিন যিনি মানবসৃষ্ট বিকটতাকেই উন্মোচিত করে গেছেন চিত্রপটে ওই প্রথম এবং এখন পর্যন্ত একাই তিনি এই চিত্রণে।

অথবা, সেই মানুষটিকে নিয়ে লিখবো যাঁর নেতৃত্বে বাঙালি মুসলমানের চিত্রপটে যাত্রা শুরু হয়েছিলো, যিনি ধর্মীয় অনুশাসন ভেঙে অথবা এরই বিপরীতে এই সমাজে একটি ধারা রচনা করেছিলেন অংকনের, চিত্রপটে জীবন উন্মোচনের, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চারুকলার বিদ্যালয়। অথবা, সেই মানুষটি – যিনি সবাইকে – শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিমান সবাইকে নিয়ে তুমুল উদ্বোধিত একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন এই বাংলায় সেই গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে, বেরুতেন চড়ুইভাতিতে, জমিয়ে তুলতেন আড্ডায় আমাদের, অবিরাম বলে যেতেন কত কথা যার স্মৃতি এখনো আমার উজ্জ্বল।

মনে পড়ে, এই আমিই তখন কত ছোট, সদ্য কৈশোর পেরিয়েছি, লেখার জগতে ভীরু পায়ে হাজির হয়েছি – তাঁর অভ্যেসেই ছিলো না চারুকলার ছাত্র ছাড়া কাউকে তিনি তুমি বলতেন, আমাকেও আপনি করেই বলতেন – সেই আমাকেও ডেকে নিয়েছেন চড়ুইভাতির দঙ্গলে, মনে পড়ে বাংলার গভীরে দাঁড়িয়ে, সবুজ বৃক্ষমালার দিকে তাকিয়ে আমাকে আবেদিনভাই বলছেন – তাঁর জন্মজেলা ময়মনসিংহের শব্দ ও উচ্চারণে – এখন লিখছি মান বাংলায় – তিনি বলছেন, ওই দেখুন সবুজ! কত সবুজ! কত তার মাত্রা! আর ওই যে দূরে আকাশছোঁয়া গাছটি, সেখানে দেখুন সবুজ কেমন নীল আভায় সবুজ-নীল হয়ে উঠেছে। আমার চোখ খুলে যায়। আমার কবিতা বা গল্প লেখায় কী কাজে লাগবে রঙের এই বিবিধতা কি এক রঙের ভেতরে আরেক রঙের ছোঁয়া লেগে যাওয়াটি, আমি ঠাহর করে উঠতে পারি না সেই বয়সে, কিন্তু মনের মধ্যে কী একটা বোধ জাগে – জলের গভীরে পলি পড়ে, আমি কবি হয়ে উঠি।

আবার, বিস্ময়ে আক্রান্ত হই, বাংলার ভেতরে আবেদিনভাইয়ের সঙ্গে ওইসব যাত্রায়, একদিন! একদিন যখন তিনি পথের এক কাঁঠালগাছটির পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার বাহুটি আঁকড়ে ধরে থামান এবং বলেন, এই দেখুন ভারমিলিয়ন! সিঁদুর! টকটকে সিঁদুরে রং। কাঁঠালগাছের বাকল ফেটে গুঁড়ো গুঁড়ো সেই আশ্চর্য রংটি ঝরে পড়ছে। শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, আহা, এই ভারমিলিয়নটা কেউ যদি তুলির মুখে তুলে নিতে পারতো!

একদিন রাত্রিবাস চলছে এক গ্রামে, ভোরে টুথপেস্ট টিপতে গিয়ে থমকে গেলেন। কী হলো, আবেদিনভাই? – না, কিছু না। অচিরে বললেন, এই যে পেস্টের টিউব, এখন তো দেশেই তৈরি হচ্ছে! রঙেরও টিউব হয়, ঠিক এই রকমই। আক্ষেপ করে বললেন, কেউ কেন ভাবছে না এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই ছবি আঁকার রংও তৈরি করে বাজারজাত করা যায়! তারপরে সারা সকালটা তিনি আমাকে বলে যেতে লাগলেন, দেশেই কত রঙের উৎস আছে – মাটিরই বা কত রং আমাদের, গাছের ফল আর বাকলেরই বা কত রং, এসব থেকে রং নিষ্কাষণ করা দরকার। তারপরই হেসে বললেন, চারদিকেই আছে ছবি আঁকার বিষয় আর আছে ছবির জন্যে রঙেরও অফুরান উপাদান। শুধু তুলে নেবার অপেক্ষা।

এত কথা! কত কথা! আবেদিনভাইকে নিয়ে যে লিখবো, ভাবছি, ভাবতে ভাবতে একটা নেমতন্ন এলো ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা থেকে। ওখানে বইমেলাটি আমাকে উদ্বোধন করতে হবে। লেখা দেবার জন্যে কালি ও কলমের সম্পাদক আবুল হাসনাতের কাছ থেকে সময় চেয়ে জীবনসঙ্গী আনোয়ারা সৈয়দ হককে নিয়ে আগরতলায় গেলাম। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী কমরেড মানিক সরকারের সঙ্গে ওখানে বইমেলাটি উদ্বোধন করে সবে আড্ডায় বসেছি, রাত তখন ভারতীয় সময় ন’টা হবে, হঠাৎ আমার কাছে ফোন এলো – বজ্রপাতের মতোই সংবাদ – কাইয়ুম, আমার প্রাণের বন্ধু, শিল্পের পথচলায় আমার দীর্ঘ ষাট বছরের সঙ্গী চিত্রকর কাইয়ুম চৌধুরী আর নেই। এই কিছুক্ষণ আগে তিনি সভামঞ্চে সবার সাক্ষাতে সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন! বাংলায় ইন্দ্রপতন বলে একটা কথা আছে। দেশ থেকে দূরে আমি, সীমান্তের ওপারে – জীবনে প্রথম বিমূঢ় হয়ে দেখলাম ইন্দ্রপতন কাকে বলে।

আবেদিনভাইকে নিয়ে এখন এই লেখাটি যে লিখতে বসবো, আমার সব গুলিয়ে যায়। এই কাইয়ুমের সঙ্গেই তো প্রথম আমি আবেদিনভাইয়ের বাড়ি গিয়েছিলাম! এই কাইয়ুমের শিল্পজীবন যদি লক্ষ করি তবে তো দেখতে পাই জয়নুল আবেদিন আর কামরুল হাসান – এই দুই মহান চিত্রকর – এঁদের থেকেই গঠিত হয়েছেন কাইয়ুম। কামরুলভাইয়ের কাছ থেকে কাইয়ুম পেয়েছেন বাংলার রেখায় রঙে রূপকল্পটি, আর আবেদিনভাইয়ের কাছ থেকে এই দেশমাতৃকা ও মানুষের প্রতি প্রেম।

আমিও দেশকে আমার শোণিতে ধ্বনিতে পাই আবেদিনভাইয়ের মানস থেকে প্রথমত – খুব স্পষ্ট করে যে এই প্রাপণটিকে তখন আমি বোধ করে উঠেছি, তা নয়। দিন যত গেছে ততই চেতনা-গভীরে আবিষ্কার করেছি আবেদিনভাইয়ের সঙ্গ থেকে পাওয়া সূত্রগুলো। আমার গৌরব ও গর্ব যে, আমি তাঁকে দেখেছিলাম, পেয়েছিলাম ও গ্রহণ করতে পেরেছিলাম। ভবিষ্যতে আরো মানুষ আসবেন, তাঁরা আমাদের শিল্পের সংসারকে আরো জমিয়ে তুলবেন, আরো সৃজনে তাঁরা এই দেশটিকে সমৃদ্ধ করে তুলবেন, কিন্তু তাঁদের তুলনায় আমাদের একটা জিৎ এই রয়েই যাবে যে, আমরা এই মানুষগুলোকে দেখেছিলাম, এঁদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্যে আমরা বড় হয়েছিলাম।

বাঙালির গড় হিসেবে শারীরিকভাবেই বড় মাপের মানুষ ছিলেন আবেদিনভাই, মন ও সৃজনের দিক থেকে এর সহস্রগুণ বড় মাপের ছিলেন তিনি। যেহেতু তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, অনুজ এই আমার প্রতি তাঁর স্নেহটি পেয়েছিলাম, আজ এই লিখনের মুহূর্তে তাঁকে শিল্পী নয়, বিশ্বখ্যাত জয়নুল আবেদিন নয়, আমার আবেদিনভাইকেই আমি স্মরণ করে উঠছি।

মনে পড়ে, আমার তখন বছর দশেক বয়স, কুড়িগ্রামের বাড়িতে আসতো কলকাতার সাপ্তাহিক মিল্লাত পত্রিকাটি, আর ওই পত্রিকার পেছনের পৃষ্ঠায় প্রতি সপ্তাহে ছাপা হতো জয়নুলের সেই দুর্ভিক্ষ চিত্রমালার একটি করে। মনে পড়ে, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। পঞ্চাশের সেই দুর্ভিক্ষ কাল তো আমিও দেখেছি, এক বেলা খেয়ে থেকেছি, ভাতের ফ্যান ভিন্ন মা আমাদের আহার জোগাতে পারেননি, দেখেছি ক্ষুধায় কংকালসার মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে পথ চলতে, লাশ দেখেছি ধরলার পাড়ে, রেল ইস্টিশানের প্ল্যাটফরমে, ডাকবাংলোর মাঠে, লঙ্গরখানায় আমিও যে সারিতে বসেছি বাবা-মায়ের চোখের আড়ালে ক্ষুধার যন্ত্রণায়।

এরই ছবি! এই মৃত্যুর ছবি! বালকবেলার সেই দুঃসহ দিনগুলোর পরেপরেই একজনার হাতে শাদা-কালোয় এই চিত্রমালা! নিচে নাম লেখা শিল্পী জয়নুল আবেদিন। মাত্র কয়েক বছর পরেই তাঁকে প্রথম চোখে দেখলাম লিটন হলের মিলনায়তনে এক চিত্র-প্রদর্শনীতে। ঢাকার আদিকালের সেই চিত্র-প্রদর্শনীতে আমি একটি লম্বাটে ছবির সামনে মুগ্ধ কিশোর দাঁড়িয়েছিলাম। একটি নারকোল গাছের নমিত ডাল, ডালটি আধ ভাঙা, আর সেই ভাঙার ওপরে বসে আছে একটি কাক। কাক! দুর্ভিক্ষের চিত্রমালার পরে এই আরেক কাক!

আমি দেখছি, তন্ময় হয়ে দেখছি, মনের মধ্যে শাদা-কালোয় আঁকা দুর্ভিক্ষকালের কাক কি তখন আমার মনে পড়ছিলো? বোধহয় অতটা নয়। হঠাৎ পেছনে একটা ডাক। ঘুরে দেখি, একজনা আমাকে বলছেন, ছবিটা তোমার ভালো লেগেছে? কে এঁকেছেন তাঁকে দেখবে? এই যে উনি! তোমার পাশেই! তাকিয়ে দেখি মানুষটিকে। কী দীর্ঘ দেহটি। মুখটি কী স্মিত প্রসন্ন! একটা আলো ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যেন দেবদর্শন ঘটলো আমার। যিনি তাঁকে দেখালেন, অনেক পরে জেনেছি তিনি অজিতকুমার গুহ, পরে জগন্নাথ কলেজে তাঁকে আমি পেয়েছিলাম বাংলার অধ্যাপক। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলাম, আপনি সেই কাক এঁকেছিলেন! তিনি কিছু বললেন না এর জবাবে। আমার কাঁধে হাত রেখে ছোট্ট একটা চাপড় দিলেন। শিল্পীর হাতের স্পর্শ সেই প্রথম আমি পাই আমার নশ্বর এই শরীরে।

আজ পেছন ফিরে মনে হয়, পরশমণি বলে একটা কথা আছে কিংবদন্তিতে – যার স্পর্শে লোহাও সোনা হয়ে যায়। হয়তো আবেদিনভাইয়ের সেদিনের সেই সামান্য স্পর্শটাই ছিলো আমার জন্যে শিল্পের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবার মহামুহূর্তটি। পরে যখন কাইয়ুমের সঙ্গে আবেদিনভাইয়ের বাড়ি যাই, প্রথম দেখাতেই ওই সাক্ষাতের কথাটি বলি, আর বলি যে ভাঙা নারকোলের ডালে বসা তাঁর আঁকা কাকটি আমি ভুলতে পারিনি, তিনি বলেন, এই কাকটি যদিও সবুজ একটা গাছের ডালে, আমি তাকে এঁকেছি ভাঙা ডালের ওপর! আস্ত সতেজ ডালে যে নয়, এর মধ্যে কলকাতার ফুটপাথে দুর্ভিক্ষে মরে যাওয়া মানুষের পাশে কাকটির স্মৃতি কিন্তু রয়ে গেছে। রয়ে গেছে ভাঙা ডালটিতেই কিন্তু। তারপরেই বললেন, না, এ ছবিটা আঁকবার সময় দুর্ভিক্ষের কাকা আমার মাথায় ছিলো না, এখন আপনি বলায় এই প্রথম আমার অমন মনে হচ্ছে। বললেন, একটি দেখা যখন মনের মধ্যে দাগ কেটে বসে যায়, তারপর যা দেখি তার ভেতরে প্রথম দেখাটি কিন্তু থেকেই যায় – স্পষ্ট করে না বুঝলেও।

আবেদিনভাই আমাকে আপনি বলেই বরাবর সম্বোধন করে এসেছেন, বহু বলেও তাঁকে আমার জন্যে তুমি বলাতে পারিনি। বরং দু-একবার যখন বেশ অভিমানই করেছি এ-কারণে, তিনি বলেছেন, আরে বাপ! অক্ষরে জগৎ ধরা! জগৎ ধরে ওঠা! আপনার কলম কি তুলির চেয়ে কম! কত বড় একটা পথে বেরিয়েছেন! এ-কথা মনে পড়লে এখনো আমার চোখ ভিজে ওঠে।

চোখ ভিজে ওঠে আমার বিয়ের দিনটির কথা মনে করে। আনোয়ারার সঙ্গে আমার বিবাহযাত্রায় সঙ্গী হয়েছিলেন – কৃতজ্ঞ আমি ভাবতেই পারি না, সেই বয়সে এত গুণীজনের ভালোবাসা আমি পেয়েছিলাম – চোখ ভিজে আসে – বরযাত্রায় ছিলেন কবি জসীম উদ্দীন, শওকত ওসমান, মুনীর চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, শামসুর রাহমান, আর ছিলেন বাল্যবন্ধু ফজল শাহাবুদ্দিন, আমার প্রকাশক আহমদ আতিকুল মাওলা। আসতে চেয়েছিলেন আবেদিনভাই, কিন্তু হঠাৎ কী একটা জরুরি কাজে আটকে গিয়েছিলেন, না-আসতে পারবার খবর যখন পাঠালেন, মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো।

বরযাত্রা লক্ষ্মীবাজার থেকে নয়াপল্টন ধরে এগোচ্ছে, ধরাচূড়া পরা আমি ঘামছি, গাড়িতে আমার একপাশে কবি জসীম উদ্দীন, আরেক পাশে শামসুর রাহমান, গাড়ি চলাচ্ছেন তখনকার বিখ্যাত সিনেমা-নায়ক হারুন, গাড়িটি জোনাকি সিনেমা হলের কাছাকাছি, হঠাৎ হারুন বললেন, আরে কে একজন গাড়ি থামাবার জন্যে পথের মাঝখানে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে! তাকিয়ে দেখি – আবেদিনভাই! দুপুরের তীব্র রোদে দীর্ঘ মানুষটি দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছেন! গাড়ি থামতেই প্রায় দৌড়ে এসে আবেদিনভাই আমার দুগালে ঠোঁট নামিয়ে চুমো খেলেন। বললেন, ভাই! আমি তখন থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি কখন আপনার মিছিল আসে! সঙ্গে যেতে পারছি না, তাই বলে একটু আদরও কি দিতে পারবো না আপনার জীবনের এমন একটা সময়ে!

এই আমার আবেদিনভাই! এতটা ভালোবাসতেন আমাকে! আর এই ভালোবাসার আরেকবার প্রমাণ আমি পেয়েছিলাম যখন তিনি লন্ডনে এলেন গলায় ক্যান্সার ব্যাধি নিয়ে চিকিৎসিত হতে। তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু অসুস্থ শিল্পাচার্যকে পাঠিয়েছেন লন্ডনে চিকিৎসার জন্যে। আমি তখন বিবিসিতে কর্মরত। হঠাৎ দুপুরবেলায় ফোন পেলাম আবেদিনভাই এসেছেন। তাঁর যে অমন একটা মারাত্মক ব্যাধি হয়েছে, সেই প্রথম শুনলাম। তৎক্ষণাৎ আপিস ফেলে রওনা হলাম। আছেন তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের পাশেই এক হোটেলে। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম, তাঁর কামরার দরোজা ঠেলে দাঁড়ালাম উদ্ভ্রান্তের মতো।

দেখলাম, আবেদিনভাই শুয়ে আছেন একটা বেডে, তার ওপারের বেডে তাঁর জীবনসঙ্গী আমাদের জাহানারাভাবি বসে আছেন। দরোজায় আমি স্থির। হঠাৎ একটা স্যান্ডেল এসে আমার বুকে পড়লো। চমকে উঠি আমি। আবেদিনভাই বিছানা থেকে ঝুঁকে নিচে রাখা পায়ের একপাটি স্যান্ডেল তুলে ছুড়ে মেরেছেন। আর বলছেন, কী দেখতে এসেছেন? লাশ! আমার লাশ দেখতে এসেছেন? ছুটে কাছে যেতেই তিনি আমাকে বুকের ওপর টেনে নিলেন। বললেন, আজো আমি কানে স্পষ্ট শুনতে পাই – আমার ভালোবাসার মানুষ বইলাই না আপনেরে আমি জুতা মারছি। এই জুতা আপনের দিকে না! এই জুতা মৃত্যুর দিকে। মৃত্যুরে আমি জুতা মারছি! আপনেরে না! না! না!

সেই আর্তস্বর, মৃত্যুকে আহত প্রহত করবার সেই স্বর আমি ভুলবো কী করে!

অনেকক্ষণ পরে আবেদিনভাই বললেন, ভাই, এইখানে হোটেলে যে ইংলিশ খাবার দেয়, আমি খাইতে পারি না। বললাম, কী খেতে চান? বিছানায় তখন সটান উঠে বসে আবেদিনভাই বললেন, ভুনা খিচুড়ি হবে! থেমে থেমে বললেন, তারপর ধরেন রুই মাছের পেটি, বেশ মাখো মাখো ঝোল হবে। আর, আর, আর বেগুন ভর্তা। বলেই বিশদ করলেন, বাগুনটারে পুড়ায়া যদি ভর্তা হয়! বললাম, তাই হবে আবেদিনভাই! আমি কালই ব্যবস্থা করছি।

আপিস থেকে ছুটি নিলাম পরদিনের। লন্ডনের বাঙালি দোকানে গিয়ে রুইমাছ কিনলাম, ময়মনসিংহের গোল বেগুন আর খিচুড়ির জন্যে মুগডাল! আনোয়ারা তখন লন্ডনে থাকেন না, স্কটল্যান্ডে এক হাসপাতালে তিনি কর্মরত, নিজেই পরদিন রাঁধলাম মুগডালের ভুনা খিচুড়ি, গ্যাসের আগুনে বেগুন ঝলসে করলাম ভর্তা আর রুইমাছের দোপেঁয়াজা। আমার মেয়ে বিদিতা সাত বছরের তখন, তাকে নিয়ে আবেদিনভাইয়ের হোটেলে গেলাম। তাঁর সাধের তাঁর সেই ময়মনসিংহের তাঁর সেই বাঙালি ব্যঞ্জনের আয়োজন যে সত্যি সত্যি আমি করতে পারবো, তিনি ভাবতেও পারেননি। বড় তৃপ্তি করে খেলেন। আজো আমার চোখ ভরে আছে সেই দৃশ্য। ভাবিও খেলেন। খাওয়া শেষে আবেদিনভাই আমার মেয়েকে কোলে জড়িয়ে ধরে বসলেন।

আমি বললাম, আমার মেয়েটিকে আনলাম, এতবড় একজন শিল্পীকে একবার যেন চোখে দেখতে পায়। আবেদিনভাই এ-কথা শুনে বিদিতাকে চুমো খেয়ে বললেন, মাগো, আমার চেয়েও বড় শিল্পী তোমার বাবা, তারে পাইছো, তুমি জগৎ পাইছো!

আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি না। এই আমার আবেদিনভাই! এত তাঁর ভালোবাসা! অনেকটা অপ্রস্ত্তত হয়ে, কথা ঘোরাবার জন্যে আবেদিনভাইকে বললাম, আচ্ছা, আপনি যদি আবার আপনার যৌবন ফিরে পান তবে কী করতেন? এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে তিনি বলে উঠলেন, আবার পাইলে তারে বিয়া করতাম! – কাকে?

আবেদিনভাই বললেন, সেই তাকে! শিল্পীর দীর্ঘ আঙুল তুলে বললেন, ওই যে দ্যাখেন নদী! আমার ব্রহ্মপুত্র! নদীর ওই পারে ওই যে দ্যাখেন লাল শাড়িতে মাইয়াটা। আসমানটা নীল, য্যান দোয়াতের কালি ঢাইলা দিছে! মাইয়াটা হাঁইটা যাইতে আছে! সেই তারে! আবার পাইলে তারে বিয়া করতাম!

পাশের বিছানাতেই জাহানারাভাবি। আমি তাঁর দিকে তাকাতে পারি না। এতকালের জীবনসঙ্গী যে পাশেই, তাঁকে একেবারে ভুলে গিয়ে আবেদিনভাই গাঢ় গলায় বলে চলেছেন, ছবিটা কি দ্যাখতে পাইতাছেন? নীল আসমান, লাল শাড়ি, ওই ওই ওই খাড়ায়া আছে! আবার পাইলে – তারে! হ্যাঁ, তারেই!

নারী তো নয়, যেন জীবন স্বয়ং অপেক্ষমাণ এক জীবনশিল্পীর জন্যে। আর নদীটি! জলরঙে কতবার এই নদীর ছবি এঁকেছেন আবেদিনভাই। এই জলরঙে আঁকা ছবির জন্যেই সেই ব্রিটিশ আমলে সর্বভারতে প্রথম হয়েছিলেন তিনি চারুকলার ছাত্রকালে। আমার চোখের সমুখে মূর্ত হয়ে ওঠে। আজো মূর্ত হয়ে আছে। মূর্ত হয়ে আছে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষের সেই চিত্রমালা, পৃথিবীতে যার দ্বিতীয় নজির আর নেই, যে-চিত্রমালা সেদিনের ব্রিটিশ ভারতে যখন দিল্লিতে প্রদর্শিত হয়, ধনকুবের বিরলা যে চিৎকার করে বলেছিলেন, এই ছবিগুলো সরিয়ে নাও, সরাতে কত টাকা লাগবে? আহ, এই বিরলারাও তো ওই দুর্ভিক্ষের জন্যে দায়ী – ভুলতে পারি না।

এর বিপরীতে জীবন। জীবনের প্রতি তৃষ্ণা। মানবিক জীবন। সামান্য জীবনের অসামান্য যে চাওয়া! আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে! যে-সন্তানের জননী হবে নদীর ওপারে ওই নারীটি!

না, আজো জীবনের অপেক্ষা ফুরোয়নি জীবনশিল্পীর জন্যে, এমন মহান এক শিল্পীর জন্যে আজো সে আমাদের জীবন নদীর পারে, নবীন সূর্যের লাল রঙটি তার শাড়িতে তুলে নিয়ে ওই হেঁটে যাচ্ছে। আমার সৌভাগ্য, সেই শিল্পীর একই বায়ুতে আমি নিঃশ্বাস নিয়েছি, দোয়াতের কালি-ঢালা সেই একই নীল আকাশের নিচে আমিও আমাকে – আমাদের সবাইকে – পেয়েছি। আমাদের সবার ভেতরে আছেন জয়নুল আবেদিন তাঁর জীবনতৃষ্ণা নিয়ে, মানবের অক্ষয় যৌবনস্বপ্ন নিয়ে। আমার ভেতরে সেই আবেদিনভাইকে নিয়ে যাঁর উদ্বোধিত মানবচেতনায় আজো আমি পথ হাঁটছি।