অচ্যুত গোস্বামী : ব্যক্তিত্ব ও কৃতিত্ব

সুমিতা চক্রবর্তী

প্রেক্ষাপট

বাঙালির মনে ফ্যাসিস্টবিরোধী মানসিকতা এবং সমাজতন্ত্রবাদের প্রতি আগ্রহ জেগেছিল মূলত তিরিশের দশকে। রুশ বিপ্লবের ফলে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের পতন ও সমাজতন্ত্রবাদের প্রতিষ্ঠা ঘটে ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে। তারই সূত্র ধরে অল্প কয়েকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবী সমাজতন্ত্রবাদ সম্পর্কে অবগত ও আগ্রহী হয়েছিলেন।

সমগ্র বিশের দশক জুড়ে ফ্যাসিবাদ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল ইউরোপে – মূলত মুসোলিনির নেতৃত্বে। কিন্তু ১৯৩৩-এ জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় এলে যে উগ্র অত্যাচার শুরু হয়েছিল, তারই ফলে বিশ্বের জনমানসে ফ্যাসিস্ট-বিরুদ্ধতার চেতনা প্রবল হয়ে ওঠে। সমাজতন্ত্রবাদীরা মূলগতভাবেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী। আর সাম্রাজ্যবাদের ঘনতম, তীক্ষ্ণতম রূপ হলো ফ্যাসিবাদ। যে-কোনো মানবাধিকার-বিশ্বাসী ব্যক্তির পক্ষে সমাজতন্ত্রবাদী হওয়া আবশ্যিক নয়, কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী হওয়া আবশ্যিক। তিরিশের দশকে ফ্যাসিস্ট-বিরুদ্ধতার সূত্র ধরে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা মনের দিক থেকে কাছাকাছি এসেছিলেন। সমাজতন্ত্রবাদে যাঁরা সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন এবং যাঁরা করতেন না – তাঁরা সকলেই মিলিতভাবে ফ্যাসিস্টবিরোধী কার্যক্রমে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তাঁদের প্রথম সাংগঠনিক কৃত্য ছিল প্যারিস, ব্রাসেল্স ইত্যাদি স্থানে আয়োজিত ফ্যাসিস্টবিরোধী শান্তি সম্মেলনগুলোতে প্রতিনিধি প্রেরণ, ফ্যাসিস্ট উৎপীড়নের প্রতিবাদে সভা-সমিতির আয়োজন এবং স্বাক্ষর সংগ্রহ। এরপর সাহিত্যে ফ্যাসিস্টবিরোধী চেতনা জাগানোর আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে এলেন বুদ্ধিজীবী ও শিল্পী-সাহিত্যিকের দল। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হলো ‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ এবং ১৯৩৭-এ প্রকাশিত হলো প্রগতি নামের একটি সংকলন। এই সংকলনে বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা এবং অনুবাদের মধ্যে দিয়ে উৎপীড়নের বিরুদ্ধে শোষিত মানুষের পক্ষে দরদি উচ্চারণের স্বাক্ষর রাখলেন লেখকরা। এই সংকলনটির সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে ছিলেন সেই সময়ের প্রগতিমনস্ক ব্যক্তিবর্গ।

‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’র প্রথম প্রতিষ্ঠা লখ্নউয়ে, ১৯৩৭-এ কলকাতা শাখার স্থাপনা। ১৯৩৭-এ ঢাকায় এই সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় আসেন মূল সংঘের সাধারণ সম্পাদক সজ্জাদ জহীর, বঙ্গীয় শাখার সম্পাদক সুরেন্দ্রনাথ গোস্বামী এবং অন্যতম সংগঠক হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। অপরদিকে স্বতন্ত্রভাবেও ঢাকায় তখন সমাজতন্ত্রবাদী চিন্তার প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল। কারণ এমন কয়েকজন বিপ্লবী নেতা বিভিন্ন জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তখন ঢাকায় সমবেত হয়েছিলেন, যাঁরা আগে ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লবের পন্থায় বিশ্বাসী কিন্তু কারা-অভ্যন্তরে দিনযাপনের সময়ে আকৃষ্ট হয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের প্রতি। সকলের সম্মিলিত চেষ্টায় ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ঢাকায় কমিউনিস্ট পাঠচক্র স্থাপিত হয়। এই সংগঠকদের মধ্যে ছিলেন সতীশ পাকড়াশী, জ্ঞান চক্রবর্তী, রণেশ দাশগুপ্ত, নেপাল নাগ, বিনয় বসু, বঙ্গেশ্বর রায়। ১৯৩৯-এর মাঝামাঝি ঢাকায় গড়ে ওঠে ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’। যে-তরুণরা সমাজতন্ত্রবাদে ও প্রগতিপন্থী সাহিত্যচর্চায় তখন আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই ছিলেন সোমেন চন্দ, অমৃতকুমার দত্ত, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ও অচ্যুত গোস্বামী।

 

জীবন-তথ্য

শান্তিপুরের আদি অধিবাসী ছিলেন অদ্বৈত বংশের গোস্বামীরা। পুরুষানুক্রমে পরিবারে ছিল বিদ্যাচর্চার অনুশীলন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই গোস্বামী বংশের একটি শাখা ফরিদপুরে বসবাস করতে শুরু করে। সেই বংশেরই সন্তান অচ্যুত গোস্বামী। তাঁর পিতা শশীমোহন গোস্ব^ামী ছিলেন ফরিদপুরের উচ্চ বিদ্যালয় ঈশান ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক। তাঁর জননীর নাম ছিল ষোড়শীবালা দেবী। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১ মার্চ ফরিদপুরে অচ্যুতানন্দের জন্ম হয়। অচ্যুতানন্দ নামটি ছাত্রজীবন ও কর্মজীবনের সমস্ত কাগজপত্রে অক্ষুণ্ণ থাকলেও লেখালেখির সময়ে ও সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহারের কালে তিনি নিজেই সংক্ষিপ্ত ‘অচ্যুত’ করে নিয়েছিলেন। ছয় ভাই ও চার বোনের মধ্যে মধ্যম সন্তান অচ্যুতানন্দের বাল্যশিক্ষা শুরু হয়েছিল বাড়িতেই। তারপর ঈশান ইনস্টিটিউশনে তিনি পড়েন ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত। ১৯৩৩-এ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ফরিদপুরেই রাজেন্দ্র কলেজে আইএসসি পড়েন। এই সময়ে তাঁর সহপাঠী ছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ও নরেন্দ্রনাথ মিত্র। উত্তর-জীবনেও এই তিন সাহিত্যিকের বন্ধুত্ব স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৩৫-এ প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করার পর সাম্মানিক ইংরেজিসহ ওই কলেজ থেকেই ১৯৩৭-এ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তখন তাঁর বয়স মাত্র উনিশ পূর্ণ হয়েছে।

অচ্যুত গোস্বামীর পিতা ধনবান না হলেও সাধারণ সচ্ছলতা ছিল সংসারে। আরো পড়ার বা চাকরি করার ইচ্ছে ছিল না তরুণ অচ্যুত গোস্বামীর। চিরকালই ব্যবসা করার দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল, যদিও ব্যবসা চালাবার মতো মানসিক গঠন তাঁর আদৌ ছিল না। প্রথমে তিনি মায়ের কাছে থেকে টাকা নিয়ে মাছের ও কাপড়ের ব্যবসা করার চেষ্টা করেন। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তাঁর এই প্রয়াসের শুরু। ব্যবসার সূত্রেই তাঁকে আসতে হলো পূর্ব বাংলার কেন্দ্রনগরী ঢাকায়। এসেই তিনি সমাজতন্ত্রবাদের আদর্শ এবং প্রগতিভাবনা-সমৃদ্ধ সাহিত্য ও চিন্তাচর্চায় আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অচিরেই তিনি ঢাকার কমিউনিস্ট পার্টি এবং ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’র একজন উৎসাহী ও সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের রচনা থেকে আমরা এই সময়ের বিবরণ উদ্ধার করছি। – ‘আমাদের মধ্যে তরুণতম ছিলেন সোমেন চন্দ। প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম অধিবেশন তাঁর বাড়িতেই হয়েছিলো। পরে স্থির হয়, ভিন্ন ভিন্ন স্থানে সাপ্তাহিক অধিবেশন হবে। অচ্যুত গোস্বামী তখন ঢাকায় এসে একা থাকতেন তাঁর নারিন্দার ভাড়াবাড়িতে, বাড়ির অন্য সবাই ছিলেন ফরিদপুরে। অচ্যুত পরে তাঁর বাড়িতেই প্রগতি লেখক সংঘের সাপ্তাহিক সভার আয়োজন করেন।’ (চল্লিশের দশকের ঢাকা, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, সরদার ফজলুল করিম, সাহিত্যপ্রকাশ, ঢাকা, ১৯৯৪, পৃ ৩২)।

সেই সময় থেকেই অচ্যুত গোস্বামী সাহিত্য-অনুরাগী ও সাহিত্যমনস্ক এক চিন্তাবিদ। ব্যবসায়ের খুঁটিনাটি দেখা এবং সাবধানতা অবলম্বনে আদৌ তাঁর মন ছিল না। টাকা নষ্ট হয়েছে ব্যবসায়ে। কিন্তু সাহিত্য ছিল তাঁর মননের অবলম্বন, ভালোবাসার কেন্দ্র। নিজের লেখার চেয়ে তিনি ভালোবাসতেন সাহিত্য নিয়ে ভাবতে, সাহিত্য বিশ্লেষণ করতে। যে-লেখকদের প্রতিভার স্বাভাবিক বিকাশ সাহিত্য বিশ্লেষণে – তিনি ছিলেন তাঁদেরই একজন। স্বতন্ত্র ও নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে সাহিত্যকে দেখা, নিরপেক্ষ ও নির্ভীকভাবে নিজের অভিমত প্রকাশ করা এবং সাহিত্য বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে এক জীবন সমীক্ষণকে তুলে ধরা – অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির প্রাবন্ধিকের সমস্ত গুণই ছিল অচ্যুত গোস্বামীর মধ্যে। তরুণ বয়স থেকেই তিনি মননশীল চিন্তার প্রয়োগে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন। সেইসঙ্গে প্রগতিভাবনার স্বরূপ উপলব্ধি করার ফলে, সমাজতন্ত্রবাদের শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টার সূত্রে সেই কালের পক্ষে খুবই বিরল এক নবীনতা বর্তেছিল তাঁর সাহিত্যবোধে। অল্প বয়স থেকেই তাঁর লেখায় নতুন দিগদর্শনের প্রযত্ন লক্ষ করা যেত। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসের বিরুদ্ধে সমালোচনা করেছিলেন তিনি চতুরঙ্গ পত্রিকার কোনো এক সংখ্যায়, চল্লিশের দশকের গোড়ার দিকে। সমালোচনা-শানিত সেই প্রবন্ধ পড়ে রবীন্দ্রনাথ লেখককে আরো অনেক বয়স্ক ব্যক্তি ভেবেছিলেন। সমালোচনায় একটু বিচলিতও হয়েছিলেন।

ক্রমেই অচ্যুত গোস্বামী ঢাকার প্রগতি সাহিত্যের কর্মকান্ডে নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে লাগলেন। ঢাকায় তাঁরই ভাড়া নেওয়া বাড়ির ঘরে প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সাপ্তাহিক আসর জমে উঠত। স্বরচিত সাহিত্য পাঠ ও আলোচনায় সজীব হয়ে উঠত সমাবেশ। ঢাকায় সেই সময়ের প্রগতি-আন্দোলনের অন্যতম শরিক রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণে আমরা একটি ছবি পাচ্ছি ‘মনে পড়ছে, সোমেন তাঁর ‘বনস্পতি’ গল্পটি পড়েছিলেন প্রগতি সাহিত্যের বৈঠকে অচ্যুত গোস্বামীর বাসায়। অচ্যুত গোস্বামী ছিলেন এই গল্পটির শতভাগ পক্ষে। সোমেন চন্দের কাছে অবশ্য একসঙ্গে মিলে কাজ করার একটা ঝোঁকও তিনি পেয়েছিলেন।’ (সাহিত্যচিন্তা, মে, ১৯৮০)

‘নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’র কলকাতা শাখার সদস্যদের দ্বারা প্রকাশিত প্রগতি নামক সংকলনটির আদর্শে ঢাকার ‘প্রগতি লেখক সঙ্ঘ’ ১৯৪০-এ ক্রান্তি নামে একটি সংকলন প্রকাশ করে। সম্পাদক হিসেবে কারো নাম ছিল না; কিন্তু যাঁরা ক্রান্তি প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের প্রধান চারজন ছিলেন – সোমেন চন্দ, রণেশ দাশগুপ্ত, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ও অচ্যুত গোস্বামী। প্রথম সংখ্যার ক্রান্তিতে অচ্যুত গোস্বামীর প্রবন্ধও ছিল।

সোমেন চন্দ নৃশংসভাবে নিহত হয়েছিলেন ১৯৪২-এর মার্চে। কিন্তু যাঁদের দৃঢ় সংকল্পের জন্য সোমেনের মৃত্যুর পরও ঢাকার প্রগতি-আন্দোলন বিশৃঙ্খল হয়ে যায়নি, অচ্যুত গোস্বামী ছিলেন তাঁদের একজন। সোমেন চন্দের জীবৎকালেই  ফ্যাসিস্টবিরোধী এবং প্রগতিশীল পাক্ষিকপত্র প্রতিরোধের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সোমেনের মৃত্যুর পরও সে-পরিকল্পনা ছিল সুসংবদ্ধ। এক মাসের মধ্যেই ১৯৪২-এর এপ্রিল থেকে (বৈশাখ) প্রতিরোধ প্রকাশিত হতে শুরু করে কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত ও অচ্যুত গোস্বামীর যুগ্ম সম্পাদনায়। তখন অচ্যুত গোস্বামী ঢাকার ২০নং কোর্ট হাউস স্ট্রিটের একটি হোটেল তথা মেসবাড়ির ওপরতলায় থাকতেন। সে-ঘরই ছিল প্রতিরোধের কার্যালয়। সেই ঠিকানাই থাকত পত্রিকাটিতে মুদ্রিত। কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত পূর্বোক্ত গ্রন্থ-অংশে জানিয়েছেন, প্রতি সন্ধ্যাতেই অচ্যুত গোস্বামীর ঘরে মিলিত হতেন প্রতিরোধের কর্মীরা। আলোচনা হতো পত্রিকার বিভিন্ন সমস্যা, উদ্দেশ্য এবং লেখা নিয়ে। কীভাবে নিজেকে অচ্যুত গোস্বামী প্রগতি-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন – এসব বিবরণ থেকে তা বোঝা যায়।

এর মধ্যেও তাঁর স্বাধীন ব্যবসায়ের ঝোঁক কিন্তু বিলুপ্ত হয়নি। ১৯৪৫-৪৬-এ তিনি ‘লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলে’র বিক্রয়-নির্বাহী এজেন্ট ছিলেন। কর্মসূত্রে অন্যান্য স্থান, বিশেষ করে কুমিল্লায় প্রায়ই যেতে হতো তাঁকে।

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ক্রমেই ঘনীভূত ও পরিণামমুখী হয়ে উঠতে লাগল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে উঠতে লাগল তীব্র থেকে তীব্রতর। তারপর একদিন এলো দেশবিভাগ ও স্বাধীনতা। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের বড়ো একটি অংশকে হতে হলো ঘরছাড়া, স্বদেশ থেকে উদ্বাস্ত্ত। গোস্বামী পরিবারকেও এই বিপন্নতার আবর্তে পড়ে চলে আসতে হলো পশ্চিম বাংলায়। ঠিক তার আগে ১৯৪৭-এর জানুয়ারি মাসে অচ্যুত গোস্বামী পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন উত্তর চবিবশ পরগণার এক সুশিক্ষিত পরিবারের বিএ পাশ তরুণী বাসন্তী দেবীর সঙ্গে।

দেশবিভাগের পর সাময়িকভাবে ছেদ পড়ল প্রগতিশীল              পত্র-পত্রিকায় লেখার চর্চায়। বাসস্থান সন্ধান ও জীবিকার প্রশ্নই হয়ে উঠল প্রধান। অচ্যুত গোস্বামীর অগ্রজ ভ্রাতা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ গোস্বামী ছিলেন দর্শনশাস্ত্রে সুপন্ডিত এবং পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক। দেশবিভাগের পর তিনি তাঁর কর্মস্থল বদলে চলে এলেন বসিরহাট কলেজে। পশ্চিমবঙ্গে এসে প্রথমে কয়েকজন ভাইবোন ও দাদা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণসহ অচ্যুত গোস্বামী এসে উঠলেন বড়িশার বিপিন পাল রোডের একটি ভাড়াবাড়িতে। তারপর তাঁরা ১৯৪৮-এর শেষের দিকে উঠে গেলেন নারকেলডাঙ্গা নর্থ রোডের একটি বাড়িতে, যার অনতিদূরে ছিল এক জজসাহেবের বিরাট হাতাওয়ালা বাগানবাড়ি। পরে অচ্যুত গোস্বামীর উপন্যাস কানাগলির কাহিনীর বিশাল বাড়িটির পরিকল্পনায় হয়তোবা থেকে গেছে ওই জজসাহেবের বাগানবাড়ির স্মৃতি। এই সময়ে অচ্যুত গোস্বামী একটি পথ-দুর্ঘটনায় আহত হন। তাঁর পায়ের আঙুলের ওপর দিয়ে চলে যায় ট্রামের চাকা। অসুস্থ অবস্থায় পুরীতে স্বর্গদ্বারের কাছে একটি বাসা ভাড়া করে দশ মাস ছিলেন অচ্যুত গোস্বামী ও বাসন্তী দেবী। এ ঘটনা ১৯৪৮-এর। সম্ভবত তার পরেই নারকেলডাঙায় এসে উঠলেন তাঁরা। ব্যবসায়ের নেশা তখনো তিনি ছাড়তে পারেননি। ১৯৪৭-৪৮ পর্যন্ত কটন মিলের কাজটি কোনোভাবে চালিয়ে ছিলেন। তারপর পুরীতে গিয়ে অন্য একটি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ হওয়ায় পোলান তেল চালানের কারবার শুরু করেন। এই তেল মাছের চাষ ও ব্যবসায়ের কাজে লাগে। পুরী থেকে কলকাতায় তেল নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। এই সূত্রেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। সুন্দরবন অঞ্চলের মৎস্যজীবী ও কলকাতার দক্ষিণতম প্রান্তের মাছের ভেড়ির পরিবেশে প্রতিস্থাপিত তাঁর উপন্যাস মৎস্যগন্ধায় সে-কারণেই মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের জীবনের বাস্তবতা বহু ঔপন্যাসিকের তুলনায় সম্পূর্ণতর হয়ে দেখা দিয়েছে।

এরপর মানিকতলার একটি বাড়িতে কিছুকাল থেকে শেয়ালদায় ১৭নং হায়াৎ খাঁ লেনের একটি বহু শরিকের খোপে খোপে ভাগ করা বাড়িতে কিছুকাল কাটালেন তাঁরা। কানাগলির কাহিনীর চরিত্রগুলো এরকমই একটি বিরাট পুরনো বাড়ির পার্টিশন করা ছোট ছোট ঘরে বাস করত। এই বাড়িতে বাস করার অভিজ্ঞতাও ওই উপন্যাসে জীবন্ত হয়ে আছে। শশীমোহন গোস্বামী এই সময়ে নিজেদের অবস্থা একটু গুছিয়ে নিয়ে নিজেদের বাসভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ  নাগাদ গোস্বামী পরিবার উঠে আসে স্বগৃহে ৪৭/৭, ইস্ট এন্ড পার্ক, কলকাতা ৩৯ এই ঠিকানায়। বহু               ঝড়-ঝাপটার পর পায়ের নিচে একটু মাটি পেলেন অচ্যুত গোস্বামী। ইতোমধ্যে তিনি এক কন্যার জনক এবং পত্নী বাসন্তী দেবী এক বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী। অচ্যুত গোস্বামী নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা করলেন নতুনভাবে। ব্যবসায়ের একটা নেশা তাঁর ছিল; কিন্তু সফল ব্যবসায়ী হওয়ার মতো চরিত্রের গঠন তাঁর ছিল না। অপরপক্ষে পঠন-পাঠনে ছিল তাঁর অনায়াস অধিকার। তিনি লেখা ও  পড়াশোনা শুরু করলেন আবার। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা                     দেশ-বিভাগোত্তর প্রাথমিক অস্থিরতা কাটিয়ে আবার সংঘবদ্ধ হতে শুরু করেছিলেন পঞ্চাশের দশকের কলকাতায়। তাঁদের সংগঠন, সভা-সমিতি, পত্র-পত্রিকা সবই আবার দেখা দিলো। অচ্যুত গোস্বামীও খুব সহজেই লেখালেখির মধ্যে ফিরে গেলেন। তিনি লিখতে শুরু করলেন প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প। পাশাপাশি একটা নিয়মিত পাঠ্যপুস্তক পড়ে নিয়ে ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে অনিয়মিত পরীক্ষার্থী রূপে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের স্নাতকোত্তর উপাধিও অর্জন করে নিলেন তিনি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই অধ্যাপনার কাজ পেলেন বৈষ্ণবঘাটা কলেজে। সেখানে অল্পদিন পড়াবার পর উলুবেড়িয়া কলেজে ছিলেন কিছুকাল। অতঃপর ১৯৬০-এ চলে আসেন বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় মহাবিদ্যালয়ে। ততদিনে তাঁর উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে গেছে, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ বাংলা উপন্যাসের ধারা ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে।

জীবনের শেষে কুড়ি বছর এই শিক্ষায়তনেই সম্মানের সঙ্গে কাজ করেছেন অচ্যুত গোস্বামী, যথাসময়ে তিনি বিভাগীয় প্রধান হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সফল ও ছাত্রবৎসল অধ্যাপক; ছাত্রদের ও সহকর্মীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। ষাট ও সত্তরের দশকে তাঁর আরো চারটি উপন্যাস গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন বহু প্রবন্ধ, গল্প এবং আরো অন্তত একটি উপন্যাস – যেগুলো কোনোদিন গ্রন্থবদ্ধ হতে পারেনি। সংক্ষিপ্ত আকারে ইংরেজি সাহিত্যের ইতিবৃত্ত লিখেছেন তিনি (প্রথম সংস্করণ ১৯৬২)। প্রকাশিত হয়েছে বাংলা উপন্যাসের ধারা গ্রন্থের পরিবর্ধিত দ্বিতীয় সংস্করণ (১৯৬৮)।

১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে একান্নবর্তী পরিবার ছেড়ে স্ত্রী-কন্যাসহ নিজের তৈরি বাড়িতে উঠে এলেন অচ্যুত গোস্বামী। ৭বি/১ পিকনিক গার্ডেন, ফার্স্ট লেন, কলকাতা-৩৯-এর এই বাড়িতেই বাকি জীবন তিনি বসবাস করেছিলেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ মার্চ বাড়ির ওপরের বারান্দা থেকে পড়ে গিয়ে সেই আঘাতেই তাঁর আকস্মিক মৃত্যু হয়।

 

প্রবন্ধ-চর্চা

ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র অচ্যুত গোস্বামী ফরিদপুরের বাড়ি ছেড়ে এসে যখন থেকে ঢাকায় থাকতে শুরু করেছিলেন, তখন থেকেই তাঁর প্রবন্ধ রচনার প্রয়াস চলতে থাকে। আমরা আগে বলেছি, সাহিত্য-বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ রচনায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল প্রথম থেকেই। এ-বিষয়ে আমরা একটি ঘটনার উল্লেখ পাই রণেশ দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণে। অচ্যুত গোস্বামীর মৃত্যুর পর বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে আয়োজিত স্মরণসভায় এই স্মৃতিচারণ করেছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তা লিপিবদ্ধ আছে ১৯৮০ সালের বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজ পত্রিকায়।

বিবরণ অনুসারে দেখি, ১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার সুপ্রচারিত সোনার বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকার দফতরে একটি প্রবন্ধ হাতে নিয়ে এসেছিলেন বিংশতিবর্ষীয় এক তরুণ। প্রবন্ধের বিষয় ছিল বুদ্ধদেব বসুর কবিতা। সোনার বাংলার সম্পাদক নলিনীকিশোর গুহ বুদ্ধদেব বসুর নাম শুনেই লেখাটি প্রত্যাখ্যান করেন। বুদ্ধদেব বসুও ১৯৩৮-তরুণ লেখক এবং অতি আধুনিক লেখক। যখন সেই প্রবন্ধ-লেখক তরুণ সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে থাকেন, তখন তাঁকে এসে ধরলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি তখন সোনার বাংলার সঙ্গে যুক্ত এক তরুণ কর্মী। রণেশ দাশগুপ্ত এইভাবেই অচ্যুত গোস্বামীকে নিয়ে এলেন নিজেদের সাহিত্যচক্রে। সেখানে পঠিত ও আলোচিত হলো সেই প্রবন্ধ। সেই সাহিত্যচক্রই ছিল প্রগতি লেখক সঙ্ঘের প্রাথমিক রূপ। এইভাবেই প্রগতি-আন্দোলনের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে পরিচিত হলেন অচ্যুত গোস্বামী।

পঠনের ক্ষেত্রে ফাঁক রাখার অভ্যাস তাঁর ছিল না। দ্রুত তিনি পড়ে উঠলেন মার্কসবাদী বইপত্রের বেশ কিছু অংশ। তাঁর সাহিত্যভাবনাকে নতুন দৃষ্টিকোণ খুঁজে নিতে সাহায্য করল মার্কসবাদ। শিল্প-সাহিত্য বিষয়ে সেই সময় থেকে শুরু করে  আমৃত্যু চল্লিশ বছরের বেশি সময় ধরে অচ্যুত গোস্বামী                সমাজ-সচেতনতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিটির প্রতি পক্ষপাত কখনো বর্জন করেননি। সাহিত্যকে যাঁরা সমাজতন্ত্রবাদী শিল্পভাবনার দিক থেকে বিচার করে থাকেন; যাঁদের লেখায় সমাজ-বিবর্তন ও শিল্পসৃষ্টির অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক স্বীকৃতি – সেই লেখকদের মধ্যে অচ্যুত গোস্বামী প্রথম এবং প্রধান বলে স্বীকৃত হবেন।

১৯৪০-এ কলকাতার সুখ্যাত চতুরঙ্গ পত্রিকায় তাঁর রবীন্দ্র-উপন্যাস বিষয়ক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে তাঁকে সুপরিচিত করে দিলো। ঢাকার প্রগতি লেখক সঙ্ঘের সাপ্তাহিক বৈঠকে সাহিত্য-আলোচনা হতো। বস্ত্তত, প্রতিদিনই মিলিত হতেন বন্ধুরা – আলোচনা চলত প্রতিদিনই। সেখানে চল্লিশের দশকেই বাংলা কথাসাহিত্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের ভাবনা-চিন্তা জেগে উঠেছিল তাঁর মনে। এবং তখনই বাংলা উপন্যাস বিষয়ে একটি বিস্তৃত প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধই বিভিন্ন পরিমার্জনা ও সংযোজনের মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাসের ধারা নামে একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ হয়ে উঠেছিল এবং প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে নতুন সাহিত্য ভবন প্রকাশনালয় থেকে। ‘পাঠভবন’ থেকে বইটির দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত  হয় ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। অনেক বর্ধিত-কলেবর এই গ্রন্থ বাংলা কথাসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট রিভিউ হয়ে আছে। রণেশ দাশগুপ্ত লিখেছেন, ‘অচ্যুত গোস্বামীর এই ‘বাংলা উপন্যাসের ধারা’ প্রকৃতপক্ষে মার্কসীয় দৃষ্টিতে বাংলা উপন্যাসের বিচারের প্রথম প্রয়াস। গণবিপ্লবী অভ্যুত্থান ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের বৈচিত্র্যের তাগিদকে মার্কসীয় দৃষ্টি যে পরস্পরের পরিপূরক বলে মনে করে এসেছে তার বিপন্নতার দিনগুলিতেও, তার প্রমাণ     হিসেবে ‘বাংলা উপন্যাসের ধারা’কে দাখিল করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, মার্কসীয় প্রেক্ষিতকে সামনে রেখে সাহিত্যকে বিচার করার তাগিদের মধ্যে যে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশের                   মানব-মানবী ও পরিবেশকে প্রাধান্য দেবার প্রচ্ছন্ন নির্দেশ ছিল অচ্যুত গোস্বামী ‘বাংলা উপন্যাসের ধারা লিখে তা প্রকাশিত করেন।’ (‘প্রগতিবাদী লেখক অচ্যুত গোস্বামী’, সাহিত্যচিন্তা, মে, ১৯৮০)।

রণেশ দাশগুপ্তের এই দাবি আক্ষরিক অর্থে সত্য। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে কথাসাহিত্যের আলোচনার সূত্রপাত কলকাতা ও ঢাকা – উভয় স্থানেই চল্লিশের দশকে ঘটে। পশ্চিম বাংলায় অগ্রণী, অরণি, মার্কসবাদী, পরিচয় ইত্যাদি পত্রিকায় তার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ঢাকায় ক্রান্তি, সংকলন আর প্রতিরোধ ছিল এই জাতের পত্রিকা। পশ্চিমবঙ্গের পত্রিকাগুলি থেকে চয়িত কিছু প্রবন্ধের একটি সংকলন পাওয়া যাবে ধনঞ্জয় দাশ-সম্পাদিত মার্কসবাদী সাহিত্য বিতর্ক নামের তিন খন্ড সংকলনে। পঞ্চাশের দশকে পরিচয়, নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রবাহিত থাকে এই ধারা। এই নবীন সমাজবাদী দৃষ্টিতে সাহিত্য-আলোচনার একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে অচ্যুত গোস্বামীর বইটিই বাংলা ভাষায় ‘প্রথম’-এর গৌরব দাবি করতে পারে। দ্বিতীয় গ্রন্থটি অবশ্যই সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত বাংলা উপন্যাসের কালান্তর। এই বইটির প্রকাশ ১৯৬১-তে এবং লেখাগুলির প্রথম আবির্ভাব প্রধানত নতুন সাহিত্য পত্রিকায় পঞ্চাশের দশকে। আমরা পথিকৃতের মর্যাদা অচ্যুত গোস্বামীকে অবশ্যই দিতে পারি। তবে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থে সমাজ, সময় ও ব্যক্তি সম্পর্কের মধ্যে যে গূঢ়তর বন্ধন প্রতিভাত হয়েছে ঠিক ততটাই নেই অচ্যুত গোস্বামীর লেখায়। মোটের ওপর বিবরণাত্মক ভঙ্গিতেই তিনি লিখেছেন। ভাষার প্রাঞ্জলতা তাঁর লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দ্বিতীয় সংস্করণটিতে সমাজ-অস্তিত্ব ও ব্যক্তিমানসের সম্পর্ককে তিনি অনেক বেশি বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখেছেন ও তা ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলা কথাসাহিত্যে আগ্রহী  যে-কোনো পাঠকের কাছেই অবশ্যপঠনীয় অচ্যুত গোস্বামীর বাংলা উপন্যাসের ধারা। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক ছিলেন। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের বাতাবরণে বাংলা উপন্যাসকে উপস্থাপিত করার দিকটিও আমরা তাঁর এই রচনায় পেয়ে যাই।

পারিবারিক বিপর্যয় – যার উদ্ভব ঘটেছিল দেশবিভাগের ফলে – অচ্যুত গোস্বামীর লেখার গতি কিছুটা রুদ্ধ করে। পঞ্চাশের দশকের শেষ ও ষাটের দশকে তিনি আবার নব-উদ্যামে লেখার জগতে ফিরে আসেন এবং বহুধরনের প্রবন্ধ লিখতে থাকেন সাময়িক পত্রিকায়। আমরা যথাসাধ্য তার একটি তালিকা দিচ্ছি তবে খুবই অসম্পূর্ণ এই সন্ধান। উল্লেখ্য, যে-কোনো বিষয় নিয়েই (সাহিত্য ও সমাজই বিষয়) প্রবন্ধ রচিত হোক না কেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা, সমাজ-লগ্নতা এবং প্রগতিবাদিতা সবসময়েই ছিল অক্ষুণ্ণ। ষাটের দশকে অচ্যুত গোস্বামী শনিবারের চিঠি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। শনিবারের চিঠির দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক দিকেই রক্ষণশীলতা – এমনকি প্রগতিবিমুখতা থাকলেও বাজারি-সাহিত্য এবং অতি আধুনিক মাত্রাজ্ঞানহীনতার সম্পর্কে যে একটি প্রতিবাদ থাকত তার দ্বারা কোনো কোনো বামপন্থী লেখক এই পত্রিকাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সৎসাহিত্যকে শনিবারের চিঠি অনেক সময়েই সহায়তাদান করেছে এবং সাহিত্য নিয়ে বাণিজ্য করা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে সহজে মিলিত হতে পারেন না – এমন অনেক লেখককে অনেক সময়ে প্রকাশের মঞ্চ দিয়েছে – এ-সত্যও বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বা পরিমল গোস্বামীকে ঠিক বামপন্থী বলা না গেলেও গোপাল হালদার এবং অচ্যুত গোস্বামীর একসময় নিয়মিত সংযোগ ছিল এই পত্রিকার সঙ্গে। অচ্যুত গোস্বামী শনিবারের চিঠিতে এবং অন্য পত্রিকাতেও ‘বিক্রমাদিত্য হাজরা’ এই ছদ্মনামে এবং স্বনামেও বেশকিছু প্রবন্ধ ও আলোচনা লিখেছেন। তার কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিচ্ছি।

 

এক. সাম্প্রতিককালের ঐতিহাসিক উপন্যাস – সপ্তর্ষি, শারদীয় সংখ্যা ১৯৫৯

ঐতিহাসিক উপন্যাস নিয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক আলোচনা আছে। তার মধ্যেও এটি বিশিষ্ট। উদ্ধৃতি ভারাক্রান্ত না করে সহজ ভাষায় কিন্তু বিশ্লেষণকে সরলীকৃত হতে না দিয়ে তিনি আধুনিক ঐতিহাসিক উপন্যাসের লক্ষণ ও সিদ্ধি আলোচনা করেছেন। বিমল মিত্রের সাহেব বিবি গোলাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পদসঞ্চার, তারাশঙ্করের রাধা, প্রমথনাথ বিশীর কেরী সাহেবের মুন্সী – এই চারটি উপন্যাসের আলোচনায় তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুন্দর অবকাশ তৈরি করে নিয়েছেন লেখক। উপন্যাসগুলিকে তিনি প্রশংসাই করেছেন। ত্রুটির দিকও দেখিয়েছেন কিছুটা। তাঁর মতে, প্রথমনাথ বিশীর উপন্যাসটিই শ্রেষ্ঠ। এ-বিষয়ে হয়তো মতপার্থক্য ঘটবে আমাদের সঙ্গে। তারাশঙ্করের রাধা উপন্যাসের জাত অন্য তিনটির থেকে কিছুটা আলাদা। শ্রেষ্ঠতার বিচারেও সম্ভবত অনেকে রাধাকে অগ্র-আসন দেবেন।

দুই. খারাপ সাহিত্যের সংজ্ঞা – সপ্তর্ষি, শারদীয় সংখ্যা ১৯৬৮

এই প্রবন্ধে সমকালীন জনপ্রিয় সাহিত্যের লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। সিনেমা কীভাবে কথাসাহিত্যকে বিপথে চালিত করছে তার দিক নির্দেশ করেছেন। খারাপ সাহিত্যের উদাহরণ হিসেবে অবধূত, জরাসন্ধ আর শক্তিপদ রাজগুরুর নাম উল্লেখ করেছেন তিনি।

 

তিন. সাময়িক সাহিত্যের মজলিশ (বিক্রমাদিত্য হাজরা নামে লিখিত) – শনিবারের চিঠি, মাঘ ১৩৬৯

(জানুয়ারি ১৯৬৩)

সাময়িক সাহিত্য নিয়ে যেসব বিদ্রূপ-তীক্ষ্ণ এবং আক্রমণাত্মক লেখা প্রকাশিত হতো শনিবারের চিঠিতে – এই রচনা তারই অন্তর্গত। পত্রিকা সম্পাদকের দৃষ্টিকোণ লেখকদের অনেক সময়ে প্রভাবিত করে – এই লেখাটি তার দৃষ্টান্ত। একাধিক সাম্প্রতিক লেখার সমালোচনা এবং সেই সব লেখার বাছা-বাছা অংশ তুলে দেবার ধরনটি কিছু উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পড়ে। এই ধরনের লেখা স্বনামে লিখতে চাননি অচ্যুত গোস্বামী, তা ছদ্মনাম গ্রহণেই পরিস্ফুট। তবু তিনি কোনো কোনো লেখার প্রশংসাও করেছেন। সমালোচকের সততা আর পত্রিকা-সম্পাদকের নির্দেশের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব হয়তো এই সব লেখায় অনুভব করা যাবে।

 

চার. বাংলা উপন্যাসের ভবিষ্যৎ (বিক্রমাদিত্য হাজরা) – শনিবারের চিঠি, ভাদ্র ১৩৭১ (আগস্ট ১৯৬৪)

এই লেখাটি গভীর বিশ্লেষণমূলক। সাহিত্যতত্ত্ব নিয়ে বেশ কিছুটা আলোচনা আছে এই দীর্ঘ লেখাটিতে। প্রধানত এটি উপন্যাস বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা। পাশ্চাত্য সমালোচকের মতামতের প্রাসঙ্গিকতায় লেখাটি মূল্যবান। ক্রোচে, আই. এ. রিচার্ডস প্রমুখ লেখকের উল্লেখ আছে প্রবন্ধটিতে।

 

পাঁচ. তিন টুকরো সোনা (বিক্রমাদিত্য হাজরা) – শনিবারের চিঠি, বৈশাখ ১৩৭২ (এপ্রিল ১৯৬৫)

সুবোধ ঘোষের ‘সুন্দরম্’, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ আর নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ – এই তিনটি ছোটগল্পের নিবিড় রসগ্রাহী আলোচনা এই প্রবন্ধটি। আগের প্রবন্ধটিতে আই. এ. রিচার্ডসের বিশ্লেষণ-পদ্ধতি সম্পর্কে সুন্দর আলোচনা আমরা পেয়েছিলাম। এখানে ছোটগল্প বিচারে এই রীতির প্রয়োগ কিছুটা ঘটিয়েছেন লেখক। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে এ-জাতীয় আলোচনার রীতি বাংলা সমালোচনা-সাহিত্যে তেমন ছিল না।

 

ছয়. জীবনরসের রূপকার মনোজ বসু – শনিবারের চিঠি, বৈশাখ ১৩৭২ (এপ্রিল ১৯৬৫)

পূর্বোক্ত সংখ্যাটিতেই প্রকাশিত এই প্রবন্ধ। মনোজ বসুকে নিয়ে এক প্রশস্ত আলোচনা। মনোজ বসুর লেখা অচ্যুত গোস্বামীর প্রিয় ছিল – আলোচনায় তা অনুভব করা যায়। মনোজ বসু বাংলা সাহিত্যে খুব বেশি আলোচিত হননি। তাঁর লেখার গুণের দিক যেমন আছে, তেমনি ঘাটতিও আছে কিছু। অচ্যুত গোস্বামী মোটের ওপর মনোজ বসুর লেখার সার্থকতার দিকগুলিরই উল্লেখ করেছেন।

 

সাত, সাহিত্যের সংকট (বিক্রমাদিত্য হাজরা) – শনিবারের চিঠি, মাঘ ১৩৭২ (জানুয়ারি ১৯৬৬)

সাহিত্যের সাম্প্রতিক সংকটগুলি বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। তাঁর মতে, আধুনিক সৎসাহিত্যের চার শত্রু – সরকারি ও বেসরকারি পুরস্কার প্রদান সিস্টেম; সিনেমা; ব্যবসায় মনস্ক প্রকাশককুল এবং লঘু চিত্ত-বিনোদনের প্রত্যাশী আধুনিক পাঠক। লেখাটি চিন্তা উদ্রেককারী। দেখা যাচ্ছে শনিবারের চিঠির প্রয়োজনে, বিক্রমাদিত্য হাজরার জন্ম হলেও অচ্যুত গোস্বামীর গভীর বিশ্লেষণী সাহিত্য আলোচনার প্রবণতাকে বিক্রমাদিত্য হাজরা পরাস্ত করতে পারেননি।

 

আট. রাগ করবেন না – বানানো গল্প (বিক্রমাদিত্য হাজরা) – শনিবারের চিঠি, আষাঢ় ১৩৭৩ (জুন-জুলাই, ১৯৬৬)

সাম্প্রতিক লেখক ও লেখা নিয়ে একটি সরস রম্যরচনা। সব লেখকই স্বর্গে গিয়ে লক্ষ্মীদেবীর (অর্থাৎ ধনোপার্জনের) আরাধনায় উন্মুখ – এই হলো বিষয়বস্ত্ত। গভীরতা নেই; কিন্তু সরস, বুদ্ধিমার্জিত এবং উপভোগ্য। মাত্রাছাড়া আক্রমণ, অসূয়া বা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের আতিশয্য নেই। পরিহাস-উজ্জ্বল রচনা। মলিন-বসনা, ম্লানমুখ দেবী সরস্বতীকে কেউ পুজো দিচ্ছেন না। কিন্তু হঠাৎ নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এসে তাঁকেও পুজো দিলেন। যদিও তিনি লক্ষ্মী ও কুবেরকেও পুজো দিয়েছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন – ‘ওরা এখন পাওয়ারে রয়েছেন – ওঁদের পুজো না দিলে কি চলে? কিন্তু মা সরস্বতী আপনাকেও আমি পুজো দেব। বলা তো যায় না, আজ বাদে কাল আপনি যে পাওয়ারে যাবেন না এ-কথা কে বলতে পারে?’

 

নয়. নতুন সরকার ও বাংলা সাহিত্য – শনিবারের চিঠি,  ফাল্গুন ১৩৭৩ (ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ১৯৬৭)

রাজধানী ও সাহিত্যের সম্পর্ক এখানে বিশ্লেষণের মূল সূত্র।  কংগ্রেসি সরকারের পতন ও প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনাটির সমসাময়িক মূল্য খুবই নিবিড়। যে-সাবধানবাণী তিনি ফ্রন্ট সরকার সম্পর্কে উচ্চারণ করেছেন তা সাহিত্য ও রাষ্ট্রপ্রশাসনের চিরকালীন জটিল সম্পর্কটিকে খুলে দেখিয়েছে।

 

দশ. একালের সাহিত্যচিন্তা – উত্তরণ, সেপ্টেম্বর ১৯৬৮

‘একালের সাহিত্যচিন্তা’ প্রবন্ধে ছোটো পত্রিকাকে কেন্দ্র করে মার্কসবাদী চিন্তা এই সময়ে ষাটের দশকে কীভাবে প্রকাশ পাচ্ছে তা নিয়ে অচ্যুত গোস্বামীর ভাবনা লিপিবদ্ধ। চতুষ্কোণ ও নন্দন পত্রিকার নাম করেছেন। নতুন সাহিত্যের নাম করেননি। তা কি এজন্য যে, ষাটের দশকের শেষে নতুন সাহিত্য কিছুটা গতানুগতিক পত্রিকার চেহারা পেয়েছিল?

 

এগারো. দুটি সাম্প্রতিক কাব্যসংকলন –

উত্তরণ, মে ১৯৭০

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং অসীমকৃষ্ণ দত্ত-সম্পাদিত যথাক্রমে খাড়া পাহাড় বেয়ে (লেনিনকে নিবেদিত কবিতা সংকলন) এবং শস্যের ভিতরে রৌদ্র (হো-চি-মিনের উদ্দেশে নিবেদিত কবিতা সংকলন) – বই দুটির সমালোচনা। খুব নতুন কথা নেই। প্রত্যাশিত প্রশংসাই আছে সমালোচনায়। তবু প্রতিবাদী কবিতার প্রতি লেখকের অনুরাগ লেখাটিতে প্রাণ সঞ্চার করেছে।

 

বারো. আধুনিক বাংলা সাহিত্যের হালচাল –

সাহিত্যচিন্তা, শরৎ ১৩৮০ (শারদীয় ১৯৭৩)

আধুনিককালের মননশীল ও জিজ্ঞাসু পাঠকদের উল্লেখ করেছেন লেখক। ভাষা ও রচনাশৈলীর দিক থেকে একালের সাহিত্য আগেকার সাহিত্যের চেয়ে পরিণত – এ-কথা বলেছেন তিনি।

তেরো. সাম্প্রতিক বাংলা উপন্যাস –

সাহিত্যচিন্তা, সেপ্টেম্বর ১৯৭৪

বড়ো লেখা। পাঁচের দশক থেকে মধ্য সত্তর পর্যন্ত উপন্যাসের বিবরণ। তবে বক্তব্য মোটের ওপর জনপ্রিয় ধারার সমালোচনা করার দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। বামপন্থী ধারার প্রয়াসের প্রশংসা করেছেন তিনি। ননী ভৌমিক, গোপাল হালদার, সমরেশ বসু, সুশীল জানার উল্লেখ আছে। কিন্তু কমলকুমার মজুমদার বা মহাশ্বেতা দেবীর মতো ঔপন্যাসিক যে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন, সে-বিষয়ে অচ্যুত গোস্বামী সচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। সতীনাথ ভাদুড়ী ও অসীম রায়কে নিয়ে মূল্যবান আলোচনা আছে।

 

চৌদ্দ. শরৎচন্দ্রের ‘বিপ্রদাস’ – সাহিত্যচিন্তা,

বৈশাখ ১৩৮৩ (১৯৭৬)

এই উপন্যাসকে লেখক বলেছেন মহৎ ঔপন্যাসিকের অসার্থক সৃষ্টি। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও অজিতকুমার ঘোষের মতো সাহিত্য আলোচকেরা এই উপন্যাসের প্রশংসা করেছেন বলে তাঁদের একটু সমালোচনাও করেছেন অচ্যুত গোস্বামী।

 

পনেরো. ভাষা প্রসঙ্গ – স্ফুলিঙ্গ (বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজ পত্রিকা) ১৯৭৭-৭৮

সরকারের ভাষা-নীতি এবং মহাবিদ্যালয় স্তরে ভাষা শিক্ষার গুরুত্ব হ্রাস করার বিষয়ে একটি প্রতিবাদী ও ক্ষুব্ধ প্রবন্ধ।

 

ষোলো. বামপন্থী সাহিত্য : তিন দশকের অভিজ্ঞতা – সাহিত্যচিন্তা, মে ১৯৭৭

প্রবন্ধের রচনাকালের পূর্ববর্তী তিন দশকে বামপন্থী সাহিত্যের         গতি-প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক পরিবেশ, সংকট ও প্রবণতা নিয়ে খুবই চিন্তা উদ্রেককারী একটি প্রবন্ধ। বামপন্থী সাহিত্যকে চিরকালীন সাহিত্যধারার অন্তর্ভুক্ত রূপে অনুভব করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন লেখক।

 

সতেরো. বামপন্থী সাহিত্য : তিন দশকের  অভিজ্ঞতা – সাহিত্যচিন্তা, সেপ্টেম্বর ১৯৭৭

আগের লেখাটির ধারাবাহিকতা এই প্রবন্ধে। দুটি সংখ্যা ধরে প্রকাশিত, মোটামুটি দীর্ঘ এই লেখাটি ঠিক এই মুহূর্তে যখন সাহিত্যের শিবিরগুলি অনবরত ভাঙছে আর নতুন করে তৈরি হচ্ছে; মিলছে আবার সরে যাচ্ছে, তখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।

 

আঠারো. উপন্যাস প্রসঙ্গে – সাহিত্যচিন্তা, মে ১৯৭৮

রণেশ দাশগুপ্ত-রচিত উপন্যাসের শিল্পরূপ গ্রন্থের সমালোচনা। কিন্তু মূল গ্রন্থ আর সমালোচক উভয়েরই রচনা-উৎকর্ষের কারণে লেখাটি একটি ভালো প্রবন্ধের মর্যাদা পেয়েছে। অল্প পরিসরের মধ্যে ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্তর্মগ্ন ভাষ্যরীতির উপন্যাস সম্পর্কে মূল্যবান আলোচনা আছে।

 

উনিশ. মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক –

সাহিত্যচিন্তা, মে ১৯৮০

ধনঞ্জয় দাশ-সম্পাদিত মার্কসবাদী সাহিত্য-বিতর্ক গ্রন্থটির প্রথম খন্ড নিয়ে একটি দীর্ঘ আলোচনা এই লেখাটি। প্রকাশিত হয় অচ্যুত গোস্বামীর মৃত্যুর পরে। মূল গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত হলো, বাংলায় মার্কসবাদী চিন্তার প্রসার ও সেই সূত্রে বিভিন্ন বিতর্কমূলক প্রবন্ধের সংকলন। ধনঞ্জয় দাশের লেখা একটি তথ্যবহুল ও সুসংহত ভূমিকাও আছে গ্রন্থে। এই বাতাবরণের সঙ্গে দীর্ঘকালের পরিচয় ছিল অচ্যুত গোস্বামীর। শিল্প-সাহিত্যের মার্কসবাদী তত্ত্ব নিয়েও ভেবেছিলেন দীর্ঘকাল ধরে। এই দুইয়ের সম্মিলনে আলোচনাটি উৎকৃষ্ট ও সুচিন্তিত প্রবন্ধের অবয়ব লাভ করেছে। ধনঞ্জয় দাশের মুখবন্ধটির সংগত প্রশস্তিও লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক। মার্কসবাদী সাহিত্যচিন্তার দিক থেকে প্রবন্ধটি বারবার পাঠযোগ্য। সাহিত্যের উদ্দেশ্যমূলকতার প্রসঙ্গটি বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে এই প্রবন্ধে।

এ ছাড়া অচ্যুত গোস্বামী নাউ (Now) এবং ফ্রন্টিয়ার (Frontier) পত্রিকায় ইংরেজিতে কিছু কিছু লেখা লিখেছেন – সেগুলি এখানে আলোচিত হলো না। ক্রান্তি আর প্রতিরোধ পত্রিকার লেখাগুলিও এখানে অনুল্লিখিত রইল। পশ্চিমবঙ্গে এই দুটি পত্রিকা পাইনি। যদি বাংলাদেশ থাকে তাহলে কেউ সেগুলির প্রতিলিপি পাঠালে কৃতজ্ঞ থাকব।

বেদনার সঙ্গে আমরা দেখি, নিজের পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে কিছুটা সংহতি নিয়ে এসে যখন নানা ধরনের লেখায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেছিলেন অচ্যুত গোস্বামী – ঠিক তখনই তাঁর প্রয়াণ ঘটল।

অচ্যুত গোস্বামীর প্রবন্ধের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখযোগ্য খুবই। যেমন – এক. অচ্যুত গোস্বামী উদ্ধৃতিবহুল, খুব ভারি ধরনের অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ লিখতেন না। কিন্তু খুব ‘পপুলার’ ধরনের লেখাও লিখতে পারতেন না তিনি। সরলভাবে নিজের বক্তব্যকে গভীরতর স্তরে নিয়ে যেতে পারতেন। মননী বিশ্লেষণে যে-কোনো লেখাকে সূক্ষ্মতা ও দীপ্তি দিতে পারতেন। এজন্য তাঁর লেখায় প্রসন্ন পাঠযোগ্যতা, বিচারবুদ্ধিকে তৃপ্ত করবার ক্ষমতা এবং সাহিত্যের রসবোধকে জাগিয়ে তোলার কুশলতা – এই তিনের মিশ্রণ সবসময়েই থাকত।

দুই. সাম্প্রতিক সাহিত্য-বিষয়ে সর্বদাই তিনি অবহিত ছিলেন। কখনো সমকালীন সজীব সাহিত্যধারা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি।

তিন. তাঁর স্বভাবে এক বিরল নিরপেক্ষতা গুণ ছিল। রাজনৈতিক মতবাদ কখনো সাহিত্য বিষয়ে তাঁর সততা-সমুজ্জ্বল নিরপেক্ষতাকে ব্যাহত করতে পারেনি।

চার. রাজনীতি, সমাজতন্ত্রবাদ, মার্কসীয় সাহিত্যচিন্তা বিষয়েও তাঁর মন ছিল অর্গলমুক্ত। নতুন যুগের আলোয় চিন্তাকে যাচাই করে নিতেন তিনি সব সময়ে। মার্কসবাদী শিল্প-সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ে প্রশ্নও তুলেছেন সত্তরের দশকে লেখা প্রবন্ধে। কিন্তু সৎসাহিত্য যে সমাজমুখী হবে – এ-বিশ্বাসও কখনো তাঁর ভাঙেনি। ব্যবসায়িকতা ও লঘু বিনোদনের কাজে শিল্প-সাহিত্যকে ব্যবহার করার বিপক্ষে ছিলেন চিরকালই।

অচ্যুত গোস্বামী একজন কথাসাহিত্যিকও ছিলেন। পাঁচটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত উপন্যাস আছে তাঁর। গ্রন্থাকারে  অপ্রকাশিত উপন্যাসও একটি দেখেছি। ছোটোগল্প লিখেছেন অন্তত                   দশ-বারোটি। পত্র-পত্রিকা সংরক্ষিত না থাকায় সেগুলি পাওয়া দুরূহ। তবে তাঁর কোনো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কথাসাহিত্যিক অচ্যুত গোস্বামী সম্পর্কে আলোচনা বারান্তরের জন্য তুলে রেখে প্রাবন্ধিক অচ্যুত গোস্বামী সম্পর্কে এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তাঁর প্রবন্ধের প্রকৃত মূল্য ও উৎকর্ষ ঠিকমতো বোঝানো সম্ভব হলো না। তবু এই কথা আবারো বলে শেষ করা যায় – বাংলা উপন্যাসের ধারা বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে প্রায় আবশ্যিক আলোচনাগ্রন্থ। এই গ্রন্থের পুনর্মুদ্রণ প্রয়োজন। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধের একটি সংকলনও হওয়া উচিত এখনই।