অনুবাদ : আলম খোরশেদ
তুমি যখন আমাকে বলো, এত দূর অতীতের কথা আমি মনে করতে পারব না, সুস্থ মস্তিষ্কের কেউ তা পারেও না, এবং এখন আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে এরকম বোকার মতো কথাবার্তা বলে সময় নষ্ট না করার জন্য, আমি তখন চুপ করে যাই। তবে তা কেবল বাইরে বাইরেই। এসব বিষয়ে কথা বলার মতো কাউকে না পেয়ে, তুমি যেহেতু আমার কথা শুনতেই চাও না, আমি তখন নিজের ভেতরে, নিজেরই সঙ্গে কথা বলে যাই। আমি আমার কথার অপচয় করতে পারি, কিন্তু নীরবতার অপচয় করব কেন? আমি দেয়াল আঁকড়ে ধরি, পলেস্তারার ওপর মুখ চেপে রাখি, অনুভব করি আমার নিশ্বাসের সঙ্গে কথারা ভেসে আসছে, চুনকাম ও সাদাটে শিশু তেলাপোকার স্বাদগন্ধসমেত। আমি মুখের ভেতর সেগুলোকে খানিকটা চিবিয়ে নিয়ে ওপরের দিকে উগড়ে দিই। তারা অতঃপর বাইরে বেরিয়ে আসে এবং সিলিংয়ের মাকড়সার জালে গিয়ে আটকে যায়।
আর তুমি বলো : এভাবে বিড়বিড় কোরো না সারাক্ষণ, একই বিষয় নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতে থেকো না। তোমার ওই মগজহীন মাথাটার কারণেই তোমার জীবন গোল্লায় যাবে। ঠিক যেমনটি করেছিল তোমার বাবা তার গিটারখানি দিয়ে। তবে সে অন্তত একজন সত্যিকারের মানুষ ছিল, সব অর্থেই। আর তুমি কেবল জানো আজগুবি সব কথার ফিসফিসানি, নয়তো দিনভর ওই অভিশপ্ত ঢোলের বাড়িতে আমার মাথা নষ্ট করে দিতে। তোমাকে শেষবারের মতো একটা কথা বলি – তোমার নিজেকে নিয়ে অর্থপূর্ণ কিছু একটা করার কথা ভাবো, কারণ তুমি কোনো গায়ক হওয়া দূরের কথা, একজন ঢোলবাদক হওয়ার জন্যও জন্মাওনি; খোদাই জানেন, তোমাকে কী বানানোর জন্য সৃষ্টি করেছেন তিনি।
আমি আমার জবান বন্ধ রাখি, তোমাকে আর বিরক্ত করব না বলে। তোমার চোখজুড়ে বিষাদের অমন নেকড়ে-রঙা রূপান্তর আর দেখব না বলে; রাস্তার ধারের সেই শীর্ণ গুল্মলতা আর তাদের ধুলোয় ধূসর, কালশিটে পড়া, ছোট্ট ন্যাতানো পাতাদের গায়ের রঙের মতো। মলিন হয়ে আসা শোকের পোশাকের তলায় তোমার পুরো অস্তিত্বই তো এখন সেই গাছগুলোরই মতো।
তোমাকে বিরক্ত করব না বলে আমি চুপ করে থাকি, তাকিয়ে দেখি তোমার ঠোঁটে উথলে ওঠা অভিযোগের স্রোতকে, যা আমাকে ব্যথিতও করে, কেননা আমি খুব ভালো করেই জানি, তা উঠে আসছে এরই মধ্যে জমাট বেঁধে যাওয়া এক গভীর যন্ত্রণার ভেতর থেকে, যা তোমার পোশাক ও কণ্ঠস্বরের মতোই বিবর্ণ হয়ে গেছে। বিশেষ করে তুমি যখন বাবার কথা মনে করো। তোমার ভেতরের জমে থাকা নীরবতার দ্বারা অভিভূত, তখন তুমি একটি শব্দও উচ্চারণ করো না এবং আমি এর সুবিধা নিয়ে আবারো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করি, আমার দিকে তাকিয়ে থাকা তোমার চাহনিতে আশ্বস্ত হয়ে; সেই চোখের চাহনিতে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, আমি অনুভব করতে পারি আচমকা বড় ও বয়স্ক হয়ে যাচ্ছি আমি, অনেকটা বাবারই মতো আকারে ও প্রকারে, যার ছায়া আমি তোমার চোখের মধ্যে পরিষ্কার প্রতিফলিত হতে দেখি। আমার চিন্তাগুলোকে আমার গলার মধ্যে আমি যতদূর পারা যায় ফুলিয়ে, ফাঁপিয়ে তুলি, যাতে করে এমনকি আমার কণ্ঠস্বরেও তারই গলার প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। আমার জন্মেরও পূর্বের স্মৃতিগুলোর কথা বলতে আমি তাড়াহুড়ো করি, তাদের সংখ্যা যদিও বেশি নয়, কিন্তু আমি সেগুলোকে দীর্ঘজীবী করে তুলতে সচেষ্ট হই, যেন তুমি আগেরবারের মতো শোনামাত্রই রাগান্বিত না হয়ে পড়তে পারো, যাতে করে আমি তোমার প্রশংসার উপযুক্ত হয়ে টিকে থাকতে পারি। আমি সেইসব স্মৃতিকে যতটা সম্ভব তোমার কাছাকাছি নিয়ে আসতে চেষ্টা করি, যেন আমি সেগুলোকে যেভাবে দেখি তুমিও ঠিক সেভাবেই দেখতে পাও, অনেকটা ডিমে তা-দেওয়া কোনো বড় পাখির মতো, যা তার পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষুদ্র স্মৃতিসমূহের ওপর বসে থাকে সেগুলোকে ফুটিয়ে বাচ্চা প্রসব করবে বলে। আমি যখন সেগুলোকে নিয়ে একা থাকি, অন্ধকারের মধ্যে তাদের নড়াচড়া করতে দেখি, তখন এক গভীর অসহায়তার বোধ আমাকে পেয়ে বসে, ভয় নয়, তুমি জানো, কেবল গভীর ও অপরিসীম নিঃসঙ্গতা। আমি চৌকির নিচ থেকে জোনাকিভরা বোতলটা বের করে আনি। সেটা আরো খারাপ হয়, কেননা আমি তখন কাচের সবুজাভ কিনার ঘেঁষেও অন্ধকারকে বেরিয়ে আসতে দেখি। স্মৃতিগুলো হামাগুড়ি দিতে থাকে, যেন বা তারা ক্ষুধার্ত এবং ছোট পোকাগুলোকে ধরে ধরে খেতে থাকে, যতক্ষণ না বোতলটা শূন্য হয়ে আসে। তখন আর ঘুমুতে পারি না আমি, কেননা আমি অপেক্ষা করতে থাকি কখন তারা এসে আমাকেও ঠুকরে ঠুকরে একেবারে গিলে খেয়ে নেবে।
তুমি যখন গাধাটাকে নিয়ে বাজারে যাও তোমার পনির ও ছোট ছোট পাত্রভর্তি দুধ বিক্রি করবে বলে, আমি উঠানে শুয়ে থাকি, মুখ ওপরে তোলা, যতক্ষণ না সূর্য আমাকে একেবারে অন্ধ করে দেয়; কিন্তু আমি সৈন্যদেরও আসতে দেখি; আমি তাদের সোনাঝুরি গাছের নিচে তোমার সঙ্গে তর্ক করতে দেখি, আমি আমার ভেতরে আরো কুঁকড়ে যাই, কোনদিকে যাব তা ঠিক করতে না পেরে।
তবে তুমি যদি আমাকে শোনো, তাহলে সেটা আলাদা; আমি কুঁকড়ে যাই আনন্দের অনুভূতিতে, সেই স্মৃতিগুলো যত দুঃখেরই হোক না কেন, এবং অস্বীকার করার জো নেই, সেগুলো দুঃখেরই। বিশেষত আমি যখন দেখি সেগুলো নিয়ে কথা বলার মতো কেউ নেই আমার; কেননা আমার বয়সী বাচ্চারা দ্রুতই আমার ওপর চড়াও হয়ে তাদের বুনোপাখির মতো গলার চিৎকারে আমাকে দিশেহারা করে দিতে আর আমাকে নিয়ে মশকরা করতে শিখে গেছে। এখানে, ওখানে সবখানে ‘অজাত’, ‘অজাত’ ধ্বনি শুনি, বড়গুলো একেবারে সাক্ষাৎ শয়তান, যাদের শয়তানি প্রবৃত্তিকে আমি বুঝতে পারি না, কেননা তা অস্বাভাবিক, ধার করা মনে হয় আমার কাছে। আমি যখন কবুতর শিকারের জন্য পাহাড়ের দিকে রওনা হই তখন ঘন ঝোপের আড়াল থেকে আমার দিকে ছোড়া পাথর ও পচা টমেটোর বৃষ্টির তোড়ে আমি সেখান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি না। তুমি নিজেও একদিন আমাকে পিটিয়েছিলে, আমি পুরো ন্যাংটো শরীরে, গা-ভরা বুনো গাছের দুধের আঠায় পুড়ে যাওয়া ঘায়ের মধ্যে আটকানো মুরগির পালক নিয়ে ঘরে ফেরার পর। আমার পশ্চাৎদেশে রক্তাক্ত পালক নিয়ে সেদিনের বাড়ি ফেরার পর থেকে আমি আর কোনোদিন ময়লার নালাটি দ্বারা চিহ্নিত সীমানার ওপারে যেতে সাহস করি না। সবচেয়ে দূরের মধ্যে আমি সেই সেতু অবধি যাই, তুমুল গর্জন করে ট্রেন চলে যাওয়ার আওয়াজ শুনব বলে, আমার মাথা তখন জলের নিচে থাকে, একটা নলখাগড়ার গাছের ফাঁক দিয়ে শ্বাস নিই আমি, পুলের পিলারকে শক্ত করে জাপটে ধরে থেকে, যেন সেই প্রকম্পিত শব্দকে আমি আমার দন্তপাটির মধ্যে শুনতে পাই। অথবা পাহাড়ি ছড়া বয়ে যাওয়া গুহার মধ্যে আমার ঢোলখানি নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখি। আমার কথা শোনে একমাত্র উসেবিও, যে পাথরের গা থেকে তার হাতের নখ দিয়ে শ্যাওলা খুঁটে খায়। কিন্তু সে তো বোবা কালা, আমি জানি না সে যখন কেতুর ভরা চোখ নিয়ে আমার কথা শোনে তখন আদৌ আমাকে বুঝতে পারে কি না, কেননা তার কম্পিত মাথা তো সবসময় সবকিছুকেই না বলে, এমনকি গাছ থেকে পড়া পাতাদেরও।
তবে এগুলো আমার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে আমার জন্মের আগের স্মৃতিসমূহ, তারা এতই গোঁয়ারগোবিন্দ যে কিছুতেই আমাকে ছেড়ে যায় না, এমনকি যখন আমি তাদের কথা ভাবিও না। এখন তো আমার কাছে যা স্মৃতি, তোমার কাছে তা নয়, তোমার সঙ্গে যা একবার ঘটেছে, তা-ই আমার সঙ্গে ঘটছে বারবার, একইভাবে, অব্যাহত গতিতে।
প্রতিদিন সকালে সৈন্যেরা বাবার খোঁজে বাড়িতে আসে, বাবা তখন লুকিয়ে আছেন পাহাড়ে। তারা উঁচুগলায় চিৎকার করতে থাকে এবং রাইফেলের বাঁট দিয়ে বাড়িঘর ওলটপালট করে দেয়, দাঁড়িয়ে থাকা আলমারিগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেয়, এমনকি ক্ষুদে ড্রয়ারটিকেও, যার মধ্যে একটি ইঁদুরেরও লুকানোর জায়গা নেই। সেই মুহূর্তে বাড়ির উঠোন থেকে একটা গালি শোনা যায়, আর তার পরপরই একটা ক্ষ্যাপাটে পোলকা গান গাওয়ার শব্দ; বাবার গলার মতো, তবে অনেক উঁচুতে চড়া সুরে বাঁধা, যেন বা রাগ ও ক্রোধে তৈরি কোনো রাবারের নল তার গলায় ঠেসে দেওয়া হয়েছে। শব্দটা ওপর থেকে ভেসে আসে, যেনবা বাবা কোনো গাছের ডালে পা দুলিয়ে বসে গাইছে। সৈন্যেরা সেই গানের শব্দের দিকে তাদের রাইফেল তাক করে, যার সুর তখন শাখাদের ফাঁকে ফাঁকে হাসির দমকে ফেটে পড়ছিল। তুমি তাদের কাছে গিয়ে ভয়ে ভয়ে, লজ্জিতভাবে বলো, যেনবা কোনো গোপন কথা বলছ এমনভাবে : এটা তো পানচিতো। স্বর্গের দোহাই লাগে, গোবেচারা মানুষটাকে কিছু কোরো না।
তারা তাকে নিচে নামিয়ে আনে, বেয়নেটের পাত দিয়ে আঘাত করে, উঠোনের মাঝখানে নিয়ে যায়, আর সেখানে প্লাটুন সদস্যদের রাইফেলের গুলির দমকে লাল রঙে ভেজা সবুজ পালকের মেঘ জাগে আকাশে : তোতা পাখিটার মৃত্যুর টুকরো টুকরো অংশকে তুমি এবং আমিও ধীরে ধীরে মাটিতে পড়তে দেখি, যা বারুদের ঘন ধোয়া আর সূর্যরশ্মির আগুনের মোলায়েম আদরে এতক্ষণ ঝুলে ছিল ওপরের বায়ুমণ্ডলে।
তবে সৈন্যরা এখন তোমার কাছে সরে আসে, তাদের ভারি বুটগুলোকে ক্রুদ্ধ ধীরতার সঙ্গে মাটিতে ঘষটে; তারা তোমার হাত ধরে টেনে নেয়; তারা তোমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে চায়; তারা তোমার কাপড় ওপরে টেনে তুলে ছিঁড়ে ফেলে দেয়। তুমি চিৎকার করো; সারা শরীর বেঁকিয়ে চিৎকার করো; তুমি কামড়ে দাও, লাথি মারো; এবং চিৎকার করতে থাকো; তুমি চিৎকার থামাও না, এমনকি মারা যাওয়ার পরও। প্রতিবার তুমি বমির উদ্গার তোলো, আমাকে তা আরো শক্তভাবে চেপে ধরে সর্বাঙ্গে, তা আমাকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে তোলে, আমার অনস্তিত্বের শেষ সীমা পর্যন্ত, যেন আমি তোমার ভেতর থেকে বের হয়ে না আসতে পারি। একটি ঘোড়ার খুরধ্বনি শোনা যায়; এটা বাবার ঘোড়া হতে পারে; আরো লোক আসতে থাকে; ঘোড়ার নালের শব্দ, আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দ, কর্কশ গলার আওয়াজ; সূর্যের অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। বাবা পাহাড়ে লুকিয়ে আছে; আর ফিরে আসবে না কোনোদিন।
তুমি এইসব কথার উল্লেখ শুনতে চাও না এবং তুমি আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে আদেশ করো, যেন আমি এইসব ফালতু কথা আর না বলি। তুমি অন্তহীনভাবে পুনরাবৃত্তি করতে থাকো যে, আমার শূন্য মস্তিষ্ক, আর এইসব নির্বোধের মতো বলা হাবিজাবি কথা আমার জীবনটাকেই ধ্বংস করে দেবে, যে খুদে নির্বোধটিকে প্রয়োজনের তাগিদে একটু বেশি আগেই টেনে বের করে আনা হয়েছিল। তোমার স্বল্পদেহ, তোমার শীর্ণতার চূড়া থেকে আমার উদ্দেশে চিৎকার করে বলো : একবারের মতো ও চিরকালের মতো নিজেকে একটা মানুষ করে তোলো, কেননা আমি আর বেঁচে নাও থাকতে পারি, জানি না তাহলে তোমার কী গতি হবে, কেননা কথায় বলে না, একটা এতিম বাছুর আরেকটা মা খুঁজে পাবে না তাকে প্রথম দুধের স্বাদ দেওয়ার জন্য। এখানে বোকার মতো সেঁধিয়ে না থেকে যাও খোঁয়াড় থেকে গরুগুলোকে ছেড়ে দাও।
কিন্তু আমি যাই না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমি তোমাকে কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতে দেখি বাড়ির কোনায়-কানায়, নানা আসবাবের মাঝখানে ঝুঁকে নিচু হতে দেখি, ঝাড়ুর ঘষটানিতে জেগে ওঠা ধুলার মেঘে কখনোবা হারিয়ে যেতে; পরক্ষণেই দেখি উঠানে, রান্নাঘরের বাগানে, প্রতিটি কাজের ভঙ্গিতে ক্রমে ছোট থেকে ছোট হয়ে যেতে, যতক্ষণ না তুমি কলাগাছের পুড়ে যাওয়া পাতাদের ভেতর, একটি বাতাসের ঝলকের চেয়ে আর বেশি কিছু থাকো না। একমাত্র তখনই আমি আমার ঢোলখানি আঁকড়ে ধরে গুহাটার দিকে যাত্রা করি, সেখানে ঢোলের বাদন আর তীব্র স্রোতের যুগল শব্দের মাঝখানে নিজেকে আটকে রাখব বলে। গুহার গায়ের এক ছোট্ট ছিদ্রপথে সূর্যের একটি রশ্মি প্রবেশ করে, অন্ধকারের মধ্যে একটা নারকেল গাছকে উল্টো করে উপরদিকে পা দিয়ে দাঁড় করিয়ে দেয়, নদীর ছোট ছোট ঢেউ উল্টো না হয়েও, আকাশের পরিবর্তে মাটির দিকে চেয়ে চিকচিক করে বয়ে যায়। ঠিক যেমনটি আমি তোমার ভেতরে সেঁধিয়ে ছিলাম যখন, এবং তোমার চোখের ভেতর দিয়ে পৃথিবী দেখছিলাম; সম্পূর্ণ একা এক গুটিপোকার মতো, মধুর চাকের ভেতর বসে, অন্যপাশে টুপটাপ মধুর ফোঁটা ঝরার শব্দ শুনতে শুনতে।
যখন ঝড় আসে তখন জানালার কাচগুলোকে জিব দিয়ে চাটতে শুরু করা ছাড়া আমার আর কিছুই করার থাকে না, যতক্ষণ না আমি শরীরের ভেতরে বৃষ্টিকে অনুভব করতে পারি, জিবের মধ্যে পাই বিজলিচমকের পোড়া সালফারের স্বাদ। আর যখন বজ্রের মুষ্টাঘাতে দারুণ ঝড়ের মেঘগুলো মুক্তি পেয়ে নেচে ওঠে, আমি তখন কাচ চাটা বন্ধ করে আমার চামড়ার ঢোলের মাথায় আঘাত করতে থাকি, কিন্তু বাইরের প্রকৃতির ছন্দকে ধরতে ব্যর্থ হই, যা বেপরোয়াভাবে মিশে যায় আমার বাদনের সঙ্গে এবং আমার আঙুলগুলোতে, হাতে, পেটে খিঁচ ধরে যায়, যতক্ষণ না আমি আমার দোষগুলোকে বমি করে দিতে থাকি, আমার সবচেয়ে বড় অপরাধকে, ঘনকালো আখের চোলাইয়ের মতো এক তরল, সেই ‘আমি পাপী’ গানখানির নির্যাস, যা তুমি আমাকে প্রতিরাতে গাইতে বাধ্য করতে, যা আমার মাথার মধ্যে ঢুকে, পাগলের মতো বকতে প্ররোচিত করে এবং আমি ঈশ^রের পবিত্র নামকে থুথুর মতো দেয়ালের গায়ে বৃথাই ছিটিয়ে দিই।
তুমি শুধু যদি আমাকে একটু শুনতে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যেত। কারণ যা আমাকে সুখের আবেশে গলিয়ে দেয়, আমাকে সারিয়ে তোলে, তা হচ্ছে আমার জন্মের আগের সেই স্মৃতিগুলো নিয়ে কথা বলতে পার; সেটা তোমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য নয়, বিশ^াস করো, যেন শুধু আমরা আরেকটু কাছাকাছি আসতে পারি; তারা আমাকে অনুভব করায়, বুঝিবা আমি ফের তোমার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছি যতক্ষণ না তোমার অন্ধকারের স্রোতে আমার হাড় অবধি ভিজে যাই আমি, তোমার উদ্বেগের উষ্ণতায় বিজড়িত, আমার মাথার মধ্যে তোমার পদধ্বনির মৃদু দুলুনির অনুভূতি, পাহাড়ে বাবার খোঁজে আমাদের সেই অনিঃশেষ অনুসন্ধানকালের মতো; যখন তোমার একান্ত নিজস্ব উদ্বেগের স্পর্শ আমাকেও শান্ত করে দিত। দেখা যাক আমি মনে করতে পারি কি না।
ঠিক যে বিন্দুটি থেকে আমরা একে অপর থেকে আলাদা হয়ে যেতে থাকি সেটা সবসময়ই ছিল তার মৃত্যু; এক নির্বোধ মৃত্যু, তুমি সবসময়ই বলে এসেছো; একটি মৃত্যু যা সারাটি জীবন সে যা ছিল তার নেতি হিসেবেই প্রতিভাত হয়েছে : একটি জীবন প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, রাগে ও সৌভাগ্যে পূর্ণ, সবসময়ই অন্যের চাইতে অনেক বেশি জানা, বেশি হাশিখুশি ও নিশ্চিন্ত, বেশি সাহসী, বেশি সবকিছু। সে মহীরুহ। এটা বিশ্বাস করা শক্ত যে, রাতভর গান ও গিটার বাদনের আসর থেকে তাকে বাড়ি বয়ে আনা ঘোড়াটি, সেই বাদামি ঘোড়াটির ওপর থেকে সে যখন পড়ে গিয়েছিল, একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায়, তাতে করে একেবারে স্বর্গের গায়ে মাথা ঠুকে তার মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তার এমন পতনে গিটারটিও ভেঙে গিয়েছিল, যার শব্দ আমাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয় এবং এই প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা বিষয়ে অবহিত করে। আমরা ময়লার ভাগাড়ে নিচু হয়ে পড়ে থাকা ভয়ার্ত এক পুরুষের প্রাণহীন শরীর ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাই না।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলার মতো আমার আরেকটি বাবা না থাকার কারণে তুমি সেই মৃত মানুষটি বিষয়ে যা-কিছু বলো আমি তা-ই শুনি, সেই মৃত মানুষটির বিষয়ে, তোমার ভেতরে যার মৃত্যু কখনোই নিঃশেষিত হয় না। এবং যা স্বাভাবিক মাত্র : আমাকে যদি তোমার চোখ দিয়েই তাকে দেখতে হতো, তাহলে আমি তার মধ্যে এমন এক অবয়ব দেখি যা তোমার আত্মাকে প্রসারিত করে দেয়। কিন্তু আমি তাকে ভিন্নভাবে দেখি, এবং সেটাই তোমাকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করে। আমরা যখন ঠিক এই বিন্দুতে এসে পৌঁছাই, তোমার হাত থেকে একটি প্রবল আঘাত ছিটকে এসে আমার মাথার মধ্যে অনুরণন তোলে, আমার মাথা গিয়ে ঠেকে দেয়ালে, আর সেই গর্জনে মাথা থেকে পা অবধি কাঁপতে থাকে। আহা, তুমি যা চাও তা চাইতে না পারার অক্ষমতার বিষাদ; আমি কী চাই তোমাকে তা বোঝাতে না পারার বেদনা। তোমার আঘাত আমাকে যে পিঁপড়েদের দঙ্গলে নিয়ে গিয়ে ফেলে আমি তাদের আঁচড়াতে থাকি, ক্ষুধার্ত পিঁপড়ে, আমার মাথার নিচে, এবং আমি সেখানেই পড়ে থাকি এবং তোমার দিকে তাকাই; আমি ভাবি তোমার স্বামীর প্রতি তোমার গভীর ভালোবাসার কারণে তুমি হয়তো আমাকেও তারই মতো মৃত্যু এনে দিতে চাও, যেন তুমি আমাদের দুজনের কারো প্রতিই অন্যায় না করো। এটাই আমি ভাবি, এবং এটাই সম্ভবত আমাদের তিনজনের জন্য সবচেয়ে ভালো। কে জানে। আমি মাথা নিচু করি সেই আঘাতটির জন্য, যা হয়তো আমার সবকিছু বের করে নিয়ে আসবে, তুমি যদি আমাকে না-ও আঘাত করো, আমি নিজেই আমার মাথাকে আঘাত করব সেই কাদামাটির শক্ত দেয়ালে, গাছের গায়ে, অবুঝ ছাগলছানার মতো, যতক্ষণ না আমি জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে যাবো মাটিতে, শুধু তোমাকে দেখানোর জন্যই যে, আমাদের দুজনের মন আসলে একইরকম।
আমি জানি সেইসব দুঃখময় স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে প্রহার করার অধিকার তোমার রয়েছে; কিন্তু তোমার কোনো অধিকার নেই, আমি কেন এতদূর পূর্বের স্মৃতি মনে করতে পারছি তার জন্য মারা। আমার অপরাধবোধ ও অনুশোচনা খুবই বিস্মৃতিপ্রবণ হতে পারে। আমি জানি না। আমি যা জানি তা হলো, আমাকে সেই একই জায়গায় ক্রমাগত লাথি মেরে যেতে হবে, চারদিক থেকে সেলাই করা, এই ভারি, জলাবদ্ধ আকাশের গায়ে আঘাত করে যেতে হবে, যে-আকাশ আমার পায়ের ওপর পাল্টা ধাক্কা দেয়; আমার এই যুদ্ধ, যেন পৃথিবীর মাটিতে একদলা আকৃতিহীন পদার্থের মতো পতিত না হই তার বিরুদ্ধে; জন্মানোর আগেই যে অনাথ, জীবনকে জানার পূর্বেই যে তাকে ঘৃণা করতে শিখে গেছে।
তাই আমার ক্লান্তি উদ্বেগ বাড়ছে তোমার চেয়েও বেশি। জন্মানোর আগেই আমি তোমার চেয়েও বেশি বয়স্ক, এমনকি আমার মৃত পিতার চেয়েও বয়োবৃদ্ধ, শহরের প্রবীণতম ব্যক্তিটির চেয়েও অনেক বেশি বুড়ো। তুমি আমাকে কেন বিশ্বাস করো না যখন আমি বলি যে, এইসব স্মৃতিকে আমি খুব ভালো মনে করতে পারি।
আর তুমি বলো : তুমি যা জানো না তার সম্পর্কে এভাবে অন্তহীন বকা বন্ধ করো। তুমি আমাকে সেসব বিষয়ে কথা বলতে শুনেছো, এবং সেখান থেকেই তোমার ধারণা হয়েছে যে, তুমিও সেসব ঘটতে দেখেছো। কেউই তার নিজের সত্তার সঙ্গে যা ঘটে তা ছাড়া আর কিছু মনে করতে পারে না। এবং সেটিও, যদি একজন মানুষের যুক্তিশৃঙ্খলার সক্ষমতা থাকে।
শ্রদ্ধার সঙ্গেই আমি তোমাকে বলছি, আমার কাছে সেটা মনে করা নয়, বরং ভুলে যাওয়া। আমি সেগুলোকে আমার যুক্তির শক্তিতে মনে করি না : তুমি নিজেই বলো আমার মাথা অর্ধেক খারাপ। আমি সেগুলোকে আমার নাভিমূলে অনুভব করি; আমি চোখ বন্ধ করে ফেললেও সেগুলোকে দেখতে পাই – তারা আছে সেখানে।
আমি যখন বাবার সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করি তখনই তুমি রাগে উন্মাদ হয়ে যাও এবং আমাকে চুপ করিয়ে দাও। এমন গোঁয়ার্তুমি কোরো না। তুমি তার সম্পর্কে খারাপ ভাবতে পারো না। এটা সাদা চোখেই দেখা যায় যে, তুমি তার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারোনি। আর জানবেই বা কী করে, সে মারা যাওয়ার সময় তুমি আমার পেটে মাত্র ছয় মাসের ভ্রূণ। সে একজন সত্যিকারের মানুষ ছিল, আর তার বাদ্যযন্ত্রটিকে নিয়ে দুজন মানুষ। সে যখন গাইত তখন তার দেহ হয়ে উঠত আকাশের সমান, আর তার ছায়ায় বসে লোকেরা ভাবতো, জীবন তাহলে তেমন খারাপ কিছু নয়। সে জানতো কীভাবে সেইসব বিষয়কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হয়, গরিব মানুষেরা যার কাছে পৌঁছাতে পারে না, তাই সে তাদের জন্য সেগুলোকে মাটিতে নামিয়ে আনতো। এ এক নিঃসীম করুণা যে, সে তার কোনো বীজ রেখে যেতে পারেনি তোমার মধ্যে। সে নিশ্চয়ই জানতে পেরেছিল যে, তার ভবিতব্য তার মৃত্যুর সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে। সে মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে তাই আমাকে দিয়ে শপথ করিয়েছিল যেন তার গিটারটিকেও তারই সঙ্গে সমাহিত করাকে আমি কর্তব্যজ্ঞান করি এবং আমি তার সেই শেষ ইচ্ছাকে পূরণ করেছিলাম।
আমি সেটাও খুব স্পষ্টভাবে মনে করতে পারি, এবং তোমাকে এটা বলছি যত না তোমার মন ভালো করার জন্য, তার চেয়ে বেশি এটাই চরম সত্য বলে। আমি সেদিন রাতের বেলায় তোমাকে দেখি বাবার গিটারখানি কফিনে ভরার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করতে, প্রথমে খুব ধীরেসুস্থে ও সুন্দরভাবে, শান্তভাবে তাকে কফিনের একটুকরো খালি জায়গায় স্থান করে দিতে; তুমি তাদের দুজনকেই তোমার অশ্রুতে ভিজিয়ে দিচ্ছিলে, তোমাদের বিধবার আহাজারিতে; তুমি তাদের বারবার করে আঙুল ছুঁয়ে আদর করছিলে যেনবা চাইছিলে তাদের আরো নমনীয় করে দিতে, তাদের বোঝাতে এবং টেনেটুনে দুজনকে এক করে দিতে। কিন্তু মৃত মানুষটি তো বড়সড়, তাকে দেখে মনে হচ্ছিল প্রতিমুহূর্তে আরো ফুলেফেঁপে উঠছে, এবং কফিনে গিটারটিকে জায়গা দিতে অস্বীকার করছে; কিংবা হয়তোবা গিটারখানিই, মৃতদেহটির মতোই ঘর্মাক্ত ও গোঁয়ার, বাক্সে না আঁটার বুদ্ধিতে জিতে যায়। তুমি তোমার স্বামীকে ডাকো, আদুরে গলায় মিনতি করো, যা কেবল তুমিই করতে পারো, তার সকল গুণপনার কথা মনে করিয়ে দাও, তোমাদের দুজনের ভাগ করে নেওয়া গভীর আনন্দের কথাও, সে কতটা ভালোবাসত তার গিটারকে, তুমি তার কাছে মিনতি করো, তার এক হাত তুলে ধরো, তার পা, তার মাথা। কিন্তু তাতে কাজ হয় না এক বিন্দুও। কফিনের ভেতরে মৃতমানুষটি রাগে আরো গুটিয়ে যায়, তার শেষ ইচ্ছাকে অস্বীকার করে; সে এখন আর কোনো সংগীত চায় না, কেবল শান্তি ও নৈঃশব্দ্য; বাইরে গিটারটি গা মোচড়ানোর শব্দে প্রতিবাদ করে, তার কাঠের শরীরখানি ভাঙা, তার তারগুলো মাথার দিকে জট পাকানো, বুঝি সেই লোকটির প্রতি অভিমানে, যে তাকে ছোট করছে, চাইছে তার মৃত্যুটা কেবল তার একারই হোক। সেইসব অর্থহীন চেষ্টাচরিত্রের পর তুমিও ক্ষেপে ওঠো; এবং যেটা সৎ প্রচেষ্টায় অর্জন করতে পারোনি সেটা আদায় করো অসৎ উপায়ে; তুমি গিটারটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করো মাটিতে আছাড় দিয়ে; তুমি তার টুকরোগুলোকে মুঠোতে করে তুলে এনে কফিনের ভেতর ছুড়ে মারো। তোমার আহাজারি কিংবা আঘাতের শব্দ কোনোটাই ঠিক শোনা যায় না; লোকেরা প্রাণপণে হেসে নিচ্ছে যতটা তাদের সাধ্যে কুলায়; যেনবা তারা এক ভীষণ মজাদার কান্নাতেই ভেঙে পড়ছে। একটা সময় আসে যখন হাসি আর কান্না কোনোভাবেই আলাদা থাকে না; সেই সময়, যখন তারা দেহের ভেতর থেকে তাদের মরিয়া ভাবটুকু উন্মাদের মতো বের করে আনে, আজেবাজে শব্দসমূহ থেকে শরীরকে মুক্ত করে নেবে বলে।
তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছো। আর আমিই কেবল জানি, একজন মৃত মানুষ, যাকে লোকে আমার বাবা বলে, এখানে, তোমার ভেতরে এসেছে আমার সঙ্গে জায়গা ভাগ করে নেবে বলে, যেখানে আসলে দুজনের জন্য যথেষ্ট জায়গাই নেই। এবং আমি জানি, আজ হোক, কাল হোক সে আমাকে এখান থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। সেজন্যই আমি তোমার মারগুলোকে, তুমি সারাক্ষণ আমার ওপর যে অপমানগুলো ছুড়ে দিচ্ছো তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ না করে, মুখ বুজে সহ্য করেছি। আমি জানি তোমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব এখন তার প্রতি যেহেতু সে-ই এখন দুর্বলতম; তুমি আমার চেয়ে তার প্রতিই বেশি দরদ দেখাতে বাধ্য যার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। আমাকে এখন তোমার দুঃখের দাঁড়িপাল্লায় একটা বিপরীত বাটখারা বসাতে হবে, যে-পাল্লার দুটো কাঁটাই খুব পক্ষপাতদুষ্টভাবে তোমার দিকে তাক করা, অনেকটা দোন লুকাসের পাল্লাটিরই মতো; তুমি যখন আমাকে তার কাছে জিনিস কিনতে পাঠাতে, তার এক পাল্লায় থাকত একটা কালো সিসার বাটখারা, আর অপর পাল্লায় একমুঠো মাতে কিংবা বিস্কিট, রাখা মাত্রই যা একটানে নিচে নেমে আসত। আমি তোমাকে সেই অতিরিক্ত চাপের বেদনা থেকে নিষ্কৃতি দিতে চাই, যা তোমাকে ছিঁড়ে দুই ভাগ করে দিচ্ছে বৃথাই, যা তোমার জীবনকে স্রেফ যন্ত্রণায় পর্যবসিত করেছে। আগামীকাল আমি সেই সেতুটির কাছে যাবো, গর্জনরত ধাবমান ট্রেনের শব্দ শুনতে, আমার মাথাখানি অনেকটুকু পানির নিচে ডুবিয়ে, এবং বরাবরের মতো খুঁটির সঙ্গে মুখ আটকে রেখে, কিন্তু আমি এবার কোনো খড়বিচালি আমার মুখে দিয়ে রাখবো না কোনোভাবেই; আমি পানির নিচেই থাকবো, দাঁতে দাঁত চেপে, যতক্ষণ না সেই ধাতব শব্দ মুখের কিনার থেকে গড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে শরীরের হাড়ের ভেতর মিশে যায়, আমার ভেতরে বিরতিহীনভাবে ধ্বনিত হতে থাকা অন্য সব শব্দের সঙ্গে।
লেখক-পরিচিতি
প্রখ্যাত কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিত্রনাট্যকার ও শিশুসাহিত্যিক আউগুস্তো রোয়া বাস্তোসের জন্ম পারাগুয়াইয়ে হলেও জীবনের অনেকটা সময় তিনি আর্হেন্তিনা ও ফ্রান্সে কাটান। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও রাজনীতিসচেতন বাস্তোস তাঁর স্বদেশের গুয়ারানি সম্প্রদায়ভুক্ত আদিবাসীদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি সোচ্চার হয়েছেন সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেও, যার জন্য তাঁকে এমনকি নির্বাসনেও যেতে হয়েছিল। বিষয়ের বৈচিত্র্য ও সমৃদ্ধির পাশাপাশি বাস্তোসের গদ্যভাষাও বহুমাত্রিক, কবিত্বময় ও দার্শনিকতায় জারিত। তাঁর প্রধান গ্রন্থসমূহের মধ্যে রয়েছে : Son of Man (1960), I the Supreme (1974), The Prosecutor (1993), Counterlife (1994) ইত্যাদি। ১৯৮৯ সালে বাস্তোস স্প্যানিশ সাহিত্যের অত্যন্ত সম্মানজনক সেরবান্তেস পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০৫ সালে স্বদেশের আসুনসিয়ন শহরে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.