অন্ত্যজা

এ অঞ্চলে নদী বলতে এই একটিই। নাম মৌরি। নামটা অনেকটা পাহাড়ী নদীর মত। যদিও মৌরি নদী জড়িয়ে আছে পাঁচ গ্রামকে, তারপরও মৌরি পাড়ের মানুষ বলতে বুঝায় মনোহরপুর বাজার আর কামদেবপুর গ্রামের পাশ ঘেসে মৌরি যেখানে বাঁক নিয়েছে নিজস্ব ঢংঙে ঠিক তার পূর্ব পার্শে মাইল খানেক উচু জায়গায় গড়ে ওঠা বেশ্যা পল্লীটিতে যারা বসবাস করে তাদেরকে। এক সময়ের দোর্দন্ড প্রতাপ মৌরির বাঁকের মুখে কবে এই পতিতা পল্লীর জন্ম -এ নিয়ে এ অঞ্চলের কারো ভাবনা নেই। তবে পরিচিতির কমতি নেই। এই পাড়ায় দূর দুরান্ত থেকে খদ্দের আসে যন্ত্রচালিত নৌকা ভাড়া করে। সন্ধ্যায় আসে সকালে চলে যায়, আবার দুই একদিন থেকেও যায় কখনো কখনো। তাই মৌরি এখানকার মানুষের নির্ভরতার অনেকখানি। এরা মৌরি জলে স্নান সেরে পবিত্র হয়, মৌরির জলেই বাঁচে, আবার ভেসেও যায়। বর্ষার মুখে মৌরির যৌবন আসতে শুরু করে। আষাঢ়ের শুরতে মৌরির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালে মনে হয় নদীটি কেমন যেন দুলছে। বৃষ্টির চাপ বাড়ার সাথে সাথে নদীও হিংস্র হয়ে উঠতে থাকে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। পরিণত খরিস সাপের মত ফনা দোলাতে থাকে। সারা বছরের অবজ্ঞার প্রতিশোধের নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। পাঁচ গ্রাম ধোয়া ঘোলা জলে ঘুর্ণি খেলতে শুরু করে। সেই ঘুর্ণিতে দূর থেকে ভেসে আসে মরা পেট ফোলা গরু, ছাগল, ঘরের টিন, ঘুমানোর চৌকি আবার মানুষের লাশ -যার চোখ খেয়েছে মাছে। পেট ফোলা লাশের উপর নিশ্চুপ বসে থাকে কাক। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে মৌরির ধ্বংসযজ্ঞ দেখতে থাকে। এ সময় বেশ্যা পাড়ার রোগা ডিগডিগে কালো কালো ছেলেদের সামান্যতম বেয়াদবী, দুষ্টুমি অথবা ছেলেমানুষী মৌরি সহ্য করেনা। ভেসে আসা অভিশপ্ত টিন অথবা চৌকিতে প্রলুব্ধ হয়ে বেশ্যা পাড়ার অভাবী মানুষগুলো ঘোলা জলে ঝাপ দিলেই মৌরি আবার তার জলে ঘুর্ণি তোলে। একটানে তাকে নিয়ে যায় বহুদূর। যেখানে বেশ্যাপাড়ার নিত্যদিনের হিসেব নিকেষ, হাহাকার আর বেবুশ্যেদের চিৎকার অথবা হা-হুতাশ পৌঁছেনা। এভাবে বহু প্রাণ ভেসে গেছে আজ অবধি। তবু লোভ যায়না অভাবি মানুষগুলোর। চৌকিতে শোয়ার লোভ সামলাতে পারেনা এখানকার মানুষগুলো। প্রিয়জনকে নদীর পাড়ে অপেক্ষায় রেখে ওরা ভেসে যায় নদীর জলে। শোকের তুফান ওঠে বেশ্যাপাড়ায়। বুক চাপড়ে প্রলাপ করতে থাকে আরতি, পূর্ণিমা, রেবতিরা। সেই শোকে সংক্রামিত হয় শাবানা, অলিভিয়া, ববিতাদের মাঝেও। এ সবই নিজেদের রাখা নাম। এরা নিজে নিজেই নিজের নাম রাখে অথবা খালা দিয়ে দেয় একটা বাহারী নাম; অথবা খদ্দেরে। খদ্দেরের পছন্দ মোতাবেক বেশ্যারা কেউ হিন্দু অথবা মুসলমান হয়। মৌরির জলে যেদিন কেউ ভেসে যায় সেদিন আর হাঁড়ি চড়েনা বেশ্যাপাড়ার হেঁসেলে। পিতৃ পরিচয়হীন শিশুর শোকে নামহীন গোত্রহীন বেশ্যারা সেদিন নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়। সবাই সেদিন একত্র হয় হরেন মাস্টারের ঘরে। হরেন মাস্টার এদের ভগবান, এদের আল্লাহ, এদের প্রাণ। পাড়ার সকলেই মাস্টারকে মান্য করে। নতুন পুরাতন সব মেয়েমানুষ তাকে পথে দেখলে পথ ছেড়ে দেয়। হরেন মাস্টারের কি জাত তা এরা জানে না- এ নিয়ে এদের মাথাব্যথাও নাই কারো। শুধু বেশ্যাগুলো জানে হরেন মাষ্টার ওদের এক ধরণের আশ্রয়। সামান্যতেই এদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়। চুল ছেড়াছিড়ি ঝগড়া; খিস্তি-খেউর। খদ্দেরের ফেলে যাওয়া বাংলা বোতলের তলানিটুকু গিলে এক ঘরের মাগী অন্য ঘরের মেয়েছেলের উপর চড়াও হয়। এও ছাড়ার পাত্র নয়; একজন অন্যজনকে ‘খানকি’‘বেশ্যা’ বলে গালাগাল দেয়। বাড়াবাড়ির রূপ নিলেই গলা খেঁকরে বেরিয়ে আসে হরেন মাস্টার। গম্ভীর গলা বলে ওঠে,
– যাও, অনেক হয়েছে, এখন শান্ত হও।
জোঁকের মুখে নুনের ছিটে যেন। কুঁকড়ে যায় দু’পক্ষ। তারপর দু’জনেই ফিরে যায় দু’জনের ঘরে।
অদ্ভুত রহস্যময় এই মানুষটি। সুন্দর সুপুরুষ এই মানুষটিকে সহজেই এখানকার মানুষগুলোর মধ্য থেকে আলাদা করা যায়। বর্তমানে সে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নয়; অতীতেও ছিল কিনা জানেনা কেউ- তবু তিনি মাস্টার। এই নিষিদ্ধ পাড়ার পিতৃ পরিচয়হীন শিশুগুলোকে কলা-পাউরুটির লোভ দেখিয়ে নিজের ঘরের মেঝেতে পড়তে বসায় হরেন মাস্টার। নিজের অন্যান্য খরচ বাঁচিয়ে সস্তা পেনসিল, কাগজ, স্লেট আর পাউরুটি নিজের পয়সাতেই শহর থেকে কিনে আনে সে। শিশুরা দুলে দুলে সুর করে পড়তে থাকে। পড়তে পড়তে ভুল হলে হাত পাখার লাঠি দিয়ে সেই ভুল শুধরে দেয় হরেন মাস্টার। কখনো কোন চিঠি পত্র উড়ে পাড়ায় এসে পড়লে হরেন মাস্টারই তা পড়ে দেয়। বেশ্যাদের টাকা কড়ির হিসাবও হরেন মাস্টার রাখে সারা বছর। পড়া শেষে সব ছেলেগুলোকে কাছে বসিয়ে নিজেই খাওয়ায় হরেন মাস্টার আর বলে,
– খা, খা, খেয়ে জোয়ান হয়ে ওঠ তো দেখি তাড়াতাড়ি; মস্ত বড় বিদ্যান হবি একদিন, তখন এই মাস্টার দাদুকে একটা লজেন্স কিনে দিস। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবচেয়ে আদরের ফুলি তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়,
– তখন তো তুমি বুড়ো হয়ে যাবে, তোমার দাঁত পড়ে যাবে, চকলেট খাবা কি করে?
খিলখিল করে হেসে ওঠে শিশুগুলো। সে হাসিতে হরেন মাস্টারও যোগ দেয়। তখন অন্য গ্রামের ভদ্র পাড়ার মত সুন্দর হয়ে ওঠে মৌরি নদীর পাড়ের বেশ্যা পাড়াটা। সারা রাতের ধকল সহ্য করা ক্লান্ত বেশ্যাগুলো দুর থেকে এই পবিত্র দৃশ্য দেখে। তাদের সদ্য ঘুম ভাঙ্গা চোখে চকিতে একচিলতে স্বপ্ন খেলে যায়। হরেন মাস্টারের প্রতি ওদের শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা বাড়ে।
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে মেয়ে শিশুর সংখ্যায় বেশি। এ পাড়ায় মেয়ে জন্মায় বেশি। আর মেয়ে জন্মালেই এ পাড়ার খালা/ মাসী খুশি হয়। বাঁচলে এরাই হবে পাড়ার লক্ষি। ছেলে হলে খুশি যে একেবারে হয় না তাও ঠিক না। ছেলে বড় হলে মাস্তান হবে। চুরি করবে; পুলিশে ধরবে; হাজত খাটবে; বের হবে আবার। এক সময় খুনের মামলায় পড়িয়ে পড়বে; অবশেষে দাগী আসামী হয়ে কোন মাগীর ঘরে লুকিয়ে চুরি করে বাংলা মদ, গাঁজা বিক্রি করবে। তারপর এক সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়বে। জেলে যাবে বড় সময়ের জন্য অথবা ক্রসফায়ার। আর মেয়েগুলো পাড়াতেই থাকে। বড় হয়ে ওঠে কলাগাছের মত। তারপর একদিন সন্ধ্যায় গন্ধ তেলে চুল ভিজিয়ে, টাইট ব্লাউজ আর রঙিন সায়া পরে দাঁড়িয়ে থাকে তার মায়ের ঘরের সামনে। এটাই যেন নিয়ম এখানকার। এর ব্যতিক্রম নেই। শুধু ব্যতিক্রম ঘটেছিল ফুলির জন্মের সময়। শেফালী যে পোয়াতী ছিল তা পাড়ার মেয়েছেলেরা ভালো করে জানতো না। যেদিন শেফালী পাড়া কাঁপিয়ে ‘ওয়াক’ করতে লাগল, তখন সবাই তার দিকে তাকালেও তেমন গায়ে মাখলো না কেউ, …… এ দৃশ্য পাড়ায় নতুন না। তারপরও ছুটে এসেছিল খালা। এক বালতি জল এনে চোখে মুখে জলের ছিটে মেরে মমতাময়ী হয়ে বলেছিল, – প্রথম তো; এ সময় এমন হয়; চিন্তা করিসনি; মেটার্নীতে গিয়ে ঠিক করে দেব।
অন্যরা বলেছিল,
– খালা সোহাগি মাগীর ছিনালী; আবার মেটার্নী হাসপাতাল! কতই আর দেখবো লো; এখনই ছমিরন ধাইকে খবর দিলেই হয় ; হাত ভরে দিয়ে টেনে আনবে আপদ।
খিলখিল করে হেসে উঠেছিল উপস্থিত সবে। শুধু হাসেনি হরেন মাস্টার। উতলা হয়ে অযথা দৌড়ে বেড়িয়েছে সারা পাড়া। আর মাঝে মাঝে এসে দাঁড়িয়েছে শেফালীর ঘরে। আস্তে ধীরে সব অস্থিরতা থেমে আসে। শুধু স্থিরতা আসে না খালা আর শেফালীর বুকে। শেফালী দেখতে শুনতে ভাল। ভদ্র বাড়ীর মেয়েদের মত দেখায়। পাড়াতে তার দামও কিছুটা বেশী। থানার বাবুরা মাঝ রাতে এলে শেফালীকেই খোঁজে। তাই খালা তাকে লক্ষিজ্ঞান করে -আর সে কারণেই শেফালী অন্যদের চক্ষুসুল। তাই শেফালীর অবস্থা যত তাড়াতাড়ি মেটানো সম্ভব হবে ততই খালার ব্যবসার জন্য ভাল। আর এজন্যই মেটার্নীর ব্যবস্থা। হরেন মাস্টার নির্বাক। কেবল প্রতিবাদ করেছিল শেফালী। ও বলল,
– আমি হাসপাতালে যাব না; ছমিরণ দাইকে মাছ কাটা বটি দিয়ে ফালা ফালা করে ফেলব আমি। খালা বলল,
– তোর ও পাপ তুই কতদিন বইবি?
– ও পাপ না-বিধাতার অমোঘ লিখন-আশীর্বাদ; না হলে ও বেশ্যার পেটে আসবে কেন? তীক্ষè গলায় উত্তর করে শেফালী।
তারপর অনেক কথা জল্পনা-কল্পনা শেষ করে শেফালী একদিন সাধ খেল পাড়ার এক বেশ্যার ঘরে। অবশ্য এর ব্যবস্থা হরেন মাস্টারই করেছিল। সাধ খেতে বসে মাস্টার যখন শেফালীকে একটা নতুন কাপড় দিয়ে আশীর্বাদ করতে গেল, শেফালী তখন বলল,
– আশীর্বাদ কর মাস্টার, আমার যেন জুঁই ফুলের মত সাদা ধবধবে একটা মেয়ে হয়।
শুনেই সবাই দাঁতে জিব কেটেছিল। একে পাপ তারপর আবার মেয়ে -এ তুই কি বলছিস শেফালী? রেবতির প্রশ্নে ফুঁসে উঠেছে শেফালী,
– এ পাপ না; মুখ সামলে কথা বলবি তোরা।
শেফালীর রুদ্র মুর্তির সামনে রেবতি যেন চুপসে গিয়েছিল সে সময়।
তারপর সামনের বর্ষার শুরুতে এক রাতে যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠল শেফালী। দিশে না পেয়ে খালা দৌড়ে গিয়ে মাস্টারকেই ডাকতে লাগল,
– মাস্টার, ও মাস্টার একবার এদিকে এস দিকিনি, শেফালীর যে ব্যথ্যা উঠেছে …
শুনেই লাফ দিয়ে মাস্টার। তারপর পড়িমরি করে ছুটে আসে শেফালীর ঘরের দিকে। ছমিরণ দাইকেও ডাকা হলো। একজন একজন করে অন্যরাও এসে হাজির হল শেফালী ঘরের। শেষ রাতের দিকে যমে মানুষে টানাটানি শেষে শেফালী শান্ত হলো। মুহূর্তে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল মৌরি পাড়ার বেশ্যা পাড়ার কোনে কোনে। হঠাৎ একটা মহা খুশির রোল পড়ে গেল সবার মাঝে। একটি মেয়ে শিশুকে সাহসের সাথে জন্ম দেওয়ার আনন্দে আজ সকলেই আনন্দিত। শেফালীর যে চরম শত্রু ছিল সে ছুটে এসে সদ্যজাতকে কোলে নিয়ে আনন্দে চিৎকার করতে লাগল,
– ওরে দেখে যা আমাদের কি টুকটুকে একটা মেয়ে হয়েছে; ও মাস্টার একটা নাম রাখ দিকিনি আমাদের মেয়ের।
ঘরের সামনের এক কোনায় দাঁড়িয়ে চুপচাপ সবকিছু দেখছিল মাস্টার। রেবতির কথায় চেতন ফিরে পেল হরেন মাস্টার। মিন মিন করে জিজ্ঞেস করল,
– শেফালী কেমন আছে? ভাল তো?
ছমিরণ ধাই জবাব দেয়,
– চিন্তা করো না মাস্টার, ও মাগী ভালই আছে।
– ফুলের মত মেয়ের নাম তাহলে ফুলকুমারী থাক; ছোট করলে দাঁড়ায় ফুলি। সেদিন থেকে ফুলি সবার মেয়ে হয়ে গেল। পিতৃপরিচয়হীন বেশ্যার মেয়ে ফুলি আর পাঁচটা মেয়ের মত সকলের মেয়ে হয়ে বাড়তে লাগল মৌরি পাড়ের বেশ্যা পাড়ায়।
গোল বাধল ফুলির বয়স যখন আট মাস। তখন ফুলি হাসতে শিখেছে; অল্প অল্প হামাও দেয়। আর দিনের বেশি সময় হরেন মাস্টারের কাঁধে কাঁধে থাকে তখন। একদিন সকালে সামান্য কারণে যথারীতি বেধে যায় তুমুল ঝগড়া। ঝগড়ার এক ফাঁকে খালা বলেই দেয়,
– তোর দেমাগ আমি শেষ করে দেব। তুই কার পাপ জন্ম দিয়েছিস আমি জানিনা ভেবেছিস, কচি খুকি পেয়েছিস; ছি! ওরকম মানুষটার সাথে শুতে তোর লজ্জাও করল না; তোর কি নরকেরও ভয় নেই লো মাগী?
শেফালী চিৎকারা করে কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারল না শেষ পর্যন্ত। তারপরও খালা চালিয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ তারপর আস্তে ধীরে সেদিনকার মত সব শান্ত হয়ে আসে। সূর্য ডুবল আবার মৌরি পাড়ের বেশ্যা পাড়া জীবন ফিরে পায়। গন্ধ তেলে চুল ভিজিয়ে বেশ্যাগুলো খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। লঘু তামাশায় হাসির বন্যা বয়। কেউ কেউ সস্তা গানও গায়। শুধু শেফালীর ঘরে লন্ঠন জ্বলে না; শেফালী আজ চুল বাঁধেনি। শুধু বিকেল বেলা হরেন মাস্টারের কোলে ফুলিকে দিয়ে সে চলে আসে। আর কোন হদিস মেলেনি এ পর্যন্ত। যখন শেফালীর হদিস মিলল তখন, তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। বিষক্রিয়ায় তার মুখ কালচে হয়ে গেছে। ঠোঁটের কোনে জমে থাকা ফেনা শুকিয়ে গেছে। কোথা থেকে যে শেফালী বিষ জোগাড় করল তা আজো রহস্য। শেফালীর মৃত্যু সমস্ত পাড়াকে স্তব্ধ করে দেয়। শেফালীর এই মৃত্যু সংবাদের বিষে পাড়াটা যেন নীল হয়ে পড়ে। পাগলের মত কাঁদতে লাগল ববিতা, আরতি, পূর্ণিমা, শাবানারা। এমনকি পাষাণ হৃদয় খালাও শেফালীর লাশের পরে আছড়ে পড়ে ডুকরে কেঁদেছে দীর্ঘক্ষণ। শুধু নির্বাক ছিল হরেন মাস্টার। শুধু শেফালীর মাথার কাছে বসে এলোমেলো চুলগুলো মুখের উপর থেকে একটি একটি করে সরিয়ে দিচ্ছিল ও। আর বিড় বিড় করে বলছিল,
– এ কি করলি গো তুই’ নিজে পালিয়ে গেলি অভিমানী’।
এক পর্যায়ে ছমিরণ ধাই বলে ওঠে,
– উঠ মাস্টার, এখন অনেক কাজ!
এখন যে অনেক কাজ তা মাস্টারের অজানা নয়। বেশ্যা পাড়ায় কোন অপঘাত মৃত্যুতে পুলিশী ঝামেলা নেই। সমাজপতিরনা এদেরকে পতিতা করেছে। এখানে কেই মরলে শ্মশানে তাদের যাওয়ার অধিকার নেই আবার কবরস্থানেও তাদের জায়গা হয় না। কারণ এদের জাতের ঠিক নেই। অবশ্য এসব নিয়ম এ পাঁচ গ্রামের সমাজপতিদের তৈরী করা। কিন্তু তারা গোপনে এখানে আসেন। নানা ছুতোতে তারা ওদের ঘরে ঢোকে। বেশ্যাগুলোর শরীর হাতরায়। কখনো কখনো এদের শরীরের মধ্যে ডুব দিয়ে আকন্ঠ পান করে নর্দমার নোংরা সুস্বাদু সুধা। কিন্তু এসব ঘরে অন্ধকারে। দিনের আলোতে এদের সাথে কথা বললে সমাজপতিদের মান যায়। তাই এরা মরলে লাশের স্থান হয় মৌরির বুকে। যথাসম্ভব রীতিনীতি মেনে লাশের বুকে একটা ভারি কিছু বেঁধে হরেন মাস্টার
কাঁধে নিয়ে মৌরির দিকে এগুতে থাকে; পিছনে শোকস্তব্ধ একদল নামহীন জাতহীন, গোত্রহীন বেশ্যা আর ফুলকুমারী। মৌরির পাড়ে দাঁড়িয়ে ওরা সর্বশক্তিমানের কাছে প্রার্থনা করে, যিনি ওদের সৃষ্টি করেছেন, ওদের বেশ্যা বানিয়েছেন। তারপর ওরা মৌরি নদীকে ওদের ভক্তি নিবেদন করে, যে নদী এই বেশ্যা পাড়ার জীবন প্রবাহকে বাঁচিয়ে রাখে তারপরও শেফালীকে শুইয়ে দেওয়া হয় মৌরির জলে। মুহূর্তে শেফালী তলিয়ে যেতে থাকে। পা হাত বুক মাথা এক সময় চুলও। এক অন্ধকার জীবনে তলিয়ে যাওয়া শেফালী আর এক অন্ধকারে হারিয়ে যায় মুহূর্তেই। এক এক করে সবাই ফিরে আসে নিজেদের কুঁড়েতে। শুধু হরেন মাস্টার মৌরির পাড়ে বসে থাকে ফুলিকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নির্বাক।
এসব পুরনো কথা। সবাই ভুলেছে। বেশ্যাদের এত অনুভূতিপ্রবণ হলে চলেনা। কিন্তু ফুলি বড় হয়েছে এখন। ফুলির সাথে যারা কলা পাউরুটির লোভে হরেন মাস্টারের ঘরে যায় তারা এখনো পর্যন্ত শুধু যায়-ই। ফুলিই ব্যতিক্রম। এখন ফুলি বেশ ক’টি ইংরেজী ছড়া পড়তে পারে; ছোট ছোট হিসেব কষতে পারে। চিঠি লিখতে ও পড়তে শিখেছে সে ইতিমধ্যে। এমনকি ওর খালা/মাসীদের যৌন রোগের ঔষধের খোসাগুলো পড়ে দেয় মাঝে মধ্যে। ফুলি পাড়ার আশা-আকাঙ্খার সলতে। আজ হরেন মাস্টার সবাইকে তার ঘরে ডেকেছেন। সকলেই হাজির হয়েছে এই পড়ন্ত বেলায়। তবে কিছু নতুন মেয়ে আসেনি এখনো। পাড়ায় কিছু নতুন মেয়েও এসেছে এখন; তাদের কাছে হরেন মাস্টার বুড়ো বৈ আর কিছুই নয়। তবুও অনেকেই তাকে মানতে বাধ্য হয়। খানিক পর হরেন মাস্টার ফুলিকে কাঁধে নিয়ে সবার সামনে এসে দাঁড়ায়। অবিকল আগের মত ফুলি মাস্টারের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। অনেকেই সেই পুরনো দিনের কথা মনে পড়ে আর চোখ ভিজেক উঠল নিজেদের অজান্তে। এর মাঝে হরেন মাস্টার বলে উঠল,
– তোমরা সবাই আসাতে আমি খুশি; আজ একটা বিশেষ কারণে তোমাদেরকে এখানে ডেকেছি;
ছমিরণ ধাই এখন কানে শোনে না ভাল। সেও একটু এগিয়ে আসে। মাস্টার বলে চলে,
– ফুলি আজ পড়তে লিখতে শিখেছে; ও তোমাদের সন্তান; তোমরা সবাই ওর মা।
‘মা’ কথাটা শুনেই পুর্ণিমা, শাবানা আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নেয়। মাস্টার বলে,
– আগামী কাল ফুলিকে উজ্জ্বলপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে যাব। সবই মুখ চাওয়া-চায়ি করে। এ পাড়ার কেউ স্কুলে ভর্তি হওয়া, এমনকি পড়া লেখা করার কথা কল্পনা করাও গতকাল পর্যন্ত পাপ ছিল। আজ এই আনন্দ সংবাদে মৌরি পাড়ের বেশ্যারা হু হু করে কেঁদে ওঠে। আনন্দে বিস্ময়ে। হরেন মাস্টার বলে,
– তোমরা সকলেই ফুলির মা, ফুলি তোমাদের সন্তান; পরীক্ষায় পাশ করলেই সে স্কুলে ভর্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। তোমরা সকলেই তোমাদের সন্তানের জন্য প্রার্থনা কর;
কথা শেষ করে হরেন মাস্টার ফুলিকে নামিয়ে চোখের জল আড়াল করতে দ্রুত ঘরে চলে যায়। রেবতি দৌড়ে এসে ফুলিকে কোলে নিয়ে কাঁদতে থাকে। কাঁদছে সবাই, আবার হাঁসছেও সবাই। কান্না-হাসির দোলায় দুলছে মৌরি পাড়ের বেশাপাড়া। এর মধ্যে সুর্য পশ্চিমে ডুব দেয়।
পরদিন বেশ্যা পাড়ায় সকালটা হল একটু অন্য রকমের । সকলেই মৌরির জলে ¯œান সেরে নিজেকে পবিত্র করেছে। সারিবদ্ধ ভাবে জড় হয়ে মৌরির পাড়ে প্রতিক্ষা করছে তারা কখন হরেন মাস্টার ফুলিকে নিয়ে নৌকায় উঠবে। বলতে বলতে মাষ্টার আর ফুলিকে আসতে দেখা যায়। আজ ফুলি হেঁটে আসছে; ফুলির পিছনে ওর এ পাড়ার বন্ধুরা; খালি গায়ে; খালি পায়ে। হরেন মাস্টার নৌকায় পা দেওয়ার আগে বলল,
– তোমরা ফুলিকে আদর করে দাও; ও যেন পরীক্ষায় ভাল করে।
রেবতি, পূর্ণিমা, শাবানা সকলেই ফুলির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে, আঁচলে চোখ মুছল। মাাস্টার বলল,
– মাঝি নৌকা ছাড়, বেলা বাড়ছে।
মাঝি নৌকার দাড়ি তুলে নেয়। মৌরির ঢেউ কেটে নৌকা এগিয়ে চলে উজ্বলপুরের দিকে। এ পাড়ের বেশ্যাগুলো মানুষ সেজে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের পিতৃপরিচয়হীন এক দঙ্গল কঙ্কালসার ছেলেমেয়েদের নিয়ে। নৌকার উপর দাঁড়িয়ে ওদের আশা-আকাঙ্খার সলতে ফুলি, ওদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে। সকালের আলো এসে পড়েছে মাস্টার আর ফুলির মুখে। সেই চকচকে আলোয় ফুলির মুক্তা দানার মত মুখটা অবিকল ওপারের ভদ্র মানুষের বাচ্চার মত দেখাচ্ছে।