চন্দন আনোয়ার প্রধানত কথাসাহিত্যিক।

প্রাবন্ধিক-গবেষক-সম্পাদক হিসেবেও তাঁর পরিচিতি রয়েছে। নিগূঢ়জীবন ও বাস্তববাদী চেতনার আলোকে গড়ে ওঠে তাঁর লেখামালা। তাঁর শাপিত পুরুষ (২০১০) ও অর্পিত জীবন (২০২০) উপন্যাসদুটি বিষয়মূল্য ও শিল্পগুণে সমৃদ্ধ। এ-বছর (২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে তাঁর তৃতীয় উপন্যাস অক্টোপাসের হাসি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানুষের প্রগতি ও মুক্তচিন্তার বিপক্ষে সর্বদা সক্রিয় থেকেছে একদল ধর্মান্ধ-কুচক্রী-স্বার্থান্বেষী অপশক্তি। তারা অক্টোপাসের মতো মানবতা ও শুদ্ধবোধ-বিবেচনাকে চারদিক থেকে আঁকড়ে ধরে বিনষ্ট করে অট্টহাসি হাসতে চায়। মুক্তচিন্তক, সদর্থক ভাবনার বাহক এই জীবননিষ্ঠ ঔপন্যাসিক। অতীত ও নিকট-অতীতের নির্বাচিত প্রাসঙ্গিক ঘটনা উঠে এসেছে তাঁর বর্তমান উপন্যাসে। আপাতভাবে মনে হতে পারে, অক্টোপাসের বিজয় ঘোষিত হয়েছে। আসলে তা নয়, উপন্যাস পাঠ করলেই পাঠক জেনে যান – ঔপন্যাসিক কোন পক্ষের মানুষ। উপন্যাস পাঠান্তে পাঠকের মনোজগতে আলোড়ন ওঠে, প্রতিবাদীকণ্ঠ সম্মিলিত হয় – ঘাতকের লাল পর্দা দুলে উঠলেও প্রফেসর ওয়াসিরা বিলুপ্ত হন না। এখানেই সমাজজীবন ও শিল্পের প্রতি চন্দন আনোয়ারের দায়বদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে যায়।

ইতিহাসের অনেক ঘটনা ও চরিত্র প্রেক্ষাপটে এনে এবং প্রধানত একটি শিক্ষিত দেশপ্রেমিক-মানবতাবাদী-উদারপন্থী পরিবারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে উপন্যাসের আখ্যান ও বয়ানা। তবে ইতিহাসের সত্যকথন উপন্যাসের শিল্পরস ক্ষুণ্ন করেনি। বিষয় ও চরিত্রের প্রয়োজনে ধারাবাহিকতা রক্ষা না করে, যখন যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ইতিহাস-তথ্য লেখক নিয়েছেন। দেশের সীমানা ছেড়ে বৈদেশিক প্রসঙ্গও আবশ্যিক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থান পেয়েছে। এটি চন্দন আনোয়ারের ব্যাপক পাঠ্য ও দূরদৃষ্টির পরিচায়ক।

উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিশ^বিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এবং তিনি উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রের সেতুবন্ধন। কতগুলি টেক্সট বা গল্প নিয়ে একত্রে গড়ে ওঠা উপন্যাসের আখ্যানের মধ্যে চেতনাগত একটি ঐক্য বিদ্যমান। সর্বত্রই বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মৌলচেতনা ও বিশ^মানবতার চেতনা প্রতিষ্ঠিত। এই চেতনার পতাকাবাহী প্রফেসর ওয়াসির বিচরণ বর্তমান ও নিকট-অতীতের এমনসব ঘটনাতে, যার মধ্যে দিয়ে বাঙালি সত্তার বিকাশ ও স্বাধীন রাষ্ট্রের চেতনা গড়ে উঠেছে। উপন্যাসের শুরুতে ধর্মান্ধ একটি রাজনৈতিক সংগঠন শহরে আতঙ্কময় মিছিল বের করে এবং এই মিছিলের নিরাপত্তা বিধান করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাবাহিনী। সাবলীলভাবে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনমনে ত্রাস সৃষ্টি করে এবং একজন রিকশাচালকের শরীর বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশের ক্ষমতার রাজনীতির অন্তর্গত ধূর্তামির কারণে এই রাষ্ট্রবিরোধী শক্তির উত্থান ঘটে। এই উত্থান এতটাই সমারোহে ঘটে যে, দেশের ৬৩ জেলায় একই দিনে একই সময়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়। এভাবেই বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উত্থানের বিপরীতে প্রগতিশীল মুক্তবুদ্ধির মানুষের অবস্থানকে আখ্যানে রূপ দিতে গিয়ে লেখক অধ্যাপক ওয়াসির চরিত্রায়ণ করেন, যাঁর পিতা সৈনিক ছিলেন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহিদ। তাঁর মা হয়ে ওঠেন আত্মত্যাগী বাঙালি নারীর মূর্তপ্রতীক, সন্তানকে বাংলাদেশি চেতনা তথা মুক্তিচিন্তক করে গড়ে তোলেন। মঙ্গলবাসরীয় আড্ডা নামে শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটা আড্ডাচক্র গড়ে তোলেন প্রফেসর ওয়াসি, যারা প্রাতিষ্ঠানিকতার গণ্ডির বাইরে গিয়ে স্বাধীন-চিন্তার জগৎ তৈরি করে। ক্রমেই বিস্তৃত হয় প্রফেসর ওয়াসির বিচরণের জগৎ। মূলত স্বাধীন বাংলাদেশের সার্বিক বাস্তবতার আখ্যায়ন করতে গিয়ে ঔপন্যাসিক যে বিষয়গুলি তুলে এনেছেন তা হলো – জঙ্গিবাদের উত্থান, যুদ্ধাপরাধীর বিচার, শাহবাগের গণজাগরণ, মুক্তচিন্তার লেখকদের হত্যা, একজন বাউলের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার মতো নিষ্ঠুরতা, সাদা-নীল-হলুদ ইত্যাদি রঙের ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির প্রকৃত স্বরূপ, শহরের পাশাপাশি গ্রামের রাজনৈতিক বাস্তবতা তথা ক্ষমতার রাজনীতির অপচর্চা, অর্থ ও ক্ষমতার নেশায় তরুণ-সমাজের একটি বড় অংশ রাজনৈতিক দল ও নেতাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার। এই সমসাময়িক বাস্তবতাকে আরো বেশি প্রসারিত করার জন্যে লেখক ইতিহাসের ধারাবাহিকতা ভেঙে সাঁওতাল বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহ, খাপড়া ওয়ার্ড হত্যাকাণ্ড, শহিদ শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ ও ঊনসত্তরের  গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের দশকে দেশ-কাঁপানো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নীহারবানুর অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উপন্যাসের আখ্যানে উঠে এসেছে। এসব ঘটনার ভেতর দিয়ে প্রফেসর ওয়াসির প্রত্যক্ষ ও মনোজাগতিক বিচরণ ঘটে, বাঙালি জাতীয়চেতনা ও মানবতার একটি শক্ত ভিত্তি তৈরি হয়। এ-কারণে প্রফেসর ওয়াসির লড়াই জাতীয় লড়াইয়ের প্রতীক হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা, ক্যাম্পাসে ক্রমাগত শিক্ষক ও শিক্ষার্থী খুন-জখমের বিরুদ্ধে প্রফেসর ওয়াসির অবস্থান স্পষ্ট, যা ‘লেখকের কুশপুত্তলিকা’ পর্বে লেখকের বক্তব্যে প্রকাশিত হয় :

ওয়াসি ভয় পেয়ো না। মানুষ এখন আর মাতৃগর্ভেও নিরাপদ নেই। তুমি তো জানো সবই। ফেরাউনের শিশু হত্যা কাহিনি রূপকথা নয়। গুজরাটে মায়ের পেট কেটে বের করে নয় মাসের ভ্রূণ আগুনে ছুড়ে মারার খবর পত্রিকায় পড়ে আমি কেঁদেছিলাম, তুমি পাশে ছিলে সেদিন। কী ভয়ংকর উন্মাদন অন্ধ হলে বাবরী মসজিদ ভেঙে ফেলা যায়! টুইন টাওয়ার গুঁড়িয়ে পড়ে ছাতুর মতো। পৃথিবী ক্রমশ উন্মাদ অন্ধদের দখলে চলে যাচ্ছে। অবশ্য আমার স্থির বিশ্বাস, আলো আসবে একদিন। মানুষের পরাজয় আমি প্রত্যাখ্যান করি। (পৃ ১০৪)

ওয়াসি ভয় পান না। তাঁর কর্মাদর্শের সঙ্গে আছেন ত্যাগী-সাহসী মা, শিক্ষিত সহধর্মিণী জাকিয়া, টগবগে শিশুসন্তান রৌদ্র ও অসংখ্য ভক্ত-শিক্ষার্থী। তাই তিনি বলতে পারেন, ‘আমি স্বপ্ন দেখি,  আমি প্রার্থনা করি, একুশ শতকে বাংলাদেশে অন্তত একজন লেখকের জন্ম হোক, যে লেখকের নামে বাংলাদেশ চিনবে গোটা পৃথিবী।’ (পৃ ১৭৭)

অক্টোপাসের হাসি ১৮টি পর্বে বিভক্ত এবং প্রতিটি পর্বের স্বতন্ত্র নামকরণ ছোটগল্পের নামকরণের মতো তাৎপর্যবহ ও প্রতীকধর্মী। যেমন – একটি শান্ত নিরাপদ মিছিল, সুখজাল, মাটির ফাঁদ, খেলোয়াড়ের বাজি, খুনের সাক্ষী কামড়, বধ্যভূমি জেগে আছে, নন্দিনীর পতাকা, লাল পর্দা দুলে ওঠে প্রভৃতি। এসব পর্বে মৌল চিত্র ও চারিত্র্যের সঙ্গে সংগতি রেখে

সমাজ-জীবনের অন্যবিধ অনুষঙ্গ – আনন্দবেদনার শিল্পরূপায়ণে লেখক বিশেষ পারদর্শী। প্রসঙ্গত, শিক্ষিত মেধাবী জাহানারার সংসার-পীড়ন স্মরণ করা যায়, যা বাংলার নারীজীবনের প্রায় নিত্যদৃশ্য।

চন্দন আনোয়ারের ভাষা সাবলীল ও সহজবোধ্য। উপন্যাসের আখ্যান-কাঠামোতে বিচিত্র বিষয়ের সেতু তৈরি করে লেখকের মজবুত ভাষা-গাঁথুনি : 

মাঠ ভরে উঠেছে পাকা ধানে। ধানের ছোট্ট সোনালি শরীরে টলমল করে শীতের শিশির। এই সব শিশির মুক্তোর দানা হয়ে ওঠে সকালের সোনালি রোদে। পাকাধানের গন্ধমাতাল আমি হেঁটে বেড়াই আলপথে। সকাল নটার দিকে হঠাৎ শুনি চতুর্দিকে এলোপাতাড়ি চিৎকার। মাথা তুলে দেখি, গ্রামের বড় তালগাছটির মাথায় লাল নিশান উড়ছে পতপত করে, যেন স্বাধীন দেশের পতাকা উড়ছে। আমিও চিৎকার দিয়ে দৌড়াই।  (পৃ ১৩২)

চন্দন আনোয়ারের বয়স চল্লিশোত্তর। মুক্তিযুদ্ধসহ অনেক কিছুই দেখেননি, অথচ তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, তিনি অনেক কিছুই দেখেছেন নিপুণভাবে। লেখক হিসেবে এটা তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ও পঠন-পাঠনের ফল। সেইসঙ্গে আছে সার্থক কথাকার হওয়ার শ্রমনিষ্ঠ সাধনা। একজন পাঠক হিসেবে অক্টোপাসের হাসি আমাকে আশান্বিত করে এবং ঔপন্যাসিকের লেখার ওপর নির্ভরতার আস্থা বাড়ে।

Leave a Reply