‘প্রেসক্রিপশন ঠিকঠাক ফলো করছেন তো সিস্টার?’

ঘরে ঢুকেই বিতস্তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করলেন ডক্টর সেন।

‘হ্যাঁ স্যার। আপনার অ্যাডভাইসমতোই সমস্ত কিছু করা হচ্ছে।’

‘দেখবেন পেশেন্টের ট্রিটমেন্টের ব্যাপারে যেন বিন্দুমাত্র গাফিলতি না থাকে।’

‘বিপাশা ঠিকঠাক কেয়ার নিচ্ছে তো?’

‘হ্যাঁ স্যার, আপনি কোনোরকম চিন্তা করবেন না।’

ডক্টর সেন একনজর পেশেন্টের দিকে তাকালেন।

রোগীর ভেতর বিন্দুমাত্র চাঞ্চল্য লক্ষ করলেন না তিনি। হুইলচেয়ারে যেমনভাবে বসে ছিলেন সেভাবেই বসে আছেন। ভাবলেশহীন নিস্পৃহ দৃষ্টি। কিছুটা আত্মসমাহিত। যেন সুদূর কোন অতীতে বিচরণ করছেন। 

ডক্টর সেন কিছুটা সময় নিরীক্ষণ করে নতুন কিছু ওষুধ   যোগ করলেন। আগের ওষুধের ডোজ পরিবর্তন করে সেগুলি আবার বিতস্তাকে বুঝিয়ে দিলেন। তারপর আরেকবার রোগীর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।

বিশাল প্রাসাদোপম বাসগৃহ ‘একটুকু বাসা’ ডক্টর অতলান্ত সেনের। তাঁর বাবা নামকরা ব্যারিস্টার। দাদুও ছিলেন রাঁচির নাম করা ফিজিশিয়ান। মা মারা গেছেন খুব ছোটবেলায়। অতলান্ত এখনো বিয়ে করেননি। পোর্টিকো থেকে গাড়ি বের করে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে সিকিউরিটিকে বলে গেলেন ঠিকমতো লক্ষ রাখতে। দিনকাল সুবিধের নয়। অপরিচিত কাউকেই যেন ঢুকতে না দেওয়া হয়।

সিকিউরিটি কাম গেটম্যান রাজেশ মাহাতো ‘একটুকু বাসা’তে পঁচিশ বছর ধরে ডিউটি করছে।

ডক্টর সেন নিজেই আজ চালকের আসনে বসলেন। এক মাসের নাম করে ছুটিতে দেশের বাড়িতে গেছে ড্রাইভার দেবেশ ডস। তিন মাস হয়ে গেল আসার নাম করছে না। জমিজমা সংক্রান্ত ব্যাপারে অনেকদিন ধরে ছুটি চাইছিল।

গাড়িতে উঠে এফএম অন করলেন। খবর শুরু হলো। তিনি ড্রাইভ করতে করতেই শুনতে পাচ্ছেন, বেশ কিছুদিন আগে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে জঙ্গলমহলের পাষাণী দেবীর মূর্তি। খবর পেয়ে চলে আসেন জঙ্গলমহল থানার আইসি। সঙ্গে আরো তিনজন স্টাফ সরেজমিন তদন্ত করতে এসেছিলেন। ত্রিকূট পাহাড়ের ওপরে বহুকালের পুরনো এই পাষাণী দেবীর মন্দির। মূলত আদিবাসী অঞ্চল এটি। জঙ্গলে ঘেরা মন্দিরটি সচরাচর কারো চোখে পড়ার  কথা নয়।

এখনো পর্যন্ত দেবী মূর্তির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। আশেপাশে থানা পুলিশ চৌকিগুলিতে অলরেডি খবর পাঠানো হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশকে অ্যালার্ট করা হয়েছে। নাকা চেকিং অব্যাহত আছে। পুলিশের অনুমান মূর্তি ধারেকাছে কোথাও আছে। এখনো পাচারকারীরা সরিয়ে ফেলতে পারেনি।

দুই

গাড়িটাকে পার্কিংয়ে রেখে অতলান্ত হাসপাতালে ঢুকলেন। মেইল এবং ফিমেইল ওয়ার্ডে রাউন্ড দিয়ে সিসিইউতে ঢুকে  রোগীদের নতুন করে অ্যাডভাইজ দিয়ে তিনি ওটিতে গেলেন। আজ মেজর ওটি। ওটিতে কর্মরত সিস্টার এবং অন্য স্টাফদের মুখে সেই একই প্রসঙ্গ, দেবী পাষাণীর অন্তর্ধান-রহস্য।

বছরখানেক হলো মহুল গ্রামে পোস্টিং হয়েছে অতলান্তর। এই পাষাণী দেবীর কথা এখানে এসেই প্রথম জানেন তিনি। মনে পড়ল সেদিনের কথা। ডা. সেনের সেদিন মেজর ওটি ছিল। ওটিতে ঢুকে দেখেন ওটির বেশ কয়েকজন স্টাফ অনুপস্থিত। পেশেন্টের সমস্ত রকম ইনভেস্টিগেশন, অ্যানাস্টেথেটিক চেকআপ পর্যন্ত কমপ্লিট। এত বড়ো অপারেশনের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি হাসপাতালে না থাকায় বাইরে থেকে কিছু ইনস্ট্রুমেন্ট ভাড়া করতে হয়েছে। কোম্পানির সঙ্গে কথাও হয়ে গেছে। কোম্পানির লোক এসে গতকাল ওটি সিস্টারের কাছে সমস্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে গেছে। অথচ আজ শুধু ওটি স্টাফের অনুপস্থিতির কারণে ওটি ক্যানসেল করতে হচ্ছে।

নেক্সট ওটি ডেট পেতে পরের সপ্তাহ। এদিকে রোগীর কন্ডিশন খুবই খারাপ। ব্লাড চলছে। ইমিডিয়েট অপারেশন না করলে হয়তো পাটাই কেটে বাদ দিতে হবে।

অতলান্ত হতাশ হয়ে রেজিস্টার রাখা টেবিলের পাশের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লেন।

সিনিয়র সিস্টার অনন্যা ঢুকলেন সবে।

তিনি এদের অনুপস্থিতির কারণ কী জানতে চাইলে অনন্যা বললেন, স্যার আজ পাষাণী মন্দিরে উৎসব। সবাই সেখানে গেছে।

পাষাণী মন্দিরে উৎসব? তাই হাসপাতাল ডিউট ফেলে চলে গেল?

গজগজ করতে থাকেন অতলান্ত। এই হচ্ছে আমাদের দেশের চিত্র। উৎসব, পুজো-পার্বণ নিয়ে এমনি মাতোয়ারা যে অন্য কোনোদিকে তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।

অনন্যা সিস্টার বললেন, স্যার টেনশন করবেন না, আমি এসে গেছি, আমার সঙ্গে আরো দুজন আছে। আমি অলরেডি ফোন করে দিয়েছি। একজন জিডিএ আসছেন গাইনি ডিপার্টমেন্ট থেকে।

পেশেন্ট নির্দিষ্ট সময়ে ওটিতে তোলা হয়েছে। অতলান্ত প্রস্তুত। বাইক অ্যাকসিডেন্টে বাঁ-হাঁটুটা গুঁড়িয়ে গেছে। প্যাটেলার হাড়গুলো এখন একটা একটা করে জুড়তে হবে তার দিয়ে। এক্স-রে দেখে নিয়েছেন। বেশ ছোট ছোট টুকরো। এগুলো পরস্পর জোড়া দিতে ঘণ্টাচারেক সময় তো লাগবেই। কিছু হাড়ের চিহ্ন নেই পর্যন্ত। গুঁড়িয়ে গেছে। সেগুলি কী করবেন ভাবছেন।

হাত চলছে আর টুকটাক কথা কানে আসছে। পায়েল সিস্টার মন দিয়ে শুনছে অভিজ্ঞ এবং দায়িত্বপরায়ণ  অনন্যাদির কথা। এই হাসপাতালেরই মেইল ওয়ার্ডে কর্মরত রিমা সিস্টারের সাত বছর হলো বিয়ে হয়েছে, অথচ কোনো ইস্যু নেই। এই নিয়ে ওদের সংসারে দারুণ অশান্তি ছিল একটা সময়ে। রিমা গত বছর এই সময়ে পাষাণী মন্দিরে গিয়ে মানত করে বটগাছের ডালে একটা ভার বেঁধে এসেছিল।

দেবী ওর মনের আশা পূরণ করেছেন। এক বছরের মধ্যেই ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে রিমার। বাড়িতে আনন্দের জোয়ার বইছে। আজ গেছে দেবীর কাছে পুজো দিয়ে ভার খুলতে।

অতলান্ত মোটামুটি হাড়গুলি জুড়ে ফেলেছেন। যেসব জায়গায় হাড় ভেঙে-গুঁড়িয়ে গেছে সেগুলির কিছু রাখলেন, অবশিষ্ট গুঁড়োগুলি সরিয়ে ফেললেন। প্রায় চার ঘণ্টা হতে চলল। পায়েল সিস্টার ঘনঘন ঘড়ি দেখছেন। আজ ওনারও দেবী পাষাণী মন্দিরে যাওয়ার কথা আছে।

অতলান্ত নিখুঁত হাতে হাঁটুর অস্ত্রোপচার করতে করতে ভাবছেন, এইসব ছেলে তো বোঝে না, উন্মাদের মতো বাইক চালায়। তখন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এখন পেশেন্টের তো ভোগান্তি আছেই তার চাইতে টেনশন বেশি সার্জনের। অপারেশনের পরে ঠিকমতো হাঁটতে পারছে কি না সেটা যতক্ষণ না দেখতে পাচ্ছেন ততক্ষণ সার্জনের মনে শান্তি নেই।

অপারেশনের ভেতরেই একসময়ে অতলান্ত অনন্যা সিস্টারকে বললেন, ‘কীসের মন্দির বললেন?’

‘পাষাণী মাতার মন্দির। খুব জাগ্রত স্যার।’

মহুল গ্রামে পোস্টিং হওয়ার পরে অতলান্ত অনেক ধরনের মানুষের সঙ্গে যেমন পরিচিত হয়েছেন, তেমনি অনেক সংস্কার, রীতিনীতি, লৌকিক ধর্ম ও লোকাচারের পরিচয় পেয়েছেন। প্রচুর আদিবাসী রোগী আসে এখানে। তাদের ভিন্ন ধারার সংস্কৃতি। কত গল্প-কাহিনি গড়ে উঠেছে তাদের জীবনযাপন ঘিরে। সময়ে সময়ে কানে আসে অতলান্তর। এই যেমন দেবী রংকিনী মাতার মন্দির নিয়েও কত
কাহিনি-লোককথা গড়ে উঠেছে। সাহিত্যে স্থান পেয়েছেন এই রংকিনী মাতা। ছোটবেলায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের রংকিণী দেবীর খড়গ পড়ে গাঁয়ের রোমকূপ খাড়া হয়ে গিয়েছিল। 

এখানে এসে পাষাণী দেবীর মন্দিরের নাম শুনলেন।

জীবনে এত জায়গায় ঘুরেছেন, কোথাও পাষাণী দেবীর মন্দির আছে শোনেননি। হয়তো কোনো লৌকিক দেব-দেবী। সেই অঞ্চলের লোকবিশ্বাস সংস্কার নিয়ে গড়ে ওঠে।

অনন্যা সিস্টার বললেন, ‘স্যার, একদিন সময় করে ঘুরে আসুন। গেলেই বুঝতে পারবেন।’

শুধু দেবী-দর্শনই নয়, জায়গাটা এমনিতে খুবই সুন্দর।

অতলান্ত তখন বাইরের লেয়ারে স্টিচ দিচ্ছিলেন নিপুণ হাতে।

 ওটি কমপ্লিট করে বেরিয়ে এলেন অতলান্ত।

পায়েল সিস্টার অনেক আগেই চলে গেছে। বলে গেছে অবশ্য। মোটামুটি কাজটা নামিয়েই গেছে। অনন্যা সিস্টারই বললেন, তুই এবারে যেতে পারিস। আমি আর দিব্যা ঠিক সামলে নেবো।

মহুল গ্রাম থেকে ঘাটশিলার দিকে যেতে পড়ে সেই মন্দির। ঘন জঙ্গলের ভেতরে। পাহাড়ের বেশ কিছুটা ওপরে। বছরে এক বিশেষ সময়ে এক সপ্তাহ ধরে উৎসব চলে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসে। মেলা বসে পাহাড়তলিতে। বিশাল বটবৃক্ষের তলায় মন্দির। কত লোক মানত করে সেই বটগাছের ডালে ইটের টুকরো, লাল কাপড়, শাঁখা, পলা ইত্যাদি বেঁধে যান, আবার তাদের মনোস্কামনা পূর্ণ হলে খুলে দেন। মন্দিরে পুজো দেন।

এদেশে ঠাকুর দেবতা নিয়ে কত রকম যে ব্যবসা চলে। লোকে অন্ধ বিশ্বাসে সেসব মেনেও নেয়।
যুক্তি-বুদ্ধি ধারে-কাছে আসে না।

বেসিনের জলের ধারার সঙ্গে অনন্যা সিস্টারের কথাগুলি ঘুরেফিরে মাথার ভেতরে শাণিত বিদ্যুতের মতো ঝিলিক দিচ্ছে।

তিন

অতলান্ত ঠিক করলেন এই উইকএন্ডে পাষাণী দেবীর মন্দিরে যাবেন। নিজের চোখে একটিবার দেখবেন, কী আছে সেখানে। এতো মানুষের ঢল নামে।

সিস্টারের মুখে শুনেছেন শনিবারে মন্দির খোলা থাকে।

মন্দিরের অবস্থান যেখানে সে-জায়গায় ট্রেনে যাওয়া যায় আবার গাড়িতেও যাওয়া যায়। এখন শোনা দরকার পথের অবস্থা কেমন। যারা গেছে তেমন একজনের কাছে শুনলেন, মেইন রাস্তা বেশ ভালো। কিন্তু মূল সড়ক ছেড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে-পথ চলে গেছে সে-পথের অবস্থা খুবই খারাপ।

হাসপাতালের একজন স্টাফ সুবল জানাল, টোটো, অটো আর ছোট গাড়ি বলতে মারুতি ওমনি চলে।

অতলান্ত দেখলেন, তার দামি গাড়ি নিয়ে গেলে দফারফা হয়ে যাবে। কোথায় জনহীন অঞ্চলে ফেলে রেখে যেতে হবে, কতটা সময় লাগবে সেই জঙ্গলাকীর্ণ পরিবেশে পাহাড়ের ওপরে উঠে দেবী-দর্শন করে আবার ফিরে আসতে। তার ওপর দুই-তিন কিলোমিটার পথ নাকি ট্রেকিং করতে হবে। পাহাড়ের বেশ কিছুটা ওপরে সেই মন্দির।

সুতরাং গাড়ি নিয়ে যাওয়াটা রিস্ক হয়ে যাবে।

অগত্যা তিনি ঠিক করলেন ট্রেনেই যাবেন। বাকি পথ ওখানে গিয়েই ডিসিশন নেবেন।

সেই মতো সুবলকেই সঙ্গী করলেন। ওখানকার পথঘাট, মানুষজন সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।

একটা অপরিচিত স্টেশনে নেমে অটো বুক করলেন অতলান্ত। অটোচালক সুবলের বেশ পরিচিত।

অটোচালক আটশো টাকা লাগবে জানালো। অনেকটা পথ। পথের অবস্থাও ভালো নয়।

অতলান্ত বললেন, ঠিক আছে তুমি মন্দির ঘুরিয়ে আমাদের আবার সন্ধের ট্রেন ধরিয়ে দিও।

চালক ঘাড় কাত করল।

শহর ছাড়িয়ে জামশেদপুর হাইওয়ে ধরে বেশ কয়েক কিলোমিটার পথ চলার পরে রাস্তাটা ডান দিকে টার্ন নিল।

এ-পথ এঁকেবেঁকে চলে গেছে বুরুডি পাহাড়ের দিকে। দুই পাশে ফসলের ক্ষেত, আদিবাসী পল্লী, তাদের নিকানো ঘরবাড়ি উঠোনজুড়ে ফুল-লতা-পাতার আলপনা, দেয়ালে সুন্দর হাতে আঁকা ফুল-লতা-পাতার ছবি। দূরের ঢেউ খেলানো পাহাড় ছবির মতো। বেশ শান্ত নিস্তরঙ্গ জনপদ। ভালো লাগছে অতলান্তর। যেতে যেতে সুবলের মুখ থেকে এসব অঞ্চলের গল্প শুনতে লাগলেন।

ওনাদের পেছনে আরো দুটি অটো এবং টোটো আসছে। একটা ছোট চার চাকার যান পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল লাল ধুলো ওড়াতে ওড়াতে। গ্রাম ছাড়াতেই দুপাশে জঙ্গল শুরু হলো। তার ভেতর দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা পথ। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু।

কত নতুন নতুন গ্রাম, কত নতুন নাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা লাগল পাহাড়ের কাছাকাছি আসতে। দূর থেকে সুবল দেখাল আর এক কিলোমিটার গেলেই পাহাড়ের ওপরে পৌঁছে যাবে।

অটো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। জানিয়ে দিলো আর যাবে না। বাকিটা ট্রেকিং করতে হবে।

সামনে সরু পথ। এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে রাস্তা। এই রাস্তাই মন্দিরের দিকে চলে গেছে। পথ ক্রমশ চড়াইয়ের দিকে উঠছে। শাল, সেগুন, কাজুবাদাম, পলাশ আর মহুয়া গাছের জঙ্গল। কোথাও জঙ্গল বেশ ফাঁকা। আবার কোনো কোনো জায়গায় জঙ্গল এতটা ঘন যে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারছে না। গাছে গাছে পাখিদের ওড়াউড়ি, আলাপচারিতা, জায়গা নিয়ে দখলদারি বেশ মাতিয়ে রেখেছে। কিছু সুদৃশ্য প্রজাপতি উড়ছে। বনের ভেতরে কত নাম-না-জানা ফুল ফুটেছে। বুনো ফুলের গন্ধে বাতাস মাতোয়ারা হচ্ছে। শুকনো পাতার মস মস ধবনি বেদনা বয়ে নিয়ে আসছে।

গাছদের শুকনো ডালে ডালে ঘষা লেগে ফিসফিসানি আওয়াজ কানে এলো। বেশ নির্জন বনপথ। শুকনো পাতার ওপর দিয়ে চলার সময়ে মস মস শব্দ বেশ কানে বাজছে। সুবলকে বললেন, কোনো হিংস্র
জন্তু-জানোয়ার নেই তো?

সুবল বলল, তেমন তো কখনো শোনা যায়নি। ওই শিয়াল আর বাঁদর ছাড়া কিছুই তো চোখে পড়েনি কখনো।

যা জঙ্গল দেখছি, সাপ আছে নিশ্চয়ই।

সে তো থাকার কথা।

কিছু বেজি নজরে পড়ল। সুতরাং সাপ থাকলেও তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করে এই নেউলদের জন্যে। কথা বলতে বলতে অনেক ওপরে উঠে এসেছেন।

দূরে পাহাড়ের কোলে বেশ বড় একটা জলাশয় দেখা যাচ্ছে।

সুবল বলল, ওটা একটা প্রাকৃতিক লেক। ফেরার পথে যদি সময় থাকে একবার না হয় লেকের কাছে যাওয়া যাবে।

আরো কিছুটা ওপরে ওঠার পর জল পড়ার শব্দ কানে এলো।

সুবল বলল, এখান থেকে সামান্য কিছুটা ওপরে একটা ঝরনা আছে। এখন শীতের সময়। তাই এর জলধারা খুবই ক্ষীণ। বর্ষায় আসল রূপ দেখা যায়।

জঙ্গলের শুঁড়িপথ ধরে সর্পিল গতিতে নিচের দিকে নেমে আসছে ক্ষীণ জলধারা।

এবারের পথ আরো সংকীর্ণ। গাছের ডালপালা সরিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। ছোট-বড় বোল্ডার পেরিয়ে, কখনো  ডিঙিয়ে-লাফিয়ে পার হতে হচ্ছে। বেশ দুর্গম পথ। সুবলকে বললেন, এত লোক যাতায়াত করে বলছো এই মন্দিরে, কিন্তু পথের এই অবস্থা কেন?

সুবল বলল, স্যার, অন্য একটা পথ আছে সেটা ঘুরে ঘুরে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে। সেই পাক দণ্ডী ধরে গেলে অনেক সময় লাগত। এটা শর্টকাট রাস্তা। ওপথে অবশ্য ছোট গাড়ি চলাচল করে। আমাদের হাতেও তো সময় কম। সন্ধের আগে আগে পৌঁছুতে না পারলে মন্দিরে প্রবেশ করা যাবে না। আমাদের আসাটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

মূলত শাল, শিমুল, পলাশ আর মহুয়া বনের ভেতর দিয়ে চলে গেছে সরু পথ। বনতুলসী, আকন্দ, নিম, পিটুলী আর ভ্যারেন্ডা গাছের জঙ্গল। কত বুনো ফুল-লতা-গুল্ম জড়াজড়ি করে আছে। ঝরনার জলে সিক্ত ভিজে স্যাঁতসেঁতে জায়গায় মস আর টাইগার ফার্ণ নজরে পড়ল। কয়েকটা পাখি পাথরের খাঁজে জমে থাকা জল পান করছে। কেউ শরীর ডুবিয়ে স্নান করছে।

তাদের স্নানপর্ব দেখতে দেখতে আরো ওপরের দিকে উঠে গেলেন।

হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। সুবলকে বললেন, হাঁফ ধরে গেল দেখছি। একটু জিরিয়ে না নিলে আর বোধহয় ওঠা সম্ভব নয়। আর কতটা দূর?

– খুব বেশি নয়, প্রায় চলে এসেছি।

বেশ ঘেমে গেছেন অতলান্ত। হার্টবিট বেড়ে গেছে।

জোরে জোরে ঘাই দিচ্ছে। গায়ের জামাটা ভিজে শরীরের সঙ্গে এঁটে বসেছে।

সুবল তরতাজা যুবক। এসব পাহাড় ডিঙানো ওর অভ্যাসে আছে। তাই সে অতটা ক্লান্ত বোধ করছে না।

অনেকটা ওপরে উঠে আসায় এখন একটু হালকা শীতের অনুভূতি হচ্ছে। বেশ মনোরম বাতাস বইছে। ঘর্মাক্ত শরীরে আলতো শীতের পরশ। সুখানুভূতি হলো অতলান্তর। জোরে জোরে শ্বাস নিলেন এবং ছাড়লেন।

সুবল বলল, ঝরনার জন্যে এমন ঠান্ডা বাতাস।

বেলা আর সামান্যই অবশিষ্ট আছে। দূরে পাহাড়ের পাদদেশ ছায়াচ্ছন্ন হয়ে এলেও ওপরের দিকে আলোর প্রাচুর্য নজরে পড়ল।

সামনেই বড় মহুয়া গাছের ছায়াতলে একটা সমতল পাথরের ওপর দুজনে বসলেন।

চার

ব্যারিস্টার অয়োস্কান্ত সেন কোর্ট থেকে ফিরে সোজা ছেলের ঘরে ঢুকলেন।

ঘরে দেখতে না পেয়ে হাউজকিপার ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করলে সোমনাথ বলল, ছোট স্যার ছাদে আছেন।

অয়োস্কান্ত ধীরপায়ে ছাদে এলেন। দেখলেন ছেলে আলসেতে ভর দিয়ে দূরে তাকিয়ে আছে। হাতের সিগারেট পুড়ে ছাই ঝুলে পড়েছে। তাঁর অভিজ্ঞ চোখ বুঝল, অতলান্ত চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে।

– কী ভাবছ?

চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে বাবাকে দেখেই হাতের সিগারেট ফেলে দিয়ে অতলান্ত বললেন, না না, কিছু না। বলো? এখনি ফিরলে?

– জাস্ট, এখনো ড্রেস ছাড়িনি। ভাবলাম দেখি তুমি কী করছো।

একটু কাছে এসে বললেন, তোমার পেশেন্টের কন্ডিশন কী?

– একটু ইমপ্রুভ করছে বলে মনে হচ্ছে। আমি নতুন কিছু মেডিসিন শুরু করে দিলাম। বেটার হতো অপারেশন করলে। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা তো সম্ভব হচ্ছে না।

– কেন সম্ভব নয়?

– তুমি তো জানো গোটা ব্যাপারটা। দেখি আর কয়েকটা দিন।

– দরকার হলে অপারেশন করতে হবে। বাকিটা আমার ওপর ছেড়ে দাও।

ব্যারিটোন গলায় বললেন অয়োস্কান্ত।

– দেখছি, তেমন হলে তোমায় অবশ্য বলবো।

– ও কে। আমি আসি তাহলে।

অয়োস্কান্ত নিচে নেমে গেলেন।

কিছু সময়ের জন্যে অতলান্ত অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন।

সেদিন দেবী পাষাণীর মন্দিরে যাওয়ার পথে সুবলকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা কী ব্যাপার বলো তো? এই যে লোকমুখে শুনছি একেবারে জীবন্ত বিগ্রহ। সোনার পাথরবাটির মতো গাঁজাখুরি ব্যাপার না তো?

সুবল বলল, স্যার আমি যা জানি তাই আপনাকে বলেছি। একসময়ে ওখানে একজন সাধু বাস করতেন। বহু বছর ধরে তিনি ওই বটগাছের তলায় কুঁড়ে বেঁধে থাকতেন। খুব জ্ঞানী মানুষ ছিলেন শুনেছি। তাঁর  অনেক শিষ্য ছিল। তারা নিয়মিত সাধুবাবার কাছে আসতো, শাস্ত্র অধ্যয়ন করতো।

সেই সাধুবাবা একদিন হাঁটুর বয়সী একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এলো। বাপ ঠাকুরদার মুখে শুনেছি অসাধারণ রূপসী ছিল।

– সাধু এই জঙ্গলেই থাকতেন সেই সুন্দরী বউ নিয়ে?

– হ্যাঁ, সাধুবাবা তো এখানেই থাকতেন। তপস্যা করতেন। বনে বনে ঘুরে বেড়াতেন। নানান গাছ-গাছড়ার সন্ধান করতেন। প্রায় সবই ঔষধি গাছ। অনেক কিছু জানতেন, জানেন স্যার। অব্যর্থ ছিল তাঁর ওষুধ। এই জঙ্গলমহলে তখন তো কোনো ডাক্তার ছিল না। সাধুবাবাই ছিলেন এখানকার বৈদ্য। জঙ্গলমহলের আদিবাসী মানুষদের তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন।

– তিনি চিকিৎসাও করতেন? 

– হ্যাঁ।

– তারপর?

সুবল বলল, আমার বাবা-জ্যাঠাদের মুখ থেকে শুনেছি তার মতো রূপবতী নাকি সচরাচর দেখা যায় না। স্বর্গের দেবীর মতো দেখতে ছিলেন। ওই জঙ্গলে অমন সুন্দরী যুবতীর কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ল। পাহাড়ি আদিবাসীরা এই ঝরনার জল নিতে আসতো প্রতিদিন। এখনো আসে। এই ঝরনার জলই ছিল পানীয় জলের একমাত্র উৎস। দ্বিতীয় কোনো পানীয় জলের উৎস ছিল না সেই সময়ে এসব অঞ্চলে।

সাধুপত্নীও আসতেন, মাটির কলসি কাঁখে নিয়ে জল নিতে। তখন গাঁয়ের মেয়ে-বউদের সঙ্গে কথা বলতেন। গাঁয়ের মানুষ তাঁকে দেবী জ্ঞান করতেন। সাধুবাবার শিষ্যরাও নিয়মিত যাতায়াত করত। 

সেই শিষ্যেদের ভেতরে একজনের সঙ্গে নাকি সাধুপত্নীর মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সম্পর্কটা আস্তে আস্তে অন্যদিকে গড়াল।

একদিন সাধুবাবা কোথায় জানি গিয়েছিলেন। সেই সময়ে সেই শিষ্য কুটিরে আসে।

সাধুবাবা ঠিক সেই মুহূর্তে কুটিরে ফিরে আসেন। কুটিরের ভেতরে প্রবেশ করলে দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত দেখে ফেলেন।

– তারপরে?

অতলান্ত কৌতূহলী।

– নিজ পত্নীর সঙ্গে শিষ্যের এই দৃশ্য দেখে তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়লেন। সেই শিষ্য তখন কোনোমতে কুটির থেকে বেরিয়ে পালানোর চেষ্টা করলে সাধুবাবা তার পিছু ধাওয়া করলেন। শিষ্য ছুটছে সাধুবাবাও ছুটছেন। বন-জঙ্গল ডিঙিয়ে দুজনেই ছুটছেন। দুজনেই মরিয়া তখন। একজন প্রাণ বাঁচানোর জন্য, আর একজন ছুটছেন প্রতিশোধ নিতে।

সাধুবাবা যখন দেখলেন দৌড়ে তাকে ধরা প্রায় অসম্ভব। তখন তিনি সেই শিষ্যকে লক্ষ্য করে ত্রিশূল ছুড়ে মারলেন। অব্যর্থ নিশানা ছিল তাঁর। তীব্র বেগে নিক্ষিপ্ত সেই ত্রিশূলে শিষ্যের শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেল। পিঠ ফুঁড়ে বুকে গেঁথে গেল।

পরদিন সকালে গ্রামের মানুষ দেখল ছেলেটি মৃত অবস্থায় পড়ে আছে পাথরের ওপরে। চাপ চাপ রক্ত জমাট হয়ে আছে পাথুরে মাটিতে। তার সর্বাঙ্গে ক্ষতচিহ্ন। ত্রিশূলের আঘাতে আঘাতে তার সমস্ত শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় দিয়েছে।

সুবল কথাগুলি বলে দীর্ঘ একটা শ^াস ছাড়ল।

অতলান্ত শিউরে উঠলেন।

ছায়াতল থেকে উঠে আবার তাঁরা যাত্রা শুরু করলেন।

শীতের বেলা ক্রমশ পড়ে আসছে। গাছেদের ছায়া দীর্ঘতর হয়েছে। পশ্চিমের সূর্য অনেকটাই হেলে পড়েছে। পাহাড়ের শীর্ষদেশ আলোকময় হলেও বাকি অংশে সবুজ-কালো ছায়াবৃত। নিস্তব্ধ চারদিক।

অতলান্তর মনের ভেতরে চিন্তার ঝড় তোলপাড় করে দিচ্ছে।

কিছুটা উঠতেই অনেকটা প্রশস্ত জায়গা নজরে পড়ল।

পাহাড়ের ওপরে বেশ খানিকটা সমতল জায়গা। তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা, একদিক অরণ্যবেষ্টিত। বিশাল প্রাচীন বটবৃক্ষ যেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো মন্দিরটিকে বেষ্টন করে আছে। ডাইনির চুলের মতো দীর্ঘ প্রলম্বিত তার ঝুরি নেমেছে। বহু প্রাচীন এই বটগাছের

মা-গাছ যে কোনটি এখন আর বোঝার উপায় নেই। বিশাল বিস্তার নিয়েছে। গুঁড়ি থেকে অনেক বটগাছের জন্ম হয়েছে। তারাই ঘিরে রেখেছে মন্দিরটাকে। বাইরে থেকে চট করে বোঝার উপায় নেই।

সুবল অতলান্তকে নিয়ে সেই ছায়াঘেরা জঙ্গলের ভেতরে জীর্ণ মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

ভগ্নদশা। বহুকাল আগের ছোট ছোট লাল ইটের তৈরি মন্দিরের দেয়াল থেকে কিছু কিছু ইট খসে পড়েছে।

জানালা-দরজার কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। মন্দিরের দেয়াল ভেদ করে গাছের শিকড় ছড়িয়েছে। ছাদেও অনেক গুল্মজাতীয় গাছপালা দেখে মনে হচ্ছে, পুরোটাই গাছেদের দখলে চলে গেছে। পাখির ভাঙা বাসা, শুকনো কাঠ, ডালপালা, পাতা জঙ্গল-জঞ্জালে পূর্ণ। তবে মন্দিরের সামনের চাতাল পরিষ্কারই আছে। মনে হয় নিত্য ঝাঁট পড়ে সেখানে।

সুবল আগে আগে চলেছে। পেছনে অতলান্ত। ওদের পায়ের শব্দে ঘর থেকে একজন আদিবাসী মেয়ে বেরিয়ে এলো।

লাল পাড় সাদা শাড়ি পরা মেয়েটি। বয়স তেইশ-চব্বিশ বছর হবে – অনুমান করলেন অতলান্ত।

– কিছু বলবেন?

সুবল বলল, আমরা দেবী-দর্শনে এসেছি।

– একটু অপেক্ষা করতে হবে। 

– ঠিক আছে আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি।

পাঁচ

ডিনার টেবিলে বাবার মুখোমুখি বসে খাচ্ছেন অতলান্ত। খাচ্ছেন বলা ভুল, একটা রুটির টুকরোর সঙ্গে কিছুটা পনির বাটার মশলা নিয়ে চুপ করে কী যেন ভাবছেন।

অয়োস্কান্ত সেন বললেন, তোমার পেশেন্টের এত তাড়াতাড়ি  এতটা ইমপ্রুভমেন্ট আমি সত্যি আশা করতে পারিনি।

বাবার কথায় সম্বিৎ ফেরে অতলান্তর। তিনি রুটির টুকরো মুখে পুরে বললেন, খুবই রেয়ার কেস। এমএস করার সময়ে গুপ্ত স্যার বলতেন এক কোটির ভেতরে একজন বলতে পারো। সারা পৃথবীতে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র এমন পেশেন্ট পেয়েছি আমরা।

– অপারেশান করলে প্রগ্নোসিস বেটার হতো বলছো?

– আমি সেটাই ভাবছি।

– কিন্তু …

– কোনো কিন্তু নয়। আমি তোমার পাশে আছি।

কথা বলতে বলতে সুবলের ফোন এলো।

‘সরি, আসছি’ বলে অতলান্ত উঠে গেলেন।

– হ্যাঁ, সুবল বলো।

– স্যার এদিকের খবর শুনেছেন কিছু?

– কই না তো? কী খবর?

– এদিকের তদন্তের ভার সিআইডির হাতে দেওয়া হয়েছে।

– তাই নাকি?

– হ্যাঁ স্যার, গোয়েন্দা পুলিশ ঘুরতে ঘুরতে আমাদের হাসপাতালেও এসেছিল।

– আমাদের হাসপাতালে এসেছিল কেন?

– পুলিশ খবর নিয়ে জেনেছে যে, মেলা চলাকালে এখানকার কিছু স্টাফ মন্দিরে গিয়েছিল।

– তো? সে তো মেলা উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল  মন্দির প্রাঙ্গণে।

– আসলে দেবীর কাছে যে দুজন পরিচারিকা বা সিকিউরিটি থাকে, তাদের সেদিন অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশের ধারণা তাদের অজ্ঞান করেই দেবী মূর্তি পাচার করা হয়েছে।

– শুধুই কি অনুমান?

ও-প্রান্তে সুবল কী বলল শোনা গেল না।

অতলান্ত দাঁড়িয়ে রইলেন মোবাইল হাতে নিয়ে। পাথরের মূর্তির মতো।

তিনি আবার ফিরে গেছেন সেদিনের সেই দেবী পাষাণীর মন্দিরে। ঘটনা সত্যি রহস্যময়।

– এবারে আসুন, আপনারা।

দেবীর সহচরীর ডাকে অতলান্ত আর সুবল এগিয়ে গেলেন দেবী-দর্শনে।

মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করতেই চমকে উঠলেন অতলান্ত। দেখলেন সামনে উঁচু বেদির ওপর বসে আছেন দেবী। সামনের দিকে দুই পা কিছুটা ছড়ানো। হাত দুটো দুই হাঁটুর ওপরে রাখা। সুন্দর এক প্রস্তরমূর্তি। রাফায়েল কিংবা মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর হাতেগড়া নিখুঁত এক ভাস্কর্য।

পশ্চিমের ভাঙা জানালা দিয়ে বিদায়ী সূর্যের কিছুটা মøান আলো প্রবেশ করেছে তেরছাভাবে। মন্দির-অভ্যন্তরে

আলো-ছায়ামাখা পরিবেশ। সেই আলোর কিছুটা এসে পড়েছে দেবীর মুখে।

অতলান্ত মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন।

ইনিই সেই পাষাণী দেবী!

এনার সম্বন্ধে এত লোককথা-কাহিনি-গল্প গড়ে উঠেছে?

নিজের মনেই বললেন কথাগুলি।

সুবল দেবীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

সেই সময়ে অতলান্ত গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছিলেন। দেবীর মুখের দিকে ছিল তাঁর দৃষ্টি।

তিনি দেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চমকে উঠলেন। এতো জীবন্ত!

এরপরে সুবল সরে এলে অতলান্ত দেবীর পায়ে হাত রাখলেন।

প্রণামের সময়ে সামান্য একটু কাপড় সরে যেতেই লক্ষ করলেন, দেবীর পায়ের আঙুলগুলি বেশ লম্বা, সাধারণ আঙুলের চাইতে অনেকটাই বেশি। সর্বক্ষণ সাদা কাপড়ে ঢাকাই থাকে। সচরাচর চোখে পড়ার কথা নয়।

অতলান্ত দেবীর পদতলে বসে পড়লেন।

দেবীর হাত স্পর্শ করলেন। অতলান্তর দীর্ঘপ্রশিক্ষিত হাত, যে-হাত বহু  রোগীর পরিচর্যা করে আসছে, কত দুর্বোধ্য রোগের কারণ অনুসন্ধান করে প্রকৃত রোগের চিকিৎসা করে তাদের সুস্থ করে তুলেছেন – সেই হাত বলছে, এ কোনো পাথরের মূর্তি নয়।

তিনি দেবীর পদতলে বসে দেবীর মুখের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।

ছয়

সেদিন ফেরার পথে সুবল অতলান্ত স্যারের মুখ থেকে একটি শব্দও শুনতে পেল না। মন্ত্রে বশীভূত হওয়া মানুষের মতো মোহাচ্ছন্ন হয়ে ছিলেন। 

সুবল মনে মনে ভাবল, এসবই দেবীর মহিমা। স্যার তো কিছুতেই বিশ^াস করছিলেন না। এখন দেখছি স্যারকেই বেশি আকর্ষণ করেছে।

সেদিন কোয়ার্টারে ফিরে অতলান্ত অস্থির পায়ে ঘর-ব্যালকনি পায়চারি করতে লাগলেন। বেসিনে গিয়ে মাথায় জল দিচ্ছেন। চুল মুঠো করে ধরে অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন।

এক মুহূর্ত যেন স্থির থাকতে পারছেন না। একটা দুরন্ত ঘূর্ণিপাকের ভেতরে তিনি পড়ে গেছেন মনে হচ্ছে।

মাথার ভেতরটা বনবন করে চরকিবাজির মতো ঘুরছে।

পায়চারি করতে করতে হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা জিনিস ক্লিক করে উঠল।

‘রাইট!’

সজোরে চিৎকার করে উঠে দেয়ালের গায়ে জোরসে ঘুষি মারলেন।

শক্ত মুষ্টির আঘাতে দেয়াল কেঁপে উঠল সহসা।

তিনি দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে মোবাইল স্ট্যান্ড থেকে মোবাইলটা হাতে তুলে নিলেন।

তক্ষুনি সুবলকে ফোন করে আসতে বলেন তাঁর কোয়ার্টারে।

সুবল এলে কী কী করতে হবে সমস্ত নির্দেশ দিলেন।

সুবল চুপ করে আছে দেখে অতলান্ত বললেন, কী, তুমি পারবে না?

– না স্যার, পারবো না তা নয়, ভাবছি, কীভাবে কাজটা করব।

এরপরে অতলান্ত সুবলকে ব্লু প্রিন্ট বানিয়ে দিলেন।

অতলান্তর বুদ্ধিমত্তা দেখে সুবল বিস্মিত। জানিয়ে দিলো, চিন্তা করবেন না স্যার, সব হয়ে যাবে।

– কাকপক্ষীও যেন টের না পায়, বুঝলে? 

– আমার ওপর বিশ^াস রাখুন।

সুবল বেরিয়ে গেল।

অতলান্তর মনে পড়ে গেল তখন এসএসকেএমে অর্থোপেডিকে এমএস করার সময়ে প্রফেসর গুপ্ত ক্লাস নিচ্ছেন। একদিন ওটিতে স্যার পড়াতে গিয়ে একটা অসুখের কথা বলেছিলেন।

বলেছিলেন, খুবই রেয়ার অসুখ। মাসল বোনম্যারো সবই হাড়ে পরিণত হয়। আস্তে আস্তে সে পাথর মানুষে পরিণত হয়। কেউ কেউ এই রোগকে বলে ‘স্টোন ম্যান সিনড্রোম’। মূল ডিজিজটা হলো ‘ফাইব্রোডিস্পেশিয়া অসিফিক্যানস প্রগ্রেশিভা’।

সুবলের মুখে শুনেছিলেন সেদিন সাধু নাকি তাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, যে-শরীরে তোর এত কামনা সেই শরীর তোর পাথর হয়ে যাবে। থাকবে না কোনো অনুভূতি।

এরপরে সাধুকে আর কেউ কখনো সেই অঞ্চলে দেখেনি।

সেদিনের পরে সাধুপত্নী আর কোনোদিন ঘর থেকে বের হননি। লজ্জায়-দুঃখে-শোকে এরপরে আস্তে আস্তে নাকি তাঁর শরীরটা পাথরে পরিণত হয়। অনেকের বিশ^াস, সাধুবাবার অভিশাপে এটা হয়েছে।

কিন্তু গাঁয়ের সকলে তাকে দেবীর আসনে বসিয়ে পুজো করে আসছে।

সেই প্রথম দেবীর ঘরে ঢুকলেন ব্যারিস্টার অয়োস্কান্ত সেন। দেবীর দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বললেন, কেমন আছেন মাতা?

দেবী আস্তে আস্তে চোখ তুলে চাইলেন। তাঁর ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠল।

ঘর থেকে বেরিয়ে অয়োস্কান্ত ছেলের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, আমি জানতাম তুমি পারবে পাথরে ফুল ফোটাতে।