অনুবাদ : মেহবুব আহমেদ
সাগর মেখলা দ্বীপপুঞ্জ জাপানের উঁচু আকাশে একটি মাত্র বেলুন পুবদিকে ভেসে বেড়াচ্ছিল। গাঢ় ধূসর কাগজের বেলুনটা সাধারণ, চমৎকারিত্বহীন। কিন্তু আকারে বিশাল, এপাশ থেকে ওপাশ দশ মিটারের বেশি। আর কেবল এই আয়তনের জন্যই বেলুনটা যখন মেঘমুক্ত গ্রীষ্মাকাশে গোধূলিবেলায় উড়ছিল, তখন তাকে আরো নিঃসঙ্গ মনে হলো; সূর্যাসেত্মর রক্তাভা বা সাগরের ঘন নীল কিছুতেই তার রং বদলাল না।
আগুনে বেলুন নামে পরিচিত এটি এক গোপন অস্ত্র। প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধের সময় জাপানিরা সেকেলে এই অস্ত্রটিকে নতুনভাবে তৈরি করেছিল। এটি সম্পূর্ণভাবে বৈজ্ঞানিক তথ্যনির্ভর এবং কিছু সাফল্যও অর্জন করেছিল।
বাতাসের গতি যার নিয়ন্ত্রক, তার ওপর তেমন নির্ভর করা চলে না। কিন্তু জাপানে আসলেই এক দ্রম্নততম বায়ুস্রোত প্রবাহিত হয় এবং জেট স্ট্রিম নামে পরিচিত এই বায়ুস্রোতের কথা আমরা এখন জেনেছি; তখন জানত কেবল জাপানের আবহাওয়া পরিদফতর। শীতকালে জেট স্ট্রিমে বিশেষভাবে শক্তি সঞ্চারিত হয় আর তখন সেকেন্ডে সত্তর থেকে আশি মিটার পর্যন্ত বেগবান হতে পারে। সেকেন্ডে আশি মিটার, ঘণ্টায় দুশো পঞ্চাশ কিলোমিটারের বেশি। সুতরাং একটি বেলুন বাতাসে ভর করে মাত্র দু-রাত, দু-দিনে আমেরিকা পৌঁছে যায়। আর কোনো ইঞ্জিন, জ্বালানি বা চালকের দরকার হয় না।
এই অস্ত্রকে আমেরিকাও যে প্রতিহত করতে পারবে না, এ তো যুক্তিসংগত চিন্তা এবং সে-অর্থে এই বেলুনকে আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়ার পরবর্তী উদ্ভাবিত বহুগুণে ভয়ংকর আন্তর্জাতিক ব্যালিস্টিক মিসাইলের অগ্রদূত বলা যায়। অবশ্য এ-বেলুনের উদ্ভাবন হয়েছিল চূড়ান্ত হতাশা থেকেই।
১৯৪১-এর ৮ ডিসেম্বরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরবর্তী ছ-মাস জাপান অত্যন্ত ভালো অবস্থানে ছিল; কিন্তু তারপরই মিডওয়ের যুদ্ধে তার প্রচুর ক্ষতি হয়ে যায়। এ-যুদ্ধে চারটি গুরুত্বপূর্ণ এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার ডুবে যায় এবং বেশ কয়েকজন অতি-অভিজ্ঞ বৈমানিক যোদ্ধা মারা যান। এই যুদ্ধের পর থেকেই জাপানের অবস্থা বদলে গেল। কিছু কিছু সাফল্য এরপরও এসেছিল যেমন – শত্রম্ন-অধিকৃত ভূমি দখল করা, শত্রম্নর জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া এবং কোল যুদ্ধে জয়লাভও হয়েছিল। কিন্তু ভাটায় পড়া ঢেউয়ের মতো জাপান কেবলই পিছিয়ে যেতে লাগল এবং শেষে দেশের মাটিতেই যখন আকাশপথে আক্রমণ শুরু হলো, তখন নতজানু হতে বাধ্য হলো।
আমেরিকার মতো শক্তিশালী শত্রম্নর তুলনায় প্রথম থেকেই জাপানের সুযোগ কম ছিল। এই অযৌক্তিক যুদ্ধে বহু রকমের অসমতা সুস্পষ্টভাবে জাপানের বিরুদ্ধে ছিল এবং দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো কঠিন হয়ে পড়ল। সেনাবাহিনীর প্রাণপণ চেষ্টা ছিল আগের অবস্থা ফিরিয়ে আনার এবং তারা ভালো কিছু করে জনগণকে উৎসাহিত করতে চেয়েছিল, আর তখনই বেলুন তৈরির এ-পদক্ষেপ নিয়েছিল।
যুদ্ধের প্রায় শুরুর দিকেই ১৮ এপ্রিল ১৯৪২-এ জাপানের প্রধান এলাকায় আকাশপথে আক্রমণ হলো। ক্ষতি তেমন বেশি হয়নি, কিন্তু জনগণ প্রচ- বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। তখন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর শপথ ছিল, দেশের আকাশে শত্রম্নর বিমান ঢুকতে দেবে না এবং তারা বিস্মিত হলো এ-ঘটনায় যে, হুঁশিয়ারি দেওয়ার মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
সেনাবাহিনীর আশা ছিল, আগুনে-বেলুন আমেরিকার ওপর একই রকম আঘাত হানবে – ক্ষতি তেমন না করতে পারলেও ভয়ানক একটি মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারবে। দূরপশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগরে ঘটমান যুদ্ধ যে তাদের দেশেও পৌঁছে গেছে, এতেই আমেরিকাবাসী নাড়া খাবে।
সেনাবাহিনী আশা করেনি যে, ওয়াশিংটন বা নিউইয়র্কে ঢুকে প্রেসিডেন্টকে সাদা পতাকা ওড়াতে বাধ্য করতে পারবে। তাদের আশা ছিল, বিলাসিতায় অভ্যস্ত আমেরিকাবাসী সুদীর্ঘ যুদ্ধকালীন অবস্থায় ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেবে। তবে এ-পর্যন্ত ওরকম কিছু ঘটার চিহ্ন দেখা গেল না।
কিন্তু আমেরিকার ভেতরে ঢুকে প্রধান এলাকায় আক্রমণ করে জনগণকে প্রচ- ভয় দেখানোর একটা উপায় তো পেতেই হতো। ওরা রাতের অন্ধকারে সাবমেরিন থেকে গোলা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, আকাশপথে আক্রমণ চালিয়েছে তবে ওগুলো ছেলেখেলার চেয়ে খুব বেশি কিছু ছিল না এবং এর ফলে সাগর-তীরবর্তী অঞ্চলগুলোতে আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাহিনী আরো বেশি সতর্ক হয়েছিল।
তখন জাপান আগুনে-বেলুনের ধারণা নিয়ে এগিয়ে এলো। একগুচ্ছ নিঃশব্দ বেলুন থেকে বোমা বিস্ফোরিত হলে নিশ্চয়ই ওরা ভয় পেয়ে যাবে। আর জেট বায়ুস্রোত যেহেতু কেবল পুবদিকেই প্রবাহিত হয়, একই ধরনের কাজ ওদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল সেনাবাহিনী – এ-বাতাস স্বর্গীয়।
এদিকে জাপানে বেলুন তৈরির মতো শক্ত কোনো রাবার ছিল না, আর থাকলেও তা উড়োজাহাজ এবং অন্যান্য যানবাহনে ব্যবহার করা হতো, বাতাসের খেয়ালে চলা একরাশ বেলুনের জন্য নয়। অতএব ঠিক হলো কনিয়াকু আঠা দিয়ে কাগজ জোড়া লাগিয়ে বেলুন তৈরি হবে।
যুদ্ধের শেষের দিকে আক্রমণের আশঙ্কা তো ছিলই জাপানের এবং অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন হয়েছিল যে, আত্মরক্ষার জন্য যে-কোনো অস্ত্র যেমন সেকেলে বাঁশের বর্শা, তীর-ধনুক, লোহার রড, বেস্না গানস, ম্যাকলকস সবই জোগাড় করেছিল। নতুন অস্ত্রগুলোর নাম শুনে মনে হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের ব্যবহার উপযোগী। আর প্রধানত স্কুলের ছেলেমেয়েদেরই বেলুন তৈরির দায়িত্বটা দেওয়া হলো।
তবে বেলুনের জন্য সাধারণ কাগজ ব্যবহার হয়নি, ওরা মালবেরি গাছের বাকল দিয়ে তৈরি শক্ত, ভালো কাগজ ব্যবহার করেছিল। এ-কাগজ তৈরি হতো শীতকালে আর কাজের দায়িত্ব পড়েছিল স্কুলের মেয়েদের ওপর – তাদের চামড়া শুকিয়ে ফেটে গেল আর বসে কাজ করতে করতে হাত-পা ফুলে লাল হয়ে উঠল। ওরা সারারাত কাজ করে ৬০ সেন্টিমিটার x ১৮০ সেন্টিমিটার আকারের কাগজ তৈরি করছিল।
ডেভিলস টাঙ্গ নামে একটি শস্যজাতীয় গাছ থেকে কনিয়াকু আঠা তৈরি হতো। সাধারণত এটা ঝোল এবং অন্যান্য রান্নায় খাবার হিসেবে ব্যবহার হতো। আঁশযুক্ত সবজিটা হজমের জন্যও ভালো, কিন্তু এর পুষ্টিগুণ মোটামুটি শূন্য। এতে পেট ভরানো যেত কিন্তু যুদ্ধের সময় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার যেমন মিষ্টি আলু, বাজরার ফলন দরকার ছিল। তাই ফসলটির প্রচুর পরিমাণে ফলন বৃদ্ধির আদেশে কৃষকরা বিস্মিত হলো।
আর যেহেতু সমস্ত ফসলটাই সামরিক দফতর কিনে নিচ্ছিল, সাধারণ মানুষের হাতে এটা পৌঁছেনি। ১৯৪৩-৪৪ সালে জাপানের সব রান্নাঘর থেকে কনিয়াকু সম্পূর্ণ উধাও হয়ে গেল। অবশ্য তাতে কারো মনে ক্ষোভ ছিল না, কারণ এটা খাওয়া না-খাওয়ায় বিশেষ আলাদা কিছু হয়নি। একে আঠা হিসেবে ব্যবহার করার জন্য বড় বড় পাত্রে সিদ্ধ করে পিচ্ছিল একটা পদার্থে পরিণত করা হতো।
বেলুনের জন্য প্রথমে ওরা লম্বা, পাতলা, দু-মাথা সরু ডিমের আকারের কাগজের ফালি তৈরি করেছিল, তারপর ফালিগুলো আঠা দিয়ে আটকে দিত। কিন্তু এ-বেলুন তো সাধারণ ছিল না, এর ভেতর বোমা বসিয়ে দেওয়া হতো এবং আমেরিকায় পৌঁছে বোমা বেরিয়ে যাওয়ার যন্ত্রও বসানো থাকত। এই পরিমাণ ভার বহন করার জন্য যথেষ্ট দৃঢ় এক ভাসমান শক্তির প্রয়োজন ছিল, অর্থাৎ বেলুনগুলোকে আয়তনে অতিকায় করে হাইড্রোজেন ভরে দিতে হতো।
কনিয়াকু আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো কাগজ কেটে এ-ধরনের বিশাল বেলুন তৈরি করা সহজ ব্যাপার ছিল না। যে-কোনো ছিদ্র, এমনকি তা সুচের ছিদ্রের আকারে হলেও জিনিসটা সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যেত – কেবল যে আমেরিকায় পৌঁছাতে পারত না তা নয়, হাইড্রোজেন বেরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটতেও পারত।
সেনাবাহিনী বাছাই করা ছাত্রদের নিয়ে বেলুন তৈরির কাজে নিয়োগ করল, কিন্তু ওরা যে গুরুত্বপূর্ণ একটি অস্ত্র তৈরি করছে সে-ধারণা ওদের ছিল না বলে মেজাজ খারাপ করতে লাগল।
‘কী যে সময় নষ্ট হচ্ছে, যত শিগগির সম্ভব পাইলট হতে চাই আমি – ইয়াংকিগুলোর ওপর বোমা ফেলব।’
‘আমি নৌবাহিনীতে যেতে চাই, জাপানের মতো বড় যুদ্ধজাহাজ পৃথিবীর কোথাও নেই, একেবারে শেষ করব আমেরিকানদের।’
প্রত্যেকের ইচ্ছা তাদের কোনো কারখানায় পাঠিয়ে দেওয়া হোক, সেখানে যুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত কাজ করবে।
ইতোমধ্যে জাপানের সর্বত্র কলকারখানা ও খামারগুলোতে প্রধান কর্মীবাহিনী হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে স্কুলের ছেলেমেয়ে ও সামান্য উঁচু ক্লাসের ছাত্ররা, কারণ অন্যসব তরুণকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উড়োজাহাজ তৈরির কাজ করছিল যেসব ছাত্র, তারা খুবই গর্ববোধ করত। ওয়েল্ডার এবং লেদ অপারেটররাও প্রচুর উৎসাহ নিয়ে কাজ করছিল, তবে কাজগুলো কঠিন ছিল। তারা যে একেবারে অভিযোগ করেনি তা নয়। কিন্তু স্কুলের যে-ছেলেমেয়েরা কনিয়াকু আঠা দিয়ে কাগজের টুকরো জোড়া দিচ্ছিল এবং কোনো প্রশ্ন করতে পারছিল না, তারা অপমানিত বোধ করছিল।
ইতোমধ্যে ১৯৪৩-এর শুরু থেকেই বড় থিয়েটার হলগুলোতে নাটক প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল আর এসব হলেই বেলুনের গোপন কাজগুলো হচ্ছিল। বেলুনগুলো পূর্ণমাত্রায় ফোলানোর জন্য সামরিক বাহিনীর এ-ধরনের বড় জায়গার দরকার ছিল; কিন্তু সাধারণ কলকারখানা অত বড় নয় আর খোলা জায়গায় তো গোপন অস্ত্রের কাজ করা যায় না।
এ-কাজেও ছাত্রদের নিযুক্ত করা হলো। দর্শকদের সমস্ত আসন সরিয়ে ফেলে কিছুটা জেলি ফিশের মতো গাঢ় ধূসর রঙের ঢিলেঢালা বস্ত্তটাকে থিয়েটার হলের মাঝখানে বসিয়ে হাইড্রোজেন ঢুকিয়ে দেওয়া হতো এবং সবার বিস্মিত চোখের সামনে বেলুনটা দ্রম্নত ফুলে তিনতলার মেঝে পর্যন্ত পৌঁছে যেত, তারপর পরীক্ষা করা হতো কোনো ছিদ্র দিয়ে হাইড্রোজেন বেরিয়ে যাচ্ছে কিনা এবং নিশ্ছিদ্র প্রমাণিত হলেই ওকে শক্তভাবে প্যাক করে ওড়াবার জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হতো।
১৯৪৪-এর বসন্তে প্রথম আগুনে বেলুন ছাড়া হলো। ততদিনে জাপান অনস্বীকার্যভাবে শোচনীয় অবস্থানে পৌঁছে গিয়েছিল, রসদ ফুরিয়ে আসছিল এবং দু-বছর আগেও যুদ্ধক্ষেত্রে ও সাধারণ জনগণের মধ্যে যে-সাহসিকতার প্রকাশ ছিল তা ঝুলে যেতে লাগল। সেনাবাহিনী কাজে নয়, কথাসর্বস্ব হয়ে রইল। কাঁচামালের অভাবে কলকারখানা বন্ধ, ছাত্ররা বেকার কিন্তু তারা বড় বড় কথা বলেই চলল – যে-কোনো অবস্থাকে সদর্থে সাজাতে চাইছিল, যেমন যুদ্ধে পিছিয়ে এলে বলত নীতি পরিবর্তন করেছে, ভয়াবহ পরাজয়কে বলত সাহসী আত্মত্যাগ; কিন্তু যে-কোনোভাবেই হোক করুণ অবস্থাই জনগণকে সব বুঝিয়ে দিত।
সকলকে উৎসাহিত করার প্রচেষ্টায় প্রশান্ত মহাসাগরের কাছের একটা নির্দিষ্ট স্থান থেকে ভোরের আকাশে বেলুনগুলো ছেড়ে দেওয়া হলো। আকাশের অবস্থা লক্ষ করতে করতে ক্ষক্ষতে যাওয়ার সময় কৃষকের চোখে পড়ল, জেলেরা দেখল বাতাসের গতি লক্ষ করতে গিয়ে, মেয়েদের চোখে পড়ল স্বামীদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের আশায় মন্দিরে যাওয়ার পথে, আর বয়স্ক মহিলারা তো ভোরেই ওঠে।
‘ওটা কী?’
‘পাখা ছাড়া উড়োজাহাজ বোধহয়, বাঁধন কেটে দেওয়া হয়েছে।’
এ যে একটা নতুন অস্ত্র, সে-কথা কারো মনে হলো না, তাকিয়ে তাকিয়ে বেলুনগুলো চলে যেতে দেখল সবাই। মনে হলো ভয়ংকর অপ্রিয় একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে এবং শক্ত করে মুখ বন্ধ করে রইল। যুদ্ধের সময় তারা কত রকমের অদ্ভুত দৃশ্য দেখত; কিন্তু যে-কোনো অসতর্ক রটনা অনিবার্যভাবে সাধারণ পুলিশ বা সেনা পুলিশের গোচরীভূত হতো এবং তাতে কারো কোনো ভালো হতো না।
এ-সময়ে যে দু-হাজার বেলুন ছাড়া হয়েছিল, তার মাত্র দশ শতাংশ আমেরিকা পৌঁছাল এবং তারও অধিকাংশই পাহাড়ি অঞ্চলে পড়ে গিয়ে আগুন ধরে গেল। পাহাড়ে তখনো বরফ, আগুনে-বেলুন তেমন ক্ষতি করতে পারেনি; কিন্তু আমেরিকা সরকারের মানসিক বিপর্যয়ের কাজটা ভালোই হয়েছিল, কারণ তারা আরো কড়া নজরদারি শুরু করল।
গ্রীষ্মের শুরুতেই জেট বায়ুস্রোত দুর্বল হয়ে পড়ে, তাই বেলুন ছাড়া স্থগিত রেখে আরো বেলুন তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া হলো। সেনাবাহিনী এ-অস্ত্রটা সম্বন্ধে অতিরিক্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করছিল। কিন্তু একের পর এক পরাজয়ে হতোদ্যম জনগণের আত্মবিশ্বাস জাগানোর জন্য নতুন উড়োজাহাজ এবং যুদ্ধজাহাজের খবর একটু একটু করে ছাড়তে শুরু করল। আর আগুনে-বেলুনের কথা জনসমক্ষক্ষ যদিও বলল না, বেলুন তৈরিরত ছেলেমেয়েদের জানাল, ‘এই বেলুন আমাদের এক নতুন অস্ত্র এবং আমাদের গর্বের বস্ত্ত, প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আসবে এমন কোনো উন্নত অস্ত্র আমরা এখনো তৈরি করতে পারিনি, কিন্তু ইতোমধ্যে এই আগুনে-বেলুন দিয়েই আমরা আমেরিকার মাটিতে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আসতে পারব।’
কী যে উৎসাহিত হলো ছেলেমেয়েরা! এ-কাজে তাদের কোনো আগ্রহ ছিল না, ভাবত কী এক মেয়েদের কাজ কিন্তু এবার বুঝতে পারল তারা যে-অস্ত্র তৈরি করছে তা আমেরিকায় গিয়ে বিস্ফোরণ ঘটাবে আর ওই পশুগুলো প্রাণভয়ে ছোটাছুটি করবে – এ-কথা ভেবেই তারা প্রাণপণ করে লেগে গেল একঘেয়ে কাজটায়, গরম কনিয়াকুর ফোঁটায় হাত পুড়ে গেলেও নিরুৎসাহিত হলো না।
তখন সাইপান আত্মসমর্পণ করেছে। যে-কোনো মুহূর্তে আকাশপথে আক্রমণ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। গুরুত্বপূর্ণ কারখানাগুলো গ্রামের দিকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল; সেইসঙ্গে আগুনে-বেলুনের কারখানাও। তখন পাহাড়ি অঞ্চলে খুবই সাধারণ কিছু কাঠের ঘর দ্রম্নত তুলে সমস্ত দেশ থেকে স্কুলের ছেলেমেয়েদের এনে চবিবশ ঘণ্টা তিন শিফটে কাজ হতে লাগল।
‘ওই আঠাটা এখনো হলো না? আমারটা তো শেষ।’
‘দাঁড়াও ভালো জ্বাল না পেলে কি আঠা হয়? এসে হাত লাগাও, নাড়ো।’
‘কাগজটা এখানে একটু পাতলা হয়ে গেছে, আর একটা কাগজ লাগালে শক্ত হতো না?’ পূর্ণশক্তি নিয়োজিত করে কাজ করছিল ছেলেমেয়েরা, দেখে বিস্মিত হচ্ছিল ওদের পরিদর্শক। কিন্তু এ কি স্বাভাবিক নয়! যুদ্ধে যারা আপনজনদের হারিয়েছিল, এভাবেই তো তারা প্রতিশোধ নেবে। আকাশপথের আক্রমণ শুরু হতেই ওদের সংকল্প আরো দৃঢ় হলো, নিচে তাকিয়ে দেখল দাউদাউ আগুনে ওদের শহর পুড়ছে।
দাঁতে দাঁত ঘষে ছেলেমেয়েরা মনের চোখে দেখতে লাগল দাউদাউ আগুনে জ্বলে যাচ্ছে আমেরিকার আকাশছোঁয়া দালানগুলো।
‘একটু অপেক্ষা করো, দেখবে আমরা তোমাদের নিউইয়র্ক আর ওয়াশিংটনে বৃষ্টির মতো বোমা ঝরাব।’ প্রতিশোধস্পৃহায় কাঁপতে কাঁপতে ওরা মনপ্রাণ ঢেলে কাগজ তৈরি করে আঠা দিয়ে জোড়া দিয়েছিল। কিন্তু যতই উৎসাহের প্রকাশ থাকুক ওদের কাজে সেনাবাহিনী তো ইতোমধ্যে আগুনে-বেলুনের বিষয়টাকে বর্জন করেছিল।
প্রথমবার পাঠানো বেলুন ক্ষতিসাধন করতে পেরেছিল কিনা সে-বিষয়ে আমেরিকা একেবারে নিঃশব্দে ছিল আর তাতে জাপান সামরিক বাহিনী বেলুনের কার্যকারিতা সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়েছিল। ১৯৪৫-এর শুরুতে শীতের কয়েক মাস জেট বায়ুস্রোত সবচেয়ে শক্তিশালী থাকে অথচ কোনো বেলুন পাঠানো হলো না। ওরা বেলুন তৈরি করে যেতে লাগল; কিন্তু অস্ত্র হিসেবে একে তেমন গুরুত্ব আর দেওয়া হলো না এবং ছেলেমেয়েদেরও অবহেলা হতে লাগল। দিনে তিনবার ওদের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার দেওয়া হতো; কিন্তু পরে কেবল ভুট্টা আর মাছের পাতলা স্যুপ দেওয়া হচ্ছিল। ওরা শুকিয়ে হাড় চামড়ায় পরিণত হলো, কিন্তু তবু ওদের মন ভাঙল না।
ওদের তৈরি কয়েক হাজার বেলুন – ওরা তাকিয়ে রইল বেলুনগুলোর দিকে, পড়ে থাকা অবস্থায় হয়তো চোপসানো জেলি ফিশের মতোই লাগছিল। কিন্তু ওরা তো তাকিয়ে ভাবছিল হাইড্রোজেন ভরার পর রাজকীয় বেলুনের কথা আর তারপর আমেরিকার আকাশ থেকে নামছে নিচে – ক্ষুধার জ্বালা কি আর থাকে তখন ছেলেমেয়েদের! আকাশপথের বোমা হামলায় যারা আপনজনদের হারিয়েছিল, ঘরবাড়ি হারিয়েছিল, তারা সংকল্পে আরো দৃঢ়, ওদের বিশ্বাস ছিল বেলুন দিয়েই প্রতিশোধ নিতে পারবে।
১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণ ঘোষণা করল। বেলুনগুলো বিজয়ী বাহিনীর চোখে পড়লে তারা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে তাই সামরিক সদস্যরা কারখানায় ঢুকে হাইড্রোজেন তৈরির সরঞ্জামসহ অন্য যন্ত্রপাতি নষ্ট করে যত দ্রম্নত সম্ভব পালিয়ে গেল।
পেছনে পড়ে রইল স্কুলের ছেলেমেয়েরা, প্রচ- আঘাত নিয়ে তাকাল সত্মূপীকৃত মৃতদেহের মতো পড়ে থাকা বেলুনগুলোর দিকে আর সকলে যেন একসঙ্গে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ল। ওদেরই নিজের হাতে তৈরি একটি বেলুনে হাত বুলিয়ে জলভরা চোখে একটি মেয়ে বলে উঠল, ‘বেচারারা।’ ওরা প্রবঞ্চিত হয়েছিল সত্যিই, কিন্তু তারপরও নিজের জন্য ততটা নয় যতটা করুণা বোধ করছিল বেলুনগুলোর জন্য – ওরা যে আর উড়বে না। একই অনুভূতি হলো সব ছেলেমেয়ের। ওদের হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারবে না সে দুঃখ ছিল, কিন্তু বেলুনগুলো কোনো কাজে লাগল না, চোখের সামনে পড়ে রইল, এ-দুঃখ ওরা সহ্য করতে পারছিল না।
একটি ছেলে হাইড্রোজেন পাইপ মুখে নিয়ে বেলুনে ফুঁ দিলো, সে জানত কোনো লাভ নেই, এভাবে একটা দশ মিটার আয়তনের বেলুন কিছুতেই ফোলাতে পারবে না; কিন্তু এ তবু কিছু না করার চেয়ে তো ভালো। একের পর এক অন্য ছেলেমেয়েরা এগিয়ে এলো বেলুনে ফুঁ দিতে আর একটু একটু করে বেলুনটা ফুলতে শুরু করল। শক্তি নিঃশেষ করে মুখ নীল হয়ে লুটিয়ে পড়া পর্যন্ত ওরা ফুঁ দিচ্ছিল, এবং কয়েক হাজার ছেলেমেয়ের মিলিত প্রচেষ্টায় বিকেলের দিকে বেলুনটা পূর্ণ আকারে দাঁড়িয়ে গেল আর যেন ওদের হৃদয়ের ভাষা বুঝে ভাসতে ভাসতে ওপরে উঠে পড়ল।
কেউ আনন্দধ্বনি উচ্চারণ করল না! কেউ হাততালি দিলো না, চোখের জলও কেউ ফেলল না। বেলুনটা যে আকাশে উড়ে চলেছে ওরা তাকিয়ে তাকিয়ে কেবল তা-ই দেখতে লাগল। কোনো অস্ত্র কি কখনো এত সুন্দর হয়! কাদাটে রঙের অনর্থক অকেজো একটা বেলুন, কিন্তু কি মন্দ-মধুর গতিতে আকাশে ভাসমান।
দূরগামী বেলুনটা দেখতে দেখতে ছেলেমেয়েদের মনে পড়ল স্কুলে খেলার শেষ দিনটাতে বেলুন ওড়াবার কথা। উৎসবের রাতে এলাকার দোকান থেকে কেনা বেলুন হাত ফসকে উড়ে চলে গেলে কত যে কষ্ট হতো তাও মনে পড়ল, গ্রীষ্মকালীন ক্লিয়ারেন্স সেলে কেনা বেলুন কেউ যদি ওদের দিয়েছে, আর তা নিয়ে মারামারি করে, বেলুনটা ফুটে গেলে সে কী কান্না, আর ওই হাওয়া চলে যাওয়া কোঁচকানো বেলুন – কি সে-চেষ্টা ফোলাতে; কিন্তু মেলার বুড়োটা ফুলিয়ে দিলে যেভাবে উড়ত সেভাবে আর উড়ত না।
বেলুনটা কিছুক্ষণ একটু নিচে ভেসে বেড়াতে লাগল যেন সেটি ওদের ছেড়ে যেতে চাইছিল না, তারপর হঠাৎ আকাশের উঁচুতে উঠে গেল। পরে আর একবার নিচে এসে ইতস্তত ঘুরে ঘুরে বিদ্যুৎবেগে উড়ে গিয়ে চোখের আড়াল হয়ে গেল।
১৫ আগস্টে মেঘমুক্ত নীল সন্ধ্যাকাশ থেকে জাপান ছেড়ে একটিমাত্র অতিকায় বেলুন জেট বায়ুস্রোতে ভর করে আমেরিকার উদ্দেশে যাত্রা করল। বোমা বা অন্য কোনো যন্ত্র এতে ছিল না। জাপানি কিশোরদের প্রাণের নিঃশ্বাসবায়ু ভরা বেলুনটা নামতে না পেরে এখনো সম্ভবত কোথাও না কোথাও ভেসে বেড়াচ্ছে।
লেখক পরিচিতি
১৯৩০ সালে জাপানে আকিয়ুকি নোসাকার জন্ম। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণের হাত থেকে তিনি নিজে বেঁচে গেলেও পিতা-মাতাকে হারান এবং ফলে তার ভগ্নিরও মৃত্যু হয়। তিনি জাপানের ভস্মোত্থিত প্রজন্মের একজন সদস্য ছিলেন এবং ২০১৪ সালেও বলেছেন, ‘ভস্মীভূত ধ্বংসাবশেষ থেকে এখনো আমার উত্তরণ হয়নি।’ তিনি উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তিনি গীতিকবি ও গায়ক ছিলেন। তিনি রাজনীতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন। ২০১৫ সালে নোসাকার মৃত্যু হয়।
এখানে অনূদিত গল্পটি The Cake Tree in the Ruins নামক নোসাকার গল্পগ্রন্থ থেকে সংগৃহীত। এ-সংকলনের সব গল্পই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত।
১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট সম্রাট হিরোহিতোর রেকর্ডকৃত ভাষণ রেডিওর মাধ্যমে জাপানের উদ্দেশে সম্প্রচারিত হয়; এই ভাষণে তিনি যৌথবাহিনীর কাছে জাপানের আত্মসমর্পণ ঘোষণা করেন। সেজন্য এ-দিনটিই যুদ্ধবিরতির দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং প্রতিবছর জাপানে এ-দিনটি শহিদ যোদ্ধাদের স্মরণে পালিত হয়ে থাকে।
ব্যালিস্টিক মিসাইল : যে-মিসাইল নির্ধারিত স্থানে গিয়ে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য বিশেষ দিক থেকে বিশেষ গতিতে বাতাসে প্রেরিত বা নিক্ষিপ্ত হয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.