ভূমিকা ও অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন বসাক
ভূমিকা
আগা শাহিদ আলী ভারতীয়-কাশ্মিরি-আমেরিকান কবি (১৯৪৯-২০০১)। দক্ষিণ এশিয়ার ইংরেজিতে-লিখিয়ে কবিদের মধ্যে আগা শাহিদ আলী একটি উল্লেখযোগ্য নাম। তাঁর কবিতার দর্শন কী জানতে চাইলে তিনি এই বলে জবাব দিয়েছিলেন, ‘I don’t have a philosophy; I have a temperament.’ দর্শন থাক বা না থাক, তাঁর কবিতার আছে একটি অননুকরণীয় মেজাজ – পারিসরিক স্মৃতি, স্থানচ্যুতি, অভিবাসন, সাঙ্গীকরণ, বারংবার
দিল্লি-কাশ্মির-অ্যারিজোনার স্মৃতিকাতর বৃত্তে ঘোরা, অদ্ভুত বেদনা ও উৎকণ্ঠা-মেশানো হাহাকার, কখনো বা
ক্রোধ-ক্ষোভ-অনুযোগ, সম্প্রীতি সৌহার্দ্যরে আকুলতা এবং সর্বোপরি, একধরনের ফয়েজ আহমদ ফয়েজের কবিতা/ বেগম আখতারের গজলের যুগল তন্ময়তা। এই মেজাজের মর্মে আছে এক ভূরাজনৈতিক এবং একইসঙ্গে ভূস্বর্গীয় নাড়ির বন্ধন। পূর্ব ও পশ্চিমের রসায়ন।
তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত কবিতাসমগ্র The Veiled Suite-এর ভূমিকায় ড্যানিয়েল হল আগা শাহিদ আলীকে ‘মুসলমান, হিন্দু এবং যথাযথ পরিচয়-চিহ্নের অভাবে, পশ্চিমা সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী’ বলে উল্লেখ করেছেন। মোটাদাগে সত্য মনে হলেও এরূপ সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরার মধ্যে আমরা বিহ্বল, অন্যায্য অন্যায়ে কাতর মানবিক আগা শাহিদ আলীকে পাই না। তাঁর কবিতায় আমরা বরং তাঁকে ইত্যাকার বিভাজনে বিভাজিত এবং পুনঃউপনিবেশিত হওয়ার যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে দেখি, যা ঢের বেশি রাজনৈতিক। কাশ্মির তাঁর কবিতায় মেটোনিমি (অন্নংভট্টের প্রাচীন ব্যাকরণে মেটোনিমি ‘জহৎ লক্ষণা’), রবার্ট ফ্রস্টের কাছে যেমন নিউ ইংল্যান্ড মেটোনিমি। ভৌগোলিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক যে শ্রীনগর, যে কাশ্মির তাঁকে লালন করেছে, তাঁর কবিমানসের ভিত রচনা করে দিয়েছে, তিনি কবিতায় তার কাছে বারবার ফিরে গেছেন। তাঁর জীবনবোধের একটি বড় অংশের সৃষ্টি স্বদেশের ভেতর এই অন্য স্বদেশে। আমেরিকান অভিবাসী জীবন (স্বেচ্ছানির্বাসন কী?) এই বোধের বড়জোর সম্পূরক হতে পারে, সমতুল্য নয়। ৫২ বছর জীবনের ঠিক অর্ধেক সময় – আমেরিকায় কাটানো ২৬ বছর (১৯৭৫-২০০১) কখনো কাশ্মিরময় ২৬ বছর (১৯৪৯-১৯৭৫) হয়ে উঠতে পারেনি। কবিতায় তিনি বারবার ফিরে গেছেন দিল্লি, শ্রীনগর, কাশ্মির, হিমালয়ে, ঝিলমের জলে, ইতিহাসের অলিগলিতে, রাজপথে বাহাদুর শাহদের সঙ্গে। সংকটে, সন্ত্রাসে, স্বপ্নে ও স্বপ্নভঙ্গে।
আগা শাহিদ আলীর জন্ম নতুন দিল্লিতে। বেড়ে উঠেছেন কাশ্মির উপত্যকায়। তিনি কাশ্মির বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পিএইচ.ডি করেন ইংরেজি সাহিত্যে এবং ফাইন আর্টসে স্নাতকোত্তর। ভারত ও আমেরিকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন আমৃত্যু। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হলো – The Half-Inch Himalayas, A Walk through the Yellow Pages, A Nostalgist’s Map of America, The Country without a Post Office, Rooms are Never Finished Ges Call Me Ishmael Tonight।
১. বেগম আখতারের স্মৃতির উদ্দেশে
(মৃত্যু ৩০শে অক্টোবর ১৯৭৪)
এক
প্রতিটি কাগজে তোমার মৃত্যুসংবাদ,
সাদা-কালো খোপে
ছবি, শোকবাণী,
আকাশ ঈষদুষ্ণ, নীল, সাদামাটা,
বিপর্যয়ের পূর্বাভাস নেই,
দু-লাইনের মাঝখানে
কান্নার পরিসর নেই।
ইচ্ছে হয়, কেয়ামতের কথা বলি।
দুই
তোমার আঙুল এখনো কি ক্ষুধার্ত ভৈরবী তান তোলে?
নাকি শুধু কাদামাখা কফিনের কাপড় খামচায়?
গজল, সেই মৃত্যু-জাগানিয়া মৃতভর্তৃকা,
তোমাকে নিবেদিত মলিন মহাফেজখানায়
ফুঁপে ফুঁপে কাঁদে।
পরনে তার শোক, চন্দ্রস্নাত সাদা,
আকাশকে অবিশ্বাসে কোণঠাসা করে রাখে।
তুমি অবশেষে শাণিত করেছো তোমার চূড়ান্ত বিয়োগ,
গালিব, মীর, ফয়েজের স্বরলিপি ঋদ্ধ করেছো তুমি,
দশক দশক ধরে।
আমি এক স্বরলিপিহীন রাগের নিরীক্ষা করে যাই।
তিন
তোমাকে ঠান্ডা মাটির নির্বাসনে দিয়ে
তোমার নির্বোধ শুভ্র কফিন
তার নিজস্ব অজ্ঞতায় বিপন্ন বিস্মিত।
তার পরিধানে শূন্যতার অহংকার,
যাযাবর প্রতিধ্বনির অস্থিমজ্জা খসে খসে পড়ে।
আমি তোমার পেছন পেছন মাটির থাবার কাছে চলি।
আমার দু-কাঁধে সময়ের ছায়া,
এই তবে ইতিহাসের অসহ্য ঔদ্ধত্য,
এই সেই হাড়গোড়ের মুক্তির সময়।
মৃতের সাথে তো জেরা সম্ভবপর নয়।
অতএব তোমার রেকর্ড, ফটো, টেপ,
পরিস্থিতিগত সব তথ্যপ্রমাণ মেনে
আমার এই যত্নহীন সাক্ষ্য দিলাম।
ইচ্ছে হয়, আত্মপক্ষ সমর্থনে তোমাকে হাজির হতে বলি,
কিন্তু কবর তো স্যাঁতসেঁতে, ঠান্ডা, অধিকন্তু মালহার –
খুব মন কাঁদে বৃষ্টিকে সুতোয় বেঁধে
তোমাকে ঢেকে দিতে সুরের চাদরে ; অথচ তুমি সম্পূর্ণ এড়িয়ে
যাও।
বৃষ্টির মুখে কথা নেই,
এবং জীবন, পুনরায়, সমীপবর্তী হয়,
আপন অধিকারে পৃথিবী পৃথিবী হয়,
বাতাসে ভেসে থাকে শোকার্ত সময়।
(সালিম কিদওয়াইয়ের জন্যে)
২. কাশ্মির থেকে আসা পোস্টকার্ড
আমার মেইলবক্সে কাশ্মির গুটিসুটি ঢোকে,
সে আমার চার-বাই-ছয় ইঞ্চির পরিপাটি ভিটেবাড়ি।
আমি বরাবর ছিমছাম পছন্দ করতাম।
এখন আমার ঘরে আধা-ইঞ্চি হিমালয়।
এ আমার ঘরদোর। এর চেয়ে কাছাকাছি
কখনো বাড়িকে পাবো না। যখন ফিরবো,
এইসব রং এমন উজ্জ্বল থাকবে না,
ঝিলামের জল এমন কাকচক্ষু থাকবে না,
থাকবে না এমন সামুদ্রিক নীল।
আমার ভালোবাসা
এতোটাই অতি-প্রকাশিত।
আর স্মৃতিগুলো কিছুটা বেপথু হবে,
স্মৃতির ভেতর
এক বিপুল নঞর্থকতা,
কালো ও সাদায়,
এখনো অস্ফুট।
৩. শবদাহ
শবদেহে আমরা আগুন দিলাম
তোমার হাড্ডি-অস্থি পুড়তে অস্বীকার করলো।
কে অনুমান করেছিল
মৃত্যুর পরও তুমি অনবনত থেকে যাবে?
৪. মনিহারি
চাঁদ সূর্য হতে পারেনি।
সে শুধু তোমার হাতে-বোনা রিম রিম
বিশাল রুপালি কাগজ হয়ে
মরুভূমি জুড়ে নেমেছিল।
এখন রাত তোমার কুটিরশিল্প।
দিন ঝকঝকে দোকান।
কাগজে কাগজে পৃথিবী সয়লাব।
চিঠি দিও।
৫. উত্তরজীবী
আমার ঘরে কে যেন একজন থাকে
রাতে সে ফ্রিজ খোলে
গ্রীষ্মের ধনেপাতা শ্বাস নেয়
শোনে রেডিও কাশ্মির ঘোষণা করছে
গত বছর নাঙ্গা পর্বতে
নিখোঁজ আরোহীদের
খোঁজাখুঁজি আর নয়
প্রতিবেশীদের প্রতি অনুকম্পাবশত
আমার ঘরদোর ভাঙে
এ মুহূর্তটি একান্তই তার
সে আমার রুমে
টেবিলে বসে
আমার স্বাক্ষর মকশো করে মেইলের জবাব দেয়
সে কার্ডিগান পরে থাকে
যা আমি পরবো বলে মা নিজ হাতে বুনেছিল
তার জন্যে আয়না
আমার মুখচ্ছবি তুলে ধরে
সে আমার মাকে ডাকে আমার গলায়
মা ফিরে দেখে
অধীর সে মাকে কত-শত গল্প শোনায়
সেসব গল্পের আমি উপজীব্য নই।
৬. দিল্লিতে কজিনসেভের কিং লিয়ার
মঞ্চায়ন দেখে
কর্ডেলিয়া যখন ভাঙা দেয়াল থেকে ঝুলে থাকে
কিং লিয়ার আর্তনাদ করে বলেন, ‘তোমরা পাষাণ মানুষ’।
আমি চাঁদনি চকে পা বাড়াই
সে সড়ক একদিন জুঁইয়ে জুঁইয়ে মুড়ে দেওয়া হতো
সম্রাজ্ঞী বলে কথা, আসবেন,
সাথে রাজকীয় রমণীর দল,
তাদের সুগন্ধি দ্রব্য আসতো ইস্পাহান থেকে,
মসলিন ঢাকা থেকে, আতর কাবুল থেকে,
আগ্রা থেকে কাচের কঙ্কন।
এখন অজ্ঞাত অভিজাত এবং বিস্মৃত সন্তদের
স্মৃতিসৌধে বাস করে ভিখারির দল,
হকাররা আয়না চিরুনি বেচে
শিখ মন্দিরের পাশে, সড়কের উলটো দিকে
থিয়েটারে চলছে বোম্বাইয়া ধামাকা ছবি।
আমি ভাবছি কবি ও সম্রাট জাফরের কথা,
দুপায়ে শেকল বেঁধে তাঁকে
এ সড়ক ধরে নিয়ে যাচ্ছে ব্রিটিশ সেনারা
যেন তিনি তাঁর পুত্রদের ফাঁসিতে ঝোলানোর দৃশ্য দেখতে পান।
নির্বাসনে তিনি লিখলেন :
‘হতভাগ্য জাফর
অর্ধেক জীবন তার কেটেছে আশার পেছনে ছুটে,
অর্ধেক প্রতীক্ষা করে।
সে ভিক্ষা চায়, দিল্লির দুই গজ কবরের মাটি।’
ওরা তাঁকে বার্মায় নির্বাসন দিলো,
কবরস্থ করলো রেঙ্গুনে।
৭. ইতিহাসের জন্যে একটি পাদটীকা
সিন্ধুর তীরে,
সমুদ্রে
মেশার
ঠিক আগে
এবং ঠিক
বর্ষার আগে,
ওরা আমাকে
রেখে গেল খামচে ধরা
বিদায়ের দ্বীপপুঞ্জে।
দশটি দশক ধরে
ওরা কোনো সংবাদ দিলো না
যদিও শামুকের কাছ থেকে
আমি প্রায় সময় শুনতাম
জাহাজগুলো সাহায্যের জন্যে অস্ফুট ডাকছে।
আমি আমার সারাটি পকেটে
ভাঙনের শব্দ ভরে রাখি।
নদীর ঢেউয়ের পাতা
ওল্টাতে ওল্টাতে
ঝড়ের পাণ্ডুলিপির মর্মোদ্ধার
আমি এখনো করতে পারিনি।
প্রবল বাতাসে তাদের
আধেক-ছেঁড়া কথাবার্তা
তীরে পৌঁছে, দাবি জানায়
আমি যেন কণ্ঠস্থ করি
তাদের প্রাচীন এবং সাম্প্রতিক
ভ্রমণ-বৃত্তান্ত
কাফেলার দল অতর্কিতে আক্রান্ত,
জঙ্গলে জ্বলছে আগুন॥
(বারি ক্যারোলির জন্যে)
৮. প্রিয় সাহিদ
কোনো ধারণাই, এমন কী তা যদি অনেক রাশিয়ানের কাছে রাশিয়ার স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাস করার ধারণাও হয়ে থাকে, একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে জায়েজ করতে পারে না।
– এলেনা বনার, চেচনিয়া বিষয়ে ইয়েলেৎসিনের কাছে খোলা চিঠি
কোনো ব্যক্তি-মানুষ বা কোনো গোষ্ঠীই একটি নগরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে পারে না।
– চার্লস সিমিক
অনেক দূরদেশ থেকে তোমাকে লিখছি। আমরা যারা এখানে থাকি সেই দেশ থেকেও দূরের দেশ। যেখানে তুমি এখন আর থাকো না। যেখানে সবাই পকেটে ঠিকানা রেখে বেড়ায় যেন অন্তত তার মৃতদেহ বাড়ি পৌঁছতে পারে।
নগরীতে, আমাদের কাছে, হঠাৎ হঠাৎ গুজব কানে আসে। তারপরও সীমান্তবর্তী শহরগুলো থেকে আমরা আসল সংবাদ পেয়ে যাই : পুরুষদের সারা রাত খালি পায়ে বরফ-জলে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। ঘরের ভেতরে নারীরা একা। সেনারা রেডিও ভাংচুর করে, টিভি ভাংচুর করে। খালি হাতে ওরা আমাদের ঘরদোর টুকরো টুকরো করে।
তুমি শুনে থাকবে, রিজোয়ানকে হত্যা করা হয়েছে। রিজোয়ান : যে কি না বেহেশতের ফটকগুলো দেখাশোনা করতো। মাত্র আঠারো বছর বয়স। গতকাল গোপন ক্যাফেতে (ওখানে সবাই তোমার কথা জানতে চাচ্ছিলো), এক ডাক্তার – যে জিজ্ঞাসাবাদ সেল থেকে সদ্য ছাড়া পাওয়া এক ষোলো বছর বয়সী ছেলের চিকিৎসা করেছিল – বললো, আমি ভাগ্যগণনাকারী গণৎকারের কাছে জানতে চাইবো : তার ভাগ্যরেখা কি পূর্বাভাস দিয়েছিল ছুরি দিয়ে তার হাতের আঙুল থেকে কব্জি অবধি ফালা ফালা করা হবে?
এই চিঠি, ইনশাআল্লাহ, তোমার কাছে পৌঁছবে : আমার ভাই আগামীকাল দক্ষিণে যাচ্ছে, সেখানে ডাকবাক্সে দেবে। এখানে স্ট্যাম্প জোগাড় করাই কঠিন। আজ আমি পোস্টাপিসে গিয়েছিলাম। নদীর ওপারে। ব্যাগের পর ব্যাগ – শয়ে শয়ে ক্যাম্বিশের ব্যাগ – সব বিলি-না-করা ডাক। কপাল ভালো, নিচে তাকাতে দেখি মেঝের ওপর এই চিঠিটা পড়ে আছে, তোমার ঠিকানা লেখা। আমি সেই চিঠিটাও সাথে দিলাম। আমার ধারণা, এটা এমন কেউ লিখেছে যার খবর পেতে তুমি উদ্বিগ্ন আছো।
এখানে সবকিছু আগের মতো চলছে, যদিও আমরা প্রায় সময় তোমার কথা বলাবলি করি। তুমি কি শিগগির আসছো? তোমার জন্যে অপেক্ষা আর বসন্তের জন্যে অপেক্ষা একই যেন। কখন বাদাম ফুল ফুটবে আমরা প্রতীক্ষায় আছি। এবং আল্লাহ চাহে তো, ওহ! সেসব শান্তির দিন ছিল, আমাদের সৌহার্দ্য ছিল, এবং যেখানেই যেতাম না কেন, করতলে বৃষ্টি নামতো।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.