জলের অক্ষরে লেখা   

পর্ব : ১৬

আড্ডা আর জমলো না। টুকিটাকি কথাবার্তা হলো, একটু-আধটু দুষ্টুমি, ডিনার শেষ হলো প্রায় নিঃশব্দে। ঠিক হলো, অংশু আর অপলা বাসায় চলে যাবে, ঋভু অবন্তিকে নামিয়ে দিয়ে আসবে।

বিদায়ের সময় অপলা বললো, কালকে আপনারা আমার বাসায় আসেন। কই মাছের ভুনা খাওয়াবো।

– কালকে না। আমার অন্য একটা কাজ আছে। বললো অবন্তি।

– তাহলে পরশু?

– হ্যাঁ, পরশু যেতে পারি।

– ঋভুভাই, আপনি?

– আমি তো যে-কোনোদিন যেতে পারি। তুমি কেবল ডাকলেই হবে।

– ওরে আমার প্রেম! – ফোড়ন কাটলো অংশু।

– আমাদের প্রেম নিয়ে তোর এত মাথাব্যথা কেন? – ঋভু ঝাড়ি দিয়ে বললো।

– আমার মাথাব্যথা কেন? এই যে তোর প্রেমিকাকে নিয়ে যাচ্ছি। পারলে ফেরা। তারপর অপলার দিকে ফিরে বললো, এই যে মহিলা চলো। রাত হইছে। আমার সামনে পরপুরুষের লগে প্রেম কইরা বেড়াও? আইজকা তোমারে মজা দেখামু। 

– পাগল খেপেছে। – হেসে বললো অপলা। সে জানে কী ঘটতে চলেছে। গিয়েই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে অংশু, বলতে থাকবে ঋভুর কথা। আর সেও সেই খেলায় মেতে উঠবে।

বেরিয়ে যে যার পথ ধরলো।

যেতে যেতে অবন্তি বললো, কালকের দিনটা আমি তোমার সঙ্গে কাটাতে চাই।

– হুম। কখন আসবে?

– সকালের দিকে। ধরো দশটা। তোমার অসুবিধা হবে?

– না! কিসের অসুবিধা?

– অফিস আছে না?

– যাবো না।

– তোমার মনে আছে, এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে যেটা খুব একটা বদলায়নি?

– হ্যাঁ। মনে আছে।

– আমার পরিচিত জায়গা হতে হবে কিন্তু।

– আচ্ছা।

– আর একটা পুরনো গাছ থাকতে হবে সেখানে।

– গাছ?

– হ্যাঁ। যেন দেখেই চিনতে পারি।

– আচ্ছা। তারপর?

– দুপুরে একসঙ্গে খাবো।

– হুম।

– তারপর তোমার বাসায় যাবো।

– ঠিক আছে তাই হবে।

পৌঁছতে বেশি সময় লাগলো না। গাড়ি গেটে এসে দাঁড়ালে অবন্তি বললো, ভেতরে চলো!

– না, আজকে না। অনেক রাত হয়ে গেছে।

– তাতে কী? সবাই এখনো জেগে আছে বোধহয়।

– এত রাত পর্যন্ত জেগে থাকার কথা নয়।

– এমনিতে থাকে না। এখন সবাই আছে তো। অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা হয়।

– তবু … থাক। সকালে তোমাকে নিতে আসবো। তখন ভেতরে যাবো।

– তুমি নিতে আসবে!

– হ্যাঁ। কোনো অসুবিধা?

– আরে না, আমার কী অসুবিধা? তোমাকেই উল্টোদিকে আসতে হবে।

– আমার আর উল্টো-সোজা কী? সব দিকই সমান।

– হুম। ঠিক আছে, এসো।

গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হলো ঋভু। ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে রইলো অবন্তি, যতক্ষণ দেখা যায় ততক্ষণ। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মনে হলো, ওকে ঠিক বুঝে ওঠা যায় না। কী যে ভাবছে, আন্দাজও করা যায় না। সেই তখন থেকে, অংশুর প্রকল্প নিয়ে আলাপের পর থেকে, কী যে গম্ভীর হয়ে আছে! আর এই যে বললো – আমার আর উল্টো-সোজা কী, সব দিকই সমান – এই কথার মানে কী? সব দিক কি কারো সমান হয়?

বেশিক্ষণ অবশ্য ভাবা গেল না, এত রাতে গেটের বাইরে কতক্ষণই বা দাঁড়িয়ে থাকা যায়, ভেতরে ঢুকে যেতে হলো।

পরদিন সকালে ঋভু এলো। ঘড়িতে তখন দশটা বেজে গেছে। অবন্তি এসে ভেতরে নিয়ে গেল তাকে, বসালো ড্রয়িংরুমে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এলো আফসানা। বললো, অনেকদিন পর এলে ঋভু। কেমন আছো?

– এই তো ভাবি, আছি। আপনারা কেমন আছেন?

– চলনসই। অবশ্য সুসান আসার পর থেকে গল্পটল্প করে ভালো সময় কেটেছে। ওর ফিরে যাওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসছে, ততই মন খারাপ লাগছে।

ঋভু কিছু বললো না। কী-ই বা বলা যায় এ-কথার প্রেক্ষিতে? একটু পর কিছু একটা বলতে হয় বলে বললো, বাসাটা এত খালি লাগছে কেন? কেউ নেই?

– সবাই যে যার কাজে বেরিয়ে গেছে। শুধু শুভ আছে ওপরে।

– ও হ্যাঁ। আজকে তো ছুটির দিন না।

– চলো, টেবিলে চলো। তুমি আসবে বলে এখনো খাইনি।

– আমি তো খেয়ে এসেছি ভাবি!

– তাতে কী? আরেকবার খেলে কিছু হবে না। শুভকেও ডাকছি।

– না না ভাবি। আমি এখন খেতেই পারবো না।

– ঠিক আছে, খেতে হবে না। টেবিলে এসো। গল্প করি।

ইতস্তত করেও উঠলো ঋভু। গিয়ে বসলো টেবিলে। শুভও এলো ওপর থেকে। টুকিটাকি গল্প করতে করতে এগারোটা বেজে গেল। চোখের ইশারায় ঋভু অবন্তিকে বোঝালো, এবার বেরোনো দরকার, দেরি হয়ে যাচ্ছে। অবন্তি বুঝলো এবং বললো, এবার তাহলে ছুটি দাও ভাবি, আমরা যাই।

– দুপুরে এসে খাবে তো?

– না, একটু ঘুরে বেড়াবো। ফিরতে রাত হবে।

ঋভুর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমির হাসি হেসে আফসানা বললো, সুসানকে ঠিকঠাক ফেরত দিয়ে যেও কিন্তু ঋভু।

– যদি না দিই? – ঋভুও দুষ্টুমির জবাব দিলো।

– না না, ঠিকঠাক ফেরত দিয়ে যাবে।

– আচ্ছা। ফেরত দেবো। কিন্তু ঠিকঠাক ফেরত দিতে পারবো কি না, কথা দিতে পারছি না।

– উল্টাপাল্টা কিছু করলে কিন্তু তোমার কাঁধে গছিয়ে দেবো।

– আমার কাঁধ তো অত চওড়া না ভাবি।

– তাহলে তোমার বাসায় রেখে আসবো।

– তাতে অসুবিধা নেই। আমার বাসায় পর্যাপ্ত জায়গা আছে।

– কথাটা মনে রাখলাম।

– আচ্ছা আচ্ছা, মনে রাখবেন। ভুলে যাবেন না কিন্তু।

হাসতে হাসতে বেরোলো দুজন। 

অনেকক্ষণ ধরে গাড়ি চলছে, কোথায় যে যাচ্ছে ঋভু বুঝতে না পেরে অবন্তি বললো, আগে কোনদিকে যাবে?

– ঠিক করিনি কিছু। ঋভু উত্তর দিলো।

– পথে পথেই ঘুরবো নাকি?

– ঘুরলামই না হয়। খারাপ লাগছে?

– না, তা লাগছে না। কিন্তু আমি কোথাও যেতে চাই।

– ঠিক কী দেখতে চাইছ বলো তো!

– নির্দিষ্ট কিছু না। আমার ছোটবেলার শহরটাকে দেখতে চাইছি।

– সে-শহর তুমি কোথায় পাবে?

– পাচ্ছি না বলেই তো দেখতে চাইছি। সব বদলে গেছে। কোথাও কি পুরনো দিনের চিহ্ন নেই?

– পুরনো ঢাকায় আছে, সেদিন তো দেখলে। তুমি অন্য কোথাও যেতে চাইছ, তাই তো?

– হ্যাঁ।

– ঠিক আছে। এক জায়গায় সব পাবে না। বেশি কিছু আশাও করো না। হয়তো কিছু চিহ্ন পাবে।

– ওটুকু হলেও চলবে।

ঋভু গাড়ি চালিয়ে চলে এলো তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত এক মহল্লায়। গেটে বড় করে লেখা ‘বাগানবাড়ি আবাসিক এলাকা’। বললো, চিনতে পারছো?

– হ্যাঁ। সুরভীদের বাসা ছিল এখানে। এখন ও কোথায়?

– জানি না। কারো সঙ্গেই আমার যোগাযোগ নেই।

– হুম, জানি।

মহল্লাটা বদ্ধ। মানে কানাগলি, একপাশ দিয়ে গাড়ি ঢুকতে বা বেরোতে পারে, অন্য পাশ বলতে কিছু নেই। সেজন্যই এ-এলাকার মানুষ ছাড়া বাইরের লোকজন কম ঢোকে এখানে। ঋভু ভেতরে ঢুকে গাড়ি পার্ক করলো রাস্তার পাশেই। বেশিক্ষণ তো থাকবে না, গাড়ির ভিড়ও নেই এখানে, অসুবিধা হবে না।

এই মেঘলা দুপুরে এলাকাটা শান্ত হয়ে আছে। তবে আগের মতো গাছপালার প্রাচুর্য নেই। অবন্তি বললোও সে-কথা – আগে আরো অনেক গাছ ছিল, তাই না?

– হ্যাঁ। দু-বছর আগে এলেও প্রায় আগের মতোই দেখতে পেতে। গত দু-বছরে অনেক নতুন বিল্ডিং উঠেছে, গাছপালা কাটা পড়েছে।

– তাও যা আছে, মন্দ না। এখনো কেমন শান্ত, নির্জন।

ছোট্ট মহল্লা। দশ মিনিটেই ঘোরা হয়ে গেল। কারো বাসায় যাওয়ার ব্যাপার নেই। সুরভীর বাসাটা যে কোথায় ছিল তাও মনে করতে পারলো না। এখানকার আর কাউকে চেনে না ওরা, তবে সুরভীর কাছে গল্প শুনেছে প্রচুর : সজীব, অমিত, নীলু, মামুন, সজল, অপু … এরা সবাই ওর মহল্লার বড় ভাই-বোন। একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন তাঁরা, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করেছেন, অনেক নাটকীয় ঘটনা – সেইসব গল্প বলতো সুরভী। অবন্তি জিজ্ঞেস করলো, উনাদের খবর কী? জানো কিছু?

– আরে না। সুরভীর খবরই জানি না, উনাদের খবর জানবো কী করে? তবে শুনেছি, উনারা নাকি কোনো এক উপন্যাসে ঢুকে পড়েছেন।

– মানে?

– মানে, একজন লেখক উনাদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন।

– তাই নাকি? মজার তো! তুমি পড়েছ?

– না, এখনো পড়া হয়নি। অপলার কাছে শুনেছি, ওই সময়টা নাকি দারুণভাবে এসেছে উপন্যাসে। ওর কাছে চরিত্রগুলোর নাম আর কাহিনিসংক্ষেপ শুনে বুঝলাম, এরা সব এই এলাকার।

– নাম কী উপন্যাসটার?

– নিরুদ্দেশ যাত্রা।

– কোথায় পাওয়া যাবে?

– তুমি পড়তে চাও?

– হ্যাঁ।

– আচ্ছা দেখি, কোথায় পাওয়া যায়। এখন চলো, অন্য কোথাও যাই।

বাগানবাড়ি থেকে বেরিয়ে সার্কিট হাউজ রোডের নওরতন কলোনিতে ঢুকলো কিছুক্ষণের জন্য। এখানে একসময় বাহাই সম্প্রদায়ের মানুষরা থাকতেন। খুব শান্তিপ্রিয়, মধুর স্বভাবের সব মানুষ ছিলেন তাঁরা; এখনো তাঁদের অফিস আছে, ভেতরের দালানগুলো বহুতল ভবনে রূপান্তরিত হয়েছে, কিন্তু তাঁরা আর থাকেন না এখানে। তবু একটা সংরক্ষিত এলাকার আমেজ রয়ে গেছে। ছিমছাম, নির্জন, কোলাহলহীন।

ওখান থেকে তারা ঢুকলো মিন্টো রোডে। দুপাশে সরকারি বাড়ি। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করা মুশকিল, ঋভু তাই পরিচিত এক সরকারি কর্মকর্তার বাসার কাছে রেখে এলো। এই এলাকাটা মোটামুটি আগের মতোই আছে। না থাকার কোনো কারণ নেই অবশ্য, একপাশে মন্ত্রীদের বাড়ি, অন্যপাশে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের কোয়ার্টার। ডেভেলপারদের গ্রাসের মুখে পড়েনি এসব বাড়িঘর। গাছপালাও আছে প্রচুর। এই রাস্তার এ-মাথায় অফিসার্স ক্লাব, ওপাশে রমনা পার্ক। তারা পার্কের দিকেই এগিয়ে গেল। যতই এগোচ্ছে ততই ঘন সবুজ হয়ে উঠছে চারপাশ, অবন্তির মনে হলো। আপনমনে বলে উঠলো সে, ‘কেন বৃক্ষরা এত সবুজ/ আর কেনই বা সবুজ দেখলে আমাদের এত ভালো লাগে?’

ঋভু একটু অবাক হলো – কী বললে?

অবন্তি হেসে লাইন দুটো আবার বললো।

– কোনো কবিতার লাইন?

উত্তর না দিয়ে অবন্তি বললো, চলো পার্কের ভেতরে যাই।

– হ্যাঁ, তুমি গাছ দেখতে চেয়েছিলে, সেজন্যই তো এখানে এলাম।

– থ্যাংক ইউ। কিন্তু এত সাজানো-গোছানো কেন পার্কটা? আগে কেমন একটা বন্য ভাব ছিল না?

– ছিল। সব তো একরকম থাকবে না।

– তা থাকবে না জানি। কিন্তু কিছুই কি থাকবে না? ধরো, এই পার্কটা যদি আগের মতো থাকতো, কী ক্ষতি হতো?

– আমি জানি না। উন্নয়নপ্রেমীদের জিজ্ঞেস করো।

– তারা কোথায়? কাদেরকে জিজ্ঞেস করবো?

– তারা তো তোমার চারপাশে গিজগিজ করছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই উন্নয়ন উন্নয়ন বলে বলে তোমার মাথা ধরিয়ে দেবে।

– থাক। মাথা ধরানোর দরকার নেই। আচ্ছা, লেকটা এখনো আছে?

– তা আছে। হাঁটতে হাঁটতেই পেয়ে যাবে।

পেলও অচিরেই, আর লেকের পাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফের আপনমনে বলে উঠলো অবন্তি, ‘কেন শেকড় নিয়েও কচুরিপানা চিরকাল ভেসে বেড়ায়/ কেনই বা তার ফুলের এত রঙ, এত মায়া, এত রূপমাধুর্য?’

– এটা আবার কোন কবিতা?

রহস্যময়ীর মতো হাসলো অবন্তি, বললো, বলো তো ‘মাছদের চোখ কেন সর্বদা খোলা থাকে/ এমনকি তাদের মৃত্যুর পরও?’

– এসব লাইন তুমি পাচ্ছো কোথায় সেটা আগে বলো।

– পারলে না, তাই না! তাহলে এটা বলো, ‘কেন তৃণভোজীরা এত নিরীহ, মায়াময়/ আর মাংসাশী প্রাণীরা এত হিংস্র?’

– হুম, বুঝলাম। এসব তোমারই লেখা।

– আরে না। আমি কবিতা লিখতে পারি নাকি?

– তাহলে? কোথায় পড়েছ এগুলো?

– বলবো বলবো। অস্থির হয়ো না। আজকে আমি সব বলার জন্যই এসেছি।

ঋভু আর কিছু বললো না। অবশ্য ‘সব’ বলতে ও কী বোঝাচ্ছে তা নিয়ে একটু ভাবলো, কিন্তু বুঝতে দিলো না।

হেঁটে হেঁটে পুরো পার্কই ঘুরলো তারা। ঋভুর ভালো লাগছে অবন্তির পাশে থাকতে, কিন্তু কেমন যেন একটু অস্বস্তিও হচ্ছে। অবন্তি আজকে যেন নিজের মধ্যে নেই। একটু উদাসীন, একটু আত্মহারা, একটু এলোমেলো। যেন সে তার সুসান নয়, অন্য কারো; যেন সে এখানে নেই, আছে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে। অবশ্য কবেই বা সে আমার ছিল, ওই রাতটুকু ছাড়া, ভাবলো ঋভু। কিন্তু ওই রাতের পর কি সব বদলে যাওয়ার কথা নয়? সেদিন তো ওকে সুখীই মনে হয়েছিল; তৃপ্ত ও সুখী; সেই স্মৃতি কি ওর মনে পড়ছে না? মাঝে মাঝে ঋভুর হাত ধরছে সে বটে, কথাও বলছে টুকটাক, কিন্তু ওটুকুই, ফের ডুব দিচ্ছে নিজের ভুবনে।   

হাঁটতে হাঁটতে ঢাকা ক্লাবের পাশের গেট দিয়ে বেরোলো তারা, রাস্তা পার হয়ে শাহবাগ মোড়ে এসে ঋভু একটা রিকশাকে ডাকতেই অবন্তি বললো, রিকশা কেন? কোথায় যাবে? ক্যাম্পাসে একবার যাবো না?

– হ্যাঁ, সেজন্যই তো রিকশা নিচ্ছি।

– হেঁটেই চলো না। হাঁটতে ভালো লাগছে তো!

– আচ্ছা চলো।

হাঁটতে গিয়ে মাথার ওপর নির্মীয়মাণ মেট্রোরেলের কর্মযজ্ঞ দেখে ভীষণ বিরক্ত হলো অবন্তি। ক্ষুব্ধ স্বরে বললো, ক্যাম্পাসের ভেতর দিয়ে এরকম আজদাহা মেট্রোলাইন বানানোর বুদ্ধিটা কোন গর্দভের মাথা থেকে এসেছে শুনি?

অবন্তি গুম হয়ে রইলো। মুখ ভার, বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। হেঁটে চলেছে রাগী ভঙ্গিতে। এমন এক ভাব যেন এ-ক্যাম্পাস এখনো তার, কেউ যেন দখল করে নিয়েছে। ঋভুর মজা লাগছে। সুসান জানেই না, সব কিছু দখল হয়ে গেছে। কোনোকিছুই আর ওর কিংবা আমার বা আমাদের নেই, সব তাদের, ওই উন্নয়নপ্রেমীদের। কিছু বললো না ঋভু, হেঁটে চললো অবন্তির পাশাপাশি।     

চারুকলা পেরিয়ে নজরুলের সমাধির কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো অবন্তি। বললো, ভেতরে ঢোকা যায় না? এরকম বন্ধ করে রেখেছে কেন? আগে তো খোলা ছিল।

– যায়। মসজিদের পাশ দিয়ে যেতে হবে।

– ও!

– যেতে চাও?

– না, থাক। ভোরে এলে একবার যেতাম।

– কেন? ভোরে এমন কি বিশেষ ব্যাপার থাকে?

– তুমি কখনো ভোরে এসেছ?

– না।

– তাহলে বুঝবে না।

– বলো, শুনি।

– ভেতরে নজরুল ছাড়াও আরো কয়েকজন ঘুমিয়ে আছেন, চারুকলার দেয়াল ঘেঁষে। খেয়াল করেছ কখনো?

– হ্যাঁ, করেছি।

– দেয়ালের ওপারে, মানে চারুকলার ভেতরে একটা শিউলি গাছ ছিল। একদিন ভোরে এসে দেখেছিলাম, একটামাত্র কবরের ওপর শিউলি ফুল এমনভাবে বিছিয়ে আছে যে দেখে মনে হয়, কেউ যেন ফুলের বিছানা সাজিয়েছে।

– কার কবরের কথা বলছো? নজরুলের?

– না। আরেকজনের। নাম বলবো না। তোমার যদি কখনো দেখতে ইচ্ছে হয়, ভোরবেলায় এসে দেখে যেও।

– থাক, দেখতে চাই না।

– কেন!

– কবর দেখতে ভালো লাগে না। তাছাড়া শিউলি গাছটাও হয়তো এখন নেই। যে হারে গাছ কাটা হয়েছে …

– নেই! প্রায় আর্তনাদ করে উঠলো অবন্তি।

– আছে কি না জানি না।

– চলো খুঁজে দেখি।

– না। খুঁজতে হবে না। অন্য এক জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে। 

নজরুলের সমাধিসৌধ পেরিয়ে ডানদিকের গেট দিয়ে ঢুকে কলাভবনের পেছন দিয়ে হেঁটে চললো তারা। মাঝে মাঝে কোথাও থামছে অবন্তি, এটা-ওটা প্রশ্ন করছে – ‘এই বিল্ডিংটা তো আগে ছিল না, কবে হলো’, ‘আগে তো কমার্স ফ্যাকাল্টি ছিল, বিজনেস ফ্যাকাল্টি নাম হলো কবে’, ‘আগে তো এখানে দোকানপাট ছিল না, এসব কবে হলো’, ‘এখানে না একটা সিঁড়ি ছিল, শেষ মাথায় ছিল কলাপসিবল গেট, সবসময় বন্ধ থাকতো, আমরা সিঁড়িতে এসে বসতাম, ওটা গেল কোথায়’ – এই ধরনের প্রশ্ন। ঋভুও সব কিছু জানে না। ক্যাম্পাসে তো আসা হয় না বহুদিন ধরে, আসার কারণও নেই।

ঋভু অবন্তিকে নিয়ে যেতে চাইছিল ফুলার রোডে, এই জায়গাটা এখনো প্রায় আগের মতো আছে, খুব বেশি বদলায়নি। কিন্তু তার আগেই ভিসি-চত্বরের কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো অবন্তি, বললো, এটা সেই রেইনট্রি না?

– এটা রেইনট্রি, কিন্তু সেই রেইনট্রি বলতে কী বোঝাচ্ছো, তা তো জানি না। 

কাছে গিয়ে গাছটাকে জড়িয়ে ধরলো অবন্তি। বললো, ও আমার অনেক কিছুর সাক্ষী, জানো?

– কীরকম?

– অনেক স্মৃতি আর স্মৃতিচিহ্ন ওর কাছে জমা হয়ে আছে।

– স্মৃতিচিহ্নও?

– হ্যাঁ। আচ্ছা বলো তো, ‘কেন স্মৃতিচিহ্ন বয়ে বেড়াই, রাখি সযতনে/ স্মৃতি কি চিহ্নে থাকে না হৃদয়ে?’

– প্রশ্নের ভেতরেই তো উত্তর দেওয়া আছে।

– উত্তর কোনটা?

– স্মৃতি হৃদয়েই থাকে, গোপনে-নিভৃতে, চিহ্ন সেগুলোকে উসকে দেয়!

– এভাবে ভাবিনি তো! আচ্ছা, এটার মানে কী – ‘কেন বসন্তে ফোটে সব প্রগাঢ় রঙিন ফুল, লাল কিংবা হলুদ/ আর শরতে ফোটে সাদা ফুলেরা?’

– মানে হলো, একেক ঋতুর রং একেরকম।

– বসন্তের রং কী?

– লাল আর হলুদ।

– শরতের রং সাদা?

– হ্যাঁ।

– তাহলে বর্ষার রং?

– সবুজ।

– হেমন্তের?

– অফ হোয়াইট। এটার বাংলা জানি না।

– শীতের?

– নীল।

– আর গ্রীষ্মের?

– ছাইবর্ণ, মেঘরংও বলতে পারো।

– ইস! সব তোমার বানানো।

– বলাই বাহুল্য। তোমার কাছে অন্য রঙেরও মনে হতে পারে।

– তা হবে কেন? একইরকম হওয়ার কথা না?

– উঁহু। একেকটা ঋতু যার কাছে যে রঙে ধরা দেয়, তার কাছে সেরকম।

অবন্তির মুখে এখন হাসি। ঝলমল করছে আনন্দে। বললো, দেখেছ, এতকাল ধরে আমরা পরস্পরকে চিনি, অথচ আজকের দিনের মতো আর কোনোদিন এসব নিয়ে কথা আমরা বলিনি।

– প্রতিটা দিনই তো আলাদা।

– না, প্রতিদিন আলাদা নয়। জীবন যখন একঘেয়ে হয়ে ওঠে তখন প্রতিটি দিনকেই একরকম মনে হয়।

– তা অবশ্য ঠিক। আমি কেবল তোমার-আমার দিনগুলোর কথা বলছিলাম।

অবন্তি এখনো গাছটাকে জড়িয়ে ধরে আছে। কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলো, তারপর দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে বললো, জানো, এই গাছটার কাছে আমি কথা জমা রাখতাম।

– গাছের কাছে! ভীষণ অবাক হলো ঋভু।

– হ্যাঁ।

– কেন? গাছের কাছে কেন?

– গাছ যে মানুষের মতো নয়। ওরা খুব সহনশীল আর সব কিছু গ্রহণ করতে পারে। দেখ না, কী মায়া ওদের! ছায়া দিয়ে ঢেকে রাখে মানুষকে, আশ্রয় দেয় পাখিদের। মারো আর কাটো, কিচ্ছু বলে না। নিশ্চয়ই ব্যথা পায় ওরা, দুঃখও পায়, তবু প্রতিশোধ নেয় না। ফুল ফোটায়, ফল দেয়, ছায়া দেয়, যতদিন বাঁচে ততদিন অক্সিজেন দেয়, মরে গেলে কাঠও দেয়। যেন শুধু দেওয়ার জন্যই জন্মেছে ওরা, কিছু নিতে আসেনি।

– হুম, বুঝলাম। কিন্তু কী কথা জমা রাখতে ওদের কাছে?

– যে-কথা কাউকে বলতে পারতাম না, সেইসব কথা। মানুষের জীবনে অনেক গোপন কথা থাকে না? কাউকেই বলা যায় না এমন কথা?

– হ্যাঁ, তা তো থাকেই।

– আজকে তোমাকে সেরকম কিছু কথা বলবো।

– আমি কি গাছ হয়ে গেছি? – দুষ্টুমির সুরে বললো ঋভু।

– তা হয়তো হওনি। তবু আমি বলবো।

– কখন বলবে?

– বাসায় নিয়ে যাবে না আজকে?

– হ্যাঁ, তা তো নেবোই।

– তখন বলবো।

– আচ্ছা।

– এখন চলো, কিছু খেয়ে নিই। খিদে পেয়েছে।

– কোথায় খাবে? বাসায় না বাইরে?

– বাইরেই খাই, তারপর বাসায় যাবো।

ঋভু আজকে অবন্তির কোনোকিছুতেই আপত্তি করবে না বলে ঠিক করে রেখেছিল। নইলে বলতো, বাসায় চলো। চাচিকে রান্না করতে বলে এসেছি।

ফুলার রোড ধরে ফের হাঁটতে লাগলো তারা। অবন্তি মুগ্ধ চোখে দেখছিল সবকিছু, বললো, খুব সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া সবকিছু প্রায় আগের মতোই আছে, না?

– হ্যাঁ।

– থ্যাংক ইউ।

– কেন?

– এখানে নিয়ে আসার জন্য। এর আগে আমার মনেই পড়েনি জায়গাটার কথা। ক্যাম্পাসেও আসতে ইচ্ছে হয়নি। কেন বলো তো?

– আমি কী করে বলবো? হয়তো এখানে পরিচিত কেউ নেই বলে …

– না, তা হবে কেন? অনেককিছুই তো পরিচিত। ওই যে রেইনট্রিটা, এই যে ব্রিটিশ কাউন্সিল, এই দালানগুলো, এই রাস্তা …

– আমি মানুষের কথা বলছিলাম। পরিচিত কেউ আর নেই তো এখানে …

– আমার কী মনে হচ্ছে জানো?

– কী?

– মনে হচ্ছে, দীর্ঘদিন বাইরে থেকে আমি অনেক কিছু ভুলে গেছি। কিংবা টানটা হারিয়ে ফেলেছি। আবার যে ফিরে আসবো, সে-কথা কখনো ভাবিনি তো, হয়তো আমার অবচেতন মন তাই স্মৃতিগুলো ভুলিয়ে দিয়েছে। নইলে এতগুলো বছর এখানে কাটিয়েছি, একবারও আসতে ইচ্ছে করলো না কেন?

– হতে পারে। আমাদের তো অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। প্রকৃতিই ভুলিয়ে দেয়। নইলে তো স্মৃতির ভারে চাপা পড়ে জীবন শেষ হয়ে যেত আমাদের।

অবন্তি আর কিছু বললো না। রেস্টুরেন্টে বসে তেমন কিছু খেলও না। কেমন নীরব হয়ে গেছে ও, আগের মতো। ঋভুর খাওয়া শেষ হলে ও বললো, আমার ঘুম পাচ্ছে। বাসায় নিয়ে চলো। তোমার বিছানায় শুয়ে একটু ঘুমাবো।

– আচ্ছা ঠিক আছে। আগে গাড়িটা নিতে হবে, ওটুকু রিকশায় যাই?

– ওহ! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম গাড়ির কথা। আমার জন্য আজকে অনেক হাঁটতে হলো তোমাকে।

– থাক থাক আর ভদ্রতা দেখাতে হবে না। এমন কোনো যুদ্ধ করিনি।

– হুম। যুদ্ধ ছাড়াই রাজকন্যাকে পেয়ে গেছ। সেজন্যই এর মূল্য বুঝলে না।

– চলো তো। দেখবে মূল্য বুঝেছি কি না!

– খুব গরম হয়ে উঠেছ নাকি? দুষ্টুমির হাসি হেসে বললো অবন্তি।

– না হয়ে উপায় কী? এরকম উসকানিমূলক আবহাওয়া, তার ওপর উসকানিমূলক সুন্দরীর সান্নিধ্য …

– থাক থাক আর বলো না। পুড়ে যাবো। তার আগেই আগুন নেভাও।

বাসায় গিয়ে ঋভু প্রথমেই চাচিকে জানালো, তারা খেয়ে এসেছে। কিছু লাগলে পরে জানাবে। তারপর অবন্তিকে নিয়ে ওপরে গেল। নিজের রুমে। অবন্তি গিয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়, আহ্ আরাম, বলে স্বস্তি প্রকাশ করলো, তারপর ঋভুকে ডাকলো, এসো।

ঋভু গিয়ে জড়িয়ে ধরলো অবন্তিকে। চুমু খেলো ঠোঁটে, মুখ ঘষলো বুকে। অবন্তি ফিসফিসিয়ে বললো, একটু পর।

– কেন? – অবাক হয়ে বললো ঋভু।

– কিছু কথা বলবো তোমাকে।

– এখনই বলতে হবে?

– হ্যাঁ। একটু হুইস্কি আনবে?

– এই অবেলায় হুইস্কি খাবে!

– একদিন খেলামই না হয়।

– আচ্ছা, আনছি।

হুইস্কি, পানি, গ্লাস আর বাদাম সাজিয়ে নিজেই ট্রে নিয়ে এলো ঋভু। অবন্তির হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে নিজেও নিল। অবন্তি বিছানায় বসে আছে, দেয়ালে ঠেস দিয়ে, ঋভু একটা চেয়ারে। দ্রুত প্রথম পেগ শেষ করে আবার চাইলো অবন্তি।

– এত তাড়াতাড়ি খাচ্ছো কেন?

– দাও না! এত প্রশ্ন করো কেন?

ঋভু আবার দিলো। কোনো কারণে অবন্তি খুব অস্থির হয়ে আছে, পরিষ্কার বুঝতে পারলো ঋভু। সম্ভবত এমন কিছু ও বলতে চায় যা বলা খুব সহজ নয়। কথাগুলো বলার জন্য হয়তো নিজেকে কিছুতেই তৈরি করতে পারছে না, আর সেজন্যই সহায়তা নিতে হচ্ছে অ্যালকোহলের।

পরপর তিন পেগ খাওয়ার পর কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো অবন্তি, তারপর ফের শুয়ে পড়লো, হাত বাড়িয়ে ডাকলো ঋভুকে, এসো। ঋভু এবার গভীর মমতায় আলিঙ্গন করলো অবন্তিকে, কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো, কী হয়েছে তোমার?

– কিছু হয়নি। আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।

– বলতে কষ্ট হচ্ছে? কষ্ট হলে বলার দরকার নেই।

– কষ্ট না, ভয় হচ্ছে।

– ভয়? কিসের ভয়?

– যদি আমাকে ঘৃণা করো! যদি আমাকে না নাও!

– কী যে বলো! ঘৃণা করবো কেন?

– যদি সেরকমই কিছু বলি!

– অতো ভেবো না তো! আমার মধ্যে ঘৃণাটৃণার ব্যাপারটা কম, প্রায় নেই বললেই চলে।

– জানি।

– তাহলে বলো।

– ওই যে কবিতার লাইনগুলো বলছিলাম, ওগুলো একজন লেখকের লেখা। নাম বললেই চিনবে, বলতে চাইছি না।

– আচ্ছা, ঠিক আছে, নাম বলতে হবে না।

– ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়, যখন তোমার সঙ্গে আমার প্রেম হয়-হয় ভাব, তখন উনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল।

– আচ্ছা।

– খুবই সুদর্শন একজন মানুষ ছিলেন, লেখক হিসেবে খ্যাতিও ছিল, আমি তাঁর মুগ্ধ পাঠক ছিলাম।

– তারপর?

– পরিচয়ের পর ধীরে ধীরে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। প্রায়ই ফোনে কথা হতো, দেখাও হতো এখানে-ওখানে।

– আচ্ছা!

– একদিন আমাকে বাসায় নিমন্ত্রণ করলেন তিনি। আমি খুব সহজ মনেই গেলাম।

– হুম।

অনেকক্ষণ চুপ করে রইলো অবন্তি। ঋভু তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে, বুঝতে পারলো, অবন্তি খুব কাঁপছে। একসময় ও বললো, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। ঘুরে ঘুরে উনার বাসা দেখছিলাম, প্রচুর বই বাসায়, সেগুলো দেখছিলাম, উনার লেখার টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলাম, ওরকম টুকরো টুকরো অনেক লাইন লেখা। উনি কবি ছিলেন না, ওগুলো যে কবিতা তা বুঝতেও পারিনি। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আমি ওরকম একজন বিখ্যাত মানুষের বাসায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি, বিশ^াসই হচ্ছিল না।

– বাসায় আর কেউ ছিল না?

– উঁহু। স্ত্রীর সঙ্গে উনার ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল।

– ও! তারপর?

– কখন যে উনি পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন টেরও পাইনি। সত্যি বলতে কী, বাধাও দিইনি। সেদিনই আমার প্রথম সঙ্গমের অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

ঋভু কিছু না বলে অবন্তির বুকের আঁচল সরালো, ব্লাউজের বোতাম খুলে বুকে নাক ডুবিয়ে দিলো। অবন্তি এবার বাধা দিলো না। কিছুক্ষণ পর ঋভু বললো, এই কথাটা বলতে এত ভয় পাচ্ছিলে?

– না, আরো আছে।

– বলো, শুনি।

– আমার কেমন যেন নেশা ধরে গিয়েছিল, শরীরের নেশা। প্রায়ই যেতাম উনার বাসায়, সপ্তাহে অন্তত দুদিন। মাস চারেক এভাবে তার কাছে গিয়েছি, মিলিত হয়েছি।

– তখন আমি কোথায় ছিলাম?

– তুমি নিয়মিত আসতে না ক্যাম্পাসে। কেমন যেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে। একবার শুনলাম তুমি নেপাল থেকে ঘুরে এসেছ। আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করিনি।

– ও! সেই সময়টা! তারপর কী হলো?

– একসময় আমি বুঝতে পারলাম, আমি কনসিভ করেছি!

– ওহ! তাহলে তো ভালোই বিপদে পড়েছিলে। কী করলে তারপর?

– উনাকে বললাম। টেস্ট-ফেস্ট করে দেখা গেল আমার আশঙ্কা মিথ্যে নয়। উনি বললেন, আমাকে বিয়ে করতে চান। আমি রাজি হলাম না।

 – কেন? বিখ্যাত একজন লেখক …

– তাতে কী? আমি তো তার সঙ্গে স্থায়ী সম্পর্কের কথা ভাবিনি। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে।

– তখন তো বলোনি!

– হ্যাঁ বলিনি। বলার সাহস পাইনি। এত বড় একটা ব্যাপার চেপে গিয়ে তোমার সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে মন সায় দেয়নি। তবে তুমি যদি বলতে কিছু, আমি সবকিছু খোলাখুলিই জানাতাম, আজকে যেমন জানালাম।

– হুম। কিন্তু ওই সংকটটা কাটালে কী করে?

– উনিই একটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানেই অ্যাবরশন …

– ও! তারপর?

– তার আর পর নেই। ওটাই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আর কোনোদিন দেখা করিনি, যোগাযোগও করিনি।

– এটুকুই?

– হ্যাঁ।

– বলতে এত ভয় পাচ্ছিলে কেন?

– আমাকে ঘৃণা হচ্ছে না তোমার?

– না! ঘৃণা হবে কেন?

– আমি যে তোমাকে লুকিয়ে ওরকম একটা সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম …

– শোনো, মানুষের জীবনে বহু ধরনের ঘটনা ঘটে। জীবন তো আর সরলরেখা নয়। কত আঁকাবাঁকা পথ পেরোতে হয় জীবনে। এ নিয়ে এত ভাবলে চলে?

ঋভু ভাবছিল, এই ঘটনা নিয়ে সুসান এত শঙ্কিত, তাহলে ও যদি শোনে আমার সব কথা, পারুলের কথা, আরিয়ানার কথা, কীভাবে নেবে? বলবে নাকি সব? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলবে। তবে, আজ নয়। একদিনে এত কনফেশন প্রাণে সইবে না।

– তুমি সেদিন যেভাবে আদর করেছিলে আমাকে, আজকে সেভাবে পারবে? – হঠাৎ বললো অবন্তি।

– পারবো না কেন?

– এসব জানার পর তোমার অন্যরকম অনুভূতি হবে না? মনে হবে না যে এই মেয়েটা অপবিত্র!

– বোকা মেয়ে! এই দ্যাখ তোকে কীভাবে আদর করি!

ঋভু একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়লো যেন, একটানে খুলে নিল শাড়ি-ব্লাউজের আবরণ। তখনো বিকেলের আলো মরে যায়নি। যদিও দরজা বন্ধ, জানালায় পর্দা টানা, তবু মৃদু আলো ছড়িয়ে আছে ঘরজুড়ে। সেদিন রাতের অন্ধকারে যা দেখেনি ঋভু, আজ দিনের আলোয় দেখে নিল। অবন্তির নিরাভরণ শরীরে দেখলো কোজাগরী পূর্ণিমার আলো। এত সুন্দর, এত সুন্দর! অবিশ্বাস্য। পোশাকের আড়ালে এই রূপ ঢাকা পড়ে থাকে, সামান্যই বোঝা যায় – কী আছে ভেতরে। চুম্বনের ঝড় তুলে আগ্রাসী ভঙ্গিতে ওকে দখল করে নিল ঋভু। অবন্তি এত চমৎকার সাড়া দিলো যে মিলনটা হয়ে উঠলো শব্দমুখর, উত্তেজনার তুঙ্গে পৌঁছে যেতে সহায়তা করে সেইসব মধুর শব্দ।

উত্তেজনা শেষ হলো একসময়। দুজনের শরীর-মনে নেমে এলো প্রগাঢ় প্রশান্তি। এসির ঠান্ডা হাওয়ার ভেতরে ঘেমে-নেয়ে উঠেছে দুজনেই, তবু পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে রইলো তারা।

একসময় অবন্তি বললো, তুমি একেবারে ডাকাতের মতো। স্বর্বস্ব লুটে নাও।

– পূর্ণেন্দু পত্রীর কবিতার লাইন মনে হচ্ছে!

– হলোই না হয়। আমাদের সময়ে তো তাঁর কবিতা মুখে মুখে ফিরতো।

– তোমার সংশয় কেটেছে?

– হ্যাঁ। একদম। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে আর নেবেই না।

– বোকা মেয়ে। আমি কি তোমার কাছ থেকে কুমারীত্ব চেয়েছি?

– কী চেয়েছ তাহলে?

– যা চেয়েছি তা পেয়েছি।

– কী পেলে?

– তীব্র, বন্য, আবেগমুখর, উত্তেজনাপূর্ণ প্রেম।

অবন্তি মিষ্টি করে হাসলো। বললো, আজকে কি এটুকুই?

– আরে না। সহজে ছাড়ছি না তোমাকে।

– আচ্ছা, ছেড়ো না। আমিও সহজে যেতে চাই না। দাও আরেকটু হুইস্কি দাও।

– আবার খাবে?

– হ্যাঁ। ড্রিংক করে কখনো এসব করিনি। আজকে পুরো ব্যাপারটাই অন্যরকম লাগছে। না করো না।

অবন্তির সঙ্গে ঋভুও নিল, বসলো বিছানায় গিয়ে, দেয়ালে হেলান দিয়ে। তখনো দুজনেই নগ্ন, কাপড়চোপড় পরার কথা মনেই হয়নি। অবন্তি বসলো ঋভুর কাঁধে মাথা রেখে। ঋভুর মনে হলো, এই মেয়েটা খুব দুঃখী, তার চেয়েও দুঃখী। তার কেউ নেই আর ওর সবাই থেকেও নেই। বারবার ও কাউকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে, হয়তো কিছুদিন ধরে রাখতেও পেরেছে, তারপর হাত ফসকে বেরিয়ে গেছে। একেবারে আমার উল্টো স্বভাবের – ভাবলো ঋভু। আমি কাউকেই আঁকড়ে ধরিনি, ধরতে চাইনি। সেই ছোটবেলায়, নীলুকে কবরে নামাতে দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম, কেউ থাকে না, থাকার নিয়ম নেই।

হঠাৎ খেয়াল করলো ঋভু, অবন্তির কোনো সাড়াশব্দ নেই। হাতে ধরা গ্লাসটা কাত হয়ে আছে। সাবধানে গ্লাসটা ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের গ্লাসসহ সাইড টেবিলে রেখে অবন্তিকে শুইয়ে দিলো সে। অবন্তি ঘুমিয়ে পড়েছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। ওর সারা গায়ে হাত বুলাতে লাগলো ঋভু, যদি ঘুমিয়ে না থাকে, যদি নেশার ঘোরে থাকে, তাহলে এতেই সাড়া দেবে। কিন্তু হাত বুলাতে বুলাতে আবার উত্তেজনা ফিরে এলো শরীরে। কী করা যায়! অবন্তির তো কোনো হুঁশই নেই। ওর স্তন দুটো মুঠোয় পুরে নিল সে, চাপলো বেশ কিছুক্ষণ। না, সাড়া নেই। ঘুমিয়েই গেছে। থাক, ঘুমাক কিছুক্ষণ, জাগলে ফের হবে, ভেবে নিজেও শুয়ে পড়লো ওর পাশে। গভীর মমতায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো ওর সারা শরীরে।

বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ঘুম ভাঙলো অবন্তির, দেখলো, তখনো হাত বুলিয়ে আদর করছে ঋভু। তার ঠোঁটে ফুটে উঠলো মৃদু, লাজুক, রহস্যময় হাসি। (চলবে)