আদম সুরত : মানুষের স্বরূপ অন্বেষণ

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চে প্রদর্শিত আদম সুরত নাটকে প্রতীকী শিল্পব্যঞ্জনায় বালুধূম গ্রামের সমাজবাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের স্বরূপ খোঁজার এক চেষ্টা করেছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত নাট্যদল ‘তাড়ুয়া’। রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন বাকার বকুল, যিনি নাট্যাঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত। সমাজের মানুষ চরিত্র কেমন, জীবন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তার চেহারা বা রূপরেখা অন্বেষণ যেন নাটকটির অভীষ্ট। দু-দফায় নাটকটির পরপর প্রদর্শনীগুলিতে জনতার উচ্ছ্বসিত অংশগ্রহণ এর গুরুত্ব সপ্রমাণ করেছে। নাটকটিকে বর্তমান সমাজের সংঘাতপূর্ণ বাস্তবতায় নিজেকে বোঝাপড়ার এক অনবদ্য দলিল বলা যেতে পারে।

বাকার প্রথমে ফরিদপুর থিয়েটার ও পরে স্বপ্নদলের ত্রিংশ শতাব্দী নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে নাট্যজগতে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। অভিনয়ের পাশাপাশি নির্দেশনায় তাঁর কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন, যা তাঁকে সেই কৃতিত্ব এনে দেয়। বর্তমানে তিনি প্রাচ্যনাট নাট্যদলের সদস্য হয়ে নাট্যচর্চা করলেও পাশাপাশি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘তাড়ুয়া’ নামে পেশাদার নাট্যদল।

আদম সুরত নাটকটি তাড়ুয়া নাট্যদলের দ্বিতীয় প্রযোজনা। ‘আলী যাকের নতুনের উৎসব’ শিরোনামে আলী যাকের নাট্যোৎসবের জন্য অনুদানে নির্মিত হয় এ-নাটক এবং এতে এর উদ্বোধন প্রদর্শনী হয়। এখন পর্যন্ত নাটকটির আটটি সফল প্রদর্শনী হয়েছে। 

কবরে সদ্য শায়িত হিসাবুলের প্রশ্নে মানবজীবন নতুন এক পরিপ্রেক্ষিতে ফুটে ওঠে আদম সুরত নাটকে। নাটকটি সমাজবাস্তবতার বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনার সমষ্টি, যার কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবুল। এ-নাটকে হিসাবুল কবরে অপেক্ষা করতে থাকে মুনকার-নাকিরের তিন প্রশ্নের। অপেক্ষারত মুহূর্তে একে একে প্রশ্নবিদ্ধ হতে থাকে নিজে। আত্মজিজ্ঞাসা সামাজিক জিজ্ঞাসায় রূপান্তরিত হয়। সামাজিক দোলাচল, রাজনৈতিক নিষ্পেষণের বিকলাঙ্গ এক রূপরেখায় যেন বিধ্বস্ত মানবতা। আবার মুক্তি-অন্বেষী মানুষও নিস্পৃহ বা আক্রমণের শিকার – এমন এক জনপদের ক্ষয়িষ্ণু প্রতিচ্ছবি এই নাটক।

তিনদিকে দর্শকবেশিষ্ট মধ্যমঞ্চে নাটকটির উপস্থাপনা। আখ্যানভাগে দেখা যায় – লাশ দাফন করে মুসুল্লিগণ চলে যাচ্ছেন। কবরে শায়িত হিসাবুল ফেরেশতার সওয়াল-জবাবের জন্য জেগে উঠছে এবং নিজেকে খুঁজতে শুরু করে। হিসাবুল আসলে কে? সমাজের সংঘাতময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা এক সত্তা। হিসাবুল তার শৈশবের বেড়া ওঠা দিনগুলি দেখতে পায়। দেখতে পায়, কুকুর হত্যার জেনোসাইড কিংবা লাঞ্ছিত শিক্ষকের অবদমিত কুণ্ঠিত মুখ। শিক্ষকের দেশান্তরী হওয়ার মর্মন্তুদ স্মৃতি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। গাভিন গরুর বিচ্ছিন্ন মাথা দেখে আঁতকে ওঠে তার মন। সমাজের নৃশংস বাস্তবতায় বেড়ে ওঠা হাসিবুলের জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাবটা কী? তার জীবনের পরিক্রমার মধ্য দিয়ে মঞ্চে ভেসে উঠতে থাকে লখাই নদীর তীরে পড়ে থাকা কাকার লাশ, বাল্যবন্ধু বাকিবিল্লাহর উন্মাদ হয়ে যাওয়া। শিক্ষার পরতে পরতে যে বলাৎকারের নোংরা দৃশ্য থাকে তা উন্মোচিত। আরো দেখা যায়, মর্গে পড়ে থাকা মৃত তরুণীর উদরজাত নিষ্প্রাণ ভ্রূণ, লাশকাটা যুবকের জীবনের হিসাব।

হিসাবুল চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত-অসহায়। পিতা মফিদুলের একহাত কাটা গেছে পাটকলের মেশিনে। বাজারে ছমির কসাইয়ের মাংসে মানুষের পায়ের বুড়া আঙুল খুঁজে পাওয়া যায়। ভয়কাতুরে সোনামুখী রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে ঘুমায়। তলপেটে তার অসহ্য যন্ত্রণা। কর্মসন্ধানে বিদেশে যাওয়ার পথে কবরে শায়িত হয় হিসাবুল। নিজের প্রতারণাও যেন রক্তচক্ষু হয়ে ভেংচে ওঠে। বালুধূমের ঘোরের মধ্যে এমন করে জীবন হাতড়ায় হাসিবুল।

নাটকের গল্পটি অন্ত্যভাগ থেকে শুরু। নাটকের প্রধান চরিত্র। হিসাবলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনজন। শৈশবের হিসাবুল তানভীর হোসেন, কৈশোরের খালিদ বিন নাসির, যুবক হিসাবুল চরিত্রে খায়রুল আলম হিমু। তিনজনের অভিনয়ই অত্যন্ত বাস্তবঘনিষ্ঠ। চরিত্রের পোশাক বাস্তববাদিতার সঙ্গে সাজেস্টিক। হিসাবুল
হিসাব-নিকাশ মেলানোর মধ্য দিয়ে নিজের সুরত বা রূপকে দেখতে পায় সে। আর সে রূপরেখা ধরেই মানবজীবন তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।

বালুধূম শহরতলি গ্রামের মানুষগুলি যেন প্রতীকী চরিত্র। হিসাবুলের পিতা মফিদুল চরিত্রে অভিনয় করেছেন রূপক দাশ। মফিদুল মনে করে, শ্রমিকরা মানুষ না। সমাজে শঠতা, প্রতারণা যেন ভদ্র সেজে বাস করে। শৈশবে যে-ছবি হিসাবুলের মনে আছে তা যেন কুকুরের ঝগড়া কিংবা সঙ্গম দেখার মতো বাস্তবতায় নিমজ্জমান। কুকুর প্রতীক মাত্র। সহপাঠী হোসনে আরাকে শৈশবেই হতে হয় নারী পরিচয়ের শিকার। হোসনে আরা চরিত্রে মৃত্তিকা মাটির অভিনয়ে দর্শক বুঝতে পারেন শিক্ষাব্যবস্থার মর্মমূলে আছে অত্যাচার-নৃশংসতা। তাকে বেত্রাঘাতের জন্য কামিজ উঁচু করে তুলে ধরতে বললে যখন তা করে না, তখন বেয়াদবির শাস্তি হিসেবে শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাতাড়ি দাগ পড়ে যায় –

: রোল চার।

: প্রেজেন্ট স্যার।

: কেমন আছে হোসনে আরা?

: হুসনার তো জ¦র আসছে, ১০৩ ডিগ্রি।

কথাটি সমস্বরে নামতা পড়ার মতো একযোগে বলে

শিক্ষার্থীরা। হতবাক হয়ে যায় শিক্ষক। ঘুণে-কাটা কাঠের মিহি গুঁড়ো হাতের আঙুলে পিষতে পিষতে যেন
অস্ফুট-স্বরে ধ্বনিত হয় –

: টর্চার ক্যাম্প।

নাটকটিতে গ্রামীণ নানা ঘটনা আছে। বালুধূম গ্রামে মানুষের মানবিক কোনো মর্যাদা নেই। কুকুর-ছাগলের মতোই মানবজীবন। আবার রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়ানো ধর্মীয় গোঁড়ামি। মোমেন মাস্টার চরিত্রে দিপু রহমান বলেন –

: নাফরমানের বাইচ্চারা কুত্তা পোষে।

: এই কুত্তা আগে দেখি নাই।

: কালা রঙের – গলার নিচে সাদা।

: বেওয়ারিশ মাস্টার সাব – পোষা না।

: বেওয়ারিশ আর ওয়ারিশে ফারাক আছেনি কোনো? কুত্তা না পুষলে কুত্তা আসে?

শৈশবেই হোসনে আরাকে কালো বোরকা পরে উপস্থিত হতে হয় স্কুলে। স্কুলের শিক্ষক কিংবা এলাকার কাউন্সিলর ওসমান খন্দকারের কাছে স্কুলের ইউনিফর্মের চেয়ে বোরকার মর্যাদা বেশি। এলাকায় কুকুরের কামড়ানো বেড়ে যায়। আতংকিত হয়ে ওঠে জনপদবাসী। ঠিক তখন দেখা যায় আরেক ঘটনা। সমস্ত গ্রামের মানুষ ধর্ম অবমাননাকারীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মসজিদ থেকে ঘোষণা আসে। শিক্ষক কমলকান্তিকে তখন চারপাশে কোথাও দেখা যায় না। বিক্ষুব্ধ জনপদে ওসমান খোনকার যেন ভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

: বাড়াবাড়ি কইরা ফেলছে খুনকার সাব।

: মাস্টারে কী কম গ্যাছে।

: আল্লাহ-খোদা নিয়া বাজে কথা বলছে।

…  …  ….

: খুনকার সাবে হুনছে …

: শোধ নিল।

: কিসের?

: খুনকারের ইটভাটা বন্ধ আছিলো ক্যান?

: আদালত সমন জারি করলো তাই।

: মামলাখান কেডায় দিছে?

বালুধূমপুর গ্রাম প্রতারণা, স্বার্থপরতা আর সংঘাতে আকীর্ণ। হিসাবুলের বন্ধু বাকি বিল্লাহ তার মাদ্রাসার শিক্ষকের দ্বারা বলাৎকারের শিকার। অপরদিকে পাঁচটি শাবকের মৃতদেহ একসঙ্গে জড়ো করে কোদাল হাতে বসে থাকে বৃদ্ধ উমেদালী। বাকি বিল্লাহ চরিত্রে অভিনয় করেছেন সাগর মাহমুদ। স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রাভিনয়। বাকিবিল্লাহ উন্মাদ সেজে থাকে কারণ সে মাদ্রাসায় পড়তে চায় না। তার পায়ুপথে অসুখ। সারাক্ষণ পাক সাফ থাকতে ইট নিয়ে ঘোরে। বাকিবিল্লাহ দু-একবার হুজুরের মাথাও ফাটিয়েছে। এরই মধ্যে বালুধূমের মানুষ লখাইর পারে ভিড় করে। বড়শির ছিপসদৃশ তর্জনী খোলা হাত টান করে লাশের স্থান শনাক্তে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ-লাশ সেই লাশ নয়; এ যেন এই সমাজের উল্টো প্রতিচ্ছবি। আরেকদিকে মেডিক্যাল কলেজ যেন লাশকাটার উৎসবে মেতে থাকে। শহিদুলের মরদেহ

ময়নাতদন্ত-পরবর্তীকালে বালুধূমে ফেরে বটে; কিন্তু লাশকাটা যুবকের মুখে শোনা যায় সেই রাতের বর্ণনা –

: খুনটা না করলেও পারতেন।

: কিসের কথা কস – রাত অনেক হইছে – ঘুমা গিয়া।

: ঘুম তো আসে না – চোখের সাথে বেইমানি করে – আপনার মতো।

: হিসাব।

: ধমকটা বড় চাপায় দিলেন যে। লোক জানাজানির ভয় আছে তাইলে।

: সে ডাকাইতের গুলিতে মরছে। বেবাকে জানে। পোস্টমর্টেমেও তো প্রমাণ হইছে।

বাইরের ভদ্রতার আড়ালে ভেতরে খুনি লুকিয়ে থাকে, তা কী জানে মানুষ? গ্রামীণ প্রচলিত কিছু অশিষ্ট শব্দ ও বাক্য ব্যবহৃত হয়েছে নাটকে। মজ্জেম ভাই স্থানীয় সাংসদের খাস লোক। মজ্জেম ভয়ংকর খুনি। লোকে বলে তার পেশা রাজনীতি। মজ্জেম ভাই চরিত্রে আহমেদ অপুর অভিনয় সেই ভয়ংকরতাকে উসকে দেয়। ছমির কসাইকে বাধ্য করে খুন করতে। তার বিক্রির জন্য রাখা মাংসের সঙ্গে খুন মিশে গেছে। নির্দেশক মেটাফরিক বা রূপক নানা ইঙ্গিত করেছেন নাটকে। আনু ভাই চরিত্রে শাহজাদা সম্রাট চৌধুরী শ্রমিক লিডার – হয়তো মরতে চায় না। অপরদিকে বিদায় নিতে না নিতে ন্যাংটা ফকির – কী এক জিদ চাপে – আলতার শিশিটারে চাপ দিয়া ভাঙে হাতের মুঠোয়।

সোনামুখী এক রহস্যময়ী চরিত্র। এক ধরনের জাদুবাস্তবতা আছে এ-চরিত্রের উপস্থাপনে। সোনামুখী চরিত্রে আনন্তি হোসেনের অভিনয় যেন মায়াবী এক আবেগে ঘিরে রাখে। হিসাবুলের দু-গ্রাম পরেই তার বাড়ি। হিসাবুল চায় সোনামুখীকে। কানাচাঁনও সোনামুখীকে পছন্দ করে। কানাচাঁন তার আগের বউকে মেরে আড়তে বেঁধে রেখেছিল। মুচাইরদি গ্রামের সোনামুখীর বাড়ির বন্ধ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে হিসাবুল। তখন মধ্যরাত, টোকাটুকি এবং কোকিল ও শেয়ালের ডাক।

: সোনামুখী ঘুম গ্যাছেন নাকি, আমি হিসাব।

এবার জানালার এক পাল্লা খোলে –

: দরজা খোলেন।

: বাজান দরজার সামনে ঘুমায়। খোলা যাবে না।

: দরজার সামনে ঘুমায় ক্যান? আর জায়গা নাই?

: চোর পাহারা দেয়।

হিসাবুল কি সত্যি ভালোবাসে সোনামুখীকে? চোর হিসেবে হিসাবুল ধরা পড়লেও কৌশলে সোনামুখীকে নিয়ে পালায়। ভালো না বাসলে পালায় কেন? গল্পের মধ্যে যেন আরেক গল্প স্থান পায়। মাজারে বসে সোনামুখী তার আগের বিয়ের বাসররাতের গল্প শোনায় – যে-রাতে সে তার স্বামী বরপুত্রের পুরুষাঙ্গ কেটে দিয়েছিল। একধরনের বিকৃত বা পারভার্টেড মনোজগৎ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। নিজ হাতে সোনামুখীর ঘর ভাঙার নৃশংস এই ঘটনা শুনে হিসাবুল গোপনে ঢেকুর গেলে।

মাজারে সোনামুখীকে রেখে সে তার গহনা নিয়ে পালায়। চোরাইপথে পাড়ি দিতে গিয়ে থাইল্যান্ডে এসে তার ঘটে জীবনের পরিণতি। এসব কথা আওড়াতে আওড়াতে ঘর্মাক্ত মৃত হিসাবুল নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে, যে-সাদা শার্ট পরে সে দূরদেশের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল, সেটি এখনো তার গায়ে। কবরের অন্ধকারে শার্টটিকে এতক্ষণ কাফনের কাপড় বলে ভ্রম হয়েছিল তার। তাহলে কী সঠিক নিয়মে তার দাফন হয়নি? হিসাবুলের জীবনের দায় কি হিসাবুলের একার। হিসাবুল অপেক্ষা করতে থাকে মুনকার ও নাকিরের প্রশ্নের।

হিসাবুল অবশ্য প্রকৃতপক্ষে মারা যায়নি। সে মনে করেছিল, সে মারা গেছে। গণকবরে সবার সঙ্গে তাকে দাফন করা হয়েছিল। নাটকে বিচিত্র সব ঘটনা ও চরিত্রের সম্মিলন নানা ইঙ্গিতময়তা তৈরি করেছে। নাট্যকার-নির্দেশক বাকার বকুল বলেন, ‘বিচ্ছিন্নভাবে কিছু দৃশ্যকল্পের সমন্বিত রূপ ‘আদম সুরত’। দৃশ্যগুলো নৃশংসতার, নির্মমতার আবার দায়বদ্ধতারও বটে। আমাদের গা ঘেঁষে প্রত্যহ জন্ম নেওয়া ঘটনাগুলোই বিষয়বস্তুর উৎস। ধারাবাহিক কোনো গল্প কিংবা ব্যাকরণগত নাটকীয় দ্বন্দ্বের চেয়ে সংবেদনশীল প্রশ্নই এখানে গুরুত্বপূর্ণ। … নির্দেশনার ক্ষেত্রে ‘আদম সুরত’-এর প্রেক্ষাপট নির্বাচনে আমার মনোযোগ রাজনৈতিক-সামাজিক অসংগতি চিহ্নিতকরণে। বালুধূমবাসী অশিক্ষার ছাঁচে বেড়ে ওঠা মগজপচা এক জনসমষ্টি। সংখ্যালঘু মুক্তচিন্তাশীল কথা বলা মানুষ এখানে নিঃসঙ্গ-অস্পৃশ্য এবং আক্রমণের শিকার। উদ্দেশ্যমূলকভাবেই আমরা উল্লিখিত বিষয়াদি নাট্যমঞ্চে জুড়ে দিতে কিংবা পুরে দিতে চাই। যে-দর্শকের জন্য নাটক, সেও এই প্রেক্ষাপট রচনার চরিত্রসমূহ, অসুস্থ একটি সমাজ নির্মাণে তার ভূমিকা।’ (সুভ্যেনির)

বর্ণনাত্মক ধারায় আদম সুরত নাটকটি উপস্থাপিত। উপস্থাপনে নানা নিরীক্ষা লক্ষণীয়। সাজেস্টিক উপায়ে কবরকে মূল ফোকাস করে সেট নির্মাণ করা হলেও তা কবরের চেয়ে মাটির নিচের বাঙ্কার বলেই বেশি মনে হয়েছে। হয়তো এটি থাইল্যান্ডের গণকবর। থাইল্যান্ডের দ্বীপের পরিবেশ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে গাছের সাজেশন। নাট্যকার একটি কবরের সাজেশন থেকে প্রতীকী অর্থে সর্বজনীন রূপরেখা বিনির্মাণ করতে চেয়েছেন। বিশেষ থেকে সাধারণে যেতে চেয়েছেন। নাটকে কোরিওগ্রাফি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দৃশ্য নির্মাণগুলি অনন্য ভালো লাগার স্পর্শ ছুঁয়ে দেয়। রং, রূপ ও আঁধারের অনবদ্য কল্পরূপ। গাছের দরজা, পাটকল প্রভৃতি দৃশ্যপটের শারীরিক ভঙ্গিমা, ক্রিয়া ও কোরিওগ্রাফির নির্মাণগুলি অপূর্ব সৌন্দর্যবোধে দর্শককে নাড়া দেয়। হিসাবুলের স্মৃতিতে  ঘটনাগুলি বিনির্মিত বলে এই দৃশ্যগুলি অস্থায়ী।

পরিবেশনাটিতে রয়েছে নানা নাটকীয় মুহূর্ত। বিশেষত দীর্ঘক্ষণ ধরে মঞ্চে চলনশীল হিসাবুলকে শেষ দৃশ্যে বাঙ্কার বা কবরের মুখ খুললে যখন দেখা যায়, তখন সে গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে। তখনই দর্শক যেন ম্যাজিক দেখে। এ-নাটকে সংগীত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। শুরুটা ছিল ইসলামি ধর্মীয় আবহের মধ্য দিয়ে। মুর্দাকে কবরে শায়িত করার ‘মিনহা খালাক্বনা কুম..’ দোয়ার মধ্য দিয়ে। নানা দৃশ্য, নানা আবেগে বিভিন্ন ধরনের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগীতের ব্যবহার গল্পে প্রাণ সঞ্চার করেছে। আধ্যাত্মিক সুফিবাদীসহ নানা গানও ব্যবহৃত হয়েছে। ‘মনা দোষ দিবো আর কারে’, ‘আমি কোথায় পাবো তারে’, ‘আন ফাসেতে জপো নাম আল্লাহু আল্লাহু’, ‘তোমার লাইগা মন পাখিটা উড়ি উড়ি যায়’ দর্শক হৃদয়কে নাড়া দেয়। স্কুলের দৃশ্যে ‘ইশকুলে যাই ভাই ইশকুলে পড়তে’ র‌্যাপগান ব্যবহার করা হয়েছে। আবার বিয়ের দৃশ্যে ‘মায়ারে তুই মায়া’, ‘নুনেতে ভাতেতে রাখিবো সুখেতে’। জাহাজের দৃশ্যে ‘ভাসলো নোনা জলে তরী’। নাটকে গানগুলি আবহ সংগীত হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি, বরং চরিত্রই গানগুলি গেয়েছে।

আলো ব্যবহারে দৃশ্যগত ইমেজ তৈরিতেই মনোযোগ ছিল নির্দেশকের। নীল রঙের ব্যবহার পাওয়া যায় বেশি। নির্দেশক সম্ভবত জীবনসংগ্রামের কষ্টগুলি দেখাতে বেশি তৎপর ছিলেন। বিক্ষিপ্তরকম দৃশ্যাংশে যেন মঞ্চ ভরে তুলতে চেয়েছেন। নাটকটি সংলাপ-দ্বন্দ্বের চেয়ে বর্ণনা, ঘটনা ও নাট্যক্রিয়ায় অনবদ্য। কাহিনির ঘনঘটার চেয়ে একধরনের আর্তনাদ তৈরি হয়েছে নাটকে, যা দর্শকের মানবিক হৃদয়ের অতলকে স্পর্শ না করে পারে না।
আলো-আঁধারি পরিবেশনির্ভর নাটকের দৃশ্যপ্লট। কোনো সুনির্দিষ্ট চরিত্রকে ফোকাস করার চেয়ে নির্দেশক আবেগগত রূপ নির্মাণ করতেই প্রয়াসী ছিলেন। 

নাট্যকার-নির্দেশক নাটকে যেভাবে মানবস্বরূপকে খুঁজেছেন তা পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ায় নয়। দর্শন বা সমাজভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা নয়, বরং বাকার বকুল সচেষ্ট ছিলেন। শিল্পনির্মাণে সমাজবাস্তবতার ছোট ছোট স্কেচ নির্মাণ করেছেন। তাতে নাট্যীয় নানা উপকরণ প্রযুক্ত করেছেন। সামাজিক-রাজনৈতিক ঘূর্ণাবর্তে হিসাবুলের মধ্য দিয়ে মানুষের অস্থিতিশীল রূপ চিহ্নিত করেছেন। দৃশ্য নির্মাণে বৈচিত্র্যমুখী নানা প্রপ্স-মুখোশের ব্যবহার ভালো লাগা তৈরি করে। প্রপসগুলিতে যেমন শিল্পের ছোঁয়া আছে, তেমনি গল্প-চরিত্রের আবেগের নৈর্ব্যক্তিক ভাষা তৈরিতে অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকায় অবতীর্ণ। দুই ঘণ্টা ব্যাপ্তির এ-নাটকে এত নাট্যক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে মঞ্চে যে, দর্শকের চোখ কোনো মুহূর্তে সহজে সরে যেতে পারেনি। তবে নাটকে এত বেশি চরিত্র ও মুহূর্তের সমাগম ঘটেছে যে, কখনো কখনো মূল গল্পের বহমানতার চেয়েও কোরিওগ্রাফি বড় হয়ে উঠেছে। মঞ্চমধ্যে একটি কবরের সাজেশনের পাশাপাশি তিনদিকে দরজার সাজেশন। আর দরজার নিচেই কসাইয়ের দোকানের প্রতীকী রূপ। অভিনেতার মঞ্চে প্রবেশের পথও বৈচিত্র্যময়। অভিনয়, নৃত্য-গীত, কোরিওগ্রাফি ও প্রপসের বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহারের নানা মুহূর্তগুলি অনবদ্য, প্রাণবন্ত। অভিনয়-সংলাপ আরো সুনির্দিষ্ট হলে দর্শকের চিন্তাকে আরো গভীরে নেওয়া যেত। যদিও শেষ পর্যন্ত মৃত এক চরিত্রের অভিজ্ঞতায় এ-নাটকটির মানবীয় সুর দর্শকের আবেগকে স্পর্শ করে।