অশোক মিত্রের স্মৃতিতে ঢাকা

‘ঘোড়ায়-জিন-লাগানো সময়, এক দমকায় যেন ষাটটি বছর পেরিয়ে গেছে, তিরিশের দশকের গোড়ার দিকের সেই দিনগুলিকে তবু মনে হয় হাতে ধরা যায়। সম্ভবত ১৯৩২ সাল, সম্ভবত তার পরের বছর, হালে যারা বি-বা-দী-তে পর্যবসিত, সেই

বিনয়-বাদল-দীনেশের পীঠস্থান আমাদের ঢাকা শহর, উত্তেজিত গল্প, যা কিংবদন্তী হয়ে দাঁড়ায়; কী ক’রে মিটফোর্ড হাসপাতালের প্রাঙ্গণে লোম্যান না হাডসন সাহেবকে পর-পর তিনটি গুলি ক’রে বিনয় বসু ধীরে-সুস্থে রিভলভার পকেটে পুরলেন, রুমাল বের ক’রে মুখ মুছলেন, গুলির-শব্দের-সঙ্গে-সঙ্গে-জনমানবহীন ইসলামপুরের রাস্তা পেরোলেন, দেড়শো গজ হেঁটে পিকচার হাউসের দেওয়ালের কাছে পৌঁছুলেন, দেওয়াল টপকে ওপাশে
আগে-থেকে-দাঁড়-করানো সাইকেল চেপে উধাও হয়ে গেলেন, ছ-সপ্তাহ বাদে বিজয়ী বীরের ফের আবির্ভাব কলকাতায়, রাইটার বিল্ডিংয়ের করিডরের গরীয়ান ভয়ংকর যুদ্ধক্ষেত্রে। পরাধীন দেশের মুহ্যমান মফস্বল শহর, পৃথিবী জুড়ে আর্থিক মন্দা। আইন-অমান্য আন্দোলন কখনো একটু মাথা চাড়া দিচ্ছে, পরক্ষণে ঝিমিয়ে পড়ছে।’ এভাবেই অশোক মিত্র তাঁর পটভূমি গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন তাঁর শৈশবের মফস্বল শহর ঢাকাকে। তিনি ছিলেন একজন অর্থনীতিবিদ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের জ্যোতি বসু সরকারের প্রথম অর্থমন্ত্রী এবং রাজ্যসভার সদস্য। তাঁর জন্ম পুরান ঢাকায় ১৯২৮ সালের ১০ই এপ্রিল। দেশভাগের অব্যবহিত পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করে তিনি ও তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে যান। পরে উত্তর প্রদেশের বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর এবং নেদারল্যান্ডস থেকে পিএইচ.ডি করেন।

অশোক মিত্র শুধু একজন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ বা রাজনীতিবিদ ছিলেন না, ছিলেন বাংলা সাহিত্যের একজন খ্যাতিমান লেখকও। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাজউদ্দীন আহমদকে অশোক মিত্রই প্রথম নিয়ে যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। তখন তিনি দিল্লিতে ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা। আমরা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ও অধ্যাপক রেহমান সোবহানের জবানিতে জেনেছি, দিল্লিতে অশোক মিত্র কীভাবে পরম সমাদরে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন ভারত সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে। সেই সুবাদে ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের পক্ষে রেহমান সোবহানকে ইউরোপে পাঠানো হয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার চালানোর জন্য।

শৈশবের স্মৃতিচারণ করে অশোক মিত্র তাঁর আত্মজীবনী আপিলা-চাপিলায় লিখেছেন, ‘চেতনার উন্মেষ-মুহূর্তে
ভাসা-ভাসা এটুকু জানতে পেরেছি, আমাদের যে-পাড়ায় বাড়ি, তার নাম আর্মেনিটোলা। কে জানে কবে, হয়তো সপ্তদশ শতাব্দীতে, এক দঙ্গল আর্মেনি ব্যবসায়ী আমাদের শহরে উপনীত হয়েছিলেন, আমাদের পাড়ায় উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন। তাঁদের ইতিহাস পুরোপুরি হারিয়ে গেছে; শুধু স্মৃতির স্বাক্ষর হিসেবে থেকে গেছে আর্মেনিটোলা পাড়া এবং সে-পাড়ার পূর্ব প্রান্তে আড়াইশো-তিনশো বছরের পুরনো আর্মেনি গির্জা। আশ্চর্য, আমার মতো শিশুর চোখেও তার স্থাপত্য চোখ ধাঁধিয়ে দিত।’ তাঁর গ্রন্থ পটভূমির নিবন্ধ ‘নিরাশা, মীর আতা, বেচারাম’ থেকে জানা যায়, তাঁর বাড়ি ছিল চকবাজারের কাছে বেচারাম দেউড়িতে। মোড়ের বাড়ি হওয়ায় সে-বাড়ির দুটো ঠিকানা ছিল – চৌষট্টি বেচারাম দেউড়ি এবং তেরো নম্বর মিরাতার গলি। হয়তো কোনো এক মহল্লা সর্দার মীর আতার নামে ছিল সেই গলি। তবে পৌরসভার নির্বাচনে যে-বছর তাঁদের প্রতিবেশী বীরেন বসু জিততেন তখন গলির নতুন নাম হতো রজনী বসু লেইন। রজনী বসু ছিলেন বীরেন বসুর পিতা। তখন পৌরসভা নির্বাচনে ভোটার ছিলেন বাড়ির মালিক ও প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বাসিন্দারা। অশোক মিত্রের ভাষায়, ‘এই নামদ্বৈততার মধ্যে যে-সাম্প্রদায়িক চেতনার ইঙ্গিত ছিল, আমরা অবোধ শিশুরা তখন তার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে; চৌষট্টি বেচারাম দেউড়ি এবং তেরো নম্বর মিরাতার গলি একই বাড়ির দুই ঠিকানা সামলাতেই আমরা হিমশিম, মিরাতার গলির বিকল্প নাম রজনী বসু লেইন অতএব গোদের উপর বিষের ফোঁড়া।’

ঢাকা শহরে তখন রাস্তায় সাইকেল আর ঘোড়ার গাড়ি চলত। সারা শহরজুড়ে মোটরগাড়ি ছিল ‘একুনে বোধহয় মাত্র গোটা পঞ্চাশ’। তখন স্বদেশি আন্দোলনের সময়। মিরাতার গলির পঁচিশ-তিরিশটি বাড়ি থেকেই অন্তত
পঁচিশ-তিরিশ জন যুবক দেশের বিভিন্ন কারাগারে রাজবন্দি ছিলেন। অশোক মিত্র উক্ত নিবন্ধে লিখেছেন, ‘গরিব পরাধীন দেশে ওটুকুই পাড়াভিত্তিক অহংকার, স্বাধীনতা সংগ্রামে কোন পাড়া থেকে কতজন স্বেচ্ছাসেবক নাম সই করেছেন, কতজন আইন অমান্য ক’রে কিংবা পিস্তল নিয়ে ধরা প’ড়ে জেলে গিয়েছেন ইত্যাদি।’

পুরান ঢাকার সেই ছোট্ট গলিটাতে সে-সময় বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির বসবাস ছিল। অশোক মিত্রের বাড়ির উল্টো দিকে ছিল বিজয় বসুর বাড়ি, যিনি ডক্টর অটল-ডক্টর কোটনিসদের সঙ্গে চীন গিয়েছিলেন তিরিশের দশকে সেই দেশের লড়াকু-বিপ্লবী মানুষদের সহায়তা করার জন্য। পরে যিনি কিছু সময়ের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি বাংলা কমিটির কর্ণধার হয়েছিলেন। সেই গলিতেই বাস করতেন জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক প্রবোধরঞ্জন গুহ। যিনি অসহযোগ আন্দোলনের সময় জুতো পরা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় প্রবোধ গান্ধী। তাঁরই বড় ভাই রামকৃষ্ণ মিশনে যোগ দিয়ে হয়েছিলেন ভরত মহারাজ। বীরেন বসুর বাড়িতে ভাড়া থাকতেন পাবনা থেকে আসা উকিল নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী, যিনি ছিলেন সাহিত্যিক মণীশ ঘটকের শ^শুর, অর্থাৎ সাহিত্যিক মহাশে^তা দেবীর দাদু। সে-পাড়াতেই বাস করতেন প্রগতি পত্রিকার অমলেন্দু বসু ও চিত্রপরিচালক বিমল রায়। পাড়ার আরেক বাসিন্দা মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসক-অধ্যাপক পরেশ চক্রবর্তী, যিনি কর্কটরোগ-বিশেষজ্ঞ রণেশ চক্রবর্তী ও ‘মার্কিন বিশ^বিদ্যালয়াদি কাঁপানো জটিলতাকে আরো ঘোর জটিল ক’রে তোলা সমাজতাত্ত্বিক’ গায়ত্রী স্পিভাক চক্রবর্তীর পিতা।

আরমানিটোলার পাশেই জেলখানা। সেখান থেকে প্রতিদিন নতুন নতুন গল্প ছড়ায়। ঢাকার ছেলে অনিল দাস সেই জেলখানায় আটক। সেই অনিল দাস, যাঁর বোন লতিকা সেনকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কয়েক মাসের মধ্যে বিধান রায়ের পুলিশ কলকাতার রাস্তায় গুলি করে হত্যা করে। ঢাকা জেলখানায় অনিল দাসের ওপর ইংরেজ পুলিশের
অকথ্য-অবর্ণনীয়-অত্যাচার চলে, সন্ত্রাসবাদীদের গোপন খবর বের করার চেষ্টায় উপর্যুপরি চাবুক চলতে থাকে। যতবার চাবুক চলে, ততবার অনিল দাসের কণ্ঠে ‘বন্দেমাতরম্’ চিৎকার, আবার চাবুক, আবার চিৎকার ‘বন্দেমাতরম্, বন্দেমাতরম্’। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে গল্প, সারারাত ধরে অত্যাচারের পর ভোরের আলোয় অনিল দাসের ‘নিষ্প্রাণ, নিঃস্পন্দ দেহ’। পটভূমি গ্রন্থের ‘এক গুলিতে তেইশ সাহেব মারবো’ নিবন্ধে অশোক মিত্র লিখেছেন, ‘ছোটো শহরের ছোটো বিশ্ববিদ্যালয়, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যুজ্জ্বল ছাত্র অনিল দাস, তাঁর শহিদের মৃত্যুবরণের কাহিনী রূপকথার স্তরে উত্তীর্ণ হয়, ঢাকা শহর প্রতিবাদে থমথম করে, আমরা শিশুরাও চঞ্চল।’

অশোক মিত্র স্কুলজীবন শুরু করেন আরমানিটোলা স্কুলে। ‘ত্রিশের দশকের ঊষালগ্নে আমার বয়স দুই কিংবা তিন। শৈশব এগিয়ে চলে সেই শহরে, গোল্লাছুট আর কানামাছির অমল শৈশব। তারপর একদিন আর্মেনিটোলা স্কুল। শৈশব থেকে কৈশোর। স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ অধ্যায়। দাঙ্গা। মন্বন্তর। দেশভাগ। ওদিকে আমরা স্কুলের উঁচুক্লাসে ওঠবার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত বিপ্লবের কথা শুনতে শুরু করেছি।’ এভাবেই  আপিলা-চাপিলার পাতায় পাতায় পর্ব থেকে পর্বান্তরে উন্মোচিত সেই সময়, সমাজ ও ইতিহাসের ধারাবাহিক পরিক্রমা।

আপিলা-চাপিলার ১৫ পাতার শেষাংশে তিনি বলছেন, ‘যেটুকু জোর দিয়ে বলতে পারি, স্কুলের প্রতিটি ক্লাসে শ্রেণীবিন্যাসের জটিলতা সত্ত্বেও হিন্দু-মুসলমান ছেলেরা একসঙ্গে ক্লাসে বসতাম, দুষ্টুমি করতাম, খেলতাম,
বাড়ি-বাড়ি ফুল চুরি করতাম, কেউ পড়াশুনোয় একটু খাটো হলে তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতাম। আমাদের চেতনায় অন্তত সাম্প্রদায়িক সমস্যাটি কোনও বড় আকার নিয়ে হাজির হয়নি। গোলমাল বাধতে শুরু করলো ১৯৪০-৪১ সাল থেকে। খবরের কাগজে বিষ ছড়ানো, কংগ্রেসের তরফ থেকে ফজলুল হককে শত্রু বলে ঘোষণা করা, অতঃপর তাঁর মুসলিম লিগে ঢুকে পড়া, সেই সঙ্গে বিভিন্ন চক্র থেকে দাঙ্গার উস্কানি ইত্যাদি নানা গোলমেলে পরিস্থিতির সৃষ্টি। একচল্লিশ সালের একটা বড়ো সময় জুড়ে ঢাকায় আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হই। স্কুল বন্ধ, হাটবাজার বন্ধ, লোকালয় নিঝ্ঝুম, এ-পাড়া থেকে ও-পাড়ায় যেতে গা ছমছম।’

সে-সময় অশোক মিত্রের পরিবার আরমানিটোলা ছেড়ে কায়েতটুলিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি একটি ছোট বাড়িতে উঠে যায়। কয়েক বছর বাদে কিছুদিনের জন্য আবার আরমানিটোলার পুরনো বাড়িতে ফিরে আসেন। পরে তাঁর বাবা ঢাকেশ্বরী মন্দিরের কাছে বকশীবাজারে নতুন বাড়ি তৈরি করেন। অশোক মিত্রের স্কুলপর্বের শেষ দুই বছর সেই বাড়িতেই ছিলেন। সেই বাড়ির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বাড়ির ঠিক বাইরে অরফ্যানেজ রোডের উপর মস্ত এক কৃষ্ণচূড়া গাছ, বছরে অন্তত চার-পাঁচ মাস যা আমার সমস্ত অন্তর রাঙিয়ে দিয়ে যেত। পলাশের লালও দেখেছি, রক্তজবার লালও, কিংবা রক্তগোলাপের; কৃষ্ণচূড়ার মহিমার সঙ্গে তুলনা হয় না তাদের।’
(আপিলা-চাপিলা, পৃ ২০)

স্কুলজীবনের অনেক গুণী শিক্ষকের কথা তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়। তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন একজন শিক্ষকের কথা। তিনি শামসুদ্দিন স্যার। পড়া না পারলে, কিংবা দুষ্টুমি করলে, কড়া শাসন করতেন, জুলপির চুল ওপরের দিকে টেনে তুলতেন। ডাস্টার দিয়ে পেটাতেন। তথচ ছাত্র-অন্ত্যপ্রাণ, ছাত্রদের শুভ-অশুভ নিয়ে তাঁর অহোরাত্র চিন্তা। প্রতি রবিবার, এবং ছুটির দিনে, পায়ে হেঁটে বা নিজের পয়সায় রিকশায় চেপে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের জানিয়ে আসতেন, কে কোন বিষয়ে ভালো, কোন বিষয়ে দুর্বল, কার হাতের লেখার উন্নতি দরকার, কার স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিতে হবে। অশোক মিত্রের ভাষায়, ‘আমরা জ্ঞানান্বিত না হ’তে বদ্ধপরিকর, উনি ততটাই দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ আমাদের বিদ্যার পরিধি বাড়াবেনই।’ সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তখন অতিসামান্য মাইনে পেতেন, বাড়তি উপার্জনের কোনো সুযোগ ছিল না, সংসারের নানা সমস্যার জটিলতা ছিল। সেই সব বাধাকে অতিক্রম করে শামসুদ্দিন স্যারেরা ছাত্রদের মানুষ করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করতেন। স্কুলজীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘কৃষ্ণচূড়া গাছ, গীতবিতান-এ ডুবে যাওয়ার প্রথম উন্মাদনা, কবিতা আর কবিতায় ঘেরা আর্মানিটোলা স্কুল। স্কুলের উত্তর প্রান্তে একটি মস্ত গুলঞ্চ গাছ। গীতবিতান আসলে রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ কাব্যের নির্যাস, এই উপলব্ধির পাশাপাশি একটু-একটু করে রবীন্দ্রসংগীতের মোহিনী মায়ায় আবিষ্ট হওয়া যদিও কবুল না করে উপায় নেই বাংলার ঘরে-ঘরে নজরুলের গানের জাদু তখনও রবীন্দ্রসংগীত ছাপিয়ে!’ (আপিলা-চাপিলা, পৃ ২৩)

কৃষ্ণচূড়া লাল রং আর গীতবিতানের মোহিনী মায়ায় তিনি যেমন আবিষ্ট হতেন, নদীও তেমনি তাঁকে আপ্লুত করত। অন্যত্র নদীর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখছেন, ‘নদীর উপর দিয়ে প্রবল হাওয়া বয়ে যেতো, তার শোঁ-শোঁ শব্দ।
বড়ো-বড়ো বট-অশ্বথ গাছ, তারাও হাওয়ার ঝাপটা নিতো, তাদের ডাল-শাখা-পাতা মুখর হয়ে উঠতো। সেই সঙ্গে তাল, শুপারি বা নারকেল গাছের মন-মাতানো আন্দোলন।’ (আপিলা-চাপিলা, পৃ ২৫)

অশোক মিত্র তাঁর নিজের অদম্য ব্যক্তিসত্তাকে গড়ে দেওয়ার জন্য কৃতিত্ব দিয়েছেন ‘পূর্ববঙ্গের নদীসংকুল, হাওয়াতে দীর্ণ, বৃক্ষরাজিতে পর্যুদস্ত’ প্রকৃতিকে। বলেছেন, ‘মানুষের কল্পনা জল-নির্ভর, হাওয়া-নির্ভর, প্রাকৃতিক
সম্পদ-নির্ভর।’

(আপিলা-চাপিলা, পৃ ২৫) এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ঢাকা শহর, ভালোবাসার শহর, তবু সে এক মফস্বল শহর। ইংরেজ প্রভুরা দেশের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে সরিয়ে নিয়ে গেছে। তাতে ঢাকা যেন আরো দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই কলকাতাও তখন ঢাকা থেকে অনেক দূর। ট্রেনে-স্টিমারে উনিশ-কুড়ি ঘণ্টার পথ। তিনি লিখেছেন, ‘প্রভুদের স্থাপিত সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী কলকাতা, উজ্জ্বল মানুষজনের ভিড় যেখানে, মন্থর মফস্বলে নির্বাসিত বোকা-বোকা আমরা।’ (‘এসেছিস বোস’, পটভূমি)

মফস্বলে বাস করা মানুষ সবসময় কোনো একটা কিছু নিয়ে কেন্দ্রকে ডিঙিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। কলকাতার আধিপত্য আভিজাত্যের অন্যতম প্রধান প্রতীক তখন প্রেসিডেন্সি কলেজ। দেশের সেরা মেধাবী ছাত্ররা সেখানে পড়ে। সে-কলেজের আরেক শ্রেষ্ঠত্ব তাদের ফুটবল টিম। সেই টিমকে কেউ হারিয়ে দিতে পারে, তা ঢাকায় কলেজে পড়া ছেলেদের কাছে ছিল চিন্তার অতীত। তখনো দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শুরু হয়নি। পঞ্চাশের মন্বন্তরের আরো বেশ কয়েক বছর বাকি। সম্ভবত ১৯৪০ সাল সেটা! কলকাতা থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ফুটবল দল ঢাকায় এসেছিল কয়েকটি প্রদর্শনী খেলা খেলতে। অন্য সবকটি খেলা জিতল কিংবা ড্র করল। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সঙ্গে খেলায় ড্র করলো। কিন্তু ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের সঙ্গে খেলতে গিয়ে এক-শূন্য গোলে তাদের পরাজয়। গোলদাতা গোলাম হোসেন, অশোক মিত্রের একই স্কুলে কয়েক ক্লাস ওপরে পড়তেন। ঢাকার ছেলেরা এমন অঘটন এর আগেও দুয়েকবার ঘটিয়েছে। তবে প্রেসিডেন্সি কলেজের সঙ্গে সেই প্রথম। এই ঘটনার বছর দুয়েক আগে বিলেত থেকে ইসলিংটন করিন্থিয়ানস্ নামে এক ফুটবল দল এসেছিল ভারতবর্ষে খেলতে। বিলেতে বিভিন্ন নামকরা ক্লাব থেকে বাছাই করে গঠিত এক দুর্ধর্ষ টিম। তারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন শহরে সব মিলিয়ে গোটা পঁচিশেক খেলায় অংশগ্রহণ করেছিল। অন্য সবকটি খেলায় তারা অপরাজিত, একমাত্র ঢাকা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে এক গোলে হেরে যায়। গোল করেছিলেন ভূপেন সেন, যাঁর ডাকনাম ছিল পাখি সেন। অশোক মিত্র পটভূমিতে লিখেছেন, পাখি সেন যখন গোলটা সেঁধিয়ে দিলেন, যে-জয়ধ্বনি উঠল তা বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারেও নাকি পাঁচ ক্রোশ পর্যন্ত শোনা গিয়েছিল। সেদিন ঢাকার সমস্ত স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছিল বিজয় উৎসবের আবেগে।

আরমানিটোলা স্কুল শেষ করে অশোক মিত্র ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। তেতাল্লিশ সাল, চারদিকে মন্বন্তরের বিভীষিকা। বাংলাদেশে সে-বছর ফসলের ঘাটতি তেমন ছিল না। কিন্তু ফসলের একটা বড় অংশ বিদেশি সরকার অন্যত্র পাচার করে দিয়েছিল। তার ওপর এক জেলা থেকে অন্য জেলায়, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, খাদ্যশস্য পরিবহনের নৌকো বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। শাসক ইংরেজদের মনে তখন জাপানি আতঙ্ক। জাপানিরা এসে যদি ফসলের দখল নেয়, তাই শস্য বাজেয়াপ্ত করা, নৌকো ডুবিয়ে দেওয়া বা বাজেয়াপ্ত করা হয়। লক্ষ-লক্ষ অভুক্ত মানুষ, নারী-পুরুষ-শিশু, শহরে ঢোকে, প্রতি পাড়ায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, সরকার উদাসীন। মানুষ ভাত ভিক্ষা বাদ দিয়ে খুদ ভিক্ষা, ফ্যান ভিক্ষা করে। অধিকাংশ উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবার নিজেদের সংসার-পরিজনের সংস্থান নিয়ে ব্যস্ত। এখানে-সেখানে দুয়েকটি সরকারি-বেসরকারি লঙ্গরখানা। মানুষগুলি খিদেয় ধুঁকতে ধুঁকতে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে। দয়ালু কেউ যখন তাদের জিজ্ঞেস করে, কী রে হাসপাতালে যাবি? সাড়া দেওয়ার মতো শারীরিক শক্তি অধিকাংশেরই নেই। যাদের আছে, তারা কোনোক্রমে ঘাড় নেড়ে অস্ফুট উচ্চারণ করে, না, একটু ফ্যান দাও বাবা। অশোক মিত্রের স্মৃতিচারণে এভাবেই সে-সময়ের ছবি ফুটে উঠেছে। লিখেছেন, ‘এই মরা, প্রায়-মরা মানুষগুলিকে ডিঙিয়ে কলেজে যাই।’ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা তখন ত্রাণের কাজে ভালো অবস্থান নিয়েছে। সাধারণ মানুষের মনে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে একটা বিরূপ ধারণা ছিল। মাত্র এক বছর আগে ঢাকা শহরের পূর্ব প্রান্তে তরুণ কমিউনিস্ট কর্মী, প্রতিভাবান তরুণ সাহিত্যিক সোমেন চন্দ উগ্র জাতীয়তাবাদী সুভাষ বসুর অনুসারীদের হাতে নিহত হয়েছেন। সোমেন চন্দের শৈশব কেটেছে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারে। পোগোজ স্কুলের মেধাবী ছাত্র ঢাকার মিটফোর্ড মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। যদিও মেডিক্যালের পড়া শেষ না করেই জড়িয়ে পড়েছিলেন কমিউনিস্ট রাজনীতি আর প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে। তাঁর নৃশংস হত্যার ঘটনায় শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে গভীর ক্ষোভ ছিল, তবে তা নিয়ে বিশেষ শোরগোল ছিল না। বরং অনেকেই বলেছে, ছেলেটা বিপথগামী ছিল। কারণ ছেলেটা কমিউনিস্ট দলে নাম লিখিয়েছিল। দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্টকর্মীদের ত্রাণ তৎপরতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা পার্টি সম্পর্কে মানুষের ধারণায় ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সোমেন চন্দের মৃত্যু, দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অশোক মিত্রের মতো ঢাকার অনেক যুবককেই আলোড়িত করেছিল। তাঁরা কেউ রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন, কেউ সাহিত্যচর্চায় সম্পৃক্ত হয়েছেন। তখন ঢাকার তরুণ যুবকদের মাঝে আরেকজনের প্রভাব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তিনি বুদ্ধদেব বসু। যিনি কিছুকাল আগে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে অশোক মিত্র লিখেছেন, ‘স্বীকার করতে আদৌ সংকোচ নেই, দুটো পাশাপাশি স্মৃতি আমার মনে একত্র জড়িয়ে আছে; ঢাকা শহরে
রাস্তাঘাট-গাছপালা, আরমানিটোলা স্কুল-জগন্নাথ কলেজ-ঢাকা হল, আমার প্রথম প্রেমিকা, কিন্তু তারই পাশাপাশি ‘বন্দীর বন্দনা’-‘কঙ্কাবতী’র সঙ্গে প্রথম প্রেমের উতরোল আনন্দ যতদিন ঢাকায় ছিলাম, বুদ্ধদেব-বিভোরতায় কেটেছে।’ এই বিভোরতার এক পর্যায়ে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ শুরু হয় অশোক মিত্রের। বুদ্ধদেব বসু তখন ঢাকা ছেড়ে কলকাতা। বুদ্ধদেব বসুর মতো জীবনানন্দ দাশের সঙ্গেও ছিল তাঁর পত্র-যোগাযোগ। তখন ঢাকার মালিটোলায় কবি কিরণশঙ্কর সেনগুপ্তের বাড়িতে প্রতি রোববার সাহিত্য বাসর বসত। বুদ্ধদেব বসুর মাধ্যমে অশোক মিত্র যুক্ত হন সেই সাহিত্য বাসরে। সেই সাহিত্য বাসরে আসতেন অচ্যুত গোস্বামী এবং অজিত গুহের মতো আরো অনেকে। এই কিরণশঙ্করের উৎসাহে অশোক মিত্র যুক্ত হন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘ’র সঙ্গে। অজিত গুহ তখন সংঘের সম্পাদক। সেই সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে মুনীর চৌধুরী, কবির চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ এবং সানাউল হকের।

ছেচল্লিশে কলকাতা নোয়াখালীর দাঙ্গার ধাক্কা এসে লাগল পুরান ঢাকায়। অশোক মিত্র তখন যুক্ত ছিলেন দাঙ্গাবিরোধী, দেশভাগবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি লিখেছেন, ‘সাতচল্লিশ সালের মধ্য-আগস্ট, রাতারাতি পাকিস্তানের নাগরিক হয়ে গেলাম আমরা! অবশ্য মনস্থির করেছিলাম, যে-কংগ্রেস দল আমাদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলো, যে-দল স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নেতৃত্ব দেবে, তার সম্পর্কে সম্পূর্ণ মোহমুক্ত হওয়াই ভালো। আমরা পাকিস্তানের বিশ্বস্ত নাগরিক হবো, সব সম্প্রদায়ের মানুষজন মিলেমিশে নতুন দেশ গঠন করবো। এমনকি লিগ নেতাদের অনেকেই, অন্তত প্রথম লগ্নে, এ ধরনের সংকল্পেরই প্রতিধ্বনি করেছিলেন।’ (আপিলা-চাপিলা, পৃ ৫৪)

দেশভাগের পরে অশোক মিত্র পরিবারসহ ঢাকাতেই থেকে যান। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পরীক্ষা শেষ করেন। সেই সময় রাজনৈতিক কারণে তাঁর নামে হুলিয়া জারি হয়। তিনি পালিয়ে কলকাতা চলে যান। আপিলা-চাপিলায় লিখেছেন, ‘অপেক্ষায় আছি, কবে ফিরে যাবো, ইতিমধ্যে খবর এলো যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক পরীক্ষার ফল বের করা হয়েছে এবং আমি প্রথমই হয়েছি, তা হলেও, ঢাকাতে নাকি গুজব, আমাকে আর ভর্তি করা হবে না। আমার বাবা-মা তখনও ঢাকায়, দু’জনেই শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত।’ এরপর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে অশোক মিত্রের বাবা-মা ঢাকা ছেড়ে কলকাতা চলে যান।

বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু দীর্ঘ কর্মময় জীবন শেষে ২০১৮ সালের পহেলা মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপর সরকারি আমন্ত্রণে অশোক মিত্র বেশ কয়েকবার ঢাকায় আসেন। ঢাকা ছিল তাঁর স্মৃতির শহর। তাঁর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ আপিলা-চাপিলার প্রথম প্যারাতেই লিখেছেন, বাংলাদেশ সরকারের পীঠস্থান ঢাকা শহরে এখন যাঁরা গেছেন, ‘তাঁরা আমাদের পুরনো ঢাকাকে আদৌ চিনে উঠতে পারবেন না। রাজধানী ঢাকা, চকমকে, ঝকঝকে! চওড়া-চওড়া রাস্তার বিস্তার, সৌধপ্রতিম অট্টালিকার পর অট্টালিকা। নেতৃৎপর্যায়ভুক্ত মানুষজন তুখোড়, অতি সংস্কৃত। যদিও, আমার সন্দেহ, গরিব-গুর্বোরা আজ থেকে

সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগে যে-তিমিরে ছিলেন, আছেন সেই তিমিরেই। পুরনো ঢাকা শহর জরাজীর্ণতর, সরু-সরু রাস্তার ঠাসাঠাসি, এক কোণে অবহেলায় পড়ে আছে। সেই আমলের শহরটিকে এখন, গভীর দীর্ঘনিশ^াসযোগেই বলতে হয়, ‘কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে …’।’