ব্যঙ্গ-তামাশায় বাস্তবতার গালে চাপড়

পিঁপড়া কামড়াবে দু-একটা, কিন্তু পিষে মরে সবাই। পিঁপড়ারও নীতি আছে। পিঁপড়ার দলে লক্ষ করলে দেখা যায়, যদি কোনো কারণে কোনো পিঁপড়া আহত বা নিহত হয়, তবে তাদের সঙ্গের অন্যান্য পিঁপড়া তাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যায়। কী সুন্দর সহমর্মিতা। তারা চলে এক লাইনে। বাধা পেলেও যাওয়ার রাস্তা তৈরি করবেই তাদের গন্তব্যে।

বাস্তবতা ও কল্পনাকে নিয়ে ঠাট্টা-ব্যঙ্গ করতে করতে  চিত্রকর্মের পাশেই এরকম কিছু শব্দ দিনপঞ্জি আকারে ‘লালসার উপাখ্যান’-এ হাজির (Anecdot of Lust)। গ্যালারি কলাকন্দ্রে তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর একক চিত্রকর্ম একটি বিক্ষত হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এসেছে, যেন সেই হৃদয় বুঝে উঠতে পারেনি, কীভাবে অর্থবোধক প্রতিক্রিয়া তৈরি করা যায়! তাই যেন হেসে উড়িয়ে দিতে দিতে পিঁপড়ার দলের নীতি খোঁজ করতে গিয়ে শিল্পী কি খোঁজ করলেন মানুষের নীতিহীনতার?

দার্শনিক নিৎসে বলেছিলেন, ‘কোনো শিল্পীই বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেন না।’ সম্ভবত তিনি বাস্তবতার রূঢ় দিকের কথাই বলতে চেয়েছেন। যেভাবে দুলু দেখেন যে, ভোগবাদিতা কী নির্মমভাবে আমাদের হিংস্র করে তুলেছে, অসহনশীল করে তুলেছে। দিগি¦দিকশূন্য পাগলপ্রায় যেন ‘নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ’ ঘটে আমাদের জীবনে!

কিন্তু তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর রয়েছে এক স্বপ্নময়, বিস্তৃত  কল্পনার জগৎ। পেইন্টিংয়ের অবজেক্টগুলি ওই জগৎ থেকে বাস্তবের উপাদানসমূহকে রূপান্তরিত করে উদ্ভট এক উটের পিঠে চড়ে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। শিল্পীর ক্যানভাসের চিত্রপটে ভেসে ওঠে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে শহুরে সংস্কৃতির সংমিশ্রণের সচেতন অনুপ্রবেশ, ফাঁদে আটকেপড়া পাখি, উদ্ভিদ-প্রাণীর মাঝামাঝি পাখাওয়ালা রূপে রূপান্তর একটা ভুল সংকর ভবিষ্যতের আভাস দেয় এবং বর্তমানকে প্রবঞ্চনা করে। শিল্পী শুধু সমাজকে, এই পুঁজিবাদী সুখনির্ভর স্বার্থপর ব্যবস্থাকেই বিদ্রূপাত্মকভাবে এঁকেছেন, নাকি নিজের সীমাবদ্ধ ক্ষমতাকেও কটাক্ষ করেছেন? অনেক জিজ্ঞাসা, দর্শকের মনে নাড়া দেওয়ার  মতো শক্তির আভাস পাওয়া যায়। শিল্পীর সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক যে স্বস্তিদায়ক নয়, তা স্পষ্ট। নারীদেহের লাস্যময় ভাঁজগুলিকে নানা অবয়বে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে ভোগবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

দুলুর কাজে শক্তিশালী রেখচিত্র, হালকা পরিশীলিত রঙের ব্যবহার, কম্পোজিশনে নিরীক্ষা লক্ষণীয়।  প্রদর্শনীতে ৭০টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। কিউরেটর শর্মিলী রহমান তাঁর নোটে লিখেছেন – Tasadduk Hassain DuluÕs ÔAnecdots of LustÕ offer a feast for eyes. বোধকরি এই প্রদর্শনী দর্শকের মগজকেও কিছু শান দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

দুলু আরো লিখতে থাকেন, যার পরিক্রমায় ছবি তৈরি হয়। … মধ্যরাত। এক কাপ চা হাতে। আলো নিভিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। ঘরে ধীরগতিতে শীতল হাওয়া বইছে এবং সঙ্গে রজনীগন্ধার সুগন্ধির সঙ্গে শরীরের গন্ধ নাকে। বেসিনটা বেশ আলোকিত হয়ে আছে। দেয়ালজুড়ে হৃদয় ভাঙার গল্প? ভাঙাচোরা গর্তে ভরা।

একটি আয়না দেয়ালে ঝোলানো। দেয়ালে লাগানো ছোট্ট আয়নাতে নিজের প্রতিচ্ছবির বদলে ভাঙাচোরা গোটা পৃথিবীটাকে দেখা যায়। ভেসে আসছে পাশের বাড়ির হিন্দিমিশ্রিত গান, যা মনোরঞ্জনের জন্য চলছে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে চেহারা দেখে আক্ষেপ জাগে কখনো! মনে হয়, সবচাইতে সুন্দর মানুষটিও এরকম ভাবনার শিকার হতে বাধ্য। মুখাবয়বের প্রশ্নে অভিব্যক্তি নিছক আমার মনের ভুল, অবচেতন মনের কোনো পাগলামি। এই হলো স্বপ্ন  ভাঙার প্রতিচ্ছবি।

কাগজে কর্তৃত্বপরায়ণ সাদাকালোয় ড্রইং ও সীমিত আকারে জলরঙের শিল্পকর্মগুলিতে দৈনন্দিন জীবনের দ্রব্যাদির চিত্রায়ণ করেছেন; কিন্তু উপস্থাপনে একধরনের ভিন্ন অবলোকন ও কথোপকথন রয়েছে। চিরুণি, সুইচ, দুটি হাতুড়ির মাঝে একটি পেরেক, একটি বাজারের ব্যাগ ইত্যাদি।

একটা সময়ে লোভলালসাকে মানুষের একটি নেতিবাচক নীতি হিসেবে সমাজ-সংস্কৃতিতে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু এখন এই ভোগবাদিতার চূড়ান্ত উৎসবে বিশৃঙ্খলাই যেন নীতি। সম্মোহিত ভোক্তাসংস্কৃতির অধঃপতিত রূপে হাতড়ে বাঁচার পথ খোঁজার প্রয়াস চিত্রায়ণে তাসাদ্দুক হোসেন দুলুর মনোযোগ।

‘লালসার উপাখ্যান’ শিরোনামের প্রদর্শনীতে শিল্পী তাঁর পূর্বচর্চার ধারাবাহিকতায়, মোটাদাগের কটাক্ষে, রসবোধে, উদ্ঘাটন মূলক ও সরলতায় চিত্রকর্ম নিয়ে উপস্থিত। যা কি না তার কাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও বিষয়কে ভিন্ন পাঠে, বাহাসে উৎসাহিত করে।

প্রদর্শনীটি ২রা থেকে ৩০শে জুন পর্যন্ত চলেছে।