এই সময়ের শিল্পকর্ম : একটি প্রদর্শনীর সমীক্ষা

ভূমিকা

জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী, যা গত পঁচিশ বছর ধরে হয়ে আসছে, যদিও কয়েক বছরের বিরতি দিয়ে, দেখার সময় দর্শকের প্রত্যাশা হয়তো ছিল অগ্রগতি অব্যাহত আছে কি না, সেই বিষয় নিয়ে। অপরদিকে শিল্প-সমালোচক স্বভাবতই ভেবেছেন, এখানে নতুন কী আছে, যা দেখে বাঁকবদলের আভাস পাওয়া যায়? পৃথিবীর সব দেশেই দর্শকরা অল্পে সন্তুষ্ট, আগের তুলনায় সংখ্যায় এবং বৈচিত্র্যে কম না হলেই তাদের প্রাপ্তি সম্পূর্ণ হয়ে যায়। দর্শকদের এই প্রত্যাশা পূরণ যে-কোনো শিল্পীর (যে-কোনো প্রদর্শনীরও) ন্যূনতম দায়িত্ব, কেননা তারা তো নিজের জন্য শিল্পকর্ম সৃষ্টি করেন না। এইভাবে দর্শকতৃপ্তি মিটিয়ে শিল্পীরা আরো একটি কাজ করেন, শিল্পরসিকদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি একটু একটু করে তাদের রুচিরও উন্নতি বিধানে ভূমিকা রাখেন।

সমালোচকদের প্রতি শিল্পীরা একই ভাবে দায়বদ্ধ নন; কিন্তু তাঁদের তাঁরা অপ্রয়োজনীয় মনে করেন না। সাধারণ দর্শক শিল্পকর্ম দেখে তাৎক্ষণিক ইন্দ্রিয়জ আনন্দানুভূতি লাভ করেন। ছবির কারিগরি দিক বুঝতে পারলে এই নান্দনিক অনুভূতি অনেকটা বাড়ে। যুগে যুগে সমালোচকরাই শিল্পী আর দর্শকদের মধ্যে এই উদ্দেশ্যে মধ্যস্থতা করে এসেছেন, বিশেষ করে যখন নতুন ধারার শিল্প উপস্থাপিত হয়েছে। আর কে না জানে, সমালোচকরা দর্শকদের তুলনায় শিল্পীর কাছে একটু বেশিই চান। শুধু স্থিতাবস্থা অক্ষুণ্ন রাখা নয়, অগ্রগতি ধরে রাখতে পারলেই তাদের চাহিদা মেটে না। তারা আশা করেন নতুন কিছু সৃষ্টি হলো কি না, তা দেখতে। যদি এই বাড়তি প্রত্যাশা কিছুটা হলেও মেটে, তাঁরা তৃপ্ত হন। আর যদি পুরাতনেরই পুনরাবৃত্তি ঘটে, তাহলে তাঁরা যে খুব হতাশ হন, তা নয়। তাঁদের জানা আছে, নতুন কিছু হঠাৎ করে হয় না, তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়, প্রস্তুতিপর্বের সময় দিতে হয়। তারপরও সবাই তো নয়ই, অনেকের পক্ষেই নতুন কাজ নিয়ে সামনে আসা সম্ভব হয় না। এ কাজটি হয় কয়েকজনের হাতেই, যা পরে একটা নতুন ধারা হয়ে সকলের অনুসরণীয় হয়ে যায়, অনুকরণ করা হলে সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে না শিল্পরসিক দর্শকের, সমালোচকের তো নয়ই।

এই পূর্বকথনের পর যা উত্তরকথনে বলার কথা, সেই উপসংহার আগেভাগেই সকল জল্পনা-কল্পনার ইতি ঘটিয়ে বলা যায় যে, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত পঁচিশতম চারুকলা প্রদর্শনীতে যেসব শিল্পকর্মের সমাবেশ তার ভিত্তিতে চারুকলায় আমাদের অগ্রগতি অব্যাহত আছে, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়। নতুন, মৌলিকভাবে ভিন্নধারার শিল্পের জন্য মনে হচ্ছে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এই নতুন হতে পারে পাশ্চাত্যের নতুন কোনো ধারার অনুসরণ, যা সাধারণত হয়ে এসেছে পশ্চিমের বাইরের অধিকাংশ দেশে, অথবা জাতি সৌভাগ্যবান হলে, একেবারে অকৃত্রিম দেশজ নতুন কিছু দিনের আলোয় এসে, দর্শক, সমালোচক সবাইকে অবাক করে দিতে পারে। এমন দুর্মর আশাবাদ তো আমাদের থাকতেই হবে।

এক

দেখা যাচ্ছে গত বছরের তুলনায় এ-বছর অংশগ্রহণকারী শিল্পীর সংখ্যা ৬২ জন কম, ৩২৩ বনাম ২৬১। কিন্তু এ-বছরে প্রদর্শিত শিল্পকর্মের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৪৬টি বেড়েছে। আবেদন জমাকারী ১১৩৮ জন শিল্পীর কাজ দেখে যাচাই-বাছাই করা বেশ দুরূহ কাজ। এখানে ভুলত্রুটি হতেই পারে। যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই নবীন, তাঁদের অপেক্ষা করার সময় আছে। তবে তাঁদের কয়েকজনের জন্য ‘নবীন শিল্পীর দেয়াল’ নামে একটি বিশেষ সেকশন প্রদর্শনীতে থাকলে মন্দ হতো না।

জাতীয় গ্যালারির দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ তলায় নির্বাচিত শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। এখানে বলে নেওয়া ভালো, শিল্পী এস এম সুলতানের শিল্পসংগ্রহ এবং মোহাম্মদ কিবরিয়া ও রফিকুন নবীর ছবি সম্মান দেখিয়ে, শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রদর্শনীতে রাখা হয়েছে, সেগুলি ‘নির্বাচিত’ নয়। গাড়িবারান্দার তিনদিকে যে তিনটি প্রচারণা বিলবোর্ড সেখানে গ্রাফিক্স আরো শিল্পসম্মত হলে দর্শকদের বেশ আনন্দ দিতে পারত এবং উৎসবের আমেজ পাওয়া যেত। একতলায় প্রবেশ করে যে ফাঁকা জায়গা সেখানে প্রদর্শনীর জন্য নির্বাচিত একটি দৃষ্টিনন্দন এবং সেলিব্রেশনের প্রতীকী স্থাপনা রাখা হলে প্রদর্শনীর স্বাগতমসূচক শিল্পকর্ম হতে পারতো সেটি। প্রায় নিরানন্দময়, ছায়াচ্ছন্ন এবং বিরান ওপেন স্পেসে ঢুকে কিছুই না দেখে লিফটে দোতলায় উঠে হঠাৎ প্রদর্শনীর আলো-ঝলমল কক্ষে প্রবেশ বেশ আকস্মিক এবং ধাক্কা খাওয়ার মতো মনে হয়েছে। এই শূন্য অভিজ্ঞতার বিকল্প হতে পারে গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকেই দর্শকের জন্য শিল্পিত স্বাগতম জ্ঞাপন।

দ্বিতীয় তলায় বাঁদিকের ঘরের ভেতরে বেশ বড় সাইজের ক্যানভাসে নার্গিস পলির (জন্ম ১৯৭৯) দুটি তৈলচিত্র বেশ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অ্যাক্রিলিকে তৈরি ছবি দুটির প্রথমটিতে নীল রং এবং দ্বিতীয়টিতে সবুজ প্রাধান্য পেয়েছে; কিন্তু অন্য রঙের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে নয়। প্রথম ছবিতে যোগাসনে কয়েকটি ফিগারের বিভিন্ন ভঙ্গি এবং কাকের ইতি ও নেতিবাচক উপস্থিতি দেখিয়ে শিল্পী কোভিডের ব্লু পিরিয়ডের ছবি এঁকেছেন। দ্বিতীয়টিও বক্তব্যপ্রধান, এখানে লাল রজ্জু দিয়ে অরণ্যকে বেঁধে মানুষের অহংবোধের উল্লেখ করেছেন পলি অর্ধবিমূর্ততায়। স্পেসের ব্যবহার, রঙের হারমনি এবং ফর্মের অস্পষ্ট ইঙ্গিতময়তা ছবি দুটিকে বিশিষ্ট করেছে।

ইমতিয়াজ ইরনাম (জন্ম ১৯৯৩) ‘ভ্রমণের আখ্যা’ নামে যে কোলাজধর্মী অভিনব কাজ করেছেন সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে ফ্যাবিয়ানা কাগজে সাইনোটাইপ, অ্যাক্রিলিক এবং জলরং। বেশ কয়েকটি অংশে বিভক্ত করে ইমতিয়াজ ভ্রমণকালীন অভিজ্ঞতাকে দেখিয়েছেন পোস্টেজ স্ট্যাম্প সাইজের অনেক নর-নারীর ছবি সাজিয়ে এবং বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করে। কম্পোজিশনের অসংখ্য ফর্ম মনোটনি এড়িয়ে গিয়েছে, রঙেও রয়েছে বৈচিত্র্য। যেমন, স্বাভাবিক রঙের ফটোর পাশে একই ছবির নেগেটিভ।

সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রাপ্ত আব্দুস সাত্তার তৌফিকের (১৯৭৯) ছবি কোলাজধর্মী এবং অর্ধবিমূর্ত। চৌকো সব ফর্মে তিনি বিভিন্ন মোটিফ ব্যবহার করে ‘জীবনের গল্প’ বলতে চেয়েছেন। পপ আর্টের মতো তাঁর ছবির সব ফর্মের রং একটু বেশিই যেন উজ্জ্বল। তার পাশেই আনিসুজ্জামানের উডকাটের কাজ বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে। অনেকগুলি কাঠের খণ্ডে জাপানের প্রাকৃতিক নানা দৃশ্য এবং কাঠের ঘরবাড়ি পরিস্ফুট করে তিনি দেখাতে চেয়েছেন ‘বন্ধুত্বের বন্ধন’। জাপানের এই পটভূমিতে একটি খণ্ডে তাঁর লেখা ‘আমি বাংলার মায়াভরা পথে পথে হেঁটেছি এতোটা দূর’, কথার অর্থ স্পষ্ট নয়, কেননা বাংলাদেশের দ্যোতক কোনো মোটিফই আশেপাশে নেই। আনিসুজ্জামান হালকা ব্রাশে বিভিন্ন ফর্মে বাদামি, সবুজ, নীল এবং সাদা রং ব্যবহার করে উডকাটে প্রচলিত রঙের মনোটনি দূর করেছেন।

অনুকূলচন্দ্রের (১৯৭৪) পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবি ‘দ্য স্টোরি অব ঢাকা’ মিনিমাল শুধু কম্পোজিশনে নয়, সাদা-কালো রঙের ব্যবহারেও। স্পেসের মাঝখানে লম্বা আয়তক্ষেত্রে আবছা দেখা যায় ঢাকার রাজপথের পরিচিত ব্যস্ত, ক্লান্ত, দূষিত এবং বিশৃঙ্খল রাজপথের পরিচিত দৃশ্যের স্ন্যাপশট বা খণ্ডাংশ। ছবির জ্যামিতিক ফর্মের সরলতা কম্পোজিশনকে নিকটবর্তী এবং প্রত্যক্ষ করে তুলেছে।

এশা আহমেদের (১৯৮৩) অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা ‘স্পিল্ড স্যুপ’ কেবল বাস্তবধর্মী নয়, সন্দেহাতীতভাবে পপ আর্ট ঘরানার। কোনাকুনি দুটি চপস্টিক এঁকে ছবিটিতে জ্যামিতিক ফর্ম সৃষ্টি করা হয়েছে। তাঁর ছবির সামনে দেখা যায়, ঘরের মেঝেতে সাদা বেদির ওপর রাখা ফারহানা তাসমিম মিমের ছোট আকারের ধূসর রঙের মার্বেলের ভাস্কর্য ‘রেণু’। সরলতায়, সৌকর্যে, স্নিগ্ধতায় এবং পরিমিতিবোধে কাজটি অনবদ্য।

একই তলায় (ফ্লোরে) পাশের ঘরে জয় কর্মকারের (১৯৯৫) মিক্সড মিডিয়ার ‘যুদ্ধ’ শীর্ষক ছবির নিচের বেজলাইনে পুরনো কাগজের অংশ, যার ওপর এক একটি স্তরে প্রায় গ্রাফিক্সের মতো দেখানো হয়েছে ছোট আকারের নগ্ন মানবদেহ, দাবার ঘুঁটি হয়ে এবং দুপাশে দুই দল দর্শকের ভূমিকায়। এদের ওপরে আরেক স্তরে একপাশে লোভাতুর কাক অন্যপাশে প্রশান্ত এক পারাবত বসে আছে মুখোমুখি। একেবারে ওপরের স্তরে প্রজ্বলিত আগুন, কালো ধোঁয়া যুদ্ধের ধ্বংসের প্রতীক। ডানদিক থেকে ধেয়ে আসছে মারমূর্তি হয়ে ক্রুদ্ধ এক ষাঁড় মৃত্যুর দূত হয়ে। ছবির বাঁদিকে কালো ধোঁয়ার মধ্যে যেন ধেয়ে আসছে দৈত্যের মতো বিশাল এক অবয়ব। যুদ্ধের ভয়াবহতা, ধ্বংস এবং মানবতাবিরোধী আবহ যথাযথ প্রতীকে মোক্ষমভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এই ছবিতে।

রফিকুল ইসলাম (১৯৯৩) তাঁর ট্রিপটিচে (তিন অংশে বিভক্ত) মা ও শিশুর ছবি এঁকেছেন সাদা-কালো রঙে। বাঁদিকের ছবিতে দেখা যায়, প্রোফাইলে কালোর ভেতর সাদা রঙের আঁচড়ে মানবী মা এবং তার কোলের শিশুকে; মাঝখানের ছবিতে বাঁদর-মা তার শিশু বুকে নিয়ে সামনে তাকিয়ে; ডানদিকের ছবিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে একটি পুরুষ বাঁদর। ছবিতে তুলির টান বলিষ্ঠ, রঙের নির্বাচন বিষয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কিন্তু কম্পোজিশন নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়বেন দর্শক। ডানদিকের পুরুষ বাঁদরের ভূমিকা কি এই গল্পে? কিসের প্রতিনিধিত্ব করছে সে?

হাওয়া (?) আখতার রুমি (১৯৯৪) বিশাল ক্যানভাসে এঁকেছেন ‘শান্তির জন্য প্রার্থনা’। মিক্সড মিডিয়ার এই ছবিতে অয়েল পেইন্টিংয়ের ধ্রুপদী চরিত্র রয়েছে রঙের স্বাভাবিক মসৃণ অবিভাজ্য মিশ্রণে। জোড় হাতে প্রার্থনারত ব্যক্তির আনত মুখের একাংশ যদিও অস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, তিনি যে বৃদ্ধ, তা তার হাতের বলিরেখায় স্পষ্ট। দেহের আর কোনো অংশ দৃশ্যমান নয় এই ছবিতে, করজোড়ে প্রার্থনারত বৃদ্ধের দুই হাতের ওপরই এখানে ফোকাস নিবদ্ধ। গাঢ় বাদামি রঙের পেছনে হালকা বাদামি রঙের সঙ্গে মিশেছে গভীর থেকে ক্রমে হালকা হয়ে আসা কালো রং। ছবির জমি সমতল নয়, স্থানে স্থানে টেক্সচার যোগ করেছে বাস্তবের অন্তরঙ্গতা। মনে হয় ছবিটি পুরস্কার পেলেও পেতে পারত।

নায়মা আখতারের (১৯৬৮) অ্যাক্রিলিকে আঁকা ‘সিরিজ ভূমিকম্প’ ফিগারেটিভ ছবি হলেও প্রতীকী মনে হয়। ছবিতে দেখা যায়, সিংহাসনে বসে আছে নীল টি-শার্ট পরিহিত মুণ্ডিত মস্তকের এক যুবক। তার পা স্থাপিত  কাঁকড়ার ওপর আর আসনের পাগুলির নিচে পিষ্ট হয়ে আছে গোলাপি রঙের পদ্মফুল। পেছনে রয়েছে দা ভিঞ্চির আঁকা মানবদেহের ছড়ানো হাতের বিস্তার। শিরোনামের সঙ্গে ছবিটির অর্থ আপাতদৃষ্টিতে সামঞ্জস্যময় মনে হয় না। রঙের উজ্জ্বল এবং সরল ব্যবহারে লোকজ শিল্পের অনুসরণ। ছবিটির পুরস্কারপ্রাপ্তির কারণ বোধগম্য নয়।

সৈয়দ হাসান মাহমুদ (১৯৫৮?) ‘স্বাধীনতার মাতা’ নামে যে বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন সেটি ক্যানভাসে ওয়াটার কালার বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা বেশ বিরল। ক্যানভাসে রং শুষে নেওয়ায় প্রায় বিবর্ণ দেখায় ছবির কম্পোজিশন। ওপরে ছোট আকারের কাগজের খেলনা প্লেনের মোটিফ কিসের অর্থ বহন করে বলা মুশকিল।

আবদুল্লাহ আল বশিরের ‘উত্তরণ-১২’ আকারে বেশ বড় উডকাট। এতো বড় কাজে ব্যাপ্ত ধূসর রং দৃষ্টির জন্য একঘেয়ে। ফর্মের অস্পষ্ট রেখা দেখে বাড়িঘরের সারি অথবা ট্রেনের জানালা খোলা কম্পার্টমেন্ট মনে হতে পারে। উডকাটে এমন অস্পষ্টতা (দুর্বোধ্যতা?) অপ্রত্যাশিত।

ইসরাত জাহানের (২০০০) ছোট আকারের কালো পাথরের ভাস্কর্য ‘ছলাঞ্জনা দেবী’ দৃষ্টিনুন্দন। স্কেলের সঙ্গে সংগতি রেখে মাস (mass) এবং ঘনত্ব (volume) তাঁর কাজে সামঞ্জস্যময়তা এনেছে। এই কাজের কাছাকাছি সুব্রত দাশের (১৯৮৬) ‘মাইগ্রেশন’ ছবিতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষের অভিযাত্রাকে দেখানো হয়েছে চক্রাকারে। বিভিন্ন পর্বে যাত্রার ফর্মগুলি চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে কম্পোজিশনের বৃত্তে। পাশেই মৃণালকুমার বাড়ৈ (১৯৭২) ওপরে, নিচে এবং মাঝখানে তিনটি ফর্মে মাছ, লতাপাতা দিয়ে এঁকেছেন জলজ জীবনের ছবি। তিনি এর নাম দিয়েছেন ‘জীবনীশক্তি’। ফর্ম, কম্পোজিশন, রঙের সুমিত ব্যবহারে বেশ ভালো কাজ এটি।

দ্বিতীয়তলার প্রান্তদেশে সমস্ত ঘর নিয়ে উপস্থাপিত ফারেহা জেবার মিক্সমিডিয়ার শিল্পকর্ম ‘এ ম্যাসন-স জার’। এই অনবদ্য কাজটির জন্য শিল্পী পেয়েছেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের পুরস্কার। 

দুই

গ্যালারির তৃতীয় তলায় যেসব শিল্পকর্ম তার বেশিরভাগ কনসেপচুয়াল আর্টের শ্রেণিতে পড়ে, সংখ্যার নিরিখে তারপরই আসে ভাস্কর্য। প্রবেশপথেই রয়েছে ইসরাত জাহান স্বপ্নার ‘স্বাধীনতার সৌন্দর্য্য’ নামে গাড়ির টায়ারের কালো পাত জোড়া দিয়ে কনসেপচুয়াল আর্ট ‘স্বাধীনতার স্বপ্ন’। নৃত্যরত ব্যালে নর্তকীর অবয়ব এতো স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ যে, একে ভাস্কর্যও বলা যেতে পারে। টায়ারের পাতাগুলি জোড়া দেওয়া হলেও প্রান্তদেশে সঞ্চরমান, যার জন্য কাইনেটিক ভাস্কর্যের বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে এটি।

সংলগ্ন কক্ষের ভেতর শ্রাবণী দত্তের ২০২১ সালে আঁকা ‘কম্পোজিশন’ মিক্সড মিডিয়ার কাজ। কনসেপচুয়াল আর্টের এই নিদর্শনটি ত্রিকোণাকার। এর অর্থোদ্ধার আয়াসসাধ্য। পাশেই আশফাকুর রহমানের মিক্সড মিডিয়ায় তৈরি ‘আস্পেক্ট অফ টাইম’ শীর্ষক কনসেপচুয়াল আর্টে দুটি চেয়ারের ফ্রেম দেখা যায়। একটির চার পা কালো পাথরের, অন্যটির চার পা বাঁকানো, লাল কাঠের তৈরি। আর্ট নভোঁর সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে এই কাজের। গোবিন্দ পালের কনসেপচুয়াল আর্টে পুরনো পরিত্যক্ত বাড়ির অংশ ঘিরে গাছের কাণ্ড, ঝুরি, লতাপাতা দেখানো হয়েছে বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করে, অর্ধবিমূর্ততায়। মিনিমাল আর্টের বৈশিষ্ট্য রয়েছে এই কাজে।

নিশাত তামান্না তুলি (১৯৯৪) ‘গার্বেজ’ নামে যে কনসেপচুয়াল আর্ট তৈরি করেছেন সেটি খবরের কাগজ দিয়ে তৈরি মুণ্ডুহীন এক ম্যানেকিনের ফিগার। ফ্রিলআলা গাউনের পেছন দিকের কিছুটা মাটিতে লুটিয়ে আছে, যেমন থাকে বিয়ের কনের ব্রাইডাল গাউন। কনসেপশনে এবং এক্সিকিউশনে চমৎকার একটি কাজ। এর পাশে অমিতাভের (১৯৮৫) কাঠের ভাস্কর্য বিমূর্ত, কিন্তু ছন্দময়।

এজাজ কবীরের (১৯৭১) মিক্সড মিডিয়ায় তৈরি কনসেপচুয়াল আর্ট চটের থলি দিয়ে তৈরি। চটের মুক্তিযোদ্ধারা মাথার ওপর উঁচু করে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন যে বিশাল পতাকা তার মাঝখানের শূন্য গোলাকার স্থানটি সূর্য। অবশ্য সেটা বোঝার জন্য ছবি থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়াতে হয়। মৌলিক ধরনের কাজ এটি, পুরস্কার পাওয়ার মতো।

গোবিন্দ পাল (১৯৯৭) মিক্সড মিডিয়ায় তৈরি করেছেন কনসেপচুয়াল আর্ট ‘কলস’। কংক্রিটের তৈরি কলসের মতো আধারের সামনে এবং পেছনের খোলা মুখ দিয়ে নিচে নেমে এসেছে বৈদ্যুতিক তার। বেশ ভালো কাজ, তবে পুরস্কার পাওয়ার মতো মনে হয় না।

বেশ কয়েকটি মাঝারি এবং ছোট আকারের ভাস্কর্য রয়েছে এই ঘরের মেঝেতে। অমিতকুমার দাশের (১৯৯৭) ‘মাতৃত্ব’ সাদা মার্বেলে তৈরি, অর্ধবিমূর্ত রূপের। মিলনকুমার দাসের (১৯৯৫) গ্রানাইট পাথরে তৈরি ‘কৃষক’ও অর্ধবিমূর্ত। মাঝারি সাইজের গ্রানাইটে তৈরি কৃষকের স্টাইলাইজড আনত ফিগারে যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ক্লান্তি এবং হতাশার ভার। ব্রোঞ্জে তৈরি আব্দুর রহমানের (১৯৯৭) ‘আরেক মুহূর্তের অপেক্ষায়’ সবুজ রঙের ছোপ লেগেছে, যেন তার দীর্ঘ প্রতীক্ষার দ্যোতক হিসেবে। স্বাধীন মণ্ডল (১৯৯৭) ‘প্রকৃতির ছন্দ’ নামে বাদামি রঙের যে-ভাস্কর্য তৈরি করেছেন সেটি বিমূর্ত হলেও শামুকের আদলের আভাস দেয়। তপন কুমার হালদারের (১৯৭৯) সাদা রঙের গোষ্ঠী (group) ভাস্কর্য ‘সম্পর্ক’, অর্ধবিমূর্ত হলেও মানুষের যূথবদ্ধতার পরিচয়দানে সফল। বেশ পরিচ্ছন্ন আর সামঞ্জস্যপূর্ণ এই কাজ।

তিন

তিনতলার তিন নম্বর কক্ষে স্থান পেয়েছে কিউরেট করা কয়েকটি গ্রুপের বিষয়ভিত্তিক (theme) শিল্পকর্ম। এদের অভিহিত করা হয়েছে ‘প্রকল্প’ শিরোনামে, হয়তো এক্সপেরিমেন্টাল, এই অর্থে। প্রদর্শনীতে শুধু নতুন সংযোজন নয় এই সেকশন, নতুন চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে যৌথ প্রয়াসে, যা ভবিষ্যতে নতুন দিগন্তের সন্ধান দিতে পারে।

এস এম সুলতানসহ সাতটি কিউরেটেড সেকশন আছে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর এই এডিশনে। ‘পৃথিবীর প্রতিধ্বনি’ শীর্ষক প্রদর্শনীর কিউরেটর হারুনুর রশীদ টুটুল। এতে অংশগ্রহণ করেছেন কারু তিতাস, কুন্তল বাড়ৈ, মাহমুদা সিদ্দিকা, মাহমুদুর রহমান দীপন, মো. রাসেল রানা, প্রমথেশ দাস পুলক এবং তাহমিনা হাফিজ লিসা। এই কিউরেটেড প্রদর্শনীর বিষয় স্বয়ংব্যাখ্যিক; অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা পরিবেশ দূষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে তৈরি করেছেন চিত্রকর্ম, ভাস্কর্য, স্থাপনা, ভিডিও আর্ট ইত্যাদি। ‘পানির দামে কেনা’ নামে কিউরেটেড প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন অভিজিত চৌধুরী এবং এতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন : আবু সালেহ মো. নাহিয়ান, সুবর্ণা, সাখাওয়াত হোসেন, অনুজ দাস, আহসানুল কাইয়ুম, সানজিদা ইসলাম জেরিন, তনুশ্রী রায়, স্নিগ্ধ পাল আনন্দ, অর্পিতা রায় পূর্ণা এবং মো. জুবায়ের হাওলাদার। এই প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় স্থাপনাশিল্প হলো অসংখ্য প্লাস্টিকের গ্লাস মাটিতে রেখে, শূন্য থেকে ঝুলিয়ে, দেয়ালে রেখে পানি সংকটের ওপর আলোকপাত। পাশাপাশি দুটি সেকশন নিয়ে এই ইনস্টলেশন সম্পূর্ণ হয়েছে, একটির দেয়ালে নদী অথবা সমুদ্রে পানির বিন্দু পড়ার দৃশ্য, অন্যটিতে ব্যবহারকারী দরিদ্র নারীর অসহায় কয়েকটি ছবি। কল্পনায় এবং রূপায়ণে এই শিল্পকর্ম অনবদ্য।

‘আত্মানুসন্ধান’ শীর্ষক প্রদর্শনীর কিউরেটর সুমন ওয়াহিদ। এতে অংশ নিয়েছেন : শেখ আফজাল হোসেন, সুশান্ত কুমার অধিকারী, সঞ্জয় চক্রবর্তী, মোহাম্মদ ফখরুল ইসলাম মজুমদার, আরাফাত করিম, মিশকাতুল আবীর, শেখ ফাইজুর রহমান, নুর মুনজেরীন রিমঝিম, প্রসূন হালদার এবং আহসানা নাসরীন হক অঙ্গনা। এই শিল্পগোষ্ঠী মনে করেন, শিল্পীদের কাজে নিজ অস্তিত্বের প্রতিফলন ঘটে নানাভাবে। অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রতিফলন সমকালীন বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতেরই অনুসন্ধান। নিছক ইগো নয়, বৃহত্তর জীবনজিজ্ঞাসা রয়েছে শিল্পীদের আত্মানুসন্ধানের পেছনে, মনে করেন তাঁরা। প্রদর্শনীর রেখাচিত্র, ছাপচিত্র, ডিজিটাল ইমেজ প্রভৃতি মাধ্যম উপস্থাপন করেছে শিল্পীদের নিজ অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা এবং তার মাধ্যমে তাঁদের সামগ্রিক জীবনদর্শন ও তার বয়ান।

‘প্রতি (বন্ধ + বিম্ব)’ শীর্ষক কিউরেটেড প্রদর্শনীর কিউরেটর রত্নেশ্বর সূত্রধর। তাঁর আয়োজিত প্রদর্শনীতে যারা অংশ নিয়েছেন তাঁরা হলেন : ইমতিয়াজ ইসলাম, রাসেল রানা, পূর্ণিমা আক্তার, মো. সবুজ, তামান্না লিজা, রূপশ্রী হাজং এবং ম. আরমান চৌধুরী। কোনো উদ্যোগকে যে প্রতিবন্ধকতা বাস্তবতার প্রতিফলনকে বদলে দেয় এবং তার ফলশ্রুতিতে শৈল্পিক বাস্তবতার প্রতিবিম্বিত রূপ বন্ধ এবং বিম্ব, দুটি ধারণার সম্মিলন ঘটায়, একই টাইম লাইনে বিবেচনা করেছে সেই প্রক্রিয়া প্রদর্শনীর শিল্পকর্মটি। শব্দবন্ধ দুটিকে যুক্ত করে একটি কমন ভাষিক রূপ দেওয়ার প্রয়াস রয়েছে এই কিউরেটেড প্রদর্শনীর শিল্পকর্মে। বেশ একটা ভুয়ো দার্শনিকতাও রয়েছে এই ধারণার পেছনে। অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের কাজে বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে লোকজ কারুকাজ, গ্রাফিক্স, কোলাজ রয়েছে।

রাশেদ সুখন কিউরেট করেছেন ‘নন্দনচিত্তে অবয়বঘনিষ্ঠতা’ নামে প্রদর্শনী। তাঁর সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন তর্পন পাল। এতে অংশ নিয়েছেন : মো. রাজন, সাজন পাড়, আরিফ বাচ্চু, সানজি সুলতানা, সোহানুর রহমান, সুদীপ চাকমা এবং নূপুর পোদ্দার। প্রদর্শনীটির দেয়ালে লেখা রয়েছে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের বাণী : ‘যে ছবি সুন্দরের দিকে নিয়ে যেতে পারে সে-ই হচ্ছে মহৎ ছবি।’ যে দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে নতুন প্রজন্ম তাদের মুক্তির পথের দিশা দেওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন এই প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা তাঁদের কাজের মাধ্যমে। শিল্পে সুন্দরের জয়গান অনুসন্ধান করেছেন তাঁরা বর্তমানের হতাশার ওপর দাঁড়িয়ে। এখানে প্রদর্শিত শিল্পকর্মের মধ্যে রয়েছে মিক্সড মিডিয়ার ইনস্টলেশন, কোলাজ এবং গ্রাফিক্স।

‘প্লাস্টিক স্রোত’ প্রদর্শনীটি কিউরেট করেছেন আফসানা শারমিন, অংশ নিয়েছেন – মাশকুরা বিনতে আরিফ রাত্তিলা, সাহিবা কিরণ এরিন, রোদেলা জামাল মিম, আশ্রাফুল আলম অনীক, মো. আরিয়ান ইসলাম, আনিকা মাহমুদ, মিজানুর রহমান মিজান, সুমাইয়া সুলতানা, ফাহাদ আনোয়ার, নীলিমা ইসলাম, ফয়সাল আহমেদ স্বাধীন, তৌফিক এলাহী শুভ, শিহাবুর রহমান, মায়শা ফেরদৌস, তাহমিনা আফরোজ উপমা, রবিউল বারি, বাদশা ফাহাদ, মুস্তারি তাসনিম, জাহিদুল ইসলাম ফয়সাল, নুসরাত জাহান, শাহরুখ এনাম, আইরিন আয়রা, ফাইরুজ মুনিয়া, নুর এ আফ্রিন মিম, কানিজ ফাতেমা, মাজহারুল ইসলাম তুহিন, নীতি রাণী সরকার এবং রত্ন সাহা। এই শিল্পীরা প্রধানত ফ্যাশন কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার করে তার কদর্যতা এবং পরিবেশ দূষণের পরিণাম দেখিয়েছেন তাঁদের কাজে। এই ঘরানার অনেক শিল্পকর্ম একসঙ্গে দেখাতে গিয়ে গ্যালারির স্পেস ঘিঞ্জি হয়ে গিয়েছে।

শিল্পী এস এম সুলতানের জন্মের শতবর্ষ উপলক্ষে শাওন আখন্দ কিউরেট করেছেন তাঁর নির্বাচিত শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। এই সেকশন জাতীয় চারুকলার পঁচিশতম প্রদর্শনীর শুধু বিশেষ নয়, গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। কিউরেটে সাহায্য করেছেন মিজানুর রহমান, হেমায়েত হিমু, কিরীটি সাহা, পারভেজ আখন্দ, তামান্না আবেদিন, মেহেদী হাসান, আবু খবির, জাইমা হাসান, মারদুল ইসলাম ও মো. আশরাফুল ইসলাম।

চার

গ্যালারি ভবনের চারতলায় প্রদর্শিত হয়েছে মিক্সড মিডিয়ার শিল্পকর্ম। প্রবেশপথের হলওয়েতে রয়েছে সামিউল আলমের (১৯৮৭) ইনস্টলেশন ‘বিশ্বশান্তি, বিপন্ন ও ধ্বংস’। অনেকগুলি মাছ রাখার কাচের জার সিলিং থেকে ঝুলিয়ে তাদের এক একটির মধ্যে শিল্পীর কল্পনায় বিপন্নতা, ধ্বংস এবং বিশ্বশান্তির প্রতীকগুলি রাখা হয়েছে। নিচে মেঝেতে পড়ে আছে শুকনো পাতা, ফুল এবং হাতুড়িসহ অন্য যন্ত্রপাতি। উপকরণের বিন্যাস এমন হয়নি যা দেখে ধারণাটি সম্বন্ধে অবহিত হওয়া যায় সন্দেহাতীতভাবে, তবে কাজটি দেখতে মন্দ না।

ঘরের ভেতরে কয়েকটি কাঠের গুঁড়ির খণ্ড দিয়ে তৈরি হয়েছে সরলধর্মী ইনস্টলেশন। তারপরই বাঁদিকের দেয়ালসংলগ্ন বিশাল ত্রিমাত্রিক-কনসেপচুয়াল আর্টে পরিস্ফুট হয়েছে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। ছোট ছোট সাদা এবং কালো রঙের প্লাস্টিক পাইপের টুকরো দিয়ে করা হয়েছে এই অনবদ্য ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম। শিল্পী মিজানুর রহমানের (১৯৭৫) এই কনসেপচুয়াল আর্ট প্রদর্শনীর মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে।

তানভির আহমেদ জয়ের (১৯৯৮) তিনটি কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ইনস্টলেশনকে (‘মুক্তির আশা’) ভাস্কর্যের শ্রেণিতেও ফেলা যায়। অর্ধবিমূর্ত তিনটি ফিগারে প্রাকৃতিক চরিত্রের স্বাভাবিকতা রয়েছে।

জয়তু  চাকমার (১৯৯০) ‘নির্বাপিতা সত্তা’ অ্যাক্রিলিকে তৈরি চিত্রকর্মে এক চাকমা নারীকে দেখানো হয়েছে ট্রিপটিচে। লাইফ সাইজের ফিগারে এই নারীকে প্রথম দেখা যায় পূর্ণাঙ্গ রূপে, দ্বিতীয় ছবিতে তার অর্ধেক দেহ পরিদৃশ্যমান, বাকিটা অদৃশ্য; তৃতীয়টিতে দেহের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ দেখা যায়, বাকি অংশ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। তিন পর্বে দেহের ছবিতে দেখা যায় ক্যাটারপিলার কাজ করছে, যে মোটিফ জানায় যে, এই চাকমা নারীর
নিকট-অন্তর্ধানের পেছনে রয়েছে সমতলের মানুষের লোভ এবং লালসা। এই ছবিকে প্রকৃতি বিনাশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও মনে করা যেতে পারে। ছবিটি চিত্রকলা বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে।

সুবর্ণা মোর্শেদার ‘অন্ধকার সময়’ শিল্পকর্মে ছোট এবং বড় ফ্রেমে বাঁধা দশটি সাদা-কালো স্কেচের ফর্ম রয়েছে। মাধ্যমে বিমূর্ত এবং অর্ধবিমূর্ত, দুই-ই ব্যবহার করা হয়েছে এই ছবিতে। শিল্পী কোভিডের মহামারি যে শূন্যতা এবং অনিশ্চিতের ভাবনা এনেছিল মানুষের মনে, তার প্রতিফলন করার প্রয়াস পেয়েছেন।

বিলাস মণ্ডল (১৯৯৬) তাঁর ‘লিভিং ইন ওয়াটার’ শীর্ষক ইনস্টলেশনে বৃত্তাকারে অনেকগুলি ছোট কাঠের গোলাকার গুঁড়ি ঝুলিয়েছেন সিলিং থেকে, যেগুলি সঞ্চরমান। প্রতিটি গুঁড়ির উপরিভাগে খোদাই করা হয়েছে মিনিয়েচার আকারে নানা মোটিফ। পেছনের দেয়ালে একই আকারের মোটিফসহ কয়েকটি কাঠের গুঁড়ি টানানো। মেঝেতে গোলাকার হয়ে পড়ে আছে কাঠের তুষ। প্রদর্শনীর স্থানে আলোক নিয়ন্ত্রিত করে ভাবগম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই ছবিটিতেও মনে হয় বিপন্ন পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। বেশ পরিশ্রমী এই কাজ, বিশেষ করে খোদাই করা মিনিয়েচার মোটিফগুলি।

ফাহাদ হাসান (১৯৮৭) ‘বিস্মৃতির সুর’ শীর্ষক ইনস্টলেশনে অনেকগুলি মাটির সরা ব্যবহার করেছেন, যেগুলি কাঠের বেদির ওপর রাখা। প্রতিটি সরাতেই পানি রয়েছে অল্প পরিমাণে, যার ভেতর ভেজানো হয়েছে বিভিন্ন উপকরণ, যেমন খবরের কাগজের টুকরো, চাল, জঞ্জাল, কাদামাটি ইত্যাদি। কাজটির পেছনের কল্পনা অভিনব, সেই অনুপাতে অর্থময় মনে হয় না।

‘অভিযোজন’ নামে যে চিত্রকর্ম এঁকেছেন আহসানা নাসরীন হক অহনা সেটি পরাবাস্তব ঘরানার। মার্ক শাগালের মতো শূন্য থেকে ফিগারও (হাতি) দেখিয়েছেন তিনি। রঙের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ এবং কম্পোজিশনের ভারসাম্য রক্ষা লক্ষণীয়। পাশেই সজীব কুমার দে (১৯৯৭) তাঁর ‘অব্যক্ত গল্প’ ইনস্টলেশনে সিলিং থেকে কয়েকটি সাদা-নীল বালিশ ঝুলিয়েছেন একই উচ্চতায়। বালিশগুলির নিচে কিছু নকশা করা। এমন আহামরি কিছু নয়, কিন্তু এটি স্থাপনা মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছে। কাছেই, ডানদিকের দেয়ালে বেশ বড় আকারের রিকশা পেইন্টিং ‘হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা’, লোকশিল্পের অল্প ক’টি নিদর্শনের মধ্যে একটি। এটি এঁকেছেন আবদুর রব (১৯৬৬)।

ফইয়াজ ইমরান (১৯৯৭) যেন নিজেকেই ব্যঙ্গ করে আত্মপ্রতিকৃতি হিসেবে ছোট আকারের কয়েকটি ফ্রেমে বাঁধা ছবিতে এঁকেছেন ছাগলের মুখ। বেশ নতুনত্ব আছে এই ছবিতে, একাধিক অর্থেই।

পাশের ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে ওপর থেকে ঝুলছে একটি বড় চোখ, নিচে একটি আধারে জড়ো করে রাখা হয়েছে পড়ে যাওয়া আরো অনেক চোখ। আধারের চারদিকে শুকনো ডালপালা রাখা, যেন আগুন জ্বালানো হবে। শিল্পী দিবাকর হালদারের (১৯৯৮) ‘সেভিংস’ (savings) শীর্ষক এই ইনস্টলেশনটি বেশ রহস্যময়, এর অর্থ উদ্ধার করা সহজ নয়। বর্তুলাকার বস্তুগুলি কি ডিম? আর শুকনো ডালপালা নীড়? তাহলে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায় এই বলে যে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঞ্চয় করে রাখা হচ্ছে। হ্যাঁ, তাই হবে, নচেত সার্থকনামা হয় না।

আলোকচিত্র সেকশনে বেশ কিছু ফটো প্রদর্শিত হয়েছে, বেশির ভাগই প্রকৃতিবিষয়ক। আসাদুজ্জামান আসলাম তাঁর ‘জনজীবন’ নামের স্থিরচিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। ছবিতে দেয়ালে পাতার ছায়া, একপাশে ডালপালা দেখা যায়। কোনো প্রাণীর উপস্থিতি নেই। ‘জনজীবন’ নামটি বেমানান মনে হয়।

নুসরাত জাহান (১৯৯৮) তাঁর ছাপচিত্র ‘হোম ইজ এ ফরেন প্লেস’ লিথোগ্রাফের জন্য ছাপচিত্রে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছেন। কাজটি নিঃসন্দেহে ভালো।

হৃদিতা অনিশার (১৯৯৬) ‘বনবাসে জন্ম’ ডিজিটাল প্রিন্টের কাজ। এই ছবিতে প্লাস্টিকের স্ট্যান্ডে দু-পাতা করে একটা ছাপা ম্যাগাজিনের নয় জোড়া প্রিন্ট আউট ডিসপ্লের জন্য রাখা হয়েছে। পাতাগুলির কয়েকটি সচিত্র। ডিজিটাল আর্টে এর চেয়ে সরলতম প্রদর্শন আর কিছু হতে পারে না।

‘পরিত্যক্ত কার্টন’ নামে হালিমা আখতার (১৯৯৯) যে শিল্পকর্ম প্রদর্শন করেছেন সেটি দেখলে কার্ডবোর্ডের তৈরি বলে না মনে হয়ে পারে না। রঙে, টেক্সচারে এবং প্রাচীনত্বে এটি এতই মৌলিক। কিন্তু তিনি এটি তৈরি করেছেন পাথর ব্যবহার করে। ভাস্কর্য শাখায় এটি এক পরম বিস্ময়কর সৃষ্টি।

পাঁচ

প্রদর্শনীতে সব কাজ দেখার পর মনে হলো, মাধ্যম হিসেবে চিত্রকলা পেছনে পড়ে যাচ্ছে, এতই কম তাদের সংখ্যা। অথচ চিত্রকলাই শিল্পের আদি এবং চিরায়ত মাধ্যম। তাৎক্ষণিক চমক সৃষ্টি করা যায় না, বেশ আয়াস এবং সময়সাধ্য, ব্যয়বহুলও বটে, এই সব কারণে কি চিত্রকলার চর্চা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে?  এই ধরনের চারুকলা প্রদর্শনীতে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য কি মনে করা হচ্ছে অন্য অত্যাধুনিক, আভাঁ-গার্দ মাধ্যমের শিল্পকর্মকে অগ্রাধিকার দেওয়াই শ্রেয় এবং বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলের ভাবার বিষয়।

সুখের কথা, পুরনো মাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্য শুধু টিকে নেই, ক্রমেই তার উপস্থিতি মুখ্য হয়ে উঠেছে। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে ভাস্কর্যের সংখ্যা এবং তাদের আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য দেখে একথাই মনে হলো। দেখা যাচ্ছে, আমাদের ভাস্কর সমাজ নির্মাণ উপকরণের সীমাবদ্ধতা এবং প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। বিশেষ করে মার্বেলে বিমূর্ত, অর্ধবিমূর্ত কাজের সংখ্যা এবং উঁচু মান এই মাধ্যমে করা কাজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আশার সঞ্চার করেছে। শিল্পসংগ্রাহকদের এখন ভাস্করদের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে আসতে  হবে।

হতাশাব্যঞ্জক বলতে হবে প্রাচ্যকলা এবং লোকশিল্পের বিভাগে শিল্পকর্ম প্রদর্শনের স্বল্পতা। কারুশিল্পের নিদর্শনেরও অভাব দেখা গেল জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে। এই পশ্চাৎপরতা এবং বন্ধ্যত্ব আরো দুশ্চিন্তার বিষয়, কেননা এর সঙ্গে আমাদের ঐতিহ্য  সংরক্ষণ এবং তার ওপর ভিত্তি করে নতুন সৃষ্টির প্রশ্ন জড়িত।

শিল্প-সাহিত্যের সব শাখার মধ্যে চারুকলাকেই বলতে গেলে সবচেয়ে বেশি গ্রাস করেছে পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যম এবং ধারা। অনেকদিন থেকেই সংস্কৃতিতে আন্তর্জাতিকতার ভূমিকা মেনে নিয়ে কাজ করছেন বিভিন্ন শাখায় এবং মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক সমাজ। কিন্তু এই অনুসরণ যদি হয় নিজস্ব জাতীয় ঐতিহ্য ও বিশিষ্ট সৃজনকর্মের বিনিময়ে, তাহলে তা হবে আত্মপরিচয় বিস্মৃত হওয়ার সমান। বিভিন্ন কর্মসূচিতে, শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে এবং পাবলিক পারফরম্যান্সের আয়োজনে নিজস্ব সংস্কৃতি এবং জাতীয় ঐতিহ্যের কথা মনে রেখে পদক্ষেপ নেওয়া এখন খুব প্রয়োজন।

পরিশেষে তিনটি প্রস্তাব রেখে এই সমীক্ষা শেষ করছি। প্রথম প্রস্তাব এই যে, প্রত্যেক বার্ষিক জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে বয়সের ক্রমানুসারে একজন সিনিয়র শিল্পীর একক শিল্প-প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এতে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে এবং নতুন প্রজন্মের সামনে তাঁদের কাজ তুলে ধরে উৎসাহিত করা যাবে। দর্শকরাও প্রবীণ এবং খ্যাতনামা শিল্পীদের কাজ দেখার বিরল সুযোগ পাবেন। দ্বিতীয় প্রস্তাব হলো এই যে, প্রত্যেকবার যেসব শিল্পী জাতীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য কাজের নমুনাসহ আবেদন করেন তাঁদের অর্ধেকই বাদ পড়ে যান। যেহেতু তাঁরা চারুকলার স্নাতক এবং উৎসাহের সঙ্গে চর্চা করে যাচ্ছেন, সেজন্য তাঁদের উৎসাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী শেষ হওয়ার  অব্যবহিত পর তাঁদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘দ্বিতীয় প্রদর্শনী’ নামে  আরেকটি আয়োজন করা যেতে পারে। এর সময়কাল হতে পারে দুই সপ্তাহ। শিল্পীর নাম, শিল্পীর  পাসপোর্ট সাইজ  ছবি,  প্রদর্শনীতে স্থান পাওয়া কাজের মাধ্যম ও সংখ্যা উল্লেখ করে সাদা-কালোতে ক্যাটালগ ছাপানো হলে ব্যয় সাশ্রয় হবে।

সর্বশেষ প্রস্তাব হলো, জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী হেমন্ত অথবা শীতকালে করা হোক।

* ব্রোশিউরের অভাবে গ্যালারিতে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে  তাড়াতাড়ি ছবি ও শিল্পীর নাম লিখতে হয়েছে। এই কারণে নামের বানান ভুল হতে পারে। স্থানাভাবে কারো কারো নাম অন্তর্ভুক্ত করতে পারা গেল না বলে দুঃখিত।