এই বিলের নাম কী, আমি জানি না। আমার একান্ত সহকারী আমাকে নামটা বলেছিলেন একটু আগে। আমি ভুলে গেছি। কারণ বিল দেখার জন্য এখানে আসিনি। এসেছি হাঁস দেখতে।

অনেক হাঁস। বিলের জলে সাঁতার কাটছে। মাঝে মাঝে মাথা ডুবিয়ে খাবার খুঁজছে। মাঝে মাঝে কোনো কোনো হাঁস জলের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ছোট মাছ অথবা কাঁকড়া মুখে নিয়ে ভেসে উঠছে। সেটা কেড়ে নেওয়ার জন্য অন্য হাঁসগুলি উড়াল-আক্রমণ করছে। মাঝে কিছু পুরুষ হাঁস কোনো নারী হাঁসের ওপর উপগত হওয়ার চেষ্টা করছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য।

যখন অন্যরা থাকে না, তখন সব প্রোটোকল ভেঙে সেলিম সাহেব সহজ হয়ে যান। আমার কাছে এসে খুব ক্যাজুয়াল ভঙ্গিতে বলেন, ‘স্যার, হাঁস দেখার কী হলো! আমি তো ভাবছি আপনি বিল দেখতে এসেছেন।’

আমি তাঁর চোখের দিকে কয়েক সেকেন্ড স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। কিছু বললাম না। সেলিম সাহেব একটু হকচকিয়ে গেলেন। কিন্তু দমলেন না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘জানেন স্যার, পৃথিবীতে সব ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি হয়, একমাত্র হাঁসের প্যাক প্যাক ছাড়া! এবং বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি এর কারণ!’

এবার আমি একটু সহজ হলাম। বুঝলাম সেলিম সাহেব অনেক ঝানু।

আমি বললাম, ‘জানি।’

এবার সেলিম সাহেব বিস্মিত হলেন। চোখ জোড়া বড় বড় করে লজ্জাবনত ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্যার আপনি সত্যিই জিনিয়াস। আমি অনেকজনকে এ-কথা বলেছি। তারা কেউ জানতো না। আপনি জানেন, এটা জেনে খুব অবাক হয়েছি।’

আমি আরো একবার হাঁসের ঝাঁক, বিলের স্বচ্ছ পানি এবং ওইপারের সাদা সাদা বকের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি কীভাবে জানি, আপনি শুনবেন?’

এরপর সেলিম সাহেবের উত্তরের জন্য কোনো অপেক্ষা না-করেই বললাম, ‘আমি জানি, কারণ আমি একজন হাঁস।’

বলেই ফসলকাটা জমির আইল ধরে মূল রাস্তায় রাখা আমার গাড়ির দিকে রওনা দিলাম। পেছনে সেলিম সাহেবের অভিব্যক্তি কী আমি জানি না।

দুই

গ্রামের একটা গন্ধ থাকে। আমি সে-গন্ধ পাচ্ছি। পাখির আওয়াজ কানে আসছে। আলপথে হাঁটতে মাঝে মাঝে পা নিচে চলে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি দামি প্যান্টের গায়ে মাটি লেগে যাচ্ছে। ঘাসের ছোঁয়া লাগছে। চোরাকাঁটা দেখলাম বহুদিন পর। সেগুলি প্যান্টে গেঁথে যাচ্ছে। শরীরে কোনো মাটি লাগাতে পারছি না। অথচ আমি মাটির এত কাছে! আমার খুব ইচ্ছে করছে জুতো খুলে, কোট-টাই খুলে জল-কাদার এই ভূমিতে শুয়ে একটু আকাশ দেখার। হলো না।

ড্রাইভার আমাকে দেখে দৌড়ে এলো।  অফিসের ড্রাইভার। তাই সবকিছু জানে না। আমাকে এরকম দেখে আকাশ থেকে পড়ছে। আমি হাতের ইশারা করলাম। ড্রাইভার যা বোঝার বুঝে গেল।

ডোনা ফোন করেছে।

‘হ্যালো।’

‘কতক্ষণ ধরে ফোন করছি। কী করো তুমি? ফোন ধরো না কেন?’ ডোনার বাজখাঁই কণ্ঠ।

‘ব্যস্ত ছিলাম।’

‘ওই একটা কথাই তো শিখেছো তোতা পাখির মতো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। বলো?’

‘তা আর শুনতে হবে না। ব্যস্ততা নিয়েই থাকো।’ ফোন রেখে দিলো ডোনা।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ফোনটা পকেটে রাখলাম।

তিন

ড্রাইভার কাকে যেন ফোন দিচ্ছে বারবার। আমি চারপাশটা দেখছি। ঘন গাছগাছালি। কাশবন। বুনোফুল। ইউক্ল্যালিপ্টাস। বিস্তীর্ণ আকাশ। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। ড্রাইভার বলছে, ‘স্যার, সেলিম স্যার তো ফোন ধরে না।’

বুঝতে পারলাম ড্রাইভার সেলিম সাহেবকে ফোন দিচ্ছিল। এবার তাকে বিলের দিকে হেঁটে যেতে দেখলাম।

ফোন হাতে নিয়ে দেখি ডোনার মেসেজ। ‘তাড়াতাড়ি এসো। আয়ান কাচ্চি ছাড়া আজ রাতে কিছু খাবে না। তুমি এক্ষুনি নিয়ে এসো।’

আমি ফিরতি টেক্সট করলাম। ‘আমি খুব ব্যস্ত। নগর থেকে বেশ দূরে। ভিজিট শেষ করে জাস্ট গাড়িতে বসলাম। রাত ৯টায় মন্ত্রী মহোদয়ের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠক। আন-অফিসিয়াল। কেউ থাকবে না। নো পিএস, নোবডি, নো মিডিয়া। ফেরার পথে নিয়ে আসবো।’

ডোনা ফিরতি টেক্সট করেছে। ‘তুই তোর মিটিং নিয়ে থাক।’

চার

সেলিম সাহেবকে নিয়ে ড্রাইভার ফিরে এসেছে। আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো। আমি ল্যাপটপ ওপেন করলাম। মেইলগুলি চেক করতে গিয়ে দেখি অভিনন্দন বার্তা। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণাপত্র জমা  দিয়েছিলাম। অনুমোদন করেছে। অবশ্য এটা এবারই প্রথম নয়। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া হয়েছে আমার। পৃথিবীর সেরা জার্নাল আমার লেখা প্রবন্ধগুলি খুব গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে। পেঙ্গুইন থেকে বের হয়েছে আমার বই। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক দক্ষিণ এশীয় প্রতিনিধি হিসেবে এখনকার প্রজেক্ট আমার বাংলাদেশ নিয়ে। বন্ধুরা বলেছিল, এখানে দুর্যোগ নিয়ে কাজ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না। সব চোর। এরকম ভুল কেউ করে! তুমি যতই পরিকল্পনা করো, যতই আওয়াজ তোলো কোনো লাভ নেই। কোনোই প্রতিধ্বনি হবে না। প্যাক প্যাক করাই সার।

কিন্তু আমি এই ভুলই করতে চেয়েছিলাম। করেছিও। আলো-ঝলমল নির্ঝঞ্ঝাট একটা জীবন পার করতে পারতাম। করিনি। আমি

ইউরোপ-আমেরিকার রমরমা জীবন  ছেড়ে চলে এসেছি বাংলাদেশে। একটু হলেও যদি কিছু করা যায়!  অর্থ, সম্মান, ক্ষমতা সব নিয়ে আমার এখন দিনাতিপাত। ঘরে সুন্দরী বউ। আর পুত্রসন্তান।

পাঁচ

মূল রাস্তায় উঠে এসেছে আমাদের গাড়ি। ড্রাইভার বলছে, ‘স্যার কোনদিকে যাবো?’ আমি একটা জায়গার কথা বললাম। শুনে দুজনেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। সম্ভবত ভাবছে, ঘরে সুন্দরী বউ, সুখী সংসার আর নিপাট ভদ্রলোকের ভেতরে এরকম বদভ্যাস কেন? মানুষ কত বিচিত্র!

না, আমি মদের বারে যেতে চাইনি। আমি যেতে চেয়েছিলাম এই এলাকার এক যৌনপল্লিতে।

গাড়ি চলছে। উন্নয়নের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে চারিদিকে। শ্রমিকরা ফিরছে যার যার ঘরে।

আমিও তো শ্রমিক। কোথায় ফিরছি? কেন যাচ্ছি সেখানে? শিউলি, শেফালিকে খুঁজতে? আচ্ছা, তারা কি টিভি দেখে? যদি দেখে তাহলে আমাকে দেখে চিনতে পারে কি? কপালের কাটা দাগ তো এখনো রয়েছে। এখনো খাড়া খাড়া চুল। শুধু একটু পেকে গেছে। একটু বিবর্ণ। তাদের মধ্যে কি কোনো অভিমানের স্পর্শ রয়েছে! একটি নৌকার অভাবে পার হতে পারছে না! আসতে পারছে না আমার কাছে! নাকি আড়াল করে রেখেছে নিজেদের। তাদের ওই জীবন নিয়ে আমার এই জীবনের সামনে হাজির হতে চায় না! কিন্তু আমি তো খুঁজে যাচ্ছি তাদের কতদিন ধরে, কত জায়গায়!

গাড়ি থামলো। ড্রাইভার গেট খুললো। আমি বের হয়ে এলাম। হাঁটছি। হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি শিউলি-শেফালির কাছে।

ছয়

গাড়ি চলছে। ড্রাইভারকে বলেছি বাসায় যেতে। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবো না আজ। মোবাইল বন্ধ করেছি। সেলিম সাহেবকে বললাম, ‘আপনার ফোনটা দিন তো। একটা মেসেজ লিখবো।’

সেলিম সাহেব হাত বাড়িয়ে ফোন দেন আমার হাতে। মেসেজ লিখতে গিয়ে দেখি সেলিম সাহেব কাউকে টেক্সট করেছে, ‘জানো, আমাদের স্যার না একটা হাঁস। বিলের দৃশ্য দেখার পর যখন ফিরে যাচ্ছিলেন স্যার, দেখি উনি স্যার নন, স্যারের ড্রেস পরে একটা ইয়া বড় হাঁস,  হেঁটে যাচ্ছে গাড়ির দিকে।’

 টেক্সট না-করেই মোবাইলটা ফেরত দিলাম সেলিম সাহেবকে।

সাত

দরজা খুলে দিলো ডোনা। একবার তাকালোও না। হাত থেকে ছেলের জন্য আনা কাচ্চি বিরিয়ানির প্যাকেটও নিল না। সোজা চলে গেল বেডরুমে। ছেলে এসে খাবার নিয়ে গেল। আমি সোফায় বসে টাইয়ের নটটায় জাস্ট হাত দিয়েছি খোলার জন্য, দেখি ডোনার অগ্নিমূর্তি। ‘এই এগুলো কী এনেছিস। তোকে যে কাচ্চি বিরিয়ানি আনতে বলেছিলাম। আয়ান বলছে এগুলো কুত্তার মাংস। তুই এইসব হাঁসের মাংস কোত্থেকে আনলি ছোটলোকের বাচ্চা।’

আমি স্তম্ভিত হয়ে ডোনার দিকে তাকিয়ে আছি। তখনই ওই প্যাকেট আমার দিকে ছুড়ে মেরে দিলো ডোনা। জোরে জোরে হেঁটে চলে গেল বেডরুমের দিকে।

খাবারের ঝোলে আমার বুক-পেট মেখে গেছে। শার্ট, প্যান্ট, কোট, টাই একাকার। মুখও মেখে গেছে। চোখ জ¦লছে খুব। কিন্তু কোথায় যেন একটা শান্ত ভাব চলে এসেছে। আমি সোফায় গা এলিয়ে দিলাম। যাক, গন্ধে আর ময়লায় ভরে যাক সবকিছু।

আট

ইটপাড়া রাস্তা, মাটির রাস্তা, আইল আর নদী পার হয়ে বাড়ি আসতে প্রায় দুই ঘণ্টা লাগে। স্কুল তাই চারটায় ছুটি হলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে ছয়টা। আমি ঠিকমতো হাঁটতে পারলেও শিউলি আর শেফালিবু নেতিয়ে পড়ে। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। মাঝে মাঝে গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায় বসানো টিউবওয়েলের পানিই আমাদের কাছে অমৃত। সকালবেলা হালকা-পাতলা কিছু খেয়ে হাঁসগুলির জন্য শামুক কুড়িয়ে রেখে স্কুলে দে দৌড়। বিকেলে এসে বইপত্র ছুড়ে মারার আগেই সবার চোখ হাঁড়ির দিকে। আজ সানকিতে? নাকি কলসিতে? সানকিতে মানে ভাতের পরিমাণ একটু বেশি। কলসিতে মানে কম।

ভাতের পরিমাণ বেশি হলে সানকিতে রেখে দেন মা। আমরা তিন ভাইবোন একসঙ্গে ওটার ওপর হামলা চালাই স্কুল থেকে ফিরে। যে-যেটুকু খেতে পারলো ব্যস। ওটুকুই। পানি দেওয়া থাকে। খেতে একটুও সমস্যা হয় না। কলসিতে রাখলে একটু সমস্যায় পড়তে হয়। তিনজনের হাত একই সঙ্গে ঢুকতে চায় না। যে প্রথমে হাত ঢুকাতে পারে, সে পানির ভেতরে থেকে ভাত কব্জা করে বের করেই মুখে চালান করে দেয়। ওই ফাঁকে আরেকজন হাত ঢোকায়। তখন ভাতের পরিমাণ কমতে থাকে। চাপ থাকে তাড়াতাড়ি হাত বের করার।

এভাবেই চলছে আমাদের। কোনো সমস্যা হচ্ছে না। আমরা ভালো আছি। কোনো অভিযোগ নেই কারো প্রতি। মা কাজ করেন মাঠে, কখনো কখনো বাসাবাড়িতে, কখনো মাটি কাটেন। বাবা কোথায় জানি না। মানুষ মারা গেলে কোথায় যে যায়!

একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি বাড়িতে মেহমান। মা বলে, তোর মামা। সঙ্গে তাঁর দুই বন্ধু। আমরা মেহমানকে সালাম দিই। তাঁরা আমার দিকে তাকান না। শিউলি আর শেফালি বুর দিকে তাকিয়ে থাকেন।

আমরা ঘরের ভেতরে ঢুকে এক কোণায় রাখা জীর্ণ কাঠের টুলের ওপরে বইখাতা রাখি। মেহমান আসার আনন্দ আমাদের খুব স্পর্শ করে। মা আমাদের হাতে কয়েকটা বিস্কুট দিয়ে যান। বলেন, ‘খা, নাবিস্কো বিস্কুট। খুব মজা।’

আমরা নাবিস্কো বিস্কুট খেতে খেতে সেদিন সানকিতে রাখা পান্তা কিংবা কলসি ভরা জলের তলানিতে রাখা ভাত কাড়াকাড়ি করে খেতে ভুলে যাই। আমাদের নাকে এসে লাগে রান্নার সুবাস। শিউলি বু বলে, ‘হাঁস রান্না হচ্ছে।’

আমি তখনই ঘর থেকে বের হয়ে যাই হাঁসগুলি খুঁজতে। আমার ক্ষুধা কোথায় যেন হারিয়ে যায়। কোন হাঁস আজ দল থেকে ছুটে চলে গেল রান্নার পাতিলে তার জন্য আমার ভেতরটা কেমন হু-হু করে ওঠে। আমি হাঁস খুঁজতে যাই না আর পুকুরে কিংবা বিলে। তার বদলে জমির ক্ষেতের দিকে হাঁটতে থাকি হাতে খলুই নিয়ে। আজ যে কী হলো। আমি অনেক শামুক পেয়ে যাই। হাঁসগুলি পেট পুরে খেতে পারবে।

সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরি। দেখি হুলস্থূল কাণ্ড। হাঁসগুলি নির্ধারিত জায়গায় এলেও তাদের সেখানে রাখা হচ্ছে না। কারণ আজ মেহমান এসেছে। একই ঘরের মধ্যে হাঁস আর আমরা গাদাগাদি করে থাকতে কোনো অসুবিধা না হলেও মেহমানের জন্য তা হবে কেন। হাঁসের জন্য আজ অন্য ব্যবস্থা হচ্ছে।

আমি যথারীতি হাঁসের জন্য শামুক কেটে খাবার তৈরি করি। হাঁসগুলি অদ্ভুত শব্দ করে করে খেতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাবাড় করে ফেলে সব শামুক।

রান্নার গন্ধ নাকে যেতেই পেটের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি মায়ের দিকে তাকাই। মা ইশারায় বুঝিয়ে দেন, মেহমানের খাওয়া হলেই তোদের দেব। আমরা সুবোধ সন্তানের মতো বসে থাকি। মেহমানদের খাওয়া-দাওয়া হলেও তারা দীর্ঘ সময় বসে থাকেন। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকেন। কী নিয়ে যে মা এতো কথা বলেন। মাঝে মাঝে মা আনন্দ আর বিষাদের এক মিশ্রিত অভিব্যক্তি নিয়ে আমাদের দিকে তাকান।

মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙে। দেখি শিউলি আর শেফালিবু আমাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে। ওদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরার জন্য, নাকি ক্ষুধায় আমার ঘুম ভেঙে যায় বুঝতে পারি না। তবে বুঝতে পারি, তারা ঘুমায়নি। আমার গালে টপ করে এক ফোঁটা পানি পড়ে। কার চোখের পানি বুঝতে পারি না। শেফালিবু, নাকি শিউলি। আমি পাশ ফিরে শুই। তখনো আমার গাল ভিজে যায়। কার যেন চোখের জলে। শেফালিবু অথবা শিউলিবু’র।

ঘুম ভেঙে যায় সকালবেলা। হাঁসগুলি হইচই করতে করতে বের হয়ে যায়। আমি লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠি। মেহমান চলে গেছেন। বেড়ার দরজায় মা বসে আছেন।  বিষণ্ন মুখ আর ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমার দিকে নির্বাক তাকিয়ে থাকেন মা।

আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, ‘বু

কোথায়?’

মা জোরে কেঁদে ওঠেন। বলেন, ‘ওরা আসবে। কয়েকদিন পরই আসবে। শহরে গেছে বাসাবাড়িতে কাজ করতে।’

যে-রাস্তা দিয়ে আমরা রোজ স্কুলে যাই সে-রাস্তা দিয়ে আমি খুব জোরে দৌড় দিই। মা আমাকে আটকান না। দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তা ভুলে আমি গিয়ে দাঁড়াই একটা বিলের পাড়ে। দেখি অসংখ্য হাঁস জলকেলি করছে।

নয়

তারপর তেমন কিছু মনে নেই। দেখি ধবধবে বিছানায় শুয়ে আছি। সাদা ড্রেস পরা একজন নারী এসে খুব আদর করেন আমাকে।

আমাকে একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক মা পেয়ে যাই। প্রাতিষ্ঠানিক বাবাও। ভাই পাই, বোনও। কিন্তু কোথায় যেন আমার মায়ের শীর্ণ হাত আর মায়াভরা মুখটা খুঁজি। খুঁজি শিউলি আর শেফালি বু’কেও।

আমি খুব ভালো ফলাফল করি।

একদিন কে যেন আমার ভেতরে তাতিয়ে দেয় জন্ম-ভিটেয় ফেরার তাগিদ। মনে হয়, ওখানে ফিরলেই পাওয়া যাবে আমার মাকে। শিউলিবু শেফালিবু’কে। পাওয়া যাবে হাঁসগুলি। সেই বিল। মেঠো রাস্তা। জমির ক্ষেত। শামুক।

আমি ফিরে যাই। কিন্তু কেউ কিছু বলতে পারে না। জন্মভিটেও নেই। চলে গেছে নদীর ভেতরে। মায়ের কথা কেউ বলতে পারে না। বলে নিরুদ্দেশ। শিউলি-শেফালির কথা জানে। বলে, ‘ওরা তো বেশ্যা হয়ে গেছে। আইছিল একবার। সব্বাই মিল্যা খেদাই দিছি। পাপ। পাপ।’

দশ

আজকে নিষিদ্ধ পল্লিতে যাওয়ার পর তিনটা মেয়ে আমাকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু আমার দৃষ্টি চলে গিয়েছিল খানিক দূরে নিষ্পলক দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের দিকে। আমি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। শিউলিবু! কিংবা শেফালিবু! নইলে আমার দিকে অমন করে তাকাবে কেন? এক মেয়ে বলে, ‘সাহেব গো ওর তো কোনো রস নাই। বুড়ি। আমার দিকে তাকান।’ আরেকজন বলে, ‘দ্যাখেন না সাহেব খালি পা। মানে বুঝেন?’ আরেকজন বলে, ‘নতুন মনে হয়। মানে বুঝে না। আরে সাহেব ওর রেড সিগন্যাল চলছে।’

আমি ওদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসি।

এগারো

আমার একমাত্র ছেলে ড্রয়িংরুমে এসে চিৎকার দেয়। ‘মাম্মি দেখে যাও, বাবার ড্রেস পরে একটা হাঁস আমাদের ড্রয়িংরুমটা নোংরা করছে।’