সতীশবাবুর অন্তর্ধান

আগে নাম ছিল তেঁতুলতলা। এখন হয়েছে শাপলার মোড়। শাপলার মোড় দিয়ে রিকশা এগোচ্ছে পশ্চিম দিকে। যাচ্ছি সতীশবাবুর সন্ধানে।

যেখান দিয়ে রিকশা যাচ্ছে, এর আগে নাম ছিল চামড়াপট্টি। রাস্তা জুড়ে প্যাচপ্যাচে কাদা। তার ওপর পচা চামড়ার দুর্গন্ধ। নাক চেপে না ধরলে যাওয়া-আসা করা দুষ্কর ছিল। সেই আগের অবস্থা আর নেই। এখন পাকা রাস্তা। দুপাশে দোকানপাট, ছোট কাঁচাবাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। এলাকাটির আগের সেই নামও নেই। চামড়াপট্টির পরিবর্তে হয়েছে আদর্শপাড়া। আর এখানে থাকতেন সতীশবাবু। খালের ধারে একটি বাঁশের চেঁচার বেড়ার ছোট্ট টিনের চালাঘরে।

কয়েকদিন ধরে সতীশবাবুর কথা খুব মনে পড়ছিল। জীবনে চলার পথে অনেক লোকের সঙ্গে দেখা হয়, মেলামেশা হয়। এদের কেউ কেউ মনে রেখাপাত করে। আবার অনেকের কথা মন থেকে মুছে যায়। কিন্তু সতীশবাবুকে আমি মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি।

একুশ-বাইশ বছর ধরে সতীশবাবুর সঙ্গে আমার দেখা নেই। রংপুর কারমাইকেল বিশ^বিদ্যালয় কলেজ থেকে অনার্স, মাস্টার্সের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছি ঢাকায়।

চাকরি-বাকরির খোঁজে গেছে কিছুদিন। তারপর কর্মসংস্থানের নাগাল পেয়েছি। পরে ব্যস্ততার কারণে রংপুরে আসা হয়েছে কম। আর এলেও ক্ষণিকের অতিথির মতো এসেছি। গ্রাম থেকে লোকাল বাস ধরে রংপুরে এসে পরক্ষণই ঢাকার বাস বা ট্রেনে উঠে পড়েছি। সতীশবাবুর আর খোঁজখবর নেওয়া হয়নি।

রিকশা থামিয়ে রাস্তার ডান পাশে তাকালাম। চোখে পড়ল না সেই টিনের চালাঘরটি। এই একুশ-বাইশ বছরে কতই না পরিবর্তন হয়েছে। আগের সেই টিনের চালাঘরটি থাকার কথাও নয়।

আসলে ঘরটি আর নেই। ওখানে গড়ে উঠেছে তিনতলা ইমারত।

সতীশবাবুকে তাহলে খুঁজে পাব কোথায়? মনে মনে ভাবলাম।

রিকশাওয়ালাকে বললাম আরো একটু এগোতে।

সামনে একটি মসজিদ, তার পেছনের দিকে একটি মুদিদোকান। ওই দোকানের সামনে বসে সতীশবাবু বিড়ি টানতেন। মুদির সঙ্গে তাঁর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। এ-সুবাদে তিনি মুদির কাছ থেকে এক-দেড়শ টাকার বাকি পেতেন। ওখানে গেলে হয়তো সতীশবাবুর সন্ধান পাওয়া যাবে।

হতাশ হলাম, মুদিদোকানের

নাম-নিশানা না পেয়ে। যেখানে মুদিদোকানটি ছিল, সেখানে এখন একটি ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকান।

রিকশা থেকে নেমে দোকানের সামনে গিয়ে বললাম, আবু বকর নামের এক লোক এখানে একটি দোকান চালাতেন, উনি এখন কোথায়?

দোকানি বললেন, জানি না। বিকেলে বাবলু নামে এক ইলেকট্রিক মিস্ত্রি আসবেন। তিনি হয়তো বলতে পারবেন তাঁর কথা। বাবলু এই এলাকার পুরনো লোক।

রিকশায় উঠে চালককে বললাম, ঘোরাও।

রিকশা ঘুরতেই পেছন থেকে কানে ভেসে এলো, মতি, দাঁড়াও।

কে আমায় ডাক নাম ধরে ডাকল! খুব পরিচিত ছাড়া আমার এই ডাকনাম ধরে তো কেউ ডাকে না। চমকে উঠে পেছন ফিরে তাকালাম। যাকে চোখে পড়ল, তাকে চেনা চেনা লাগলেও চিনতে পারছি না।

সে কাছে এসে বললো, তুই বুঝি আমাকে চিনতে পারিসনি মতি। আমি তোকে ঠিকই চিনতে পেরেছি।

তখনো তাকে চিনতে পারছিলাম না। আমি তার মুখের দিকে ভালো করে তাকাচ্ছিলাম। তখন সে বলল, আমি সৈয়দ শহিদুল।

তার কথা শুনে তড়াক করে রিকশা থেকে নামলাম। জড়িয়ে ধরলাম তাকে। বললাম, তোকে চিনব কী করে? তোর যে সেই বেশবাস নেই। অনেক বদলে গেছিস।

শহিদুল বলল, হ্যাঁ, অনেক বদলে গেছি।

– তা বলে দাড়িগুলো …

একথা বলায় শহিদুল মুখ কাচুমাচু করে ফেলল।

বছর কয়েক আগে আরেক সহপাঠী আবিলের কাছ থেকে শুনেছিলাম, শহিদুল একটি কলেজে শিক্ষকতা করে। এই খবরটুকু ছাড়া ওর কোনো খোঁজ রাখিনি। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর শহিদুল দাড়ি রেখে দিলো। এ নিয়ে দু-একজন বলে, ছ্যাঁকা খেয়েছে বুঝি। এজন্য …। ওই বয়সে প্রেমে ব্যর্থতা বা বিরহ প্রকাশের জন্য অনেকের অবলম্বন থাকে মুখভর্তি দাড়ি। ওর বেলায় আসলে কথাটি ঠিক ছিল কি না তা জানা হয়নি।

ওকে বললাম, এই অঘটনটা কবে ঘটালি?

–  বিয়ের আগে আগে।

চাপা হাসি নিয়ে বললাম, দাড়ি নিয়ে পাত্রীর আপত্তি ছিল বুঝি?

শহিদুল আমার কথার জবাব না দিয়ে মুখে চাপা হাসি নিয়ে বলল, রিকশা ছেড়ে দে। চল, আমার বাসায়।

  • এখানে তোর বাসা কোথায়?

বাসাটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিয়ে শহিদুল বলল, ওই তো। গ্রামের কিছু  জমিজমা বিক্রি করে চার শতক জমি কিনে রেখেছিলাম। বছর তিনেক আগে মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু করে ফেলেছি।

– ভালো করেছিস।

শহিদুল যে জায়গাটায় বাড়িটা দেখিয়ে দিলো, ওখানে শহরের

ময়লা-আবর্জনা ফেলা হতো। দুর্গন্ধের চোটে ওই পাশ দিয়ে চলাফেরা করা যেত না। সেখানে গড়ে উঠেছে আবাসিক এলাকা। তার পশ্চিম পাশে হয়েছে নতুন বাসস্ট্যান্ড।

শহিদুল আবার বললো, চল।

– আজ না শহিদুল। অন্যদিন এসে তোর বউকে দেখে যাব।

– এখানে এসেছিলি কেন?

– সতীশবাবুর সন্ধানে।

– কোন সতীশবাবু!

– ওই যে আমার সঙ্গে …

– ওহ্, সেই সতীশ। তোর সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল।

– হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেই সতীশবাবু। উনি কোথায় থাকেন, তা জানিস?

শহিদুল বলল, না। পাঁচ-সাত বছর আগে তাকে শেষ দেখেছিলাম শাপলা সিনেমা হলের সামনে। তখন মনে হয়েছিল তার খুব দুরবস্থা যাচ্ছে। কেমন জানি উসকো-খুসকো দেখাচ্ছিল লোকটিকে। সোনার মতো তার গায়ের রং ছিল। সেই লোকটি কেমন জানি কালচে হয়ে গেছে। পরনের

কাপড়-চোপড় ছিল ছেঁড়া, ধূলিমলিন। তাকে একদিন তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম, ও এখন কোথায়?

শহিদুল আমার কথা তাকে জিজ্ঞেস করার কথা বলাতে বুকটা চিন চিন করে উঠলো। বিমর্ষ গলায় বললাম, সতীশবাবু কি বললেন?

– উনি দু’পাশে ঘনঘন মাথা নেড়ে বললেন, না-না, জানি না।

তার কথায় আমার ভেতর থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল, সেটা চেপে রেখে বললাম, শহিদুল আসি।

চলন্ত রিকশায় ভাবলাম, সতীশবাবু তাহলে কি বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যাননি? এই শহরে আছেন! হ্যাঁ, এই শহরে তাঁর থাকার কথা। আর বাড়িতে ফিরে যেতে চাইলেও তাঁর বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন তাঁকে গ্রহণ করবেন না।

তাঁকে গ্রহণ না করার কারণ তিনি বাড়িতে একটা অঘটন ঘটিয়েছিলেন। বিষয়টা এর মধ্যে সীমিত থাকলে হয়তো জটিল সমস্যা হয়ে দেখা দিত না। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় তিনি আরেকটি বর্বর ঘটনার শিকার হয়েছিলেন। এতে তাঁর বাড়ি যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

তাঁদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। এক জ্যাঠা, দুই কাকা ও তাঁর বাবা এক অন্নে ছিলেন। পুজো-পার্বণে উৎসবের কোনো কমতি ছিল না। নিজেরাই বাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন। কালীপুজো সারতেন কলকাতার দক্ষিণেশ^র থেকে ব্রাহ্মণ এনে।

তাঁদের বড় পরিবার বড় হওয়ায় ছেলেমেয়েও ছিল অনেক। তারা

স্কুল-কলেজে যায়। তাই বাড়িতে দেবী সরস্বতীর বিগ্রহ সযত্নে প্রতিষ্ঠা করা ছিল।

ছেলেমেয়েরা শুভ্রবসনা দেবীর পুজো করত ভক্তি ভরে। প্রতিদিন সকালে তারা দেবীর পাদপীঠে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে মন্ত্র পাঠ করত –

সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে 

কমললোচনে

বিশ^রূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাংদেহী নমস্তুতে। …

সতীশবাবুও এই মন্ত্র পাঠ করতেন, বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে।

দেবীর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ আরো বেড়ে যায় এসএসসি পরীক্ষায় ডাব্বা খাওয়াতে। মন্ত্রে আরো যোগ হয় –

সরস্বতীত্বং ভব মে প্রসন্ন

তৎ পাদপদ্মে নমস্করোমি।

যা কালীদাসে করুণা তবৈব

স্বেয়ং কৃপাতে ময়ী সেবকস্তু

বাড়িতে গীতা পাঠদানের জন্য মাঝে মাঝে আসতেন পণ্ডিত প্রদীপ শংকর। তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসা হতো। তাঁর কাছ থেকে সতীশবাবু শুনেছিলেন মহাকবি কালিদাসের গল্প।

কালীদাস ছিলেন গোমূর্খ। মন্ত্রীর পুত্র চূড়ো রাজকন্যা চাঁপার বিয়ের জন্য এই কালিদাসকে খুঁজে খুঁজে বের করে। চূড়োই ছিল রাজকন্যার পাণিপ্রার্থী। চূড়ো এতে ব্যর্থ হয়। তাই প্রতিশোধ নিতে … হস্তীপৃষ্ঠে কালিদাসকে রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গুরুগম্ভীর দেখা গিয়েছিল। কারো সঙ্গে কথাও বলেনি কালিদাস। চূড়ো তাকে সেই ভাবে শিখিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে চূড়ো রাজা-রানীকে এবং তাঁদের পরিষদদের কালিদাস সম্পর্কে জানিয়ে দেয়, তার জ্ঞান ও বিদ্যাবুদ্ধি এতই গভীর যে, সে সহজে মুখ খোলে না। গম্ভীর থাকতে পছন্দ করে। চূড়োর কথায় সবাই খুশি হয়।

কালিদাসের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হয়ে যায়।

ফুলশয্যার রাতে রাজকন্যা চাঁপা কালিদাসকে নিয়ে যায় চিত্রশালায়। কালিদাস রাজকন্যার সঙ্গে বিভিন্ন চিত্র দেখে। তখনো চূড়োর শেখানো বুলি তার মন থেকে মুছে যায়নি। চিত্রশালায় তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ভাব থাকলেও গাম্ভীর্য অটুট থাকে।

রাজকন্যা আগে আগে যান, তাঁর পেছন পেছন কালিদাস। একসময় দূরত্ব বাড়ে।

যেতে যেতে একটি জায়গায় গিয়ে কালিদাস চোখ স্থির করে ফেলেন। চিত্রে শ্রীকৃষ্ণ গাছতলায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছেন। দূরে মাঠে গরুর পাল ঘাস খাচ্ছে। তা দেখে কালিদাস আবেগ আর থামিয়ে রাখতে পারলেন না। উঁচুস্বরে বলে উঠলেন, ওগো রাজকন্যা, দেখে যাও – দেখে যাও!

রাজকন্যা কাছে এসে নিরস ভঙ্গিতে বলেন, কী?

কালিদাস আঙুল তুলে গাভিদের দেখিয়ে দিয়ে বলেন, রাজকন্যা দেখো, কী তার বাঁট। আ-হা, ইচ্ছে করছে এখুনি চ্যাঁ চুঁই করে গাভি দুয়োই।

রাজকন্যা চোখ ওপরে তুলে বলেন, তুমি বুঝি গাভি দুইতে পারো?

– পারি না মানে! ছোটকাল থেকে অনেক মানুষের বাড়িতে ছিলাম। আর সেখানে চ্যাঁ চুঁই করে কত গাভি দুয়েছি।

রাজকন্যা ভাবলেন, দেখছি, এ এক গোমূর্খ! চূড়োর মুখও ভেসে ওঠে তাঁর চোখের সামনে। রাজকন্যা আর স্থির থাকতে পারলেন না। তাঁর চোখ গেল চিত্রশালার এক কোণে। সেখানে খাপের ভেতর ঝুলিয়ে রাখা একটি তলোয়ার দেখতে পেলেন। লম্বা পায়ে গিয়ে খাপ থেকে তলোয়াটি টেনে বের করলেন।

কালিদাসকে মেরে ফেলতে উদ্যত হলেন রাজকন্যা।

রাজকন্যার তলোয়ারের কোপ থেকে অনেক কষ্টে নিজেকে রক্ষা করলেন কালিদাস। তারপর রাজবাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেলেন।

ছুটতে ছুটতে গিয়ে থামলেন এক বনের মধ্যে। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের ভয়ডর না করে ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর নিয়ে কালিদাস বনের মাঝে শুয়ে পড়লেন। জীবনের প্রতি যেন তাঁর কোনো মায়া নেই।

বনের হিংস্র জন্তু-জানোয়ার কালিদাসকে স্পর্শ করেনি।

কয়েকদিন পর তাঁর সামনে আবির্ভাব ঘটে ধবলবসনা দেবী সরস্বতীর। দেবী তাঁকে বর দিলেন। মূর্খ কালিদাস দেবীর কৃপায় মহাকবি হয়ে গেলেন।

সতীশবাবুর ধারণা, দেবী যদি তাঁকে একটু কৃপা করেন তাহলে তাঁর বিদ্যা তরতর করে এগোবে।

না, তাঁর বিদ্যা এগোলো না। দ্বিতীয়বারও তিনি এসএসসিতে

অকৃতকার্য হলেন।

এখন মানুষের সামনে কী করে মুখ দেখাবেন? জ্যাঠার ছোট ছেলে সোমেন, ছোট কাকার বড় ছেলে বিলটু – ওরা দুজনই সতীশের চেয়ে বয়সে ছোট। ওরা এসএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেছে। ওরা কলেজে ভর্তি হবে। আর সতীশবাবু কৃতকার্য হতে পারলেন না! চারদিক থেকে তাঁকে কটূক্তি ও তিরস্কার শুনতে হয়।

ব্যর্থতা নিয়ে তাঁর নিজের মধ্যেও ধিক্কার জন্মে। সেই ধিক্কার ক্ষোভের সঞ্চার করে। দেবীর পদমূলে এতো পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, তার কাছে এতো কৃপা মাঙ্গা – সবই নিষ্ফল হলো। একসময় ক্ষোভের তোপ গিয়ে পড়ে মণ্ডপে।

এ-ঘটনায় আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বাড়িতে জ্যাঠা, কাকারা প্রচণ্ড ক্ষেপে যান তাঁর ওপর। তাঁরা বলেন, ওই পাতককে বাড়ি থেকে বের করে দাও। এতে বাবা-মা মুখ খুলতে পারেননি। কারণ তাঁদের ছেলে একটি বড় অন্যায় করেছে। তার পক্ষ নিয়ে কথা বলা যায় না। বললে, সেটাও পাপ হবে তাঁদের জন্য।

তাঁকে ধর্মাদ্রোহী আখ্যা দিয়ে, সামাজিকভাবে হইচই ফেলে দেয় কয়েকজন। কেউ কেউ গোটা পরিবারকে একঘরে করারও হুমকি দেয়।

চারদিকে ক্ষোভ আর প্রতিবাদের মুখে সতীশবাবু তিষ্টাতে পারলেন না। এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বের হতে বাধ্য হলেন।

এক-দেড় মাইল হেঁটে আসার পর, পেছন থেকে ছোটভাই অজিতের কণ্ঠ শুনতে পেলেন তিনি – দাদা, দাঁড়াও।

সতীশবাবু মুখ ফিরিয়ে দেখলেন, অজিত ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে আসছে।

অজিত কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, দাদা তোর জন্য মা খুব চিন্তা করছে। এরপর সে লুঙ্গির খুঁট থেকে ভাঁজ করা কয়েকটা একশ টাকার নোট বের করে এদিক-ওদিক তাকাল, যাতে কেউ না দেখে। অজিত বলল, মা দিয়েছে। বোঝা গেল মা শশীবালা টাকাগুলি গোপনে পাঠিয়েছেন।

ফেরার সময় অজিত বলেছে, দাদা তুমি কয়েক দিন পর বাড়িতে চলে এসো। কোনো অসুবিধা হবে না। মা সমীর দাদুর কাছে গোপনে দেখা করতে গিয়েছিল। উনি শাস্ত্র বিষয়ে বেশ জ্ঞান রাখেন। মাকে উনি বলেছেন, তোমাকে প্রায়শ্চিত করতে হবে। মাথা মুণ্ডন ও গোবর-পানি ভক্ষণ করতে হবে। পাঁচজন বেদজ্ঞকে আমন্ত্রণ করিয়ে খাওয়ানো এবং তাঁদের দ্বারা মন্ত্রোচ্চারণ করিয়ে নিতে হবে। এসব করলে সমাজ আর তেমন কোনো আপত্তি করতে পারবে না। দাদা তুমি চলে এসো। তুমি না থাকলে ভালো লাগবে না। মা সবার আড়ালে চোখের জল ফেলছে।

বিষয়টা এ-পর্যন্ত থাকলে হয়তো সতীশবাবুর জন্য বড় সমস্যা হতো না। বাবা-জ্যাঠা-কাকারা বেশিদিন তাঁর ওপর কঠোর অবস্থান নিয়ে থাকতেন না। তাঁরা নমনীয় হতেন। নমনীয় না হলেও তাঁর জন্য তেমন কোনো অসুবিধা হতো না। কারণ, বাবা-মা আত্মজকে বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখতে পারতেন না। তাঁরা কাছে টেনে নিতেন। কিন্তু আরেকটি ঘটনা যোগ হওয়াতে তাঁরা সবাই এককাট্টা হয়ে গেলেন। এতে সতীশবাবু পড়ে গেলেন চরম বিপর্যয়ের মুখে। তাঁর জন্য বাড়ির চৌহদ্দিতে পা ফেলা আর সম্ভব হয়ে উঠল না।

রংপুরে এসে তিনি প্রথম রাতটা কাটালেন রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে। এর আগে তিনি একবারই রংপুরে এসেছিলেন, ছোট কাকা অতীনের সঙ্গে। তখন উনি রংপুর কলেজে পড়তেন। শহরে দু-তিনদিন ছিলেন।

একা একা ঘুরে বেড়ানোর তখন বয়স হয়নি। কাকার সঙ্গে দু-চার জায়গায় গিয়েছিলেন। শহরটি তাঁর কাছে অচেনাই রয়ে গেছে।

অচেনা শহরে তিনি কোথায় থাকবেন – এ নিয়ে চিন্তায় পড়েন। তাঁর সম্বল মায়ের দেওয়া কয়েকশো টাকা। এ দিয়ে কদিন চলবে!

সকালবেলা প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি।

কিছুদূর এগোতেই দেখা হলো পাশের গ্রামের আমির হামজার সঙ্গে। আমির হামজা তাঁর স্কুলের সহপাঠী শামির হামজার বড়ভাই। বিদ্যুৎ বিভাগে চাকরি করেন। তাঁকে দেখে আমির হামজা বলেন, এত সকালে তুমি এখানে! পরক্ষণেই তিনি সুর পাল্টে বলেন, ওহ্ বুঝেছি।

তাঁর ঘটনাটি আশপাশের কয়েকটি গ্রামে চাউর হয়েছে। শর্মাদের বাড়ির সতীশ …। এ ঘটনা আমির হামজার না জানার কথা নয়।

সতীশবাবুকে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে তিনি নাস্তা খাইয়ে দেন। এরপর শহরের মুরগির ফার্ম এলাকার কাছে তাঁর এক পরিচিত মেসে সতীশবাবুর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমির হামজা বলেন, যে কদিন তোমার থাকার দরকার সে-কদিন এখানে থেকো।

চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠাঁই পাওয়াতে তিনি স্বস্তি পেয়েছিলেন। তাঁর কাছে যে-টাকা ছিল তা দিয়ে তাঁর খাবারেরও সমস্যা হচ্ছিল না। ভাবছিলেন, কয়েকদিন পরেই তো বাড়ি ফিরে যাব। মা বলেছে …

তাঁর কোনো কাজ নেই। মেসে কত আর শুয়ে-বসে কাটানো যায়। তাই শহরের বিভিন্ন্ন জায়গায় তিনি ঘুরেফিরে বেড়ান।

একদিন সন্ধ্যার পর তিনি মহাবিপদে পড়ে গেলেন। একটি ফাঁকা জায়গা দেখে প্রস্রাব করতে বসেছিলেন। প্রস্রাবের খুব চাপ পড়ায় তিনি সামনের দিকে তাকানোর সময় পাননি। তাঁর চোখে পড়ল কয়েকটি লম্বা টিনের ঘর। তিনি বুঝতে পারলেন এটি একটি মাদ্রাসা। মাদ্রাসার সঙ্গে ছাত্রদের বোর্ডিং।

প্রস্রাব সেরে উঠতে না উঠতে তিনটি ছেলে তেড়ে এসে তাঁর পাশে দাঁড়াল। তারাও তাঁর মতো বয়সে তরুণ। পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি। তাদের সবার মুখে নতুন গজানো দাড়ি, মাথায় টুপি। তারা সতীশবাবুকে ঘিরে ধরল। সে-মুহূর্তে বোর্ডিংয়ের বারান্দা থেকে এক বয়স্ক লোক কর্কশ স্বরে বললেন, ওটা একটা জালিম, কাফের। মাদ্রাসার দিকে মুখ করে প্রস্রাব করে। ধরে আনো ব্যাটাকে।

লোকটি বোর্ডিংয়ের সুপারিনটেন্ড্যান্ট হবেন। তাঁর হুকুম তামিল করতে ছাত্ররা সতীশবাবুকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেল ভেতরের দিকে।

ভেতরে নিয়ে যাওয়ার পর অনেক ছাত্র এসে জড়ো হলো। তাদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করল, এই তোর নাম কী? তিনি সরল স্বীকারোক্তি করে বললেন, সতীশ শর্মা।

নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোর্ডিংয়ের ছাত্ররা উল্লম্ফন দিয়ে ওঠে। বলে, হিন্দু! এরপর তারা হায়দারি হাঁক ছাড়ে – নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর –

সতীশবাবুর অনুনয়-বিনয় বর্বর, অসুরে শক্তির কাছে কোনো মায়া জন্মাল না। বরং তাঁর আর্তচিৎকার হাসির খোরাক জোগাল তাদের কাছে।

ওই রাতে মাদ্রাসার বোর্ডিংয়ের ছাত্ররা সতীশবাবুর মুসলমানি করে দেয়।

এ ঘটনাটি চাপা রাখা যায়নি। দু-তিনদিনের মধ্যে বাড়িতে চলে যায়। ঘটনাটির আরো গাছপালা ছড়ায়।

খৎনা হয় মুসলমানের মধ্যে। তাহলে কি সতীশ ধর্মান্তরিত হয়েছে? এরকম ধারণা বাবা-জ্যাঠা-কাকাদের মনে জন্মে। আবার আর একটি ঘটনা! তাঁরা সতীশবাবুকে ত্যাজ্য করলেন। বাড়ি যাওয়ার পথ তাঁর বন্ধ হয়ে গেল।

সতীশবাবুর নিরীহ, শান্ত-সুবোধ রূপটি আমাকে আকর্ষণ করেছিল। এছাড়া তাঁর প্রতি আমার সহমর্মিতা জন্মানোর কারণ ছিল। আমি কৈশোরে পিতৃমাতৃহীন, স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আর তাঁর আপনজন থাকার পরও তিনি স্নেহ-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এবং তাঁদের কাছে তিনি ধিকৃত।

তাঁর সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় মুলাটোলে। আমার ক্লাসমেট আখতারের বাসায়। তার ভাইয়ের ছ-বছরের এক বাচ্চাকে সতীশবাবু পড়াতেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়। ধীরেসুস্থে এবং গুছিয়ে কথা বলেন তিনি। তাঁকে আমার খুব ভালো লেগে যায়।

তিনি বিকেল চারটা থেকে রাত নটা পর্যন্ত তিন জায়গায় পড়াতেন। সকালে পড়াতেন আরো দু-জায়গায়।

ওয়ান-টু’র ছাত্রছাত্রীদের। যে-মানুষ এসএসসিতে দু-দুবার ফেল করেন তাঁর পক্ষে ওপরের ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো সম্ভব নয়। তাই  টাকাও পেতেন খুব কম। এক জায়গায় পড়ানোর বিনিময়ে রাতের খাবার পেতেন।

সতীশবাবু আমার চেয়ে বয়সে দু-তিন বছরের বড় হলেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এর মূলে আরো একটি কারণ ছিল। আমি যে-কবিতা লিখতাম, সে-কবিতার প্রথম পাঠক ছিলেন সতীশবাবু। সহপাঠীদের সামনে কবিতা পড়তাম না, তাচ্ছিল্যের ভয়ে। তাদের সামনে কবিতা পড়লে দু-একজন বেফাঁস কথা বলতো – কে শোনে তোর এতো প্যাচাল!

আর সতীশবাবুর সামনে কবিতা পড়লে প্রশংসাই পেতাম। কবিতা শুনে তিনি বলতেন, বেশ-বেশ, খুব ভালো হয়েছে। আপনি একদিন এদেশের বড় কবি হবেন। এতো বড় সার্টিফিকেট যিনি দিচ্ছেন, তাঁর প্রতি তো আকর্ষণ দেখা দেবেই।

আমার এখনো মনে আছে, একদিন বৃষ্টিঝরা দুপুরে আধভেজা হয়ে নতুন কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছিলাম সতীশবাবুর ছাপড়াঘরে। তখন তিনি একটি আধা-ছেঁড়া গামছা এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ভালো করে মাথাটা মুছে নিন। ভেজা জামাটাও খুলে ফেলুন। না হলে সর্দি-জ্বর হবে।

সতীশবাবু তখন দুপুরের রান্নার আয়োজন করছিলেন। চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি রান্না করবেন স্টোভে। আমি যাওয়াতে তিনি বললেন, আপনি দুপুরে আমার এখানে খেয়ে যাবেন।

ছোট্ট ঘর। বৃষ্টির ছাঁট আসছে। সামনে খাল। খালের পানি উপচে ঘরের সামনে পর্যন্ত এসেছে। ছোট্ট মেঝেতে স্টোভে রান্না করা সম্ভব হচ্ছিল না। শেষে বিছানার রংচটা ময়লা চাদর সরিয়ে দিয়ে চটের ওপর স্টোভটি তোলা হয়েছিল। বিছানায় তোশক হিসেবে তিনি চট ব্যবহার করেছিলেন।

সতীশবাবুর কাছ থেকে বড় কবির সার্টিফিকেট পাওয়ার পরও কবিতা নিয়ে বেশি মাতামাতি করিনি। রংপুর শহর থেকে চলে যাওয়ার পর কাব্যলক্ষ্মীকে বিদায় দিয়েছি। তরুণ বয়সে অনেকে কবিতাকে ধ্যান-জ্ঞান মনে করেন। কিন্তু জীবনের নানান ফেরে পড়ে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয় না। আমারও সে অবস্থা হয়েছে।

সতীশবাবু রংপুর শহরে থাকলেও তিনি কলেজ রোড এবং স্টেশন রোডের দিকে পা মাড়াতেন না। বাড়ির কারো সঙ্গে অথবা পাড়া-প্রতিবেশী কারো সঙ্গে দেখা হোক, তিনি তা চাননি। এর কারণও অবশ্য ছিল।

ইতোমধ্যে তাঁর ছোটভাই অজিত ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে কারমাইকেল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অনার্সে পড়ছে। তার ছোট কাকার ছেলে পুলকরঞ্জন এসএসসি পাশ করে রংপুর সরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছে। অজিতের সঙ্গে একদিন করনজাই রোডে তাঁর দেখা হয়েছিল। অজিত কথা বলেনি। তাঁকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আপন বড়ভাইকে সে যেন চেনে না। বাড়ি থেকে আসার সময় দৌড়ে এসে তাঁর হাতে টাকা দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছিল, দাদা, তুমি কয়েকদিন পর চলে এসো।

পুলকের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল জাহাজ কোম্পানির মোড়ে। তখন পুলকের কাঁধে একটি ব্যাগ ঝোলানো ছিল। মনে হয়েছিল পুলক বাড়ি থেকে আসছে।

সে-মুহূর্তে সতীশবাবু ভুলে গিয়েছিলেন তিনি পারিবারিকভাবে পরিত্যাজ্য এবং ধিকৃত। কেউই তাঁর মুখ দেখতে চায় না। কিন্তু আবেগের কাছে পরাভব মেনে তিনি গলা ছেড়ে বলে উঠেছিলেন – এ পুলক, পুলক। পুলক পেছন ফিরে একবার তাঁর দিকে তাকায়। তাঁকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এরপর হনহন করে চলে যায়।

সতীশবাবু অবাক! তাঁর হাত-পায়ে যেন অসাড়তা নেমে আসে। অস্ফুট স্বরে বলে ওঠেন, ও এভাবে চলে গেল!

নিজের এবং জ্যাঠাত, কাকাত ভাইদের মধ্যে পুলককে তিনি বেশি ভালোবাসতেন। পুলকও তাঁর অনুরক্ত ছিল। তাঁকে ছাড়া ও কিছু বুঝত না। রাতের বেলা পুলক তাঁর গলা জড়িয়ে ঘুমাত। বাড়ির সামনে তাদের একটি বড় দিঘিতে স্নানের সময় কতবার যে বায়না ধরেছে – দাদা, তুমি আমাকে সাঁতরিয়ে ওপারে নিয়ে যাও না।

ছোট পুলকের বায়না তিনি পূরণ করেছিলেন। পুলককে তাঁর পিঠে চড়িয়ে, হাত-পা দাপিয়ে দাপিয়ে চলে গিয়েছিলেন দিঘির অপর পাড়ে। এতে পুলক খুব খুশি হয়েছিল। পরে তিনিই পুলককে সাঁতার শিখিয়ে দেন।

বিকেলে রিকশা থেকে নেমে ইলেকট্রিক সামগ্রীর দোকানের সামনে গেলাম। দেখলাম, দোকানির সামনে একজন প্যান্ট-শার্ট পরা বয়স্ক লোক বসে আছেন। দোকানিকে লক্ষ্য করে বললাম, বাবলু মিয়া কি এসেছেন?

– হ্যাঁ, এসেছেন। এরপর দোকানি তাঁর পাশে বসে থাকা লোকটিকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ইনি –

বাবলু মিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি আমাকে চাচ্ছেন?

– জি।

– বলুন।

– আমি জানতে চাচ্ছি, এখানে আবু বকর নামে এক লোক দোকান করতেন। ওনাকে কোথায় পাওয়া যাবে?

বাবলু মিয়া বললেন, শহরে আর উনি থাকেন না। গ্রামের বাড়ি শ্যামপুরে চলে গেছেন। গ্রামে গিয়ে উনি ভালো অবস্থা করেছেন। তাঁর এক ছেলে থাকে সৌদি আরবে। আরেক ছেলে শ্যামপুর সুগার মিলে চাকরি করছে। আবু বকর ভাইকে বুঝি আপনার খুব দরকার?

– হ্যাঁ, দরকার। আমি এসেছি সতীশবাবুর খোঁজে। ওনার সঙ্গে সতীশবাবুর খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। উনি হয়তো সতীশবাবুর খোঁজ দিতে পারতেন।

– ওহ, সেই সতীশ! আমি বুঝতে পেরেছি। সে বকর ভাইয়ের কাছে খুব আসত।

– হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আপনি কি বলতে পারেন সতীশবাবু এখন

কোথায়?

– সতীশ তো আর বেঁচে নেই।

বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো – সতীশবাবু বেঁচে নেই!

– হ্যাঁ, বছর চারেক আগে মারা গেছে। মারা যাওয়ার আগে লোকটা পাগল হয়ে গিয়েছিল। চুল-দাড়ি বড় বড় হয়েছিল। রাতে শুয়ে থাকত শাপলার মোড়ে। একদিন সকালে গিয়ে দেখি সতীশ পড়ে আছে খালি গায়ে। পৌষের তীব্র শীতে কাঁপছে। একটা দোকান থেকে কয়েক হাত চট এনে ওর গা ঢেকে দিই। না খেয়ে খেয়ে ওর শরীরটা কংকাল হয়ে গিয়েছিল। মনে হয় মরে গিয়ে ভালো হয়েছে। অত কষ্ট –

শুষ্ক গলায় বললাম, শাপলার মোড়েই কি সতীশবাবু মারা গেছেন? 

– না-না। মানুষের মুখে শুনেছি, তাঁতিপাড়ার কাছে শ্যামাসুন্দরী খালের পাড়ে তার লাশ পড়ে ছিল। এ-খবর শুনে অনেকে অবাক হয়েছিলেন। যে সতীশ ঠিকমতো দাঁড়াতে পারত না, সে কীভাবে ওখানে গেল! কিন্তু কেউ তার লাশ ধরেনি।

– কেন কেন?

– আগে থেকে নানান জনে নানান কথা বলত তাকে নিয়ে। কেউ বলতো সতীশ হিন্দু, আবার কেউ কেউ বলত মুসলমান। এজন্য তার লাশ কেউই ধরেনি। পরে কী হয়েছে তা আর শুনিনি।

আমার মনে পড়ে গেল, সর্বধর্মবেত্তা কবীরের কথা। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর মরদেহের দুপাশে দু-দল লোক জড়ো হয়েছিল। এক দল যারা হিন্দু, তারা বলেছিল, কবীর হিন্দু। তাঁর লাশ নিয়ে গিয়ে শশ্মানে পোড়ানো হবে। অন্য দল মুসলমান, তাদের দাবি ছিল কবীর মুসলমান। তাঁর লাশ নিয়ে গিয়ে তারা কবর দেবে। লাশ নিয়ে দুপক্ষের

তর্ক-বিতর্ক চলতে থাকে।

তর্ক-বিতর্ক উত্তপ্ত হতে থাকে। কেউই লাশ ছাড়তে রাজি নয়। একসময় দু-দলের মধ্যে মারমুখী অবস্থার সৃষ্টি হয়। সেই মুহূর্তে কবীরের লাশ আর দেখা গেল না।

কোথায় যে মিলিয়ে গেল কেউ বলতে পারে না।

সমবেত দুপক্ষে উত্তপ্ত, মারমুখী জনতা তখন একই সুরে বলে ওঠে, কবীর স্বর্গে চলে গেছেন।

সতীশবাবু কোনো ধর্মগুরু বা ধর্মবেত্তা ছিলেন না। তাই তাঁর লাশ নিতে হিন্দুরা বা মুসলমানেরা কেউই যায়নি। খালের পাড়ে পড়ে থাকা তাঁর লাশ নিশ্চয় কুকুর-শিয়াল-শকুনে টানাটানি করে খেয়ে নিয়েছে।

বাবলু মিয়া বললেন, সতীশ বোধহয় আপনার কেউ হন?

তার কথার জবাবে আমার বুকের ভেতর থেকে শুধু একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।