স্বপ্ন ও সত্যি

ছেলেবেলায় আমি প্রায় প্রতি রাতে স্বপ্ন দেখতাম। কোনোটা মধুর। কোনোটা ভীতিকর। আর ভীতিকর হলে ঘুম ভেঙে যেত। মধুর স্বপ্ন না ভাবাই ভালো। আমাদের মানস-প্রক্রিয়ার বিচিত্র জালে মানুষ জড়িত। একে জানার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মনোবিদগণ। আজকে মনোবিদ্যা একটি পৃথক জ্ঞান-ভাণ্ডার হিসেবে বিবেচিত এবং বিশ^বিদ্যালয় স্তরে পঠন দেওয়া হয়। বিশেষ করে জোর দেওয়া হয় মনোবিকলনের ওপর। আজকের বিংশ-একবিংশ শতকের মানুষ শারীরিক ব্যাধির চেয়ে মনোরোগে ভোগে বেশি। কারণ পূর্বের সামন্ততান্ত্রিক জীবনধারার পরিবর্তন।

শিল্প-বিপ্লবের পর থেকে মানুষের হাজার চাহিদা। তা মেটাতে গিয়ে মানুষ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ফলে মানসিক চাপ বৃদ্ধির ফলে নানারকম স্নায়বিক চাপ। এই উত্তেজনা থেকে চিন্তার জটাজাল, সবকিছু মেলাতে না পারার ব্যর্থতা। মানুষের মনে জন্ম নেয় হতাশা। আর সৃষ্টি হয় নানা ধারার উত্তেজনা বা টেনশন। এর প্রভাব শরীরের স্বাভাবিক কর্মকে ব্যাহত করা। ক্ষুধামান্দ্য-নিদ্রাহীনতা এর প্রাথমিক প্রকাশ। পরবর্তী সময়ে সারা শারীরিক পদ্ধতিকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাওয়া। তখন শরীর ও মনের ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় কী। এটা আধুনিক যুগের উন্নত দেশের দৈনন্দিন জীবনধারা। বয়স যত বাড়ে, বাড়ে এর পরিধি। আসে নানা রকম মনোবিকলন। ভুলে যাওয়া, অল্পে উত্তেজিত হওয়া … নেতিবাচক উচ্চারণের বাহুল্য জীবনকে পীড়িত করে তোলে। উন্নত দেশে ছাত্রবয়সে আত্মহত্যার মতো কঠিন কাজের উদাহরণও প্রচুর। ছবির মতো দেশ জাপান – সেখানেও এই অসুস্থতা সমাজকে চিন্তায় ফেলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাচ্চাদের বন্দুক নিয়ে শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ, শিক্ষক ও সহপাঠীদের হত্যা একটা নিয়মিত ব্যাপার। আমাদের দেশে চিত্রটা এর উল্টো। চাষি উৎপাদিত দ্রব্যের দাম না পেয়ে করে আত্মহত্যা। এই ব্যাপারে ভারতের মহারাষ্ট্র সবচেয়ে অগ্রগামী রাজ্য। বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও পারিবারিক অশান্তির জন্যে রেলগাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়া মা ও সন্তানদের মারা যাওয়া অহরহ ঘটে। দু-জায়গায় চিত্রটি দুরকম।  এক জায়গায় অতিসম্পদ। আর এক জায়গায় সম্পদহীনতা। পৃথিবীর মানবসমাজ এর গড় ফল তৈরি করতে না পারলে এই ঘটনা শেষ হওয়ার নয়, আর তা মুখের কথায় হবে না। নিষ্পত্তির একটাই পথ – সমাজবিপ্লব। আপসে হলে তা সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল। বাংলাদেশে ঝিনাইদহের শৈলকূপা আত্মহত্যার সর্বোচ্চ শিখরে। ধান ভানতে শিবের গীত এসে গেল। এদেশে সবার ওপরে অনার্য দেবতা শিব ঠাকুর। তাঁর পুত্র প্রথম পূজ্য গণেশ।

তো স্বপ্নের কথা। আমার স্বপ্ন। বাল্যকালের। পরবর্তী জীবনের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের পালার বয়ান আগামীতে। যদি এ-দেহ থাকে সচল। মস্তিষ্ক থাকে নিরোগ। যদি বলার ক্ষমতা থাকে : জয় বাংলা। কারণ বাংলায় জন্মেছি। আর তা অবিভক্ত বাংলায় ও ভারতে। সুতরাং জন্মগতভাবে আমি বাঙালি ও ভারতীয়। পরবর্তী সময়ে দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গীয় বা পূর্ব পাকিস্তানি। পাকিস্তান ফাঁকিস্থানে পরিবর্তিত হওয়ার পর বাংলাদেশি। বাঙালিত্ব, ভারতীয়ত্ব, পাকিস্তানিত্ব সব কাটা গেল, রইল বাকি এক : বাংলাদেশি। এটা আবার ক’দিন টেকে ঈশ্বর বা আল্লাহই জানেন। যদি বেঁচে থাকি তাহলে আবার লাভ করব ভিন্ন পরিচিতি। না হয় বাংলাদেশি। বিশ্বজুড়ে করোনা, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ, সমগ্র বিশ^জুড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের শুভবোধকে পীড়িত করে চলেছে। অতি-উন্নয়নের ঠেলায় মানুষ প্রকৃতিকে করে চলেছে অবিন্যস্ত। লোভ ছাড়া, লাভ ছাড়া এখন কোনো অগ্রগতি বন্ধ। মানুষ পশ্চাৎগতি ধরলে পৃথিবীকে আরো কিছুদিন বসবাসযোগ্য করে রাখতে পারে। না হয় মঙ্গলগ্রহের মতো লালগ্রহ হিসেবে দু-নম্বরে গিয়ে দাঁড়াবে। মানুষ প্রাণীটি যে একটা ভাইরাসের চেয়ে দুর্বল এ-ধারণা আজো মানুষ অনুভব করেনি। সুতরাং তার উন্নয়ন অর্থাৎ বৈশি^ক উন্নয়ন হাইপারবোল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উইপোকা যদি পেটে কিছু না দেয় তার পেটে উপস্থিত জীবাণু তাকে খেয়ে ফেলবে। তাই উইপোকা নিরন্তর কুট কুট করে যা পায় কেটে চলে। আমাদের উন্নয়নও দাঁড়িয়েছে সেই দরজায়। ধনীদের বাসনা পূর্ণ না করতে পারলেই তারা রাজনীতি বদলে দেবে। ফলে শেষ পর্যন্ত সবটাই নির্ভর করছে সমাজবিপ্লবের ওপর। যখন উন্নয়ন সর্বলোকের এবং সর্বাঙ্গীণ অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রের উন্নয়ন। বর্তমানে এই উপমহাদেশে বাহ্যিক উন্নয়নের চমক দেখানোর প্রতিযোগিতা চলছে। শিক্ষাগতি সবচেয়ে অবহেলিত। শিক্ষা মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। তাই উচ্চশ্রেণি চায় অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত-কেনা উচ্চশিক্ষিত শ্রেণি। যারা কোনো প্রশ্ন করবে না। শাসক শ্রেণি প্রশ্ন সহ্য করে না। পুলিশ-সেনা-পার্টি ক্যাডার, বিচার বিভাগ, ধর্মব্যবস্থা সব তারা দখল করে রেখেছে। সাধারণ মানুষ তাই বিপন্ন এবং ঈশ^রাশ্রয়ী বা আল্লাহনির্ভর। এককথায় ভাগ্যবাদী। স্পার্টাকাসের মতো বিপ্লবী কোথায় পাওয়া যাবে? চারু মজুমদার এককভাবে শ্রেণিশত্রু ধ্বংসের চেষ্টা চালিয়ে বিফলে গেলেন। গণজাগরণ, সেটা ফরাসি বিপ্লবের ধাঁচে হলেও এতদঞ্চলে অনেক মূল্যবান হবে। সমাজে পরিবর্তন আসতে বাধ্য। আজকে উন্নত দেশগুলো শ্রেণি-সংগ্রামের অভিঘাতেই গরিবদের রাষ্ট্রীয় দান-ধ্যানের ব্যবস্থা রাখতে বাধ্য হয়েছে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এইখানে সফল। আজ উন্নত দেশ হওয়া মানে সবাইকে বণ্টন নীতির মধ্যে আনা এবং সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারের স্বীকৃতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সংঘটিত হতে হবে। বয়স্ক ও দুস্থ-ভাতা প্রচলন। এ-সবই শ্রেণি-সংগ্রাম করে আদায় করা হয়েছে। শিকাগোর ১৮৮৬-এর ১লা মে সেই

শ্রেণি-সংগ্রামেরই একটি রূপ। বলশেভিক বিপ্লব বা রুশ-বিপ্লব তারই ধারাবাহিকতায় আসে। আসে চীনা বিপ্লব। কিউবা ও উত্তর কোরিয়ার বিপ্লব। এসবই মনীষীদের স্বপ্নের ফল।

আমার স্বপ্ন তেমন নয়। আর দশটা বালকের মতো। পরাধীন ভারতবর্ষে জন্ম। দশ বছর পেরোতে না পেরোতে দেশবিভাগ ১৯৪৭ সালে। সুতরাং স্বপ্ন দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল। তার রেশ আজো আমাকে তাড়া করে ফিরছে। এখনো ভাবতে পারি না, আমি কোন দেশের বাসিন্দা। আমার মন শতধাবিভক্ত। তাই আমি বিশ্বের জনগণের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ভাবি। দেশের বেড়া আমাকে বিরক্ত করে। অন্তত পুরো ভারতে থাকলে খানিক হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারতাম। আমি এখন ডানাকাটা পাখি। দেশের এক অংশ থেকে আরেক অংশে যেতে পায়ে হাঁটতে হয়। বর্তমানে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ জায়গাটিও দূষিত হয়ে গেছে। ভিনদেশের নাগরিকদের বিতাড়িত হয়ে এখানে আশ্রয় নেওয়ার কারণে। ছোট একটা হাঁড়িতে আঠারো কোটি লোকের রান্না কী করে সম্ভব? তাই বাংলাদেশিরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে যাচ্ছে মাইগ্রেশনে। কিন্তু তাদের মনটা বাংলার মাটিতে পড়ে থাকে। সুতরাং বাংলাদেশিদের জীবন থেকে সুখ নামক পাখিটা উড়ে গেছে। যে দেশে আছে তার এবং যে বিদেশে গেছে তারও। বিদেশের ভালো গল্প শুনলে বাকিরাও স্বপ্ন দেখে সেই দেশে যাওয়ার। পথে অনেক বাধা। দালাল এক নম্বরে।  তার আছে বিরাট সিন্ডিকেট। বিশ^বিদ্যালয়ের মতো। তারপর নৌকো করে টেকনাফ থেকে মালয়েশিয়া যাত্রা। এদিকে স্থলপথে মিশর হয়ে লিবিয়া। ওখান থেকে ছোট ট্রলারে ভূমধ্যসাগর পাড়ি। পথে দুর্ঘটনার শেষ নেই। আমরা প্রায়ই এসব ঘটনার তথ্য ও চিত্র দেখি। কতজনের স্বপ্নভঙ্গ হয়। বাড়িতে পড়ে কান্নার রোল। আগে লোকে গান বাঁধতো : ইংরেজি শিখাইলাম তোরে ক্যান … এখন গান বাঁধে : ও সখিনা গ্যাছস কিনা ভুইলা আমারে। আমি এখন রিকশা চালাই ঢাহা শহরে…

রূপকথার সেই স্বপ্নের শহরে যাওয়ার জন্যে প্রতিদিন কতো জওয়ান, পুরুষ ও নারী প্রাণ হারাচ্ছে। যে দেশে হিরের ফুল, মতির মালা গাছে গাছে থরে থরে সাজান। গেলেই পাওয়া যাবে।

রূপকথা কী? একটা স্বপ্নের দেশে বিচরণ করার বাসনা। সে-দেশে কিন্তু সহজে যাওয়া যায় না। অনেক বাধা ও কষ্ট সহ্য করে তবে যেতে হয়। সেই রূপকথার গল্প আজ নতুন করে দুনিয়ায় ফিরে এসেছে। সভ্য দেশগুলো সাজানো-গোছানো। আর আমরা সামগ্রিকভাবে দারিদ্র্যপীড়িত। জীবনের কোথাও শ্রী নেই। আছে বিষণ্নতা। আছে দীর্ঘশ^াস। আছে হাহাকার। তারই পাশে ধনীদের ওয়েসিস বা মরু-উদ্যান।

মামাবাড়ি ঝামটিয়া হলো আমার স্বপ্নের প্রধান কেন্দ্র। বাবাবাড়ি সবলসিংহপুর সবল হলে কী হবে তা বাঁশঝাড়ে ও খানাখন্দে ভরা। তাই ওখানে ভূতের আবাস। ভূত স্বপ্নে আসার কথা, কিন্তু কেন  জানি আমাকে ভয় দেখাতে তেমন করে আসত না। আমার বাবাও ভূতকে ডোন্ট কেয়ার করতেন – তাই বংশগতিধারা ধরে ভূতের ভয়টা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল না। ভয় পেতাম না তা নয় – তবে ভূতের ভয় নয়। ছিলাম কিছুটা ভীতুপ্রকৃতির। তবে অকারণ ভয়, ভূত-প্রেতে ভয় নয়। বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে সন্ধ্যার পর একা একা যেতে অকারণেই ভয় লাগত। আর যদি কোনো গুইসাপ শুকনো বাঁশপাতা মাড়িয়ে যেত তাহলে ভয়টা বৃদ্ধি পেত। গা ছমছম মনে হয় সবারই করে। জোর করে বললে তো হবে না যে, আমি কোনো কিছুতে ভয় পাই না। ভয় মানুষের চিরন্তন প্রবণতা। তবে তার মাত্রার হেরফের আছে। নেপোলিয়ন একরকম। আমরা সাধারণ মানুষ তাঁরই মতো এক পাল্লায় পড়বো না। শোনা যায় যুদ্ধক্ষেত্রে নেপোলিয়ন ঘোড়ার পিঠে বসে ঘুমিয়ে নিতেন। সেই ওয়াটার লু-র  যুদ্ধে। যে-যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে তাঁর আর বিশ^নায়ক হওয়া হলো না। তাঁকে ইউরোপের অন্যান্য দেশের জোট সেন্ট হেলেনা নামক দ্বীপে বন্দি করে রাখে।

তিনতলা মামাবাড়ির পশ্চিমদিকে আমরা থাকি। পুবদিকে নানার বড়ভাইয়ের আবাস। এই নানা নানার বাবার পালকপুত্র। কিন্তু নানা তাঁকে বড়ভাই হিসেবে নিজের ভাইয়ের মতোই শ্রদ্ধা করতেন। পুবদিকে ছ-টা কামরা, পশ্চিমে সাতটা। এদিকের দোতলার পশ্চিমের কামরাটা বেশ লম্বাটে এবং অন্য কামরার তুলনায় বড়। উত্তর দিকে একটা জানালা। আর এর অদূরে একটা পুরোনো বাবলা গাছ। জানালা বরাবর। উত্তরমুখী হয়ে শয়ন করলে চোখ খুললেই বাবলাগাছটা চোখে পড়ে। ঝিরিঝিরি পাতা। হলুদ ফুল। আবার আট-ন’ইঞ্চি লম্বা ফল – ওষুধের গায়ে যেরকম কাটা কাটা দাগ সাঁটা হয় এক দাগ করে ওষুধ খাবার জন্য, তেমন খাঁজকাটা। বাবলাসুঁটি গরু-ছাগলের প্রিয় খাদ্য। কাঁচা-শুকনো সম্পূরক হিসেবে বাবলা ফল জমিয়ে রাখার চল আছে। আর আমার প্রিয় ছিল বাবলা আঠা লজেন্সের মতো চুষে খাওয়া। পরে জানি যে, ওই আঠা খুবই দামি আঠা – গাম অ্যারাবিক নামে পরিচিত। এটা গুলিয়ে তৈরি হতো তরল আঠা, যাকে আমরা বলতাম লেই। বাবলা আঠা কাগজ সাঁটার ব্যাপারে সবার ওপরে।

একদিন ভোররাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আর দেখি বাবলাগাছটা  জানালার পাশে উঠে এসেছে। ভয় লেগে গেল। আমি চিৎকার করে উঠি।

মা জেগে ওঠেন।

: কী হলো?

: মা, বাবলাগাছটা!

: কী হয়েছে বাবলাগাছের?

: ওটা ওটা …

: কী ওটা ওটা করছ …

: জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল।

: বুঝেছি। নাও, ঘুমোও। বাবলাগাছ সরে গেছে।

আমার আর ঘুম আসে না। বারবার দেখি … ঠিকই তো বাবলাগাছ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে। তবে সরে এলো কী করে? অনেক ভেবেও উত্তর পাই না। পরবর্তী জীবনে শেক্সপিয়রের হ্যামলেট পড়ে একটা উক্তি পাই : দেয়ার আর মোর থিংস ইন হ্যাভেন অ্যান্ড আর্থ দ্যান ইন ইউর ফিলোসফি হোরাসিও … তাই নিজের পক্ষে যুক্তি পেলেও সন্তুষ্ট হতে পারি না।

বাবলাগাছটি দশ বছর আমার বাল্যের সঙ্গী ছিল। মানসপটে দেখতে পাচ্ছি স্বাস্থ্যবতী গাছটি ফুলে-ফলে ভরে উত্তরের আকাশজুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

বাবলাগাছ ঝামটিয়ার একটা অন্যতম সৌন্দর্য। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের লোগো হিসেবেও বাবলাগাছ দাবিদার হতে পারে।

এর পরের স্বপ্নটি বেশ অন্যরকম।

ঝামটিয়া হাজা অঞ্চল। বর্ষায় দু থেকে তিনবার – কোনো কোনো বছর চারবারও বান আসে। বানের জলে নানা রকম জিনিস ভেসে বেড়ায়। বিশেষ করে ভাদ্রমাসে তাল তাল ঠুকে দুলতে দুলতে চলতে থাকে। অনেকে ডোঙা নিয়ে গিয়ে তাল ধরতে হয় ব্যস্ত। আমাদের বাড়িতে জওয়ান মানুষ নেই। আমিই নিধিরাম সর্দার। অভিযানে যাওয়ার মতো বয়স হয়নি।

বান এলে আমার কাজ ছিল পশ্চিমদিকের নেমে যাওয়া সিঁড়িতে কদ্দূর বান উঠল তা মাপা। সিঁড়ি ডুবে যাওয়া মানে জল বাড়ছে। সাধারণ বানগুলো খুব ধীরগতিতে বাড়ত। অনেক সময় শ্মশানে পোড়া কাঠ সিঁড়ির গায়ে লেগে থাকে। আমি পা দিয়ে সরিয়ে দিই। আঞ্চলিক কথায় একে বলে মড়াকাঠ। আমি পা দিয়ে ঠেলে মনে মনে বলি : বাবা মড়াকাঠ তুমি এখান থেকে যাও। অর্থাৎ ভেসে চলো। বসে থাকলে চলবে না। তাছাড়া এটা একটা অলক্ষুণে বস্তু। নানির চোখে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সাবধানবাণী : মড়াকাঠে পা লাগিয়ো না … ওই মড়াকাঠে আত্মা থাকে … ক্ষতি করে দেবে … আমি পা সরিয়ে নিতাম। আত্মা কী! এই কাঠ কি ক্ষতি করতে পারে! কিছুই ধারণা করতে পারতাম না। তবে অশুভ মনে করে নানির সামনে আর পা লাগাতাম না। একটা কাঠি জোগাড় করে ডাঙা থেকে দূরে ঠেলে দিতাম। তবে নানি না থাকলে পা লাগানো অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

একবার বানের দিনে এরকম একটা ঘটনা ঘটে। আমি যথারীতি পা দিয়ে মড়াকাঠ ঠেলছি, আর নানির চোখে পড়ে গেল। তিনি আবার সচেতন করলেন। অর্থাৎ পা লাগাতে বারণ করলেন।

এটা বিকেলের ঘটনা।

ভাদ্র মাস। দিন অনেক বড়। দুপুরে মায়ের চোখ এড়িয়ে ছোটবাগানে সময় কাটিয়েছি। বিশেষ করে বিলেতি-বাবলা নামে একটা নবীন গাছ ছিল। এটা ক্যাসিয়া জাতীয় গাছ। বাবলা পরিবারের। এর ফলটা কিন্তু হতো প্যাঁচানো। আর পাকলে গোলাপি থেকে লাল হয়ে উঠত। আর মিষ্টি বলে আমরা লগি দিয়ে পেড়ে খেতাম। আমার সঙ্গে থাকত আমার বাহিনী।

মেজ-সেজ আর তখন ছোট – পরে ন’সেজ এরা সবাই। বেশ একটা কোলাহল বা কিচিরমিচির করে সময় কাটাতাম। লগি দিয়ে পাড়ার কাজটা আমার। আর কুড়িয়ে আনার কাজ অন্যদের। সবাই একসঙ্গে দৌড় লাগাত।

এই ক্যাসিয়া গাছকে মামাবাড়িতে বলত বুচগাছ। এই বুচ কোথা থেকে এলো এ নিয়ে কখনো গবেষণা করা হয়নি। একে অনেকে বিলেতি বাবলাও বলে। গাছের পাতা কতবেল পাতার মতো। গাছ সোজা উঠে গিয়ে ডাল ছড়ায়। তখন সন্ধ্যা আর সন্ধ্যারাত কাটানোর কোনো কিছু ছিল না। একটা হারিকেন জ¦ালিয়ে তার চারপাশে বসে গল্প করা। তখন না ছিল রেডিও-ট্রানজিস্টার, টিভি, ক্যাসেট, টেপ-রেকর্ডার, মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার … সে-যুগ হারিকেনের যুগ। সৌখিন মানুষ আবার দেয়ালসির বাতি জ্বালাতেন। তা হলো ল্যাম্পটার ওপর গোল কাচের গ্লাস দিয়ে ঘেরা। দেয়ালে টানিয়ে রাখার ব্যবস্থা ছিল। বেশ ভালো লাগত। হারিকেনের কেরোসিনের গন্ধটা নাকে লাগত না। বেশ একটা সৌখিনতার ছোঁয়া। মামা বা বাবা বাড়িতে এলে অনেক সময় এই দেয়ালসিরটার ব্যবস্থা হতো। আজকে হাতে হারিকেন মানে নিঃসঙ্গতার প্রতীক। তখন হারিকেন না থাকলে লম্প বা কুপি ছিল আলোর উৎস। পশ্চিমবঙ্গে লম্প আর পূর্ববঙ্গে কুপি বা আরো কিছু আঞ্চলিক শব্দ থাকতে পারে, আমার জানা নেই। কেরোসিন তেলনির্ভর বাতি। মানুষের তেল খরচের সামর্থ্য কম থাকায় সন্ধ্যারাতেই সবাই শুয়ে পড়ত। পূর্ণিমার রাত গ্রামে ছোট-বড় সবার থাকত দোল উৎসবের মতো। লোকজন ভিটে ছেড়ে গ্রামের ফাঁকা জায়গায় ঘুরতে বেরোত। তখন এমন ছিঁচকে চোরের উপদ্রব ছিল না। ডাকাতি সে তো আরো দূরের ব্যাপার। প্রচুর ধনী যাঁরা তাঁদের বাড়িতে ডাকাতরা চিঠি দিয়ে আসত। আমরা অমুক দিন আসব। সব রেডি রেখো। না হয় … অনেকে ডাকাতদলের সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্যে বন্দুক নিয়ে তৈরি থাকত। বন্দুককে ডাকাতরা ভয় পেত। ঝামটিয়ায় দক্ষিণপাড়ায় প্রত্যেক বাড়িতে বন্দুক ছিল এবং মেয়েরা বন্দুক চালাতে পারত। এই শিক্ষা তাদের আত্মরক্ষার জন্য। পুরো সপ্তাহ পাড়া পুরুষশূন্য। তাই মেয়েরা খুব সাহসী। একরকম ডাকাবুকো বলা যায়।

পাড়ায় সাহসী মহিলা হিসেবে আমার নানি গোলাপজানের খুব সুনাম ছিল।

স্বপ্ন ছেড়ে বাস্তবে এসে গেছি। আবার স্বপ্নে ফেরা যাক। স্বপ্ন আর বাস্তব খুব যে পৃথক, তা মনে হয় না। চোখে চেয়েও স্বপ্ন দেখা যায়। দিবাস্বপ্ন। সুতরাং স্বপ্ন আর বাস্তব বড় বেশি অঙ্গাঙ্গি। ছেলেবেলায় দেখেছি আমার সত্যি কথাও মানুষ বিশ^াস করতে চায় না, এটা বড় কষ্টের। তাছাড়া প্রশ্ন হলো, যা দেখি তা কি সবটা দেখা যায়? সর্প ভেবে কি রজ্জু দেখি না? তাই এ-জগৎ মায়া বলে ভ্রম হয়, আবার হয় না। শঙ্করাচার্য হোক বা প্রভু ফ্রয়েড হোক কেউ কি পুরো ব্যাখ্যা দিতে পারবেন? মায়াবি চক্রধারী বিষ্ণু কি করছেন তার জবাব কে দেবে? লালনকে অপার হয়ে হয়ে বসে থাকতে হয় পারে যাওয়ার জন্য। এখন  মাঝি না এলে বেচারা পার হবে কী করে পুলসিরাত। এই চুলের  সাঁকো পার হওয়া বড় কঠিন। এই চুল আগুনে পোড়ে না। জগতে দরবেশ নাম ধরে মানুষের রক্ত শোষণ করে চুলের সাঁকো পার হওয়া যাবে না। এটা মহাজনরা মনে রাখে না। আহা যদি গুরু নানক হতে পারতাম! সিদ্ধার্থ হওয়া বড় কঠিন। রাজার ছেলে হলো ভিখিরি। কঙ্কালসার ভাস্কর্যগুলো এখনো সাক্ষী। কালের সাক্ষী। আম্রপালির কথা মনে পড়ে। রাজনর্তকী। মনের ভেতর সাক্যসিংহের বাস। সিদ্ধার্থ বা বুদ্ধ মায়ের কথা ভোলেনি, যিনি বুকের দুধ পান করিয়ে বড় করেছিলেন – সেই মা গৌতমী সন্তানের সঙ্গে চিরজীবী হয়ে গেলেন। গৌতম বুদ্ধ। সিদ্ধার্থ কোথায় গেল! স্বপ্ন না বাস্তব। তাই বলি স্বপ্ন আর বাস্তব ধরা-বোঝা অত সহজ কার্য নয়।

এবার আসি স্বপ্নের রাজ্যে। একদিন স্বপ্নের জগতে বিরাজ করছি। অকুস্থল পশ্চিমের সিঁড়ি। আবার এর ওপর সুপার ইম্পোজড হয়ে এসে পড়ছে মেজ খালুদের বাগানের বাবলাগাছ ভরা কোনাটা। সিঁড়িতে বানভাসি। বাগান শুকনো। সিঁড়ির শেষ প্রান্তে একটি মড়াকাঠ সেঁটে আছে। আমি ওকে মুক্তি দেওয়ার জন্যে ডান-পাটা লাগিয়েছি আর চকিতে এক ঘটনা ঘটল। পুরো মড়াকাঠ একটি জ¦লন্ত মানুষের বিমূর্ত রূপ গ্রহণ করে চোখ রাঙিয়ে বলে উঠে; হুঁ ক্ কা, রা কে রা … এ কেমন ভাষা। মৃতদের ভাষা অবশ্য নানারূপ নিতে পারে। কিন্তু এটা হিব্রু না কোরিয়ান ভাষা কিছু বুঝতে পারি না। ভয় পাইনি, কিন্তু চমকে উঠি মড়াকাঠের এই ধারা আচরণ দেখে।

: হুঁ ক্ কা, রা কে রা … হতে পারে ইশারা – আমাকে পা দিয়ে ঠেলার তুই কে রে?

সেই মড়াকাঠের সারা অবয়ব বিদ্যুৎপ্রবাহের মতো জ¦লছে।

আমার হকচকিয়ে যাওয়ার অবস্থাটা কাটিয়ে স্থিতি লাভ করার মধ্যে আবার হুঙ্কার : হুঁ ক্ কা, রা কে রা … আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আবার পা দিয়ে ঠেলব সে অ্যাকশনে যেতে পারছি না। মনে হলো, চলচ্চিত্রের পরিচালক অ্যাকশন বলতে ভুলে গেছে। আমি চিৎকার করে জেগে উঠি। মা-ও জেগে উঠলেন।

: কী হলো?

: হুঁ ক্ কা, রা কে রা …

: হুঁ ক্ কা, রা কে রা, আবার কী?

: মড়াকাঠ। আমাকে ভয় দেখাল।

মা ছেলের ধাত জানতেন। স্মিত হেসে বললেন, ভয় পেলে কেন? তুমি তো মড়াকাঠকে ভয় পাও না।

: কিন্তু রেগে উঠল যে!

: রাগবেই তো। তোমাকে তোমার নানি বারবার বলেছেন না, মড়াকাঠে পা লাগাবে না। ছড়ি দিয়ে ঠেলে দেবে। গায়ে পা লাগলে রাগ তো করবেই। যাক এখান ঘুমোও। কাল সকালে সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখো। ঘুমিয়ে পড়ি।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দে দৌড়। দেখি চারদিকে বানের জল থইথই করছে। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দেখি জল একই জায়গায় স্থির। তবে ধীর একটা স্রোতের টান বোঝা যাচ্ছে। সিঁড়ির পাশে কেন, এদিক-ওদিক চেয়ে কোনো মড়াকাঠ দেখতে পেলাম না।

কিন্তু কানে বাজছে : হুঁ ক্ কা, রা কে রা … ধ্বনি। জীবনভর। পিছু ছাড়েনি। মড়াকাঠে আর পা ছোঁয়াব! এতো বড় সাহস।

দেশভাগের পর সেই মড়াকাঠ কেথায় ভেসে গেল জানি না। আমরাও মড়াকাঠের মতো ভেসে গেলাম। সেই ঝামটিয়া …। সেই বর্ষার বান … সেই মড়াকাঠ … আজো পিছু ডাকে।