আগুনটা আজো সমাজ-আশ্রয়ী

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

‘নন্দন কানন’ থেকে মানুষটা হেঁটে চলেছেন। মাথার ওপর অমলিন নীল আকাশ। পায়ের নিচে লাল মাটির বুকে জুতোর মশমশ। চাদর জড়ানো বুকের নিচে কত যে আঘাত – ক্রুশের চিহ্ন! দৃঢ়মনস্ক ঈশ্বর পথাশ্রয়ী। দূরে দাঁড়িয়ে দেহাতি মানুষগুলোর ডাক্তার দেবতা। বারে বারে আঘাতও তাঁর পরোপকারে বাধা হয়নি।

    পায়ে বিঁধেছে কাঁটা

        ক্ষতবক্ষে পড়েছে রক্তধারা

         নির্মম কঠোরতা মেরেছে ঢেউ

                     আমার নৌকোর ডাইনে বাঁয়ে

          জীবনের পণ্য চেয়েছে ডুবিয়ে দিতে

                       নিন্দার তলায়, পঙ্কের মধ্যে

তবুও সর্বংসহা এক সমুদ্র প্রাণে হৃদয় ভরা। মনে মনে আউরে চলেন : ‘They alone live who live for others. The rest are more dead or alive.’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – এক আগুনগোলা। উনবিংশ শতকের শিক্ষাবিদ, গদ্যকার, আধুনিক বাংলা ভাষার জনক, সমাজ সংস্কারক, নারীশিক্ষার সোচ্চার দূত … সামগ্রিকে তিনি। জন্ম ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভগবতী দেবীর স্বপ্ন লালনে। গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ করে আরো পড়াশোনার জন্য বীরসিংহ গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় কর্মরত বাবার কাছে যাওয়া। বাহান্ন কিলোমিটার পথ কিছুটা ভৃত্যের কাঁধে করে হলেও বেশির ভাগ পথই পায়ে হেঁটে পাড়ি জয়ের ছন্দে। আট বছরের শিশুর দৃপ্ত পদসঞ্চারে সেদিন ধরিত্রী বুঝেছিল : এসেছে, সে এসেছে! ম্লানিমায় সবুজ চাঁদনী আনতে। কুসংস্কারের নাগপাশে থাকা স্থবির সমাজকে মুক্তির দিশা দিতে। কালজয়ী যুগপুরুষের আবির্ভাবের তেজময়তার সেদিন থেকেই শুরু দিন গোনা।

কলকাতায় সরস্বতীর আরাধনায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বরে কলকাতার একটি পাঠশালায় তাঁর পড়াশোনা শুরু হয়। ১৮২৯ সালে জুন মাসে তিনি সংস্কৃত শিক্ষার জন্য সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। ১৮৩৯ সালের মধ্যেই মেধার স্ফূরণ তাঁর অনন্য কৃতিত্বের পরিচায়ক হয়ে ওঠে। ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি তাঁর মুকুটে নতুন পালক যোগ করে। শিক্ষার অদম্য আগ্রহে আরো দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলংকার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন, ইংরেজি প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশোনা করেন নিজেকে তৈরি করার জন্য। এটা যেন ছিল তাঁর আগামীর বিনিয়োগ। তিনি জানতেন, পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার জন্য জ্ঞানের পরিধি বাড়ানো একান্তই প্রয়োজনীয়। ফলস্বরূপ নানা পুরস্কারে সম্মানিত হন পরবর্তীকালে। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বরে সংস্কৃত কলেজ ছাড়ার কিছুদিন পরই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা ভাষার হেড পণ্ডিত পদে নিয়োগপ্রাপ্তি। ১৮৪৬ সালের এপ্রিল মাসে আবার সংস্কৃত কলেজে যোগদান সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে। কিন্তু উদারমনস্ক ও দৃঢ়চেতা বিদ্যাসাগরের সঙ্গে শিক্ষকদের মানসিক দূরত্ব বৃদ্ধির কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে কাজে ইস্তফা দেন। ১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ হন। আবার ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেন সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে এবং পরে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। অধ্যক্ষ হিসেবে তাঁর সংস্কারমূলক কাজ শুরু হয় এরপরেই। ওই কলেজে শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাত্ররা পড়ার সুযোগ পেত। তিনি নিয়ম ভেঙে সকলের জন্য অবারিত দ্বার করেন। তাঁর মতে, শিক্ষার সুযোগে সকলের সমানাধিকার থাকা প্রয়োজন। না হলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। কলেজের বেতন নামমাত্র করেন যাতে অর্থ যেন শিক্ষার সুযোগের প্রতিবন্ধক না হয়। রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি চালু করেন, যা আগে শুধু প্রতিপদ ও অষ্টমীতে মিলত। কলেজের ডিগ্রির গুরুত্ব বাড়াতে তিনি সচেষ্ট হন। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় তাঁর দাবি ছিল, ওই কলেজের ডিগ্রি নিয়ে ছাত্ররা যেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে বসতে পারে। তাঁর অনমনীয় মনোভাব ও অকাট্য যুক্তির কাছে সরকার বাহাদুর নত হতে বাধ্য হন। কলেজের পাঠ্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন। পূর্বের নিয়ম বদলে ব্যাকরণ বাংলায় এবং গণিত ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানো চালু করেন। ইংরেজি ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন এবং সেজন্য ইংরেজি বিভাগকে ঢেলে সাজান মানোন্নয়নের জন্য। সঙ্গে বাংলা শিক্ষার ওপরও জোর দেন। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন দর্শন পাঠ্যক্রমে। সাংখ্য ও বেদান্ত দর্শন তাঁর ভ্রান্ত ও প্রাচীনপন্থী বলে মনে হতো। তাই আধুনিক দর্শনে জোর দিতে বার্কলের দর্শনের পরিবর্তে বেকনের দর্শন ও জন স্টুয়ার্ট মিলের তর্কশাস্ত্র পাঠে অধিকতর গুরুত্বারোপ করেন। সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও তিনি পিছপা হননি। পরবর্তীকালে শিক্ষা পরিষদ তাঁর সংস্কারের ভূয়সী প্রশংসা করে এবং ফলস্বরূপ ১৮৫৪ সালে তাঁর বেতন বৃদ্ধির পুরস্কার পান।

 ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে কলেজের অধ্যক্ষ পদের সঙ্গে সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয় ১৮৫৪ সালে গৃহীত চার্লস উডের শিক্ষা সনদ অনুযায়ী গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য। এই দায়িত্ব তাঁর কাছে যেন আশীর্বাদস্বরূপ হলো। জাগ্রত উদ্যমে তিনি নদীয়া, বর্ধমান, হুগলি, মেদিনীপুর জেলায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় দু-বছরের মধ্যে কুডড়টা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। নিজ গ্রাম বীরসিংহে নিজের মায়ের নামেও একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

শিক্ষার প্রসারে পাগলপ্রাণ এই মানুষটির মুকুটে তাই উজ্জ্বল পালকের সম্ভার। এশিয়াটিক সোসাইটি, বেথুন সোসাইটিসহ অনেক সংগঠনের সম্মানিত সদস্য ছিলেন তিনি। ১৮৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ফেলো, ১৮৭৭ সালে ইম্পেরিয়াল অ্যাসেম্ব্লিজে সম্মাননা সনদ, ১৮৮০ সালে সিআইই সম্মানপ্রাপ্তির সঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন অর্জন করেন।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষায় গদ্যকে রসসমৃদ্ধ সহজগতি করেন। আগে প্রচলিত গদ্যধারা বড় বেশি নীরস, সুমধুরতাবর্জিত, কষ্টবোধক ছিল, যা পাণ্ডিত্যের দ্যোতনাই প্রকাশ করত। পাঠককুলের মহাকাশে সরস আবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হতো। বিদ্যাসাগরই প্রথম সাধু গদ্যের সরস উপস্থাপন শুরু করেন। ছন্দোময় পেলব কোমল ভাষা যা হৃদয়ে দোলা দেয়, পড়তে পড়তে বড় বেশি আপন বোধ হয় যেন। বৃষ্টির টুপটাপ বা পিয়ানোর টুংটাং যেন গদ্যে তখন। এক আপন বেগে চলা স্রোতস্বিনীর পাঠক মনে ছলাৎছল যেন!

উদাহরণ ১৮৫৪ সালে শকুন্তলা ও ১৮৬০ সালে সীতার বনবাস গ্রন্থ। শব্দরা আপন খেয়ালে মায়াময় পরিবেশ তৈরি করে সহজ কাব্যময়তায়। পাঠক তখন ভালোলাগার আপন বলয়ে।

শকুন্তলার অধরে নবপেল্লবশোভার

 সম্পূর্ণ আবির্ভাব; বাহুযুগল কোমল

  বিটপের বিচিত্র শোভায় বিভূষিত;

   আর, নব যৌবন, বিকশিত

    কুসুমরাশির ন্যায়, সর্বাঙ্গ ব্যাপীয়া

     রহিয়াছে।

(শকুন্তলা, প্রথম পরিচ্ছেদ)

কলম যেন ছবি এঁকে চলেছে আপন মাধুরী মিলায়ে। এক বিবশ করা ভালো লাগা প্রতি ছত্রে। শব্দদের শিশুর মতো সরল পদচারণ অনাবিল হাসিমুখে। আলংকারিক গদ্যভাষার পাশাপাশি লৌকিক ভাষাও সমান সহজগামী। শ্লেষাত্মক গদ্যরচনাতেও তিনি সমান সাবলীল ও সহজ গতি। ‘ব্রজ বিলাস’ উদাহরণ হতে পারে –

এই কয় প্রশ্নের উত্তর পাইলেই,

বিদ্যারত্ন ও কপিরত্ন, উভয় খুড়

মহাশয়ের সঙ্গে, নানা রঙ্গে, হুড়হুড়ি ও

গুঁতোগুঁতি আরম্ভ করিব। প্রশ্নের উত্তর,

                        পাইলে, হাঙ্গাম ও পেসার

উপস্থিত করিবেক, এমন স্থলে উত্তর

না দেওয়াই ভাল, এই ভাবিয়া,

       চালাকি করিয়া, লেজ গুটাইয়া,

 বসিয়া থাকিলে আমি ছাড়িব না ।

(‘ব্রজ বিলাস’)

এক অদ্ভুত মজা যেন আপন হাসিতে পাঠককে বিভোর করে রাখে। পাঠক ক্লান্ত  হয় না। মন বরং আরো পেতে আগ্রহী। বাংলা গদ্যে সাবলীলতা রক্ষার দিকে তাঁর সবিশেষ নজর ছিল। ইংরেজি সাহিত্যের মতো যতিচিহ্নের ব্যবহার তাঁর এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টা। এতে গদ্যের উৎকৃষ্টতা বাংলা ভাষাকে আদরণীয় ও গ্রহণীয় করেছে। কখনো অনুকরণবিলাসী তিনি হননি। কারণ তিনি জানতেন অন্য ভাষায় নাগকেশরের উগ্রতা থাকলেও বাংলা ভাষায় আছে রজনীগন্ধার স্নিগ্ধ সৌরভ। তাঁর মনে থাকত কথাটা ‘অনুকরণ দ্বারা পরের ভাব আপনার হয় না। অর্জন না করলে কোন বস্তুই নিজের হয় না। সিংহ চর্মে আচ্ছাদিত হইলেই কি গর্দভ সিংহ হয়?’ বাংলা গদ্যভাষার এই উত্থান বিদ্যাসাগরেরই জয়তিলক।

তাঁর প্রথম সাহিত্যগ্রন্থ বেতালপঞ্চবিংশতির ক্ষেত্রেও তিনি অনন্য। অনুকরণ না করে নিজস্ব ঢংয়ে গল্পের জাদুকরী প্রয়াস। কিছু ক্ষেত্রে মূল গল্পের সঙ্গে নিজ সংস্কার রুচিবোধ জুড়ে দিয়েছেন, যা গল্পটাকে এক অন্য মাত্রা দান করেছে। শেক্সপিয়রের কমেডি অফ্ এররসের বাংলা অনুবাদ ভ্রান্তিবিলাস হাস্যরসের কারণে পাঠকসমাজে খুবই জনপ্রিয়। এভাবে তাঁর সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজি থেকে সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞান সংক্রান্ত অনেক অনুবাদ বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। দেশের আপামর মানুষের সহজ শিক্ষার জন্য মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেন এবং শিশুদের আনন্দময় পাঠদানের জন্য সহজ-সরল প্রাথমিক পাঠক্রম চালু করেন। শিশুদের অক্ষরযাত্রার পথ মসৃণ করতে বর্ণ পরিচয়, বোধোদয়, কথামালা বই লেখেন। শব্দরাও যেন শিশুকণ্ঠে আনন্দে সাবলীল। জীবনচরিত, সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা, ব্যাকরণ কৌমুদী রচনা তাঁর অনন্য কলমশৈলীর নিদর্শন। নিরস গদ্যভাষাকে প্রাঞ্জল ও মনোগ্রাহী করার জন্যও তিনি সচেষ্ট। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসা সেই জন্যই – ‘গদ্যকে দখল করে তাকে যথার্থ সৌন্দর্য দিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরের মধ্যে দেখতে পেয়েছিলেন প্রাচীন ঋষির প্রজ্ঞা। পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে তাঁর স্মৃতি রক্ষায় স্থাপিত হয়েছে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়। কলকাতা তাঁকে স্মরণ করে তাঁর নামে তৈরি বিদ্যাসাগর সেতুতেও।

মানুষের পূর্ণতার বিকাশ সাধনই ছিল তাঁর শিক্ষার মূর্ত দ্যোতনা। মানুষের কষ্ট তাঁকে উতলা করে তুলত। বিশেষত নারীদের। অসহায় নিত্য যন্ত্রণাসঙ্গী মায়ের মুখটা তাঁর মনে পড়ত অহর্নিশ। নারী যে অর্ধেক আকাশ। নারী শুধু সন্তান প্রসবের যন্ত্র নয়। নারীশিক্ষা, নারীমুক্তিই হতে পারে আগামীর বিনিয়োগ। হাসিমুখ সকাল তখনই দেবে সমাজ উন্নয়নের স্থায়ী ঠিকানা। তাঁর মনে তাই স্থির বিশ্বাস ‘If you educate a man, you educate a man.If you educate a woman, you educate a generation.’ নরম কাদার তালের মতো অবোধ শিশুর মুখের প্রথম শব্দ-আশ্রয়ই যে ‘মা’। তাই নারীকে পিছনে ফেললে সমাজের চিরকালীন নিশ্চিত ঠিকানা নিকষ কালো অন্ধকারবাস। পশ্চাতে রাখিবে যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিবে নিশিদিন সুখহীন।

অতঃপর শুরু নারীশিক্ষার জয়ধ্বজা ওড়ানো। একের পর এক স্কুল স্থাপন নারীশিক্ষার জন্য। নারীর পড়াশোনা তখন প্রতি ঘরে উজ্জ্বল বর্তমান। তাঁর ও ড্রিংক ওয়াটার বিটনের উদ্যোগে ভারতের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’কলকাতায় স্থাপিত হয়, যা বর্তমানে বেথুন স্কুল। উদারমনা স্থানীয় মানুষের সাহায্যে বর্ধমানে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ৩৫টির বেশি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। নারীশিক্ষা স্রোতস্বিনীর রূপ নিতে শুরু করে আপন তেজে।

 অথর্ব বেদ বলেছেন : ‘তস্মাদ বৈ বিদ্বান পুরুষ মিদং ব্রম্ভেতি মন্যতে।’ যিনি বিদ্বান তিনি মানুষকে তার প্রত্যক্ষের অতীত বৃহৎ বলেই জানেন। মাতৃসম নারীকে মায়ের বিদ্বান সন্তান তাই এক প্রত্যক্ষ পূর্ণতার উড়ান দিতে চেয়েছিলেন। সমাজের লোলুপ লোভ নারীশরীরকে যখন অল্প বয়সেই বিধবা বানায়, তারপর ভালোবাসার স্পর্শহীন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই জীবন কাটাতে বাধ্য করে বিধিনিষেধের ঘেরাটোপে – তখনো তিনি গর্জনবিলাসী। মানতে পারেননি এ-কালা নিয়ম। নারীকে আপন ভাগ্য গড়িবার, কেন নাহি দিবে অধিকার! প্রতিবাদমুখরতা তাঁকে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্দীপিত করে। চালু করেন ‘বিধবাবিবাহ’। ‘চপল চঞ্চল চন্দন চর্চিত’ শোভা বৃদ্ধি এখানেই, ঠিক এখানেই। জীবন মন্থনে উত্থিত নীলকণ্ঠ নয়, প্রেমসুধার বর্ষণ থাক অভাগা অবলা বঞ্চিত শোষিত হৃদয়গুলোয়। বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ দূরীকরণেও তাঁর স্মরণীয় প্রয়াস ছিল।

বিধবাবিবাহ দিয়েছেন নিজের ছেলে নারায়ণ চন্দ্রের সঙ্গে পাত্রী ভবসুন্দরী দেবীর। পুত্র গর্বে গর্বিত পিতার উজ্জ্বল মুখ বারে বারে জানিয়েছে সে-কথা। ‘বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব (জানুয়ারি ১৮৫৫) তৎকালীন রক্ষণশীল বাঙালি সমাজে তীব্র নিন্দার ঝড় তুলল। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের আক্রমণ তো শালীনতার মাত্রা ছাড়াল। স্থির অচঞ্চল তিনি। রাতের নিকষ কালো আকাশে তারারাও তো আলোর মালা গাঁথে আনন্দ উদ্দীপনায়। কবি-পাঁচালিকার দাশরথি রায় এবং শান্তিপুরের তাঁতিরা সযত্নে শাড়ির পাড়ে রাখলেন বিদ্যাসাগর বন্দনা : ‘সুখে থাক বিদ্যাসাগর চিরজীবী হয়ে।’ কীটদুষ্ট হিংসাভরা অপসারী প্রয়াস এলো তাৎক্ষণিক : ‘শুয়ে থাক বিদ্যাসাগর চিররোগী হয়ে।’

বাংলার নবজাগরণের পুরোধা রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র রমাপ্রসাদ রায় বিধবাবিবাহে সম্মতি দান করেও অনুপস্থিত থাকলেন বিবাহে। বিদ্যাসাগর বুঝলেন, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়। এমনকি বঙ্কিমচন্দ্রের কলমেও চলল বিধবাবিবাহ নিয়ে লাগামছাড়া সমালোচনা। মনের উদারতা সব শিক্ষার দ্যোতনা হয় না, বুঝলেন বিদ্যাসাগর। আরো চোয়াল চাপা লড়াইয়ের রসদ পেলেন। মুখ তুলে সূর্যের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, সেও তো একা আলো দিয়ে যাচ্ছে। পরম সুহৃদ দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখলেন : ‘আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।’

জনহিতে তিনি বন্দিত দয়ার সাগর। প্রয়োজন ফুরালেই তিনি তখন আবার অসম্মানীয়। স্বার্থপর এই দুনিয়া তাঁকে নিয়ে খেলেছে এভাবেই প্রতি পলে, প্রতি পদে। কিন্ত আসলে সেটা তো তাঁর পরাজয় নয়। ‘প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত।’ প্রতিটা আঘাত তাঁকে করেছে আরো মহিমান্বিত। তবুও তো রক্তক্ষরণ চলে যখন প্রিয়জন তাঁকে শুধু প্রয়োজনে পরিণত করে চলে অবিরত।

‘সংস্কৃত প্রেস ও ডিপজিটারী’র মালিকানার অধিকার নিয়ে ভাই দীনবন্ধুর সঙ্গে অগ্রজের লড়াই আদালত পর্যন্ত যেতে বসেছে। অবশেষে সালিশির মাধ্যমে মীমাংসায় অন্যায্য দাবি ত্যাগ করতে বাধ্য হয় অনুজ। দয়ার সাগর অনুজের মাসোহারার টাকা পাঠালে সেখানেও অগ্রজকে অপমানের অপরিসীম ঔদ্ধত্য। প্রত্যাখ্যান করেন মাসোহারা। ভ্রাতৃবধূর কাছে টাকা পাঠালেও একই প্রতিক্রিয়া। বোঝেন তিনি সব। পরে অবশ্য টাকা নিতে সম্মত হন দীনবন্ধু।

আর এক ভাই শম্ভুচন্দ্রের সঙ্গেও মনোমালিন্য শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়। ১৮৬৯ সালে চকপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক পণ্ডিত মুচিরাম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কালীগঞ্জের মনোমোহিনী দেবীর বিধবাবিবাহে উপস্থিত থাকার অনুরোধ সত্ত্বেও বিদ্যাসাগরের অনুপস্থিতি বিরোধের মাত্রা তুঙ্গে তোলে। শম্ভুচন্দ্র এই ঘটনাকে বিদ্যাসাগরের ‘পশ্চাৎপদতা’ ও ‘কাপুরুষতার পরিচয়’ বলে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেন। আহত বিদ্যাসাগর রক্তাক্ত হতে থাকেন ভেতরে ভেতরে।

পুত্রের সঙ্গেও বিরোধ চরমে পৌঁছায় একসময়। মধুসূদন ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তির স্ত্রী বিন্ধ্যবাসিনী দেবীকে তাঁর স্বামীর সম্পত্তির উপস্বত্বভোগ থেকে বঞ্চিত করায় ক্ষিপ্ত বিদ্যাসাগর নিজের উইল বা ইচ্ছাপত্রে (১৮৭৫, ৩১শে মে) পুত্রকে সমস্ত সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। ভাগ্যের এ কি নিষ্ঠুর পরিহাস! দণ্ডিতের সঙ্গে দয়ার সাগর দণ্ডদাতাও যে সমানে কেঁদেছেন, একথা নিশ্চিত।

পুত্রের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই পত্নীবিচ্ছেদ হয় মানুষটির। স্ত্রীর মৃত্যুশয্যায় (১৮৮৮-র ১৩ই আগস্ট) ঈশ্বর স্ত্রীর মনের অভিযোগ নিরসনে তাঁকে শান্তি দিতে বলে ওঠেন : ‘বুঝেছি, তাই হবে; তার জন্য আর ভাবতে হবে না।’

আর এক ধাক্কা খান জামাই সূর্যকুমারের কাছ থেকে। বিদ্যাসাগরের স্বপ্ন প্রকল্প মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনের অধ্যক্ষ পদে বসা সূর্যকুমারের আর্থিক অনিয়মের খবর তাঁকে ব্যথিত করে। ভিন্ন বক্তব্য থাকলেও সতত সত্যাশ্রয়ী বিদ্যাসাগর তাঁকে কর্মচ্যুত করেন নির্দ্বিধায় বিবেকের বিচারে।

অন্তরের গহিন গভীরে যে দগদগে ঘা তা শুধু পুত্র-পরিবারের দেওয়াই নয়। শিক্ষিত সমাজ, বন্ধুবর সকলের কাছ থেকেই ঘনিষ্ঠতার ছদ্মবেশে এসেছে হৃদভেদী আঘাত। আর এক যিশু হয়ে নীরবে দেখেছেন আপন রক্তপাত।

১৮৪৭ সালে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ থেকে ইস্তফা দেন সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মতানৈক্যের কারণে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সংস্কৃত মুদ্রণ যন্ত্র’ নামে একটি প্রেস ও বুক ডিপোজিটরি। কিছুদিনেই ছন্দপতন! বন্ধুর সঙ্গে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা নিয়ে হয় মতবিরোধ ঋজু শিরদাঁড়ায় বাঁচা বিদ্যাসাগরের।

একবার সম্বাদ ভাস্করে প্রকাশিত এক অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন। অভিযোগ, ইংরেজদের কাছে তিনি ছাড়া অন্য কোনো বাঙালির গ্রহণযোগ্যতা চাইতেন না বিদ্যাসাগর। হাস্যকর অভিযোগ! অভিযোগের সমর্থন মেলে পরে তাঁরই বিশেষ স্নেহধন্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যেরও। মিথ্যাকে সত্যের রঙিন মোড়কে গ্রহণযোগ্য করার কি নিরর্থক প্রয়াস!

এইভাবে অসম্মান, অপমানের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত তাঁর চিরতরে গ্রাম ছেড়ে অভিমানী স্বেচ্ছানির্বাসন ঘটে বিহারের কর্মাটাঁড়ে (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড)। বিরক্ত ধ্বস্ত বিদ্যাসাগর ভুলেও বলে ওঠেননি : ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো/ সন্তানের মুখ ধরে শেষ চুমু খাবো ।’ দুঃখের করুণ আস্যা তার জীবন। মন তাঁর বারে বারে যেন বলেছে – ‘মুকদ্দরমে মেরে আগে দর্দহি লিখা হ্যায়, মনজুর হ্যায় মুঝে/ ইলতেজা ইয়ে হ্যায়, সহেনে কে লিয়ে সঙ্গ-এ জিগরভী মিলনা চাহিয়ে।’ ভাগ্যে দুঃখ লেখা থাকলে সম্মতি দিলাম। শুধু সহ্য করার মতো পাষাণ হৃদয় দাও।

অধমের আক্রমণেও তিনি অবিচল উত্তম সর্বদা। জন্মভূমির উন্নয়নে উইল করে দিয়ে যান বহু অর্থ। মনের কোণে কোথাও কী লালিত ইচ্ছা ছিল, একটিবার আর একটিবার জন্মভূমির মাটির ধুলোর শেষ চুমু খাবো!

এভাবে ভালোবাসাসর্বস্ব পরহিতময়তায় ঋদ্ধ তিনি চলে গেলেন পরিচিত আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব থেকে অনেক দূরে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে : ‘দি মোর লাইফ বিকামস্ এম্পটি/ দি হেভিয়ার ইট বিকামস্ টু ক্যারি।’

শূন্যজীবন বয়ে বেড়ানো যে বড় কষ্টের! সেটা ঈশ্বরই জানেন। তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলা। একাকিত্বের ঘুণপোকা কুরে কুরে খায় হৃদয়। তবে সবই কি পণ্ডশ্রম? কিছুই কি ঠিক করা হলো না এ-জীবনে? তাহলে এভাবেই চলে যাওয়া ‘unwept, unhonoured and unsung’। রক্তঝরা সন্ধ্যা বেদনালীন। ঈশ্বর কাঁদছেন। চোখের কোণে মুক্তোর মতো জলবিন্দু তখনো মানুষেরই সবুজ হিত চাইছে যেন!

সব সান্ত্বনার শেষে সব পথ একেবারে

মিলেছে শূন্যের অন্ধকারে

          ফিরিছ বিশ্রামহারা ঘুরে ঘুরে

খুঁজি কাদের বিশ্ব মুহূর্তে যা চলে গেল দূরে

খুঁজিছ বুকের ধন সে আর তো নেই

বুকের পাথর হল মুহূর্তেই।

নবজাগরণের পুরোধা বিরাটহৃদয় সাগর মানুষ ১৮৯১ সালের ২৯শে জুলাই রাত্রি দুটো আঠারো মিনিটে কলকাতার বাদুড়বাগানের বাসভবনে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা করেন। মাও সে তুং খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন : ‘কারো কারো মৃত্যু পালকের মতো হালকা। কারো কারো মৃত্যু পাথরের মতো ভারী।’ বিদ্যাসাগরের মৃত্যু তাই মলিন সমাজের বুকে আজ বড় ভারী বলে মনে হয়!

তথ্যসূত্র :

১. অমরেন্দ্র কুমার ঘোষ, যুগপুরুষ বিদ্যাসাগর, তুলিকলম, কলকাতা, ১৯৭৩।

২. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগর, মন্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৯৭০।

৩. ইন্দ্র মিত্র, করুণা সাগর বিদ্যাসাগর, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৬৬।

৪. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর বাঙালি সমাজ, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ।

৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর চরিত, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ, কলকাতা।

৬. ‘ব্যক্তি বিদ্যাসাগরের কিছু অজানা পরিচয়’, রাধারমন মিত্র, কোরক, শারদ সংখ্যা, ১৪১৬।

৭. ‘বিদ্যাসাগরের অভিমান’, সমকাল, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, ঢাকা, ২০১৭। ৮. বিদ্যাসাগর, মনি বাগচী, প্রেসিডেন্সি পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৯৫৭।