শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্থপতি কে? পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান স্থপতি মাজহারুল ইসলামের বন্ধু সন্তোষ ঘোষের কথায় :
‘অনেকের মনেই এই প্রশ্নটি এসেছে। প্রথমজন ছিলেন বাঙালি স্থপতি বিদ্যাধর ভট্টাচার্য, যিনি ১৭২৭ সালে রাজস্থানের জয়পুর শহরের পরিকল্পনা এবং বেশ কয়েকটি বাড়ির নকশা করেছিলেন। এখনো পর্যটকরা এই স্থানটি পরিদর্শন করে থাকেন। ১৯৭৭ সালে জয়পুরের আড়াইশোতম বার্ষিকী উদযাপিত হয় এবং আমি ভাগ্যবান যে সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। বিদ্যাধরকে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছিল নৃত্য পরিবেশনের মধ্য দিয়ে। রাজস্থান সরকার একটি শহরতলির নামকরণ করেছে বিদ্যাধরনগর এবং একটি পার্কের নামও তাঁর নামানুসারে রাখা হয়েছে। কিন্তু আমরা, বাঙালিরা, কিছুই করিনি। মাজহারুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্থপতি, এটা দুই বাংলার স্থপতিদের চিরকাল মনে রাখা উচিত।’ (আবুল হাসনাত-সম্পাদিত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম, বেঙ্গল পাবলিকেশন্স, ২০১৫)
জয়পুরের স্থপতি-পরিকল্পনাবিদ বিদ্যাধরের সঙ্গে আধুনিক স্থপতি মাজহারুল ইসলামের তুলনা করাতে জটিলতা আছে। বিদ্যাধরের আধা-আধুনিক মহাজাগতিক নগরী এবং মাজহারুল ইসলামের ভবিষ্যৎমুখী আধুনিকতা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনার পরিচায়ক। বিদ্যাধরের উদয় ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনালগ্নে, অন্যদিকে মাজহারুল ইসলামের প্রকাশ সেই শাসনের আনুষ্ঠানিক বিদায়পর্বকালে। এই অন্তর্বর্তী সময়ে, প্রায় দুশো বছরে, ভারতীয় ও বাঙালি সমাজ প্রচণ্ড এক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে, যার বেশিরভাগই ছিল ক্ষতিকর – রজনীপাম দত্ত এবং মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতো মার্কসবাদী চিন্তাবিদদের লেখায় সেটার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। মাজহারুল ইসলামের চিন্তাভাবনার বিকাশে এসব অনুষঙ্গ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।
মাজহারুল ইসলাম সবসময়ই ছিলেন ঔপনিবেশিক শাসনের সমালোচক। তিনি উপনিবেশবাদকে কেবল অর্থনৈতিক শোষণ ও নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা হিসেবে নয়, বরং সাংস্কৃতিক, অস্তিত্বগত ও ঐতিহ্যগত মূল্যবোধের ব্যাপক ক্ষয় ও ক্ষয়ের একক কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে, এমন বিচ্যুত অবস্থায় ব্রিটিশদের অনুসরণে বাঙালিরা উৎসাহী হবে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সমগ্র বাংলার শত শত জমিদারবাড়িতে। সেসব বাড়িগুলিতে শোভা পেয়েছে প্যালাডিয়ান চেহারা, করিন্থিয়ান পিলার এবং গ্রিক পেডিমেন্ট। এগুলো সবই ছিল ইউরোপীয় বিষয়বস্তুর প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের বহিঃপ্রকাশ।
কীভাবে মৌলিক এবং স্থানীয় হওয়া যায়? অতীত প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পর কীভাবে সেই শূন্যতা অতিক্রম করা যায়? এটাই ছিল মাজহারুল ইসলামের কাছে চ্যালেঞ্জ। ঊনবিংশ শতাব্দীর পর থেকে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যখন নতুন সচেতনতা জেগে উঠে, তখন বাংলার সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত প্রায় সবাই এ-ধরনের সংকটের সম্মুখীন হয়েছেন। হিন্দু সংস্কারবাদিতার বিকাশ সত্ত্বেও তথাকথিত ‘বেঙ্গল রেনেসাঁস’ এই আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করেছিল। রামমোহন রায়, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যচর্চা ও কর্মকাণ্ডে সেই আন্দোলনের ধারা লক্ষ করা যায়। সেই আন্দোলনে সাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থাপত্য ছিল সবচেয়ে ধীর এবং পিছিয়ে। বিশিষ্ট লেখক এবং নেহরু মন্ত্রিসভায় সংস্কৃতিমন্ত্রী হুমায়ুন কবির মন্তব্য করেছেন, স্থাপত্যের ব্যর্থতার কারণ ছিল ‘সামাজিক সংহতি’ এবং ‘সামাজিক সহযোগিতার’ অভাব, যা শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রে ততোটা প্রয়োজনীয় ছিল না। আমরা বলতে পারি, মাজহারুল ইসলামই ছিলেন স্থাপত্যে সেই চেতনার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ। এখানেই মাজহারুল ইসলাম বিদ্যাধর থেকে আলাদা।
ঔপনিবেশিকতার সায়াহ্নকালে একজন বিবেকবান ব্যক্তি হিসেবে বেড়ে ওঠা এবং একটি নতুন জাতিসত্ত্বা – পাকিস্তান অভ্যুদয়ের সময়ে স্থপতি হিসেবে প্রশিক্ষিত মাজহারুল ইসলাম তাঁর কর্মকাণ্ডের লক্ষ্য নিয়ে ভাবিত ছিলেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে একটি সরকারি সংস্থায় কাজ শুরু করেন; কিন্তু সেখানে সৃজনশীল কাজের প্রবণতা ও পরিধি সীমিত ছিল। এদিকে মাজহারুল ইসলামকে একটি বৃহত্তর উদ্দেশ্য সাধনের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছিল নিয়তি। পাকিস্তানের মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পরিবর্তে, বা সেই সময়কার ধর্মভিত্তিক সাংস্কৃতিক রূপান্তরচেষ্টায় শামিল হওয়ার পরিবর্তে, মাজহারুল ইসলাম আধুনিকতাবাদী ভাষাকে বেছে নিয়েছিলেন। সময়টা ছিল ত্রিমুখী সংকটের – পাশ্চাত্যের প্রভাব হিসেবে ঔপনিবেশিক ধ্যান-ধারণা বহন করে চলা, ঐতিহ্য হিসেবে যাকে প্রচার করা তার তমসাচ্ছন্ন অবস্থা এবং একটি আধা-ধর্মীয় মতাদর্শের ক্রমবর্ধমান প্রভাব।
সেই ত্রিমুখী বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে আধুনিকতাবাদী মতাদর্শ এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ অত্যন্ত যৌক্তিক, সুবিবেচনাপ্রসূত ও অ-নিবর্তনমূলক উপায় বলে মনে হয়েছিল মাজহারুল ইসলামের কাছে। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে তিনি যেমন
সে-সময়কার স্থাপত্যগতভাবে অনুর্বর বাংলায় শিল্পের সর্বোচ্চ উন্মেষ ঘটাতে চেয়েছিলেন, সেইসঙ্গে তাঁর পেশাগত প্রতিষ্ঠান বাস্তুকলাবিদ নামকরণে তিনি প্রাচীন স্থাপত্য ধারণা ‘বাস্তু’-কে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। ব্রিটিশ ভারতকে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে বিভক্ত করা হয় (পাকিস্তানের পূর্বাংশই পরে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করে)। সে-সময় এই দুই স্বাধীন দেশের কোনোটিতেই আধুনিক স্থাপত্য-সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। তখন স্থাপত্যের বিষয়-আশয়ের নিয়ন্তা ছিলেন প্রকৌশলীরা। তারা অপেক্ষাকৃত সরল ও ইউটিলিটারিয়ান স্থাপত্যকাঠামো নির্মাণ করতেন, অথবা ব্রিটিশ স্থপতিরা নব-ধ্রুপদী ইউরোপীয় ধাঁচ নকল করে কাজ করতেন। সে-পন্থায় আবার স্বল্পজ্ঞানের নকশাবিদরা বাঙালি অভিজাত শ্রেণি মানুষের জন্য বড়-ছোট ভবন বা প্রাসাদ নির্মাণে ব্রত ছিলেন। মানে, চলছিল নকলের নকল। অন্যদিকে সমাজের একটি বড় অংশ স্থাপত্যের সুবিধা থেকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত ছিল। তাদের ধারণাই ছিল না যে, স্থাপত্যের মাধ্যমে সাধারণের মৌলিক চাহিদা মেটানো যায়। ভারতের প্রায় সমস্ত সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পুনরুত্থান ঘটলেও কেন একটি নতুন দেশীয় স্থাপত্যশিল্প বিকশিত হয়নি – এই জিজ্ঞাসা নিয়ে হুমায়ুন কবির ১৯৫৯ সালে নয়াদিল্লিতে একটি সম্মেলনে আবারো বলেন :
‘আমাদের স্থাপত্যের মহান ঐতিহ্য সত্ত্বেও, গত দেড়শো বা দুশো বছরে আমরা আমাদের নোঙর-করার-স্থান হারিয়েছি বলে মনে হচ্ছে। যদিও এই সময়ে প্রচুর ভবন-কাঠামো নির্মিত হয়েছে; কিন্তু আমরা স্থাপত্যে কোনো অসামান্য কৃতিত্ব দেখতে পাইনি। আমরা সামাজিক সংহতির সেই অনুভূতি খুঁজে পাই না, যা মানুষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে প্রকাশ করে এবং এমন একটি স্থাপত্য, যা আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে। পাশ্চাত্যের ব্যাপক প্রভাব ছিল এবং এই প্রভাবগুলো আমাদের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপকারী প্রভাব ফেলেছে; কিন্তু স্থাপত্যের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই তাদের সেই প্রভাব ছিল বলে মনে হয় না।’
আধুনিকতার আদর্শিক ছাতার নিচে বিকশিত স্থাপত্যশিল্প একটি নতুন সুশৃঙ্খল ধারণাকে বিকশিত করবে, যা নব্য সামাজিক প্রয়োজনীয়তাগুলোকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি সেগুলোকে আরো বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দেবে। এমন ধারণাই মাজহারুল ইসলামের ছিল। তাঁর কাছে আধুনিক স্থাপত্যশিল্প ছিল নতুনত্বের নান্দনিক নিদর্শনের চেয়েও বেশি কিছু, যা ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরে একটি বৈপ্লবিক মানবতাবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হবে।
মাজহারুল ইসলামের প্রথম প্রকল্পগুলো থেকেই এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তিনি আধুনিক স্থাপত্যের আদর্শিক লক্ষ্য ও প্রতিশ্রুতির প্রতি সুস্পষ্ট অঙ্গীকার নিয়ে একজন স্থপতি হিসেবে তাঁর কাজ চালিয়ে যাবেন। একই সময়ে স্থাপত্য এবং এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে সাধারণ মানুষেরও কীভাবে চিন্তা করা প্রয়োজন – সেই ভাবনার প্রসার ঘটাতে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তাঁর মতে, আধুনিক স্থাপত্য শুধু একটি চোখ-ধাঁধানো ঘটনা হবে না, যা দেশের নতুন ভোক্তা এবং বিভিন্ন ধরনের চাহিদা মেটানোর কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করা হবে। মাজহারুল ইসলাম আগ্রহী ছিলেন একজন আধুনিক মানুষের মধ্যে সর্বোচ্চ আদর্শের – যেমন, যুক্তিবাদিতা, নৈতিকতা, ন্যায়পরায়ণতা, পক্ষপাতহীনতা, নিবেদিতপ্রাণতা ইত্যাদির – সমন্বয় ঘটাতে।
মাজহারুল ইসলাম নিজের কাজ সম্পর্কে তেমন কিছু বলতে চাইতেন না এবং তাত্ত্বিকতার ব্যাপারে ছিল তাঁর অনীহা। তবে তিনি তাঁর কাজের ক্ষেত্রে কয়েকটি নীতি মেনে চলতেন। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা ও আলাপচারিতা থেকে আমরা তা খুঁজে বের করতে পারি। তাঁর কাজের সুস্পষ্ট নীতি ছিল, স্থাপত্যকে একটি বৃহত্তর সমগ্রের অংশ হিসেবে দেখা। এই বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনা প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ভিনসেন্ট স্কালির ধারণার সঙ্গে মিলে যায়। ভিনসেন্ট স্কালির মতে, ‘সমগ্র পরিবেশের নির্মাণ, কেবল একটি ভবন কিংবা স্বতন্ত্র কোনো ভবন নয়, বরং বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত মানবসৃষ্ট সবকিছু মিলেই এটি নির্মিত হয়। … এটি মানবকেন্দ্রিক সকল কর্মকাণ্ডের সমন্বিত বিন্যাস। স্থাপত্যকলার প্রথম উপাদান হচ্ছে প্রকৃতি নিজে, অর্থাৎ ভূপ্রকৃতি, এবং দ্বিতীয় স্তরটি হলো এই ভূপ্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নির্মিত সমস্ত কিছু।’
মাজহারুল ইসলাম বিভিন্ন উপলক্ষে স্থাপত্যের ব্যাপক উদ্দেশ্য ও প্রসারের কথা পুনরাবৃত্তি করেছেন। তিনি বলতেন, ‘এখন যখন আমরা বলি স্থাপত্য, তখন শুধু একটি ভবনকে, এর নকশার নানা অংশ, উপাদান এবং খুঁটিনাটি বিষয়কে বোঝানো হয় না, বরং স্থাপত্য দিয়ে বোঝানো হয় ভবনটি কোথায় নির্মিত হয়েছে, পরিবেশের সঙ্গে এর সমন্বয় এবং পুরো এলাকার একটি যথার্থ নকশা। সম্প্রসারিত অর্থে এটি পুরো শহর, পুরো গ্রাম, পুরো অঞ্চল ও পুরো দেশকেই বোঝায়।’
১৯৬৮ সালে স্থাপত্যকলা বিষয়ক একটি সম্মেলনে মাজহারুল ইসলাম বৃহত্তর সমগ্রতার প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট করেন :
‘যখন মানুষের কর্মকাণ্ড পৃথিবীপৃষ্ঠে প্রাকৃতিক অথবা মনুষ্যসৃষ্ট বস্তু তৈরিতে উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে, তখন তা স্থপতির ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে। স্থপতির ঐতিহ্যবাহী কর্মকাণ্ড ক্ষুদ্রাকৃতির কাঠামোর গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ; কিন্তু তিনি তখন অনুভব করেন যে, ভৌত অবস্থান এবং বস্তুর যৌক্তিক ও বিস্তারিত নকশা ছাড়া তাঁর পক্ষে নিজের শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও সম্পূর্ণরূপে কাজ করা অসম্ভব।’
স্থাপত্য বিষয়ে মাজহারুল ইসলামের অভিমত ‘সামগ্রিক, প্রাকৃতিক ও সামাজিক নকশাতেই ভৌত বস্তুর সৃষ্টি ও বিন্যাস’ তাঁকে আধুনিকতার প্রতিনিধিত্বকারী স্থাপত্যের একটি প্রগতিবাদী মতাদর্শের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিল। স্থাপত্যশিল্প বোঝার মূলকথা হলো, এগুলো শুধু দর্শনীয় বস্তু নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বড় মণ্ডলের অংশ। তাঁর মতে, স্থাপত্যকে সমগ্রতার অংশ হিসেবে বিবেচনা করা মানে একরকম দায়িত্ববোধের সূচনা করা। স্থাপত্যের এই অন্তর্নিহিত শক্তি ধীরে ধীরে একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তিতে বিকশিত হবে, যা বাঙালির মধ্যে আত্মপরিচয়ের অনুভূতি জাগিয়ে তুলবে। এটিই মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যকলার মূল ভিত্তি।
মাজহারুল ইসলামের কাছে নিওক্লাসিক্যাল বা প্রথাগত ধারাকে অস্থিতিশীল বলে মনে হয়েছিল। একমাত্র জলবায়ু ও ভৌগোলিক পরিমাপ তাঁর কাছে মনে হয়েছিল স্থায়ী। তাঁর মতে, মানুষের দ্বারা সৃষ্ট ও উৎপাদিত স্থাপত্যকে অবশ্যই জলবায়ু এবং ভৌগোলিক অবস্থানের প্যারামিটারগুলির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হতে হবে। হুমায়ূন কবির বলেছেন, ‘আমাদের দেশে আমরা দেখতে পাই স্থাপত্যের বিভিন্ন রূপ কীভাবে আঞ্চলিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। স্থাপত্যকে অবশ্যই বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লেষিত হতে হবে।’ মাজহারুল ইসলামের কাজের দ্বিতীয় নীতি হলো, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বা আঞ্চলিক পরিবেশের সচেতনতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে মাজহারুল ইসলামের কাজকে ‘আঞ্চলিক আধুনিকতাবাদ’ বলে আখ্যায়িত করা যায়।
মাজহারুল ইসলামের কর্মকাণ্ডকে সংজ্ঞায়িত করার তৃতীয় নীতিটি হলো একটি ভবনের গঠনগত স্পষ্টতা (বা ইংরেজিতে tectonic clarity), যে-কোনো ভবন নির্মাণের পেছনে সুস্পষ্ট যুক্তি প্রয়োগ এবং উপকরণসমূহের ন্যূনতম ব্যবহার। আমার কাছে এই অভিব্যক্তিকে তপস্যাপূর্ণ বলে মনে হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, কোনো রকম বাগাড়ম্বর ছাড়াই অপ্রয়োজনীয় ও জাঁকজমকপূর্ণ উপাদানগুলো পরিহার করা। এভাবেই মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্যশিল্পকে আমি ভারতীয় সমসাময়িক স্থপতি অচ্যুত কানভিন্দের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছি। মাজহারুল ইসলামের মতো কানভিন্দেও পঞ্চাশের দশকে ভারতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-নির্মাণ প্রকল্পে জড়িত ছিলেন। আমার মতে, নির্মাণের বাস্তবতা ও নির্মাণের শৈল্পিক প্রকাশের মাধ্যমে কানভিন্দে ও মাজহারুল ইসলামের স্থাপত্য নিজেরাই তাদের তাৎপর্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। ‘বাস্তব’ স্থাপত্য বলতে যা বোঝায় তা হলো এক ধরনের সংক্ষেপণ, যেখানে লক্ষ্য হলো ধীরে ধীরে অতিরিক্ত সবকিছুকে পরিশুদ্ধ করে এমন একটি অপরিবর্তনীয় স্তরে পৌঁছানো, যেখানে অন্য কিছু দ্বারা স্থাপত্যের যোগ্যতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তা নেই। বালকৃষ্ণ দোশি এবং চার্লস কোরেয়ার শেষদিকের কাজগুলোর বিপরীতে মাজহারুল ইসলাম ও কানভিন্দে রূপককরণ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতেন এবং তাঁরা স্থাপত্যের বাস্তবতা বলে দাবি করেন সেটার গঠনাত্মক ও নির্মাণমূলক প্রকাশভঙ্গি।
মাজহারুল ইসলাম পরিমিত কথা বললেও একটি শব্দ প্রায়ই ব্যবহার করতেন, যা তিনি স্থাপত্য বা সমাজ সম্পর্কিত নানা বিষয়েও বারবার বলেছেন – ভদ্র। ভদ্রকাজ, ভদ্রসমাজ। ভদ্র ধারণাটি আধুনিক স্থাপত্যের তাত্ত্বিক আলোচনায় সহজে শোনা যায় না। তবে মাজহারুল ইসলামের মনে ভদ্রকাজ এবং ভদ্রসমাজ ছিল আপোসহীন লক্ষ্য, যা একটি নৈতিক সাধনার রূপ ধারণ করেছিল। আমি এটাকে মাজহারুল ইসলামের চতুর্থ নীতি হিসেবে উল্লেখ করব। তাঁর স্থাপত্য পরিকল্পনাগুলোতে এই নীতি প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রতি মাজহারুল ইসলামের পূর্ণ অঙ্গীকারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল একটি ‘ভদ্রসমাজ’ প্রতিষ্ঠা, একটি যুক্তিবাদী ও ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠন। তিনি নিঃসন্দেহে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের অনুকরণে তাঁর ভদ্রসমাজ তৈরির কথা ভেবেছিলেন। তাঁর স্থাপত্যশৈলীতে যে সরলতা এবং স্থাপত্য-পরিকল্পনায় সৌন্দর্যমণ্ডিত স্পষ্টতা ধরা দেয়, তা রুচিশীল স্থাপত্যের বহিঃপ্রকাশ। অলংকার বলে যেটা অভিহিত করা যায়, সেটা তিনি বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতে, অলংকার একটি কাজের যুক্তিযুক্ততা ও যথার্থতার বাইরে ভিন্ন কিছু নির্দেশ করে। ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে স্থপতি ল্য করবুজিয়ের তাঁর টুয়ার্ডস অ্যান আর্কিটেকচার গ্রন্থে বুর্জোয়া-স্থাপত্য প্রসঙ্গে কঠোর সমালোচনা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর শেষের কবিতা উপন্যাসে অমিত রায়ের চরিত্রবর্ণনা করতে গিয়ে মুখোশ ও মুখশ্রীর মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরেন। ১৯৯৩ সালে আমি যখন মাজহারুল ইসলামের সঙ্গে ধারাবাহিক কথোপকথন রেকর্ড করছিলাম, তখন তিনি হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি কি শেষের কবিতা পড়েছেন?’ আমি পরে নিশ্চিত হলাম যে, তিনি আমাকে এমন কিছুর ইঙ্গিত করছেন, যেটাকে তিনি ভদ্র ও খাঁটি বলে মনে করেন। অমিতের কাছে সাহিত্য-বর্ণনার মুখোশ হলো ফ্যাশন আর মুখশ্রী স্টাইলের প্রতীক। যারা নিজেদের কাজে আত্মবিশ্বাস ও মৌলিকতা বজায় রাখে, তারাই স্টাইলের সংজ্ঞা নির্ধারক। ‘তারা আলাদা।’ রবীন্দ্রনাথের লেখায় আমরা অমিতকে এমনটা বলতে শুনি। কিন্তু যারা নিজেদের কাজে অন্যের মতামতকে প্রাধান্য দেয়, যারা অধিকাংশ যে-পথে হাঁটে সে-পথ ছেড়ে ভিন্ন পথে হাঁটতে ভয় পায়, তারা শুধু ফ্যাশনের ধারক ও মুখোশের বাহক।
মাজহারুল ইসলাম তাঁর সমসাময়িকদের চেয়ে ভিন্ন পথে হেঁটেছেন। তিনি তাঁর মৌলিকত্বের প্রতি সবসময় নিবেদিত ছিলেন – এটাই তাঁর জীবন ও কাজের বৈশিষ্ট্য। শেষের কবিতা-র অমিতের মতো মাজহারুল ইসলামও, কিছুটা হলেও, একটি ভিন্ন ‘স্টাইল’ তৈরি করেছেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, তিনি পাশ্চাত্য ও বাংলা উভয় ধারায় স্বচ্ছন্দ ছিলেন, একে বিশ^জনীনতাও বলা যায়। তিনি ভীষণভাবে বই পড়তেন – লেনিন থেকে রজনীপাম দত্ত, চার্লস জেঙ্কস থেকে আইজ্যাক আসিমভের অত্যন্ত মনোযোগী পাঠক ছিলেন। আগ্রহী শ্রোতা ছিলেন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও জ্যাজ সংগীতের। পাশ্চাত্যের পোশাক ‘স্যুট’ অথবা বাঙালি পোশাক ‘কুর্তা’ দুটোই অত্যন্ত সচেতনভাবে পরতেন। মাজহারুল ইসলাম আবেগময় নাটকীয়তা থেকে দূরে থাকতেন। কিন্তু যাদের পথের লক্ষ্য ছিল সমঝোতা ও বাজারমুখী, তাদের কঠোর সমালোচনা করতে তিনি কখনো পিছপা হতেন না।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.