অপরত্ব ও ‘জাতীয় রূপক’-বিষয়ক জেমসনীয় বাগাড়ম্বর

ভূমিকা ও অনুবাদ : সুরেশ রঞ্জন বসাক 

ভূমিকা

উপনিবেশবাদের একটি অনপনেয় উত্তরাধিকার হলো, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি এক বিশ্বকে প্রাচ্য-প্রতীচ্যে দু-টুকরো করেই ক্ষ্যান্ত হয়নি, প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্ব – এই তিন বিশ্বে ভাগ করে ছেড়েছে। এসব বিভাজন রাজনীতি,  অর্থনীতি,  সংস্কৃতি,  সমাজনীতি, ভাষা-সাহিত্য ইত্যাদি ছাড়াও ভৌগোলিকভাবে বিউপনিবেশিতদের চিন্তা ও মননে স্থায়ী বিভাজন-চিহ্ন এঁকে দিয়েছে। আরেকভাবে বললে, এই ত্রিমুখী বিভাজন উপনিবেশোত্তর লেখালেখির বাস্তবতাকে আরেক প্রস্থ উপনিবেশিত করার প্রয়াস পেয়েছে। পশ্চিমা করপোরেট বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেন্দ্রগুলি এ-প্রয়াসের অন্যতম উদ্যোক্তা এবং তাদের সংজ্ঞায়িত অন্যতম অচ্যুত সাহিত্যধারার নাম দেওয়া হয়েছে ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’। এর পাশাপাশি তথাকথিত বিউপনিবেশিত দেশগুলির সাহিত্যকে ‘কমনওয়েলথ সাহিত্য’ বলে পরিচিতি তুলে ধরে পরিত্যক্ত ঔপনিবেশিক কাঠামো ধরে রাখা এবং আরেক ধরনের নব্য-ঔপনিবেশিকতার অনুপ্রবেশ নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা বলে অভিযোগ উঠেছিল বহু আগেই। ডানপন্থী, বামপন্থী ও মধ্যপন্থী উত্তরউপনিবেশী তাত্ত্বিকেরা নানা অবস্থান থেকে এই অধ্যয়নক্ষেত্রের নানা গতিপথ মতাধিক্যের প্রাবল্য নিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন। একদা বামপন্থী ফ্রেডরিক জেমসনের তৃতীয় বিশ্বসম্পর্কিত অভিমত, অপরত্বের (Otherness) মতো তুচ্ছতাজ্ঞাপক পশ্চিমা পরিবেশনা, তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যকে জাতীয়তাবাদী রূপক বলে চালানো ইত্যাদিকে যুক্তিতর্কে মোকাবিলা করেছেন আরেক মার্কসবাদী উত্তরউপনিবেশী তাত্ত্বিক আইজাজ আহমদ। বর্তমান প্রবন্ধটিতে তারই স্বাক্ষর তিনি রেখেছেন।

Social Text-এর ১৫শ সংখ্যায় (অটাম, ১৯৮৬) ফ্রেডরিক জেমসনের প্রবন্ধ ‘Third-World Literature in the Era of Multinational Capitalism’-এর প্রত্যুত্তরে আইজাজ আহমদ Social Text-এর ১৭শ সংখ্যায় (ফল, ১৯৮৭) লেখেন ‘Jameson’s Rhetoric of Otherness and the “National Allegory”। বিল অ্যাশক্রফট প্রমুখ সম্পাদিত পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজ রিডার-এ আইজাজ আহমদের প্রবন্ধটি ঈষৎ সংক্ষেপিত আকারে প্রকাশিত। তারপরও তাঁর বয়ান মোটামুটি অক্ষত আছে বলে আমার ধারণা।  প্রবন্ধের শুরুতে আইজাজ জেমসনের সঙ্গে তাঁর পনেরো বছরের আদর্শিক নৈকট্যের কথা স্বীকার করেছেন। এখানে স্মরণ করতে হবে, ফ্রেডরিক জেমসন মার্কসবাদী রাজনৈতিক তাত্ত্বিক এবং সমসাময়িক সংস্কৃতি, উত্তরাধুনিকতা, পুঁজিবাদ ইত্যাদি বিষয়ে প্রভাবশালী পণ্ডিত। কিন্তু পাণ্ডিত্যের পেছনের মানুষটি প্রথম বিশ্বের – এবং আমেরিকান। অন্যদিকে, আইজাজ আহমদ একজন ভারতীয়, এবং সে-অর্থে তৃতীয় বিশ্বের। অতএব মার্কসবাদচর্চা এই দূরত্বকে অতিক্রম করতে পারেনি। ফলে বামপন্থী হওয়া সত্ত্বেও জেমসনের অপরত্ব, জাতীয়তাবাদ,  তৃতীয় বিশ্ব, এর সাহিত্য ইত্যাদির ধারণা সংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ঠিক এখানেই আইজাজ আহমদের আপত্তি এবং পাল্টা পর্যবেক্ষণ।  ফরাসি নৃবিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ আলফ্রেড সউভি ফরাসি ম্যাগাজিন L’Observeteur-এ প্রকাশিত (১৪ই আগস্ট, ১৯৫২) প্রবন্ধে প্রথম ‘তৃতীয় বিশ্ব’ (tiers monde) শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেন। তখন যদিও তিনি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে ন্যূনতম-সংশ্লিষ্ট দেশগুলিকে বোঝাতে এই শব্দবন্ধ বেছে নিয়েছিলেন, কালে কালে এটাই হয়ে ওঠে ন্যাটো, ওয়ারশ জোট, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ান ছাড়া বাদবাকি বিশে^র তুচ্ছতাসমগ্রের প্রতিভূ – তাদের সর্বাত্মক পরিচিতি।

জেমসনের প্রবন্ধ পড়তে গিয়ে, ঠিক পাঁচ পৃষ্ঠায় এসে আইজাজ আহমদের মনে হলো, যে-তৃতীয় বিশ্বের তত্ত্ব জেমসন পরিবেশন করতে চলেছেন, আইজাজ সে-তত্ত্বে তত্ত্বীভূত হয়ে গেছেন! জেমসনের মূল থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি : ‘[L]et me now,  by way of a sweeping hypothesis, try to say what all third-world cultural productions seem to have in common and what distinguishes them radically from analogous cultural forms in the first world’।  এ তো গেল হাইপোথিসিস, এবার তাঁর থিসিস : ‘All thirld-world texts are necessarily, I want to argue, allegorical, and in a very specific way: they are to be read as what I will call national allegories, even when, or perhaps I should say, particularly when their forms develop out of predominantly western machineries of representation, such as the novel’। একেই কি হিউব্রিস/ জাত্যাভিমান বলে? এই যুক্তির আপদ হলো, কথিত বিশ্বটি ‘তৃতীয় বিশ্ব’; এর সব সাংস্কৃতিক সৃষ্টি একই রকম, এবং দ্বিতীয়ত, এগুলি প্রথম বিশ্বের অনুরূপ সৃষ্টিকর্ম থেকে মৌলিকভাবে ভিন্ন। কারণ, জেমসনের মতে, তৃতীয় বিশ্বের তাবৎ টেক্সট অবধারিতভাবে শুধু রূপকই নয়, জাতীয়তাবাদী রূপক। যেন ইউরোপে রূপক ছিল না, জাতীয়তাবাদ ছিল না, এ-ধারার সাহিত্যও ছিল না। আইজাজ আহমদ জেমসনীয় তত্ত্ব উদ্ধৃত করে – ‘সব?  অবধারিতভাবে?’ – এসবের পর বিস্ময়সূচক প্রশ্ন রেখেছেন এবং পাল্টা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন : তাঁর জন্ম তো ভারতে, তিনি উর্দুতে কবিতা লেখেন এবং আমেরিকান বুদ্ধিজীবীরা সচরাচর এ-ভাষা বোঝেন না। সেক্ষেত্রে ‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট’ দাবি কি যৌক্তিক? জেমসনের ‘sweeping hypothesis’ যথার্থই বাছবিচারহীন অনুমান। তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট সম্পর্কে অবগত না হয়ে (যা কার্যত অসম্ভব) এমন একতরফা সিদ্ধান্তে পৌঁছা, আইজাজের মতে, জেমসনের ‘সভ্যতা-প্রসূত অপর সত্তা’ জাহির করার প্রচেষ্টা, এবং এটি কোনো সুখদ অভিজ্ঞতা নয়।

আইজাজ আহমদ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, ইন্ডিয়ান, আফ্রিকান ও ল্যাটিন আমেরিকার লেখকেরা প্রচুর ভালো বই লিখেছেন। এসব বই ইংরেজিতে পাওয়া যায়। তিনি তীর্যকভাবে পরামর্শ দিয়েছেন, এসব বই পশ্চিমা বিশ্বে, বিশেষ করে, ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান মানবিকবিদ্যার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিক্ষীণতা এবং সাধারণ জাতিকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে পড়ানো উচিত’। এর পর তিনি তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, কারণ যে-অন্তর্নিহিত সামঞ্জস্যের ওপর একটি সাহিত্যের তাত্ত্বিক অবয়ব গড়ে ওঠে, এ-সাহিত্যে তা অনুপস্থিত। শুধু তৃতীয় বিশ্বে রচিত সাহিত্যের জন্যে যদি কোনো লেবেল লাগাতে হয়, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। যেহেতু আইজাজ আহমদ ‘তৃতীয় বিশ্ব’ শব্দবন্ধটিকে যথার্থ মনে করেন না, তাই স্বভাবতই তৃতীয় বিশে^র সাহিত্যের ধারণাটিকে তাঁর আরোপিত ও অযাচিত মনে হয়েছে। আবার যখন জেমসন তাঁর তৃতীয় বিশ্বের ধারণাকে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতার নিরিখে সংজ্ঞায়িত করেন, তিনি জাতীয়তাবাদকে এতটাই গুরুত্ব দেন যে, এই খণ্ডিত তিন নম্বর বিশ্বের সব সাহিত্য তখন তাঁর কাছে জাতীয় রূপক হয়ে ওঠে। আইজাজ আহমদ এ-প্রবন্ধে যুক্তি-তর্ক তত্ত্ব-তথ্য দিয়ে একদিকে প্রথম ও তৃতীয়  বিশ্বের মধ্যে বিদ্যমান উন্নাসিকতার মুখোশ যেমন খুলে দিয়েছেন, তেমনি জেমসনীয় বাগাড়ম্বরের অসারত্বও প্রমাণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন কোরান, ভাগবত-গীতা, মনু-সংহিতাকে ‘আদিম’ (‘primordial’) প্রাচ্য/ তৃতীয় বিশ্বের টেক্সটের তকমা দেওয়া হলে, আতঙ্কিত বোধ করতে হয় বইকি। পরিশেষে তিনি দেখিয়েছেন, রূপকায়নের কাজটি, জাতীয়তাবাদের মতো, তৃতীয় বিশ্বের একচেটিয়া নয়। জাতীয়তাবাদের আয়নায় না দেখে, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আয়নায় রূপকায়নকে দেখা সম্ভব।

জেমসনের লেখালেখির সঙ্গে আমার পরিচয় কম-বেশি পনেরো বছরের। পশ্চিম ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে আমি যতটুকু জেনেছি, অন্তত তার কিছু অংশ তাঁর কাছ থেকে শেখা। এর কারণ, আমি একজন মার্কসবাদী,  আমি সবসময় ভেবে এসেছি, আমি ও জেমসন – আমরা দুজন একই পালকের পাখি, যদিও আমরা কখনো সেভাবে একসঙ্গে থাকিনি। কিন্তু, আমি যখন তাঁর প্রবন্ধের (‘Third World Literature in the Era of Multinational Capitalism’) পাঁচ নম্বর পৃষ্ঠা পড়ছিলাম (বিশেষ করে, যে বাক্যটি শুরু হয়েছে এভাবে :  ‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট আবশ্যিকভাবে…’ ইত্যাদি), আমি বুঝতে পারলাম, তিনি যা তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করতে যাচ্ছেন আমি নিজেই সেই উপস্থাপিত উপাদানসমূহের একটি। আমার জন্ম ভারতে এবং আমি উর্দুতে কবিতা লিখি, যে-ভাষা আমেরিকান বুদ্ধিজীবীরা সচরাচর বোঝেন না। তাই আমি স্বগতোক্তি করলাম, ‘সব? … আবশ্যিকভাবে?’ কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। সে যাক, আরো কৌতূহল আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল। কারণ,  আমি যতই পড়ে যেতে লাগলাম, যথেষ্ট উষ্মার সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারলাম, যে-লোকটিকে আমি এতকাল, সস্নেহে, শারীরিক দূরত্ব সত্ত্বেও, কমরেড বলে মেনে নিয়েছিলাম, তাঁর নিজের বয়ানে, তিনি কি না হলেন আমার সভ্যতা-প্রসূত অপর সত্তা  (‘civilizational Other’)। এ-অনুভূতি সুখদ ছিল না।

আমিও মনে করি, আফ্রিকান, ইন্ডিয়ান এবং ল্যাটিন আমেরিকান লেখকদের লেখা প্রচুর খুব-ভালো বই রয়েছে যেগুলি ইংরেজিতে পাওয়া যায় এবং যেগুলি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বিদ্যমান মানবিকবিদ্যার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিক্ষীণতা (cultural myopia) এবং সাধারণ জাতিকেন্দ্রিকতার (general ethnocentricity) বিরুদ্ধে প্রতিষেধক হিসেবে পড়ানো উচিত। আর এ-কাজের জন্যে যদি কোনো পরিচয় সেঁটে দিতে হয়, তাকে ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’ বলে ডাকা যেতে পারে। সে যাক, এর বিপরীতে, আমি আরো মনে করি  ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামক শব্দবন্ধটি, এমনকি সর্বোচ্চ কার্যকর ব্যবহারেও তর্কাতীত নয়, যার কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি নেই …। এতএব আমি অনুষঙ্গ বিচারে এই যুক্তি দেব যে, ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’ বলে কোনো বস্তু নেই, যাকে অন্তস্থ সামঞ্জস্যপূর্ণ তাত্ত্বিক জ্ঞানের বিষয় (internally coherent object of theoretical knowledge) হিসেবে দাঁড় করানো যেতে পারে। সাহিত্যের সৃজন-ক্ষেত্রে সময়ের পর্ববিভাগ, সামাজিক ও ভাষাগত স্তরবিন্যাস এবং রাজনৈতিক ও আদর্শিক সংগ্রামের মতো অপরিহার্য বিষয়াদি রয়েছে,  যা সম্পূর্ণ ধনাত্মক খণ্ডতাবাদ (positivist revisionism) ব্যতিরেকে সাধারণ বিবেচনার স্তরে সুরাহা করা যায় না …।

আমি পরবর্তীকালে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করবো, যেহেতু জেমসন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অভিজ্ঞতার আলোকে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বকে সংজ্ঞায়িত করেছেন, ফলে অবধারিতভাবে এর রাজনৈতিক – ‘জাতীয়’ – চারিত্র্যের ওপর এতটাই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে যে, জাতীয়তাবাদ হয়ে উঠেছে এক অদ্ভুত পরাক্রমশালী আদর্শ (peculiarly valorized ideology)। এই জাতীয়তাবাদী আদর্শকে প্রাধিকার দেওয়ার কারণে এটা তাত্ত্বিকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে, ‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট অবধারিতভাবে … জাতীয় রূপক … তাদের সেভাবে পাঠ করতে হবে।’ একটি অন্তঃস্থিত পাঠ বা টেক্সট (metatext) হিসেবে ‘জাতীয় রূপক’-তত্ত্ব বৃহত্তর তিন-বিশ্ব তত্ত্ব (Three Worlds Theory) থেকে অবিচ্ছেদ্য, যা জেমসনের নিজের টেক্সটের পুরোটা জুড়ে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। অতএব আমাদেরও  ‘তৃতীয় বিশ্ব’ নামক উদ্ভূত একটি তাত্ত্বিক শ্রেণি এবং  ‘জাতীয়তাবাদ’ নামক আবশ্যকীয় ও বিশেষভাবে কাম্য আদর্শ নিয়ে দু-চারটে মন্তব্য দিয়ে শুরু করতে হয়।

জেমসন যা ‘বর্ণনা’ করেছেন, আমরা যদি তার সারমর্মে পৌঁছাই, তাহলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখে পড়বে : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বের সংজ্ঞায়ন হয়েছে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থার নিরিখে (যথাক্রমে পুঁজিতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র), অথচ তৃতীয় শ্রেণিভুক্ত – তৃতীয় বিশ্ব – সংজ্ঞায়িত হয়েছে কেবল বাহির থেকে আরোপিত ‘অভিজ্ঞতা’র আলোকে। এই যে ধারণা – প্রথম দুটি ক্ষেত্র মানব জাতির ইতিহাসের সঙ্গে একেবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত – তা কিন্তু তৃতীয়টিতে অনুপস্থিত। আদর্শের দিক থেকে এই শ্রেণিবিভাজন গোটা বিশ্বকে দু-ভাগে ভাগ করে ফেলেছে : এর একদিকে রয়েছে যারা ইতিহাস রচনা করে এবং অন্যদিকে রয়েছে যারা ওই ইতিহাসের নেহায়েত গৌণবস্তু। তাঁর টেক্সটের অন্যত্র জেমসন অর্থপূর্ণ কারণে হেগেলের বিখ্যাত
মনিব-ক্রীতদাস সম্পর্ক বর্ণনার শরণাপন্ন হয়েছেন – সংক্ষেপে, প্রথম ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যেকার সম্পর্কসূত্র বোঝাতে। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, এই শ্রেণিকরণ তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বকে না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থায় ফেলেছে; কেবল প্রথম বিশ্ব যদি পুঁজিতন্ত্রী হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যদি সমাজতন্ত্রী হয়, তৃতীয় বিশ্বকে কোন মতবাদ দিয়ে বোঝা যাবে? এটা কি তবে
প্রাক-পুঁজিবাদী? নাকি অন্তর্বর্তীকালীন কিছু? অন্তর্বর্তীকালীন হলে কার কার মধ্যে এর অবস্থান? তা যদি হয়ে থাকে, তবে প্রশ্ন থাকে যে, বিভিন্ন  ‘জগতের’ (various ‘worlds’) অন্তর্গত বিশেষ বিশেষ দেশগুলির অবস্থান কোথায়?

উদাহরণ হিসেবে ভারতের কথা ধরা যাক। কয়েক মাস পরপর আমেরিকান টিভি-পর্দায় ভারতের ঔপনিবেশিক অতীত নিয়ে সিরিজের পর সিরিজ ধরে ব্যাপক স্মৃতিকাতর পুনরাবৃত্তির চর্চা চলে। কিন্তু পুঁজিবাদী দেশের সবকটি বৈশিষ্ট্যই আজকের ভারতের রয়েছে। সাধারণ পণ্য উৎপাদন ছাড়াও ভারতে কৃষি ও শিল্পের মধ্যে শক্তিশালী ও বর্ধনশীল বিনিময় লক্ষণীয়। শিল্প খাতের আন্তঃবিভাগের মধ্যে বিনিময় উল্লেখযোগ্য এবং প্রযুক্তি-জ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তির দিক থেকে ভারত যৌথভাবে ফ্রান্স ও জার্মানির চেয়ে এগিয়ে।

এতএব, ভারত কী প্রথম বিশ্বের গোত্রভুক্ত, নাকি তৃতীয় বিশ্বের?

আমি ইতঃপূর্বে উল্লেখ করেছি, যদি কেউ তিন-বিশ্বের তত্ত্বে বিশ্বাস করে – যেহেতু  ‘তৃতীয় বিশ্ব’ কেবলমাত্র উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের অভিজ্ঞতার আলোকেই সংজ্ঞায়িত হতে পারে – তাহলে প্রাথমিক আদর্শিক ধারণা-নির্মাণের (primary ideological formation) জন্যে একজন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীর কাছে কেবল অবশিষ্ট থাকে জাতীয়তাবাদ। অতঃপর জোর দিয়ে বলা যেতে পারে – নিশ্চিতভাবে ব্যাপক অতিশয়োক্তিসমেত –  তথাপি বলা যেতে পারে যে, ‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট অবধারিতভাবে …  জাতীয় রূপক’ (মূল লেখায় বাঁকা হরফেই আছে)। জাতীয়তাবাদী আদর্শের ওপর এই গুরুত্বারোপ জেমসনের টেক্সটের, এমনকি শুরুর অনুচ্ছেদেই জায়গা করে নিয়েছে, যেখানে তাঁর প্রিয় শব্দবন্ধ ‘তৃতীয় বিশ্ব’ (‘Third World’) স্বমহিমায় বিরাজ করছে  ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘বৈশ্বিক আমেরিকান উত্তরাধুনিক সংস্কৃতির’ (‘global American postmodernist culture’) মাঝখানে। তাহলে বেছে নেওয়ার মতো অন্য কোনো বিকল্প কী নেই? কেউ কি চাইলে, উদাহরণস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্বে যোগ দিতে পারে না? …

Binary oppositions বা দ্বি-মূল মেরুকরণের (এক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদ/ উত্তরাধুনিকতাবাদ) নিরিখে ঐতিহাসিক ঘটনাবলির যোগফল করতে গিয়ে জেমসনের তাড়াহুড়ো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের জন্যে জাতীয়তাবাদ ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা রাখেনি। জাতীয়তাবাদ  যুক্তরাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক চাপ প্রতিহত করতে  এবং  প্রকৃতপক্ষে, অনেক বিকল্প সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। এই বিকল্পগুলি ইতোমধ্যে বৃহত্তর সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক-চর্চায় স্পষ্ট রূপ পেয়েছে এবং আত্তীকৃত হয়ে গিয়েছে। কার্যত, অনেকেরই জেমসন-কথিত, ‘বৈশ্বিক আমেরিকান উত্তরাধুনিকতাবাদী সংস্কৃতি’র সঙ্গে অঙ্গীভূত হতে বেগ পেতে হয়নি। … একইভাবে সেই বিরোধিতার যথেচ্ছাচার (উত্তরাধুনিকতা/ জাতীয়তাবাদ) একটি সহজবোধ্য বিষয়কেও স্থান দিতে রাজি নয়। জাতীয়তাবাদ নিজেই পূর্বনির্ধারিত মৌলিক স্বভাব ও মূল্যবোধবিশিষ্ট কোনো ঐক্যগঠনকারী বস্তু (unitary thing) নয়। আজকের এশিয়া ও আফ্রিকায় শ’য়ে শ’য়ে জাতীয়তাবাদ রয়েছে; এদের কিছু কিছু প্রগতিশীল, বাকিরা নয়। জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চা সৃষ্টি করতে পারে কি না তা নির্ভর করে, গ্রামসির মতে, ক্ষমতা-বলয়ের রাজনৈতিক চরিত্রের ওপর, যে-বলয় তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় সংস্কৃতিকে করায়ত্ত করে একটি বস্তুগত উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে। তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদগুলির (bourgeois nationalisms) উত্তরাধুনিকতাবাদকে মেনে নিতে কোনো সমস্যা হবে না – এমন ধারণার পেছনে কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি (theoretical ground) বা প্রায়োগিক সাক্ষ্যপ্রমাণ (empirical evidence) নেই; তারা বরং এমনটাই চেয়েছে।

তারপরও তিন-বিশ্ব তত্ত্ব, জাতীয়তাবাদী আদর্শের অতিমূল্যায়ন, এবং তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের ক্ষেত্রে ‘জাতীয় রূপক’ই প্রাথমিক, এমনকি একমাত্র বয়ানের উপায়, – এমন দাবি বড্ড আঁটোসাঁটো হয়ে যায়। যদি এই  ‘তৃতীয় বিশ্ব’ অনন্য ‘ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতা’ দিয়ে গঠিত হয়, এবং এর সম্ভাব্য উত্তর যদি কেবল জাতীয়তাবাদী ঘরানার হয়, তাহলে এই ‘অভিজ্ঞতা’কে বর্ণনা করার চেয়ে অধিকতর জরুরি কী হতে পারে? বস্তুতপক্ষে বর্ণনা করার কিছুই নেই। কারণ, যদি সমাজগুলিকে উৎপাদনের আলোকে সংজ্ঞায়িত না করে আন্তঃজাতীয় আধিপত্যের আলোকে সংজ্ঞায়িত করা হয়; যদি তাদের চিরকাল পুঁজিবাদ (প্রথম বিশ্ব) এবং সাম্যবাদ (দ্বিতীয় বিশ্ব)-এর মধ্যেকার দ্বান্দ্বিক বলয়ের বাইরে ঝুলিয়ে রাখা হয়; যদি ইতিহাসের উদ্দীপক শক্তি হিসেবে শ্রেণিগঠন এবং শ্রেণিসংগ্রামকে কিংবা শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম ইত্যাদির মতো বহুস্তরবিশিষ্ট পরস্পরচ্ছেদী দ্বন্দ্বকে গ্রাহ্য করা না হয়, এবং যদি জাতীয় নিপীড়নের একক ‘অভিজ্ঞতা’কে (একপক্ষ ইতিহাসের বিষয় মাত্র, হেগেলীয় ক্রীতদাস) একমাত্র গ্রাহ্য করার  বিষয় হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে জাতীয় নিপীড়ন ছাড়া বর্ণনা করার মতো আর কী থাকতে পারে? রাজনৈতিকভাবে আমরা সবাই ক্যালিবান। আনুষ্ঠানিকভাবে, ভিন্নতাসহ একটি পুনরাবৃত্তিমূলক উত্তরকাঠামোবাদী জগতের (post-structuralist world of Repetition with Difference) অন্তর্ভুক্ত হওয়াই আমাদের নিয়তি। সেই একই রূপক, সেই জাতীয়তাবাদী বয়ান, বারংবার নতুন নতুন করে লেখা, অনন্ত অনন্তকাল ধরে : ‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট অবধারিতভাবে…’।

একেবারে ভিন্ন একটি সিদ্ধান্ত-সূত্র থেকেও আমরা এগোতে পারি, যেমন, প্রস্তাবনাটি হতে পারে : আমরা তিন বিশ্বে বাস করি না, বাস করি একটিমাত্র বিশ্বে; এই বিশ্বের রয়েছে উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের অভিজ্ঞতা, যা জেমসনের বিভাজিত বিশ্বের উভয় অংশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (ভাবাদর্শের বিন্যাস থেকে শুরু করে সামরিক-শিল্পকারখানা চক্রের সামাজিক উদ্বৃত্ত পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জীবনের সকল স্তরে –  সাম্রাজ্যবাদ একটি মুখ্য অভিজ্ঞতা)। এসব সমাজের অনগ্রসর পুঁজিবাদ যেমন শ্রেণিবিভাজনের ওপর গড়ে উঠেছে, অগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলিতেও তেমনি শ্রেণিবিভাজনকে পুঁজি করে পুঁজিবাদ গড়ে উঠেছে। ‘দ্বিতীয় বিশ্ব’ বলে যাকে ডাকা হয়, সমাজতন্ত্র কেবল সেখানে সীমাবদ্ধ নয়, তা বরং একটি প্রতিরোধের নাম, যা বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত হয়েছে, যেমনটি ঘটেছে পুঁজিবাদের বেলায়ও। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিভিন্ন উপাদানকে কেবল দ্বি-মূল বিরোধিতা (binary opposition) দিয়ে নয়, জানতে হবে তাদের বৈপরীত্যের মধ্যে বিরাজমান ঐক্য (contradictory unity) দিয়ে – পার্থক্যসমেত। তবে হ্যাঁ, তারা শেষতক গুরুতররূপে একাকার হয়ে যায় …।

জেমসন দাবি করেছেন, বিশ্বের প্রকৃত ঐক্য-বিষয়ক কোনো তত্ত্বের ভিত্তি ‘গড়পড়তা উদারনৈতিক (general liberal) এবং মানবতাবাদী সর্বজনীনতায় (humanistic universalism) পর্যবসিত না হয়ে’ যায় না। এটি একটি কৌতূহলোদ্দীপক ধারণা বটে, যখন তা একজন মার্কসবাদীর কাছ থেকে আসে। সংগতভাবে ভাবা যেতে পারে, বিশ্ব উদারনৈতিক আদর্শের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়নি।  সত্যি হচ্ছে, পৃথিবী কখনোই মতাদর্শ থেকে উদ্ভূত হয়নি, সেটা হোক হেগেলীয় বা মানবতাবাদী। বরং একটি বৈশি^ক সুনির্দিষ্ট উৎপাদনব্যবস্থা, যেমন পুঁজিবাদ, থেকে উদ্ভূত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, দেশে দেশে তার মাত্রা এক রকম নয়। সমাজতন্ত্র কোনোভাবেই তথাকথিত দ্বিতীয় বিশ্বের  (সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ) মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক বিস্ময়কর ঘটনা, যা এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার প্রত্যন্ত সম্প্রদায়গুলির মধ্যে বিস্তৃত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তি ও গোষ্ঠীবিশেষের কথা না হয় না-ই বললাম। অতএব, মানবতাবাদী মতাদর্শ বিশ্বকে ঐক্য এনে দেয়নি, ঐক্য এনে দিয়েছে মূলধন ও শ্রমের মধ্যে হিংস্র লড়াই, যা বর্তমানে সুনির্দিষ্ট ও মৌলিক রূপে বৈশ্বিক চারিত্র্য লাভ করেছে …।

সাংস্কৃতিক পার্থক্যের নির্দিষ্টতা প্রসঙ্গে, জেমসনের তাত্ত্বিক মতামত, আমার বিশ্বাস, উল্টো পথ বেছে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সমসত্ত্বায়নের (homogenization) কথা উল্লেখ করা যায়। প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে পার্থক্যকে ‘অপরত্ব’ (Otherness) হিসেবে স্থায়ী তকমা দেওয়া হয়েছে। অথচ তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসে বিদ্যমান বিপুল সাংস্কৃতিক অসমসত্ত্বতাকে (cultural heterogeneity) ‘অভিজ্ঞতা’ নামক একক পরিচয়-চিহ্নের নিচে চাপা দেওয়া হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার দেশগুলি প্রায় দুশো বছর ধরে ঘনিষ্ঠভাবে বাস করে আসছে। এসব দেশে পুঁজিবাদ অনেক পুরনো চর্চা। শেষদিকের পুঁজিবাদের সাংস্কৃতিক যুক্তিবাদ এসব দেশের নগরকেন্দ্রিক শ্রেণিবিন্যাসে খুব পাকাপোক্তভাবে বিদ্যমান।  এখানে নিজেদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পণ্যের বিতরণ এতটাই তাৎক্ষণিক, ব্যাপক এবং প্রাণোচ্ছল যে, মনে করা স্বাভাবিক, তাদের মধ্যে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বতা বিরাজ করছে। কিন্তু এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায়? ঐতিহাসিকভাবে এসব মহাদেশের দেশগুলি কখনো এতটা সংস্কৃতি-ঘনিষ্ঠ ছিল না …।

অবশ্য বৈশ্বিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সদৃশ অবস্থানে থাকা দেশগুলিতে ব্যাপক সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য বিদ্যমান রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ইত্যাকার সাদৃশ্য পুঁজিবাদ-পূর্ব সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোগুলির মধ্যে বিরাজমান সাদৃশ্যসমূহের উত্তরাধিকার। এখানে আমার উদ্দেশ্য জেমসনের পর্যবেক্ষণকে ঘিরে কোনো ছাঁচ নির্মাণ (typology) নয়, বরং প্রাগ্রসর পুঁজিবাদী দেশগুলিতে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক সমসত্ত্বতার মাত্রা নিরূপণ এবং একই সঙ্গে পুঁজিবাদী বিশ্বের অন্যত্র সেই সমসত্ত্বতার অনুপস্থিতি নিরূপণের জন্যে একটি বস্তুগত ভিত্তি (material basis) নির্মাণই আমার লক্ষ্য। অতএব পটভূমির বিবেচনায় এটা দ্বিগুণ বিস্ময়কর যে, জেমসনের তত্ত্ব পার্থক্যের (Difference) ওপর প্রবল গুরুত্ব আরোপ করা ছাড়াও  প্রথম এবং তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে অপরত্বের (Otherness) সম্পর্কের ওপর জোর দিয়েছে। এই তত্ত্বের আরো জেদের জায়গা হলো : ‘তৃতীয় বিশ্বের’ সমুদয় ‘অভিজ্ঞতা’ নাকি একটিমাত্র বর্ণনামূলক আখ্যানে (single narrative term) ধারণ ও বিনিময় করা যায়। পুঁজিবাদকে প্রথম বিশ্বে এবং সমাজতন্ত্রকে দ্বিতীয় বিশ্বে স্থাপন করে, জেমসনীয় তত্ত্ব সেই বৈশ্বিক পরিসরকে অকার্যকর ও ইতিহাসচ্যুত করে দেয়,
যে-পরিসরে এই দুই প্রণোদনাদায়ী শক্তির মধ্যে বস্তুত সকল দ্বন্দ্ব-সংঘাত সংঘটিত হয়। প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধ-সূত্রে গাঁথা একটি মাত্র হেগেলীয় রূপকল্পের ভেতর আমাদের জীবনের বিপুল বৈচিত্র্য ও বহুমুখী সৃজনশীলতাকে আত্তীকৃত করে এই তত্ত্ব আমাদের একটি আদর্শ ছাঁচে (ideal type) পরিণত করে। এবং দাবি করে, আমরা সেই আদর্শ ছাঁচের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ কোনো আখ্যান বেছে নিয়ে যেন বয়ান করি। তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট অবধারিতভাবে হয় এটা, নয় ওটা। এমন বলা মানে, প্রকৃতপক্ষে এটা বলা যে, ওই সামাজিক পরিসর থেকে উদ্ভূত যে-টেক্সস্ট এটাও নয়, ওটাও নয়, সেটা ‘যথার্থ’ আখ্যান হতে পারে না। সর্বোপরি, প্রাগুক্ত অর্থেই প্রথমত ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’ নামক শ্রেণিবিভাজন, অতঃপর জাতীয় রূপককে  (Ônational allegoryÕ) তার গঠনপ্রকৃতি ও পার্থক্যসমেত অন্তস্থিত টেক্সট (meta text) হিসেবে উপস্থাপন করায় ‘তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্য’, জ্ঞানতত্ত্বীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তো বটেই, আমার বিবেচনায়ও, একটি অসম্ভব শ্রেণির সাহিত্য …।

এবং ইতিহাসের কোন পর্যায়ে এসে ‘উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতা’-জারিত একটি টেক্সট তৃতীয় বিশ্বের টেক্সট  (Thirld World text) হিসেবে বিবেচিত হবে?  এক ধরনের পঠন-পদ্ধতিতে, কেবল উপনিবেশবাদ পত্তনের পরে রচিত টেক্সটগুলিকে এ নামে আখ্যায়িত করা যেতে পারে। এর কারণ,  উপনিবেশবাদ/ সাম্রাজ্যবাদই তৃতীয় বিশ্ব সৃষ্টি করেছে। অথচ, জেমসন অনবরত ‘পশ্চিমের অপর’ (the West’s Other) শব্দবন্ধটি আউড়ে গেছেন; লু শুন (এশীয়) এবং সমবেনের (আফ্রিকীয়)১ টেক্সটের তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ঘুরেফিরে বর্গীয়/ শাখা শ্রেণি এবং এশীয় জীবনধারণ পদ্ধতির কথা টেনে এনেছেন; ফ্রয়েডের তত্ত্বকে ‘পশ্চিমা বা প্রথম বিশ্বের বিদ্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তার বিপরীতে লু শুনের টেক্সটগুলিতে দশ শতাব্দীপ্রাচীন  চৈনিক কাম-শক্তি-বিদ্যার প্রতিফলন দেখাতে চেয়েছেন। এসব ব্যাপক যুগান্তকারী ও
সভ্যতা-নির্ণায়ক শ্রেণিবিভাগ (broad epochal and civilizational categories) ব্যবহার করতে গিয়ে জেমসন আরো ইঙ্গিত করেছেন, প্রথম বিশ্ব এবং তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে পার্থক্য অতিপ্রাচীন এবং নানা কিছুর গভীরে প্রোথিত, যা পুঁজিবাদের চেয়ে ঢের বেশি পুরনো। সুতরাং প্রথম বিশ্বকে যদি ‘প্রতীচ্যের’ সমার্থক এবং ‘গ্রীক-ইহুদি বৈশিষ্ট্যসূচক’ (ÔGraeco-JudaicÕ) বিবেচনা করা হয়, এবং অন্যদিকে, ভগবত গীতা, মনুসংহিতা এবং কোরানকে ‘সম্ভবত’ তৃতীয় বিশ্বের টেক্সট ভাবা হয়, আতঙ্কিত না হয়ে পারা যায় না (যদিও কোরানে ইহুদি উপাদান সন্দেহাতীতভাবে বিদ্যমান, এবং বর্তমান পাকিস্তানের বহু প্রাচীন শিল্পে
গ্রীক-ভারতীয় প্রভাব সুস্পষ্ট)। 

কিন্তু তারপরও পরিসরের (Space) প্রশ্ন রয়েছে। ‘ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতা’-জারিত দেশগুলিতে লিখিত সব টেক্সটই কী, কেবলমাত্র ভৌগোলিক উৎসের কারণে, ‘তৃতীয় বিশ্বের টেক্সট’ হিসেবে বিবেচিত হবে? জেমসন এত ঘন ঘন ‘সব তৃতীয় বিশ্বের টেক্সট’-এর কথা বলেছেন এবং তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের একটি একক আখ্যান পদ্ধতির ওপর এত জোর দিয়েছেন যে, তাঁর কথা আক্ষরিক অর্থে মেনে না নিলে তাঁর ডিসকোর্সের শর্তাবলিকে অমান্য করা হয়। অথচ বিশ্বের আমাদের অংশে এমন অনেক টেক্সটের কথা জানা আছে যেগুলি তাঁর ‘জাতীয় রূপক’-এর বর্ণনার সঙ্গে মেলে না। আমরা বিস্মিত হই, কেন জেমসন একটি বিশেষ শ্রেণি – ‘সব’-এর ওপর এত জোর দিয়েছেন। অবশ্য, এই শ্রেণি ছাড়া তিনি তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের ওপর তত্ত্ব নির্মাণ করতে পারতেন না। তাহলে কী তিনি যা বলছেন, ঠিক তার বিপরীত কিছু বোঝাতে চাইছেন? তিনি বলছেন, এমন নয় যে, ‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সটকে জাতীয় রূপক হিসেবে … পড়তে হবে’। কেবল যেসব টেক্সট আমাদের জাতীয় রূপক উপহার দেয়, তৃতীয় বিশ্বের সাহিত্যের সেসব টেক্সটকে প্রামাণিক বলে গ্রাহ্য করা হবে। তাহলে সংজ্ঞা অনুসারে বাকিদের বাতিল করে দিতে হবে? আসলে নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই, আমরা কী তবে হেত্বাভাসের (fallacy) মুখোমুখি হলাম (‘তৃতীয় বিশ্বের সব টেক্সট হচ্ছে’ হয় এটা, নয় ওটা), নাকি পিতৃদেবের অনুশাসনের (Law of the Father)২ মুখোমুখি হলাম (আইনটা এমন : যদি আমার থিয়োরির অন্তর্গত হতে চাও, তোমাকে এটাই লিখতে হবে) …।

জেমসন বারংবার জোরালোভাবে বলতে চেয়েছেন, তৃতীয় বিশ্বের বুদ্ধিবৃত্তির জ্ঞানকেন্দ্রিক সংগঠন (cognitive formation of the Third World intellectual) তৈরির জন্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করে জাতীয় অভিজ্ঞতা, এবং সেই অভিজ্ঞতার বয়ান একান্তভাবেই ‘জাতীয় রূপক’-এর আদল গ্রহণ করে। ‘জাতি’ নামক শ্রেণির ওপর অতিগুরুত্ব আরোপ করে জেমসনীয় তত্ত্ব সংস্কৃতি, সমাজ, গোষ্ঠীবদ্ধতার মতো বৃহত্তর (much wider) কিন্তু অনেক কম সীমানা-নির্ধারিত শব্দভাণ্ডারের (much less demarcated vocabulary) ওপর পা হড়কে পড়েছে। ‘জাতি’ ও ‘গোষ্ঠীবদ্ধতা’ কি একই বস্তু? …

কেউ চাইলে শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতপাত, ধর্মীয় সম্প্রদায়, ট্রেড ইউনিয়ন,  রাজনৈতিক দল,  গ্রাম, জেলখানা ইত্যাদির আলোকে তার নিজের অভিজ্ঞতাকে ‘গোষ্ঠীবদ্ধতা’র সঙ্গে যুক্ত করতে পারেন। কেউ চাইলে তার ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাকে বিশেষ অর্থে রূপকাশ্রিত করতে পারেন, কিন্তু সেটা ‘জাতি’ পরিচয়জ্ঞাপক শ্রেণির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না হয়ে অথবা ‘উপনিবেশিকতা ও সাম্রাজ্যবাদের অভিজ্ঞতা’র প্রসঙ্গে ফিরে না গিয়েই করতে হবে। শেষোক্ত বাক্যাংশটি অনেক বেশি নির্ভুলতাসমেত বিপুলসংখ্যক টেক্সটের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু একইভাবে, ‘গোষ্ঠীবদ্ধতা’র ক্ষেত্রে তথাকথিত প্রথম এবং তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে খুব একটা মৌলিক পার্থক্য নেই। এর কারণ, ইউরোপীয় উপন্যাসের বাস্তবতার ইতিহাস, নানা রকমফের থাকা সত্ত্বেও, ‘বৈশিষ্ট্যসূচকতা’ (‘typicality’) ও ‘সমাজমনস্কতা’র (‘the Social’) ধারণার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এমনকি আজকের দিনেও, প্রথম বিশ্বে রচিত অধিকাংশ আখ্যানই কোনো বৃহত্তর অভিজ্ঞতার সঙ্গে ব্যক্তির মৌলিক বয়ানের রসায়নের কথাই তুলে ধরেছে।

আমরা যদি ‘জাতি’ ধারণাটিকে আরো বড় অথচ আরো কম নিয়ন্ত্রিত ‘গোষ্ঠীবদ্ধতা’র ধারণা দিয়ে প্রতিস্থাপিত করি, এবং আমরা যদি রূপকের প্রক্রিয়াকে জাতীয়তাবাদের চিন্তাসূত্র থেকে না দেখে, শুধু ব্যক্তিগত এবং সর্বজনীন, ব্যক্তিক এবং সামাজিক সম্পর্কের দৃষ্টি থেকে দেখি, তখন এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, রূপককরণ (allegorization) কেবল তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

(বিল অ্যাশক্রফট প্রমুখ সম্পাদিত The Post-Colonial Studies Reader তৃতীয় সংস্করণের সংক্ষেপিত মূল থেকে)

অনুবাদকের টীকা

১. (Lu Xun) লু শুন চীনা লেখক,  সাহিত্য সমালোচক ও শিক্ষক।

(Ousmane Sembene) উসমান সমবেন সেনেগালের চিত্রপরিচালক ও লেখক। তাঁকে আফ্রিকান চলচ্চিত্রের জনক বলা হয়।

২. এখানে উদ্ধৃতিটিতে আইজাজ আহমদ সম্ভবত ফ্রয়েডের বিখ্যাত Letter to Flies- এ বর্ণিত খধি Law of the
Father-এর ‘ঈডিপাস কমপ্লেক্স’-এর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। এই মনোজটিলতায় পিতা পুত্রসন্তানকে তার অবচেতন মনে মায়ের প্রতি কামার্ত হতে নিষেধ করেছেন।