পনেরো মাসের ব্যবধানে ভ্রমণের
জগতে পরিবর্তন
চোদ্দই মার্চ ২০২০-এর পর সাতাশে জুন ২০২১। পনেরো মাসের বেশি সময় পর জেনেভা এয়ারপোর্টে পা দিলাম। স্বাভাবিক সময়ে অনেকবার
যাওয়া-আসা হয় সেখানে – কখনো নিজেদের যাতায়াতের জন্য, কখনো কেউ আসবে বলে অথবা কাউকে বিদায় দিতে; কিন্তু যে-সময়ের কথা বলছি সেটি সারাবিশ্বের জন্য অস্বাভাবিক এক সময়। আমার জীবনের পছন্দের জিনিসগুলোর মধ্যে যেটি ওপরের দিকে তা হলো ভ্রমণ; আর তাকেই বাদ দিতে হয়েছে জীবন থেকে। হারিয়ে যাওয়া প্রিয় জিনিস ফিরে পাওয়া গেল পনেরো মাস পর।
কিন্তু এই সময়ে পৃথিবী বদলে গেছে অনেক। বদল হয়েছে আমার অনেক পরিচিত জেনেভা এয়ারপোর্টেও। যে-সময় থাকার কথা অনেক ফ্লাইট, ডিপারচার লাউঞ্জ গমগম করত যাত্রীর ভিড়ে, সে-সময় বেশির ভাগ চেক-ইন কাউন্টারই খালি (মানে ফ্লাইট নেই)। এক কোণে সস্তার এয়ারলাইন ইজিজেটের এলাকা। তাদের কিছু ফ্লাইট যায় এখানে-সেখানে। আমাদের – মানে আমার এবং আমার স্ত্রীর – গন্তব্য তেমনই এক জায়গা, স্পেনের সেবিয়া। স্প্যানিশ ভাষায় লেখা হয় Sevilla, কিন্তু উচ্চারিত হয় ‘সেবিয়া’ (আসলে ‘ব’ এবং ‘ভ’-এর মাঝামঝি একটা আওয়াজ)।
পর্যটকদের কাছে সেবিয়া একটি পরিচিত এবং প্রিয় নাম; কিন্তু আমার যাওয়ার তালিকায় এই নাম সবার ওপরে ছিল না। তবে কেন পনেরো মাস পরে প্রথম ভ্রমণ সেখানে? তার পেছনেও কোভিড-১৯ অতিমারি। ২০২০-এর মার্চে এই মহামারি যখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল তখন ইউরোপ থেকে যাত্রীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলো আমেরিকা। তার কিছুদিন পর ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আমেরিকা থেকে যাত্রীদের প্রবেশ নিষেধ করে দিলো। এভাবে আটলান্টিকের দুই পাড়ের মানুষের মুখ-দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে ভুক্তভোগী আমাদের মতো পরিবারগুলো – যাদের কারো পাসপোর্ট ইউরোপিয়ান আর কারো আমেরিকান। আমরা যেতে পারছি না আমেরিকা – যেখানে থাকে আমাদের ছেলেমেয়ে-নাতি-নাতনি, আর ওরা পারছে না আমাদের এখানে আসতে। জুনের শেষের দিকে ইউরোপের কোনো কোনো দেশ সে-নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করেছিল। আর তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল স্পেন। সে-সুযোগে আমাদের মেয়ে বলল, আমরা যাই স্পেন, তোমরাও এসে যাও সেখানে; অন্তত কয়েকটা দিনের জন্য আমরা তোমাদের দেখতে পাব আর তোমরাও আমাদের। সেভাবেই স্পেন।
স্পেনের দক্ষিণ অংশে আন্দালুসিয়া অঞ্চল। সেখানেই মালাগার রোদেলা সৈকত এবং গ্রানাডা ও কর্ডোবার মতো মুসলিম ঐতিহ্যের স্থান। মালাগা এবং গ্রানাডা আমাদের দেখা হয়ে গেছে আগেই। সে-কারণেই এবার নির্বাচিত হলো সেবিয়া। সেখান থেকে কর্ডোবা গিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসা যায়। সমুদ্রও খুব দূরে নয় – দু-ঘণ্টার ড্রাইভ।
করোনার আগে টিকিট আর পাসপোর্ট হলে আর সঙ্গে কিছু টাকা বা একটি ক্রেডিট কার্ড থাকলেই বেরিয়ে পড়া যেত; কিন্তু এবার দেখলাম বিষয়টা এত সরল আর নেই। অনলাইন টিকিট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকল নানা ধরনের পরামর্শ এবং নির্দেশ। সেগুলোর কোনো কোনোটা এতই লম্বা এবং বিরক্তিকর যে একেক বার মনে হচ্ছিল, ‘দুত্তোর ছাই’ বলে ছেড়ে দিই; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়ে, মেয়েজামাই ও নাতনির মুখ, আর তার সঙ্গে ফাউ হিসেবে সেবিয়া-কর্ডোবা-আটলান্টিক। ওদিক থেকে মেয়ে আমাকে সাহস দিয়ে যাচ্ছে, আব্বু এভাবে করো, ওভাবে করো, এত জটিল কিছু নয়। শেষমেশ দেখলাম, বিষয়টা এত জটিল ছিল না, যতটা প্রথমে মনে হয়েছিল; বিশেষ করে আমরা দুজনেই পূর্ণ ডোজ টিকাপ্রাপ্ত ছিলাম বলে। এর মধ্যে পেয়ে গিয়েছিলাম সুইস প্রশাসনের ইলেকট্রনিক কোভিড-১৯ সার্টিফিকেট, যা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সব দেশে স্বীকৃত। স্পেন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রয়োজনীয় ফরম পূরণ করা হলো আর তার সঙ্গে দেওয়া হলো সেই সার্টিফিকেট। সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল ভ্রমণের অনুমোদন।
স্বাস্থ্যবিধি এবং সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট
আমার জন্য এর পরের চ্যালেঞ্জ যাত্রার পুরো সময় মাস্ক দিয়ে মুখ ঢেকে রাখা। স্বাস্থ্যবিধির এই অংশটি পালন আমার জন্য একটা শাস্তি। একনাগাড়ে এক থেকে দেড় ঘণ্টার বেশি আমি কখনো এটা পরে থাকিনি। আর সেবিয়ার জন্য উড়ানকালই প্রায় সোয়া দুই ঘণ্টা; তার সঙ্গে যোগ করতে হবে এই প্রান্তে ট্যাক্সিতে ওঠা থেকে শুরু করে ওই প্রান্তে হোটেলের ঘরে পৌঁছা পর্যন্ত সময়। পরে দেখেছি মোট সময় ছিল পাঁচ ঘণ্টারও বেশি। এই পরীক্ষায় পাশ করেছি ঠিকই; তবে একটু চাতুরীর আশ্রয় যে নিইনি সেটা জোর দিয়ে বলতে পারব না। জেনেভা এয়ারপোর্টে ডিপারচার এলাকায় গিয়েই কফি আর ক্রোয়াসঁ কিনে বসলাম এবং যতক্ষণ পারা যায় কফির কাপটি মুখের সামনে ধরে রাখলাম।
প্লেনে উঠে একটু ভড়কেই গেলাম। সংবাদমাধ্যম থেকে অবশ্য আগেই জেনেছিলাম যে, এয়ারলাইনগুলো প্রথমে কিছুদিন মাঝখানের সিট খালি রাখার কথা বললেও সেসব কখনোই মানেনি; কিন্তু এত লোক যে ভ্রমণে উৎসাহী আর প্রতিটি সিট ভর্তি হয়ে যাবে তা ভাবিনি। সে যাই হোক, মনে মনে ভাবলাম, আমার শরীরে ঢুকেছে ফাইজারের টিকা; সে কি আমাকে রক্ষা করবে না! ফাইজার এবং আল্লাহ ভরসা বলে কাটিয়ে দিলাম ফ্লাইটের সময়টা।
ছোট আকারের এয়ারপোর্ট সেবিয়া। ইউরোপের অন্যান্য এয়ারপোর্টের মতো চাকচিক্য নেই; অনেকটা দরিদ্র আত্মীয়ের মতো চেহারা। তবে আমাদের জন্য যেটা গুরুত্বপূর্ণ – লাগেজ দ্রুত ডেলিভারি, অল্প সময়ে ট্যাক্সি পেয়ে যাওয়া – সেগুলোতে ভালো নম্বরই পেয়েছিল সেবিয়ার এয়ারপোর্ট।
আমরা হোটেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম দশটার আগেই; কিন্তু ঘর পাওয়ার কথা দুটোয়। সুতরাং লাগেজ রিসেপশনে রেখে রেস্তোরাঁতে চলে গেলাম ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য। আমাদের হোটেলটি পুরনো ধরনের এক বিল্ডিংয়ে, যার ডিজাইনে দেখা গেল উত্তর আফ্রিকার মুসলিম স্থাপত্যের প্রভাব। কয়েকটি ঘরের মাঝখানে একটি করে আঙিনা। রেস্তোরাঁর পাশেই সেরকম একটি আঙিনা, যেখানে কয়েকটি টেবিল খাওয়ার জন্য তৈরি করা ছিল। ঘরের ভেতরে না বসে আমরা আঙিনাতে একটি টেবিল নিয়ে বসলাম; কিন্তু বুফেতে খাবার সার্ভ করা ছিল ভেতরে। সেখানে যেতে হলে প্রথমেই মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি – স্যানিটাইজার লাগিয়ে হাত পরিষ্কার করো, মাস্ক দিয়ে মুখ ঢাকো। আর ভেতরে বসলে খাওয়ার সময় বাদে বাকি সময় মাস্ক লাগিয়ে রাখতে হবে। এক ভদ্রলোক ভেতরের টেবিলে বসে খাচ্ছিলেন। বুফে থেকে কিছু একটা নেওয়ার জন্য উঠেছেন; কিন্তু মাস্কটা লাগাতে হয়তো ভুলে গিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে এক ওয়েট্রেস এসে বিনীতভাবে তাঁকে অনুরোধ করলো মাস্কটা পরে নেওয়ার জন্য।
তবে নিয়ম কড়া হলেও মানুষ নিজেরা সাবধান না হলে সংক্রমণ ছড়াতেই পারে। তার উদাহরণ পেলাম বিকেলেই। আমাদের ঘর থেকেই হই-হট্টগোল শুনে আমি বের হলাম। ওপরের বারান্দা থেকেই দেখলাম একটি খোলা লাউঞ্জে কিছু লোক জড়ো হয়ে টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখছে। একটু উৎসুক হয়ে নিচে নেমে গেলাম। সেদিন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের খেলা হচ্ছিল স্পেন আর ক্রোয়েশিয়ার মধ্যে। ফুটবলপাগল লোকেরা সে-খেলা দেখার জন্য টিভির সামনে ভিড় করবে, সেটাই স্বাভাবিক। তবে তাদের অনেকেই মাস্ক পরেনি এবং টিভির সামনে বসে উঁচু স্বরে কথা বলছিল বা চিৎকার করছিল। আদর্শ সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট। আমি তো অবাক এবং কিছুটা শঙ্কিতও। তাড়াতাড়ি সরে পড়লাম সেখান থেকে। খেলায় অবশ্য স্পেন জিতেছিল।
সেবিয়ার পুরনো শহর
আগেই জেনেছিলাম সেবিয়ার পুরনো শহরটি অনেক বড় আর খুবই সুন্দর। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের পুরনো শহর আমাদের দেখার সুযোগ হয়েছে বলে কিছু ধারণা ছিল কেমন হয় সেগুলো। সরু (এবং অনেক ক্ষেত্রে পাথরে বাঁধানো) রাস্তা, সুন্দর স্থাপত্যে গড়া পুরনো দালানকোঠা, ছোট ছোট দোকান এবং রেস্তোরাঁ – সবমিলিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য চমৎকার। মেয়ে (শমী) এবং মেয়েজামাইয়ের (ফারাজ) ওপর দায়িত্ব ছিল হোটেল বুক করার। ওদের বলে দিয়েছিলাম, এবার আমরা পুরনো শহরের মধ্যেই থাকতে চাই, যেন সব জায়গায় হেঁটে বেড়ানো যায়। সেভাবেই হোটেল নির্বাচিত হয়েছিল; কিন্তু আমরা আগেই জানতাম যে, ঘর পাওয়া যাবে বেলা দুটোয়। চেক-ইনের সময়ও রিসেপশনের মেয়েটি বিনীতভাবে বলে দিয়েছিল যে, দুটোর আগে ঘর পাওয়া যাবে না।
তবে আনন্দের ব্যাপার ঘটলো ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেই – শমী, ফারাজ এবং ওদের মেয়ে আয়লার প্রবেশ। আমাদের ফ্লাইটের সঙ্গে সময় মিলিয়ে ওরাও মাদ্রিদ থেকে সকালের ট্রেনে এসে গিয়েছে। প্রায় উনিশ মাস পর দেখলাম ওদের। প্রাথমিক আনন্দ-উচ্ছ্বাসের পর ওরাও ব্রেকফাস্টে বসলো এবং তারপরই আমরা বেরিয়ে পড়লাম একটু ঘুরে আসার জন্য।
সাম্প্রতিক সময়ে যখনই আমরা ছেলেমেয়েদের কারো সঙ্গে বেড়াতে বের হই তখন ওদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যাই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভূমিকায় কী পরিবর্তন ঘটেছে তা ভেবে মনে মনে এক ধরনের আনন্দ বোধ করি। একটা সময় ছিল যখন আমাকেই প্ল্যান করা থেকে শুরু করে সবকিছু করতে হতো। আর এখন ওরাই সবকিছু ঠিক করে, অবশ্য আমাদের কাছ থেকে জেনে নেয় কোনো মন্তব্য বা আপত্তি আছে কি না। আর আমি শুধু জেনে নিই কখন বের হবো। বের হয়ে ওদের সঙ্গে সঙ্গে যাই।
হোটেল থেকে বের হয়েই বুঝতে পারলাম, শমী এবং ফারাজ দুজনেই যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে এসেছে; কোন দিকে গেলে মিউজিয়াম, ক্যাথিড্রাল, ভালো ক্যাফে-রেস্তোরাঁ ইত্যাদি সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা দুজনেরই। শমী ওর সেলফোনে গুগল ম্যাপ খুলে নেয় আর সেটা দেখে হাঁটতে শুরু করে। আমার তখন মনে পড়ে যায় আগের দিনের কথা, যখন আমি ভাঁজ করে রাখা কাগজের ম্যাপে রাস্তা দেখে নিতাম। লন্ডন শহরের জন্য ছিল A to Z London নামে রীতিমতো একটি বই, যেটা ছিল আমার লন্ডনের জীবনের নিত্যসঙ্গী। এখন আমিও গুগল ম্যাপ ব্যবহার করি; কিন্তু এই ট্রিপে আমার ফোন পকেট থেকে বের করেছি শুধু ছবি তোলার জন্য।
আসলে হাতে ম্যাপ না থাকলে কোনো বাইরের লোকের পক্ষে সেবিয়ার পুরনো শহরে ঠিক রাস্তা ধরে গিয়ে কোনো গন্তব্যস্থান বের করা প্রায় অসম্ভব, কারণ প্রায় সব রাস্তাই ঘোরানো-প্যাঁচানো। বেশির ভাগ রাস্তাই এত সরু যে কোনোরকমে একটি ছোট গাড়ি যেতে পারে, আর তার দু-ধারে (কোনো কোনো জায়গায় একপাশে) এক ফুট বা দুই ফুটের মতো মানুষের হাঁটার জায়গা। এরকম রাস্তায় দুজন পাশাপাশি যাওয়া অথবা দুদিক থেকে দুজন আসা-যাওয়া করা অসম্ভব। তখন একজন দেখেশুনে রাস্তায় নেমে পড়ে – বিশেষ করে করোনার কালে সবাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছিল। তবে একটু স্বস্তির ব্যাপার এই ছিল যে, প্রায় সকলেই মাস্ক পরে হাঁটছিল।
প্রথম দিন সকালে হাঁটতে বের হয়েই আমি সেবিয়ার পুরনো শহরের প্রেমে পড়ে যাই। সরু হলেও গলিগুলো খুব ছিমছাম। হাঁটতে হাঁটতে কেউ ক্লান্ত হয়ে গেলে মাঝে মাঝেই পেয়ে যাবে এক চত্বর, যেখানে বিভিন্ন দিক থেকে গলি এসে মেশে। জায়গার পরিমাণ অনুযায়ী সেখানে থাকে দু-একটি গাড়ি থামার জায়গা, দু-একটি ক্যাফে-রেস্তোরাঁ এবং ছোট দু-একটি দোকান। এরকম একটি ক্যাফেতে একবার কফি খেয়ে সবাই চাঙ্গা হয়ে নিলাম। খুব পুরনো ধরনের ক্যাফে। কফি এলো গ্লাসে যা দেখে ষাটের দশকের ঢাকার হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরিতে তৈরি গ্লাসের কথা মনে পড়ে গেল। আমার ছোটবেলায় ঢাকায় পথের ধারের অনেক চায়ের দোকানে কাচের গ্লাসে চা দেওয়া হতো।
গলিগুলোর দুপাশে দালান উঠে গিয়েছে তিন-চারতলা। কোনোটির সামনের দরজা খোলা থাকলে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে আমি দেখে নিই তার ধরন। স্থাপত্যের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, ঢোকার পর মাঝখানে একটি আঙিনা আর তার চারপাশে ঘর। মার্বেলের ব্যবহার বেশ; ডিজাইনে মুসলিম স্থাপত্যের ছাপ স্পষ্ট। কোনো কোনোটির আঙিনা এত সুন্দর যে ঢুকে পড়তে ইচ্ছে করে।
প্রথম দিনই আর একটি বিষয় নজরে পড়ল : পুরনো সেবিয়ার পাড়ায় পাড়ায় গির্জা – বিভিন্ন আয়তনের এবং ডিজাইনের। তাদের স্থাপত্যের কোথাও না কোথাও দেখা যায় ইসলামি স্থাপত্যের কিছু বৈশিষ্ট্য। প্রায় সবই দৃষ্টিনন্দন। আমাদের হোটেলের কাছেই দেখলাম দুই টাওয়ারের অতি সুন্দর কারুকাজ করা একটি চার্চ। অনেকবার তার পাশ দিয়ে গেলেও কখনো কাউকে সেখানে ঢুকতে দেখিনি; সবসময়ই দরজা বন্ধ। একদিন রাতে ডিনারের পর ফিরে আসার সময় চাঁদের আলোতে দেখলাম তার রূপ – অপূর্ব ছিল সে-দৃশ্য।
স্পেনে মুসলিম ঐতিহ্য
কলেজের (অর্থাৎ উচ্চ মাধ্যমিকের) বাংলা বইয়ে ‘স্পেনে মুসলিম সভ্যতা’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ ছিল, যা থেকে জেনেছিলাম, মুসলমানরা কয়েকশো বছর স্পেন শাসন করেছিল; কিন্তু সেই লেখাটির বিশেষ কিছু মনে রাখতে পারিনি। এবার সেবিয়া যাওয়ার আগে একটু হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে অনেক চমকপ্রদ তথ্য পেলাম। আইবেরিয়ান উপদ্বীপে, বিশেষ করে স্পেনের আন্দালুসিয়া অঞ্চলে মুসলমানদের শাসনকাল অষ্টম শতাব্দীর গোড়া থেকে শুরু হয়ে প্রায় সাতশো বছর স্থায়ী হয়। সে-অঞ্চলে কর্ডোবা এবং গ্রানাডাসহ বিভিন্ন শহরে তাঁরা রেখে গিয়েছেন মুসলিম সভ্যতার বিভিন্ন নিদর্শন।
সেবিয়ার প্রধান ক্যাথিড্রাল এবং তার সঙ্গের জিরাল্ডা (স্প্যানিশ ভাষায় উচ্চারিত হয় ‘হিরাল্ডা’) টাওয়ারেরও রয়েছে উল্লেখ করার মতো ইতিহাস। এর শুরু হয় মসজিদ হিসেবে; কিন্তু পঞ্চদশ শতকে মুসলমানরা পরাজিত হওয়ার পর মসজিদটিকে ক্যাথিড্রালে রূপান্তরিত করা হয়। তার মিনারকে রূপ দেওয়া হয় বেল টাওয়ারে। এত বছর বিভিন্ন ঝড়-ঝাপটা সত্ত্বেও মিনারটি তার আদি রূপ হারায়নি। আর একটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, তাতে ওপরে ওঠার জন্য সিঁড়ির বদলে দেওয়া হয়েছে ঢালু পথ। এর একাধিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। কেউ বলে, মসজিদ বানানোর সময় মালপত্র ওপরে ওঠানোর একমাত্র উপায় ছিল ঘোড়ার গাড়ি। সুতরাং সিঁড়ির বদলে ঢালু পথ বানানো ছাড়া উপায় ছিল না। অন্য এক মতে, প্রতিবার আজান দেওয়ার জন্য মুয়াজ্জিনকে যেন সিঁড়ি ভেঙে না উঠতে হয়, তিনি যেন ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারেন সে-লক্ষ্যেই এ-ব্যবস্থা। এই মিনারের উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিনশো ফুট।
করোনার কারণে সে-সময় একসঙ্গে সীমিতসংখ্যক লোককে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল; কিন্তু আমাদের ভাগ্য ভালো ছিল বলতে হবে, কারণ বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করেই আমরা টিকিট পেয়ে গিয়েছিলাম। তাছাড়া সিনিয়র হিসেবে মূল্যছাড়ও পেলাম। তবে ভেতরে গিয়ে দেখলাম, সিনিয়রদের মিনারের ওপরে যাওয়া নিষেধ – যদিও সেটা মান্য করানোর জন্য কেউ ওখানে ছিল না। মনে হলো, এটি একটি পরামর্শ। সুতরাং আমার স্ত্রী এবং আমি দুজনেই সাহস করে উঠতে লাগলাম; কিন্তু শখানেক ফুট ওঠার পর মনে হলো, এতটা দুঃসাহস করা বোধ হয় ঠিক নয়। ফিরে গেলাম নিচে। তবে টাওয়ারের বিভিন্ন জায়গাতে রয়েছে ছোট জানালা, যা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যায় এবং শহরের একটা দিকের ‘পাখির চোখে দেখা’ দৃশ্য দেখতে পারলাম।
আয়তনে সেবিয়ার ক্যাথিড্রালটি বিশাল, একমাত্র ইস্তাম্বুলের হাজিয়া সোফিয়াই নাকি এর চাইতে বড়। তবে হাজিয়া এখন আর ক্যাথিড্রাল নয়; অনেক বছর শুধু দর্শনীয় স্থান হিসেবে রাখার পর ইস্তাম্বুল সরকার সম্প্রতি তাকে আবার মসজিদ হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। গোথিক স্থাপত্যশৈলী ব্যবহার করে নির্মিত সেবিয়ার এই ক্যাথিড্রাল; এর বিশালত্ব, গাম্ভীর্য এবং দেয়ালের কারুকাজ দেখে চমৎকৃত না হয়ে পারা যায় না। তার এক জায়গায় রয়েছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের সমাধি। কয়েকজন সুঠামদেহী পুরুষ তাঁর শবাধার বহন করছে – এরকম একটি স্থাপনা সমাধির ওপর তৈরি করে মানুষটিকে মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে বলে মনে হলো।
ক্যাথিড্রাল দেখতে দেখতে লাঞ্চের সময় পেরিয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া সেদিন বেশ গরম পড়েছিল। তাই আমরা খাওয়ার পর হোটেলে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম, যদিও সেবিয়ার আরেকটি দর্শনীয় স্থান ‘আলকাজাবা’ তার পাশেই। পরদিন সকালে গেলাম সেখানে।
আলকাজাবা শব্দটি এসেছে আরবি শব্দ ‘আল-কাসবা’ (যার অর্থ দুর্গ) থেকে। মধ্যযুগে স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্গের মতো করে নির্মিত হয়েছিল কোনো কোনো শহর; সেগুলোকেই এই নামে ডাকা হয়। দক্ষিণ সৈকতের মালাগায়ও রয়েছে সেরকম একটি দুর্গশহর, যা আগে দেখেছি। সেটি ছিল পুরনো শহরের এক প্রান্তে – ছোটখাটো একটি শহর বা দুর্গের মতো। সেবিয়ার আলকাজাবা অবশ্য এত বড় এলাকা জুড়ে নির্মিত হয়নি; কিন্তু প্রাসাদ হিসেবে এটি অনেক বড় বলে মনে হলো। ঘরের পর ঘর – প্রতিটিতেই তৎকালীন ঐশ্বর্যের ছাপ। আর গল্পও প্রায় একই ধরনের; প্রথমে নির্মিত হয়েছিল মুসলিম শাসকদের আমলে এবং তারা পরাজিত হওয়ার পর বিজয়ী শক্তি তাদের নিজেদের মতো করে গড়েছে এই প্রাসাদ। মূল দালানের পেছনে বিশাল বাগান, জলাধার, ফোয়ারা ইত্যাদি।
স্পেনে মুসলিম শাসনামলে অন্য যে-শহরটি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল সেটি কর্ডোবা। অনেকদিন থেকেই সেখানে যাওয়ার একটি ইচ্ছা মনে ছিল; এবার সে-ইচ্ছা পূরণের সুযোগ এলো। সেবিয়া থেকে কর্ডোবা ট্রেনে যাওয়া যায়, মাত্র ঘণ্টাখানেকের পথ। অন্যদিনের তুলনায় একটু সকাল সকাল উঠে ব্রেকফাস্ট সারতে হলো, কারণ আমরা দশটার ট্রেন নেওয়ার প্ল্যান করেছি। সেবিয়ার রেলস্টেশনে, বিশেষ করে ট্রেনে বেশ ভিড় ছিল। তবে স্বস্তির ব্যাপার ছিল এই যে, সকলের মুখই ছিল মাস্কে ঢাকা। তা না হলে আমার মনে হতো, এই দেশে কি কখনো কোভিড মহামারি হয়েছিল!
কর্ডোবা রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে ফারাজ ফোন বের করে গুগল ম্যাপ দেখে হাঁটতে শুরু করলো। আমাদের জিজ্ঞেস করলো আমরা মিনিট পনেরো হাঁটতে পারবো, নাকি ট্যাক্সি নিতে হবে। আমরা সবাই হাঁটার পক্ষে রায় দিলাম। একটি পার্কের মধ্য দিয়ে ছায়াঘেরা সুন্দর পথ। মাঝখানে একটি ক্যাফেতে বসে কফি খেয়ে সবাই চাঙ্গা হয়ে নিলাম।
যে-রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম সেটি ছিল আর দশটা শহরের মতোই; কিন্তু তার শেষ মাথায় বাঁদিকে মোড় নিতেই চোখে পড়ল উঁচু পুরনো ধরনের দেয়াল আর তার মাঝখানে বিশাল প্রবেশপথ। ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারলাম যে, একটি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের জায়গায় এসে পড়েছি। এতক্ষণ ছিলাম বিংশ বা একবিংশ শতকে, আর এখন হঠাৎ করেই ফিরে গিয়েছি মধ্যযুগে। সেবিয়ার পুরনো শহরের মতোই সরু সরু গলি আর তাদের দুপাশে রাস্তার ওপর বাড়ি বা দোকান। আমাদের গন্তব্য কর্ডোবার ঐতিহাসিক মসজিদ, যার বর্তমান সরকারি পরিচয় ‘ক্যাথিড্রাল-কাম-মস্ক’।
যেতে যেতে হঠাৎ পেছন থেকে এলো ঘোড়ার খুরের আওয়াজ। মনে হয় এক মুহূর্তের জন্য আমি বর্তমানকে ভুলে গিয়েছিলাম। মনে হলো, আমি কি মধ্যযুগের এক পথচারী, আর আমার পেছনে কেউ আসছে ঘোড়ায় চড়ে! হয়তো সে কোনো রাজকর্মচারী। এক্ষুনি দেবে কোনো ঘোষণা। এর মধ্যে খুরের আওয়াজ আরো কাছে এসে গেল এবং আমি স্বাভাবিকভাবেই পেছনের দিকে ফিরে তাকালাম। ঘোড়ার খুরের আওয়াজই ছিল সেটা; তবে সেই ঘোড়ার গাড়িতে সওয়ারি দেখে আন্দাজ করলাম এটি টুরিস্টদের শহর ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। তবে রাস্তা এতই সরু ছিল যে, পথ ছেড়ে একপাশে দেয়ালের গা-ঘেঁষে কোনোমতে দাঁড়াতে হলো।
আমাদের গন্তব্যে পৌঁছতে সময় বেশি লাগলো না। পৌঁছে বুঝলাম যে, আমরা একটু সৌভাগ্যবান, কারণ দুপুরের একটা সময় ক্যাথিড্রাল বন্ধ করে দেয়া হয় দু-ঘণ্টার জন্য। এখানে উল্লেখ করা উচিত, স্পেনের লোকদের দিবানিদ্রার কথা জগদ্বিখ্যাত। অনেক জায়গায়ই দুপুরে বেশ লম্বা সময়ের জন্য সবকিছু বন্ধ থাকে। কর্ডোবার শপিং এলাকা দিয়ে হাঁটার সময় দেখেছিলাম অনেক দোকানেই সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জানানো আছে দুপুরের কোন সময়ে বন্ধ থাকবে।
টিকিট কিনে ক্যাথিড্রালে ঢুকে একটু অবাক হলাম। মনে হলো, বিশাল একটা মসজিদে ঢুকে গিয়েছি; কিন্তু নামাজের সময় নয় বলে খালি। সারি সারি স্তম্ভের ওপর উজ্জ্বল রঙের খিলান আর মার্বেল পাথরে বাঁধানো মেঝে; শুধু জায়নামাজ বা কার্পেট নেই। পুরোটা হেঁটে দেখতে দেখতে ভাবছিলাম কত স্কয়ার মিটার হবে এর এলাকা, কত মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তো এখানে! হয়তো ইন্টারনেট ঘাঁটলে এসব প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু খালি চোখে আমার মনে হলো, মক্কা এবং মদিনার প্রধান দুটি মসজিদ বাদে এত বড় মসজিদ আমি আর কোথাও দেখিনি। ইস্তাম্বুলের ব্লু মস্ক আয়তনে বেশ বড় এবং খুবই সুন্দর; কিন্তু এত বড় কি?
পরিসংখ্যান যাই হোক, এখন কর্ডোবার সে-মসজিদ একটি ক্যাথলিক চার্চ। হেঁটে মসজিদের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে দেখলাম, স্থাপনাটির চেহারা বদলে গেল এবং একটি অংশ সম্পূর্ণ গির্জার কায়দায় তৈরি। কিন্তু তার সঙ্গে মিশে গিয়েছে আগেকার মসজিদের কিছু অংশ। এমনকি কোনো কোনো দেয়ালে এবং খিলানে আরবি হরফে কিছু লেখাও দেখা যাচ্ছে (যদিও অস্পষ্টতার কারণে ভালোভাবে পড়তে পারিনি এবং বুঝতে পারিনি সেগুলো কুরআনের আয়াত কি না)।
কর্ডোবার এই মসজিদ-গির্জার ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানকার কাহিনিও এ-ধরনের অন্যান্য স্থাপনার মতোই। বিজয়ী শক্তি বিজিতের উপাসনার স্থানকেই রূপান্তরিত করে নিজের ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। আবার এই বিজয়ী শক্তি যখন পরাজিত হয় তখন আগেকার কাহিনিরই পুনরাবৃত্তি ঘটে। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে কর্ডোবার মসজিদের জায়গায় ছিল একটি গির্জা; কিন্তু অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে তখনকার শাসক প্রথম আবদুর রহমানের নির্দেশে সেখানে মসজিদ তৈরির কাজ শুরু হয়। তবে এখানে একটি ব্যতিক্রম দেখা যায়। পঞ্চদশ শতকে মুসলমানরা পরাজিত হওয়ার পর সেখানে গির্জা পুনঃস্থাপিত হলেও মসজিদটির বিশাল অংশই তার আদি রূপে রয়ে গিয়েছে।
তাপা, পায়েয়া আর সাড়ে তিনশো বছরের রেস্তোরাঁ
স্পেনে গেলে তাপা (স্প্যানিশ ভাষায় লেখে tapas, কিন্তু উচ্চারণ করে তাপা) আর পায়েয়া তো খেতেই হবে। তবে কোথায় ভালো মানের খাবার পাওয়া যাবে সে-ব্যাপারে শমী, ফারাজ দুজনেই সতর্ক এবং হোমওয়ার্ক করে এসেছে, তা বোঝা গেল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক সময়ই দেখতাম সামনে মোটামুটি ভালো দেখতে রেস্তোরাঁতে না ঢুকে ওদের লিস্টে আছে এমন রেস্তোরাঁর জন্য আরো একটু হাঁটতে।
প্রথমদিন ডিনারের সময়ই দেখলাম সেটা। তবে শেষ পর্যন্ত খুব সুন্দর জায়গায় (একটা ছোট্ট পার্কের পাশে) একটা ভালো রেস্তোরাঁতেই আমরা গিয়েছিলাম।
ইউরোপের অনেক শহরেই রেস্তোরাঁয় ঢোকার দরজার পাশে টানানো থাকে মূল্যসহ খাবারের মেন্যু; সুতরাং কী খাবার সেখানে পাওয়া যাচ্ছে সেটা যেমন জানা যায়, তেমনি জানা যায় তাদের দামের সঙ্গে আমার পকেটের সামঞ্জস্য আছে কি না। সব রেস্তোরাঁতেই আমরা আগে মেন্যু দেখে ঠিক করি সেখানে বসবো কি না। গ্রীষ্মকালে মূল রেস্তোরাঁর বাইরে ফুটপাতে অথবা সামনের চত্বরে চেয়ার-টেবিল সাজিয়ে ব্যবস্থা করা হয় খাওয়ার। তাছাড়া এবার করোনার কারণে বাইরে বসার ব্যবস্থা আরো বেশি এবং তার চাহিদাও বেশি।
তাপা আসলে এক ধরনের ছোট ডিশ যাতে মাছ, মাংস বা সবজির বিভিন্ন পদ থাকে। কোনো কোনোটি দেখতে আমাদের কাবাব বা চপের মতো, আবার কোনোটি আমাদের পুলি পিঠার মতো। আর পায়েয়া হচ্ছে ভাতের সঙ্গে অর্ডার মতো মাংস, সবজি বা সি ফুড মিশিয়ে তৈরি একটি ডিশ। কয়েকটি তাপার ডিশ আর একটা-দুটো মেইন ডিশ নিলেই আমাদের মতো চারজন মানুষের খাওয়া হয়ে যায়। প্রথমদিন ডিনারে আমরা নিয়েছিলাম মাশরুম ভেতরে দিয়ে স্প্রিং রোলের মতো, ফালি ফালি করে কাটা বেগুন একটু মিষ্টি ধরনের সস দিয়ে ভাজা, ক্যাটল ফিশের ভাজা, কুঁচো চিংড়ি আর বাটার মিশিয়ে চ্যাপ্টা পিঠা (ডুবো তেলে ভাজা)।
পরে আমরা বেশ কয়েকটি রেস্তোরাঁয় বিভিন্ন ধরনের তাপা খেয়েছি; কিন্তু বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সেবিয়ার সবচেয়ে পুরনো রেস্তোরাঁর কথা, যার বয়স সাড়ে তিনশো বছর। ফারাজ আগে থেকেই বের করে রেখেছিল তার নাম (ELRINCONCILLO) ও ঠিকানা। গুগল ম্যাপ দেখে সেখানে পৌঁছতে অসুবিধা হলো না। দুটো রাস্তার কোনায় তিনতলা দালানের প্রথম দুই তলাজুড়ে বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তার অবস্থান। তবে আমরা যখন গিয়েছি তখন ভেতরে প্রায় কেউ ছিল না। বসার/ খাওয়ার ব্যবস্থা বাইরে। চৌরাস্তার মোড়ের একপাশে, যেখানে ফুটপাত বেশ চওড়া, টেবিল-চেয়ার পাতা। মূল রেস্তোরাঁর ওপরের তলা থেকে ঝুলতে থাকা ব্যানার জানিয়ে দিচ্ছিল যে, ২০২০ সালে এর ৩৫০ বছর বয়স হয়েছে। যখন আমাদের ন্যাপকিন এবং ছুরি-কাঁটাচামচ দেওয়া হলো তখন দেখলাম তাদের গায়েও সেই বিশেষ কথা উল্লিখিত। সেখানে অ্যাপেটাইজারের জন্য সøাইস করা টমেটোর ওপর আনচোভি মাছ – আর কোথাও খেয়েছি বলে মনে পড়ছে না। আর ছিল পালং শাকের সঙ্গে মটরশুটি দিয়ে নিরামিষ পদ, যা আমাদের সবারই খুব পছন্দ হয়ে গেল। হয়তো বা আমাদের বাড়ির রান্নার সঙ্গে কিছুটা মিল পেয়েছিলাম; নানরুটির মতো এক ধরনের রুটির সঙ্গে খেতে বেশ ভালো লেগেছিল। ল্যাম চপ, ফ্রাইড স্কুইড – সব খাবারই ছিল উঁচু মানের।
কর্ডোবায় মসজিদ-ক্যাথিড্রাল দেখতে দেখতে খাওয়ার সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। রেস্তোরাঁ খুঁজতে গিয়ে শহরটি সম্পর্কে আরো একটু ধারণা পাওয়া গেল। সরু গলির ওপর বাড়ির দেয়াল হলেও অনেক বাড়ির ভেতরে ঢুকলে প্রথমেই পড়ে একটুখানি খোলা জায়গা – আজকাল বাড়ির সামনে যেমন বাগান থাকে। কোনো কোনো রেস্তোরাঁর বাইরের সাইনবোর্ডেই উল্লেখ করা – এখানে বাগান বা খোলা জায়গায় বসার ব্যবস্থা আছে। তেমনি একটি রেস্তোরাঁতে ঢুকে পড়লাম আমরা। ঢুকতেই চোখে পড়ল তার আরেকটি
সুবিধা : খোলা বাগানে ছায়ার জন্য তাঁবু তো রয়েছেই, তার সঙ্গে আছে তাঁবুর চারদিকে সরু পাইপ থেকে খুব সূক্ষ্ম জলের ধারা ছিটিয়ে দেওয়া – ওদের বর্ণনায় ‘মিস্ট’ (ইংরেজি শব্দ mist)। সেবিয়ার দু-একটি রেস্তোরাঁতেও এটা দেখেছি, খোলা জায়গায় এয়ার কন্ডিশনিংয়ের ব্যবস্থা করা যায় না বলে এই ব্যবস্থা। তবে কর্ডোবায় সেদিন সেটা সত্যিই উপকারী হয়েছিল, কারণ গরম পড়েছিল প্রচণ্ড (৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস), আর আমরা ঘুরে ঘুরে গরমে হাঁসফাঁস করছিলাম।
রেস্তোরাঁটিতে খাওয়াও ভালো ছিল। খেতে খেতে আমার মনে হলো, এর ভেতরের জায়গাটি একটু দেখে যেতে পারি না কি? টয়লেট ব্যবহার করতে যাব বলে যেতে পারলাম মূল রেস্তোরাঁতে, আর তখন দেখলাম কী সুন্দর পুরো বাড়িটি। পুরোপুরি উত্তর আফ্রিকা এবং মুর স্থাপত্যের নিদর্শন সেখানে। চারদিকে ঘরের মাঝখানে একটি আঙিনায় চেয়ার-টেবিল পাতা। চারদিকের বারান্দার ওপরে খিলানের সারি। স্বাভাবিক সময় হলে হয়তো আমরা সেখানে বসেই খেতাম আর উপভোগ করতে পারতাম ভবনটির স্থাপত্য-সৌন্দর্য।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.