মিলিত হই প্রাণের শাশ্বত আনন্দের পথে

‘বারো মাসে তেরো পার্বণ’ – বাঙালির এমন উৎসবপ্রিয়তার কথা শোনেননি এমন লোকের সংখ্যা নেহায়েতই কম। বাঙালি জাতি

সংস্কৃতিপ্রিয়। আনন্দ-বেদনা, হাসি-ঠাট্টা যেন অবচেতনভাবেই এদেশের মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। হাজার বছরের পুরনো বাঙালি সংস্কৃতি এতোটাই সমৃদ্ধ ও বলশালী যে, প্রাচীনকালের বৈদিক-আর্য প্রভৃতি বহিঃসংস্কৃতি যেমন এতে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি, তেমনি ব্রিটিশ এবং পরবর্তীকালে পাকিস্তানের নির্মম শাসন ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের চেষ্টাতেও বাঙালি দূরে ঠেলে দেয়নি তার ঐতিহ্য-উৎসব-রীতিনীতি। নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বলীয়ান দুর্দমনীয় সেই বাঙালি জাতি প্রায় দেড় বছরের বেশি সময় ধরে গৃহবন্দি, কোভিড-১৯ ভাইরাসের ব্যাপক বিস্তারহেত। গৃহকোণে বন্দি বাঙালিহৃদয় খুঁজছিল মুক্তির আকাশ।

অবশেষে শঙ্কা-দ্বিধার মধ্যেই এসেছে মুক্তির বাতাস। কোভিডকালীন বিধিনিষেধ আলগা হয়েছে, প্রায় স্বাভাবিকই এখন জীবন। বিধিনিষেধকালে, বিশেষত থিয়েটারের জন্য খ্যাত, শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ ছিল বন্ধ। সেই দুঃসহ সময়ে এলাকাভিত্তিক যেসব নাট্যপ্রদর্শনী হয়েছে তার পরিসর ছিল অত্যন্ত স্বল্প। সেসব মঞ্চনাটক উপভোগ ছিল অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। অবশেষে উন্মুক্ত হলো শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ। শুরু হলো নাট্যপ্রদর্শনী। প্রাণ ফিরে পেল ঢাকার নাট্যাঙ্গন। শুরু হলো নাট্যোৎসবের আয়োজন। এ যেন মুক্তির আনন্দে অফুরান প্রাণের মেলা!

কোভিডকালীন দীর্ঘ বন্ধের পর গত ১ থেকে ১২ অক্টোবর, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় আয়োজন করা হয় ‘গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২১’। এটি বাংলাদেশে গঙ্গা যমুনা উৎসবের অষ্টম বৈঠক। ঢাকার সেগুনবাগিচায় অবস্থিত শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালা, এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল, স্টুডিও থিয়েটার, জাতীয় সংগীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি মঞ্চ এবং উন্মুক্ত মঞ্চে বারো দিনব্যাপী ৩৬টি মঞ্চনাটক, ১২টি পথনাটক, ১১টি আবৃত্তি সংগঠনের পরিবেশনা, সংগীত, নৃত্য ও নৃত্যনাটক, সংগীতালেখ্যসহ নানা পরিবেশনা মুগ্ধ করে দর্শক-শ্রোতাদের। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপনকে কেন্দ্র করেই এ-উৎসবের আয়োজন। এবারের উৎসব উৎসর্গ করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে।

এ-উৎসবে সংস্কৃতির নানা মাত্রা যুক্ত থাকলেও নাটকই ছিল প্রধান। আয়োজক হিসেবে ছিল ‘গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব পর্ষদ’। এ পর্ষদের সদস্যসচিব নাট্যজন আকতারুজ্জামান এবং সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। উৎসব আয়োজনে আর্থিক সহযোগিতায় ছিল সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। শিল্পকলা একাডেমিও তার হল ভাড়া মওকুফ করে দেয়।

‘গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসব’ শিরোনামে এই উৎসবের যাত্রা হয়েছিল মূলত কলকাতায়। ১৯৯৮ সালে কলকাতার অনীক নাট্যদল প্রথম এ-উৎসব আয়োজন করে। এই দলের কর্ণধার ছিলেন অমলেশ চক্রবর্তী। তখন এ-উৎসবে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দলকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। সে-উৎসবের ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এই উৎসব আয়োজন করা হয়। সে-বছর এই উৎসব আয়োজনের কেন্দ্রে ছিল কলকাতার অনীক নাট্যদল। ঢাকার বিভিন্ন নাট্যদল তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করেছিল। ওই উৎসবটির আহ্বায়ক হিসেবে অমলেশ চক্রবর্তী (কলকাতা) ও আকতারুজ্জামান (বাংলাদেশ) নাম পাওয়া যায়। ভারতের ‘গঙ্গা’ এবং বাংলাদেশের ‘যমুনা’ নদীর রূপকের মধ্য দিয়ে দুদেশের সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনের প্রতীকে এই ‘গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসবে’র নামকরণ। উৎসব আয়োজনের প্রথমদিকে নাট্য প্রদর্শনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীকালে এর কলেবরে সাংস্কৃতিক নানা উপকরণ যুক্ত হতে থাকে।

অমলেশ চক্রবর্তী প্রয়াত হয়েছেন কয়েক বছর আগে। তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর নামাঙ্কিত প্রথম সম্মাননায় অভিষিক্ত হন বাংলাদেশের

সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছ। এবারের উৎসবে ভারতকে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হয়নি। করোনা-পরবর্তী ভিসা জটিলতায় এমনটি হয়েছে বলে আয়োজকরা উল্লেখ করেন। এবারের উৎসবে শুধু বাংলাদেশি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো পরিবেশন করে।

ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে ১ অক্টোবর উৎসবের উদ্বোধন হয়। উদ্বোধন করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম শব্দসৈনিক সুজেয় শ্যাম। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। উৎসবের আহ্বায়ক গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশ অভিন্ন সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা বিনিময় এবং জনগণের মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করার লক্ষ্য নিয়েই মূলত গঙ্গা-যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজিত হয়ে আসছে আট বছর ধরে। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর আমরা উৎসব আয়োজন করতে পারিনি। দুই বছর পর উৎসব আয়োজন করা হলেও করোনার কারণে ভারতের কোনো নাট্যদল অংশগ্রহণ করতে পারছে না। করোনায় গত দেড় বছরে আমরা হারিয়েছি দেশের অনেক সংস্কৃতিজন, সংস্কৃতিকর্মী, অগণিত আলোকিত মানুষকে। আমরা এই উৎসব পর্ষদের পক্ষ থেকে সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।’

উদ্বোধনের পর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় থিয়েটার (বেইলি রোড)-এর নাটক পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়। সৈয়দ শামসুল হক-রচিত নাটকটি বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে ব্যাপক জননন্দিত ও আলোচিত। মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একজন রাজাকার চরিত্রের জীবন, ট্র্যাজিক পরিণতি এ-নাটকের বিষয়বস্তু। কাব্যনাট্যটিতে সত্তর ও আশির দশকের নাটকে গ্রামীণ দৃশ্য, বাড়ির সেটের সাজেশন যেভাবে ব্যবহৃত হতো এ-উৎসবে সেভাবেই উপস্থাপিত করা হয়। পোশাক, প্রপস হিসেবে গ্রামীণ শাড়ি, লুঙ্গি ও নাকের নোলক ব্যবহৃত হয়। সময়কালকে ধরার অজুহাত দেওয়া গেলেও এতে স্থান পেয়েছে এক অভিজ্ঞতাহীন গ্রামীণজীবন। বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় নাট্যপ্রযোজনার ব্যাপকমাত্রার পরিবর্তন ঘটেছে। সৈয়দ জামিল আহমেদ, কামালউদ্দীন নীলু, নাসিরউদ্দীন ইউসুফসহ নানাজনের উপস্থাপনা লক্ষ করলেই তা স্পষ্ট। পঠিত কাব্য হিসেবে এ-নাটক যতটা জনপ্রিয়, থিয়েটার হিসেবে, বর্তমান সময়ে, তার সাফল্য নিয়ে ততটাই প্রশ্ন ওটা স্বাভাবিক।

নাটকটির আদি নির্দেশক ছিলেন নাট্যজন আব্দুল্লাহ আল মামুন। নতুন নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী।

উদ্বোধনের দিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় আরণ্যক নাট্যদলের কহে ফেসবুক এবং স্টুডিও থিয়েটার হলে ঢাকা জেলা শিল্পকলা একাডেমির জনকের মৃত্যু নেই নাটকটি।

উৎসবের দ্বিতীয় দিন শনিবার, ২ অক্টোবর, জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় প্রাচ্যনাট নাট্যদলের নাটক সার্কাস সার্কাস। নাটকটি বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে অত্যন্ত পরিচিত। ১৯৯৮ সালের ২৭ এপ্রিল প্রাচ্যনাট মঞ্চে আনে তাদের প্রথম মঞ্চপ্রযোজনা সার্কাস সার্কাস। নাটকটির রচনা ও নির্দেশনা আজাদ আবুল কালামের। দেশ বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মীয় আগ্রাসনে সার্কাসশিল্পীদের জীবনযাত্রার আখ্যান এ-নাটক।

১৯৪৭-এর পর এদেশে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক সংঘাতগুলো কারো অজানা নয়। এ-সময় সার্কাস দলগুলোর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ায় মৌলবাদী শক্তি, পুড়িয়ে দেওয়া হয় অনেক দলের আস্তানা, সহায়-সম্পদ। দেশের সংস্কৃতিকে সমূলে বিনাশ করতে তৎপর হয়ে ওঠে একটি প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। তেমনি এক প্রেক্ষাপটে সাধন দাসের রয়েল বেঙ্গল সার্কাস দল ভেঙে যাওয়ার অমানবিক কাহিনির ইম্প্রুভাইজেশনাল প্রযোজনা সার্কাস সার্কাস। আবহমান বাংলার সংস্কৃতি এ-নাট্যের মূল বিষয়। নাটকটিতে বিভিন্ন শারীরিক কসরত, ভাঁড়, মূকাভিনয়, নানা খেলা দৃশ্যায়নের মধ্য দিয়ে সার্কাসের আবহ ফুটে উঠেছে। অসাধারণ অভিনয় ও উপস্থাপনকৌশলে এ-নাটকের মধ্য দিয়ে বাঙালির জীবনসংকট ও সংস্কৃতির বাস্তবতা অত্যন্ত অনবদ্যভাবে প্রস্ফুটিত। নাটকটি সে-সময়ও যেমন দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেছিল, এখনো তেমনই জনপ্রিয়।

একই দিনে শিল্পকলার এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় সময় নাট্যদলের নাটক ভাগের মানুষ। এ-নাটকটিও নাট্যাঙ্গনে অত্যন্ত সুপরিচিত। ১৯৯৭ সালে সময় প্রযোজনা করে ভাগের মানুষ, সাদত হোসেন মান্টোর ‘টোবাটেক সিং’ গল্প অবলম্বনে নাট্যরূপ দেন মান্নান হীরা ও নির্দেশনা আলী যাকেরের। দেশ বিভাজনের ফলে মানুষের জীবনের অসহায়ত্ব এ-নাটকের উপজীব্য। ধর্মের ভিত্তিতে একটি ভৌগোলিক সীমানায় মানুষকে বেঁধে ফেলা হবে – এমনটা কখনো ভাবেনি অখণ্ড ভারতবর্ষের মানুষ। ক্রমশ ক্ষোভ, ক্রোধ ও হতাশা ঘিরে ফেলে তাদের। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মেঘ ক্রমশ গাঢ় কালো রূপ ধারণ করে। এমনই অস্থির সময়, অস্থির মানুষের গল্প ভাগের মানুষ। নাটকটি সাম্প্রতিক সময়েও জনপ্রিয়।

একই দিন স্টুডিও থিয়েটার হলে মুন্সীগঞ্জের থিয়েটার সার্কেল পরিবেশন করে পঞ্চভূতের রঙ তামাশা।

৩ অক্টোবর উৎসবের তৃতীয় দিন শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে প্রদর্শিত হয় নাটক মূল্য অমূল্য। নাটকটি সদ্যগঠিত নাট্যদল অনুস্বরের প্রযোজনা। আর্থার মিলারের দ্য প্রাইজ অবলম্বনে ভাবানুবাদ করেছেন অসিত মুখোপাধ্যায়। নাটকটি রূপান্তর করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন মোহাম্মদ বারী। ভোগবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপরীতে এই নাটক নতুন এক ভাষা। বাবার ব্যবহৃত পুরনো আসবাবপত্র নিলামে বিক্রি করতে গিয়ে দুই পুত্রের মাঝে ফেলা আসা জীবনচিন্তার উদ্রেক হতে থাকে। তেমনি নিলামদার খোদাবক্স যেন সমাজের শোষক শ্রেণির মূর্তি। নাগরিক পরিমণ্ডল রূপান্তরের মধ্য দিয়ে সমাজের চিন্তার নতুন রূপ ফুটে উঠেছে এ-নাটকে।

এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় খেয়ালি নাট্যগোষ্ঠীর কদমতলী আর্মি ক্যাম্প এবং স্টুডিও থিয়েটার হলে রাঙামাটির হিল রিবেং থিয়েটারের গঙ্গা মা।

৪ অক্টোবর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে হবিগঞ্জের জীবন সংকেত নাট্যগোষ্ঠী উপস্থাপন করে তাদের জনপ্রিয় প্রযোজনা জ্যোতিসংহিতা। নাটকটি রচনা করেছেন রুমা মোদক এবং নির্দেশনায় সুদীপ চক্রবর্তী। নাটকটি বৃহত্তর ভাটি অঞ্চলের দাস পার্টি ও জগৎজ্যোতি দাসের মুক্তিযুদ্ধের কাহিনি। অসীম সাহসী এ-যোদ্ধা দেশের জন্য, মানুষের জন্য যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়েছেন। এ এক ইতিহাসের অনুসন্ধান। নাটকটি উপস্থাপনায় আবহমান বাংলার রীতিকে অবলম্বন করা হয়েছে। উপস্থাপনে নানা বস্তুর পরিবর্তে প্রপসের প্রতীকী রূপের আশ্রয় নিয়েছেন নির্দেশক।

এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় মৈত্রী থিয়েটারের বর্ণচোরা ও স্টুডিও থিয়েটার হলে উৎস নাট্যদলের স্বর্ণজননী।

উৎসবের পঞ্চম দিন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় নাটক ঘুম নেই। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর ঘুম নেই আত্মস্মৃতিকথা অনুসারে নির্দেশনা দিয়েছেন জন মার্টিন। ১৯৯৪ সালে মহাকাল নাট্য সম্প্রদায় ঘুম নেই-এর মঞ্চ-প্রযোজনা করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ইতিহাস ও রাজনীতিকীকরণের বিপরীতে এ-নাটক অত্যন্ত গুরুত্ববহ। সে-সময় নাটকটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এবারের গঙ্গা যমুনা নাট্যোৎসব উপলক্ষে নাটকটি পুনঃপ্রযোজনা করা হয় এবং এবারো দর্শকের ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায় এ-প্রযোজনা। 

এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় রঙ্গনা নাট্যগোষ্ঠীর শত নারী এক পুরুষ। নামকরণের মধ্যে একধরনের শিল্পরুচিগত প্রশ্নের অবতারণা থাকলেও নাটকে দেখা যায় গ্রামীণ সমাজব্যবস্থায় নানা রূপের হাস্যরসাত্মক প্রকাশ। গ্রামীণ সমাজে লুকিয়ে থাকে নানা অসংগতি-অবিচার হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে রূপায়িত করা হয়েছে এ-নাটকে। বাস্তববাদী ধারায় গ্রামীণ বাড়ি, মাঠঘাটের সাজেশন দিয়ে তৈরি করা হয়। হিল্লা বিবাহপ্রথাকে কেন্দ্র করে ঘটনার আবর্তন হলেও গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা এর মূল উপজীব্য। নাটকটি রচনা করেছেন সিরাজ হায়দার এবং নির্দেশনায় হাসান হাফিজুর রহমান। এদিন স্টুডিও থিয়েটার হলে স্বপ্নদলের হেলেন কেলার প্রদর্শিত হয়।

৬ অক্টোবর নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় প্রাঙ্গণেমোর নাট্যদলের নাটক কনডেমড সেল। নাটকটি রচনা করেছেন অনন্ত হিরা, নির্দেশনা দিয়েছেন আউয়াল রেজা। নাটকটি কনডেমড সেলে সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের ঘটনা নিয়ে আবর্তিত। এর মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার, আলবদরদের দুষ্কৃতিগুলোকে নতুনভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। এ-নাটকে সাকা চৌধুরী চরিত্রের স্বাভাবিকভাবে সারাক্ষণ অশ্লীল বক্তব্য ব্যবহারের কারণে দর্শকের মধ্যে সাড়া পড়ে।

এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে উপস্থাপিত হয় পদাতিক নাট্যসংসদের নাটক প্রেরণা এবং স্টুডিও থিয়েটার হলে এথিক নাট্যদলের আয়না ঘর।

উৎসবের সপ্তম দিন ছিল ৭ অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। এদিন নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় লোক নাট্যদলের (বনানী) জনপ্রিয় প্রযোজনা কঞ্জুস। মলিয়েরের দ্য মাইজার নাটকের ভাবানুবাদ এটি। নাটকটির প্রযোজনা নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। এনএসডি-ফেরত কয়েকজন তরুণ ‘নাট্যদল’ নামে নতুন ব্যানারে ১৯৮৩ সালে প্রথম মঞ্চে নিয়ে আসে কঞ্জুস। ‘নাট্যদলে’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ, তারিক আনাম খান, ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, গোলাম সারোয়ার, কামালউদ্দীন নীলু প্রমুখ এনএসডিয়ান। যতটুকু জানা যায়, নাটকটির ভাবানুবাদ করেন তারিক আনাম খান এবং নির্দেশনা দেন কামালউদ্দীন নীলু। বর্তমান সময়ে লোক নাট্যদল তিনটি – লোক নাট্যদল (সিদ্ধেশ্বরী), লোক নাট্যদল (টিএসসি) এবং লোক নাট্যদল (বনানী)। টিএসসির লোক নাট্যদলটি বর্তমানে প্রায় অকার্যকর। মাঝেমধ্যে তাদের অন্য প্রযোজনা মঞ্চস্থ করতে দেখা যায়। প্রতিটি দলই তাদের নিজস্ব প্রযোজনা হিসেবে কঞ্জুস নাটকটি প্রদর্শন করে থাকে। প্রতিটি দলের প্রচারণাতেই আলাদা অনুবাদক ও নির্দেশকের নাম পাওয়া যায়। নির্দেশকের মধ্যে – কামালউদ্দীন নীলু, সালেক খান, লিয়াকত আলী লাকী, কামরুন নূর চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পুরান ঢাকার এক বুড়ো কৃপণের মানসিকতাকে কেন্দ্র করে নাটকের ঘটনা আবর্তিত। এতে রোমান্টিকতার এক স্বপ্নীল রাজ্যের রূপ আছে। জনপ্রিয় উর্দু-হিন্দি নানা গানের আবহে নাটকটি পরিবেশিত। ফলে আশির দশকে এর প্রযোজনা হলেও আজ পর্যন্ত এর জনপ্রিয়তা কোনো অংশেই কমেনি। বলা যেতে পারে, এটি বাংলাদেশে এযাবৎ সবচেয়ে বেশি প্রদর্শিত নাটক। সহজ-সরল ও কৌতুকপূর্ণ কাহিনিবিন্যাসে আবেগ ও রোমান্সে ঠাসা এর গল্প সহজেই দর্শক-শ্রোতার মন জয় করে নেয়। নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের নির্মল বিনোদন এ-নাটক।

এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রযোজনা কোর্ট মার্শাল এবং স্টুডিও থিয়েটার হলে ব্যতিক্রম নাট্যগোষ্ঠীর পাখি।

৮ অক্টোবর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে বাংলাদেশ ব্যালে ট্রুপ ‘ব্যাটেল অব বাংলাদেশ’ পরিবেশন করে নৃত্যনাট্য। এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে চট্টগ্রামের জেলা শিল্পকলা একাডেমি উপস্থাপন করে রাজনীতির কবি। স্টুডিও থিয়েটার হলে চন্দ্রকলা থিয়েটার-পরিবেশিত দ্বৈত মানবে অতিপ্রাকৃতবাদী এক ধরনের মনোবিশ্লেষণ আছে। গল্পটি একজন লেখকের পারিবারিক সম্পর্কের উত্থান-পতনকে কেন্দ্র করে। লেখক নিজেকে সীমাবদ্ধ অনুভব করলে মনোজাগতিক টানাপড়েনের সময় তার স্ত্রীও তাকে নিস্তার দেয় না। তখন ইতিহাস থেকে আগমন ঘটে বিভিন্ন সময়ের ভয়ংকর ভিলেনদের। তারা নিজ নিজ চরিত্রে সমকালে যেন নবরূপে উত্থিত।

তৃতীয় পক্ষ হয়ে লেখক পরিবারের সম্পর্কের মধ্যে প্রবেশ করে তারা। সেই তৃতীয় পক্ষ – হিটলার, মীরজাফর, কিসিঞ্জার এবং ঘষেটি বেগম। অস্তিত্ব সংকট মেটাতে নানা পদক্ষেপ নেয় তারা। নানা রহস্য ও বিচিত্র ঘটনায় ঘেরা নাটকটি রচনা করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন এইচ আর অনিক।

গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব

২০২১-এর নবম দিন ৯ অক্টোবর বিকেল ৪টায় স্টুডিও থিয়েটার হলে আয়োজন করা হয় নাট্য সেমিনারের, শিরোনাম – ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও আমাদের

সংস্কৃতি’। প্রবন্ধকার প্রখ্যাত নাট্যসমালোচক মফিদুল হক। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধকারের পক্ষে লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করা হয়। প্রবন্ধে বাঙালির সংস্কৃতির ভিত্তিমূল তুলে ধরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সংস্কৃতি কোন পথে – এমন এক প্রশ্ন তুলে ধরা হয়। পরে প্রবন্ধের বিষয়ের ওপর অনেকেই বক্তব্য রাখেন।

এদিন শিল্পকলা একাডেমির মূল হলে প্রদর্শিত হয় লোক নাট্যদলের (সিদ্ধেশ্বরী) প্রযোজনা আমরা তিনজন। বুদ্ধদেব

বসু-রচিত এ-নাটকের নির্দেশনা দিয়েছেন লিয়াকত আলী লাকী। তিন বন্ধুর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এ-নাটকের উপজীব্য।

এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাট্যচক্র পরিবেশন করে একা এক নারী। নাটকটির রচয়িতা দারিও ফো এবং ফ্যাংকা রামে; অনুবাদ করেছেন আবদুস সেলিম, নির্দেশনা দিয়েছেন দেবপ্রসাদ দেবনাথ। নাটকের কাহিনি অত্যন্ত সরল। তালাবদ্ধ একটি ফ্ল্যাটে একা এক নারী। স্বামী অফিসে যাওয়ার সময় স্ত্রীকে তালাবদ্ধ করে রেখে যায়। একাকিত্ব ঘোচাতে পাশের বাড়ির ফ্ল্যাটের ভদ্রমহিলাকে বলতে থাকে জীবনের কাহিনি। নাট্যকারদ্বয় পুুরুষতান্ত্রিকতায় একজন নারীর স্বাধিকারের রূপটা কেমন হতে পারে তা তুলে ধরতে চেয়েছেন। নারী ও পুরুষের সম্পর্কের ধরন কী, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে নারীর সম্পর্ক এবং নারীর প্রকৃত চাওয়া-পাওয়ার স্বরূপটা কেমন হতে পারে – তারই একটি রূপরেখা অঙ্কনের চেষ্টা করা হয়েছে এ-প্রযোজনায়।

এদিন স্টুডিও থিয়েটার হলে বাতিঘর পরিবেশন করে ‘র‌্যাড ক্লিফ লাইন’।

উৎসবের দশম দিন ১০ অক্টোবর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে প্রদর্শিত হয় দৃষ্টিপাত নাট্যদলের নতুন প্রযোজনা সে এক স্বপ্নের রাত। নাটকটি রচনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন ড. খন্দকার তাজমি নূর। নাটকটি সারা কেইনের ‘সাইকোসিসে’র মতো সিজোফ্রেনিয়াটিক মনোদ্বন্দ্বের অভিনয়নির্ভর প্রযোজনা। থিয়েটারের ক্ষেত্রে কলকাতার নাট্যনন্দন বা শিল্প-দৃষ্টিভঙ্গি এখনো ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্বের দ্বন্দ্ব ও সংলাপনির্ভর, যে-আবেগের সিংহভাগই বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় নব্বইয়ের দশকে ছাড়িয়ে গেছে। এদেশের নাট্যচর্চায় সম্পৃক্ত হয়েছে নিজস্বতা। ঐতিহ্যবোধের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রয়াস পেয়েছে বিশ্বকৌশল। সৈয়দ জামিল আহমেদের রিজওয়ান, কামালউদ্দীন নীলুর পীরচাঁন, শিমূল ইউসুফের ধাবমান প্রভৃতিসহ শতাধিক প্রযোজনা-প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। উন্নত বিশ্বেও, বিশেষত রাশিয়া, নরওয়ে, ইতালি, চীন, জাপান প্রভৃতি দেশের উপস্থাপনরীতিতে তাদের নিজস্বতার খোঁজ পাওয়া যায়।

সে এক স্বপ্নের রাত নাটকে চরিত্র-সংলাপ-অভিনয়-মুহূর্ত সৃষ্টি ও ভাঙাগড়ায় মনোবিকারগ্রস্ত চরিত্রের মধ্য দিয়ে মানবিকবোধকে উসকে দিতে চেয়েছেন নির্দেশক।

এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে সংস্কার নাট্যদল প্রযোজনা করে গীতি চন্দ্রাবতী। কিংবদন্তি চরিত্র চন্দ্রাবতীর চরিত্রনির্ভর নাটকটির রচয়িতা নয়ান চাঁদ ঘোষ। নির্দেশনা দিয়েছেন ইউসুফ হাসান অর্ক। চন্দ্রাবতী ছিলেন মনসামঙ্গলের কবি দ্বিজ বংশীদের কন্যা ও রামায়ণের রচয়িতা। প্রেমবিচ্ছেদের বিয়োগান্ত কাহিনি এ-পালার মূল উপজীব্য। আনুমানিক ১৫৫০ সালে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাটুয়ারি গ্রামে চন্দ্রাবতী জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমান কিশোরগঞ্জের পাতুয়ার গ্রামে চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত শিবমন্দিরটি তাঁর ঐতিহাসিকতা বহন করে। চন্দ্রাবতী-রচিত রামায়ণ পালা গতানুগতিক পুরুষতন্ত্রকে ছাপিয়ে নারীবাদী এক আখ্যানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। সেই কবি-চন্দ্রাবতীর অমর জীবনগাথা এ-নাটক।

এদিন স্টুডিও থিয়েটার হলে উপস্থাপিত হয় কথক নাট্যদলের নাটক নিঃশ্বাস।

উৎসবের একাদশ দিন ১১ অক্টোবর জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে পদাতিক নাট্যসংসদ (টিএসসি) প্রদর্শন করে কালরাত্রি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালির ওপর নৃশংসতা, অবিচার ও অন্যায়কে তুলে ধরা হয়েছে এ-নাটকে।

একই দিনে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে উপস্থাপিত হয় ঢাকা পদাতিক নাট্যদলের প্রযোজনা কথা ’৭১। এটি রচনা করেছেন কুমার প্রতীশ বল। নাটকটির নির্দেশক দেবাশীষ ঘোষ। এ-নাটকে মুক্তিযুদ্ধকে ভিন্নভাবে ভিন্ন দৃষ্টিকোণে দেখানো হয়েছে। ঘুম নেই নাটকে যেমন মুক্তিযোদ্ধা আত্মস্মৃতিতে পৌঁছে গেছেন জীবন-শিল্পসত্যে, ঠিক তেমনি এ-নাটক মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য সত্য ঘটনা উপস্থাপনের প্রচলিত ধারাকে বাদ দিয়ে মহাকাব্যিক ব্যাখ্যানে ব্যঞ্জনাময় হয়ে উঠেছে। কাহিনিবিন্যাসে যেমন নতুনত্ব ও নয়া দৃষ্টিভঙ্গি আছে, ঠিক তেমনি উপস্থাপনেও বিস্তারমুখী প্রয়োগ স্থান পেয়েছে। এক্সপেরিমেন্টাল হলের প্রায় সমস্তটাই মঞ্চ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে নাটকটিতে। অধ্যাপক যতীন সরকারের স্ত্রী কানন সরকারের ধর্মান্তরের প্রতিবাদ করার কারণে মাওলানা সাহেবকে পাকিস্তানি সেন্যবাহিনী মসজিদে খুন করে। যে-রাজাকার ধর্মরক্ষার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে সে নিজেও জানে না অজান্তেই সে ধর্মকে নাশ করে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাবনা এ-নাট্যে গ্রন্থিত হয়েছে। শুরু থেকেই নাটকটি দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়; কিন্তু দীর্ঘ বিরতির পর নাটকটির পুনঃপ্রদর্শনী শুরু হয়েছে।

স্টুডিও থিয়েটার হলে প্রদর্শিত হয় আপস্টেজ থিয়েটারের স্বপ্নভুক। সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস অবলম্বনে নাটকটি রচনা করেছেন সাইফ সুমন এবং নির্দেশকও তিনি। নাটকটি এক কবিসত্তার জীবন পরিক্রমণ, যেখানে প্রশ্নবাণের মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে বিশ্ববাস্তবতার স্বরূপ। নাটকটিতে ‘কবি’ শিরোনামে একটি চরিত্র এবং কবির ছায়াচরিত্র নিয়েই ঘটনার আবর্তন। টানটান রোমাঞ্চমুখী কোনো ঘটনার সন্নিবেশ নয়, কবি-চরিত্রটি প্রতীকী তাৎপর্যমণ্ডিত। মানবসত্তার সঙ্গে জীবনবোধের যে-সম্পর্ক তা অনবদ্য নাটকে। বাস্তবতার নানা ঘটনার সঙ্গে ব্যক্তিমানসের যে-অবস্থান তা তুলে ধরা হয়েছে এতে। নাট্য-প্রযুক্তির উপকরণে হয়ে উঠছে মনোবিশ্লেষণী দর্শন।

জাতীয় সংগীত, নৃত্যকলা ও আবৃত্তি মিলনায়তনের প্রদর্শনী শুরু হয় উৎসব উদ্বোধনের পরদিন ২ অক্টোবর, শনিবার থেকে। উৎসবের এগারো দিনে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর কেমন আছে বাংলাদেশ (গীতিনৃত্যনাট্য), ধৃতি নর্তনালয়ের প্রেম ও প্রকৃতি (নৃত্যালেখ্য), সংবৃতা আবৃত্তি চর্চা ও বিকাশ কেন্দ্রের আমার পরিচয় (আবৃত্তি), চাঁপাইনবাবগঞ্জের আদি গম্ভীরা দলের নানা-নাতীর রঙ্গে ভরা গম্ভীরা, কথক নৃত্য সম্প্রদায়ের প্রসঙ্গ : ৪৭ (নৃত্যনাট্য), কণ্ঠশীলনের বঙ্গবন্ধু আমার প্রেরণা, মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার (আবৃত্তি), বহ্নিশিখার কুঞ্জ সাজাও গো (ধামাইল গান), আবৃত্তি একাডেমির অবিনাশী কণ্ঠ (আবৃত্তি), স্বরশ্রুতির সবুজ করুণ ডাঙায় (আবৃত্তি), পরশমণি কলাকেন্দ্রের বাদল বরিষণে (নৃত্যনাট্য), ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর স্বদেশী গান, কথা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায় (কাব্যনাট্য), মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্রের চলো এগিয়ে

যাই (আবৃত্তি), স্পন্দনের চণ্ডালিকা (নৃত্যনাট্য), সত্যেন সেন শিল্পী গোষ্ঠীর ইতিহাস কথা কও (গীতি আলেখ্য), স্রোত আবৃত্তি সংসদের সুবর্ণবাংলা (আবৃত্তি), বাকশিল্পায়নের দেশ ছাড়া ঘর হারা (আবৃত্তি), ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ঋতুরঙ্গ (গীতি আলেখ্য), নৃত্যাক্ষের আমার বাংলাদেশ (নৃত্যনাট্য), ঢাকা স্বরকল্পনের রণাঙ্গনের কথা (আবৃত্তি), বাংলাদেশ একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু (নৃত্যনাট্য), মুক্তধারা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্রের বাঙালি-বাংলাদেশ-বঙ্গবন্ধু (আবৃত্তি) পরিবেশিত হয়।

গঙ্গা যমুনা সাংস্কৃতিক উৎসব ২০২১- এর সমাপনী দিন ছিল ১২ অক্টোবর, মঙ্গলবার। সেদিন অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ আলোচনা। তারপর মূল হলে প্রদর্শিত হয় ঢাকা থিয়েটারের সাম্প্রতিক প্রযোজনা একটি লৌকিক অথবা অলৌকিক স্টিমার। নাটকটির রচয়িতা আনন জামান এবং নির্দেশক শহীদুজামান সেলিম। ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের এ-নাটকে চিন্তার আলো-আঁধারী বা প্রচ্ছন্ন ভাবনা রয়েছে। কোনো এক জনপদের নিমজ্জমান হওয়ার বিপদ থেকে মুক্তির খোঁজে যাত্রা অনিঃশেষ জীবনের ইঙ্গিতই বহন করে। জনপদে কোনো এক রোগের প্রাদুর্ভাবে শত শত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এ-ধ্বংস থেকে মুক্তির আশায় জাহাজঘাঁটিতে জড়ো হতে থাকে মানুষ। দূরাগত কোনো এক জাহাজ যেন তাদের নিয়ে যাবে রোগমুক্ত সুস্থ নিশ্চিত কোনো গন্তব্যে। কিন্তু এ কী সত্যি জাহাজ, নাকি মায়া, কিংবা মতিভ্রম! বিমূর্তবাদী ভাবনায় চিন্তার নব নব দিগন্তের উন্মোচন হতে থাকে। নির্দেশক জানান, করোনার ঘরবদ্ধ সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে নাটকটির রিহার্সাল করেছেন। লকডাউন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়।

এদিন এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র-প্রযোজিত ইনফরমার ও স্টুডিও থিয়েটার হলে জয়যাত্রার প্রযোজনা এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম প্রদর্শিত হয়।

উৎসবের প্রতিদিনই উন্মুক্ত মঞ্চে বিকেল ৪টা থেকে নানা পরিবেশনাও ছিল দর্শক-শ্রোতাদের আগ্রহের অন্যতম দিক। নাট্যযোদ্ধা, স্বরতরঙ্গ আবৃত্তি ভুবন, স্বনন, জাগো আর্ট থিয়েটার, গতি থিয়েটার, স্বপ্নঘর, উঠোন, স্বপ্ন বিকাশ কলা কেন্দ্র, থিয়েটার’ ৫২, মন্দিরা সাংস্কৃতিক পাঠশালা, স্বরবৃত্ত, সমস্বর, জিনিয়া নৃত্যকলা একাডেমি, নব আনন্দ মূকাভিনয়, শিল্পবৃত্ত, ত্রিলোক বাচিক পাঠশালা, সুরতাল রংধনু, নৃত্যালোক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, নাট্যদল, সপ্তকলির আসর, চারুকণ্ঠ আবৃত্তি সংসদ, আনন্দন, নান্দনিক নৃত্য সংগঠন, বৃত্ত নাট্যদল, আমরা কুঁড়ি, মুক্তবাক, মেঘদূত নাট্যসম্প্রদায়, ভিন্নধারা, বুলবুল একাডেমি অব ফাইন আর্টস, মুক্তমঞ্চ, রঙ্গপীঠ শিশুদল, প্রকাশ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন, প্রজন্ম কণ্ঠ, উজান, নৃত্যজন, পুষ্পাঞ্জলি, বাঙলা নাট্যদল, দনিয়া সবুজ কুঁড়ি, উচ্চারণ আকাদেমি, সুরসাগর ললিতকলা একাডেমি, বহ্নিশিখা, উত্তরীয় থিয়েটার, সন্ধান লিটল থিয়েটার, সাম্প্রতিক ঢাকা, পঞ্চভাস্কর, জিএ মান্নান দিব্য সাংস্কৃতিক সংগঠন, নাট্যভূমি, গেণ্ডারিয়া কিশলয়, স্বরকল্পন আবৃত্তিচক্র, মিরপুর সাংস্কৃতিক একাডেমি, নৃত্যম নৃত্যশীলন কেন্দ্র প্রভৃতি সংগঠন উৎসবে তাদের পরিবেশনা উপস্থাপন করে।

বিশ্বায়নের যুগে, নানা আগ্রাসনের বাস্তবতায় মানুষ যখন হারিয়ে ফেলছে তার নিজস্বতা, আত্মপরিচয়, তখন সংস্কৃতিই দিতে পারে জীবনের শাশ্বত মুক্তির আনন্দ। এবারের গঙ্গা যমুনা উৎসব পরিণত হয়েছিল প্রাণের মেলায়। করোনার দীর্ঘ ঘরবন্দি জীবনের পরে যেন আনন্দের অনাবিল স্রোতে ভেসে চলছিল সময়। একসময় সে-সময়

পেরিয়ে যায়। যবনিকা পড়ে আনন্দের। এমন উৎসব, আনন্দঘন সময় যেন বারবার ফিরে আসে – সে-প্রত্যাশা জাগে জনমনে।