আফগানিস্তানের হাজারা সম্প্রদায়ের কবি ইলিয়াস আলভির কবিতা

দারি ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ : ফাতেমেহ শামস ও লিওনার্ড শোয়ার্টজ্

বাংলায় ভাষান্তর : মঈনুস সুলতান

কবি ও চিত্রকর ইলিয়াস আলভির জন্ম ১৯৮২ সালে, আফগানিস্তানের ডায়কুন্দি প্রদেশে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন, প্রথমটি কাবুল ও বাকি দুটি প্রকাশিত হয়েছে তেহরান থেকে। দারি বা আফগানিস্তানে প্রচলিত ফার্সি ভাষার সাম্প্রতিককালের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি আলভি। কবিতা লেখার পাশাপাশি ক্যালিওগ্রাফিতেও তিনি দক্ষ। হাজারা সম্প্রদায়ের এই তরুণ তাঁর স্বদেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলদারিত্ব কয়েম হলে শরণার্থী হিসেবে কয়েক বছর তেহরানে বসবাস করেন। মূলত প্রবহমান মুক্তক ছন্দে তিনি ভাবনাপ্রধান পদাবলি রচনা করে থাকেন। তবে সামগ্রিক বিচারে বোদ্ধারা তাঁর লেখনীতে ধ্রুপদী প্রকরণ যথা কসিদা এবং গজলের গীতলতা খুঁজে পান। শরণার্থী জীবনে কবি ‘দূর-এ-দারি’ বা ‘দারি ভাষার মণিমুক্তা’ নামক সাহিত্য সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০০৯ সালে গর্গ-ই খোয়াবলাবি হাসতাম বা ‘দিবাস্বপ্নে বিভোর এক নেকড়ে’ শিরোনামে কাব্যসংকলনের জন্য আলভি ‘ব্রডকাস্টার পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড’ ও ‘অ্যানুয়েল বুক অ্যাওয়ার্ড ফর ইয়াং পোয়েটস’ নামে দুটি সম্মানজনক পুরস্কার অর্জন করেন। ২০০৮ সাল থেকে তিনি অভিবাসী হিসেবে অস্ট্রেলিয়াতে বসবাস করছেন। এখানে উপস্থাপিত কবিতা, কবির প্রতিকৃতি ও ক্যালিওগ্রাফের নমুনার সূত্র ইন্টারনেট।

বিশ্বাস হয় না আমার

মৃত্যু যদি হয় তোমার এখানে

হে প্রিয়,

তাহলে তা যেন হয় যক্ষ্মারোগে

অথবা নিউমোনিয়ায়,

প্রার্থনা করি  –  তোমার সমাপ্তি যেন না আসে

আত্মঘাতী বোমায়।

খানিকটা সময় যেন পাও তুমি

যাতে স্মৃতিময় দিনগুলি করতে পারো রোমন্থন,

চলছে কেমন শরীরের বিষয়-আশয় –

কারা এসেছে কাছে  –  কে ছিল পরম স্বজন,

উদ্বেগের উত্তপ্ত আবেগে কেটেছে তো সময় ঢের

পরিকল্পনা করতে পারো এবার  –  নীরবে নিজস্ব প্রস্থানের।

বাড়ি থেকে কোনো চিন্তাভাবনা না করে বেরিয়েছো –

অবশেষে আমরা খুঁজে পেলাম শুধু তোমার জুতা জোড়া  –  বাজারে

অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সন্ধান পেলাম না তোমার দু-চোখের,

ব্যাপক তালাশ করেও পেলাম না তোমার বাহু,

কিংবা হাস্যোজ্জ্বল  –  প্রিয় সে মুখমণ্ডল

কেবল শার্টটি ঝুলে ছিল বিজলির তারে,

যাঞ্চা করি  –  ঘটে না যেন এমন কিছু তোমার জীবনে।

নিজ চোখে আমি প্রত্যক্ষ করতে চাই তোমার মৃত্যু

আমার সেবাস্নিগ্ধ প্রতিবেশে যেন মৃদু হয় অন্তিম প্রহরের ত্রাস,

আমার কবোষ্ণ সান্নিধ্যে যেন ফেল তুমি শেষ নিশ্বাস,

আমার আঙুল যেন মুদিয়ে দেয় তোমার চোখের পাপড়ি,

তা না-হলে বিশ্বাস করবে না কেউ  –  তামাম জীবন

আদতে কী ঘটেছে তোমার?

কোনো গুজবেই কান দিতে পারবো না আমি

বিশ্বাস করবো না কিছু  –  প্রতীক্ষায় থাকবো সারাক্ষণ।

ভাই খসরু

ভাই খসরু,

উগান্ডার ছেলে আমি –

তারা আমার পায়ে চাবুক মারার জন্য শরীর ঢেকে দিয়েছিল পাতায়,

যাতে আমি নাচতে বাধ্য হই,

নাচতে নাচতে সংজ্ঞা হারানো অব্দি যেন নাচতে থাকি।

পরে তারা পাতার আব্রু সরিয়ে পরীক্ষা করে দেখছিল,

কৃষ্ণাঙ্গ একটি ছেলের ঘাম কেনোবিসের পাতায় কোনো পরিবর্তন ঘটায় কি না?

তারা বলেছিল  –  এ প্রক্রিয়ায় মানুষ ভুলে যায় তাবৎ কিছু,

বিস্মরণ!

ভাই খসরু, এমন কেউ কি আছে  –  যে চায় না ভুলতে?

ভাই খসরু,

আদিবাসী একটি মেয়ে আমি –

তারা আমার পিতাকে বেঁধে রেখেছিল দুটি সাদা ঘোড়ার সাথে

যাতে আইনের সহায়তা নিয়ে তারা কেটে নিতে পারে বাবার বাহু ও পদযুগল,

আমার জননীর কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে

তারা আমাকে সমর্পণ করেছিল শ্বেতাঙ্গ একটি পরিবারের কাছে,

ওই পরিবারের গৃহকর্তা প্রতিরাতে এসে

খুলে নিতেন আমার কালো স্তনযুগলের বোতাম।

ভাই খসরু,

গতকাল অব্দি আমি ছিলাম আলেপ্প নদী

তরুণ মাছেরা তাদের নগ্নদেহে স্পর্শ করতো আমাকে,

কিন্তু আজ আমি তিক্ত,

আমার স্রোতজলে অন্য তীর থেকে ভেসে আসে মৌন পর্যটক,

মাছসুদ্ধ তাদের দুটি হাত বাঁধা

চোখে ঠুলি পরানো

এবং তাদের কপালে গভীর গর্ত।

ভাই খসরু,

আমার টি – শার্টে আমি লিখেছি

‘১৯৪৮’

নাকবা  –  ক্রান্তিতে বাস্তুহারা হয়েও বেঁচে আছি আমি

আমিই  –  ফিলিস্তিন।

ভাই খসরু,

কুর্দি গোত্রের মানুষ তুমি,

আমি হাজারা সম্প্রদায়ের সন্তান

ভ্রাতৃত্ব আমাদের রক্তসূত্রে বাঁধা,

তবে শতাব্দী কয়েক ধরে পরস্পরকে হারিয়ে

কেবলমাত্র একে অপরকে খুঁজে পেয়েছি আজ রাত্রে

বসে আছি তোমার সোলাইমানিয়া অঞ্চলের ছোট্ট বাড়িতে;

যেখানে ভদকার কল্যাণে এতোটা নেশাগ্রস্ত হয়েছি যে –

পরস্পরের মাতৃভাষা বুঝতে আমাদের কোনো সমস্যাই হচ্ছে না।

ভাই খসরু, ফের বলছি  –  তুমিই বলো

এক বোতল সামান্য ভদকা কীভাবে আমাদের একাট্টা করলো?

ভাই খসরু,

আমার মন এ মুহূর্তে ভরে উঠছে নিখাদ আনন্দে

সরে যাচ্ছে সমুদ্র

দূরে সরে যাচ্ছে পাহাড়  –  পর্বত,

একটি সীমান্ত অতিক্রম করে তারা ঢুকে পড়ছে ভিন্ন সীমান্তে

একদিন প্রভাতে আমরা জেগে উঠবো,

আর প্রত্যক্ষ করবো  –  জলতলে তলিয়ে গেছি আমরা সকলে

বেনোজলে সয়লাব হয়েছে চেনা জায়গা-জমি

ভেসে গেছে বিপুল বন্যায় আমাদের সময় –

আউসউইথসের গ্যাসচেম্বার থেকে বেঁচে যাওয়া ইহুদিদের কাপড় ঝুলছে হ্যাঙ্গারে,

আখরোটের মতো চোখওয়ালা চল্লি­শটি হাজারা মেয়ের ওড়না

ঝুলছে আঙিনায় টাঙানো দড়িতে,

রান্নাঘরের বেসিনে পড়ে আছে ভ্যান গঘের কাটা কান,

এতোদিন যা গোপনে সংরক্ষণ করে আসছিল পৃথিবী –

গাতা  –  গর্ত ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসছে সমস্তকিছু

প্রতিটি গোপন বস্তু ভাসবে এবার,

ভার্জিনিয়া উলফের তিক্ত প্রেম

হিটলারের বিষাদনিবিড় নিঃসঙ্গতা

জখমে বিক্ষত সন্ত্রাসবাদীর দেহ

আর তুমি দেখবে  –  তার সুন্দর চক্ষুকে দেখাচ্ছে কী রকম নিষ্পাপ…

ভাই খসরু,

পারিপার্শ্বিক বিশ্ব আমাকে বিষণ্ন করে তোলে

সূর্যোদয় আর মানুষ

এবং মানুষ বিরান চকে ঘুরছে চক্রাকারে,

গির্জার ঘণ্টাধ্বনি

আমার পিতার কণ্ঠস্বর

আর সেসব রূপসী নারীদের কণ্ঠস্বর  –  যারা পাঠ করে যুদ্ধের সংবাদ।

ভাই খসরু,

আমরা যখন কবিতার নিবিড় পাঠে নিমগ্ন হই

বলতে পারো –

রুয়ান্ডার কতগুলো সমকামী ছেলেকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে মৃত্যুপুরীর সিঁড়ির দিকে?

কান্দাহারে  –  কত জন সাবেক গেরিলা কমান্ডার সম্প্রতি হয়েছে সংসদ সদস্য,

বাগদাদের কত জন নারী আজ বাড়ি ফিরছে কবরখানা থেকে?

বাড়ি-নিজস্ব নিবাস?

আদতে একটি হাস্যকর সান্ত্বনা

কোথাও নেই নিজস্ব নিবাসের অস্তিত্ব,

শহিদ হয় না কেউ

মৃত্যু হয় প্রত্যেক মানুষের –

এবং ক্রমশ তাদের দেহে পচন ধরে

যে রকম হালাবজার কবরখানায় পড়ে আছে হাজার পাঁচেক হাড়।

কলা, আপেল ও দুধের গন্ধ তাদের নেশাগ্রস্ত করে তোলে;

প্রকৃত গন্ধ  –  যে-গন্ধ পেকে ওঠা ফলের।

ভাই খসরু,

এখন থেকে যখনই তুমি অতিক্রম করবে সীমান্ত

বুকভরে টেনে নিও নিশ্বাস,

সীমান্তগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব থেকে ছড়ায় রক্তের গন্ধ।

ভাই খসরু,

ছায়া আমাকে বিষণ্ন করে তোলে,

সীমান্ত সংলগ্ন একটি গাছের ছায়া পড়েছে ভিন্ন দেশে –

ভাই খসরু,

তারা হত্যা করেছে অনেক বৃক্ষ

ধ্বংস করেছে অনেক পাহাড়-পর্বত

নিধন করেছে অনেক অশ্ব ও গবাদিপশু –

কিন্তু কেউ তাদের নিয়ে আজ অব্দি একটি কবিতাও লেখেনি,

তারা বলে, মানুষের বিষয়-আশয় তুলে ধরতে হবে প্রথমে

গুরুত্ব পাবে সদাসর্বদা মানুষ!

ভাই খসরু,

কীভাবে এক বোতল ভদকা আমাদের একত্র করলো আজ

বিষয়টা ব্যাখ্যা করতে পারো তুমি?

এক বোতল ভোদকার পর ভাবো তো সে কারখানার কথা

যেখানে হামেশা নির্মিত হয় টেলিস্কোপিক নিশানাওয়ালা রাইফেল,

যা ব্যবহার করে আইসিস যোদ্ধারা হত্যা করেছে ইয়াজদি শিশু

ন্যাটোর  সৈনিকরা মজা করছে হেলমন্দের কৃষকের সঙ্গে

বারো ইমামের নামধারী আজানা সৈনিকরা

টাফতানের অবৈধ অভিবাসীদের পাঠাচ্ছে দোজখে

উপসাগরীয় শেখরা খোলা আকাশে ছুড়ছে গুলি …

ভাই খসরু,

কখনো  –  সখনো আমি শুনতে পাই দূর থেকে ভেসে আসা ট্রাক্টরের শব্দ

তারা বিপুল মেহনতে তৈরি করছে সিমেন্টের ঘরবাড়ি,

ঠিক যে রকম মা-বাবারা পরিশ্রম করেছে প্রচুর

আর জন্ম দিয়েছে সিমেন্টের শিশুসন্তান।

ভাই খসরু,

সূর্য ক্রমশ অস্তাচলে যাচ্ছে

সূর্যাস্তের মুহূর্ত কয়েক পর

আকাশ ভরে ওঠে লোহিত রেখায়

ছবি তোলার জন্য এ আলোময়তা দারুণ,

আমি চাই অতিক্রম করতে তাবৎ কিছু এমন গোধূলিতে

ভাই খসরু,

সামান্য এক বোতল ভদকা কীভাবে আমাদের নিয়ে এলো কাছাকাছি …

কাব্যে ব্যবহৃত সকল ছবি ইলিয়াস আলভির

www.elyasalavi.com থেকে নেওয়া