আবু ইসহাকের মহাপতঙ্গ গল্পগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। সে-হিসাবে বর্তমান সময়ে গল্পগ্রন্থটি পার করছে এর ছয় দশক। সময়টা নিতান্ত কম নয়। এতদিন পরে যখন ছোটগল্প নিয়ে কথা হচ্ছে তখন ওই গ্রন্থের গল্পগুলি নিয়ে কিছু মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। সেগুলি হতে পারে মোটামুটি এরকম – গল্পগুলির প্রাসঙ্গিকতা কেমন, অভিঘাত কতটা প্রভাববিস্তারী, গভীরতা কতদূর, সমকালীন বাস্তববতায় কেমন এর প্রয়োজনীয়তা কিংবা যে-ক্ষত নিরাময়ের জন্য তিনি লিখলেন এসব গল্প, সেই ক্ষত সমাজ থেকে উৎপাটিত হয়েছে কি না অথবা এগুলির মাত্রা এখন কেমন। এক্ষেত্রে যে-বড় প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তা হলো, লেখক হিসেবে আবু ইসহাকের দূরদৃষ্টি কেমন ছিল? কিংবা সমকাল উতরে মহাকালের দিকে যাত্রার যে অনিঃশেষ প্রাসঙ্গিকতা তা কতটুকু ধারণ করল মহাপতঙ্গ? এ-ধরনের কিছু প্রশ্ন ওঠা অবান্তর কিছু নয়। কারণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো গ্রন্থ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে, আবার কোনো কোনো গ্রন্থ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে। যে-গ্রন্থগুলি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে সেগুলি প্রথমে ঐতিহাসিক তথ্যের জন্য উল্লিখিত হয়। একসময় এর পাঠ বিস্মৃত হয়। শুধু নামটুকু থেকে যায় এর ঐতিহাসিকতা রক্ষার জন্য। তাও স্থান পায় ফুটনোটে বা নিছক কোনো উদ্ধৃতিতে। আর যে-গ্রন্থ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে সেগুলিকে আমরা ঐতিহাসিক মূল্যের পাশাপাশি শিল্পমূল্যে বিচার করি। সেই গ্রন্থগুলিই ‘কালজয়ী’ নামে পরিচিত হয়।
মহাপতঙ্গ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হলেও গল্পগুলি এর আগেই লেখা – ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৯ সালের মধ্যে। সময়ের হিসাবে সবচেয়ে পুরনো গল্প হলো প্রথম গল্প ‘বিস্ফোরণ’ – ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে লেখা। আর সবশেষে লেখা গল্পটি হলো ‘বংশধর’ – ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসে লেখা। সে-হিসাবে গ্রন্থটির বয়স ছয় দশক হলেও গল্পগুলির বয়স তারও বেশি।
ষাট-সত্তর বছর পর গল্পগুলির অন্দরে প্রবেশ করে কী পাওয়া যায়? বলার অপেক্ষা রাখে না, আবু ইসহাক ভবিষ্যতের গল্প বলতেন না। তিনি সবসময় তাঁর সময়ের গল্প বলতেন। অর্থাৎ আজ থেকে সত্তর বছর আগের গল্পই তিনি বলতেন। এতদিন পর সে-সমাজচিত্র কি এক থাকার কথা? না। কিন্তু তিনি যে-সময়ের সমাজচিত্র এঁকেছিলেন আজো তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। শুধু বহিরাঙ্গনের পরিবর্তন হয়েছে। অন্দরমহলের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শুধু বাহ্যিক অনুষঙ্গের পরিবর্তন হয়েছে। ভেতরের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সমাজের এই বহিরাবরণ একটু সরালেই ভেতরের যে-রূপ দেখা যায়, আবু ইসহাক ষাট-সত্তর বছর আগেই তা এঁকে রেখেছেন। বিষয় নির্বাচন বলি বা ক্ষত উন্মোচন – যা-ই বলি না কেন এক্ষেত্রে আবু ইসহাক ছিলেন অনন্য। এজন্য তাঁর আঁকা সমাজচিত্র এখনো সমসাময়িক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সমাজের আসল ক্ষত কোথায়, কোন বিষয়টি তুলে ধরতে হবে, কোন বিষয়ের উত্তরণ দরকার, কোন বিষয়ের সংশোধন দরকার, কোন বিষয়ের নিরাময় দরকার, কোন বিষয়ের সমূলে উৎপাটন দরকার। তিনি এগুলি সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তিনি জানতেন, এগুলি চিহ্নিত না-করলে কখনোই সংশোধন হবে না, কখনোই উত্তরণ ঘটবে না এর পশ্চাৎপদতা থেকে, কখনোই নিরাময় ঘটবে না সমাজের অসুস্থতার। উল্টোদিকে এই নেতিবাচক বিষয়গুলি দিন দিন সমাজের গভীরে প্রবেশ করে একসময় বিষবৃক্ষে পরিণত হবে। তাতে ব্যক্তির মধ্যে, সমাজের মধ্যে অরাজকতা বাড়বে, বৈষম্য বাড়বে, যা একসময় আমাদের পেছন দিকে নিয়ে যাবে। মহাপতঙ্গের চিহ্নায়ন এক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় পর্যায়ে। সেজন্যই এতদিন পরও মহাপতঙ্গ প্রাসঙ্গিক ও উদাহরণীয়। এতদিন পর যে শিল্পকর্ম প্রাসঙ্গিক ও উদাহরণীয় হয়ে থাকে তাকে আমরা কালজয়ী বলতেই পারি।
ছোটগল্পের কাঠামো নির্মাণে তাঁর সমসাময়িক লেখকগণ যখন গল্পের দ্যুতি অধিকতর বিচ্ছুরণের জন্য গদ্যের বুননে মনোযোগী ছিলেন তখন আবু ইসহাক বেছে নিয়েছিলেন সরলরৈখিকতাকে। অন্যরা যখন চিত্রের ভেতরে চিত্রকল্প নির্মাণ করে গল্পের মনোভঙ্গিকে বহুরৈখিক করতে প্রয়াসী হয়েছেন তখন আবু ইসহাক প্রয়াসী হয়েছেন সরলরৈখিকতায়। এই সরলরৈখিকতাকে নিতান্তই স্কেচ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। পৌনঃপুনিকতাবিহীন এই সরলরৈখিক স্কেচ কথাসাহিত্যের একটি দুর্বল উপাদান হিসেবে চিহ্নিত। এই উপাদান আসলে সংবাদপত্রের রিপোর্টিংয়ের বৈশিষ্ট্য। আবু ইসহাক এই কাঠামোভঙ্গি বেছে নিয়েছিলেন।
কিন্তু তিনি একটি চমৎকার বিভাজনরেখা টেনে তাঁর অঙ্কিত স্কেচগুলিকে ভিন্নমাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এই বিভাজনরেখার সবচেয়ে বড় উপাদান ছিল প্রতীক। তিনি প্রতীকগুলি স্কেচের প্রতিটি টানের মধ্যে গেঁথে দিয়েছিলেন। ফলে প্রতীকগুলি একে অপরকে স্পর্শ করেছে। হয়েছে জীবন্ত। এই প্রতীকগুলি এতটাই শৈল্পিক যে, বর্ণনা বা পৌনঃপুনিক আলোকপাত বা ভিন্ন দৃষ্টির প্রক্ষেপণ অর্থাৎ তৎকালীন কথাসাহিত্যের প্রচলিত বৈশিষ্ট্যগুলিকে উজিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠেছে। এভাবে কথাসাহিত্যের একটি দুর্বল উপাদানকে তাঁর নিজস্ব শিল্প-সফলতায় শক্তিশালী উপাদানে পরিণত করেছেন আবু ইসহাক। ফলে আপাত স্কেচধর্মী গল্পগুলিও এতদিন পর সুখপাঠ্য, গতিময়, প্রাসঙ্গিক, জীবন্ত চলচ্ছবির মতো এবং সহজ-সংযোগী। শুধু তাই নয়, সরল বাক্যের ভেতরে তিনি গেঁথে দিয়েছেন গভীর ব্যঞ্জনা – কখনো তা প্রতীকের আধারে, কখনো শ্লেষে, কখনো কৌতুকে, কখনো সুস্পষ্ট প্রতিবাদে। ফলে বর্ণনায় তা ভারাক্রান্ত হয়নি। কিছু সুপ্ত অর্থ গুপ্ত হয়ে থেকেছে বাক্যের পরতে পরতে। তবে ওই গুপ্ত অর্থ পাঠকের পক্ষে আবিষ্কার করা মোটেও কষ্টকর নয়। বরং তা খোলা ও প্রশস্ত। এই ওপেন এন্ডিং উপাদান পাঠককে সুযোগ করে দিয়েছে লেখকের মনোভঙ্গির সঙ্গে তাঁর নিজস্ব মনোভঙ্গির সফল সংযোগে। ফলে মহাপতঙ্গের বর্ণনায় যা দেখা যায়, বইটির গল্পগুলি তারও অধিক।
প্রথম গল্প ‘বিস্ফোরণ’ (জুলাই, ১৯৫৩)-এর কথাই ধরা যাক। সময়ের হিসাবে এই গল্পটা গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলির মধ্যে সবচেয়ে পুরনো। কিন্তু এখনো কি কম প্রাসঙ্গিক? ইয়াসিন, পরীবানু আর কদমতলী গয়না সার্ভিসের মালিক আতাউল্লাহ খাঁর গল্প। কিন্তু ব্যক্তির প্রভাব ছাপিয়ে তা হয়ে উঠেছে সমাজের বৈষম্য, নৈরাজ্য, ভোগ ও শোষণের চিত্র। লঞ্চ সার্ভিস খোলার রুট খুঁজতে খুঁজতে পরীবানুর দেখা পায় আতাউল্লাহ। বয়সের কারণে মাথায় টাক পড়লেও, ঘরে একাধিক স্ত্রী থাকলেও সে পরীবানুকে পছন্দ করে ফেলে। এদিকে তারই কর্মচারী ইয়াসিনের সঙ্গে পরীবানুর ‘জানা-শোনা’। এই অপরাধে ইয়াসিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাধ্য হয়ে ইয়াসিন নৌকা বাওয়ার কাজ শুরু করে। একদিন রাতে যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে ঘুমালে আতাউল্লাহ খাঁর লোকজন ইয়াসিনকে মাঝনদীতে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করে। নৌকা ডুবতে থাকার সময় ইয়াসিনের গায়ে পানির স্পর্শ লাগলে সে জেগে যায় এবং তাৎক্ষণিক পদক্ষেপে সে নিজেকে রক্ষা করে। ইয়াসিন বেঁচে গেলেও গা-ঢাকা দেয়। এলাকাবাসী জেনে যায়, ইয়াসিনের সলিলসমাধি হয়েছে। পরীবানুর সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যায় আতাউল্লাহ খাঁর। বিয়ের দিন সকালে ইয়াসিনের হাত ধরে পালায় পরীবানু। বিয়ের পর পাটকলে চাকরি নেয় ইয়াসিন। তাদের কোলজুড়ে আসে এক সন্তান।
রায়ট লাগে পাটকলে। ইয়াসিন কোনোরকম বউ-বাচ্চা নিয়ে পাটক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। পরে সময়মতো নৌকা দিয়ে অন্য জায়গায় যায়। নৌকার মাঝি তাকে বিনা পয়সায় পার করে। পরে লঞ্চে চড়ে যখন সে অন্য জায়গায় যেতে থাকে তখন লঞ্চের কেরানি তার কাছে ভাড়া চায়। ইয়াসিন আকুতি জানায় তার কাছে ভাড়া নেই বলে। কেরানি মালিকের কাছে নিয়ে যায়। বিস্ময়কর যে, মালিক স্বয়ং আতাউল্লাহ খাঁ।
আতাউল্লাহ খাঁ তার পুরনো ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য লঞ্চ ভাড়ার বিনিময়ে পরীবানুকে একান্তভাবে চায়। পরীবানুর আঁচলে হাত দিতেই ইয়াসিনের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। মাটিকাটা পেশিবহুল শরীরের কাছে আতাউল্লাহর মেদবহুল থলথলে শরীর কুলিয়ে উঠতে পারে না বেশিক্ষণ। ইয়াসিন তার বুকের ওপর চেপে বসে – ‘দুরাত্মা দুঃশাসনের বক্ষ বিদারণ করে ভীম তার রক্ত পান করবে বুঝি?’
কেরানি এসে আতাউল্লাহকে ইয়াসিনের হাত থেকে বাঁচায়। আর বলে – ‘খুব হয়েছে আর নয়। এবার পালাও।’
কৈবর্ত বিদ্রোহের আবহ আর অনুষঙ্গ প্রতীকী রূপে চলে আসে এখানে। কিন্তু অবিকশিত। কারণ ইয়াসিন এখানে প্রস্তুত নয়। তাই তাকে পালাতে বলা হয়। সে পালায় কি না জানা যায় না গল্পটি শেষ হয়ে যাওয়াতে। তবে পরিস্থিতি জানান দেয়, ইয়াসিন পালিয়েছিল। কারণ সে বিস্ফোরিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ভীমরাজের মতো জয়ী হয়নি। তাই তাকে পালাতে হয়।
এদিকে ‘জোঁক’ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৮) গল্পের ওসমানরা পালায় না। কারণ ইতোমধ্যে শোষণের ফলে শোষিত জনগণের ভেতরে অজান্তেই বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে, যা ছিল সম্মিলিতভাবে বিস্ফোরণোন্মুখ।
ভাগচাষী ওসমান। অমানুষিক পরিশ্রম করে পাট চাষ করে। পাটক্ষেতে কাজ করার সময় তার পায়ে জোঁক ধরে। পাট শুকাতে না-শুকাতেই চৌধুরীদের গোমস্তা আসে। দুই ভাগ নায়ে তুলে দিতে বলায় ওসমান হা করে চেয়ে থাকে। গোমস্তা ধমক লাগায়। এক ভাগ দেওয়াতে ওসমান মৃদু আপত্তি জানায়। গোমস্তা তেভাগা আইনের কথা বলে। ওসমান বলে, তাহলে চাষী দুই ভাগ পাবে। গোমস্তা ওসমানকে চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে বলে দুই ভাগ নিয়ে চলে যায়।
ওসমান অগত্যা চৌধুরীর কাছে যায়। কোনো ফল পায় না। উল্টো অভিযুক্ত হয়। লাঙল-গরু কোনার জন্য টাকা নেওয়ার কথা বলে। ওসমান আকাশ থেকে পড়ে। চৌধুরী গত বছর কাগজে টিপসই দিয়ে টাকা নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ওসমান তেভাগা আইনের কথা বললে চৌধুরী শাসায়, ‘যা ব্যাটা বেরো। বেশি তেড়িবেড়ি করলে এক কড়া জমিও দেব না কোন ব্যাটারে।’ ওসমান ভগ্ন হৃদয় নিয়ে ফিরে আসে। ফিরে আসার সময়ে দেখা হয়ে যায় গ্রামবাসীর সঙ্গে। তাদেরও একই অবস্থা। করিম গাজী উদ্দীপ্ত করে ওসমানকে – এর প্রতিবাদ করতে হবে। ওসমানের ঝিমিয়ে পড়া রক্ত জেগে ওঠে। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে, প্রতিবাদে উদ্যত হয়। ছেলেকে বাড়ি চলে যেতে বলে সে অন্যদের সঙ্গে নিয়ে রক্তচোষা জোঁকের (প্রতীকী অর্থে) কাছে যায়।
এই গল্পটি এমন একটি গল্প যার প্রতিটি শব্দ, বাক্য, চরিত্র ও দৃশ্য প্রতীকী। চেনাজানা দৃশ্যকে এমন প্রতীকায়ন করা সহজ নয়। আবু ইসহাক সেটাই করে দেখিয়েছেন। রায়নার তেল গায়ে মাখা দেখে ছেলে জিজ্ঞেস করে তেল মালিশ করলে কী হয় মা। মা বলে, ‘পানিতে কামড়াতে পারে না।’ ‘পানিতে কামড়ায়! পানির কি দাঁত আছেনি?’ ‘আছে না আবার। দাঁত না থাকলে কামড়ায় কেমনে।’ ‘তেরো হাতি ডিঙিটাকে বেয়ে চলে দশ বছরের ছেলে তোতা।’ ‘বাজান কেমুন কইর্যা জোঁক ধরল তোমারে, টের পাও নাই?’ ‘না বাজান। এগুলো কেমন কইরা যে চুমুক লাগায় কিছুই টের পাওয়া যায় না। টের পাইলে কি আর রক্ত খাইতে পারে?’ ‘জোঁকটা কত বড়, বাপপুসরে -’। ‘দূর বোকা! ইডা আর এমুন কী জোঁক। এরচে বড় জোঁকও আছে।’ ‘বেশি তেড়িবেড়ি করলে এক কড়া জমি দেব না কোন ব্যাটারে।’ ‘আইন! আইন করে কি আর আমাদের আটকাতে পারে। আমরা সূচের ফুটো দিয়ে আসি আর যাই। হোক না আইন। কিন্তু আমরা জানি, কেমন করে আইনকে বাইপাস করতে হয়।’ শেষের কথাগুলি ইউসুফের নিজের নয়। পিতার কথাগুলিই ছেলে বলে পিতার অনুকরণে। ‘তার ঝিমিয়ে-পড়া রক্ত জেগে ওঠে। গা ঝাড়া দিয়ে সে বলে, – হঁ চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।’
রায়নার তেল মাখলে পানি কামড়াতে পারে না। ভাগচাষীরা শুধু রায়নার তেল মেখেই পানি কামড়ানি থেকে নিজেদের রক্ষা করে বা করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়। পানি কেন কামড়ায় তার প্রতিকার করতে পারে না কিংবা চিরতরে উৎপাটনও করতে পারে না। শুধু রায়নার তেল মেখে আপাত প্রতিকার খোঁজে। ‘তেরো হাতি ডিঙিটাকে বেয়ে চলে দশ বছরের ছেলে তোতা’ – সামর্থ্যের বিপরীতে অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা অর্থে বলা হয়েছে। স্বাভাবিক অর্থে আবার প্রতীক অর্থেও। এমনকি উপযুক্ত বয়স হওয়ার আগেই দায়িত্বের বোঝা কাঁধে পড়ার তীর্যক শ্লেষও এখানে উপস্থিত। ‘ইডা আবার এমুন কী জোঁক। এরচে বড় জোঁকও আছ।’ বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয় আমাদের সমাজে কত কত বড় জোঁক রয়েছে। দিন দিন ফাঁস হওয়া সেসব জোঁকের খবরে জানা যাচ্ছে – কোনো জোঁকই ছোট নয়। অন্যদিকে এসব ছোট ছোট জোঁক কাঁচির আঘাতে মারতে পারলেও বড় জোঁকের সামনে তো দাঁড়ানোরও সাহস নেই ওসমানদের। ধনলিপ্সু, অত্যাচারী, রক্তচোষা মহাজনেরা ওসমানদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ করতে চায় – তা ধ্বংস হবে কীভাবে? এই মারণযজ্ঞের বলি আর কত ওসমান হবে? প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলবে এই ধ্বংসলীলা!
গল্পটি সম্পর্কে বশীর আলহেলাল মন্তব্য করেছিলেন, ‘পল্লীবাংলার প্রাণকে তিনি উদ্ঘাটন করেছেন। আমাদের সমাজে প্রাচীন ও প্রাগ্রসর জীবনের, উঠতি নাগরিকতার ও সেকেলে গ্রাম্যতার এবং সেইসঙ্গে ধন ও নির্ধনতার যে দ্বন্দ্ব তা তিনি চিত্রিত করেছেন। কেবল তাই নয়, সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণ, অত্যাচার-অনাচারের কাহিনী তিনি লিখেছেন। ‘বিস্ফোরণ’, ‘জোঁক’ ইত্যাদি গল্পে আবু ইসহাক তাঁর জাগ্রত শ্রেণীচেতনার পরিচয় প্রদান করেছেন। এই দুই গল্পে শ্রেণী-সংগ্রামের চিত্র রয়েছে।’
নব্বইয়ের দশকে ‘জোঁক’ গল্পটি আমাদের মাধ্যমিকে পাঠ্য ছিল। এই গল্প তখন যে চেতনার জন্ম দিয়েছিল তা আজো বহমান। এ-গল্প পড়ার পর বুঝেছিলাম শোষণ ও প্রতিবাদ কী জিনিস। জেনেছিলোম এদের রূপ কেমন। পরিণতি কী। পরে বুঝেছি এর ভেতরে প্রবহমান শ্রেণিসংগ্রামের কথা। বুঝেছি সমাজের প্রতিবাদ ও সাম্য চেতনার কথা।
‘খুতি’ (ফেব্রুয়ারি, ১৯৫৪) গল্পটি সৎ পুলিশ অফিসারের সঙ্গে তার ধার্মিক কিন্তু অসৎ অর্থলোভী বাবার মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের গল্প। অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত এবং সচ্ছল ব্যক্তিরা ধীরে ধীরে আশেপাশের তুলনামূলকভাবে দুর্বল অবস্থাপন্নদের শোষণ করে নিজেদের উন্নতি করতে থাকে। বিভিন্ন কূটকৌশলে এরকম ধনীরা দিন দিন তাদের সম্পদ বাড়িয়ে তোলে। তারা আবার সমাজে স্বীকৃত, এমনকি সম্মানিতও। এরকম অপতৎপরতা সমাজও গ্রহণ করেছে স্বাভাবিকভাবে। নিয়মিত ধর্মকর্মই শুধু নয়, নানা ক্ষেত্রে ধর্মের বাড়াবাড়ি করে এরকম কর্মকে আড়াল করতেও এদের কোনো লজ্জা নেই। নেই কোনো অনুশোচনা।
আফজল পুলিশের একজন কর্মকর্তা হলেও কোনো জৌলুস নেই। কারণ তিনি ‘বিশেষ আয়-উপার্জনে’ মনোযোগী নন, আগ্রহীও নন। এমনকি এগুলি তিনি ঘৃণা করেন। ম্যারেজ রেজিস্ট্রার বাবা ভালো করেই জানেন পুলিশ অফিসারদের আয়-উপার্জনের হালহকিকত। তিনিও চান আফজল সেরকম হোক। বৈষয়িকভাবে উন্নতি করুক, শানশওকত বাড়ুক জীবনযাপনে। তিনি মনেপ্রাণে বিশ^াসও করতেন, পুলিশ অফিসার ছেলে বুঝে থাকবে সময়ের চাহিদা। বাবা টাকার জন্য এসেছেন পুত্রের কাছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অন্য দুই ছেলে ‘তলে তলে কাম’ করে অনেক কিছু করতে পারলেও মেজ ছেলে পুলিশ কর্মকর্তা কিছুই করতে পারলো না। কারণ সে সৎ। আপাতদৃষ্টিতে যে সততার কোনো দাম নেই কারো কাছে। বউমার কাছে যখন সে শোনে একবার এক লোক একটা দই নিয়ে জোরাজুরি করে রেখে যাওয়ায় তার ছেলে ড্রেনে ছুড়ে মেরেছিল, তখন আনন্দে খুশি হয়ে উঠেছিলেন বাবা। বলেছিলেন, ‘বাহিরে এরকম কড়া হওয়া ভালো বুদ্ধির কাজ। এতে নামও হয়, আবার তলে তলে কামও হয় ভালো।’
কিন্তু আকবর আলীকে হতাশ হতে হয় যখন পুত্র বাবাকে টাকা দিতে অস্বীকার করে। কীসের টাকা? পাড়ার অভাবি এক লোক দশ মণ ধান ধার করে খেয়েছিল বন্যার সময়। এখনো অভাব দূর হয়নি। পাওনা ধানও শোধ করতে পারেনি। আকবর সাহেব কৌশলে এখন তার জমি লিখে নিতে চান। এজন্য কিছু টাকা লাগবে। সব শুনে আফজল প্রতিবাদ করে ওঠে, বলে, ‘অভাবী লোককে সাহায্য করার জন্য কিস্তির ব্যবস্থা করেন। এভাবে ধারের ধান শোধ হোক। উল্টো জমি লিখে নিলে তো তার অভাব কোনোদিনও দূর হবে না। এই কাজটা খুবই অন্যায় হবে। এরকম অন্যায় করা ঠিক হবে না।’
আকবর আলী হতাশ হয়ে ফিরে যান। পরদিন তাঁর ছেলেমেয়েরা একটা জিনিসের সন্ধান পায়। ডোরাকাটা দাগের লম্বা একটা জিনিস। দুই প্রান্তে মোটা সুতা লেজের মতো ঝুলছে। দাদা যে-জিনিসটা দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘এর ভেতরে শাপ আছে, তোরা ধরবি না। জিনিশটা আসলে খুতি।’ গল্পটা এ-নামেই।
খুতিতে কিছু পাওয়া যায় না। আফজলের মনে পড়ে তখনকার কথা যখন সে বড় ভাইয়ের বাসায় থেকে কলেজে পড়ত। এই খুতিটা পকেটে নিয়ে তার বাবা সেখানে মাঝে মধ্যে যেতেন আর কোমরে বেঁধে বাড়ি ফিরতেন। বিটুইন দ্য লাইন বলে একটা কথা আছে শিল্প-সাহিত্যে। এখানে বিটুইন দ্য লাইন-এ বুঝে নিতে হয়, বাবা খালি খুতি এনে ছেলের বাড়ি থেকে ফেরার সময় কোমরে যে ‘পূর্ণ-খুতি’ বাঁধতেন তার মধ্যে কী ছিল। কিন্তু আফজল বাবাকে হতাশ করে। তাতে তার কোনো গ্লানি নেই।
গল্পটিতে শুধু তৎকালীন জীবনই ফুটে ওঠেনি, ওই ‘সমসাময়িক’ যে এখনকারও ‘সমসাময়িক।’ এই চিত্রের একটুও পরিবর্তন হয়নি। বরং বেড়েছে। সাহিত্যিক আবদুল হক গল্পটি সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘স্বাধীনতার আমলে নব্য উন্নতিশীল ব্যক্তিদের মূল্যবোধ-বিবর্জিত উন্নতির লালসা গল্পটির বিষয়বস্তু। এক আচারনিষ্ঠ মূল্যবোধহীন পিতা আর তার নীতিনিষ্ঠ পুত্রের নিপুণ কনট্রাস্ট গল্পটিতে চিত্রিত।’
‘আবর্ত’ (ডিসেম্বর, ১৯৫৩) গল্পটি শ্রমজীবী মানুষের প্রতারণার গল্প। পাশাপাশি ক্ষমতাবানদের লালসার করুণ চিত্র। এর সঙ্গে রয়েছে ব্যক্তিস্বার্থ। রয়েছে সমাজের গভীরে প্রবাহিত বহুবিবাহ ও কুসংস্কারের মতো শক্তিশালী উপাদান।
ইউনুসের দাদা শহর আলী ও বাবা জহর আলী কলেরা হয়ে কয়েক ঘণ্টা আগে-পরে মারা যান। বাবা মারা যান দুপুরে, আর দাদা মারা যান সন্ধ্যায়। দাদার আগে বাবা মারা যাওয়ায় মুসলিম আইনের বিধান অনুযায়ী ইউনুস উত্তরাধিকারবলে কোনো সম্পত্তি পায় না। ইউনুসের বিধবা মা তাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যায়। ইউনুসের বয়স বিশ পার হলে শোনা গেল, তার চাচা মৃত্যুশয্যায়। খবর পেয়ে ইউনুস চাচার কাছে গিয়ে এককানি জমির আবদার করলে তাঁর মন নরম হয়। ইউনুসকে দেওয়া হলো ফরাজীকান্দির এককোনা জমি। ইউনুস জমি পেয়ে খুশিমনে চাষবাস শুরু করলো। এই জমি চাষবাসের সময় তার সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় লোকমান ফরাজীর কন্যা নূরজাহানের।
চাষবাসের ফলে তার আয়-উন্নতি হলে একদিন তার চাচাকেই মেয়ে দেখার জন্য ফরাজিবাড়িতে পাঠালো ইউনুস। চাচা মেয়ে দেখে পাঁচ টাকাও দিলো উপহার হিসেবে। আশায় আশায় বুক বাঁধা ইউনুস প্রচণ্ড ধাক্কা খেল ধান কাটতে এলে। বাধা দিলো নূরজাহানের বাবা লোকমান ফরাজী। তর্ক-বিতর্কের মাঝে জানতে পারলো, তার চাচা ইউনুস এই জমি বিক্রি করেছেন লোকমান ফরাজীর কাছে। এরপর গোপন অভিসন্ধি ধরা পড়লো যখন দেখা গেল নূরজাহান তৃতীয় বউ হিসেবে গেল ইউনুসের চাচার ঘরে। গ্রাম্য রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে যায় ইউনুস। সে হেরে যায় কূটবুদ্ধির কাছে। মোড়লের লালসার কাছে পরাজিত হয় তার প্রেম। পরের অংশটুকু বহুবিবাহের পরিণতি ও কুসংস্কার নিয়ে। বিয়ের পর বয়স্ক মোড়ল কোনোভাবেই নূরজাহানের মন জয় করতে পারে না। নূরজাহানের মন পড়ে থাকে ইউনুসের কাছে। সে চিৎকার-চেঁচামেচি ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সবার ধারণা, নূরজাহান পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো চিকিৎসাই কাজে লাগছে না। শেষ পর্যন্ত স্বামী উমর আলী মোড়ল এসে নূরজাহানকে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসে। প্রথম স্ত্রীর পরামর্শে নূরজাহানের চিকিৎসা করাতে তৎপর হলো। পদ্ধতিটি হলো, ভোররাতে মোরগ ডাকার পূর্বে গাঙে নিয়ে পাগলকে একশ এক ডুব দিতে হবে। তারপর কাদামাটি লেপে দিতে হবে পাগলের মাথায়। এই রকম কয়েকবার করা হলে রোগীর সর্দি হবে এবং তাহলেই পাগল ভালো হয়ে যাবে।
মোড়ল তাই করে। কিন্তু এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন পদ্ধতির ফল হয়েছিল খুবই করুণ। ডুবের সময়ে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে নূরজাহান ভেসে যায় নদীর স্রোতে। সঙ্গে নিয়ে যায় স্বামী মোড়লের কয়েকগাছি দাড়ি। মোড়ল ভাবে – ওকে নিশ্চয়ই ভূতে ধরেছিল আর একটু হলে ভূত আজ চুবিয়ে মারত তাকেই। ভূতের হাত থেকে রেহাই পেয়ে মোড়ল স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
মোড়ল স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেও একটি জীবনের সলিলসমাধি হয়। অন্যদিকে তাকে ভালোবেসে ইউনুস একদিকে প্রাপ্য চাষের জমি হারালো, অন্যদিকে ভালোবাসার মানুষটিকেও হারালো। মোড়ল নদী থেকে ফিরে গিয়ে পরিবার বা সমাজের কাছে কী বলত তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার স্বস্তির নিশ্বাস ফেলা দেখে। সে ভেবেছিল, নূরজাহানকে ভূতে ধরেছিল। নূরজাহানের এই ভেসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কি অনেক অন্যায়ও প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল না? ইউনুস কোনোভাবেই তার মনের অভাব পূরণ করতে পারবে না, সংসারের অভাবও। নূরজাহানের বাবা জমি পেয়ে ভুলে গেলেও মায়ের ক্ষত সারবে কীভাবে? ওদিকে মোড়ল ভূতে ধরার যে ব্যাখ্যা হাজির করতে পারে বলে মনে হয় তা তো সে প্রতিষ্ঠিত করবেই। সমাজের এই ক্ষত তো আরো সুদূরপ্রসারী। ‘আবর্ত’ গল্পের মাধ্যমে আবু ইসহাক এভাবে সমাজের বহুমুখী ঘাত-প্রতিঘাত ও এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের চিত্র এঁকেছেন।
‘কনট্রাস্ট’ (নভেম্বর, ১৯৫৫) গল্পটি দুই নারীর পরিবার নিয়ে দুই ধরনের ধারণা ও প্রচেষ্টার গল্প। দুই টাকার জন্য কাজের মেয়ে ময়নার মা ঝগড়া করে স্বামীর সঙ্গে। স্বামী রাগ করে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। ময়নার মা ময়নার বাপকে খুঁজতে যাবে। মালকিন রেহানার কাছে সেজন্য কয়েক দিনের ছুটি চায়। রেহানা রাজি হয় না।
রেহানা রাজি না হওয়ার কারণ, কাজের মেয়ে না থাকলে রান্নাবান্না কে করবে? এইসব কাজ সে করতে পারবে না। রাগ করে উঠে গিয়ে বাবাকে টেলিগ্রাম করতে যায়।
অন্যদিকে অকর্মণ্য স্বামীর জন্য কাজের মেয়ের আপ্রাণ চেষ্টা।
রেহানা এই নিয়ে স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে। আর স্বামী কাজের মেয়ের স্বামীভক্তি দেখে মুগ্ধ হয়।
ঝগড়া শেষে খুরশীদ সাহেব ময়নার মায়ের চাওয়া চারদিনের ছুটি নয়, যতদিন লাগে ততদিনের ছুটি মঞ্জুর করেন। তার জন্য মাইনেও পাবে বলে জানান।
গল্পটি শেষ হয় এভাবে, ‘আয়নায় নেই সেই নন্দিতা আর নিন্দিতা। সেখানে এখন শিল্পীর প্রতিচ্ছবি। ছবিটা তার দিকে তাকিয়ে বলছে, সত্যি অপূর্ব কনট্রাস্ট।’
‘গাই নেই, বাছুর নেই, তবুও রুস্তম দুধ যোগান দেয়।
গাই-বাছুর যাদের নেই তারা যোগান দেয় কিনে। কিন্তু রুস্তম কেনেও না দুধ।’ এবাবে শুরু হয়েছে ‘উত্তরণ’ (জুলাই, ১৯৫৯) গল্পটি। বোঝা যাচ্ছে এক প্রতারকের গল্প। কিন্তু এ-প্রতারকের কর্মকাণ্ড জন্মগতভাবে নয়, পরিস্থিতিজনিত কারণে।
একসময় রুস্তমের গাই ছিল। দুধ বিক্রি করে সংসার চালাত। কিন্তু তার গাই দুটো একদিন পাচার হয়ে যায়। সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিশোধ হিসেবে গরু চুরি করার সময় সে ধরা পড়ে যায়। এখন সে কীভাবে সংসার চালাবে? সে পথ বেছে নিল নিজের মতো করে – ধূর্তামির আশ্রয় নিয়ে অসৎভাবে পয়সা উপার্জনের পথ। সে প্রতিদিন পাঁচসেরী একটি পিতলের কলসিতে কিছু পানি ঢুকিয়ে গামছা দিয়ে মুখ বেঁধে রাস্তার পাশে বসে থাকতো। বাচ্চারা বা সরল লোকেরা পাশ দিয়ে দুধ নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে তাড়াহুড়ো করে কিনে কলসিতে ঢেলে দিত। তারপরই দাম নিয়ে দরকষাকষি করে সমপরিমাণ দুধ কলসির মধ্য থেকে ফেরত দিত। এভাবে একসময়ে কলসির পানি দুধে পরিণত হতো এবং দুধের ঘনত্ব বাড়তে থাকতো। তারপর রুস্তম আলী সেই দুধ বিক্রি করত।
এই সৃজনশীল কিন্তু নীতিহীন জীবিকা রুস্তম বেছে নিয়েছিল। এটি নিয়ে তার কোনো অনুশোচনা ছিল না। উল্টো যুক্তি দেখাত,
তবে একসময় তার বোধোদয় হয়। সে ফিরে আসে। সে আবার রাস্তার তেমাথায় দাঁড়ায়। তবে এখন তার কলসি খালি। কলসির মুখে গামছা নেই।
রুস্তমের এভাবে শুভবুদ্ধির উদয় হয়।
বইটির নামগল্প ‘মহাপতঙ্গ’ও (জুলাই, ১৯৫৪) প্রতীকী। একটি চড়ুই পাখির পরিবারের গল্প। তাদের চোখে দেখা মানুষের কাণ্ডকীর্তি। মহাপতঙ্গও একটি প্রতীক। সে-সময়ের যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখানোর জন্যই গল্পটি লেখা। আজো সেখান থেকে উত্তরণ হলো না মানবসভ্যতার।
‘ছোট এক শহরের ছোট বাড়ি। সেই বাড়ির উত্তরদিকের দেয়ালের ফোকরে থাকতো এক জোড়া চড়ুই পাখি।’ মায়াঘেরা সুখছোঁয়া ছোট্ট একটি পরিবারের প্রতীক যেন। এরাই এই গল্পের মূল চরিত্র। তাদের চোখে দেখা মানুষের কাণ্ডকীর্তিই গল্পের মূল উপজীব্য। এই চড়ুই দম্পতির সংসারে আসা চড়ুই ছানার নিরাপত্তা আর একটু খাবার – এই তাদের জীবনের চূড়ান্ত অভীষ্ট। আর কিছু নয়। এই নিয়েই তাদের সব কায়-কারবার। তারা সবসময় সরল ও একরৈখিক চোখ দিয়ে দেখে, ভাবে ও অনুভূতি বিনিময় করে। পরিকল্পনা করে। মানুষকে তারা ভাবে দোপেয়ে দৈত্য, পাখি বা চিলকে বলে ছোঁ-রাক্ষস, বিড়ালকে বলে ম্যাও-খোক্কস, সাপকে বলে কুণ্ডলী ফোঁসফোঁস, কাককে বলে কা-ভক্ষুস। তাদের জানামতে এরাই তাদের প্রধান শত্রু। আর কেউ নয়।
এরই মধ্যে তারা এক হেলিকপ্টার দেখে। বিকট শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে। সবাই সন্ত্রস্ত হয়। কৌতূহলের অন্ত থাকে না। ‘ফড়িঙ-এর মতো পাখা আর লম্বা লেজ। সে এক মহ্–া—া পতঙ্গ। কত বড় না দেখলে বোঝা যাবে না। বোঁ-বোঁ শব্দ করে উড়ে বেড়ায়।’ পক্ষীরাজ্য ভীতসন্ত্রস্ত। এরকম পাখি এর আগে কেউ দেখেনি এদেশে। গাছে গাছে পাখিদের জরুরি সভা বসে। এক পাখি বলে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। এটা মনে হয় শস্যভোজী। মাংসভোজী রাক্ষস নয়। প্রতিবাদ করে অন্য পাখি। বলে, না না এটা নিশ্চয় রাক্ষস পাখি। রাগের চোটে কেমন বোঁ বোঁ করছিল। অন্য পাখি সমর্থন করে, ঠিকই এটা রাক্ষস পাখিই। তর্জন-গর্জন শুনেও বুঝতে পারো না তোমরা? এটা খপাখপ ধরবে আর টপাটপ গিলবে। যদি বাঁচতে চাও তবে এদেশ ছেড়ে পালাও। সব পাখি পালিয়ে যায়। শুধু একটি চড়ুইয়ের পরিবার থেকে যায়।
চড়ুই পাখিরা যেটাকে মহাপতঙ্গ বলেছিল সেটা আসলে ছিল একটি হেলিকপ্টার। সেই হেলিকপ্টার আবার আসে। চড়ুই পাখিদের চোখে যা অবাক করা কাণ্ড। তারা আরো অবাক হয় এই দৃশ্য দেখে যে, এর ভেতর থেকে দোপেয়ে দৈত্য বেরিয়ে আসে। আবার এক এক করে একপাল দোপেয়ে দৈত্য মহাপতঙ্গের পেটের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বো বো ডাক দিতে দিতে আকাশে উঠে দুপাক ঘুরে সূর্যাস্তের দিকে চলে যায় মহাপতঙ্গ।
আসলে বন্যা হয়েছে। হেলিকপ্টার এসে বন্যাকবলিত এলাকায় বাড়ির ছাদে, ঘরের চালে, গাছের ডালে আশ্রয় নেওয়া মানুষদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়। চড়ুই ভাবে, দোপেয়ে দৈত্য এতই শক্তিধর যে ওরা মহাপতঙ্গকেও পোষ মানিয়েছে। শুধু কি তাই, কত কিছুকে তারা যে পোষ মানায়। যেমন হাম্বা হাবা (গরু), ভ্যা-ভোম্বল (ছাগল), ঘেউ-পা চাটা (কুকুর), কুউক্কুরুত (মুরগি), প্যাক-চৈচৈ (হাঁস), ম্যাও-খোক্কস (বিড়াল), চিঁহিঁ টগবগ (ঘোড়া) ইত্যাদি।
বন্যার পানি নেমে যায়। পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে আসে। দোপেয়ে দৈত্যরা ফিরে আসে। শুরু হয় খরা। ফসল হয় না। তখন পহাপতঙ্গ আবার এসে মাঠে নামে। দোপেয়ে দৈত্যরা মহাপতঙ্গের পেট থেকে বস্তা বস্তা চাল বের করে। সুখের বন্যা বয়ে যায়।
এরপর আবার মহাপতঙ্গ ফিরে আসে। প্রচণ্ড শব্দ করে পাক খেতে খেতে নিচের দিকে আসে। আবার উপরে উঠে যায়। আর তার পেট থেকে কী যেন পড়ে। চড়ুই মনে করে ওগুলি নিশ্চয়ই ডিম। বড় পতঙ্গ তো তাই বড় বড় ডিম। কিন্তু চড়ুইয়ের আর কিছু মনে থাকে না। কারণ প্রচণ্ড শব্দ হয়। চড়ুই পাখি মূর্ছা যায়। আসলে মহাপতঙ্গ তথা হেলিকপ্টার থেকে বোমা ফেলা হয়েছে। বোমার শব্দে ও আঘাতে যেখানে মানুষ ও মানবসভ্যতাই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় সেখানে তো নিছক একটি চড়ুই পাখি। অনেকক্ষণ পরে চড়ুইয়ের জ্ঞান ফিরলে তার পরিবারের কথা মনে পড়ে। সে ফিরতে চায় তার পরিবারের কাছে। উড়াল দেয়। কিন্তু কোনো নিশানা ঠিক করতে পারছে না সে। তেঁতুলগাছের চেহারা আগের মতো নেই। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বাড়িগুলি দেখা যাচ্ছে না। যেগুলি দেখা যাচ্ছে সেগুলি ধ্বংসপ্রায়। চড়ুই ফিরে এসে দেখে তার মুনিবের বাড়ি আগের মতো নেই। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইটের স্তূপের ফাঁকে ফাঁকে খোঁজে তার স্ত্রী আর বাচ্চাকে। কোথাও নেই তারা। শুধু এক জায়গায় মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে বাড়ির বাসিন্দা দোপেয়ে দৈত্য। ব্যথায় ছটফট করে চড়ুই। ডানা ঝাপটায়, ঠোঁট দিয়ে বুকের পালক কাটে। কিন্তু কোনো প্রতিকার হয় না। এখন শুধু মাঝে মাঝে ছিছ ছি ছি করে ওঠে ঘৃণার স্বরে। গল্প শেষ হচ্ছে এভাবে, ‘এ ছি ছি কিসের জন্যে? এ ধিক্কার কাদের জন্যে? এ নিশ্চয় তাদের জন্যে যারা ডিম্ববতী মহাপতঙ্গিনীর পেটে চড়ে উড়ে বেড়ায় আর অশান্তি ডেকে আনে।’ অথচ এই চড়ুই-ই একসময় বলেছিল, ‘দো-পেয়ে দৈত্য সমস্ত দুঃখ অশান্তি দূর করতে পারে। ওরা ইচ্ছে করলে আরও সুন্দর করতে পারে পৃথিবীকে।’
গল্পের মূল মেসেজ তো এটাই যা আবু ইসহাক চড়ুই পাখির মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন। সাত দশকের বেশি আগে লেখা এই গল্পের মেসেজ একটুও পরিবর্তন হয়নি। সারাবিশ্বে মহাপতঙ্গের দৌরাত্ম্য এখন এতটাই বেড়ে গেছে যা দেখে আমাদের ধারণা হয়, চড়ুই পাখিগুলি আরো বেশি বেশি ধিক্কার দিচ্ছে আমাদের। এই ধিক্কার আমাদের প্রাপ্য। কিন্তু একটি বড় প্রশ্ন – এর শেষ কোথায়?
প্রতিটি গল্পেই সে-সময়ের যে-চিত্র উঠে এসেছে তা আজো যেন বহমান। শ্রমজীবী মানুষের গল্পের পাশাপাশি এখানে কয়েকটি গল্প রয়েছে সেগুলি তৎকালীন মধ্যবিত্ত চাকরিজীবী সমাজের। এই গল্পগুলির প্রতিটির পটভূমি পশ্চিম পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান হলেও চরিত্রগুলির অন্তরটা বাঙালির। আচার-আচরণও। আবু ইসহাক দেখিয়েছেন, অবস্থান করাচিতে হলেও হৃদয়টা পূর্ব পাকিস্তানে।
আবু ইসহাক এভাবে স্কেচের ভেতরে প্রতীকায়ন করেছেন। সহজভাবে দেখে গভীরভাবে উপলব্ধি করে চিত্রের মতো করে সাজিয়েছেন গল্পগুলি। ফলে চলচ্ছবির মতো ভেসে ওঠে সবকিছু। শনাক্ত করা যায় এর ক্ষতগুলি। বোঝা যায় করণীয় কী। গল্প ও গল্পের চরিত্রগুলিকে এমন জীবন্ত রূপ দেওয়া সহজ নয়। আবু ইসহাক আপাত সহজতার আড়ালে এই কঠিন কাজটিই করেছেন। তাই ষাট-সত্তর বছর পরেও জোঁকের ওসমানকে দেখা যায়, ইউসুফ চৌধুরীদের দেখা যায়, দেখা যায় মহাপতঙ্গের, ‘বিস্ফোরণে’র ইয়াসিন বনাম আতাউল্লাহ খাঁ, ‘খুতি’র পুলিশ কর্মকর্তা ও তার বাবা আকবর আলী, ‘আবর্তে’র ইউনুস, তার মোড়ল চাচা ও লোভী লোকমান ফরাজী এগুলোর যেন শেষ নেই। চলছে শোষণ। চলছে অন্যায়। চলছে হঠকারিতা। চলছে পেষণ। আজ থেকে সত্তর বছর আগে চিত্রিত এইসব অন্যায্যতার যেন শেষ নেই। আছে কি? হয়তোবা আছে। লেখক যার আভাস দিয়ে যান গল্পের অন্দরে-বাইরে কিংবা চরিত্রের মুখ দিয়ে। যেমন আভাস পাই আমরা ‘জোঁক’ গল্পের ওসমানের কাছে। যদি ওসমানের পরিবর্তিত রূপে নিজেদের রূপান্তর করা যায় তার ভেতরে। কিংবা দেশের সব ওসমান যদি ‘জোঁকে’র ওসমান হয়ে যায়! তখন। কিন্তু ওসমানদের জেগে ওঠার উসকানি নেই।
যে-সময়ে গল্প লিখেছিলেন আবু ইসহাক সেই সময়টা মোটেও এইসব বক্তব্য ধারণের অনুকূল ছিল না, সামর্থ্যও ছিল না। না সমাজে, না শিল্প-সাহিত্যে, না রাষ্ট্রে। অসহিষ্ণু সরকার ও প্রশাসন। সত্য কথা বলার জন্য নানা ধরনের খড়্গ প্রস্তুত ছিল ওই সময়ে। প্রয়োগও হতো সময়ে অসময়ে, কারণে অকারণে কিংবা বিভিন্ন অজুহাতে। তবুও তিনি বলেছিলেন দ্ব্যর্থহীন। কারণ তাঁর ভেতরে ছিল শিল্পের সাহস। সে-সাহস তাঁকে এরকম শিল্পকর্মে ব্রতী করে তুলেছিল। আজ এতদিন পর নতুন নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে ইসহাক-চিহ্নিত ক্ষতগুলির মধ্যে। কিন্তু ক্ষীণস্বরেও তা উচ্চারিত হচ্ছে না। আবু ইসহাকের সাহসী কলমের কালি ক্ষতগুলিকে যে-মাত্রায় চিহ্নিত করেছিল তা দেখে আজো আমরা উদ্দীপিত হই – কারণ ওসমান। ওসমানরা আছে। যে-কোনো সময় তারা বলে উঠবে আবার, ‘অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।’
প্রকৃত লেখকের কাজ তো তাই-ই, যা ভবিষ্যতের বর্তমানকেও উদ্দীপিত করবে, আশা জাগাবে বছরের পর বছর।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.