আমার পড়া এক সেরা উপন্যাস মৌর্য

তাপস যখন আমার কাছে এসে জানাল যে, মেŠর্য উপন্যাসের প্রকাশনা উৎসব হবে, আমাকে আসতে হবে, কথা বলতে হবে, তখন আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল, আমি যেতে পারব না। এখন চোখে দেখি না, কানে শুনি না, মাথায় কিছু ঢোকে না এবং মনে কিছু থাকে না। এতবড় বিশাল একটি উপন্যাসগ্রন্থ পড়তে হবে, তারপরে এখানে এসে সুধীজনের সামনে দাঁড়াতে হবে – এটা আমি চাইনি। বাইরে কোথাও যাই না। ঘরে থাকি। ফলে কথা বলার অভ্যেস আমার চলে গেছে। পরে বইটি পড়েছি। পড়ার পরে আমি সাগ্রহে এবং গভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগের সঙ্গে এই লেখককে আমার অভিনন্দন জানানোর জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশনা উৎসবে আসি।
বইটি আমাকে অবাক করে দেয়। এ-জাতীয় সাহিত্য, কথাসাহিত্য হোক, কাব্য হোক অথবা অন্যান্য কোনো প্রকার লেখা হোক, তার ভেতরে এমন উৎকর্ষে পৌঁছানো, বাংলা ভাষায় বিরল বলেই আমি মনে করি। আমার পড়াশোনা খুব বেশি না। আমি অন্যমনস্ক অগোছালো এবং নিতান্তই বাজে পাঠক। তাই আমার কথা সব শুনতে হবে – এটা আমি মনে করি না। কিন্তু আমার যেটুকু পড়াশোনা, তাতে আমি এই বইটিকে সম্পূর্ণ অনন্য বলে মনে করি। বইটি লেখার পেছনে লেখক আবুল কাসেম যে শ্রম ও নিষ্ঠা এবং সততার পরিচয় দিয়েছেন তার সবকটিকেই গভীরভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে আমি অনুভব করি। এখানে যে-কালটি তিনি ধরেছেন সেই কালটিকে ধরার জন্যে তাঁকে, আমার অনুমান, গভীরভাবে ভারতীয় মহাকাব্য, বিশেষ করে রামায়ণ, মহাভারত পড়তে হয়েছে এবং পাশ্চাত্য সাহিত্য বিশেষ করে, ইলিয়াড তাঁকে আত্মস্থ করতে হয়েছে। তাই এ-বইয়ের ভাষা মহাকাব্যিক। কেউ যদি রামায়ণএবং মহাভারত পড়ে থাকেন এবং মৌর্য পাঠ করেন, তাহলে আমার সঙ্গে একমত হবেন, সেই মহাগ্রন্থ দুটোর শৈলীর অনুরণন, তাদের ঝংকার এবং যে সারল্য ও সারল্যের সঙ্গে যে ভাষার মর্যাদা – এসব এ-বইটাতে সবিনয় দক্ষতায় সঞ্চারিত হয়েছে এবং শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তা কোথাও তাল কাটেনি। গ্রন্থটিতে ইলিয়াডের প্রভাব আছে। হেলেনের মৃত্যুর পরে অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়ায় গ্রিকরা অর্থাৎ হেলেনের আত্মীয়স্বজন যে প্রোথিসিস বা অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়ার ব্যবস্থা করেছেন, তা ইলিয়াডের আদলে করা। আপনারা জানেন, ইলিয়াডে হেক্টরের মৃত্যুর পর তাঁর পিতা প্রায়াম এবং হেক্টরের স্ত্রী আন্দ্রোমাশে তাঁদের একান্ত আপনজনের মৃত্যুতে যে আক্ষেপে দীর্ণ হয়েছেন ও মর্যাদাপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন, তাদেরই প্রতিফলন এ-বইতে পাই। হেলেনের মৃত্যুর পর, প্রথা অনুযায়ী তাঁর ঘনিষ্ঠ গ্রিক আত্মজনদের এবং স্বয়ং চন্দ্রগুপ্তের তাঁর অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে ভাবগম্ভীর ভাষণে। কিন্তু এটা নয় যে, লেখক অনুকরণ করেছেন। অনুভবে এটাকে তিনি আমাদের ঐতিহ্য-আশ্রিত ভাষায় যে নিরাসক্তি, যে ব্যাপ্তি, যে প্রসাদ এবং সবকিছু একত্র করে যেরকম মহাকাব্যিকভাবে এবং তার সার্বিক সমন্বিত প্রগাঢ় বার্তা ফুটিয়ে তুলেছেন, তার জন্য, তাঁর কাছে পাঠক হিসেবে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সত্যিকারের একটি ভালো বই পড়ার সুযোগ ঘটল। প্রচুর বইয়ের মধ্যে খুব বেশি ভালো বই যে পাওয়া যায় তা নয়, ওপরচালাকি থাকে অনেক জায়গায়। এখানে ওপরচালাকি আছে বলে আমার মনে হয়নি। গভীরভাবে অনুসন্ধান করে এবং আন্তরিকভাবে এ-বিষয়টির সঙ্গে একাত্ম হয়ে সেই সময়টিকে ধরে তাকে তিনি এখানে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন রসম–ত নানা কথার ভেতর দিয়ে, যার অনুরণন আমাদের মধ্যে দীর্ঘদিন থেকে যায়। আমি চাই বইটি ভালো পাঠক এবং বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছুক। আমার বিশ্বাস, পড়তে শুরু করলে কোনো অনুভূতিপ্রবণ পাঠক বইটি শেষ না করে ফেলে রাখতে পারবেন না।
আমি নিজেই আমার সীমাবদ্ধতার কথা বলি। আবুল কাসেম সম্পর্কে শুরুতে যে সংক্ষিপ্ত পরিচিতি পেলাম, সত্যি কথা বলতে কী, আমি এসব প্রায় কিছুই জানতাম না। বইটি পড়ার আগে আমি এটা জেনে বিস্মিত হই যে, তিনি একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। একজন দায়িত্ববান সরকারি কর্মকর্তা যেখানে অফিসের কাজে পুরো সময় দিয়ে তারপরে নিজের জন্য আলাদা করে সময় রেখে সে-সময়টায়, হালকাভাবে কিছু লিখে নয়, সিরিয়াস রকম একটি নয় – একাধিক বই লিখে হাসান আজিজুল হকের মতো বিখ্যাত সাহিত্যিকের প্রশংসা পান, তাঁর বই নিয়ে কথা বলা যেকোনো লোকের পক্ষে একটি শস্নাঘার বিষয়।
আমি তাঁর এই যে কৃতিত্ব – তার জন্য তাঁকে আমার অভিনন্দন জানাই। এখন বইটির প্রেক্ষাপট বা পটভূমি নিয়ে কিছু বলতে চাই। আজ থেকে ২৩০০ বছর আগের একটি পটভূমিতে লেখা এ-বইটি লিখেছেন এবং যাঁকে নিয়ে লিখেছেন, তিনি ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি। নাম চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তাঁর জীবনের কাহিনিটি ইতিহাসের সঙ্গে মিলিয়ে লেখক একটি উপন্যাস আকারে এটিকে পরিস্ফুটিত করে তুলেছেন। বৃহৎ উপন্যাস। সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার বই। বইটিতে কেউ কেচ্ছা-কাহিনি পড়বেন না। গল্প বলা কিংবা ঘটনা বর্ণনার পরিমিতিবোধের সঙ্গে সঙ্গে রুচিবোধ, সাহিত্যবোধ-ভাবনা বইটিকে যেমন উচ্চতা দিয়েছে, তেমনি পাঠকের মনোজগৎকেও উঁচুতে তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। আমার কাছে এ-জাতীয় বই খুব বিরল বলেই মনে হয়। এই ধরনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যত উপন্যাস লেখা হয়েছে, তার মধ্যে অগ্রগণ্যগুলোর মধ্যে আমি এই বইটিকে স্থান দিতে চাই। সাম্প্রতিককালে এরকম দ্বিতীয় কোনো বই লেখা হয়েছে বলে আমি জানি না। আমার কাছে মনে হয়, যাঁরা এ-জাতীয় বই লিখেছেন, তাঁরা কিন্তু অধিকাংশই সময়ের আবহটাকে ঠিক সেভাবে তুলে আনতে পারেননি। কাহিনিটিকে আজকের ভাষায়, আজকের চিমত্মা-ভাবনায় সংশিস্নষ্ট করে তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন। মৌর্যতে আমরা দেখি, তিনি সেকালে আমাদের ট্রান্সপোর্ট করছেন, আমাদের সেখানে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন এবং সেখানকার সৌরভ আমাদের মাঝে বিলিয়ে দিচ্ছেন। সেখানে তেইশশো বছর আগের কৌটিল্য, তাঁর অর্থশাস্ত্র, আচার্য ভদ্রবাহু এবং তাঁর ‘কল্পসূত্রে’ বর্ণিত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, ধর্ম ও সাহিত্যিক পরিম-লের সঙ্গে যেমন আমরা পরিচিত হয়ে উঠছি, তেমনি প্রাচীন গ্রিস, কিংবা সেলুসিয়রেও আমাদের পরিভ্রমণ ঘটছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যের ‘স্বপ্ন’ কবিতায় দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ কবি কালিদাসের কাব্যভেলায় চড়ে কতগুলো অনুচর শব্দকে (কুরুবক, লোধ্ররেণু) সঙ্গে নিয়ে প্রাচীন ভারতে প্রবেশ করছেন, মৌর্য উপন্যাসেও ক্ষত্রিয়ানী ত্রিশলার স্বপ্ন যেন আমাদের সামনে আরো কয়েকশো বছর আগের প্রাচীন ভারতের স্বপ্নের দুয়ার খুলে দিচ্ছে। ঐতিহ্য হিসেবে প্রাচীন গ্রিসের ধর্মাচার, বিবাহরীতি, সংগীত-সাহিত্য, পুরাণ সবই এসে যুক্ত হচ্ছে ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে। মানবসভ্যতা এবং
কৃষ্টির দু-ধারার বন্ধন ঘটছে যেন অবলীলায়। প্রাচীন বসন্ত উৎসবে ভারতীয় ‘কামভাব’ আঙ্গিকের সংগীত ও নৃত্য, গ্রিসের সংগীত ও নাট্য প্রতিযোগিতা এবং মিশরের পিরামিডে অংকিত চিত্রের মধ্যে লেখক যে-সাযুজ্য খুঁজে বের করেছেন, তা এক কথায় অসাধারণ। তা থেকেই বোঝা যায়, এ-উপন্যাসের লালন হয়েছে কতখানি উচ্চতায়। প্রায় আট হাজার বছর আগের চীনের বারো ছিদ্রের হাড়ের বাঁশি যেমন তার চরিত্র নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি দেবতা অ্যাপোলোর কীর্তিময় বীণা যেন রাবণের ‘রাবণহাতার’ সঙ্গে হাত ধরে হাঁটাহাঁটি করছে। আমাদের বুঝতে পারাই কষ্টকর যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের আভিজাত্য এবং ঐশ্বর্যের পাশাপাশি লেখক ইতিহাস এবং বিশ্বঐতিহ্যের কোন অসীমে আমাদের তুলে নিয়ে যেতে চাইছেন।
উপন্যাসে চরিত্র সৃষ্টির কথা না বললেই নয়। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সেলুকাস, হেলেন এবং মেগাস্থিনিস-এর একটি দিক, আরেকটি দিকে আছেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, আচার্য ভদ্রবাহু, মহামন্ত্রী চাণক্য এবং হেলেন। চন্দ্রগুপ্ত এবং হেলেন দুদিকেই আছেন। এঁরাই নায়ক-নায়িকা। প্রধান চরিত্র তিনটি – সেলুকাস, মহামন্ত্রী চাণক্য এবং আচার্য ভদ্রবাহু। সহযোগী চরিত্র বা সাপোর্টিং ক্যারেক্টার আছে অজস্র। এসব চরিত্র – যাকে যেখানে প্রয়োজন সেভাবে তিনি সৃষ্টি এবং ব্যবহার করেছেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, সেলুকাস, আচার্য ভদ্রবাহু, চাণক্য, মেগাস্থিনিস এবং হেলেনের চরিত্র-চিত্রণের ক্ষেত্রে ইতিহাসকে সামনে রাখা হয়েছে। তারপরও লেখক প্রচুর স্বাধীনতা ভোগ করেছেন। সকল চরিত্রকে ইতিহাসের কঙ্কাল থেকে মুক্তি দিয়ে রক্তমাংসের মানুষে পরিণত করেছেন। এসব মানুষের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য উপন্যাসের কাঠামোর মতোই শৈল্পিক, দার্পিক এবং চিরন্তনিক।
মহামন্ত্রী চাণক্য এবং আচার্য ভদ্রবাহু দুজনই ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পদপ্রদর্শক। চাণক্য রাজনৈতিক গুরু, আর ভদ্রবাহু আধ্যাত্মিক গুরু। এঁদের দুজনের মধ্যে প্রচলিত ধারণামতে বিরোধ বা দ্বন্দ্ব থাকার কথা। কিন্তু লেখক তাঁদের মধ্যে গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তার কারণ সম্ভবত এই, বড় চরিত্রগুলো বিবাদে জড়িয়ে খাটো হয়ে যায়, এছাড়া এঁরা এত উচ্চ পর্যায়ের যে, বড় চিমত্মার কথা বলে কিংবা উপন্যাসের প্রয়োজনে লেখক তাঁদের মধ্যে মিলমিশটা জরুরি বলে মনে করেছেন। তবে অবাক হতে হয় চাণক্যকে নিয়ে। তিনি এখানে প্রায় নেগেটিভ ক্যারেক্টারের কাছাকাছি। অবশ্য এজন্য লেখককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি যা করেছেন, যৌক্তিকভাবেই করেছেন। আনুমানিক পঞ্চম শতকে বিশাখদত্ত তাঁর মুদ্রারাক্ষস নাটক এবং উনিশ শতকের শেষের দিকে ডিএল রায় চন্দ্রগুপ্ত নাটকে এ-কাজটিই করেছেন। মৌর্য উপন্যাসে আচার্য ভদ্রবাহুই বেশি গুরুত্ব পেয়েছেন। তাঁর প্রতি লেখকের পক্ষপাতিত্ব আছে বলে মনে হয়। মেগাস্থিনিসকে কৌতুক চরিত্রে পরিণত করেছেন সম্ভবত স্ট্রাবোর পরামর্শে, যিনি মেগাস্থিনিসের বিবরণকে মিথ্যে বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে প্রেমিক হিসেবে মেগাস্থিনিস এবং তাঁর উপ-প্রেমকাহিনির বহমানতা উপন্যাসটিকে সমৃদ্ধ করেছে। নিষ্কাম প্রেমের মহিমা তাঁকে ঘিরেই কীর্তিত হয়েছে। মেগাস্থিনিসের চরিত্র কূটনীতিকের চাইতে বেশি মানবিক। তিনি উলটোপায়ের নির্বাসিত মানুষদের সামাজিকভাবে পুনর্বাসিত করে তবে ক্ষান্ত হয়েছেন।
মৌর্য উপন্যাসের আরো কয়েকটি দিক বিস্ময়ের উদ্রেক না করে পারে না। মানবেতিহাসের সবচেয়ে বড় যুদ্ধগুলোর একটি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এবং সেলুকাসের যুদ্ধ। মেগাস্থিনিসের বিবরণমতে, সে-যুদ্ধে মৌর্যদের সৈন্যসংখ্যা ছিল ছয় লাখ এবং সেলুসিড আর্মি ছিল তিন লাখেরও বেশি। সে-সময়ে যুদ্ধটা হতো দিনক্ষণ ঠিক করে, পূর্বঘোষণা দিয়ে। নয় লাখ সৈন্যের সমাবেশ কোথায় হয়েছিল, তা এক কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন। ঔপন্যাসিক মনে হয় যথার্থই বলেছেন, থর মরুভূমি ছিল তার উপযুক্ত স্থান। শুধু নয় লাখের বেশি সৈন্যই নয়, মৌর্যদের ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী, নয় হাজার গজারোহী এবং অজস্র ষাঁড় ও গর্দভ টানা গাড়ির কথা উল্লেখ রয়েছে। অপরপক্ষে তিন লক্ষাধিক পদাতিক সৈন্য ছাড়াও এদের ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার অশ্বারোহী এবং অনেক উট ও খচ্চর-টানা যানবাহন। এসবের জন্য বিসত্মৃত যুদ্ধ-ময়দানের দরকার ছিল। থর মরুভূমি ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবাই যায় না। যুদ্ধপ্রস্ত্ততি এবং পরিকল্পনাটা লেখক নিয়েছেন কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে।
এ-যুদ্ধে যেসব যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে তার বর্ণনাও আছে এ-উপন্যাসে। আমাদের অবাক হতে হয়, সকল পৌরাণিক দেব-অস্ত্রের ব্যবহার দেখে। রামায়ণ-মহাভারতে যেসব অস্ত্র ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে, লেখক এ-যুদ্ধে মৌর্যদের হাতে সেসব তুলে দিয়েছেন। যুদ্ধের আগে এ অস্ত্রের বর্ণনা শুনে সেলুকাস পর্যন্ত চিমিত্মত হয়ে পড়েছিলেন। অপরদিকে, ইলিয়াড মহাকাব্যে বর্ণিত ট্রয়ের যুদ্ধে ব্যবহৃত ‘দোরি’সহ সকল দেব-অস্ত্র এবং সেলুসিড আর্মির উদ্ভাবিত নব-নব অস্ত্র (সারিসাসহ) ব্যবহার করতে দেখা যায় গ্রিকদের। এছাড়া আছে উভয়পক্ষের যুদ্ধকৌশল এবং যুদ্ধবর্ণনা। কী অসাধারণ এসবের উপস্থাপনা! অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি উদ্ধৃতিসহ মেঘনাদবধ কাব্যের যুদ্ধবর্ণনার কথা বলেছেন। যুদ্ধশেষের বর্ণনাটা অত্যন্ত করুণ ও হৃদয়বিদারক। রামায়ণ-মহাভারত-ইলিয়াডে এরকম করুণ দৃশ্য আছে। সারা থর মরুভূমিতে চিতা জ্বলছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের যুদ্ধজয়ে আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং বিশাল মানবিক বিপর্যয় দেখে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। এটা ছিল মৌর্যদের প্রাথমিক বিজয়। তাই চিমত্মায় পড়ে যান চাণক্য। গ্রিক সৈন্যরা পালিয়ে গিয়ে সিন্ধু নদের পাশে পাহাড়ি জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। প্রস্ত্ততি নিয়ে যে-কোনো সময় হামলে পড়তে পারে। সম্রাটকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে চাঙ্গা করে তুলতে হবে। তাই মহামন্ত্রী চাণক্য আধ্যাত্মিক গুরু আচার্য ভদ্রবাহুকে পাটালিপুত্র থেকে আনিয়ে নিলেন চন্দ্রগুপ্তের মানসিক শুশ্রূষার জন্য।
চূড়ান্ত যুদ্ধজয়ের নাটকীয়তা এ-উপন্যাসের আরেকটি গৌরবদীপ্ত দিক। সেখানে হেলেন যে বক্তব্য দিয়েছেন তার তুলনা নেই। হেলেনের বিয়ের ব্যাপারে চুক্তির শর্তে বাবা হিসেবে সেলুকাসের যে আপত্তি এবং হাহাকার তা আমাদের ইলিয়াডের প্রায়ামের কথা আবার মনে করিয়ে দেয়।
তবে দুটো বিষয় আরো বিস্ময়কর উপস্থাপনা মনে হয়েছে আমার কাছে। একটি হলো হেলেনের আচার্য ভদ্রবাহুর ‘কল্পসূত্রে’ বর্ণিত দেবীর পোশাক পরিধান করে বিয়ে এবং অপরটি এ-বিয়ের পোশাকে সম্রাটের প্রাসাদে বাসররাত কাটানোর পরিবর্তে যুদ্ধের ময়দান থর মরুভূমিতে পূর্ণিমার চাঁদেরআলোয় নিখিলের বাঁশি শোনার অভিপ্রায়। সম্রাট দুটোই মেনে নিয়েছেন। হেলেনের কেন এ-খেয়াল, তা রহস্যময়। তার ব্যাখ্যা কিংবা প্রতীকী কোনো ইঙ্গিত উপন্যাসের কোথাও নেই। যুদ্ধের আগে এই নিখিল নিরো কিংবা ইস্রাফিলের শিঙার মতো ধ্বংসের বাঁশি বাজিয়েছিল। যুদ্ধের সময় সে পালিয়ে যায়। হেলেনের ইচ্ছায় চন্দ্রগুপ্ত তাঁকে খুঁজে বের করেন। যুদ্ধে চিতা জ্বলার দৃশ্য হেলেনও দেখেছিলেন। ধ্বংস আর হৃদয় বিদীর্ণ করা সব দৃশ্য। সেখানে চন্দ্রালোকিত পূর্ণিমার রাত (প্রাচীন গ্রিসে পূর্ণিমার রাতে বিয়ের রীতি প্রচলিত ছিল) কাটালেন নিখিলেরই প্রেমের বাঁশি (শ্রীকৃষ্ণ-রাধার কথা মনে হতে পারে) শুনে। কী অসাধারণ বৈপরীত্য! বিয়েতে বর-কনের তৈলচিত্র আঁকার রেওয়াজ চালু করেছিলেন জনক রাজা। রাম এবং সীতার বিয়ের চিত্র আঁকিয়েছিলেন তিনি। এ-উপন্যাসে হেলেনদের বিয়ের ছবিও আঁকতে দেখা যায়। মনে হয় লেখক প্রাচীন ঐতিহ্যের সবটুকু উজাড় করে দিতে চেয়েছেন।
প্রকাশনা অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় লেখক আবুল কাসেম বলেছেন, উপন্যাসটির শেষাংশ, চন্দ্রগুপ্ত যেখানে সিংহাসন ছেড়ে আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে দিগম্বর সন্ন্যাসীর বেশে চলে যাচ্ছেন, ছিল সম্পূর্ণভাবে স্পিরিচুয়াল। বইটির পা-ুলিপি হারিয়ে গেলে শেষাংশ আবার নতুন করে লিখতে হয়। তাতে তিনি শুধু স্পিরিচুয়াল দিকটিই না রেখে তার সঙ্গে অন্ধ্রের যুদ্ধে নির্দোষ মানুষের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া এবং হেলেনের মৃত্যুতে সম্রাটের যে যন্ত্রণা ও বিরহ তা যুক্ত করে যৌক্তিক এবং বাস্তব পরিপ্রেক্ষিতকে কারণ হিসেবে দাঁড় করান। তাতে উপন্যাসটির সমাপ্তি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আমি তাঁর সঙ্গে একমত। ইতিহাসে আছে মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে তরুণ রাজপুত্র বিন্দুসারের হাতে সিংহাসন ছেড়ে দিয়ে চন্দ্রগুপ্ত আচার্য ভদ্রবাহুর সঙ্গে দাক্ষেণাত্যে চলে যান। লেখক তাঁর চলে যাওয়ার শেষ দৃশ্যের বর্ণনায়ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। চিত্রকল্পটি অসাধারণ। বারো হাজার দিগম্বর সন্ন্যাসী জড়ো হয়েছেন দাক্ষেণাত্যের উদ্দেশে অভিযাত্রার জন্য। তাঁদের সঙ্গে আছেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। আচার্য ভদ্রবাহু তাঁকে তাঁর কালো পোশাক পরিহিত অবস্থায় থাকতে বলেছেন। কারণ, তাঁকে নতুন সম্রাট বিন্দুসার, মহামন্ত্রী চাণক্য এবং অন্যদের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। বিদায় নিয়ে আবার দিগম্বর জনারণ্যে ঢুকে পড়েন চন্দ্রগুপ্ত। বিশাল অভিযাত্রীদল যাত্রা শুরু করে। যেতে যেতে একসময় দৃষ্টিসীমার আড়াল-দূরত্বে চলে যায়। শুরুর জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ একজন দেখেন একজোড়া কালো বস্ত্র ভূমিতে পড়ে আছে। মহাবীরের শেষযাত্রার মতো তাঁর শেষ পোশাকটিও ছেড়ে গেছেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।
এ-কথা বলার সঙ্গে আমি দুয়েকটি জায়গার কথা বলব, অবশ্য এগুলো উপন্যাসের সার্বিক বিচারে অবান্তর, যেগুলো কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করতে পারে। প্রথমত, তক্ষ্মশীলা থেকে পাটালিপুত্র আসতে পু-্রবর্ধন বা মহাস্থান হয়ে আসাটা ঠিক নয় বলে মনে হয়েছে। কারণ আমরা জানি, কালিদাস একজন উন্মত্ত ও নির্বাসিত প্রেমিকের মানসিক বৈকল্য ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর মেঘদূত কাব্যে। কিন্তু সেখানে খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, মেঘদূতের মেঘের যে যাত্রাপথ তা খুব মেটিকুলাসলি উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম বায়ুর দিককার যাত্রাপথ থেকে সরে যায়নি। সে যাত্রাপথে অবস্থান করে ভেসে চলেছে। এখানে যদি আমরা তক্ষ্মশীলা থেকে পাটালিপুত্র আসতে চাই তাহলে পু-্রবর্ধন বা মহাস্থান হয়ে যাব না। কারণ, পু-্রবর্ধনের অবস্থান বিপরীত দিকে। তবে প্রয়োজনে ঘুরে আসতে চাইলে যাওয়া যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, আমরা সবসময় বলি যে, অখ- ভারত মানেই বর্তমান ভারত। এই ভারতটাও কিন্তু সুদীর্ঘকালের নয়। আমাদের জানা ভারত ব্রিটিশদের সময় থেকে পাওয়া। ব্রিটিশ ভারত থেকে যখন আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে ভারতের কথা ভাবি তখন আমরা অখ- বলতে তাকেই বুঝতে থাকি। এছাড়া, ২৩০০ বছর আগে এ-ভূখ- যতটা কান্দাহার, যতটা তক্ষ্মশীলা ছিল ভারতের, ততটাই ছিল পারস্যদেশের। গ্রিসেরও হতে পারে। তাই, সেটা একই সঙ্গে ভারতীয়, একই সঙ্গে গ্রিক এবং একই সঙ্গে পারসীয়। লেখক যথার্থ লিখেছেন যে, তক্ষ্মশীলায় বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাত্ররা শিক্ষার জন্য আসতেন এবং এই উপমহাদেশ থেকেও তাঁরা যেতেন। সেটা সম্পূর্ণভাবে একটা বিশ্বসংস্কৃতির বিকাশকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল। ৩২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে চনদ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই মৌর্য শাসনের যিনি প্রতিষ্ঠা করলেন তাঁর এবং তাঁর পেছনকার কথাও সঠিক সন-তারিখসহ লেখক আমাদের জানিয়েছেন। এখানে তিনি চাণক্যের ওপর অনেকখানি নির্ভর করেছেন এবং চাণক্য তাঁকে পরিচালিত করেছেন। এই চাণক্য এবং কৌটিল্য একই ব্যক্তি। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের যদি আমরা বিচার করি, তাহলে দেখব, লেখক সুকৌশলে তাঁর উপন্যাসের ভেতরে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং মেগাস্থিনিসের বিবরণসহ ওই সময়ের প্রাচীন আকরগ্রন্থগুলো ব্যবহার করেছেন, যাতে এই উপন্যাসটির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বিষয়বস্ত্ত সমৃদ্ধির চূড়া স্পর্শ করতে পারে। সেলুকাসের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ শুরু হয় ৩০৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, শেষ হয় ৩০৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। উপন্যাসে দেখা যায়, পরাজয় বা জয়ের ভিত্তিতে নয়, প্রেম এবং পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে সেলুকাস তাঁর কন্যাকে বড় বোনের মধ্যস্থতায় মৌর্য সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছেন।
অবশ্য একটি বিকল্প ধারণাও আছে। তা হলো, গ্রিক কন্যার সঙ্গে বিন্দুসারের বিয়ে। বিন্দুসারের সঙ্গে বিয়ে হওয়াটা অনেক সংগতিপূর্ণ বলে মনে হয়। ২৫ বছর বয়সে খ্রিষ্টপূর্ব ৩২১ অব্দে চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে আরোহণ করেন। আর ৩০৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে সেলুকাস শামিত্ম চুক্তি স্বাক্ষর করে মেয়েকে সম্প্রদান করেন। তবে ওই সময়ের বিচারে বিন্দুসারের সঙ্গে যদি তার বিয়ে হয়ে থাকে এবং একটি সূত্র যে বলে হেলেন হচ্ছেন অশোকের মা, অর্থাৎ হেলেনের পুত্র হচ্ছেন অশোক, তবে তার ধারাবাহিকতা থাকে। চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন ছেড়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন ২৯৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। সব উপন্যাসের লেখক কল্পনাকে বাস্তবে সংগঠিত করে একটি সঠিক রূপ দিতে চেষ্টা করেন। বঙ্কিমচন্দ্র আনন্দমঠে বা দেবী চৌধুরানীতে যে-কথা বলেছেন ইতিহাস তার সঙ্গে সব জায়গায় একমত নয়। আমরা সন্ন্যাসী বা ফকির বিদ্রোহের কথা বলি, সেখানে যে গতিবেগ ছিল, তা মানুষকে আকর্ষণ করেছিল – এ-কথা শুধু মনে রাখা দরকার। তবে হেলেন এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিয়ের কথাও কিংবদমিত্মতে আছে। অবাক ব্যাপার এই যে, মেগাস্থিনিস এ-বিয়ে কিংবা চাণক্য সম্পর্কে তাঁর ভ্রমণবিবরণী ইন্ডিকায় একটি শব্দও লিখে যাননি।
উপন্যাসে সেলুকাস বা গ্রিকদের অংশটিও বেশ বিসত্মৃত এবং সমৃদ্ধ। প্রথমে আমার মনে হয়েছে তাদের উপন্যাসে এতবড় স্পেস দেওয়ার প্রয়োজন কী ছিল। এখানেও লেখককে অনেক শ্রম ও নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে প্রচুর বইপুস্তক। পরে মনে হলো, তা প-শ্রমে পরিণত হয়নি। উপন্যাসের প্রয়োজনে, বিশেষ করে কাহিনি ও উভয়পক্ষের (গ্রিক ও ভারতীয়) ভারসাম্যের পাশাপাশি শৈল্পিক পূর্ণতা আনতে এ-কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প ছিল না। মনে রাখি, বইটি ক্লাসিক ধাঁচের।
ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা কঠিন কাজ। তেইশশো বছর আগের ইতিহাস নিয়ে কাজ করা আরো কঠিন। এখানে যে-দুয়েকটি প্রশ্ন নিয়ে কথা হলো তা এ-বিশাল উপন্যাসের তুলনায় খুবই সামান্য ব্যাপার। বৃহৎ কলেবরের এই উপন্যাসে এ-জাতীয় আদর্শ ও শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের কী নেই তা খুঁজে বের করাই কষ্টকর। আর কী আছে তা নিয়ে যখন ভাবি, লেখককে শুধু অভিনন্দন নয়, কৃতজ্ঞতা জানাতে হয়। আবারো বলছি, এটি একটি বিরল উপন্যাস।

[রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বইটির প্রকাশনা-উৎসবে ধারণকৃত ভাষণ অবলম্বনে]