(ডেরেক ওয়ালকট আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর জীবন ও কবিতা নিয়ে আমি মনে মনে নিজেই নিজেকে ডেরেক ওয়ালকটের স্থানে বসিয়ে লিখেছিলাম এই প্রবন্ধ। মনে হলো আমার মৃত্যু হয়েছে এবং পৃথিবীর মানুষের জন্য আমার কিছু বলার আছে। এই লেখাটি লেখার সময় কবির আত্মা এসে যেন ভর করল আমার আত্মায়। আমি হয়ে গেলেম ডেরেক ওয়ালকট। এবং তাঁরই জবানিতে শুরু করলাম লেখাটি। এখানে ব্যবহৃত কবিতার অনুবাদও করলাম নিজ থেকেই।)
আমার মৃত্যুর পর, আমি জানি, আমাকে নিয়ে তোমাদের গবেষণা বেড়ে গেছে বিস্তর। ১৯৯২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরও এমনটি হয়েছিল। যাক, এখন অন্তত আমাকে এই দায় থেকে তোমরা মুক্তি দিয়েছ যে, আমি ক্যারিবীয় সেন্ট লুসিয়ানার ক্যাস্ট্রিস নামের এক ছোট্ট শহর আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভূমিতে জন্মেও কেন কলোনিয়ানদের ভাষায় কবিতা লিখলাম। প্রশ্ন আমার, তুমি এখন কোন ভাষায় আমাকে পড়ছো? জানছো? জানাচ্ছো তোমার হৃদয়নিঃসৃত ভালোবাসা? পৃথিবীর কোন প্রান্তের বাসিন্দা তুমি? এই প্রশ্নগুলি নিজেকে করে দেখো, তাহলেই বুঝবে আমি কেন ইংরেজিতে আমার হৃদয়ের ভাষাটাকে ব্যক্ত করেছি। এই পৃথিবীর মানুষের আত্মায় আর সত্তায় লুকিয়ে আছে একটাই ভাষা। আমরা শুধু ভিন্ন ভিন্ন বর্ণমালায় একে অন্যের কাছে অপরিচিত শব্দে সেই সত্তার ভাষাটাকে কবিতায় খুঁজে ফিরি, প্রকাশ করি। বাতাসের ভাষা, সাগরের শব্দের অনুপ্রাস আর মর্মরে লুকানো শনশনকে তুমি কোন বর্ণমালায় ধারণ করবে তা বড় কথা নয়, বড় হলো তা প্রকাশে তোমার যে প্রক্ষেপণ তা অন্যের কাছে কীভাবে অনুভূত হয়। সুতরাং ওয়েস্ট ইন্ডিজের একজন দ্বীপবাসী হয়ে আমি কেন ইংরেজিতে আমার উপলব্ধিজাত অনুভবকে প্রকাশ করেছি, তার বিশ্লেষণ বাতুলতা ছাড়া আর কী?
মানুষ বাতাসের বয়ে চলা থেকে, পাতার মর্মর থেকে, সাগরের ঢেউ থেকে শিখেছিল যে, নিজেকে প্রকাশের জন্য শব্দের প্রয়োজন। স্রষ্টা মানুষকে তার প্রথম জন্মলগ্ন থেকে স্বরতন্ত্র আর শব্দতন্ত্র দিয়েছিল। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসেবে তুমি স্বীকার করবে যে, প্রাকৃতিকভাবে গুঞ্জরিত, মর্মরিত এই ব্যাপারগুলি থেকেই মানুষ নিজেকে প্রকাশ করতে সেসব শব্দকে ধারণ করতে চেয়েছিল তার কণ্ঠে। কণ্ঠনালিতে তুলে নেওয়া তার শব্দগুলি একসময় অক্ষর দিয়ে বোঝাতে তারা চিত্র আঁকলো, চিত্রের সংক্ষিপ্ত রূপ থেকে সৃষ্টি হলো অক্ষর। অক্ষর থেকে ভাষা। পৃথিবীময় ভাষার এত বিস্তৃতি হলেও মানবসন্তানদের ভেতরের অনুভবের ভাষা তো এক। ভেতরের এই অনুভবের ভাষাকে ধরার প্রক্রিয়াটা একটা শিল্প। আমার প্রক্রিয়াটা ছিল কবিতার মাধ্যমে। কবিতার মাধ্যমে আমি প্রকৃতি আর ঈশ^রকে উপলব্ধি করতে চেয়েছি, জানতে চেয়েছি তোমাকে। জানাতে চেয়েছি তোমাকে তোমার অন্তরে লুকানো সেই অনুভবের ভাষা। যে-ভাষায় তুমি সাগরের ঢেউকে, এই পৃথিবীর মানুষের ইতিহাসকে, তাদের মনের কোণে চুপটি করে লুকিয়ে থাকা মহাকালকে খুঁজে ফেরো, আমি তা প্রকাশের জন্য একটা লিপিকে বেছে নিয়েছি। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত সেই লিপিকে, যা গ্রহণ না করলে আমার ছোট্ট সাগর-দ্বীপের ওই যে নীল পাহাড় আর অনন্ত আকাশে মেশা আমাদের সন্তানদের হাহাকার তা তোমার পর্যন্ত পৌঁছানো কি সম্ভব হতো?
Then all the nations of birds lifted together
the huge net of the shadows of this earth
in multitudinous dialects, twittering tongues,
stitching and crossing it. They lifted up
the shadows of long pines down trackless slopes,
the shadows of glass-faced towers down evening
streets,
the shadow of a frail plant on a city sill —
the net rising soundless as night, the birdsÕ cries
soundless, until
there was no longer dusk, or season, decline, or
weather,
only this passage of phantasmal light
that not the narrowest shadow dared to sever.
… … …
between dusk and darkness, between fury and
peace,
but, for such as our earth is now, it lasted long.
(‘The Season of Phantasmal Peace’)
তখন সমস্ত জাতির পাখিগুলি এই পৃথিবীর বিশাল
ছায়াজাল একসঙ্গে তুলে ধরল,
কথা বলছে ওরা নানা উপভাষায়, জিহ্বায় তাদের কিচিরমিচির স্বর
সেলাই করছে একে অন্যকে অতিক্রম করে। দীর্ঘ পাইনের ছায়াগুলো
ওরা তুলে ধরল উঁচুতে, পথহীন নিচু ঢালু বেয়ে,
সন্ধ্যার সড়কে নামে কাচমোড়ানো টাওয়ারের ছায়া,
শহরের কোনো জানালার কার্নিশে রাখা চারাগাছের ছায়া –
নিঃশব্দ রাত্রির মতো জাল ওঠে, পাখির ক্রন্দনও শব্দহীন,
যতক্ষণ না থাকে সন্ধ্যা অথবা ঋতু, ক্ষয়, শুধু এই ভুতুড়ে আলোর পথ
যা ছেঁড়ার সাহস সবচেয়ে চিকন ছায়াটিরও কখনো হয়নি।
… … …
সন্ধ্যা আর অন্ধকারের মাঝে, ক্রোধ আর শান্তির মাঝে,
তবে এই পৃথিবী এখন এমন যে, টিকে থাকে অনেক দিন।
(‘ভুতুড়ে শান্তির ঋতু’)
পাখির কথাগুলি কি তুমি শুনতে পাও? ওরা কোন ভাষায় কথা বলছে? আমি জানি, তুমি প্রশ্ন করবে, আমি কবে পাখি হয়ে সাগরের ঢেউয়ের ভাষা রপ্ত করেছিলাম। এসো, বসো আমার বিচ কটেজের বারান্দায়। আমার কটেজের একপাশে আটলান্টিক আর অন্যপাশে ক্যারিবীয় সাগর। আমার কটেজের বহিরাঙ্গনে ছোট্ট অনুভূমিক ঘাসের চত্বরে পাথরের
টেবিল-চেয়ারগুলি সিমেন্ট দিয়ে প্রোথিত। এখানেই আমি বড় হয়েছি। নারিকেল গাছের সারিগুলির দিকে তাকাও, তাকাও দূরের ওই সাগরবিধৌত পাহাড়ে। উপলব্ধি করতে পারো কি, সাগর-পাহাড়ের নীলের ভেতর তৈরি হয়েছে এক জীবনমঞ্চ? শুনতে পাও মানুষের অন্তরের সঙ্গে এই সাগরমঞ্চ কোন অনুভবকে ফেরি করছে? সাগরদ্বীপের এই অনাবিল সৌন্দর্যে স্নাত আর পূর্ণ আমার অনুভবকেই খুঁজেছি, প্রকাশ করতে চেয়েছি শব্দের ডানা ধরে ধরে। আমার অনুভবকে ইতিহাসের গান শোনাতে শোনাতে তা প্রোথিত করতে চেয়েছি তোমাদের ফিরে ফিরে ফিকে হয়ে আসা ভাবনায়।
In his thirties, the water becomes ÔoceanÕs surpliced choirs/ entering its nave, to a censer/ of swung mist, Ôor elseÕ this sheer light, this clear/ infinite, boring, paradisal sea.Õ The years pass and the images accumulate : Ôpages of the sea/ are a book left open by an absent masterÕ; Ôthe pleats of the shallows are neatly creased/ and decorous and processional.Õ
‘Of the Caribbean’, কবিতায় আমি লিখেছি :
Those who require vision, complexity,
tire of its distressing
limits: sea, sand, scorching sky.
But we require from the world only what we canÕt supply from within ourselves, and a poet who can work so many transformations on the sea — and on the sky and the sand as well — never has to tire of it. Language becomes a means of mastering his surroundings, enabling him to gain an almost magical power over the elements; language is more real to him than reality itself.’
দুই
আমার শব্দগুলিকে আমি ছড়াতে চেয়েছি ঘুমজাগা শহরের ডানার ভেতর, চেয়েছি সূর্যের প্রথম আলোকরশ্মিতে মাত্র স্পষ্ট একটা নির্জন সাঁকো অথবা সাগরতীরের কাছে ফেলে রাখা তোমাদের স্মৃতিময়তার দর্শনের গভীরে প্রোথিত করতে। চেয়েছি, সেই ঘুমজাগা শহরের ডানায় লাগা আগুনটাকে নেভানোর জন্য যেন তোমার হৃদয় ব্যাকুল হয়। কী হয়েছে, জানি না। তবে তা করতে আমি সবসময় ভালোবেসেছি। ন্যাচারালিস্টিক, এক্সপ্রেশনিস্টিক, সুররিয়ালিস্টিক, ইমেজিস্টিক, হারমেটিক অথবা কনফেশনাল কত কত বিশেষণে তোমরা আমাকে বিশেষায়িত করেছো। তোমাদের কেউ কেউ আবার আমাকে মেটাফিজিক্যাল রিয়ালিস্টও বলে সম্বোধন করো। শোনো, এসব গৎবাঁধা বিশেষণের ছাঁচে আমি নিজেকে কখনো পরিমাপ করে দেখিনি।
After that hot gospeller has levelled all but the
churched sky,
I wrote the tale by tallow of a cityÕs death by fire;
Under a candleÕs eye, that smoked in tears, I
Wanted to tell, in more than wax, of faiths that
were snapped like wire.
All day I walked abroad among the rubbled tales,
Shocked at each wall that stood on the street like
a liar;
Loud was the bird-rocked sky, and all the clouds
were bales
Torn open by looting, and white, in spite of the
fire.
By the smoking sea, where Christ walked, I
asked, why
Should a man wax tears, when his wooden world
fails?
In town, leaves were paper, but the hills were a
flock of faiths;
To a boy who walked all day, each leaf was a
green breath
Rebuilding a love I thought was dead as nails,
Blessing the death and the baptism by fire.
(‘ A CityÕs Death By Fire’)
তুমি সেন্ট লুসিয়ানার যে-কোনো চূড়ায় বসলে উঁচু থেকে একই সঙ্গে সতেজতার নবীনত্বে আর নিরন্তর সময়ের সার্বভৌমত্বে যদি নিজেকে খুঁজে পাও তাহলে বুঝবে সাগর এত অবারিত হয়েও, ঢেউ এত প্রবহমান হয়েও, একে অন্যকে অতিক্রম করার প্রতিযোগিতায় মেতে থেকেও তাদের সার্বভৌমত্ব এক জাদুময় ছন্দোবদ্ধতায় আবদ্ধ। তোমার সৃষ্টির সঙ্গে তোমার অনুভবের সংযোগ তখনই হবে যখন তুমি চোখ এবং কানের সঙ্গে তোমার ইন্দ্রিয়কে গ্রন্থিত, ছন্দোবদ্ধ করতে শিখবে। মধ্যযুগীয় ইংরেজ কবিতার ধাঁচে শব্দবিন্যাসে আমি ছন্দ করি হয়তো এইজন্যই যে, যা কিছু নিরবধি আর মহান তার মাঝে অদ্ভুত এক তাল-লয়ের গান আছে। নিরবধি কালের মাঝে লুপ্ত না হতে চাইলে, তোমাকে ছন্দের সেই গোপন ভাষাটা শিখতেই হবে। গদ্য করলেও। সমুদ্রের গদ্যছন্দ আমাকে তাই-ই শিখিয়েছে। সেজন্যই আমি সবসময় ভোরের হিম মাখা এলোমেলো বাতাসে সমুদ্রের ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া সূর্যোদয়কে দেখতে ভোরের অন্ধকারে ঘাপটি মেরে বসে থেকেছি। নিঃসন্দেহে আমার কানকে সজাগ রেখে। এটা ঈশ^র-বন্দনার মতো। দেখবে, এই মগ্নতা তোমার সৃষ্টিশীল সত্তাকে, তোমার আবেগাপ্লুত মনকে দান করেছে ভাবের অথবা ভাবময় সংগীতের সুরময় ভাষা, সময়হীনতার অনুভূতিকে সময়ের মাঝে প্রবিষ্ট করানোর কৌশল। এই ভাব ভাষাটাও কবিতার বড় শক্তি বলে আমি মেনেছি।
বৃষ্টি আজ এত, এতো বেশি প্রাণ যেন আকাশও সম্প্রসারিত
এই কালো আগস্টে। আমার বোন, সূর্য
তার হলুদ কক্ষে ধ্যানরত এবং সে বের হবে না আজ।
সব কিছুই নরকে চলে যায়; পাহাড় বাষ্প হয়ে যায়
একটা কেতলির মতো, নদী উছলায়; তারপরও
সে জেগে উঠবে না এবং বৃষ্টি থামাবে না।
(‘কালো আগস্ট’)
বসো এখানে। প্রশ্ন জাগছে, কবে থেকে আমি এই সাগরমঞ্চের ফিসফিস কানাকানি আর হুল্লোড়ে কথোপকথন শুনছি? শোনো, আমার জন্মের পরই আমার বাবা মারা গেলে আমার শিক্ষিকা মা আমার কানে কানে শেক্সপিয়র আবৃত্তি করে শোনাতেন। সেই শব্দমালা আমার কানে যে অনুপ্রাস তৈরি করেছিল প্রকৃতি তাকে দিয়েছিল বিচিত্র মাত্রার দর্শন। আমার শৈশবে শোনা মায়ের আবৃত্তি আমি পরিণত হয়েও শুনি সাগর-প্রকৃতির কাছ থেকে। আমার পোর্টেবল সেই নীল টাইপরাইটার জানে আমার আঙুল আত্মার অনুভবকে তার সঙ্গে কীভাবে ছন্দজাদু তুলতো। জানো তো, Poetry শব্দটি এসেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ Poiesis থেকে। যার অর্থ ‘আমি সৃষ্টি করি’। আমি কী সৃষ্টি করলাম? এই যে, অনন্ত সাগর-আকাশ, এই যে পাহাড় আর বিস্তৃত তট এগুলি তো স্রষ্টার সৃষ্টি। আমি এর মাঝে মানুষের ছোট্ট জীবনের যা কিছু অনুভব থাকতে পারে, আমার খোলা জানালার কাছে আকাশটার দিকে তাকিয়ে আমি তাকে খুঁজে ফিরেছি। তোমার অনুভবটুকু সৃষ্টির চেয়ে তা বরং তোমাদের দর্শনে, জীবন অভিজ্ঞায় যেন উপলব্ধিজাত বোধ হয়ে বাস করে, আমি তাই-ই চেয়েছি। ‘‘Forty years gone, in my island childhood, I felt that/ the gift of poetry had made me one of the chosen,/ that all experience was kindling to the fire of the Muse.’ (‘Midsummer’)
আমার এই তাকানো যতটা না চর্ম-চোখের তার চেয়ে অন্তরের। বাইরের দৃশ্যাবলি বর্ণনা করা থেকে একজন কবি নিজেকে বিরতই রাখেন সাধারণত। কিন্তু, শোনো, আমি এই ফাঁদে কখনোই পা দিইনি। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার হিসেব আর এই প্রকৃতিকে দেখার চেয়ে আমি তার তাল-লয়-ছন্দকে দেখেছি। তার উন্মীলিত ঢেউকে আলিঙ্গন করেছি আমার হৃদয় দিয়ে। সেজন্যই তুমি আমার কবিতার প্রথম বাক্যে বিভ্রান্ত হতে পারো, কেননা সেই বাক্য পদান্বয়ী অব্যয় নিয়ে বিস্তৃত হয়ে আছে এর কেন্দ্রের সংঘাত পর্যন্ত। যতক্ষণ না আমার শব্দবিন্যাস তোমার ইন্দ্রিয়ের সীমানা অতিক্রম না করে যায়, আমি ততক্ষণই সংকেতের মাধ্যমে অনুভবটা ছড়াতে চেয়েছিলাম। ‘The teak plant was as stiff as rubber near the iron railing/ of the pink verandah at whose center was an arch/ that entered a tenebrous, overstuffed salon with the usual sailing/ ship in full course through wooden waves, shrouds stiff with starch.’
এই এক দোষ ছিল আমার। মৃত্যু নিয়ে ভেবেছি অনেক। কিন্তু একজন কবি অনেকের সঙ্গে বাস করেও সেই
মৃত্যু-নিঃসঙ্গতাকে তো আগেই পেয়ে থাকে। আবার বিপরীতে এ-ও হয় যে, নিরন্তর নিঃসঙ্গতার মাঝেও একজন কবিই শুধু জীবনানন্দের শীর্ষমাত্রায় আরোহণ করে থাকেন। দুঃখ একটাই, এই মৃত্যুতে আমার শরীর তার সত্তার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলেছে। বিচ্ছিন্ন হয়েছে চোখের দেখার সঙ্গে। কানে ভেসে ভেসে বেড়ানো অনুপ্রাসের সঙ্গে। আত্মা-সত্তার সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেললেও একজন কবি এই পৃথিবীর সত্তার সঙ্গে তার সংযোগ স্থাপন করে মানুষের অনুভবে বিস্তৃত হয়ে। সেজন্যই আমি চেয়েছি আমার কবিতা যেন তোমাদের পাঠ-বিবেচনায় থাকে। আর ঠিক এই কারণেই ব্যাকরণের নিনাদকে আমি বেঁধেছি আমার রূপক করার অবাধ স্বাধীনতায় যেন তা তোমাদের দর্শনের খাদ্য হয়। শোনো, আমি বিশ্বাস করি একটা মহান কবিতা আর তার স্রষ্টা সেই অনাগত কবিকে উসকে দেয় যার ভেতর কবিতাপ্রতিভার টালমাতাল অনুভব লুকিয়ে আছে। আর দুর্বল সৃষ্টি প্রতিভাহীনদের জন্য হাতছানির ফাঁদ পেতে তাকে ছোবল দেয় বলে পৃথিবীজুড়ে এত অনাসৃষ্টি, অকবিতা। বোধের সংকেত ছাড়া যারা সৃষ্টিবিলাসে মাতে, জীবনশেষে সে শুধু একরাশ অবসাদ আর ক্লান্তিকেই আলিঙ্গন করে।
বোধ-দর্শনের দ্বারা অন্য সকল প্রাণীর মাঝে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব নির্ধারিত হলে তোমাকে এমন সব হীরকদ্যুতিময় শব্দ নির্বাচন করতে হবে যা মানুষের অনুভবে আর ইন্দ্রিয়তন্ত্রে গিয়ে তাকে বলে, আমি দার্শনিক বলেই একজন মানুষ। তাই, কবিতার শব্দজালে আমি এই সংকেতময় ভাষাটাকে গাঁথতে চেয়েছি। একজন কাঠমিস্ত্রি, একজন চিত্রশিল্পীর মাপের সূত্র আমি ভুলিনি কখনো। মননে, অনুভবে আমার শব্দবিন্যাস যেন অবিরত একে অন্যের সঙ্গে খেলা করে, আমি তাই-ই চেয়েছি। চেয়েছি আমার ধারণাগুলি যেন রক্তমাংসের শরীর পায়। আমার বর্ণিত ভূপ্রকৃতি যেন তোমার সামনে দাঁড়িয়ে নিজ থেকে কথা বলার দায়টুকু নেয়।
Blessed are the small farms conjugating Horace,
and the olive trees as twisted as ÔvidÕs syntax,
Virgilian twilight on the hides of cattle
and the small turreted castles on the Tuscan slopes.
which follow the poet as he travels the world and returns home :
On the warm stones of Florence
I subtly alter to a Florentine
till the sun passes, in London
I am pierced by fog, and shaken from reflection
in Venice, a printed page in the sun
on which a cabbage-white unfolds, a bookmark.
তিন
সাগর, সাগরঢেউয়ের অনন্ত ছন্দ, তার অবারিত জলরাশিতে ঠিকরে পড়া প্রথম আলোকরশ্মি আমার ভাবনাকে স্মৃতিতাড়িত করেছে সারাজীবন। মনে হয়েছে, এখানেই মানব ইতিহাসের সব ক্ষয় আর উন্মীলন। জানো তো আমি ভোর চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যেই উঠে যেতাম। যদিও নিজেকে মানে আমার শরীরকে এক কাপ কফির প্রলোভন দেখিয়ে আয়েশ আর বিছানা ছাড়তে বলতাম, কিন্তু সত্যি বলি, তা ছিল ভোরের নির্জনতার ভাষা শেখার ছল। আমার আত্মার বিশ্বাসঘাতকতায় প্রতিনিয়ত বিদ্বেষ ছড়াতে ছড়াতে শরীর মহাশয় নিজেও আমার আত্মার সাথে সাগরের সংগীতটুকু শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কবি হলে, তাই-ই করতে হবে। শরীরকে তোমার আত্মার আনন্দের সারথি করতে শিখতেই হবে। নশ্বর দেহটাকেও অভ্যস্ত করাতে হবে অনুভবের মাঝে লুকিয়ে থাকা ছন্দ আবিস্কারের জাদুতে মগ্ন হতে শিখতে। তখন তোমার শরীরও মন আর মননের সাথে মেতে উঠবে সাগরের ভাষায় লুকানো ইতিহাস আবিস্কারের নেশায়,
Where are your monuments, your battles,
martyrs?
Where is your tribal memory? Sirs,
in that gray vault. The sea. The sea
has locked them up. The sea is History.
… … …
and in the salt chuckle of rocks
with their sea pools, there was the sound
like a rumour without any echo
of History, really beginning.
(‘The Sea Is History’)
যদি আমার কবিতাকে ভালোবেসে থাকো, যদি ভালোবেসে থাকো তার প্রকাশকে, তোমাকে গোপনে বলি – জেনো তাহলে, আমি ডেরেক ওয়ালকট; রপ্ত করেছিলাম ক্যারিবীয় দ্বীপ আর সাগরঢেউয়ের মাঝে লুকানো ভাষাকে। তুমিও যদি মানবের অনুভবের কোনো ভাষাকে রপ্ত করে থাকো তাহলে আমি মিশে আছি তোমারই ভেতর। তোমার, আমার জীবনের ভুল অনুপ্রাসগুলিকে শুধরে নেওয়ার এই তো সময়। কেননা জীবনসায়াহ্নে আমিও অনুভব করেছিলাম, সাগরের আস্তরিত (স্তরীভূত/ প্রবহমান) ঢেউয়ের মাঝে মানুষের অনুভবের ইতিহাস খুঁজতে খুঁজতে কখন যেন পার হয়ে গেছে একটা জীবন; নিজেকে খুব বেশি প্রতিদান না দিয়েই। ভোগবিলাসের ব্যঞ্জনায় একজন কবির চেয়ে নিজেকে আর কেউ বেশি উপেক্ষা করে না। এসো আমরা এক হয়ে পরস্পরের চোখের আয়নায় নিজেকে দেখে নিই একবার। আমরা বসে পড়ি একে অন্যের ভেতর। তারপর ভোজন করি, পরিতৃপ্ত করি সারাজীবন কোনো একটা সংকেত, একটা জীবন দর্শন, একটার ভাষার আবহ খুঁজে খুঁজে হয়রান বিধায় বঞ্চিত আমাদের ইন্দ্রিয়কে। তুমি যদি কবি অথবা কবিতাপ্রেমী হও, জেনো তবে, আমি তোমাকে ভালোবেসে তোমার পাশেই বসছি এই জীবনকে উপভোগ করব বলে। নিজের দরজাটা খুলে দেখো তোমার প্রতিরূপ নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আমিই তুমি। তুমিই আমি। ভালোবাসাই জীবন, জীবনই ভালোবাসা। কবি, তোমাকে অভিবাদন। সম্ভাষণ করো নিজেকে –
The time will come
when, with elation
you will greet yourself arriving
at your own door, in your own mirror
and each will smile at the otherÕs welcome,
and say, sit here. Eat.
You will love again the stranger who was your
self.
Give wine. Give bread. Give back your heart
to itself, to the stranger who has loved you
all your life, whom you ignored
for another, who knows you by heart.
Take down the love letters from the bookshelf,
the photographs, the desperate notes,
peel your own image from the mirror.
Sit. Feast on your life.
(‘Love After Love’)
সময় আসবে
যখন তুমি বিজয়ীর বেশে,
নিজের বাড়ির দরোজায় পৌঁছবার জন্যে
নিজেকেই অভিনন্দিত করবে, নিজের প্রতিরূপে
একজন আরেকজনের স্বাগত সম্ভাষণে একে অন্যের
জন্য নিজেদের হাসিকে বিচ্ছুরিত করবে।
বলবে, এইখানে বসো, ভোজন করো
তুমি আবার সেই আগন্তুককে ভালোবাসবে যে আসলে
তোমারই সত্তা।
তাকে দাও মদ। দাও রুটি। তাকেই ফিরিয়ে দাও
তোমার হৃদয়, সেই আগন্তুককে দাও সবকিছু
যে তোমাকে ভালোবেসেছিল
সমস্ত জীবন ধরে, যাকে তুমি অন্য কারো জন্য শুধু
উপেক্ষা করে গেছো, সেই তোমাকে হৃদয় দিয়ে চেনে।
বুকসেলফ থেকে প্রেমপত্রগুলি নামিয়ে আনো,
সেই ফটোগুলি, দুরন্ত নিস্বন আর খতগুলি,
আয়না থেকে সরিয়ে দিচ্ছে তোমার নিজেরই প্রতিবিম্ব।
বসো। তোমার জীবনকে উপভোগে, ভোজনে তুমি পরিতৃপ্ত
করো।)
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.