আহমদ রফিক মেডিক্যাল থেকে পাশ করা ডাক্তার হলেও সে-পরিচয় ছাপিয়ে একজন সৃজনশীল সংগ্রামী মানুষের পরিচয়েই জনপরিসরে খ্যাতি পেয়েছেন। মূলত লেখাই তাঁর পরিচিতির মূলকেত্র। তবে তিনি জনপ্রিয় লেখক নন, কিন্তু যেটুকু লিখেছেন তার জন্য সুখ্যাতই ছিলেন। তাঁর লেখার মূলক্ষেত্র দুটি – ভাষা-আন্দোলন ও রবীন্দ্রনাথ। এর বাইরে সমকালীন রাজনীতি ও সমাজ প্রসঙ্গে অনেক লিখেছেন। ভাষা-আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন এবং সেই সূত্রে আমাদের দেশের দস্তুর অনুযায়ী ভাষাসৈনিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। এ-অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একুশে পদকও পেয়েছিলেন ১৯৯৫ সালে। আবার রবীন্দ্রগবেষণা, চর্চা ও রবীন্দ্রপাঠ বাড়ানোর জন্য আজীবনের নিঃস্বার্থ কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন কলকাতা থেকে রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য খেতাবের মাধ্যমে।
তাঁর দীর্ঘ জীবনের প্রথম পর্বে আর দশজন বাঙালি তরুণের মতো তিনিও কবিতা দিয়েই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন, তবে তাঁর তরুণমনের যে রোমান্টিক ভাবুকতা তা ব্যক্তিগত প্রেমের চেয়েও দেশ ও মানবপ্রেমের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটেই প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা-আন্দোলনের সূত্র ধরে তাঁর দেশচেতনা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপাদানে সমৃদ্ধ। গোড়া থেকেই তা জাতীয়তাবাদী রূপে আবদ্ধ না থেকে সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক চেতনায় গড়ে উঠেছিল। এই ধারাটি তিনি কখনো ত্যাগ করেননি। কেবল এর সঙ্গে পাকিসত্মান ও বাংলাদেশের সমকালীন প্রসঙ্গ তাঁকে নানাভাবে ভাবনায় তাড়িত করেছে। আর বাংলাদেশ বরাবর এত উত্থানপতন, পরিবর্তন-রূপান্তর ও
বিতর্ক-দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে গেছে যে, একজন চিন্তাশীল মানুষের জন্য লেখার বিষয়ের অভাব হয়নি কখনো। তাঁর লেখাও থামেনি তাই।
লেখার বিষয় হিসেবে তাঁর ভালোবাসা ও অঙ্গীকারের আরেকটিক্ষেত্র হলো রবীন্দ্রনাথ। সবাই জানি, পাকিস্তান আমল থেকেই এদেশে রবীন্দ্র-বিতর্ক বলে একটা বিষয় চালু আছে। এটি কবির জন্য দুর্ভাগ্যজনক কি না জানি না, কিন্তু জাতির জন্য যে চরম দুঃখের বিষয়, এবং লজ্জারও বিষয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে – যে-সংগ্রামে কবির গান ও চিন্তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা অনস্বীকার্য – তার অবসান হয়নি। বরং বাংলাদেশেও পাকিস্তানের মতোই রাজনৈতিক ইসলামের চর্চা বেড়েছে, মুসলিম পরিচয়ের সঙ্গে বাঙালি পরিচয়কে বিবদমান সম্পর্কে দেখার অভ্যাসও কাটেনি। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর সৃষ্টিকে বিতর্কিত করার মানসিকতা পাকিস্তান আমলের জের টেনে অব্যাহত আছে। এই পাকিস্তানি উত্তরাধিকার বহমান থাকায় রবীন্দ্রচর্চা আবারো এক ধরনের প্রতিবাদী কাজে পর্যবসিত হয়েছে। এই সংগ্রামে আরো অনেকের মতো আহমদ রফিককেও শামিল হতে হয়েছে। তাতে অবশ্য তাঁর হাত দিয়ে রবীন্দ্রসাহিত্যের পাশাপাশি কবির কর্মক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ পর্ব নিয়েও মূল্যবান বই লেখা হয়েছে।
কেবল লিখেই তিনি ক্ষান্ত হননি, কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আদলে রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র গঠন করে সেটি সক্রিয়ভাবে বেশ কয়েক বছর চালিয়ে গেছেন। এভাবে আহমদ রফিক নিজের ওপর নিজেই দায়িত্ব চাপিয়ে গেছেন তাঁর স্কুলজীবন থেকেই। তিনি যেমন কর্মে তেমনি লেখায় ছিলেন একজন সচল সজীব অভিযাত্রী। তাই তাঁর ভাবনা এক বৃত্তে আটকে থাকেনি, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে গেছেন। আবার গবেষকের বৈদগ্ধ্য থাকায় কোনো কোনো বিষয়ে বিস্তর পড়াশোনা, মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান এবং সাধারণজনের সঙ্গে কথা বলে জানার পরিধিকে যাচাই করে নিয়ে তবে লেখায় হাত দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের যেমন ভাব-ভাষাভিত্তিক আলোচনা করেছেন, তেমনি আবার ভিন্ন এক মাত্রায় কাজ করেছেন পতিসরে রচিত কবির সাহিত্যকর্ম নিয়ে, যে বইটির নাম রবীন্দ্রভুবনে পতিসর। তিনি দেখিয়েছেন, কবি এখানে এসে গ্রামীণচাষিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার ফলে ক্রমেই তাঁর লেখা, লেখকের ভাষায়, ভাবসত্য থেকে বস্তুসত্যের দিকে ঝুঁকেছে। প্রথমদিককার ‘সন্ধ্যা’ বা ‘মধ্যাহ্নে’র মতো প্রকৃতির সৌন্দর্য ও তার প্রভাবে চিত্তের অনুভূতি প্রকাশের পরিবর্তে কবি ‘দুই বিঘা জমি’ বা ‘এবার ফিরাও মোরের’ মতো বস্তুসত্যের উন্মোচন ঘটিয়েছেন। কবি স্পষ্টভাবেই দেশের মূঢ়-ম্লান মূক দরিদ্র, বঞ্চিত অগণিত সাধারণের কাছে ফেরার কথা বলেছেন। এই সূত্রেই গবেষক আহমদ রফিক ধাপে ধাপে তুলে ধরেন গ্রামোন্নয়ন ও গ্রামজীবনকে উন্নত করার জন্য কবির নেওয়া সমবায়, উন্নত বীজ চাষের উদ্যোগের কথা। এতে আরো এসেছে এই বিশাল কৃষিপ্রধান উপমহাদেশের একজন কবির কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথাও। যখন গ্রামের মানুষ মহাজনের ঋণের জালে আটকা পড়ে দুই বিঘা জমির উপেনদের মতো নিজের পৈতৃক ভিটাসহ সর্বস্ব হারিয়ে বসত তখন রবীন্দ্রনাথ সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ দিয়ে তাদের ঘরের কাছে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে পাশে দাঁড়িয়েছেন।
আহমদ রফিক এ-কাজের উপাত্ত সংগ্রহের জন্য গ্রন্থাগার ছেড়ে পতিসরে গিয়েই হাজির হয়েছিলেন। বিষয়টি সম্যক বুঝেই বইটি লিখেছিলেন। এর একদিকে কবির পতিসরে রচিত কাব্যের বিচার রয়েছে আর অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়ন প্রয়াসের আড়ালে-পড়া একটি অধ্যায়ে আলো ফেলেছেন। রবীন্দ্ররচনার, বিশেষত কাব্যের, বিচারে আহমদ রফিক যেভাবে ভাবসত্য ও বস্তুসত্যের কথা তুলে ধরেছেন তাকে সাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই ‘ছান্দিক বৈপরীত্যের তত্ত্ব’ আখ্যা দিয়েছেন।
দুই
যে-মানুষ স্কুলজীবনে নানামুখী রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন, অল্পবয়সে কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন, তাঁর পক্ষ জনকল্যাণে সাংগঠনিক তৎপরতা চালানো খুবই স্বাভাবিক। তিনি যেমন প্রথম জীবনে নাগরিক নামে সাহিত্যপত্র প্রকাশ করেছিলেন, তেমনি কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ঔষধ শিল্প ‘ওরিয়ন’। সেটি বন্ধ হলে চেষ্টা করেন ‘বায়োপ্যাস’ নামে চিকিৎসা সংক্রান্ত আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে। কিন্তু ব্যবসা সহজ নয়, বাঙালির পক্ষ যৌথ মালিকানা টিকিয়ে রাখা আরো কঠিন। তাঁর এসব উদ্যোগের ভাগ্যেও এর ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। তিনি সফল হয়েছেন আশির দশকে বাংলাদেশের ঔষধ শিল্প নীতি প্রণয়নে। তাঁদের এ-কাজটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক সফল জনকল্যাণমুখী নীতির দৃষ্টান্ত।
তবে এসব পেশাদারি উদ্যোগের বাইরে তিনি প্রথম গঠন করেছিলেন ‘একুশে চেতনা পরিষদ’। এ-সংগঠনের উদ্যোগে একুশের চেতনা সংরক্ষণ, প্রচার ও প্রকাশে তিনি নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। গঠন করেছিলেন রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্র, সম্ভবত কলকাতার টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউটের আদলে। এ-সংগঠন থেকে তিনি ঢাকা ও কলকাতায় সফল অনুষ্ঠান করেছিলেন। এছাড়া কিছুদিন রবীন্দ্র কাব্য পাঠ দিবসও তিনি পালন করেছিলেন। বলা বাহুল্য এসব কাজের যে আর্থিক ঝক্কি তার সবটাই নিজে সামলাতেন – প্রধানত নিজের অর্থ দিয়ে এবং বন্ধুজনদের সহায়তায়। এ-ধরনের উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদে চালানো কঠিন এবং তাঁর পক্ষেও তা সম্ভব হয়নি। সবশেষে ‘আহমদ রফিক ফাউন্ডেশন’ গঠন করেছিলেন, সম্ভবত তাঁর সংগ্রহের মূল্যবান বই ও অন্যান্য জিনিস সংরক্ষণের ভাবনা থেকে।
বোঝা যায়, তাঁর ভেতরে লেখার প্রেরণা যেমন ছিল তেমনি তাগিদ ছিল তরুণদের এগিয়ে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত কিছু করার। এও বোঝা যায় যে, তিনি প্রথম থেকেই জীবনের লক্ষ্য ও কাজ নিয়ে যথেষ্ট ভেবে পরিকল্পিতভাবেই চলার চেষ্টা করে গেছেন। আর তাতেই প্রচুর বই লেখা, কয়েকটি সংগঠন গড়ে তোলা এবং নানা কাজে যুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে রুশ বিপ্লবের শতবার্ষিকী উদযাপন পরিষদের যুগ্ম আহবায়কের দায়িত্ব নিয়েছিলেন প্রাবন্ধিক চিন্তাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। তখন তাঁর বয়স ৮৮ বছর। প্রায় নববই পর্যন্ত, দৃষ্টি হারানোর আগে তিনি নিরলসভাবে লিখে গেছেন, পরিণত বয়সে তো বটেই, বলা যায় বৃদ্ধ বয়সে তিনি পাকিস্তান পর্ব নিয়ে মূল্যবান বই লিখেছেন। ভাষা-আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস লিখেছেন, বিষ্ণু দে-র মতো জটিল আধুনিক কবির কাব্য বিচার করেছেন, পছন্দের অন্যান্য কবি-লেখক সম্পর্কে বই লিখেছেন।
তিন
আহমদ রফিকের সঙ্গে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে। একবার ঢাকা মহানগরীর পথে, তোপখানা রোডে, চলতি পথে গাড়ি থামিয়ে তিনি আমাকে তাঁর পাশে তুলে নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তখন সম্ভবত তিনি বায়োপ্যাসে যুক্ত ছিলেন। একবার ছায়ানট মিলনাতয়নে একটি অনাড়ম্বর আলোচনায় ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে তাঁর ও অধ্যাপক সনৎকুমার সাহার সঙ্গে বসে কথা বলেছিলাম। আরেকবার চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যায়ের প্রগতিশীল ছাত্রদের একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। তখন আহমদ রফিকের সঙ্গে আমিও ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছি। সম্ভবত সর্বশেষ দেখা হয়েছে ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’র কোনো সাহিত্যসভার আগে বা পরে শিল্পকলার মুক্তাঙ্গনে বর্ষীয়ান প্রধান অতিথির সঙ্গে একান্ত আড্ডায়। বরাবর দেখেছি তাঁর উপস্থিতির মধ্যে কোনো বাগাড়ম্বর থাকত না। তাতে সহজেই আগন্তুকের পক্ষ নিজের মতো করে তাঁর সান্নিধ্য উপভোগ এবং আড্ডায় নিজের অংশগ্রহণ সহজ হয়ে যেত। আহমদ রফিক ছিলেন একজন সহজ সখা, সহজ সুহৃদ। তাঁর বয়স, অভিজ্ঞতা, প্রতিষ্ঠা বা অনুষ্ঠানে অবস্থান – এসব বাহ্য বিষয় তাঁকে ভারাক্রান্ত করেনি, দূরেও সরায়নি। তিনি আড্ডার মধ্যমণি হলেও আচরণে তা হননি, আড্ডার একজনই থেকেছেন বরাবর। দেখলাম, আশি-ঊর্ধ্ব মানুষটি দোকানের
পেঁয়াজু-ছোলাও খেলেন, যখন ষাটোর্ধ্ব আমি তা সচেতনভাবে এড়িয়ে গেলাম। চিকিৎসক মানুষ নিশ্চয় শরীরের সামর্থ্য-সীমাবদ্ধতা বুঝে-মেনেই আড্ডার খাওয়ার অংশ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের সমাজ এখনো অস্থিতিশীল। তরুণদের অস্থিরতা অন্যদের মধ্যে সংক্রমিত হচ্ছে। জনমনে অনিশ্চয়তার উদ্বেগ গভীর হচ্ছে। এ-সময় আহমদ রফিকের মতো সজীব চিন্তার গণমুখী চেতনা ও গভীর দেশপ্রেম-মানবপ্রেমসম্পন্ন বর্ষীয়ান মানুষের অভাব দেশ ও সমাজের শূন্যতা আরো বাড়িয়ে তুলবে। তবে তাঁর তো বয়স শত ছুঁইছুঁই হয়েছিল, কয়েক বছর ধরে অচল হয়ে পড়েছিলেন, হাসপাতালের শয্যায়ও ছিলেন অনেক দিন ধরে। হয়তো এই জীবনাবসান নিয়ে আক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। তাই বলব, আমরা সৌভাগ্যবান, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, যে, এই চিন্তাশীল দীর্ঘজীবী মানুষটি যেমন তাঁর চিন্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন অনেক বইয়ে, তেমনি রয়ে গেছে তাঁর কর্মময় ব্যক্তিজীবনের অনুধাবনীয় এক বর্ণময় ইতিহাস।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.