জঁ লুক গদারের মুক্তি পাওয়া দ্বিতীয় ছবি উন ফাম এ তাঁ ফাম (১৯৬১) বা ‘নারী হলো নারী’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উল্টো একটি গান গেয়েছেন। ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী’ বাণীর বিপরীতে গদার যেন বলতে চান, নারী বিদেশিনী তো বটেই, তাই তাকে চেনা সহজ কাজ নয়, অন্তত পুরুষের জন্য তো নয়ই। আপাতদৃষ্টিতে এই ছবিটি সংগীতময় প্রেম-হাস্যরসের ছবি মনে হলেও অন্য স্তরে বিছিয়ে রাখা হয়েছে নারীর কামনা ও বাসনার স্বরূপ। খালি চোখে ছবিটিকে মনে হতে পারে হলিউডের কোনো রোমান্টিক কমেডি ধাঁচের ফরাসি সংস্করণ। কিন্তু চোখ বন্ধ না করে ভাবলেও তাতে ধরা পড়বে সন্তান উৎপাদন প্রক্রিয়ার ভেতর নারীর কামনা, কামনাকে অতিক্রম করে আরো কিছু পাওয়ার বাসনা, ফরাসি মনোবিশ্লেষক জাক লাকাঁর ভাষায় জুইসঁস (jouissance), আরো বিশেষ করে বললে ফেমিনিন জুইসঁস (feminine jouissance)। জুইসঁসের বাংলা আমরা প্রস্তাব করে রাখছি ‘মজারু’*।
এক
অ্যাঞ্জেলা (আনা কারিনা) ক্যাবারে ড্যান্সার। সে যাকে ভালোবাসে, এমিল (জঁ-ক্লদ ব্রিয়েলি), একটি ছোট বইপত্রের দোকানে কাজ করে। তাদের দুজনেরই বন্ধু আলফ্রেড (জঁ-পল বেলমন্দো), ভ্রাম্যমাণ চিত্রগ্রাহক। শহরে চৌরাস্তার মোড়ে একটি ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকে অ্যাঞ্জেলা। পারিবারিক সূত্রে পাওয়া সেই অ্যাপার্টমেন্টে এমিলও থাকে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে। এমিলের কাছে শুধু ভালোবাসার প্রত্যাশী নয় অ্যাঞ্জেলা, তার একটি সন্তানও চাই। কিন্তু পিতৃত্বের দায় নিতে প্রস্তুত নয় এমিল। মাতৃত্বের স্বাদ পেতে অ্যাঞ্জেলা এতটাই অস্থির যে, এমিল শেষ পর্যন্ত রাস্তার লোকেদের অনুরোধ করে অ্যাঞ্জেলাকে একটি সন্তান দেওয়ার জন্য। বন্ধু আলফ্রেডকেও সে ডেকে আনে সন্তান উৎপাদনের নিমিত্তে। আলফ্রেড পরোক্ষভাবে পছন্দ করে অ্যাঞ্জেলাকে। এক পর্যায়ে আলফ্রেড সেটি প্রকাশও করে। অ্যাঞ্জেলা তার শয্যাসঙ্গী হয় সন্তানের আশায়। বিষয়টি অ্যাঞ্জেলা ফিরে এসে এমিলকে বলে। প্রথমটায় এমিল বিশ্বাস করতে চায় না, কিন্তু পরে বিশ্বাস করে। তখন তার ভেতর চিন্তা আসে, অ্যাঞ্জেলা যদি গর্ভবতী হয়েই যায়, তাহলে সে আর পিতৃত্বের দাবিদার হতে পারবে না। কাজেই সে ডিম্বনিষেকে নিয়োজিত হয়। শেষ সম্ভাবনাকে সে হেলায় হারাতে চায় না। কর্মসম্পাদন শেষে এমিল শ্রান্তমুখে অ্যাঞ্জেলাকে বলে, ‘তুমি নারি’ (Tu es infâme.)। অ্যাঞ্জেলা তখন এমিলকে বলে, ‘আমি? আমি ‘নারি’ না।’ (Moi? Je ne suis pas infâme) এরপর ক্যামেরার দিকে, দর্শককে এক চোখ টিপ দিয়ে অ্যাঞ্জেলা মুচকি হেসে বলে, ‘আমি একজন নারী’ (je suis une femme)! ফরাসি ভাষার সমোচ্চারিত ভিন্নার্থক শব্দের অনুকরণে বাংলায় ‘নারি’ আমদানি করলাম। ‘নারী’র সঙ্গে ‘নারি’ শব্দটিকে বেছে নিলাম গদারের মনোভঙ্গির কাছাকাছি থাকার জন্য। গদার শব্দ নিয়ে খেলতে পছন্দ করেন।
‘একজন নারী হলো একজন নারী’ ছবিতে কাহিনি বলতে আসলে ওটুকুই। এক নারী সন্তানপ্রত্যাশী, তবে তার প্রেমিক প্রস্তুত নয়, সেই সুযোগ নেয় প্রেমিকের বন্ধু। তারই ফাঁকে গদার আমাদের দেখিয়ে দেন নারী ও পুরুষের কামনা-বাসনার ফারাক। এমনকি পুলিশের হাস্যকর তৎপরতাও। গদার এখানে চকিত চাহনিতে রাষ্ট্রের সমালোচনাই করেন বইকি। তবে তাঁর মূল লক্ষ্য নারী-পুরুষের সম্পর্কের সুলুকসন্ধান করা। সুলুক অর্থ যেমন সূত্র হয়, আবার ছিদ্রও হয়। আধারে ছিদ্র মানে সে সব ধারণ করতে পারে না, পড়ে যায়। বাসনাও এক প্রকার আধার এবং সে ছিদ্রসংবলিত। এজন্য বাসনার আধেয় বরাবরই অধরা থেকে যায়। বাসনা হাজিরা দেয় সকল প্রকার কথোপকথনে, আলাপে এবং এই আলাপে যা বলতে চাই আমরা, তা পুরোপুরি ধরা পড়ে না, ছিদ্র গলে পড়ে যায়, উদ্বৃত্ত হয়। অ্যাঞ্জেলা দর্শকের দিকে তাকিয়ে যখন নিজেকে নারী বলে, তখন কি তার বাসনা পুরোপুরি ধরা যায়? লাকাঁ বলেন, ‘বাসনা না সন্তুষ্টি পূরণের ক্ষুধা, না ভালোবাসার চাহিদা, তবে দ্বিতীয়টি থেকে প্রথমটি বিয়োগ করলে যে ফল পাওয়া যাবে, সেই বিয়োগফলই বাসনা।’
অর্থাৎ ভালোবাসার চাহিদার উদ্বৃত্তের নাম বাসনা। প্রয়োজন থেকে চাহিদাকে আলাদা করলে যা থেকে যায়, সেটাকেই বাসনা বলেন লাকাঁ। বাসনা ঘনিয়ে ওঠার মূলে লাকাঁ নির্ধারণ করেন একটি বস্তুকে, যার নাম তিনি দেন ‘অবজে পতি আ’ (Objet petit a)। ছোট হাতের ‘এ’ দিয়ে অপরকে (autre) বোঝান লাকাঁ। আর বড় হাতের ‘এ’ দিয়ে বোঝান, বিগ আদার, পরমকে। পরম বলতে কেবল ঈশ্বর নয়, ঈশ্বরের মতো আরো যা কিছু আমাদের নানাবিধ নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে, সেসবকেও বোঝায়। তো ছোট অপর নিয়ে লাকাঁ বলেন, এই ‘অবজে পতি আ’ শুধু বাসনা নয়, উদ্বেগেরও উৎস এবং লিবিডো বা কামশক্তির ধারক। এই কামশক্তির সঙ্গে লাকাঁর জুইসঁস বা মজারুর ধারণা সম্পর্কিত। সুলুকের ভেতর সুলুকসন্ধান করে এবার তবে দেখা যাক কোন সুই-সুতোতে গাঁথা হয়েছে গদারের এমিল-অ্যাঞ্জেলা-আলফ্রেডকে।
দুই
বিচিত্র সব পোশাক পরে ক্যাবারে নাচিয়েরা নাচ পরিবেশন করে পুরুষ দর্শকের সামনে। তাদের লিবিডোকে তৃপ্ত করে, বিনিময়ে পয়সা পায়। শুরুর দিকে লক্ষ করা যায়, অ্যাঞ্জেলা নাবিকদের পোশাক পরে নাচতে আসে লাল টুকটুকে মঞ্চে। তার গলাতেও ঝোলানো থাকে লাল রঙের স্কার্ফ। এর আগে যে পোশাকে অ্যাঞ্জেলাকে দেখা যায় সেখানেও লালের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। লাল রং ভালোবাসা, যৌনতা ও উষ্ণতার প্রতীক। আরেকটু বাড়িয়ে বললে লিবিডো-সংবলিত জুইসঁসের প্রতীক। শুধু পোশাকে নয়, অ্যাঞ্জেলার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরেও দুটি স্ট্যান্ডিং ল্যাম্প দেখতে পাওয়া যায়। অ্যাঞ্জেলা ও এমিল যখন খেতে বসে তখন ভালো করে দেখলে চোখে পড়বে, এমিলের দিককার বাতিটির ঢাকনা সাদা আর অ্যাঞ্জেলার দিককার বাতির ঢাকনা লাল। এই রঙের ব্যবহারের সঙ্গে আমি যদি বাংলার বাউল ধর্মের দুই রূপক সাদা-লালের মিল খুঁজে পাই, সেটি কাকতালীয় হবে না। বীর্যবান পুরুষ ও রজস্বলা নারীর চিরন্তন রূপ বাউলরা যেমন করে প্রকাশের চেষ্টা করেন সাদা আর লাল রঙের মধ্য দিয়ে, গদারও আমার ধারণা সেই চেষ্টাই করেছেন।
রং ছাড়াও গোটা ছবিতে ডিম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলায় ডিম্বনিষেক বলে একটি কথা আছে, সেটা মনে রাখলে গদারের ডিম-মোটিফের ইঙ্গিত বোঝা সহজ হয়ে যায়। প্রথমবার দেখা যায়, খেতে বসে এমিলকে খাওয়াবে বলে ডিম ভেজে দিতে উঠে যায় অ্যাঞ্জেলা। তার হাত থেকে দুটো ডিম মাটিতে পড়ে চৌচির! ‘দুটো ডিম নষ্ট, অ্যাঞ্জেলা পরীর কষ্ট।’ এরপর দেখা যায়, এমিল আধাসেদ্ধ ডিম খেতে চায়। অ্যাঞ্জেলা বলে, করে দেবে, কিন্তু তাকে সন্তান দিতে হবে, অর্থাৎ তার ডিম্বনিষেক করতে হবে। আরেক দৃশ্যে দেখা যায়, ডিম ভাজে অ্যাঞ্জেলা, মানে ওমলেট বানায়। সেসময় ফোন আসে আলফ্রেডের, সে ওমলেট ছুড়ে দেয় ওপর দিকে, দৌড়ে গিয়ে আলফ্রেডের ফোন রিসিভ করে, তাকে হোল্ড করে আবার ফিরে এসে ওপরে ছুড়ে দেওয়া ওমলেটটিকে ফ্রাইপ্যানে রিসিভ করে। এরপর ওমলেট একটি বাটিতে নিয়ে সিঁড়িতে বসে বসে খায় ও আলফ্রেডের প্রেমের প্রস্তাবে সাড়া দেবে বলে মনোস্থির করে। এই ডিম-মোটিফ থেকে একটি সরল অর্থ বের করা যায়, তা হলো, ডিম্বনিষেকে এমিলের অনীহা, তাই অ্যাঞ্জেলার ডিম ভেঙে যাচ্ছে (ঋতুস্রাব)। অপরদিকে ডিম্বনিষেকে আলফ্রেডের ইচ্ছা প্রকাশ, তাই ডিমকে ওমলেট হিসেবে পাতে ধরতে পারছে অ্যাঞ্জেলা। এই জায়গায় লাকাঁনীয় ভাষায় যদি বলি, hommelette (omelette-এর পরিবর্তে little human being) তাহলে গদারের ভাষ্য আরো পরিষ্কার করে বোঝা যায়।
‘লামেলা’ (lamella) কী, সেটা বোঝাতে গিয়ে লাকাঁ কৌতুক করে l’hommelette শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। hommelette নিয়ে লাকাঁ জানান, এটাকে ছোট মানবসন্তান হিসেবে কল্পনা করা যায়। একটা ডিমের ভেতর নরম পর্দার আস্তরণে ভ্রূণের জন্ম হয়, কিন্তু যখন সেটা ভেঙে যায়, তখন এক মুহূর্ত ভাবুন, একটা কিছু উড়ে চলে যায় সেই ডিম থেকে – আত্মা বা প্রাণ। ডিম ভেঙে ফেলা মানে ঊন-মানুষকে মেরে ফেলা, যাকে লাকাঁ ডাকছেন hommelette বা lamella বলে। কাজেই অ্যাঞ্জেলার হাত থেকে ডিম যখন মেঝেতে পড়ে ভেঙে যায়, সেটি শুধু ডিমই থাকে না, তার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যায় একটি সন্তান পাওয়ার বাসনা। ভাঙা ডিমের যে তরল আমরা দেখি, ঋতুস্রাবের ভগ্ন ঝিল্লি, শ্লেষ্মা ও রক্তের মিশ্রণ থেকে তা কি খুব বেশি আলাদা কিছু? প্রত্যেক ঋতুস্রাব মানেই সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা উড়ে যাওয়া। তাই বলা যায়, ‘লামেলা’ যখন ভেঙে যায়, ‘প্রকৃত সারস’ তখন উড়ে যায়।
লাকাঁ বলছেন, ‘লামেলা হলো একেবারেই সমরূপী ধরনের, যার নড়াচড়া অ্যামিবার মতো। তবে অ্যামিবার চেয়ে এটি আরেকটু জটিল। এর চলাচল সর্বত্র। এবং এই অ্যামিবাসদৃশ বস্তুটি – আমি বলছি কেন – যৌনসত্তা (Sexed Being) যৌন বৈশিষ্ট্যে যা হারিয়ে ফেলে তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এটি অ্যামিবাসদৃশ বস্তুটি, যৌনসত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত, অমর – কারণ যত ভাগ বা কোষবিভাজনের ভেতরেই পড়ুক না কেন এটি টিকে থাকে। এবং এটি সর্বত্র ছোটাছুটি করতে পারে। … এই লামেলা, এই অর্গানের বৈশিষ্ট্য অস্তিমান থাকা নয়, কিন্তু তারপরও এটি একটি অর্গান – আমি এর প্রাণিবিদ্যাগত স্থানের আরো ব্যাখ্যা দিতে পারি – এটাই লিবিডো।
‘এটাই লিবিডো, বিশুদ্ধ জীবনের প্রবৃত্তি হিসেবে, বলতে গেলে, অমর জীবন, অথবা অদম্য জীবন, যে জীবনের কোনো অর্গানের দরকার হয় না, সরলীকৃত, অবিনশ্বর জীবন। নির্দিষ্ট করে বললে, ঘটনাচক্রেই এটি জীবন্ত সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন, তবে যৌন প্রজননচক্রের অধীন। এবং ÔObjet aÕ-এর যত প্রকারের নিদর্শন পরিমাপ করা যায় ওটি তারই অংশ, সমতুল্য। ÔObjet aÕ হলো লিবিডোর বিশুদ্ধ প্রতিনিধি, প্রতিমা।’
আর লিবিডো বা কামশক্তিকে আসলে জুইসঁস আকারেই উপস্থাপন করেছেন লাকাঁ সর্বত্র। জুইসঁসের সঙ্গে সংগমজাত মজা ও যাতনার মিল আছে, ইংরেজিতে ‘এনজয়মেন্ট’ ঠিক জুইসঁসের কাছাকাছি যায় না বলে অধিকাংশ ইংরেজি তর্জমায় ‘জুইসঁস’ই রাখা হয়েছে, বাংলায় যাকে আমরা বলছি ‘মজারু’।
‘মজারু’ শব্দটি ১৯৫৩ সালের আগ পর্যন্ত লাকাঁর কোনো লেখাপত্র বা বক্তব্যে দেখা যায়নি। ১৯৫৭ সালের আগ পর্যন্ত হেগেলীয় প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে প্রভুর মজা পাওয়াকে বোঝাতে ‘মজারু’ ব্যবহার করেছেন লাকাঁ। ১৯৫৭ সালের পর ধারণাটি তিনি প্রয়োগ করতে শুরু করেন ক্ষুধার মতো জৈবিক চাহিদার ক্ষেত্রে। কিছুদিনের ভেতরেই তিনি যৌনতা থেকে প্রাপ্ত মজা ও হস্তমৈথুনের সঙ্গে সম্পর্কিত করেন ‘মজারু’কে। ১৯৫৮ সালে স্পষ্টভাবেই লাকাঁ মজারু বা জুইসঁসের ধারণায় নিয়ে আসেন কাম ও ক্রোধের চরম উত্তেজনাকর মুহূর্তকে। ১৯৬০ সালে তিনি মজারু (jouissance) ও মজা (pleasure), এই দুইয়ের ভেতর পরিষ্কার ভেদরেখা টানেন। মজানীতিতে (pleasure principle) রাশ টানা হয় ভোগে (enjoyment)। অচেতনের ভেতরে সহজ (subject/সহজ**) অনুভব করতে থাকে, মজানীতির দৌরাত্ম্যে, বেশি ভোগ করা ঠিক নয়। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। মন চায় আরো ভোগ ও বিলাস। তবে মজানীতিকে উপেক্ষা করলে বিষয়টি আর উপভোগ্য থাকে না, যাতনা বা ক্লেশে (pain) পরিণত হয়, কারণ সহজ মানুষেরও একটা সীমা আছে ভোগ করার। ভোগ করতে করতে সীমা অতিক্রম করার পর আরাম যখন ‘হারাম’ হতে থাকে, মজার ভেতর যখন মুসিবত ঢুকে যায়, ভোগ যখন দুর্ভোগে ছেয়ে যায়, সেটাকেই লাকাঁ বলছেন জুইসঁস, আমরা বলছি মজা-রু (-য়িন্ড) (মজা Ruined!)। এই পরিস্থিতিতে মজার রেশ যেমন থাকে, তেমনি মজার বিনাশ হওয়ার কষ্টও থাকে, প্লেজার ও পেইন, দুটো মিলেই মজারু।
মজারুর যে মজানীতি (প্লেজার প্রিন্সিপাল) তার বাস আকারের কাঠামোতে (সিম্বলিক অর্ডার**), ভাষার দুনিয়ায়। এটা মনে রাখা জরুরি যে, মজারুর চরিত্র আদম-হাওয়ার মতোই, সেও আইন অমান্য করতে চায়, করে, ভোগের সকল মাত্রাকে সে অতিক্রম করতে চায় লোভীর মতো এবং প্রতিবারই সে যাতনার মুখোমুখি হয়। এই যে মজানীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সীমা অতিক্রমের অদম্য বাসনা, একেই ডাকা হয় ডেথ ড্রাইভ বলে। এর বাংলা করা যেতে পারে মৃত্যুঝোঁক (Death Drive)। পতঙ্গ যেমন কামনার আগুনে পুড়ে সত্যিকারের আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ঠিক তেমনি মজারুতেও মানুষের মন ধাবিত হয় মৃত্যুকূপের দিকে। মজারুকে দেহজ সার হিসেবে তো বটেই, লাকাঁ একে সারত ফ্যালিকও মনে করেন। ফ্যালিকের সাদামাটা অনুবাদ শিশ্নসংক্রান্ত, তবে লাকাঁনীয় পরিভাষায় এই ফ্যালাস শুদ্ধ জৈবিক লিঙ্গ নয়, কল্পনা এবং মনের ভেতর আকার ও সাকারে (সিম্বলিক : আকার, ইমাজিনারি : সাকার**) সক্রিয় ক্ষমতা ও যৌনতার প্রতীকও বটে। কাজেই ফ্যালাসের বাংলা করা যেতে পারে ‘ফলা’। লাকাঁ বলেন, মজারু হলো ফলিত (Phallic)*** ব্যাপার।
১৯৭৩ সালে লাকাঁ অবশ্য বলতে শুরু করেন, আরেকটি বিশেষ ধরনের মজারু রয়েছে, যা হলো মেয়েলি মজারু (ফেমিনিন জুইসঁস) বা ‘সম্পূরক মজারু’ (সাপ্লিমেন্টারি জুইসঁস)। একে আসলে ফলা (ফ্যালাস) দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না। এটি ফলার বাড়া, লাকাঁ বলেন ‘বিয়ন্ড দ্য ফ্যালাস’, এটি পরমের (বিগ আদার) মজারু। মেয়েলি মজারু তাই অনির্বচনীয়, মেয়েরা একে অভিজ্ঞতালব্ধ করতে পারে, কিন্তু ব্যাখ্যা করতে পারে না। তো এই দুই ধরনের মজারুর জন্য লাকাঁ বীজগণিতের দুই প্রতীক নির্ধারণ করেন : J = ফলিত মজারু (ফ্যালিক জুইসঁস) এবং JA = পরমের মজারু (জুইসঁস অব দি বিগ আদার)।
নারীর ব্যাখ্যাতীত মজারুর আকাশে সুদূর থেকে ভেসে আসে বিষাদের সুর। স্লোভেনিয়ার লাকাঁনীয় দার্শনিক রেনাটা স্যালেসল বলেন, নারীর ভেতর এই বিষাদ বিশেষভাবে জড়িয়ে থাকে মেয়েলি মজারুর সঙ্গে। নারীর ধ্যানী ও মগ্ন কামনা-যাতনা, যাকে আমরা মেয়েলি মজারু বলছি, তাকে ভাষায় ধরা যায় না, এমনকি অচেতনের রাডারেও সেটি থাকে অধরা। তো এই ব্যাখ্যাতীত মেয়েলি মজারু কি করে নারীর বিষাদের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। এই প্রশ্নের সম্ভাব্য জবাব দেন রেনাটা, তিনি বলেন, সম্ভবত দুনিয়ার বিষাদমাখা নিঃসঙ্গতায় নারী যে আনন্দ পায়, সেটাই আসলে রূপ নেয় মেয়েলি মজারুতে। নারীর ভেতর যেন একই সঙ্গে আনন্দময়ী, রহস্যময়ী ও বিষাদময়ী সত্তা লুকিয়ে থাকে। নারীরা যে শেষ পর্যন্ত মেয়েলি মজারুর আনন্দ-বেদনার ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না, রেনাটা বলছেন, সেটাও নারীর বিষাদগ্রস্ততার কারণ হতে পারে।
আরেকটি কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাখ্যা দেন রেনাটা, তিনি বলেন, নারী কল্পনায় ভাবতে ভালোবাসেন, কেউ না কেউ আছে, মানে অজানা পুরুষ, যে তার আবেগের মূল্য দিতে পারবে। সে এমন একজনের কথা কল্পনায় নিয়ে আসে, যে কি না আসলে কখনোই তাকে প্রধান কামনার বস্তু করে তুলবে না; কিন্তু কল্পনায় অধরা-অপরের বা পরমের বাসনার বস্তু হয়ে নিজে Objet petit a’র মতো গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার সুখ অর্জন করে নারী। মানে অন্যের কাছে সে Objet petit a হয়, এই Objet petit a ফলিত মজারুর উৎস হলেও, সেটি মেয়েলি মজারুর উৎস্য নয়। মেয়েলি মজারু হয় পরমের বাসনার বস্তু হয়ে ওঠার জন্য। মজার বিষয় হলো, খোদ পরমের বাসনা কি তাও নারীর অজানা। বিষাদ কোথা থেকে আসে, সেটা হয় তো এখান থেকে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। আরো বড় খবর হলো, ওই পরমেরও রয়েছে অভাবের ভাব, সেও পরিপূর্ণ নয়। অপরিপূর্ণ পরম অপরকে/ নারীকে কি করে পরিপূর্ণ করে তুলবে? সম্পূর্ণা না হওয়ার জন্য বিষণ্নভাবের উদয় হতেই পারে নারীর ভেতর। উন ফাম এ তাঁ ফামের অ্যাঞ্জেলাকে তাই বেশিরভাগ সময়েই মনমরা দেখা যায়।
তিন
ডিম প্রস্তুতকারী অ্যাঞ্জেলা যে নিজের ডিমকে নিষিক্ত করে, গর্ভে ঊন-মানুষকে (hommelette) ধারণ করতে চাইছে, সেটার জন্য যৌনমিলন ও সন্তান ধারণের সকল প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই তাকে যেতে হবে। তাতে আছে সুখ ও যাতনা। মেয়েলি মজারু প্রত্যাশী অ্যাঞ্জেলা। কিন্তু কেন সে এই মেয়েলি মজারু চায় তা তার অজানা, তারচেয়েও বড় ব্যাপার, যে এমিলের কাছে সে কামনা করছে, সে এমিলই উদাসীন। ফলিত মজারুতে এমিল রাজি, সেজন্য যৌনকর্মীর সঙ্গে সে বিছানায় যায়, কিন্তু সন্তানের দায় নিতে তা-না-না-না। জাতপাতের তোয়াক্কা করে না এমিল, প্রেমিকার জন্য রাস্তার লোকজনের কাছেই ধরনা দিতে থাকে। বিষয়টি বিষাদগ্রস্ত করে তোলে অ্যাঞ্জেলাকে। সে এমিলের কাছ থেকে সন্তান চায়। রাস্তার লোকেদের কাছ থেকে নয়। এমনকি তাদের বন্ধু আলফ্রেডের কাছ থেকেও নয়। কিন্তু ওই যে মজার নীতিকে অতিক্রম করতে চায় মজারু, তারই পথ ধরে অ্যাঞ্জেলা শয্যাসঙ্গী হয় আলফ্রেডের এবং এটার জন্য তার মনও খারাপ হয়। মনে মনে কষ্ট পায়, নিজের জন্য, এমিলের জন্য। কিন্তু সন্তান ধারণের জন্য মনের বিরুদ্ধে সে যায়, আবার তাতে মনের সায় যে একেবারে নেই, তাও নয়। নিজের বাসনাকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে অ্যাঞ্জেলার যে সীমা অতিক্রম, আনন্দ ও বিষাদকে একত্রে ধারণ, এটাই জুইসঁস বা মজারু। আলফ্রেডের সঙ্গে ডিম্বনিষেকের পর যখন অ্যাঞ্জেলা শুনতে পায় এমিল মেক্সিকো চলে যাবে, তখনো আবার তার মন খারাপ হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীমনের এই ত্রিশঙ্কু অবস্থা আনন্দ-বেদনার অনির্বচনীয় দোলাচল, এটাই ফেমিনিন জুইসঁস বা মেয়েলি মজারু।
অ্যাঞ্জেলা জানে, গর্ভবতী হলে সরাইখানায় আর নাচতে পারবে না, আয়-রোজগারে টান পড়বে। সে জানে, সন্তান ধারণ ও পরবর্তীকালের লালনপালনে দায়িত্ব ও কষ্ট তাকে সহ্য করতে হবে। তারপরও অ্যাঞ্জেলা আকাক্সক্ষা করছে সন্তানের। এমিল যখন অনিচ্ছুক, তখন কাছের বন্ধু আলফ্রেডই হচ্ছে ভরসাস্থল। আলফ্রেডের কাছ থেকে সন্তান নিলে সেটাও যে সুখকর হবে না, এমিল মেনে নেবে না, সেই শঙ্কাও কাজ করে অ্যাঞ্জেলার ভেতর। তারপরও সে মরিয়া। নারীর সন্তান উৎপাদনের সঙ্গে মানবসভ্যতার যোগ, প্রজননের সঙ্গে মানবশরীরের যোগ এবং গর্ভধারণের সঙ্গে গার্হস্থ্য অর্থনীতির যোগ, পুরো অংকটা অ্যাঞ্জেলাকে কষতে হয়েছে অংকের নিয়মেই। সেখানে ধ্রুব চলক হয়ে বসে ছিল JA, যাকে আমরা মেয়েলি মজারুর চিহ্ন হিসেবে শিখেছি। মানবসভ্যতা, মানবশরীর ও গার্হস্থ্য অর্থনীতি – সবগুলিতেই পরম ক্রিয়াশীল। পরমের বাসনাকে নিজের বাসনা করতে গিয়েই ভোগ ও দুর্ভোগের মুখে পড়তে হয় অ্যাঞ্জেলাকে, নারীকে। আর নারী বলেও তো কিছু নেই, লাকাঁ তেমনটাই বলেন। নারী বিভক্ত নানাবিধ সত্তায়। সম্পূর্ণা নারী হয় না বলেই লাকাঁ বলেন, ÔThere is no La femme, a definite article to designate the universal.’ এটাও নারী যাতনার একটি কারণ বইকি। কিন্তু লক্ষ করার বিষয়, যখন ডিম্বনিষেকের কাজ দুবার দুজনের কাছ থেকে হয়ে যায়, তখন কিন্তু অ্যাঞ্জেলা দর্শকদের বলে, সে একজন নারী, অর্থাৎ সে ভাবছে সে সম্পূর্ণা। পরসমাচার এই যে, অ্যাঞ্জেলা বুঝতে পারবে, অভাবের ভাব কাউকে ছেড়ে যায় না। ছেড়ে যাওয়ার ভান করে মাত্র। ওটা সাময়িক।
এমিল ও অ্যাঞ্জেলা যখন মৌনব্রত পালনকালে বইয়ের শিরোনাম দিয়ে ‘বাগযুদ্ধ’ করছে, তখন এমিল অ্যাঞ্জেলাকে ‘পেরুভিয়ান মাদার’ বলে মন্তব্য ছুড়ে দেয়। এমিল এসময় ব্যবহার করে সিমন ও রজার ওয়েসবার্ডের (Simone and Rozer Waisbard) ‘পেরুর মায়েদের চমকপ্রদ জীবন’ (La Vie Splendid des Momies Peruviennes) বইটি। পেরুর মায়েরা খুব অল্প বয়সে সংসার পাতে এবং সন্তান ধারণ করে। অ্যাঞ্জেলার সন্তান প্রত্যাশা ও পরিবার গঠনের বাসনা এমিলের কল্পনাকে পেরুতে নিয়ে যায়। অর্থাৎ অ্যাঞ্জেলা তার কাছে হয়ে ওঠে সুদূর পেরুর এক নারী। শুরুতেই আমরা দেখেছি পানশালায় অ্যাঞ্জেলা নাবিকের পোশাক পরে নাচে, তার সহকর্মী অ্যামাজনের পোশাক পরে মোহিনীনৃত্য পরিবেশন করে। নারী যেন গদারের গোটা ছবিতেই এক সুদূরের সত্তা। যাকে বোঝা কঠিন ব্যাপার। যেমনটা বোঝা কঠিন মেয়েলি মজারু। ঠিক এ-কারণেই যেন এমিল দূরে মেক্সিকোতে চলে যেতে চায়। ভাবখানা এমন, মেক্সিকো গেলে সমস্যার সমাধান মিলবে। অ্যাঞ্জেলা যখন আলফ্রেডের শয্যাসঙ্গী, তখন আলফ্রেডের প্রতিবেশীকে ফোন করে এমিল ওদের জানাতে বলে, ও মেক্সিকো চলে যাচ্ছে। প্রতিবেশী আলফ্রেড ও অ্যাঞ্জেলাকে খবরটি দিলে, আলফ্রেড অ্যাঞ্জেলাকে জিজ্ঞেস করে, মেক্সিকোতে কেন? তখন অ্যাঞ্জেলা জবাবে বলে, ‘সবসময় তুমি যার সঙ্গে থাকো, আসলে তুমি তার সঙ্গে থাকো না। অথবা উল্টোটা।’ অ্যাঞ্জেলার এই উত্তর আদতে তার নিজেরই কথা। অধরাকে পাওয়ার বাসনা ও না-পাওয়ার যাতনা। রবি ঠাকুর ঘটনাটিকে বলেছেন এভাবে : ‘বক্ষ হইতে বাহির হইয়া/ আপন বাসনা মম/ ফিরে মরীচিকাসম।/ বাহু মেলি তারে বক্ষে লইতে/ বক্ষে ফিরিয়া পাই না।/ যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই,/ যাহা পাই তাহা চাই না।’
এমিল, অ্যাঞ্জেলা ও আলফ্রেডের ত্রিভুজ সম্পর্কের বাইরে আরো দুটি বিষয় ব্রতের আকারে গদার দর্শকের সামনে হাজির করেন। প্রথম বিষয়টি হলো, এক জোড়া নারীপুরুষ, যারা অ্যাঞ্জেলার অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের নিচে সর্বক্ষণ দাঁড়িয়ে চুমু খেতে থাকে, তাও আবার নড়াচড়া ছাড়া। তারা চুমু খাওয়াতেই আটকে যায়। আর কিছুই করতে দেখা যায় না তাদের। এরা যেন রক্তমাংসের মানুষ নয়, ভাস্কর্যে পরিণত হয়েছে। প্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠে এই যুগল। আর অ্যাঞ্জেলার অ্যাপার্টমেন্টের পাশের অ্যাপার্টমেন্ট, যেখানে এক নারী থাকে, যার ল্যান্ডফোন অ্যাঞ্জেলা ও এমিল ব্যবহার করে, তার ঘরে প্রতিনিয়ত খদ্দেরের আনাগোনা। এ যেন প্রেমহীন দেহের ব্যঞ্জনা। বিপরীতে অ্যাঞ্জেলা কামজ প্রেমের ভেতর দিয়ে গড়তে চাইছে সংসার। এমিলের সঙ্গে। কিন্তু এমিল তাকে ঠেলে দিচ্ছে আলফ্রেডের দিকে। আলফ্রেডের ভেতর প্রেম থাকা সত্ত্বেও সে জানে অ্যাঞ্জেলা তাকে নয়, চায় এমিলকে, সন্তানের পিতা হিসেবে। দুই পুরুষের এই ঠেলাঠেলির ভেতর আমরা অ্যাঞ্জেলা, অর্থাৎ
নারী-নজরের (Female Gaze) দেখাও পাই এই ছবিতে। চাওয়া ও না-পাওয়ার দোলাচলে অ্যাঞ্জেলা যখন বিষাদগ্রস্ত, তখন দেখা যায় অ্যাঞ্জেলারই প্রস্তাব মেনে দুই পুরুষ নানাবিধ কসরত করে দেখায় অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর। তারা যেন বিষাদের তলা থেকে অ্যাঞ্জেলাকে টেনে তুলতে চায়। পুরুষদ্বয় অ্যাঞ্জেলার সামনে নিজেদের পাত্রকাম (Object-libido) করে তোলে। ওই মুহূর্তে কাউকেই পছন্দ হয় না অ্যাঞ্জেলার। ভালোবাসার ক্ষেত্রে দুই পুরুষকেই অপরিপক্ব মনে হয় অ্যাঞ্জেলার। তবে এই কসরত দেখানোর ভেতরেও দেখা যায় ডিমের উপস্থিতি। এমিল অ্যাঞ্জেলাকে তুষ্ট করার জন্য জাদু দেখানোর মতো করে নিজের কোটের পকেট থেকে একটি ডিম বের করে দেখায়। যেন সে নারীটিকে বলতে চাইছে, এই দেখো সেই নিষিক্ত ডিম, যা তুমি চাইছো, তা দিতে পারি আমি। কিন্তু অ্যাঞ্জেলা জানে, এমিল তা দিতে অনিচ্ছুক, মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে সে। তখন অ্যাঞ্জেলা ক্ষুব্ধ হয়, বিষণ্ন হয় এবং দুজনকেই ঘর থেকে বের করে দেয়। বের করে দেওয়ার পর আলফ্রেড দো মুসেতের (Alfred de Musset) ‘ভালোবাসা নিয়ে মশকরা করো না’ (ne Badine pas avec l’Amour) নাটকের বইটি হাতে নেয় অ্যাঞ্জেলা। সেখান থেকে সে পড়তে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে স্বগতোক্তিতে বলতে থাকে : ‘সকল পুরুষই মিথ্যেবাদী, অস্থির, প্রতারক, গপ্পোবাজ, ভণ্ড ও অহংকারী। ভালোবাসায় আমরা প্রায়ই প্রতারিত, প্রায়ই আহত এবং প্রায়ই অসুখী হই। কিন্তু আমরা ভালোবাসি।’ পরমের যে বাসনাকে নিজের বাসনা করে নারী ভালোবাসা কামনা করে পুরুষের কাছ থেকে, সেটি না পেয়ে, তার ভেতর বঞ্চনার বোধ জন্ম নেয় এবং তখন জীবনের যে সুখানুভূতি ও আনন্দময় দিক, সেদিক থেকে সে মুখ ঘুরিয়ে বসে। ওখানে বিষাদের উন্মেষ ঘটে। এই বিষাদময়তা বা বিষণ্নতা দর্শনের চোখে এক নেতিবাচক ব্যাপার, হেগেল একে বলতেন ‘বিশ্বের অন্ধকার’, অর্থাৎ সহজ (সাবজেক্ট) আপন সত্তা থেকেই নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়। এখানে সহজ বা সাবজেক্ট নারী, পুরুষ নয়। এই প্রত্যাহারের ফলে দূরত্ব তৈরি হয় সেই অবিনাশী জীবনসারের সঙ্গে, লাকাঁর ভাষায় বললে, লামেলার সঙ্গে। মজার বিষয়, গদারের এই ছবিতে হেগেলের ওপর লেখা একটি বইয়ের উপস্থিতি দেখা যায়, পানশালায় অ্যাঞ্জেলার এক সহকর্মীর হাতে। বার্নার্ড টেইসেডরের (Bernard Teyssèdre) লেখা ‘হেগেলের নন্দনতত্ত্ব’ (L’Esthétique de Hegel)। বিশ্বের সকল অন্ধকার যেন জমা হয়েছে পানশালার এক নারীর হাতে এসে। নারীটি ওই বই থেকে পাঠ করছিল : ÔCreations of art are the 40 days of nature’s glorious life.Õ বাইবেলে বর্ণিত চল্লিশ দিন ও চল্লিশ রাত ধরে
ঝড়-বৃষ্টি-জলোচ্ছ্বাস দিয়ে ঈশ্বরের দুনিয়া ধ্বংসের কথা আমরা জানি। এরপর প্রকৃতি নবপল্লবে জেগে উঠেছিল। আর কে না জানে, প্রকৃতি ও নারী সমার্থক শব্দ।
চার
আ উওম্যান ইজ আ উওম্যান গদারের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। সেটার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছেন তিনি। রঙের ব্যবহার করেছেন খুব সচেতনভাবে। সেটা আমরা আগেই আলাপ করেছি। এর পাশাপাশি ডিমকে মোটিফ হিসেবে কেন্দ্রে রেখে
নারী-পুরুষের কামনা-বাসনার যে সূত্র হাজির করেছেন গদার, তা এক কথায় ‘অপূর্ব’, যদিও সেভাবে ব্যবসাসফল হয়নি ছবিটি। গদার চেয়েছিলেন একটি মিউজিক্যাল কমেডি ধাঁচের ছবি বানাতে। কিন্তু ছবিতে সংগীতের ব্যবহার পুরোপুরি মিউজিক্যাল ফিল্মের মতো হয়নি। আবার কমেডির সঙ্গে মিশেছে মেলোড্রামা। হাস্যরসের সঙ্গে করুণরসের মিশ্রণও দেখা যায় ছবিতে। সম্ভবত এ-কারণেই দর্শক হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিল এই ছবি দেখে, এটি গদারের বন্ধু ও নবতরঙ্গের আরেক দিকপাল ফ্রাসোঁয়া ত্রুফোর মন্তব্য। তবে ব্যর্থতার সকল দায় গদার নিজের কাঁধেই নিয়েছিলেন। পয়সা উপার্জনে ব্যর্থ হলেও এই ছবি বক্তব্য উপস্থাপনে অভিনব পথ ধরে এগিয়েছিল। সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকায় ছবিটি মুক্তির পর মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, তারা হয় তো মনে করেছিল – গদার অশ্বডিম্ব প্রসব করেছেন। কিন্তু না, তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম এটি নয়, পক্ষান্তরে নারীর মেয়েলি মজারুকেই তিনি উপস্থাপন করেছিলেন নিজস্ব চলচ্চৈত্রিক ভাষায়।
নোক্তা অথবা প্রবন্ধ-সংলগ্ন কথা
* জুইসঁসের সঙ্গে প্লেজার ও পেইন দুটো বিষয় অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। মজা আর মৃত্যু যদি বলি, তো খুব একটা বাড়িয়ে বলা হয় না। মৃত্যুর কাছাকাছি যে গেছে সে জানে যাতনা কারে বলে। জুইসঁসের কাছাকাছি বাংলা শব্দ তাই ধার করেছি সুকুমার রায়ের কাছ থেকে।
হযবরল-তে তিনি লিখছেন : ‘বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,/ আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।/ আজকে হেথায় চামচিকে আর পেঁচারা/ আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।’ চামচিকে আর পেঁচাদের মজা, অন্যদিকে ইঁদুরের জন্য মৃত্যুযাতনা। ঘটনা হলো, এই দুটি বিষয় একই সময়ে সংঘটিত হতে হবে, অর্থাৎ ইঁদুর নিয়ে খেলতে খেলতে, মজা করতে করতে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। জুইসঁসের সঙ্গে এজন্যই ডেথ ড্রাইভকে সম্পর্কিত করেন লাকাঁ। মানুষের ভেতর এই মজা করতে করতে মৃত্যু বা যাতনার দিকে যাত্রা করে সে কি ‘একটা’ মানুষ করে? না, সেখানে ‘একাধিক’ মানুষের বাস, লাকাঁ মানুষ বা সাবজেক্টকে প্রকাশ করেন ডলার সাইন ($) দিয়ে, অর্থাৎ মানুষ বিভক্ত, একাধিক ভাগে। একভাগে দেখা মিলবে চামচিকা অথবা পেঁচার, অন্যভাগে ইঁদুরের, অপরভাগে আবার দর্শকের। শিকার, শিকারি ও দ্রষ্টার বাস একই মনে।
** এই অনুবাদটি লাকাঁ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের করা।
*** ফ্যালাসের তর্জমা ফলা ও ফ্যালিকের তর্জমা ফলিত করার পেছনে আমার চিন্তায় কাজ করেছে ‘ফলিতা’ শব্দটি, যার অর্থ রজঃস্বলা নারী। অপরদিকে ‘ফলিত’ শব্দের অর্থ ফল গতিশীলভাবে তাড়িত যাতে, যদিও ইংরেজি ‘অ্যাপ্লাইডে’র অনুবাদ হিসেবে ফলিতকে আমদানি করা হয়। তবে মনোবিশ্লেষণের খাতিরে আমরা একে ব্যবহার করছি ভিন্ন অর্থে। ফলিতা শব্দটির আরেক অর্থ ফলিতের আধার, আমরা আগেই জেনেছি ফলিতার এক অর্থ রজঃস্বলা নারী। এই রজঃস্বলা নারীতে আবার যে প্রবেশ করে ফলের আধার হয়ে – ফলা – ফলার অর্থ অস্ত্রের পাতা বা ব্লেড এবং বাণের আগাও হয়। এখানে মনে রাখা জরুরি, ইংরেজি ফ্রুট অর্থে আমরা ফল ব্যবহার করিনি, ক্রিয়াভিত্তিক অর্থের দিকে তাকালে দেখব, ফল মানে হলো সত্তার কোনোদিক দিয়ে বের হওয়া বা ফেটে বেরুনো। যদি বলি শিশ্ন থেকে যে বীর্য বের হয় সেটি ফল, তাহলে ভুল বলা হয় না। যা ফলকে ধরে রাখে সেটিকে ফলা বলে, তা পূর্বেই বলেছি। আর ওদিকে ‘ফ্যালিক’ ইংরেজি শব্দের অর্থ দেখলে ‘ফলিত’ শব্দটির মিল খুঁজে পাওয়া সহজ হয়ে যায়। ফ্যালিকের এক অর্থ যেমন শিশ্নসংক্রান্ত, আরেক অর্থ ইরেক্ট প্যানিস, ফলিত আসলে সেটাই, যে ফলার ভেতর ফল গতিশীলভাবে তাড়িত। ‘ফলিত’ শব্দের আরো একটি অর্থ হলো ‘তাৎপর্যগত’, এই শব্দের ভেতর অনুসন্ধান করলে ‘তৎ’ ও ‘পর’কে পাওয়া যাবে। ‘তৎ’ অর্থ তার; প্রাচীনকালে বস্তুর ভেতর যে অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয় ও উপলব্ধ সত্তা রয়েছে তাকে মনে করা হতো পুরুষ (Content), তাকে বোঝাতেই ‘তৎ’ শব্দের ব্যবহার হতো। লাকাঁর ফ্যালাসও এই ‘তৎ’ শব্দের মতো আকার ও সাকারে অবস্থান করে। ওদিকে, ‘পর’ দিয়ে ‘অধিক’ যেমন বোঝায়, তেমনি ‘পরপদসম্বন্ধী’ও বোঝায়। অতএব ‘ফলিত’ দিয়ে ‘ফলা’ সম্বন্ধীয় বোঝায় বললে ভুল হবে না আশা করি। ফল, ফলা ও ফলিত শব্দগুলিকে গর্ভফলের সঙ্গেও সম্পর্কিত করা যায় অনায়াসে।
সহায়
১. জঁ-লুক গদার, গদার অন গদার, টম মিলনে অনূদিত ও সম্পাদিত (নিউইয়র্ক, ডা ক্যাপো প্রেস, ১৯৭২)।
২. এলিজাবেথ এজরা, আঁ ফাম এতাঁফাম (un femme est infâme) : গদার’স রাইটিং লেসন, টম কনলে ও টি. জেফারসন ক্লাইন-সম্পাদিত আ কম্পানিয়ন টু জঁ-লুক গদার, পৃ ৬০-৭০ (অক্সফোর্ড, উইলি ব্ল্যাকওয়েল, ২০১৪)।
৩. রিচার্ড ব্রুডি, এভরিথিং ইজ সিনেমা : দ্য ওয়ার্কিং লাইফ অব জঁ-লুক গদার, (নিউইয়র্ক, হল্ট পেপারব্যাকস, ২০০৮)।
৪. জাক লাকাঁ, দ্য ফোর ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্টস অব সাইকোএনালাইসিস, দ্য সেমিনার অব জাক লাকাঁ (বুক ইলেভেন), জাক-আলাঁ-মিলার সম্পাদিত, অ্যালান শেরিডান অনূদিত, (নিউইয়র্ক, ডব্লিউডব্লিউ নরটন অ্যান্ড কোম্পানি, ১৯৯৮)।
৫. স্লাভয় জিজেক, দ্য লামেলা অব ডেভিড লিঞ্চ, রিডিং সেমিনার ইলেভেন : লাকাঁ’স ফোর ফান্ডামেন্টাল কনসেপ্টস অব সাইকোঅ্যানালাইসিস (পৃ ২০৫-২২০), রিচার্ড ফেল্ডস্টাইন, ব্রুস ফিংক ও মেইরি জানুস-সম্পাদিত, (নিউইয়র্ক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক প্রেস, ১৯৯৫)।
৬. রেনাটা স্যালেসল, লাভ অ্যাংজাইটি, রিডিং সেমিনার টুয়েন্টি: লাকাঁ’স মেজর ওয়ার্ক অন লাভ, নোলেজ, অ্যান্ড ফেমিনিন সেক্সুয়ালিটি (পৃ ৯৩-৯৭), সুজান বার্নার্ড, ব্রুস ফিংক-সম্পাদিত, (নিউইয়র্ক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক প্রেস, ২০০২)।
৭. কোলেট সোলের, হোয়াট ডাজ দ্য আনকনশাস নো অ্যাবাউট উইমেন, রিডিং সেমিনার টুয়েন্টি : লাকাঁ’স মেজর ওয়ার্ক অন লাভ, নোলেজ, অ্যান্ড ফেমিনিন সেক্সুয়ালিটি (পৃ ৯৯-১০৮), সুজান বার্নার্ড, ব্রুস ফিংক-সম্পাদিত, (নিউইয়র্ক, স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্ক প্রেস, ২০০২)।
৮. কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান (প্রথম খণ্ড), (কলকাতা, ভাষাবিন্যাস, চৈত্র ১৪১৭)।
৯. কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ : ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের অভিধান (দ্বিতীয় খণ্ড), (কলকাতা, ভাষাবিন্যাস, পৌষ ১৪১৭)।
১০. সুকুমার রায়, হযবরল, সুকুমার রায় সাহিত্য সমগ্র (প্রথম খণ্ড), সত্যজিৎ রায় ও পার্থ বসু সম্পাদিত, (কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স,২০১৪)
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.