বিকেলের সূর্য দিগন্তের ওপারে সবে ডুবতে শুরু করেছে। ছড়ানো সোনার কুচির সঙ্গে টকটকে লালের মাখামাখিতে এমন এক অপরূপ রঙের সৃষ্টি হয়েছে যে, চোখ সরানো যায় না।
নদীতীরে বসে এই দৃশ্য দেখছিল নানি আর নাতি। সালেহার বয়স বেড়েছে। বেশ ডাগর হয়েছে নাতি রেজাউলও। সে যে কত কথা বলে! মুগ্ধ বিস্ময়ে সেসব কথা শুনতে শুনতে সালেহার মনটা উদাস হয়ে যায়।
‘নানি এই নদী কতদূরে গেছে?’
নাতির এরকম প্রশ্নে নানি অবাক বিস্ময়ে তার দিকে চোখ মেলে তাকায়। বলে, ‘সে-ই অনেক দূরে।’
‘সে-ই অনেক দূরে মানে কত দূরে নানি?’
এ-প্রশ্নের উত্তর সালেহারও জানা নেই। কী উত্তর দেবে সে? নাতিকে ভোলানোর জন্য বলে, ‘দ্যাখ নানু, ওই যে আকাশে সূর্যটারে কেমন সুন্দর দেখাইতেছে।’
নাতি আকাশের দিকে তাকায়। তারও ছোট্ট চোখে মুক্ত আবেশের ঘোর লাগে। হঠাৎ তার চোখ চলে যায় ডানদিকে ভেঙে পড়া এক বিশাল মাটির চাকের দিকে। ওই চাকের ভেতর সে দেখতে পায়, কী যেন একটা ঝুপ করে নদীর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।
সে চিৎকার করে উঠল, ‘নানি দেখো, দেখো, কী য্যান্ একটা নদীতি পড়ল।’
সালেহা চমকে তাকিয়ে দেখতে পেল, ভেঙেপড়া মাটির চাকের সঙ্গে মানুষের আস্ত একটা কঙ্কাল। ধীরে ধীরে জলের অতলে হারিয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠল সালেহা।
হ্যাঁ, এই তো এখানটাতেই ছিল তাদের খড়ের গাদা। নদী ভাঙতে ভাঙতে এদিকে ছুটে আসাতে ঘরগুলির সঙ্গে সঙ্গে খড়ের গাদা আর গোয়ালঘরটা আরো পেছনে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নদী আগের জায়গার খানিকটা অংশ মুহূর্তেই গিলে ফেলল, তার সঙ্গে সেই কঙ্কালটাও।
সালেহার মনটা হঠাৎ করে কেমন বিষণ্ন হয়ে যায়। বুকের ভেতরে ধুকপুক করতে থাকে। এতদিন ভুলে ছিল। হঠাৎই ঘটনার স্রোত মনের ভেতরে ঘুরপাক খেতে থাকে। পেছন ফিরে তাকায় সে। তার চোখে ভেসে ওঠে এক জিঘাংসু ঘটনার প্রতিচ্ছবি।
তখন এই যমুনা ভাঙতে ভাঙতে প্রায় ওদের বাড়ির কাছে চলে এসেছে। বন্যার তোড়ে জলের ঘূর্ণিপাক যখন তীব্র বেগে পাড়ে এসে ঘাই মারছে, তখন মাটির বিশাল এক একটা চাক দৈত্যের মতো নদীগর্ভে আছড়ে পড়ছে। আর নদীর জল মুহূর্তেই তাকে গিলে ফেলে কোন অতলে যে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেউ তা জানে না।
এদিকটাতেই নদী খুব ভাঙে। বিশাল নদীর দুই তীর প্রায় দেখাই যায় না। তার মধ্যেই কখনো কখনো দু-একটা স্টিমার হুইসেল বাজিয়ে চলে যায়। বড় বড় নৌকা পাল তুলে নদীর এপার থেকে ওপারে যায় বাণিজ্য করতে। নদীর ওপারে সিরাজগঞ্জ। সেখানে নদীতীরে সপ্তাহে দুদিন হাট বসে। ব্যবসায়ীরা দলবেঁধে যায়, দলবেঁধেই ফিরে আসে। দক্ষিণে গোয়ালন্দ অনেকটা দূর বলে ওদিকে তেমন কেউ যায় না।
শহীদুলের বাপ রহমতও নৌকায় করেই ওপারে যায়। যেদিন হাটবার থাকে, সেদিন আট-দশজন মিলে আরিচাঘাট থেকে একটা বড় নৌকা ভাড়া করে। ঘাটের মহাজনদের অনেকেই যায়। কিন্তু এবার যমুনার যে ভয়ংকর রূপ, দেখে বুক কেঁপে ওঠে। নদী পাড়ি দিতে গিয়ে হঠাৎ যদি ঝড় ওঠে, তাহলে রক্ষে নেই, নির্ঘাৎ মৃত্যু। তাই এ-বছর এখনো হাট করতে যাওয়া হয়নি রহমতের। অপেক্ষায় আছে বানের তোড় কমে এলে তারপর যাবে। নদী থেকে সামান্য দূরে রহমতদের ঘর। রাক্ষুসী নদী তাদের গিলে ফেলার জন্যে হা করে আছে।
থাকার জন্য বড় একটা টিনের ঘর, পাশে শহীদুলের চাচাদের ঘর। একান্নবর্তী পরিবার বলে সকলেই এক উঠোনে বাস করে। বাপ-চাচাদের মিল-মহব্বত খুব বেশি। তিন ভাইয়ের মধ্যে রহমতই সবচাইতে ছোট। সকলেরই সংসার আছে, বাড়িভর্তি লোকজন। রহমত বছর আটেক আগে বিয়ে করেছে। একটামাত্র ছেলে তার, এই শহীদুল। বয়স সাত। শহীদুলের মা সালেহা এখনো দেখতে ভারী সুন্দর। মনেই হয় না তার সাত বছরের একটি ছেলে আছে।
বাড়িতে নিজস্ব পুকুর নেই। সামান্য দূরে খাঁ-সাহেবের একটি পুকুর আছে। পাড়ার লোকেরা সেখান থেকেই পানি আনতে যায়। খাঁ-সাহেব গ্রামের মাতব্বর। সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে থাকার চেষ্টা করেন। সারাদিন পুকুরে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসে। এখান থেকে পানি নেয়, এতে থালা-বাসন ধোয়, গোসল করে – খাঁ-সাহেব কিছু বলেন না। মাঝে মাঝে অবশ্য লাঠিতে ভর দিয়ে পুকুরের পাড়ে এসে দাঁড়ান। দেখেন গ্রামের ছেলে-মেয়ে, বউ-ঝি, ছোট-বড় সকলেই তাঁর পুকুর ব্যবহার করছে। হাঁক দিয়ে সকলকে সতর্ক করে দেন, ‘খবরদার পুকুরের পানি কেউ নষ্ট করবি না। তা-অলি সব শালার হাড়গোড় ভেঙে গুঁড়ো কইরে দেব।’
সকলেই জানে, এটা খাঁ-সাহেবের মনের কথা নয়। তাই চোখ তুলে তাকিয়ে খাঁ-সাহেবকে একটু দেখেই যে যার কাজে মন দেয়। খাঁ-সাহেবও মৃদু হেসে ঘরের দিকে পা বাড়ান।
সালেহা প্রায় প্রতিদিনই কলসি কাঁখে পানি নিতে আসে। যে-পথে সে
আসা-যাওয়া করে, সেই পথটা একটু নির্জন। লোক চলাচলও কম। ঘর থেকে বাইরে বেরুলেই পরপর বিশাল আকারের কয়েকটি আমগাছ, তারপরে দীর্ঘ বাঁশঝাড়। বাঁশঝাড় পেরিয়ে পুকুর। অন্য বউয়েরা আগে থেকেই যাওয়া-আসা করে। ছোট বউ বলে অন্য সবাই সালেহাকে তেমন একটা যেতে দিতে চায় না। শহীদুলের জন্মের পর থেকে এখন মোটামুটি নিয়মিতই পানি আনতে যায় সে।
আজো যাচ্ছিল সালেহা। ঘর থেকে বাইরে পা দিয়ে সামান্য এগোতেই দেখতে পেল, পশ্চিমের বড় একটা আমগাছের আড়ালে একজন লোক একটুখানি মুখ বাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটার চোখে একঝলক চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি মাথায় ঘোমটা টেনে দ্রুতগতিতে পুকুরের দিকে হেঁটে চলে গেল সালেহা। একবার মাত্র পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, লোকটা উল্টোদিকে ঘুরে তার গমনপথের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে।
সালেহা এর আগে লোকটাকে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। এতদিন ধরে এ-পথে চলাচল করছে, এই উপদ্রবের মুখোমুখি হতে হয়নি কখনো। কী চায় লোকটা? কোনো বদমতলব নেই তো? ভাবতে গিয়ে বুকটা একটুখানি কাঁপল তার। ঘাটে গিয়ে পানি ভরতে ভরতে কিছুটা দেরি করল। তারপর কলসি ভরে ধীরে ধীরে বাড়ির পথে হাঁটতে শুরু করল। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল, সেই লোকটা তখনো তেমনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। সালেহা কোনোদিকে না তাকিয়ে হন্হন্ করে এগিয়ে বাড়ির উঠোনে গিয়ে ধপাস করে পানির কলসিটা নামিয়ে নিজেও বারান্দায় বসে হাঁপাতে লাগল। বুকের ধড়ফড়ানি থামতে চায় না। ছোটবউকে ওই রকম করে আসতে দেখে মেজবউ তড়িঘড়ি ছুটে এসে সালেহার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হইয়েছে রে সালেহা। অমন কইরে ছুটতি ছুটতি এসে কলস ধপাস কইরে নামিয়ে রাখলি যে বড়?’
সালেহা মেজবউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘না, কিছু না তো। এই এমনি একটু জোরে হাঁইটে আসিছি, তাই।’
‘ও তাই বল। আমি ভাবলাম কী জানি আবার কী অলো?’
সালেহা একথার উত্তর না দিয়ে বেশ খানিকক্ষণ দাওয়ায় বসে থাকল। ঘুরেফিরে বারবার ওই লোকটার অর্ধেক অবয়ব চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। হঠাৎ করে অচেনা-অজানা এই লোকটা তার চলার পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়, বুঝে উঠতে পারে না সালেহা।
সংসারের কাজকর্মের মাঝেও এই একটা ব্যাপার তাকে আনমনা করে তোলে। ঘরের পুরুষ মানুষেরা সূর্যোদয়ের আগেই কাঁধে লাঙল নিয়ে ক্ষেতের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। কাজ শেষ করে ফেরে সন্ধ্যায়। ঘরে এখন পুরুষ মানুষ বলতে একমাত্র ওই শহীদুলই। অন্যদের ঘরে শুধু মেয়ে। নিজের মনে এক ধরনের সংশয়ের ভারী পাথর চেপে বসে। লোকটা যদি হুট করে বাড়িতে এসে হাজির হয়, তাহলে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে। না, না, অত সাহস হবে না ওর। আশেপাশে লোকজন আছে না! এ-কথা ভেবেও নিঃসংশয় হতে পারে না সালেহা।
পরদিনও পানি আনতে যাওয়ার সময় লোকটাকে একই জায়গায় একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে একটা আতঙ্ক এসে ভর করে। অথচ দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া লোকটার আচরণে এখন পর্যন্ত কোনো অসংগতি ধরা পড়েনি। সেজন্য কাউকে কিছু বলতেও পারছে না সে। তাছাড়া কীই বা বলবে? নিজের মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা এসে সংকুুচিত করে দেয় তাকে। একবার ভেবেছিল, শহীদুলের বাপকে বলবে। কিন্তু তিনি যদি ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ না করেন, সেজন্য বলতে গিয়েও ঠোঁট বুঁজে যায়, জিভ আটকে আসে। রাত্রিবেলা ঘুমোতে গেলেও এক ধরনের অজানা শিহরণে বুক কেঁপে ওঠে। দু-চোখে ঘুম আসে না। ভয়ের সঙ্গে এক ধরনের কৌতূহলও তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। লোকটা শেষ পর্যন্ত কী করে – এই একটা কৌতূহল তাকে এখন প্রতিদিন খাঁ-সাহেবের পুকুরঘাটের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
একদিন সন্ধ্যা হয়। এ-সময়ে পানি আনতে গেলে ফেরার পথে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে লোকটা সালেহার পথরোধ করে দাঁড়ায়। সে চমকে উঠে ছিটকে খানিকটা দূরে সরে যায়। তাকিয়ে দেখে, লোকটা মিটমিট করে হাসছে। মুখে একগোছা অসম্পূর্ণ দাড়ি, মোচ নেই, চোখে সুরমা। চেহারাটা ভালো না মন্দ, ঠিক বোঝা যায় না। হঠাৎ করেই কথা বলে ওঠে, ‘তোমার সঙ্গে আমার দুইডা কথা আছিল।’
সালেহা এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঘোমটাটা সামান্য টেনে বলে, ‘পথ ছাড়েন। আপনি কিডা, আমি চিনি না।’
‘আমি খাঁ-সাহেবের বাড়ির মানুষ। নতুন এইসেছি। পুকুরঘাটে তোমারে দেইখে আমার মন মজেছে।’
‘আপনে আমার পথ ছাড়েন। নালি চিৎকার কইরে মানুষ জড়ো করব।’
‘তা তুমি পারবা না। তাতে তুমারই ইজ্জত যাবে। মানুষ জড়ো হলি তেনারা তুমারে ভালো কবে? এই সন্ধেবেলায় পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলতিছ। তুমার ভয়-ডর নাই?’
‘আপনি আমার পথ ছাড়েন।’
বলেই সালেহা লোকটাকে পাশ কাটিয়ে উল্কাবেগে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। লোকটা কোনো বাধা দেয় না। সালেহা ছুটতে ছুটতে এসে ঘরে ঢুকে পানির কলসি নামিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। নিজেই সে নিজের বুকের ধড়ফড়ানির আওয়াজ টের পায়। জোরে একটা নিশ^াস টেনে, উঠে ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ফের বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্ষেত থেকে শহীদুলের বাপ এখনো ঘরে ফেরেনি।
সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উঠে হারিকেনটা জ্বালে সালেহা। তার আলোর স্থিরতর শিখায় একজন লোকের অসম্পূর্ণ দাড়ির কিছুটা অংশ কাঁপতে থাকে। বাইরে থেকে শহীদুলের বাপের হাঁক শোনা যায়, ‘ও শহীদুলের মা, কনে গেলা। এদিকে আইস।’
ডাক শুনে ত্বরিতগতিতে বাইরে বেরিয়ে এসে স্বামীর কাঁধ থেকে লাঙলটা নামিয়ে বারান্দার একে কোনায় দাঁড় করিয়ে রাখে। অন্ধকার বলে কারো মুখই ঠাহর করা যায় না। সালেহা মনে মনে খুশি হয়। যদি আলোর মধ্যে শহীদুলের বাপ বুঝতে পারে, তার মনের ভেতর ভয়ঙ্কর রকমের একটা তোলপাড় চলছে, যদি সে ধরা পড়ে যায়, তাহলে স্বামীর কাছে কী জবাব দেবে? মনে মনে ঠিক করে সালেহা, না, সে আর পানি আনতে খাঁ-সাহেবের পুকুরঘাটে যাবে না। কয়েকদিন সে যায়ও না। কিন্তু পুকুর থেকে পানি না আনলে চলবে কেন? শহীদুলের বাপ ক্ষেত থেকে ফিরে এসে এই পানিতে পা-হাত-মুখ ধোয়। যে-কদিন সে পানি আনতে যায়নি,
সে-কদিন পাশের বাড়ির হুজ্জতের মাকে অনেক অনুনয়-বিনয় করে কয়েক কলসি পানি আনিয়েছে। বদলে তাকে খুশি করে চাল-ডাল দিতে হয়েছে। কিন্তু এটা তো নিয়মিত করা সম্ভব নয়। স্বামী কত কষ্ট করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, সারাদিন রোদের মধ্যে দেহের চামড়া পুড়িয়ে ফসল ফলায়, সময় পেলে সে সিরাজগঞ্জের হাটে যায় দুটো পয়সা রোজগারের জন্য। যা রোজগার হয় তা থেকে যে আহারটুকু জোটে, সেটা দিয়ে নিজেদেরই ভালোভাবে চলা মুশকিল। সেখান থেকে অন্য কাউকে ভাগ দিলে নিজেদের পেটেই টান পড়বে। ভেবে মনস্থির করে, নিজেই সে পানি আনতে যাবে। তবে সূর্যাস্তের আগে গিয়ে আগেই তাকে ফিরে আসতে হবে। ভেবেই কলসি কাঁখে করে ঘর থেকে বেরোয় সে। বেরিয়েই দেখতে পায়, আমগাছতলায় লোকটা নিজেকে খানিকটা আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর মধ্যে একটা উদাসীনতার ভাব আছে, দেখে মনে হয়, সে প্রকৃতি দেখতে বেরিয়েছে, কোনো ব্যক্তি তার লক্ষ্য নয়। সেটা সালেহারও দৃষ্টি এড়ায় না। সে দ্রুত পুকুর থেকে পানি নিয়ে ফিরে আসার পথে লোকটা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। সালেহা সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে দ্রুত তাকে অতিক্রম করে চলে আসার চেষ্টা করে। কিন্তু লোকটা প্রজাপতির মতো দু-হাত ছড়িয়ে সালেহার পথরোধ করে দাঁড়ায়। এবার সালেহার চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সে চাপা কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, ‘আপনি কী চান?’
‘আমি তুমারে চাই।’
বুকের মধ্যে একটা প্রচণ্ড পাথরের চাঁই এসে ঘাই মারে। বলে কী লোকটা! তবু নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করে সালেহা।
‘আমার বিয়া হইছে, আমার একটা ছেলে আছে, স্বামী আছে।’
‘তাতে কী? তুমার স্বামী তো ক্ষেতমজুর। তুমারে কিছুই দিতে পারে না। আমি তুমারে সব দিমু। তুমি সুখে থাকবা।’
‘এইডা আপনে কী কন? আপনে যান, আমার পথ ছাড়েন।’
‘আমি তুমারে ভালোবাসি, আমারে ফিরাইয়া দিও না।’
‘না না, আপনি আমারে যাইতে দ্যান। এখনি আমার স্বামী ঘরে ফিরব। আমারে ঘরে না পালি সর্বনাশ অবি। আল্লার কসম লাগে, আপনি যান।’
‘আচ্ছা, আমি এখন যাইতেছি। কাইল আবার আসব। তুমি মনডারে ঠিক করো। আমার কথাডা ভাইবা দ্যাখো। তুমার মতো রাজরানীরে এই ঘরে মানায় না।’
সালেহা অন্ধকারেও টের পায়, তার চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠেছে। তার সুখের সংসার। স্বামী তাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। শহীদুল কোল আলো করে রেখেছে। সেখানে এই লোকটা কালো মেঘের অশনিসঙ্কেত হয়ে সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দিতে চায়। সালেহা কী করবে ভেবে পায় না। লোকটা অন্ধকারে কথা বলে ওঠে, ‘আইজ যাও। কাইল তুমি পশ্চিমদিকের বাঁশঝাড়ে আইবা। আমি তুমার মতামত জানতে চাই।’
লোকটার কথার মধ্যেই একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি টের পায় সালেহা। সে মাথা নিচু করে আস্তে আস্তে পা বাড়ায়। ঘরে এসে দেখে, শহীদুলের বাপ ফিরেছে। চোখের সামনে সালেহাকে দেখে মাথায় রক্ত উঠে যায় তার। এক শুষ্ক গরম অনুভূতি রক্তের মতো গলগল করে তার মুখ থেকে উত্তপ্ত লাভার মতো বেরিয়ে আসে, ‘কই গেছিলি এই সন্ধ্যারাইতে, তোর কোন ভাতারের কাছে গেছিলি? পানি আনতে বিকালে বাইরাইছস। এইটুক পথ। পানি আনতি এত সময় লাগে?’
সালেহা স্বামীর কথার কোনো উত্তর দেয় না। তাতে রহমতের রাগ আরো ঘন হয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে ক্রমশ উত্তপ্ত করে থাকে। সে এসে দ্রুত সালেহার চুলের মুঠি ধরে পিঠের ওপর কয়েক ঘা বসিয়ে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘ক, কই গেছিলি মাগি, ঠিক কইরে ক।’
চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে অন্যান্য ভাই ও ভাইয়ের বউয়েরা। ছোটভাইয়ের এই অবিশ^াস্য আচরণে তাদের চোখে ও মনে বিস্ময়ের ঝিলিক লাগে। বড়ভাই গিয়ে সালেহাকে ছোটভাইয়ের হাত থেকে উদ্ধার করে। সালেহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ততক্ষণে শহীদুল এসে মার আঁচল ধরে দাঁড়িয়েছে। মার কান্না দেখে সে-ও চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। বড়বউ এসে সালেহা আর শহীদুলকে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে যায়। সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু তাদের মনেও একটা তীব্র কৌতূহল ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকে। সত্যিই তো এই ভর সন্ধ্যাবেলায় পানি আনার নাম করে সালেহা কোথায় গিয়েছিল? কান্নার বেগ কমলে বড়বউ সালেহাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ছোটবউ, আমারে ক দিহি, তুই কুতায় গেছিলি?’
সালেহা কোনো কথা বলে না। তাতে করে বড়বউয়ের সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। নানা ধরনের চিন্তা এসে মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। মেয়েটা কি তাহলে সর্বনাশের দিকে পা বাড়াল?
মাথা খানিকটা ঠান্ডা হলে দাওয়ায় বসে রহমত নিজের চুল টানতে লাগল। এটা সে কী করল? বউকে ধরে মারল? এতটা বছর বিয়ে হয়েছে, কখনো বউকে সে একটা কটু কথাও বলেনি। অথচ আজ যে তার কী হলো? সে জানে, সালেহা কোনো অন্যায় কাজ করতে পারে না। বউ তার সুন্দরী, এ-কথা সত্যি। সেজন্য পাড়ার ছেলে-ছোকরাদের নজর আছে। সেসব সামাল দেওয়ার ক্ষমতাও আছে সালেহার। কিন্তু আজ যে কী হলো? কখনো তো সালেহা সন্ধ্যা গড়িয়ে বাড়িতে ফেরে না। পানি আনতে গেলে বেলাবেলিই সে ঘরে ফিরে আসে। আজ এমন কী ঘটেছিল যে, সন্ধ্যার পিঠে ভর দিয়ে তাকে ঘরে ফিরতে হলো? অবশ্য তার নিজেরও উচিত ছিল, সালেহাকে ভালোভাবে জিজ্ঞেস করা, কেন তার দেরি হলো। তা না করে সালেহার সঙ্গে এ-ধরনের আচরণ করা তার মোটেই উচিত হয়নি। আর যাই হোক, সালেহা তার ছেলে শহীদুলের মা। দিনরাত ঘরের কাজ করতে করতে ক্লান্ত হলেও স্বামীর সেবাযত্নে তার সামান্যতম ত্রুটি কোনোদিনই লক্ষ করেনি সে। তাই, কারণ না জেনে বউয়ের ওপর এ-ধরনের অত্যাচার করা মোটেই উচিত হয়নি। আফসোস হয় তার।
রাতে বিছানায় শুয়ে বউকে বুকের কাছে টেনে নেয়। মাথায়-পিঠে হাত বুলায়।
‘অন্যায় হয়ে গেছে বউ। তুই আমারে মাফ কইরে দে।’
স্বামীর মুখ চেপে ধরে সালেহা।
‘তুমার কী দোষ, দোষ তো আমারই। আমিই তো দেরি কইরে বাড়ি ফিরিছি।’
‘তা তুই দেরি কইরে বাড়ি ফিরলি ক্যান – ক’দিনি?’
‘তুমারে কবো না তো কারে কবো। ভেবেছিলাম, আইজ ঘরে ফিরেই তুমারে কথাডা কবো। তা …।’
‘কী অইছল ক আমারে – সব গুছাইয়া ক।’
সালেহা স্বামীর কাছে সব খুলে বলে। শুনে একলাফে তড়াক করে বিছানায় উঠে বসে রহমত। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি একটি সরীসৃপ মুহূর্তেই কয়েক লক্ষবার নেচে ওঠে। জিঘাংসায় তার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। উত্তেজিত কণ্ঠে চাপা স্বরে সে বলে, ‘বউ, তুই শালারে কাইল আমারে একটু দেখ্যায়া দিবি। অরে আমি মাটির মধ্যি পুঁইতা ফালামু।’
সালেহা এবার বিজ্ঞের মতো কথা বলে, ‘শোন, মাথা গরম কইরে কোনো কাজ করলি চলবি না, মাথা ঠান্ডা কইরেই কাজ করতি অবি।’
‘আরে কী কস তুই বউ! শালার পুতের সাহস কত! আমাগের বাড়ির বউয়ের ওপর নজর পড়িছে, ওর চোখ দুইডা ঘুঁইটে দিয়ে আমি ওরে কানা বানাইয়া ফালামু, যাতে জীবনে আর চোখে দেখতি না পায়।’
‘শোন, শোন, আমি একটা কথা কই। বিটা খাঁ-সাহেবের বাড়ির লোক। বুঝিশুনি কাজ করতি অবি। তুমি একা একা কোনো সিদ্ধান্ত নিতি যাইও না। ভাইদের সঙ্গে পরামর্শ কইরে যা হোক একটা কিছু করো।’
সালেহার কথা মনে ধরলেও রাগ কমে না রহমতের। ঘরের মধ্যে নড়েচড়ে আর একা একাই গজগজ করতে থাকে – ‘শালা খাঁ-সাহেবের গুষ্টি মারি।’
সালেহা বলে, ‘এবার ঘুমাতে যাও দিনি। কাইল সকালে উইঠে পরামর্শ কইরে যা হোক একটা কিছু করা যাবিনি।’
সালেহার কথামতো বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে রহমত। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে না। তার দু-চোখে বারবার একটা কম্পিত ছায়ামূর্তি এসে উঁকি মারতে থাকে। সেই ছায়ামূর্তির মুখটা খুব স্পষ্টভাবে দেখার চেষ্টা করে সে, কিন্তু কিছুতেই তা স্পষ্ট হয় না। আধো ঘুম-আধো জাগরণের মধ্যেই বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে রহমত। তারপর কখন ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেও তা টের পায় না।
অভ্যেসমতো খুব সকালেই ঘুম থেকে ওঠে। মাঠে যাওয়ার আগে দু-ভাইকে ডেকে পরামর্শ করে। ঘটনা শুনে ভাইদের চোয়ালও শক্ত হয়ে ওঠে, শরীরের রোমকূপে রোমকূপে উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করে। তিনজনে মিলে পরামর্শ করে, শালার পুতেরে জাহান্নামের আগুনে তিলে তিলে পুড়িয়ে মারার ব্যবস্থা করবে; ওকে এমন শাস্তি দেবে, যাতে ও কোনোদিন আর পৃথিবীর আলো দেখতে না পায়।
তিন ভাই মিলে সালেহাকে ডাকে। ওর মুখ থেকেই সব কথা শুনতে চায়। সালেহা সব কথা খুলে বলে। ছোটবউ – সকলের কাছেই ওর একটা আলাদা মর্যাদা আছে। এই বাড়ির প্রতিটি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত সালেহা কোনোকিছুই লুকোতে পারে না। বড়ভাই সালেহাকে কিছু পরামর্শ দিয়ে ঘরে যেতে বলে। তারপর তিন ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, আজ রাতেই চূড়ান্ত কাজটা সেরে ফেলতে হবে। পরামর্শ শেষ করে যার যার মতো ক্ষেতে কাজ করতে চলে যায়।
বিকেল হওয়ার আগেই সালেহা সুন্দর করে সাজতে বসে। মুখে ভালো করে স্নো-পাউডার মাখে। পায়ে আলতা মাখে। গত ঈদে স্বামীর আনা টকটকে লালরঙের একটা শাড়ি পরে। এই সাজে এখন সালেহাকে জ্যোৎস্নার পরির মতো মনে হয়। যেন এক্ষুনি ডানা মেলে মহাশূন্যে উড়ে চলে যাবে। মাথার চুলে বিনুনি কাটে। কপালের দু-পাশের চুল ছোট্ট দুটি ঢেউয়ের মতো উঁচু হয়ে থাকে।
বেলা খানিকটা পড়ে এলে কলসিকাঁখে বাইরে বেরিয়ে আলতো পায়ে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে সালেহা। সেই নির্জন আমগাছটা পেরিয়ে সে বাঁশঝাড়ের দিকে এগিয়ে যায়। সেখানে যাওয়ামাত্র আধো-আলো, আধো-অন্ধকার থেকে বেরিয়ে লোকটা সালেহার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখের তীব্র ঢেউ এসে কামনার মতো আছড়ে পড়তে থাকে সালেহার দেহের ওপরে। মুগ্ধ বিস্ময়ে সে তাকিয়ে থাকে। মৃদু হেসে চোখের ইশারায় তার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয় সালেহা। লোকটা নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না। একমুহূর্তে সে সালেহার ডান হাতটা নিজের হাতের ভেতরে তুলে নেয়। সালেহার শরীরেও এক অচেনা বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে যায়। তার রক্তের গতি কয়েক লক্ষ গুণ বেড়ে গিয়ে এক উষ্ণ স্রোতের আবর্তে তাকে নিক্ষেপ করে। মুখের ওপরে একটা রক্তিম আভা ঘন আবরণের সৃষ্টি করে। সে কিছু বলে না। মুখে শুধু একটা মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, ‘রাইতে ঘরে আইসেন।’
সালেহার কথা শুনে লোকটার চোখের ভেতরে একটা স্বপ্ন দোল খেতে থাকে। তার মনে হয়, সে কোনো সুদূরপারের মায়াবী নারীর কণ্ঠের আহ্বান শুনছে। কথাটা যেন সে শুনতে পায়নি, এমনভাবে সালেহার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কী বললা তুমি, কী বললা তুমি আমারে?’
‘বললাম, রাইতে ঘরে আইসেন।’
‘ক্যান রাইতে তোমার স্বামী ঘরে
থাকবে না?’
‘না, হ্যারা সবাই যাত্রা দেখতি যাবি। ঘরে আমি শুধু একলাই থাকব।’
নিজের কানকে বিশ^াস করতে কষ্ট হচ্ছে লোকটার। এত সহজে সালেহা স্বপ্নের নায়িকা হয়ে তার বাহুপাশে ধরা দেবে, সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল, শেষ পর্যন্ত প্রত্যাখ্যানই জুটবে তার ভাগ্যে। অবশ্য সে জানে, কঠিন প্রাপ্তির জন্য জীবনে অনেক ঝুঁকি নিতে হয় – অনেক সাধনা করতে হয়। কিন্তু তাকে তেমন সাধনা করতে হয়নি, শুধু কিছুটা ঝুঁকি নিতে হয়েছে। তবে কি তার কথায় ভয় পেয়ে সালেহা তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, নাকি তার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তাকে তার ঘরে আহ্বান জানাচ্ছে? একটা অজানা পুলকে ভরে ওঠে লোকটার মন। সে তার অসম্পূর্ণ দাড়িতে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলে, ‘আমি রাইতে তুমার ঘরে আসব।’
সালেহা মৃদু হাসির ঝলক ছড়িয়ে খাঁ-সাহেবের পুকুরঘাটে গিয়ে দ্রুত বাড়ির পথ ধরে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। একটা ভুতুড়ে নিস্তব্ধতা আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে প্রকৃতিকে। আমবাগানে ঝিঁঝিপোকার আলোর উৎসব শুরু হয়ে গেছে। এখন আর গাছের আড়ালে লোকটিকে দেখতে পায় না সালেহা। সে গিয়ে বাইরে থেকে দরজায় তুলে দেওয়া শেকলটা টেনে নামিয়ে ঘরে ঢোকে। খুঁজে খুঁজে ম্যাচের কাঠি দিয়ে হারিকেনটা জ্বালায়। স্বামী রহমত আর ভাইয়েরা এখন ঘরে ফিরবে না। সকালে মাঠে যাওয়ার সময় তার ঘরের পেছনের মুলিবাঁশের বেড়ার বাঁধন খুলে কোনোরকমে হালকা করে লাগিয়ে রেখে গেছে। ঘরের ভেতরে একা একা বসে উত্তেজনায় কাঁপছে সালেহা। লোকটাকে তো ঘরে আসতে বলল। সে এলে কী করবে সালেহা? যদি লোকটা এসে তার গায়ে হাত দেয়, যদি …। ভাবতে পারে না সে। সে কি চিৎকার করবে? তা না হলে রহমত, ভাইয়েরা কেমন করে টের পাবে, লোকটা ঘরে এসে ঢুকেছে? কিন্তু চিৎকার করলে তো আশেপাশের ঘরের মানুষরাও সব ছুটে আসবে। এসে এভাবে লোকটার সঙ্গে খালি ঘরে সালেহাকে দেখলে কেলেঙ্কারি হবে। না, চিৎকার করবে না সালেহা।
ঘরের দরজায় হালকা টোকা পড়ে। একটা ফিসফিস আওয়াজ কানে ভেসে আসে সালেহার।
‘সালেহা, দরজা খোল। আমি এইসেছি।’
সালেহা নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে ভেতর থেকে দরজার খিল খুলে দিলে লোকটা একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে একলাফে ঘরে ঢুকে পড়ে। সালেহা দরজা বন্ধ করে দেয়। হারিকেনের আলোয় এবার ভালো করে লোকটার মুখটা দেখে। বয়স কত হবে? ত্রিশ কী পঁয়ত্রিশ। থুঁতনিতে কালো কুচকুচে দাড়ি। বাকি মুখাবয়র ফাঁকা। মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। চোখে সুরমার সরু রেখা চেহারায় একটি মেয়েলি আভরণ সৃষ্টি করেছে। গায়ে সাদা দীর্ঘ পাঞ্জাবি, পরনে একটা চেক লুঙ্গি। গায়ের রং শ্যামলা। সালেহাকে আকর্ষণ করতে পারে, এমন কোনোকিছুই তার চেহারায় নেই। তবু লোকটা সালেহার পেছনে লেগেছে। সে জানে তার স্বামী আছে, সন্তান আছে – তবু সালেহাকে তার চাই-ই। সালেহা বোঝে, এটা পুরুষমানুষের একধরনের নেশা। অন্য নারীর প্রতি আকর্ষণের মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে কামতৃষ্ণাই যে প্রবল হয়ে ধরা দেয়, এই লোকটা তার ব্যতিক্রম নয়। মনে মনে লোকটাকে ঘেন্না করতে শুরু করে সে।
লোকটা ঘুরে ঢুকে খুব ভালো করে চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলে। গরিবের সংসারের যে হাল হয়, এ-ঘরেও তার জরাজীর্ণ প্রতিচ্ছবি লক্ষ করে তার প্রলোভনের মাত্রাটা আরো বেড়ে যায়। সে বুঝতে পারে, কেন এত সহজে সালেহা তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে। দারিদ্র্য নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসে পয়সাওয়ালা মানুষেরা। আজ সে চতুর শিকারি, সালেহা তার জালে বন্দি নির্জীব মাছ। সালেহাকে নিয়ে এখন সে খেলবে, বড়শিতে গেঁথে নিয়ে এক উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়বে। আজ সালেহা শুধু তার, শুধু তার।
‘আপনে চৌকিতে বসেন।’ লাজনম্র কণ্ঠে বলে সালেহা।
চৌকিতে বসতে বসতে বলে লোকটা, ‘আইজ যে আমার কী আনন্দ লাগতেছে সালেহা, তোমারে কী কইরে বোঝাব!’
সালেহা হাসে। সেই হাসির মধ্যে আলোর দোলনার মতো অজ্ঞাত এক রহস্য ঝুলে থাকে। লোকটার বুকে তাতে আরো শিহরণ জাগে। সে সালেহার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি মুহূর্তে একবার পর্যটন করে আসে। কী সুন্দর দেখতে এই সালেহা! কে বলবে তার আট বছর হলো বিয়ে হয়েছে, তার সাত বছরের একটা ছেলে আছে? ছেলেকে সালেহা আজ মেজবউয়ের ঘরে ঘুমোতে বলেছে। বোনদের সঙ্গে খেলতে খেলতে সে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ ঘর একেবারেই ফাঁকা। লোকটার আর তর সয় না।
সে চাপা স্বরে ডাক দেয়, ‘কাছে আসো সালেহা।’
সালেহাও রহস্য করে, ‘আসতিছি মিয়া সাব, আসতিছি। এত তাড়া কিসের? সারারাত্তির তো পইড়েই আছে।’
‘তা তো আছেই। তাই বইলে কি তুমি এখন আমার কাছে একটুও আসবা না?’
‘আমি তো আপনার কাছেই আছি। শুধু আমি আর আপনি। আইজ রাইতে এইখানে আর কেউ আসবি না।’
লোকটা দাঁত বের করে হাসে। জিভের আগায় একটুখানি তরল পদার্থ এসে ঝিলিক মারে। ঢোক গিলে সে আবার তরল পদার্থটুকু গলার ভেতর দিয়ে পেটের মধ্যে চালান করে দেয়। দেখে সালেহার গা ঘিনঘিন করে ওঠে। লোকটা চৌকি থেকে নেমে সালেহার কাছে চলে আসে। সালেহার বুক দুরুদুরু করে। কিন্তু নিজেকে সংযত করে সে কলস থেকে পানি ভরার ভঙ্গিতে দূরে সরে যায়।
এই সময়েই ঘরের মুলিবাঁশের বেড়ায় মড়মড় শব্দ ওঠে। মনে হয়, যেন কোনো বুনো শেয়াল বেড়া ভেঙে ঘরে ঢোকার চেষ্টা করছে। লোকটা চমকে পেছন দিকে তাকাতেই রামদা হাতে দুটো লোক বেড়া খুলে মুহূর্তেই ঘরে ঢুকে পড়ে। লোকটা দৌড়ে দরজার দিকে ছুটে যায়। বাইরে থেকে শিকল তোলা। বেরুতে না পেরে সে স্থবির ভাস্কর্যের মতো দরজার কাছেই বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তার মুখ ফ্যাকাশে। দেহ থরথর করে কাঁপছে। হারিকেনের আলোয় একটা কালো বেড়ালের মতো এক কোনায় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রহমত। তারা দেরি না করে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক ধাক্কায় সে মেঝেতে পড়ে যায়। সেই ফাঁকে সালেহা ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে এক ঝটকায় বাইরে বেরিয়ে যায়। রহমত আর রহমতের মেজভাই সরাফতের চোখে-মুখে জিঘাংসার আগুন। আধো আলো-অন্ধকারে চারটি চোখ কাচের মার্বেলের মতো ঝকঝক করছে। রহমত দেরি না করে বাঁ-হাতে কোমর থেকে নতুন গামছাটা এক ঝটকায় বের করে আনে। ভয়ে লোকটার মুখ থেকে একটা চাপা আর্তনাদ বের হতে থাকে। রহমত গিয়ে এক পা দিয়ে বুকের ওপর চেপে ধরে খুব দ্রুত লোকটার গলায় নতুন গামছাটার একদিক ফাঁসির দড়ির মতো পেঁচিয়ে দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সরাফত রহমতের সামনে চলে আসে।
লোকটা আর্তনাদ করে বলতে থাকে, ‘আমারে বাঁচান ভাই, আমারে বাঁচান। আর কোনোদিন এই ভুল হবে না। আমি গেরাম ছাইড়ে চইলে যাব। আমার জীবন ভিক্ষা দেন।’
লোকটার কথায় একটুও মন টলে না রহমতের। সে দেরি না করে গলার ওপর পা দিয়ে চেপে হ্যাঁচকা টানে গামছাটাকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে আসে। গামছাটা লোকটার গলায় এমন জোরে পেঁচিয়ে যায় যে, একটি গোঁ-গোঁ আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ কানে আসে না রহমত ও সরাফতের। বাইরে একটানা ঝিঁঝির ডাকে একটা অদ্ভুত রহস্যময়তা রাত্রির আবহে ঘন হয়ে আসে। মাঝে মাঝে শেয়ালের ডাক শোনা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটার গলার গোঁ-গোঁ আওয়াজও বন্ধ হয়ে যায়। রহমত ও সরাফত গলার ঝুলন্ত দড়ি ধরে টানতে টানতে ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে দেহটাকে বাইরে খড়ের গাদার কাছে নিয়ে আসে।
রহমত ঘর থেকে একটা কোদাল বের করে আনে। তারপর খুব দ্রুত একটা গর্ত খুঁড়তে থাকে। সরাফত ছোটভাইকে তাড়া দেয়, ‘তাড়াতাড়ি কর।’
রহমত প্রাণপণ চেষ্টায় গর্ত খোঁড়া শেষ করলে দু-ভাই মিলে দেহটাকে গর্তের মধ্যে নামিয়ে দিয়ে তার ওপরে মাটি ফেলে পুরো দেহটাকে ঢেকে দেয়। কিন্তু নতুন খোঁড়া জায়গাটা সকলের নজরে পড়বে বলে খড়ের পাঁজা থেকে খড় নামিয়ে গোটা কবরটাকে ভালোভাবে ঢেকে দিয়ে দুজনে ঘরে চলে আসে।
সরাফত নিজের ঘরে চলে যায়। রহমতও নিজের ঘরে ঢুকে হারিকেনটা জ্বালায়। এবার সে নির্ভার। এবার আর তার বউয়ের দিকে কেউ নজর দিতে পারবে না।
গভীরতর স্বস্তিতে তার বুক থেকে দীর্ঘ এক নিশ^াস বেরিয়ে আসে। হারিকেনের আলোতে সে ভাঙা বেড়ার বাঁধন ভালো করে লাগিয়ে সালেহাকে ডাকতে যায়।
বাইরে বেরিয়ে সালেহা মেজবউয়ের ঘরে গিয়ে বসে ছিল। তার মুখ গম্ভীর। মুহূর্তের মধ্যে এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল! অথচ এই সবকিছুর জন্য দায়ী সে নিজে। নিজে যদি স্বামীকে প্ররোচিত না করত, তাহলে কিছুতেই একটা লোকের জীবন এভাবে নিঃশেষিত হতে পারত না। বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা শিরশিরে অনুভূতি তাকে একেবারে শীতল করে দেয়!
সে কিছুতেই ভুলতে পারে না, একটি মুখ, অসম্পূর্ণ দাড়ি আর চোখে সুরমার সূক্ষ্ম আভরণ। ভাবতে ভাবতে এক ধরনের করুণা এসে সালেহাকে গ্রাস করে। ততক্ষণে স্বামী রহমত বাইরে থেকে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসে। তার মুখে এক ধরনের স্বস্তির আভা। খেতে খেতে বলে, ‘শালা, আর কোনোদিন আমাগো বউ-ঝিদের দিকে নজর দিতি পারবি না। শালায় এখন মাটিতে কেঁচো হইয়ে জন্মাবি।’
সালেহা হঠাৎ দেখতে পায়, সত্যি সত্যি একটা কেঁচো খাবার পাত্রের পাশ দিয়ে রহমতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রহমত খেয়াল করেনি। সালেহার আর্তনাদে রহমতও হঠাৎ করে থমকে যায়।
সালেহার চিৎকারে পাশের ঘর থেকে সরাফত ছুটে এসে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হইছে রে রহমত। বউমা চিৎকার করতিছে ক্যান্?’
রহমত হাঁক দেয়, ‘ও কিছু না ভাইজান, ও কিছু না। আপনি গিয়া ঘুমান।’
সরাফত চলে গেলে রহমত দেখতে পায় কেঁচোটা তার থালা বেয়ে ঠিক মাঝখানে গিয়ে দেহটাকে গোল করে পেঁচিয়ে নিঃশব্দে শুয়ে আছে। বিস্মিত রহমত সেইদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটি কাঠি এনে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু কেঁচোটি কিছুতেই সেখান থেকে সরে যায় না।
তখনি নদীর বুকে ঝুপ করে শব্দ ওঠে। প্রমত্তা নদীর পাড় ভাঙতে ভাঙতে ক্রমশ রহমতের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। যেখানটায় খড়ের মাচা, নদী ভাঙতে ভাঙতে প্রায় সেখানটায় চলে এসেছে। যে কোনোদিন স্রোতের টানে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। খড়ের গাদা নদীর মধ্যে ডুবে গেলে তাদের বাড়িঘর ভেঙে তলিয়ে যেতে আর কতক্ষণ?
ভাবতে ভাবতে দুজনে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে সালেহা দেখতে পায়, একটা কেঁচো এসে তার গলাটাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরেছে যে, তা থেকে সে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। একটা গরগর আওয়াজ গলার কাছে এসে বারবার আটকে যাচ্ছে। সে তীব্র আর্তনাদ করে বিছানায় উঠে বসে। সালেহার আর্তনাদে ধড়মড় করে উঠে বসে রহমতও। সে সালেহার পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কী হয়েছে রে বউ, কী হয়েছে?’
সালেহা খুব ক্ষীণকণ্ঠে দুটি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করে, ‘কিছু না।’
তখন তার গা বেয়ে দরদর করে কেবলি ঘাম ঝরতে থাকে।
‘নানি।’
নাতির ডাকে সংবিৎ ফিরে আসে সালেহার। সে নির্বাক চোখে নাতির দিকে তাকায়।
‘সন্ধ্যা হইছে, চলো নানি ঘরে যাই।’
সালেহাও কোনো কথা না বলে নাতির হাত ধরে ঘরের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে বিশাল একটা মাটির চাক ঝপ করে ভেঙে পড়ে মুহূর্তেই নদীগর্ভে তলিয়ে যায়। সেইসঙ্গে তার চোখের সামনে স্রোতে ডুবে যেতে থাকে আপাদমস্তক অ-ভঙ্গুর একটি কঙ্কালের সম্পূর্ণ অবয়ব।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.