কালো যুবতী কালী গোসল করছিল। সকালবেলায় পাড়ায় খদ্দের আসে না। এ-সময়টা রাতের পাপ ধুয়েমুছে ফেলার সময়। তারপর ঘরসংসার ঝগড়াঝাটি আছে। সুখদুঃখের কথা আছে। রান্নাবান্না আছে। রান্না করতে ইচ্ছে না করলে মোড়ের হোটেল থেকে খাবার কিনে আনা যায়। অনেক সময় রান্না করতে ইচ্ছে করে। সংসার সংসার খেলার স্বপ্ন জাগে। কিশোরীবেলার প্রিয় খাবারের কথা মনে পড়ে।

কালীর মনে হয় আজ সংসার সংসার খেলার রোগে ধরেছে। পাড়ার মেয়েদের বেলা করে ঘুম ভাঙে। সারারাত শরীরের ওপর যে নারকীয় তাণ্ডব চলে, বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। গতকাল কালীর ওপর ঈশ^রের আশীর্বাদ ছিল। শরীরের ওপর কোনো অত্যাচার হয়নি। বেশ্যার জীবনে যা স্বপ্নের মতো। কখনো কখনো তা সত্য হয় এক রজনীর সংসারের মতো। গত রাতে  কালীর শরীরে আদর পড়েছে। বিয়ে করা বউয়ের মতো গতরাতে যা সত্য হয়েছিল। তাই কালীর মন আনন্দে ফুরফুরে, সকাল সকাল বেলা ১০টায় দরজা খুলেছে। দু-একটা চায়ের দোকান খোলা ছাড়া সারাপাড়া তখন ঘুমে আচ্ছন্ন।

     দরজা খুলে আয়েশ করে সবে আড়মোড়া ভেঙেছে, কালীর মেজাজ তখনই খিঁচড়ে গেল। ওর ঘরের বারান্দায় কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে ফালু শুয়ে আছে। ওর পাশে সত্যি সত্যি একটি কুকুরও শুয়ে আছে। এর আগেও ফালু অনেকবার ওর বারান্দায় শুয়ে থেকেছে। খদ্দের থাকলে ঘরের দরজা বন্ধ থাকে। কিংবা কালী ঘুমিয়ে পড়লে ডাকলে ওর ঘুম নষ্ট হবে, কষ্ট হবে ভেবে আর ডাকেনি। আবার ভয়ও আছে। যেটুকু সুবিধা পাচ্ছে তা থেকে যদি বঞ্চিত হতে হয়। কালীকে ডেকে তোলার কোনো অধিকার ফালুর নেই। সেই সত্য ফালু খুব ভালো করে জানে। তাই রাগ নয়, অভিমান নয়, এটুকু আশ্রয় আর একটু খাবার পেলেই ফালু ধন্য হয়ে যায়।

কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে কালী আজ ভয়ানক ক্ষেপে গেল। এ কেমন পুরুষ মানুষ, মাইয়া মাইনসের অধম?  জোর করতে শিখে নাই, কেড়ে নিতে জানে না। আজ কুত্তার সঙ্গে শুয়ে আছে। ও তো কুত্তারও অধম!  কুত্তা কেড়ে খেতে জানে, ও তো তাও পারে না।

কালীর মেজাজ এত খারাপ হলো যে সজোরে ফালুর পাছায় লাথি মেরে চেঁচিয়ে উঠল, এই কুত্তার বাচ্চা, তুই কি মাইনসের জাত, না কুত্তার জাত?  আমার বাড়ি থেইকা বাহির হ।

ফালু ঘুম থেকে হকচকিয়ে উঠে বসল। কালীর এ-অভ্যর্থনার সঙ্গে সে পূর্বপরিচিত। কিছুক্ষণ বকাঝকা করবে। দু-চার ঘা চড়-থাপড়ও দিয়ে বসতে পারে; কিন্তু যেই শুনবে সারাদিন না খেয়ে আছে, অমনি কালী কাঁদতে বসবে। কাঁদতে কাঁদতে বকতে বকতে ফালুকে বাসি ভাত-তরকারি যা কিছু ঘরে আছে সব প্লেটে সাজিয়ে খেতে দেবে। সামনে বসে খুব যত্ন করে খাওয়াবে।

সেই তো খাওন দিলি, খামোকা বকাঝকা করলি।

 খামোকা? কালী ফালুর গালে চড় বসিয়ে দিলো।

 ফালু প্রথমত অপ্রস্তুত হলো। পরে কৃতার্থে হেসে ফেলল। চোখের সামনে যখন প্লেটভর্তি ভাত থাকে ফালুকে তখন চড়-থাপ্পড় কাবু করতে পারে না। ক্ষুধার আগুনে সামনে প্লেটভর্তি ভাত পেলে পৃথিবী তখন কাব্যময় হয়ে ওঠে।  বড় এক লোকমা ভাত মুখে পুরে গালটা কালীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ফালু বলল, তোর থাপ্পড়ে টেস্ট আছে। কাঁচামরিচের মতো। আরেকটা থাপ্পড় দে।

কালী মৃদু হেসে বাড়িয়ে দেওয়া গালে থাপ্পড়ের পরিবর্তে চুমু দিয়ে ফালুকে হতভম্ব করে দিলো।

আজকের দিনটি অন্যান্য দিনের মতো হলো না। কালীর চিল্লাচিল্লি থামল না। উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। হাতের চেলা কাঠের ভয়ে ফালু ও কুত্তা দুজনে পালিয়ে গেল।

মনে হয় এইখানে আইজ খাওন নাই। ফালুর সঙ্গে সঙ্গে কুত্তারও তাই মনে হয়েছে। সেও ফালুর দিকে মুখ তুলে করুণ স্বরে ডাকল। দুজনে তাই মোড়ের হোটেলটায় গিয়ে কিছু দূরে নিরাপত্তা বজায় রেখে দাঁড়াল। দাবড়ানি দিলে সহজে যেন পালাতে পারে।

রাগে কালী সর্বশক্তি দিয়ে হাতের চেলা কাঠ ছুড়ে মারল। কাকে মারল, কেন মারল এ-বোঝা মুশকিল। যুদ্ধের মাঠ তখন শত্রুশূন্য। যুদ্ধের দামামা থেমে গেছে। মনে হয় যুদ্ধটা আসলে কালীর বিরুদ্ধে কালীর ।

একটা ছেলে যাচ্ছিল, ওকে ডেকে বলল, হোটেলে গিয়ে দেখতো ওইখানে ফালু মিয়া আছে কি না। থাকলে কইবি আমি ডাকছি।

ফালু ঘরের দরজায় এসে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। সে দ্বিধায় আছে – ঢুকবে কি ঢুকবে না।

কালী ঝাঁঝাল স্বরে ব্যঙ্গ করে বলল, তোরে কি ফুলের মালা দিয়া বরণ করতে হইবে?

ফালু খুশিমনে ঘরে ঢুকে পড়ল। আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে পরিবেশনায় পরিপাটি লক্ষ করল। মেঝেতে একটা মাদুর বিছিয়েছে। প্লেট-গ্লাস-বাটি-চামচ, রীতিমতো ভদ্রলোক বাড়ির জামাই আদরের মতো পরিবেশনা। খাবারের মান ভালো। গরম করা হয়েছে। ফালু বিস্মিত ও শঙ্কিত। কালীর ঘরের বাসি খাবার কোনোকালে গরম করে খেতে দিয়েছে কি না ফালু মনে করতে পারে না।

আজকের দিনটি স্পেশাল। বিড়ি খেতে ইচ্ছে করে না। ইস্পিশাল খেতে ইচ্ছে করে। পকেট থেকে বিড়ি বের করতে গিয়ে রেখে দিলো। কালীর দিকে তাকিয়ে মৃদু মধুর হেসে বলল, তোর কাছে অনেক বড়লোক বাবু আসে। বেনসন ৫৫৫ দু-একটা নাই? দে না একটা খাই।

কালীর মন আজ দিলদরিয়া। বেনসনের প্যাকেট ছুড়ে দিলো। জলজ্যান্ত দুটো আস্ত সিগারেট বেনসন প্যাকেটে পাওয়া গেল। কালী ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, আমার হাতে মেলা কাজ। তোর লগে গপ্ করার সময় নাই। এইবার ভাগ।

বেনসনে সবে সুখের দুই টান দিয়েছে। ফালুর ইচ্ছে করছে না কোথাও যেতে। পেট ভরেছে মন ভরেছে,  এখন একটা সুখনিদ্রা হলে আজকের দিনের রাজা সে। সবকিছু নির্ভর করছে কালীর মন-মেজাজের ওপর। কালীর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলল, রাইতে ঘুম হয় নাই। কুত্তার লগে ঘুম হয় তুই ক? খেদাই, লাথি মারি আবার আমার লগে আইসা শোয়। একটু ঘুম দিতে পারলে শরীরের জুত হইতো।

কুত্তার স্বভাব তোর মতোন। তোরে এত যে লাঠিঝাঁটা করি, ভাবলাম আপদ দূর হইল। দুইদিন যাইতে না যাইতে আবার তুই ফিরা আসছ।

ফালু কালীর মুখে ধোঁয়া ছেড়ে মৃদু হেসে বলল, কই যামু? তুই ছাড়া দুনিয়াতে আমার কে আছে?

কালী ক্ষেপে গেল, খবরদার, বাবুগো মতো মিছা কথা কইবি না। ঘরে দুই-তিনটা বউ, বেশ্যা মাগিরে জড়াইয়া কয় তুই ছাড়া আমার কেউ নাই।

ফালু বিষণ্ন গলায় বলল, তুই তো আমার সব জানস। জন্মের ঠিক নাই। বউ-বালবাচ্চা কেউ নাই। তুই ক, আমার কে আছে?

কালী বলল, ঘুমাবি?

তোর অসুবিধা হইলে থাকুক। আমি অন্য জায়গা দেখি। তুই কাম কর।

কালী কঠিন স্বরে বলল, ফকিন্নির মতো বেশ্যা মাগির দুয়ারে দুয়ারে ঘুরবি। জায়গা না পাইলে কুত্তার লগে ঘুমাবি।

রাইতে কোন ফাঁকে কুত্তা আমার লগে ঘুমাইছে টের পাই নাই।

কালী হুকুমের ভঙ্গিতে বলল, ঘরে গিয়া শুইয়া থাক। কথা কইবি না। আমার কামের দিগদারি করলে বাইর কইরা দিমু। মনে থাকে যেন।

আজ সকাল থেকে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। কালী তার বিছানায় শুতে দিয়েছে। ফালু বেনসন খাচ্ছে। পেট ভরে ভাত পেয়েছে। সে যা চাচ্ছে তাই পেয়ে যাচ্ছে। ফালু বড় কিছু চাইবে নাকি?  আল্লাহ মেহেরবান। পাইলেও পাইতে পারি। তার টাকা নেই যে কালীর শরীর নিয়ে ইচ্ছেমতো নাড়াচাড়া করবে। এ ব্যাপারে ফালুকে কখনো দয়া দেখায় নাই। রাস্তার কুত্তা-বিড়ালরে অনেক মানুষই দয়া দেখায়। কালীও ফালুরে সেই রকম দয়া দেখায়। তবে কালী একবার ফালুরে দিয়েছিল। টাকা দিতে পারে নাই। একটা কাজের বিনিময়ে ফালুকে দিয়েছিল সত্যি, কিন্তু ইচ্ছেমতো নাড়াচাড়া করতে দেয়নি। আজ চাইবে নাকি? আল্লাহ যদি পূরণ করে!

পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। ফালু ঘরের বাইরে এলো। কালী গোসল করছে। কালীর শাড়ি এলোমেলো। পানিতে ভিজে তাঁর যৌবন আরো প্রস্ফুটিত। ফালু সভয়ে ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, কালী রঙ্গ করে বলল, আহারে আমার লাজুক ভাশুর! মোড়া টাইনা বস। তোর লগে গপ্ করি।

শরীরে সাবান ঘষতে ঘষতে কালী জিজ্ঞেস করল,  আমি এত কালা কেন রে?

ফালু বলল, তুই কালা কিন্তু সোন্দর। তোর মতো সোন্দর মাইয়া মানুষ আমি জীবনে দেখি নাই।

কালী শব্দ করে হেসে উঠল, তুই কুত্তার লগে থাকস আর ছাগলের লগে থাকস, আসলে তুই পুরুষ মানুষ। সব পুরুষের এক ডাক। কালা যদি সোন্দর হইবে তয় আমার বিয়া হইল না ক্যান?

ফালু অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে চুপ করে রইল। কালীর মতিগতি বোঝা ভার। কী বলতে কী বলবে, আজকের সুখটুকু না আবার ভেস্তে যায়। নিশ্চুপ থাকাই নিরাপদ।

শোন, চোদ্দো বছর বয়সে আমার বিয়া হইছিল। পোলা আমারে দেইখা নিজে পছন্দ করল। পোলা আমার কালা যৌবন দেইখা কইল,

কালা গাইয়ের বড় মাই

এর চেয়ে সুখ জীবনে নাই।

তুমি হইছো আমার কালা গাই।

শ^শুর-শাশুড়ি বলল, এইটা তুই কই থেইক্কা ধইরা আনছোস? কী কালারে কালা!  মানুষ, না ভূত?  এই বউ আমি ঘরে তুলুম না। ঝাড়ু দিয়া ভূত তাড়ামু।

বাবা-মায়ের কাছে ফিরা আসলাম। মেম্বার বাড়ি দুধ দিতে গেছি। মেম্বারের বউ গেছে বাপের বাড়ি। মেম্বার চাচা বলল, কালো গাভীর দুধ ভালো। তোগো গাই কি কালা?  আমি বললাম, না চাচা, আমাগো গাই ধলা।

মেম্বার চাচা কামুক কণ্ঠে আমার মাই দেখিয়ে বলল, কালো গাই আমার সামনে দাঁড়াইয়া আছে। ভারি ভারি ওলান। না জানি কত মধু, আহারে …

এক গায়েন কালা চিকনা, গলাখানি কী মধুর! আমাগো হাটে একতারা বাজাইয়া গান গায় :

নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ

জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত

গায়েনরে একদিন আমাগো বাড়ি দেখলাম। এই গাঁয়ে রোজগার ভালো। থাকার জায়গা চায়। গোয়ালঘরে গাই গরুর সঙ্গে থাকার জায়গা হইল। এও শুনলাম, গায়েন আমারে বিয়া করতে চায়। দুই কালাতে রঙে রঙে সমস্যা নাই। গায়েনের গান আর আমার কালা যৌবনের রূপ দুইজনরে টানলো। গায়েনরে দেখলাম ধলা গাইয়ের চেয়ে কালা গাইয়ে ঝোঁক বেশি। এক সকালে দেখা গেল সাদা গাই গরু ও গায়েন উধাও। আমি মাথায় হাত দিয়ে বইসা পড়ি। আমার কী সর্বনাশ হয়েছে সে তো আমি জানি।

বাবা সংসার বাঁচাতে সকলের সম্মান বাঁচাতে আমারে শহরে নিয়ে এলো। আমারে বেইচা দুইটা গাই গরু কিনলো। একটা মাইয়া মাইনসের দাম দুইটা গাই গরুর সমান। কিছু বুঝলা ফালু মিয়া?

কালী কখনো ফালু মিয়ার সঙ্গে একদিনে এত কথা বলেনি। এত দরদ দিয়েও কথা বলেনি। কালীর গোসল দেখতে দেখতে ফালুর ঘোর লাগে। স্বপ্ন জেগে ওঠে। যা আগে হয়নি, আজ তা হতে পারে। কালীর মনটা আজ বড়ই উড়ু উড়ু, নরম।

দীর্ঘশ^াস ছেড়ে কালী বলল, আইজ মনে অনেক দুঃখ, আবার খুশিও। কত বছর পর কত কথা মনে পড়ল। কত কথা কইলাম। বাজারে যা। আইজ ঘরে রান্না করি। তোর সঙ্গে ভালোমন্দ কিছু খাই।

ফালু মিয়া আনন্দে লাফিয়ে উঠল, কালী, তুই তো ফিলিমের ডায়লগ দিতাছস! তুই আমার ব্ল্যাক কুইন। দিলকা রানি। দে, টেকা দে।

কালী মৃদু হেসে বলল, তোর জন্য এক প্যাকেট ৫৫৫ কিনবি। আইজকার দিনে চুরি করবি না। মনে থাকবে?

ফালু জিহ্বা কেটে কান ধরে বিমর্ষ গলায় বলল, এইটা তুই কী কইলি আমার ব্ল্যাক কুইন। চুরি হইল আমার পেশা। আর তুই হলি আমার মোহাব্বত। আইজকার দিনে তোর জন্য আমি জান দিতে পারি। আমি যে চোর, ব্যর্থ চোর, এই কথাটা মনে করাইয়া কষ্ট দিলি।

মেঝেতে মাদুর বিছিয়েছে। চার পদের রান্না হয়েছে। ফালু মিয়া কতকাল পর গোসল করে খেতে বসেছে তা সে বলতে পারবে না। অকারণে কালীর দু-চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসছে। আজকের দিনটি অন্যরকম। কিশোরী থেকে এমন জীবনের স্বপ্ন দেখে আসছে কালী। কত যে শিবপূজা করেছে। শিবের মতো স্বামী পাবে। স্বামীর সেবায় জীবন ধন্য হবে।

ফালু খেতে খেতে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করল, কী রে, কী হইছে? খাস না ক্যান?  ফালু এক লোকমা ভাত জোর করে কালীর মুখে তুলে দিলো।

কালীর অন্তরে খুশির ছোঁয়া লাগে। সে খুশি লুকাতে ফালুকে বকা দিলো, ওই ডাকাইতের বাচ্চা, তোরে জোর করতে কইছে কে? আমার হাত নাই? খাইতে পারি না? সোহাগ দেখাইতে হইবে না।

ফালু লাজুক চোখে কালীকে এক পলক দেখে নিয়ে আদুরে গলায় বলল, বড় শখ আছিল কোনোদিন যদি সুযোগ পাই তোরে নিজ হাতে খাওয়াইতাম। গরিবের শখ পূরণ হয় না।

কালীর মন দুলে উঠল। পশুর মতো জীবন তাদের। দিনরাত এক চিন্তা – বেঁচে থাকা। খাওয়া-পরা। শখ-আবদার নাই, কোনো স্বপ্ন নাই। কালীর বুক চিরে বেদনার গভীর দীর্ঘশ^াস বেরিয়ে আসে। আড়চোখে ফালুর দিকে তাকায়। একটু না হয় সোহাগ নিল। বেচারার শখ পূরণ হলো।

ফালুর কাছ ঘেঁষে বসল কালী। মুখটা ফালুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সোহাগী গলায়  বলল, দে, আমারে খাওয়াইয়া দে। আমি তোরে খাওয়াইয়া দেই।

ফালুর মনে হলো, সে স্বপ্ন দেখছে না তো!

কালী মৃদু হেসে বলল, আমাগো একদিনের সংসার। ছোটবেলায় পুতুল খেলতাম। বউ-জামাই খেলতাম। আইজ আমরা সংসার সংসার খেলতাছি।

ফালু কালীর বিছানায় শুয়ে রাজার গৌরবে সিগারেট টানছে। আজ ফালুর মনে কোনো ভয়-দ্বিধা নেই। একদিনের সংসারে সে স্বামী। সে প্রভু। প্রভুর তর সইছে না। কখন বউ-জামাই খেলা শুরু হবে?

কালী দরজা বন্ধ করে বিছানায় ফালুর খোলা বুকে মাথা গুঁজে দিলো। বুকে নাক ঘষতে ঘষতে বলল, তুই আমার জামাই, একদিনের জামাই। আমি তোর বউ, একদিনের বউ।

ফালু তখন কালীর জামা খুলতে ব্যস্ত।

কালী বলল, ছোটবেলায় বউ-জামাই খেলায় কোনো বাচ্চা হয় না। বড়বেলার বউ-জামাই খেলায় বাচ্চা হইলে কী করবি?

ফালু আবেগে কালীকে বুকে টেনে বলল, বউ-বাচ্চা নিয়া অন্য জায়গায় চইলা যামু। তোরে নিয়া সংসার করুম।

আনন্দে কালীর চোখ ভিজে ওঠে। ফালুকে আজ সে কোনো বাধা দেয় না। স্বামীর অধিকারে সর্বত্র ফালু বিচরণ করতে পারে। দুজনে পরম  তৃপ্তির আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে স্বামী-স্ত্রীর মতো ঘুমিয়ে পড়ে।

সন্ধ্যা হয় হয় কালীর ঘুম ভাঙে। পাড়ার সময় শুরু হয়ে গেছে। মেয়েদের সাজগোজ শেষ। খদ্দের আসা শুরু হয়েছে। কিছু মেয়ে কালীর ঘরে উঁকিঝুঁঁকি দিচ্ছে। কালী বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আমার কী হইছে?  এই সাজবেলা পর্যন্ত ঘুম দিলাম! তোরা ডাকবি না।

দিদি, তুমি মরণ ঘুম দিছো। কত ডাকাডাকি করলাম। তোমার ঘুম ভাঙে না। তোমার ঘরের দরজা খোলা। আলমারি খোলা। 

কালীর নেশা ছুটে গেল। ফালুর কথা এতক্ষণ মনে হয়নি। ফালু কই? সে ছুটে গেল আলমারিতে। তার সারাজীবনের সঞ্চয় ফালু নিয়ে গেছে।