আড়ালে লুকানো মুখ

ঘোর মাঘে প্রতিপদ থেকে পূর্ণিমা পর্যন্ত বাতাসে ছিল অবাক করা আরামের পরশ। দ্যাখো কাণ্ড, মাঘের নির্দয় শীত এলো কি না এবার ফাল্গুনে এসে। এমন উল্টাপাল্টা আবহাওয়ায় কিরণ বসুর অপারেশনে কাটাকুটি ও সেলাই দাগে ভর্তি বয়সী শরীর এই ভালো তো এই মন্দ। সর্বক্ষণ সমঝে চলা মুশকিল জেনেও নিজেকে নিজের মতো করে ধরে রাখতে তিনি হুঁশিয়ার। বয়সের আড়াইকাল পার, এ বয়সেরই সুড়ঙ্গ ধরে উঠে আসা আবছা আলো-আঁধারির সঙ্গে জীবন যেন জোড়া লেগেছে। তাঁর অশক্ত কাঠামোয় যখন-তখন ঝিমুনি ধরে। তিনতলার তিন রুমের ভাড়া বাসার আটপৌরে ঘরোয়া গণ্ডিতে শুয়ে-বসে কাগজ, ভ্রমণের বই পড়ে, টিভি দেখে তাঁর দিনক্ষয়। দুই ছেলে যে যার কাজে সকাল সকাল বেরিয়ে যায়। বাসায় তখন স্বামী-স্ত্রী দুজন। দুপুর থেকে রাত, অফুরন্ত একঘেয়ে সময় – কেমনে যে কাটে। শরীরের জোড়ে জোড়ে ব্যথা নিয়ে স্ত্রী মনোরমা বেডরুমের ছোট টিভিতে বাংলা সিরিয়ালে চোখ ধরে রাখেন। কখনো মোটা পাওয়ারের চশমার মধ্য দিয়ে কাঁথায় রঙিন সুতোর ফোঁড় দিতে তিনি তৎপর হন। খানিকক্ষণ পর সেলাইকর্ম ফেল – তাঁর হাত থেমে যায়। হঠাৎ মনোরমার হা-হুতাশ বুকের খাঁচা থেকে দীর্ঘশ^াস হয়ে উঠে এলে করুণ কণ্ঠের চিকন আওয়াজে পুরো রুমই ব্যথিত হয়ে ওঠে। যোগ্যবয়সী বড় ছেলে এখনো বিয়ে করছে না।

মা-বাবা উভয়েই পুতের বউয়ের মুখ দেখতে ব্যাকুল, অথচ কোন অজানা কারণে ছেলে যে বিয়ে এড়িয়ে যাচ্ছে, তা ধরাই কঠিন।

কিরণ বসুর স্মৃতি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে এলেও স্মরণশক্তি এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এ তো ভুলে যাওয়ার নয়, পরমায়ু নিংড়ে বেড়ে ওঠা, মানে পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মতো জমিন আর শক্তি না-পাওয়া অবধি কষ্টের করাতে তিনি নিশিদিন চেরাই হয়েছেন – সে কী দুঃসহ অবস্থা। শৈশবে মা-বাবাহারা এই অনাথকে লালন-পালনে নিকটাত্মীয়রা ছিল অনিচ্ছুক। হিতকামী কজন মানুষের সহায়, সুনজরে স্কুল-কলেজের দরজা তিনি পার হতে পেরেছেন। অবহেলা ও দৈন্যদশার অসহ্য ঠোকর খেয়ে ধীরে ধীরে বুঝপড়া হওয়ার পর মনের ভেতরের মন, নয়নগোচরের অতল নিমেষ আর প্রখরবোধ তিনি অর্জন করেন। চটজলদি তিনি ধরতে পারেন অন্যজনের আচারের আড়ালের গুপ্ত মানে। ভিন্ন মন পড়তে-বুঝতে তিনি কুশলী হয়ে ওঠেন। সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে কিরণ বসুর ধারণা – মানুষের জন্য এখন মানুষই সমস্যা। তাই মেপে কথাবার্তা বলতে সজাগ তিনি। বলা যায়, নিরেট সহ্য ক্ষমতার ওপর ভালোই দখল তাঁর। সচ্ছল অভাবশূন্য জীবনভোগ কপালে না থাকলেও আফসোস নেই, গড়পড়তা ইচ্ছাপূরণ নিয়েই তিনি সন্তুষ্ট।

প্রাত্যহিক মর্নিং ওয়াক করে বাসায় ফিরে আরেক দফা হাত-মুখ ধুয়ে কিরণ বসু ফ্রেশ হন। আগের রাতে ভিজিয়ে রাখা একমুঠ কাঁচা বাদামের সঙ্গে কালোজিরা পেঁয়াজ রসুনের কুচি, লেবুর রস আর বিট লবণ মিশিয়ে স্ত্রী খাওয়া তৈরি করে দিলে তা ধীরেসুস্থে তিনি মুখে দেন। টিভি অন করে দিনের প্রথম খবরটা দেখেন। কে জানে আজ তাঁর সকালটা খারাপ হবে? দোতলার বেআক্কেল বাক্যবাজ পড়শী এমন ব্যস্ত হাজির যে, জমানো কথার চাপে তার পেট বুঝি ফুলে আছে। দোপেয়ে নির্বোধটা সিঁড়িতে পায়ের থপথপ আওয়াজ রেখে ভেতরে ঢুকেই সোফায় হেলান দেয়। ভাব এমন, এ-বাসার বাসিন্দাদের সঙ্গে তার এতোই মাখামাখি কিংবা নিশ্চিত দাবি আছে যে, শরীর এখানে এসে যখন-তখন সে ফেলতে পারে। গায়ের গেঞ্জি আর পরনের পাজামার দলামোচা পাট দেখে বোঝা যাচ্ছে সালাহউদ্দিন রাতের ঘুমানোর পোশাক এখনো পাল্টাননি। – ‘এলাম। জানালা দিয়ে দেখি আপনি হাঁটাহাঁটি সেরে ফিরছেন। ভাবলাম, যাই দু-চার লাইন গল্পগুজব করি।’ এটা কোনো গল্পগুজবের সময় হলো? হুট করে হাজির হওয়া যেন তার কাছে মহৎ কাজ – এমন সুখবোধে সালাহউদ্দিন বেশ গদগদ। এবার তার ঘরসন্ধানী নজর পড়ে কিরণ বসুর হাতে ধরা চামচে। কাঁচা বাদাম খেতে দেখে চোখেমুখে বিস্ময় ভাসিয়ে সে শঙ্কিত স্বর টেনে যায় – ‘এই বয়সে আপনি বাদাম খান! করছেন কী? ছেড়ে দেন। ফ্যাটফুড।’ নিষেধের অমন তাড়া দেওয়া বাক্যে কিরণ বসুর ভাবনায় প্যাঁচ এঁটে যায়। সালাহউদ্দিনের আশঙ্কা সত্য হলে এতদিনে কিরণ বসুর তো মোটা হয়ে যাওয়ার কথা। ঘটনা কী? ভাবনা কপালে ভাঁজ ফেললে মন তাঁর মচকে যাওয়ার উপক্রম হয়। তবে কি মাসের পর মাস তিনি ভুল করছেন? জেনে আসছেন, ব্যাড কোলেস্টেরল কমিয়ে আনার জন্য বাদাম বেশ উপকারী। বাদামের গুণাগুণ নিয়ে তিনি একাধিক লেখাও পড়েছেন। তাহলে? মাথার ঘোপের মধ্যে পাক শুরু হলে সকালে নিজের বাদাম খাওয়ার অভ্যাসের হিতাহিত নিয়ে কিরণ বসু বিভ্রান্ত হন। অনেক দিনের লালিত ধারণা তাঁর টোল খেয়ে যায়।

এই বিল্ডিংয়ের ওপর-নিচ বাকপটু প্রতিবেশীরা কখনো একসঙ্গে যে যার মুখের তোড় নিয়ে এ-বাসায় আসে না। প্রায়শই এদের ঝুটা-নকল-ভেজাল দুর্ব্যাখ্যায় কিরণ বসুর নিজের কান নিজেরই চড়াতে ইচ্ছে হয়। তাঁর সন্দেহ, নামের শেষে সেট করা ‘উদ্দিন’রা যোগসাজশে তাঁকে মানসিক শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাগবিস্তারের জন্য এখানে আসে কি না। ঠোঁটে-মুখে এত খই রাশপাতলা এত রসদ এরা কোথায় পায়! একজন যায় তো আরেকজনের আকস্মিক উদয় – যাতায়াতের এমন সঠিক আন্দাজ এরা কেমনে করে? এরা সিঁড়িতে ওঠানামার পায়ের আওয়াজ ধরেই কে কোন তলার উদ্দিন নির্ভুল চিহ্নিত করে কেমনে? যাই সুকৌশলে এ-বাড়ির বাবু ভাড়াটে থেকে শুনে আসি – ওই উদ্দিন কী বলে গেল? তাহলে এরা কি সর্বক্ষণ যে যার বাসাতেই থাকে? কিন্তু পারলে গর্জন করে এরা যে জানাতে চায়, তাদের বড় চালু ব্যবসা দেখভাল, হিসাবনিকাশ থেকে একগাদা কর্মচারী চরাতে চরাতে মাথা ধরে যায়, ক্লান্ত তারা। এক উদ্দিন যাচ্ছে, আরেক উদ্দিন আসছে, কী অদ্ভুত ছকবাঁধা চলাচল। কিরণ বসু তেতো বিরক্তিতে মাখামাখি হতে হতে বিস্তৃত বোঝেন – এদের কথাবার্তার মধ্যে আগড়ম-বাগড়ম ভর্তি। অথচ দেখা যায়, বাসার সানসেটের নিচে, প্রবেশ পথে, বাঁয়ে মোচড় নেওয়া রাস্তায় কিংবা ডানে ঘুরে ফুটপাতের চায়ের ছাপরায় এদের পরস্পরের দেখা হলে কী খাস অন্তরঙ্গতা, রসালাপ; তখন একে অন্যের পিঠ চাপড়ানিও বুঝি মিঠাই স্বাদের। কে বলবে, এরা কেউ কাউকে ভেতরে ভেতরে আদৌ পছন্দ করে না। একজনের আরেকজনকে নিয়ে নাক সিঁটকানো লেগেই আছে।

এক সিঁড়ি ওপরে থাকে শরফুদ্দিন। তার নাদাপেট দিন দিন বাড়ছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে লম্বা ফর্সা মানুষটার গালের ওপর যেন গাল উঠছে। তার চেহারায় ভেসে উঠেছে কেমন ষন্ডাছাপ। শোনা কথা, মানুষটা খানিক বেয়াড়া কিসিমের, টুকটাক কেনাকাটা নিয়ে ঋণ আছে, হাওলাতের টাকা শোধেও আঙুলের ফাঁক নাকি গলে না। শরফুদ্দিনের চেয়ে কিরণ বসু বয়সে বড়, মাথার চুল সব সাদা হওয়ায় ছদ্মস্বভাবের বা লোক দেখানোর নামে হোক কদর-ভক্তি সে দারুণ করে। তবে শরফুদ্দিনের গালগল্পে খাওয়ার বিষয় থাকে বেশি। গরুর ভুনা গোশত, কাবাব, পুরান ঢাকার অমুক-তমুক রেস্টুরেন্টের বিরিয়ানি দেখলেই তার সারামুখ নাকি পানিতে ভরে যায়। না-খাওয়া অবধি নিজেকে ধরে রাখা তার জন্য কঠিন। শরফুদ্দিন লোকমুখে শুনলেন যে, মোহাম্মদপুরের ওদিকে অবাঙালিদের মার্কেটে প্রতি জুমাবার ভালো তাজা গরু জবাই হয়। ব্যস, ওই গোশতের জন্য হোক চরম গরম, কী রাস্তা ডুবানো বৃষ্টি, কী দুঃসহ যানজট, কেউ তাকে বেঁধে রাখতে পারবে না – গাড়ি ভাড়া করে সে ছুটবেই। চাউর হওয়া তার পেটুক স্বভাবের এমনসব ঘটনা হাসতে হাসতে শরফুদ্দিনও স্বীকার করে। মনে হয়, তার গলার খোড়ল তখন অতিশয় স্বাদে ভেজা। এমন ভোগাসক্তির মানুষটার ইচ্ছা শিগগির সেও মর্নিংওয়াক শুরু করবে। কিন্তু বডি ফিট রাখা নিয়ে মুখর হয়েও শরফুদ্দিন আজো হাঁটাহাঁটি, কি ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম কিছুই শুরু করতে পারেনি। অথচ কারো সুস্থ থাকার জ্ঞান বিতরণে সে ওস্তাদ। শরীর বিষয়ে আলাপ-সালাপ একবার উঠলে ভেতরের অসুখ-বিসুখ কলকব্জা বিষয়ে অনর্গল বক্তৃতা তার কিছুতেই থামে না।

শরফুদ্দিন ঘাগু লোক, নজরও তার পাকা। কিরণ বসুকে বিমর্ষ মনমরা দেখে শুরু হয় তার মনজোগানো কোশেশ। বুঝি তার জিদ চেপে গেছে, যে করেই হোক, দাদাকে চাঙা রাখা চাই। তন্নতন্ন চাহনি ধরে রেখে সরাসরি এবার সে জানতে চায় – ‘বলেন তো ঘটনা কী! আপনাকে ক্যামন ক্যামন লাগছে। কোনো সমস্যা?’ তার আগ্রহের মধ্যে এমন সিদ্ধান্ত উপস্থিত যে, বাবু মানুষটার মুশকিল আসান করা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। কিরণ বসু মাথা নেড়ে বোঝাতে চান, বর্তমানে তাঁর কোনো ঝক্কি-ঝামেলা নেই। কেবল একবাক্যে সকালের ওই মন খচখচি তিনি পেশ করেন। বাদামে ফ্যাট, তাও সালাহউদ্দিন বলেছে শুনে আশঙ্কা ফুঁৎকারে উড়িয়ে দেয় শরফুদ্দিন – ‘ধুর, ও ব্যাটা হচ্ছে আস্ত গবেট। মাথায় ঘিলু বলে কিছু নেই, ও জানে কী? ও তো একটা ফালতু। ওর ধারণা পাত্তা দেবেন না তো।’ আস্ত মানুষটাকে নস্যাৎ করে দেওয়ার বিজয়ভাবে শরফুদ্দিন সোফায় হেলান রেখে দু-পা ছড়িয়ে দেয়। তার ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি দেখে মনে হয়, এই বেলা খাওয়া-দাওয়া না সেরে সে উঠছে না। এ-সময় মনোরমা মন্থর পায়ে কোনো কাজে বা আলাপের জন্য রুমে ঢুকেই ফের আড়ালে চলে যান। স্বামীর বন্ধু বা এক ছাদের তলে বাসিন্দা খোশগল্পে আসছে। আসুক, কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা সস্তা প্যাঁচাল পেড়ে এত সময় নষ্ট তাঁর অপছন্দের। শরফুদ্দিনের কৌতূহলের যেন কমতি নেই – ‘আচ্ছা, ভাবির ইউরিক অ্যাসিড কি কন্ট্রোলে আছে? অবস্থা কী?’ কিরণ বসু মৌন থেকে কেবল কাঁধ নাচান। এর মানে হতে পারে, যা ছিল তাই আছে, কিংবা বর্তমানে নিয়ন্ত্রণে বা শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা কিছুদিন হলো মাপা হয়নি।

মুখ সচল রাখার জন্য শরফুদ্দিন প্রস্তুত, তার তৈরি করা বিবেচনা রুখবে কে! কী করণীয় সেই হেদায়েত যথারীতি সে চালু করে – ‘কখনো মসুরের ডাল চলবে না। পুঁই-পালংশাক, পিচ্ছিল সব তরকারি নো খাওয়া।’ খাদ্যের নিষিদ্ধ তালিকা কিরণ বসু জানেন। শরফুদ্দিন ভাবির ইউরিক অ্যাসিড নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ আগেও দিয়েছে। আবার সেই পুরনো বকবকানি। এখন এর হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উপায় কী? কারো মুখের ওপর সাফ জবাব, স্বর কর্কশ, কিংবা চেহারার আলো মøান করে দেওয়ার মতো উল্টো আচরণ কিরণ বসু পারেন না। তাহলে? ভাবাভাবির উঠতি চাপের কারণে সহসা তাঁর মাথায় সূক্ষ্ম উপায় ঝিলিক মেরে ওঠে। শরফুদ্দিনের চাপা রাখা তার মেয়ের বিয়ের প্রসঙ্গ জিজ্ঞেস করলে নিশ্চয়ই নাখোশ হয়ে উঠে যেতে পারে। কোনো অভিভাবকই তাঁর ছেলেমেয়ের গোপন বিয়ে নিয়ে সন্তুষ্ট নন। এই বিল্ডিংয়েরই

সালাউদ্দিন-ফরিদউদ্দিন দুই খলমানুষ পালিয়ে একটা মেয়ের বিয়ের বিষয় বেশ রসালো পুঁজি মনে করে আড়ালে পরিবেশন করে যাচ্ছে। ‘জানেন, শরফুদ্দিনের মেয়ে ফুট। ও ব্যাটার মেয়ে ভেগে যাওয়ার নেপথ্যের কাণ্ড আপনিই পারবেন বের করতে’, বলে, এরা কিরণ বসুর কোর্টে বল ঠেলে দেয়। এই মানুষ দুজন কেমন, নিজেরা ভালো সেজে বা নিজেদের

না-জানার ভান বজায় রেখে আরেকজনকে বাজে একটা কাজে উসকানি দিচ্ছে। ধুর, পরের মেয়ের প্রেম-বিয়ের মধ্যে তিনি কেন নাক গলাতে যাবেন! তাঁকে এত লঘু হওয়া কি মানায়? কাদায় নামতে যাবেন কেন তিনি? কিন্তু এই মুহূর্তে শরফুদ্দিনের বিরক্তিকর উপস্থিতি, তার বাচালতা থামাতে হলে হোক অপ্রিয়, মুখ তো সামান্য হলেও খুলতে হয়। – ‘আচ্ছা, আপনার মেয়ের বিয়ের কথা শুনলাম।’ বলতেই কিরণ বসুর ভেতরে মুহূর্তে টান পড়ে – এটা তো অনধিকার চর্চা। রীতিবিরুদ্ধ জানাজানির বাসনা নিমিষে মরে যায়।

শরফুদ্দিনের মুখে ক্ষোভ-আক্ষেপ কিছুই ক্রিয়া করে না। তার স্বরে বরং তুষ্টি – ‘হ্যাঁ, বাতুল জালোয়ার হঠাৎ আকদ হয়ে গেল। ছেলেপক্ষের থেকে তাড়া ছিল।’

কিরণ বসু তাজ্জব। ট্যাটন ওই দুই উদ্দিনের চেয়ে এই উদ্দিন সোজাসাপটা, ডোন্ট মাইন্ড গোছের মানুষ। কই, মেয়ের পালিয়ে বিয়ে নিয়ে সে তো বিব্রত নয়। মেয়ে চলে যাওয়ায় মন খাঁ-খাঁ করা সামান্য মাতমও তার গলায় নেই। কিন্তু বাতুল জালোয়া আবার কী? বোঝা গেল, শরফুদ্দিন কেমন বাহাদুর। লোক ঘাঁটাঘাঁটির পোক্ত লড়িয়ে। তার সামনের বাবুমানুষটির স্থির জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিব্যি সে ধরে ফেলে – ‘ও, বাতুল জালোয়া, আমার মেয়ে। সত্যি, আমারই ওর বিয়ের ব্যাপারটা আপনাকে বলা উচিত ছিল।’

উচিত-অনুচিত নিয়ে কিরণ বসুর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এ-বাসায় শরফুদ্দিনের প্রায়ই যাতায়াত, তাই বলে মেয়ের বিয়ে নিয়ে পূর্বাপর পরামর্শের কী আছে। সে কি তাঁর আত্মীয়-মুরুব্বি? এটা তার পরিবারের নিজস্ব বিষয়। কিন্তু বাতুল জালোয়া, এমন নাম তো আগে শোনেননি। নামেরও মানে থাকে, তা যে-ভাষা থেকে নেওয়া হোক। – ‘আপনার মেয়ের নামটা বেশ আনকমন। অর্থ কী?’ কিরণ বসু কিছুতেই জানার ইচ্ছা বশে রাখতে পারলেন না।

মেয়ের জন্মাবধি নিষ্কলুষ গুণপনা আর নামের মাহাত্ম্যে পারলে শরফুদ্দিন চৌকো এই রুমের মধ্যে এখুনি নৃত্য শুরু করে। তার কণ্ঠ আবেগে উচ্ছল – ‘এই নামটা রাখেন আমার স্ত্রীর নেকবখত এক পিরবাবা। নিশানদিহি যাচাই করার গায়েবি ক্ষমতা তাঁর আছে। উনি অটল ধ্যান করেন। ইনসানে কামিল উনার কথা, এমন নামের মেয়ে ভাগ্যবতী হয়। দ্যাখেন, পিরবাবার কথাই ঠিক হলো।’

মধুর এক সোয়াদ নিয়ে শরফুদ্দিন জিহ্বার মিষ্টতা বণ্টন করে যায় – ‘বরাত দেখেন জালোয়ার। ফতুল্লায় ওর শ^শুরের তিন বিঘার ওপর বাড়ি। বনেদি বংশের বাড়ি তো – বিরাট। গুলশানেরটাও বড়। গার্মেন্টস আছে তিন-চারটা, ঢাকার ম্যানপাওয়ার ব্যবসার চল্লিশ পার্সেন্ট এই ফ্যামিলির কন্ট্রোলে। ছেলে ছিল কানাডায় প্রায় বছর তিনেক। বর্তমানে দেশে। ফতুল্লার ওদিকে বড় একটা প্রোপার্টি এখন জালোয়ার শ^শুরের কব্জায়। ওখানে সে নাকি টেক্সটাইল দেবে।’

মেয়ের বিয়ে নিয়ে দিল আফরোজ এই মানুষটার হুঁশ-জ্ঞানে সম্ভবত ঘাটতি পড়েছে, নচেৎ এক সংখ্যালঘুর কাছে তারই স্বধর্মী তাড়িয়ে তাঁদের জায়গা-জমি অধিকারভুক্তর প্রসঙ্গ অসংকোচে কেমনে বলে। দ্যাখো, কী বিকট, শরফুদ্দিন তার লুকানো খাই খাই রাক্ষুসে স্বভাব প্রকাশ্যে এনে মহাআনন্দে এখন হেসে যাচ্ছে। তার মেয়ের শ^শুর যেন বীরত্বপূর্ণ কোনো কাজ করেছে; তার আত্মীয় হিসেবে ওই সাফল্যের সেও ভাগিদার। কিরণ বসুর মনে হচ্ছে, তাঁর রুমে শ^াস নেওয়ার মতো পরিষ্কার বাতাসের অভাব হয়েছে, নচেৎ দম নিতে কষ্ট হচ্ছে কেন!

ফরিদউদ্দিন এলো পড়ন্ত বিকেলে। তখন জানালা-কার্নিশ, বাইরের লাইটপোস্ট জালবদ্ধ বিভিন্ন তার থেকে শেষ ফ্যাকাসে আলো দ্রুত মুছে যাচ্ছে। মানুষটার শরিফ আদল দেখে পয়লা ধারণা হবে, সে সুবোধ-সোজা নিরীহ। দাঁতে সুতো কাটতেও বুঝি দ্বিধা আছে তার। কিন্তু এই বিল্ডিংয়ের নিবাসীদের কাছে এমন উল্টো ধারণা বদ্ধমূল যে, লোকটা যথেষ্ট চালবাজ, তার আমিরী ভঙ্গি পুরো ফাঁপা। হয়তো নিজেও ফরিদউদ্দিন তার সম্পর্কে রটা মন্দ কথা ওয়াকিবহাল। আদৌ সে এসব যে পাত্তা দেয় না বোঝা যায় চিরভ্যস্ত চালচলনে। তার শীর্ণ শরীর নিয়ে রুমে ঢুকেই চারপাশে এমনভাবে সে আতিপাতি নজর ঘোরাতে থাকে যে, দেয়াল ভেদ করে ওপাশেরও সবকিছুই দেখতে পারছে।

কিরণ বসু মনে মনে স্থির করেছিলেন বাইরে এক পাক ঘুরে ফেরার পথে বাজারে যাবেন। স্ত্রীর একমাত্র আসক্তি পান-সুপারি, সকালে নিজের খাওয়ার টকদই, লাল চিড়া, বিকেলে মুড়ির সঙ্গে খেতে এক কেজি শসা কিনবেন। আবহাওয়া বুঝে কোনো কোনোদিন সকাল-বিকাল দু-বেলা তিনি হাঁটেন। শেষ বেলার হাঁটাহাঁটির সুফল হচ্ছে : তাড়াতাড়ি ঘুম আসে, নিবিড় হয়, বেশ ভোরে তিনি উঠতে পারেন। কিন্তু ফরিদউদ্দিন এসে তার লম্বা চিকন শরীর ফেলে সব গুবলেট করে দিয়েছে। দ্যাখো, শুরুতেই তাঁর জন্য কিছু ফালতু প্রশ্ন – ‘বলেন, কী বের করতে পারলেন?’ কিরণ বসু বুঝেও অবুঝ নজর ধরে আছে দেখে ফরিদউদ্দিন এই বিল্ডিংয়ের সবচেয়ে বয়স্ক ভাড়াটের বুদ্ধি-কৌশল নিয়ে সন্দেহ করে – ‘আপনার মগজ মনে হয় শর্ট। কিছু হবে না আপনাকে দিয়ে। আপনার সাদা দিল এখন এ-জমানায় অচল। ব্যাটা শরফুদ্দিনকে তুড়ি বাজানোর ভঙ্গিতে আমি যেতে দেখেছি। ওর মেয়ের কেটে পড়া নিয়ে পেলেন কোনো ইনফরমেশন?’

কিরণ বসুর মেজাজ ভেতরে ভেতরে তেরিয়া হয়ে ওঠে। অনাত্মীয়, উপরন্তু ভিন্ন একটা পরিবারের দোষ-ফুটো-কেলেঙ্কারি খোঁজাখুঁজির মতো বিধিবিরুদ্ধ ও অনিষ্ট কর্মে তিনি কেন জড়াতে যাবেন? এসব ঠেটা নচ্ছার নীচ পরনিন্দুক দানবদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করা উচিত।

উচিত-অনুচিতের টানাটানির মধ্যে নিজের ওপর দখল পেয়ে গেলে কিরণ বসুর স্বর আর উত্তাপ ছড়াতে পারে না। নিস্তারের উদ্দেশে তিনি বরং জানতে চান – ‘শুনেছি আপনার ছেলেও নিজে কিছুদিন হলো বিয়ে করেছে। গোপন আপনিও রেখেছেন। ঘটনা কী?’ কিরণ বসু পাল্টা পাটকেল মারতে পারেন ফরিদউদ্দিন এতটা ভাবেনি।

বাব্বা, ব্যাটা কী ত্যাঁদড়! নিমিষে নিজেকে সামলে নিয়েছে দেখে কিরণ বসুর চোখ বিস্ময়ে জমে যায়। ফরিদউদ্দিন তার পরিবারে গুপ্ত অবস্থান্তর নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি বুঝি পরোয়া করে না। শক্ত চোয়াল বলে দিচ্ছে, কথার মারপ্যাঁচে কেউই তাকে টলাতে পারবে না। কাউকে নিয়ে ঠাট্টা টিটকারি মারতে তার মতো এই তল্লাটে আর কে আছে! এবার নিজের চরকা ফরিদউদ্দিন চালু করে – ‘আর বলবেন না। ছেলেমেয়ে
প্রেম-মহব্বত করলে পয়লা জানে দিল্লাগি মিতারা, পরে পাড়া-প্রতিবেশী, সব শেষে জানে বাপ-মায়।’

প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার ফন্দি করে মানুষটা আবোল-তাবোল বকছে বুঝে কিরণ বসুর কণ্ঠ থেকে এবার খানিক বিরক্তি উঠে আসে – ‘আপনার ছেলের শ^শুর কী করেন? বাড়ি কই?’

উষ্মা তৈরি হওয়ার আগেই শোনা গেল ফরিদউদ্দিনের সন্তুষ্টির শান্ত স্বর – ‘আর বলবেন না। খুব ধার্মিক ওরা – পরহেজগার। ছেলে মাসনাদ সানির শ^শুরবাড়ি যেবার আমি আর আমার স্ত্রী  প্রথম যাই, ওরা আমাদের কোরান শরিফ প্রেজেন্ট করেছে। মোনাফেকি নাফরমানি দুচক্ষে ওরা দেখতে পারে না। ষোলো আনা ঈমানদার।’ দ্যাখো, কী প্রশ্নের কী উত্তর। ছেলের শ^শুরবাড়ির এটা কোনো পরিচয় হলো? ধুর, এদের এখানে

আসা-যাওয়ার সুযোগ দেওয়া মনে আশকারা দেওয়া।

ছুটির দিন ছাড়া রোজ সকালে দুই ছেলে বেরিয়ে যাওয়ার পর কিরণ বসু ভেতরে ভেতরে উদ্বেগে ছটফট করেন। দিনকাল ভালো নয়, অহরহ রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনা, জীবন বড় তুচ্ছ এখন। দুপুর হেলে গেলে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। দুই ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলা চাই। ছেলেদের কণ্ঠ শোনার পর তাঁর উৎকণ্ঠা কেটে যায়। তাঁর এক কথা, সুখের চেয়ে শাস্তি ভালো। আজ সন্ধ্যা উতরে যাওয়ার পর কিরণ বসুর মনে হলো – দুপুরে দুই ছেলের খাওয়া-দাওয়ার কথা শোনা হয়নি। অফিসের খাওয়া রোজ তো ভালো থাকে না, অভুক্ত আছে কি! না, বাইরে থেকে কিছু একটা কিনে খেয়েছে? তিনি ফোন অন করেন। দুই ছেলে যে যার অফিস রুমে বাবার ফোনের উদ্দেশ্য জেনে হাসে। কী ছেলেমানুষি! বাসায় ফেরার সময় হয়ে আসছে আর তখন কি না লাঞ্চের খবর জানতে চান বাবা! দুই দুলালের আয়েশ কণ্ঠ কানে নিয়ে ফোনটা কিরণ বসু কেবল নামিয়েছেন, এ-সময় সালাহউদ্দিনকে দিনে দ্বিতীয়বার আত্মীয় অধিকারে ঢুকতে দেখে নাখোশ হওয়ার সুযোগ তিনি পান না। খানিকক্ষণ আগে মনোরমা ধূপদানি ঘুরিয়ে নিয়েছেন, এখনো সামনের রুমে ওই ধূপের হালকা গন্ধ ভেসে আছে। এসব কুচুটে পাজি মন্দ দুরাত্মা থেকে স্থায়ী রেহাই পেতে বাসাটা তাঁকে বদলাতে হবে। আর ওই কথা, অন্যায় যে সহে, বর্জন উপেক্ষা মজবুত না রেখে নিঃশব্দে সেও কি অনুচিত কাজ করছে না? নিশ্চিত মাথামোটা বলেই তাঁর বিতৃষ্ণা মনে হয় সালাহউদ্দিন ধরতে পারছে না। আশ্চর্য, মুখে প্রসন্ন হাসি ঝুলিয়ে মানুষটা দেখি এগিয়ে দাঁড়িয়েছে। – ‘আপনার জন্য’ বলে, বড় একটা পলিথিন ব্যাগভর্তি

কলা-কুল-খিরাই-পেয়ারা-কামরাঙা আরো কী কী আছে সালাহউদ্দিন টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখে। কোমরের পেছনে হাত আড়াল রাখার কারণে কিরণ বসু মানুষটার সঙ্গে আনা এই ফল সব লক্ষ করেননি।

বিষয় কী? জিজ্ঞাসার দরকার হলো না। সালাহউদ্দিন সন্তুষ্টি ভোগের তৃপ্তি নিয়ে কথার বাজনা ছড়িয়ে দেয়। সালাহউদ্দিনের মেয়ের বাড়ি হচ্ছে ফরিদপুরের মধুপুরে। ওদিকের বাগানক্ষেত এখন ফল-ফলাদিতে ভর্তি। এর গায়ে কোনো রাসায়নিক নেই। কার্বাইড দিয়ে পাকানো নয়, গাছের, টাটকা ফলের স্বাদই আলাদা। এগুলি মেয়ের শ^শুরবাড়ি থেকে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার নাকি কিরণ বসুর কথা মনে পড়েছে – দাদাকে না দিয়ে কিছুতেই খাওয়া যাবে না। যার কাছে মন খুলে কথা বলা যায় সেই মানুষকে সে ফল দিচ্ছে। উপহার বা মুফতে কিছু পেলে মানুষের এমনিতেই খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কিরণ বসুর মুখে পুলকলাগা তাইরে-নাইরে কোনো ছাপ ফুটে ওঠে না। বরং কৌতূহলে তাঁর দুই ভুরু বাঁকা হয়ে আসে – ‘আপনার ওপর-নিচ দুই প্রতিবেশীকে দেননি? এক বিল্ডিংয়েই তো থাকি।’

এমন আজব কথা সালাহউদ্দিন যেন ইহজনমে শোনেনি! মানুষ মানুষের মধ্যে দেওয়া-নেওয়া করে। কিন্তু ওই উদ্দিন আবার মানুষ নাকি? শরফুদ্দিন ফরিদউদ্দিনকে জীববর্গ থেকে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে খারিজ করে সালাহউদ্দিনের গলা নিকাশ ঢুকায় – ‘অসম্ভব। ওদের দেব মেয়ে তাবাসসুমের বাড়ির ফল? কক্ষনো না। ওরা দেয় কিছু? হাড়ে হাড়ে চিনি – কিপটে, ওরা পারে যার যার ঝোলা ভারী করতে। নিজের বেলায় আঁটিসাঁটি পরের বেলায় দাঁত কপাটি। ও দুটো স্বার্থ-গুলজার সংসারী। ওদের কথা বলবেন না তো।’

দেওয়া-পাওয়ার হিসাব কষে সংস্রব সম্পর্কের এমন ধারণা কিরণ বসুর জানা নেই। সৃষ্টিছাড়া এই অপ্রীতিকর মনোভাবে তিনি তাজ্জব হবেন কি, নিজেকেই নিজে খোড়ল করে ফেলেন – এখনো তাঁর সন্তান বিয়ে না করে ভালোই করেছে। হয়তো এই জামানার রেওয়াজ অনুযায়ী তাঁকেও কিছু লুকাতে বা কেচ্ছা বানাতে হতো।

নাহ্, শাহি-কারবারের নামে এদের বাগাড়ম্বর, ডাঁট, দম্ভ, বানোয়াট মুখসাপটা দেখে-শুনে তা নিজের মধ্যে জমা রাখতে রাখতে কিরণ বসু বুঝছেন, ক্রমশ তাঁর ওপর অন্যায্য চাপ পড়ছে। খামোকা ভদ্রতা করার কোনো মানে হয় না। দুর্বল, সাহসশূন্য মানুষের কাছে সৌজন্য হচ্ছে নিজের অযোগ্যতা ঢাকার সহজ উপায়। নির্ঝঞ্ঝাট থাকার জন্য নিজেকে ক্রমাগত পীড়ন করে যাওয়া। পৌরুষহীন লোক হচ্ছে ভীরু, তারাই অন্যের হিংসুটেপনা, ছল, প্রতারণা মুখ বুজে সহ্য করে।

কিরণ বসুর বোধ থেকে ধিক্কার উঠে এসে মন-স্নায়ু, মজ্জাগত সহিষ্ণুতায় ফাটল ধরালে নিজের আত্মমুখী জড়তা তিনি ভেঙে ফেলেন – ‘শোনেন, আমাদের দুই প্রতিবেশীর ছেলেমেয়ের উঁচু বংশেই …।’ গর্বিত দুই উদ্দিনের সৌভাগ্য নিয়ে কিরণ বসুর আরো কী বলার ছিল, তার আগেই গলা খুলে যাত্রার ঢঙে হেসে ওঠে সালাহউদ্দিন। তার বিকট হাসির প্রতাপে দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারও বুঝি দুলে ওঠে। – ‘বিয়ে হা-হা-হা, একজন শিল্পপতির, আরেকজন ধার্মিক ফ্যামিলিতে, হা-হা-হা। নির্ঘাত ওরা আপনাকে এই গল্প দিয়েছে। বোগাস, অল বোগাস। দুটোরই বিয়ে হয়েছে পাকা রাজাকার ফ্যামিলিতে। একাত্তরে পাক আর্মির দালাল ছিল।’

মুহূর্তে কিরণ বসুর ভেতর প্রবল ধস নামে। নিস্তারহীন এই জটিল দুর্দশা রোধ করার অনমনীয় ক্ষমতা তাঁর কোথায়! চারপাশে আদিম ভাঙন, কিনার-ঘেঁষা পত্তন খসে পড়ার উপক্রম। এসব উপলব্ধি সঙ্গে নিয়ে ধারালো সন্দেহে তিনি জখম হন। এমন কাটাকুটির মধ্যে নতুন একটা ভাবনা তাঁর লতিয়ে ওঠে। অনেকেই বলে, এতদিন পর একাত্তরের শত্রু নিয়ে আপত্তির কী! কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরাই নিজেরা তাদের লুকানো পাপ পরস্পর রেষারেষি করে ফাঁস করে দিচ্ছে। প্রায়শ্চিত্ত বলে একটা অমোঘ সত্য আছে। এই যে সালাহউদ্দিনের আনা ফল, মেয়ের শ্বশুরবাড়ির, বিশ^াস কী, এগুলি কোনো আলবদরের  বাড়ির বাগানের নয়!