নাশপাতির শেষকৃত্য

পঁচিশ বছর পর এবাদুল্লা যখন এলাকায় ফিরল, তখন তার লাপাত্তা হওয়ার সময় যেমন শোরগোল উঠেছিল তেমন কিছু না ঘটলেও নিকট আত্মীয়স্বজন বা চেনাজানা বয়স্করা যে ঘটনার কিনারা করতে গিয়ে বিপাকে পড়ল তা না বললেও চলে। বয়স্করা পষ্ট মনে করতে পারল, এ সেই এবাদুল্লা যে বহুকাল আগে টক-মিষ্টি কুল ফেরি করে বেড়াত, কিন্তু সেসব আদতে কুল ছিল না, ছিল নাশপাতি, আর মানুষজনও সুস্বাদু নাশপাতি জেনে দেদার কিনত। দেশি টক-মিষ্টি বা নারকেলি যে জাতেরই হোক, কুল বা বরই কী করে নাশপাতি হয়ে যায় সে গেরো খুলতে না পারলেও পাকা, টসটসে নাশপাতির স্বাদ-গন্ধ আজো যেন তাদের কারো কারো নাকে-জিভে বিঁধে আছে। এদের একজন, দামপাড়া দারুল উলুম মসজিদের একসময়ের মুয়াজ্জিন সবর হাজী যে একটা গোটা রমজান এবাদুল্লার নাশপাতি দিয়ে ইফতার সেরেছে, সে তার ফিরে আসার খবরে জিভ-টাকরায় নাশপাতির স্বাদ-গন্ধের মাতামাতিতে কিছুক্ষণের জন্য আনমনা হয়ে রইল। তার মনে পড়ল, এবাদুল্লা রোজ ইফতারের ঠিক আগে একটা নাশপাতি তাকে মাগনা গছিয়ে যেত।   

বয়সের ভারে এবাদুল্লার চেহারা-শরীরে পরিবর্তন এসেছে। হাঁটে খানিকটা কুঁজো হয়ে, হাতে মোটাসোটা ঘাড় বাঁকানো বেতের লাঠি থাকলেও লাঠিতে ভর না দিয়ে ঝুঁকে-ঝুঁকে ভালোই চলাফেরা করতে পারে।
গাল-থুঁতনি আগে ছিল সাফসুতরা, এখন সাদা দাড়ি-গোঁফে মুখের নকশা অনেকখানি চাপা পড়লেও ঢুলুঢুলু বড়-বড় চোখ, গলুইভাঙা থ্যাবড়া নাক আর ডান ভুরুর ওপর গুটলিপাকানো টাকিজোঁকের মতো ঘোর বাদামি জড়ুল তাকে চেনানোর জন্য যথেষ্ট। তবে সে যে সে, এর বড় প্রমাণ বাঁ-হাতের বুড়ো আঙুলের কোমর ঘেঁষে সবে গজানো বাচ্চা ছাগলের কচি শিংয়ের মতো ইঞ্চি দুয়েকের একটা ছানা আঙুল।

বাজারে মহামায়া হোমিও হলের বারান্দার বেঞ্চিতে তাকে আনমনে বসে থাকতে দেখে কারো চোখে অন্যরকম কিছু দেখার আগ্রহ-কৌতূহল জাগেনি। জাগার কথাও নয়। পরনে আধময়লা খাটো পাঞ্জাবি, সাদার ওপর সবুজ খোপ-খোপ লুঙ্গি, খালি পা আর কোলের ওপর শোয়ানো লাঠির পাশে গামছার গোলগাল পুঁটলি নিয়ে সে কতক্ষণ বসেছিল এ নিয়ে পরে যখন বলাবলি হচ্ছিল, কেউ বলছিল সকাল দশটা-সাড়ে দশটা থেকে জোহরের আজান পর্যন্ত তাকে ঠায় বসে থাকতে দেখেছে। কেউ অন্য কথা বলছিল, সে নাকি একনাগাড়ে বসে থাকেনি, কিছু সময় পরপর উঠে গিয়ে এদিকে-ওদিকে হাঁটাহাঁটি করে কাউকে খুঁজছিল, নয় নসু মেম্বরের কোল্ডস্টোরেজের দিকে তাকিয়ে এ জায়গায় তো পুকুর ছিল – এমন অবিশ্বাসী চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উল্টো দিকে সার-সার দোকানপাট, ভাতের হোটেল ও পাঙাশ মাছের উন্নত ফিড পাওয়া যায় লেখা সাইনবোর্ডে হাঙরের মতো প্রকাণ্ড পাঙাশের ছবি দেখতে দেখতে সম্ভবত বিরক্ত হয়ে আবার বারান্দার ছায়ায় ফিরে এসেছিল। চৈত্র মাসের মোষখেপা গরমও তার বিরক্তির কারণ হতে পারে।

 এসব ফালতু বকবকের মধ্যে এবাদুল্লা যে কখন বারান্দা ছেড়ে ফার্মেসির ভেতরে পা রেখেছিল এ নিয়ে কেউ কথা বলছিল না। কারণ তার দিকে কারো তেমন মনোযোগ ছিল না। তবে তার নিজের দরকার ছিল মনোযোগের, আর তাই মহামায়ার খোলা দরজা পেরিয়ে সে যখন কাউন্টার আগলে বসা বছর চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশের ঝাঁকড়াচুলের লোকটার সামনে গিয়ে নিচু গলায় অবিনাশ বাবুর খোঁজ করেছিল, তখন ক্যাশবাক্সের ফোকরে চাবি ঘোরানো থামিয়ে লোকটা তার জোড় ভুরুতে অন্তত তিনটা গিঁট ফেলে বুকে গামছার পুঁটলি ধরা বুড়ো লোকটাকে খুঁটিয়ে দেখে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিল – শ্রী অবিনাশ চন্দ্র সাহা? জবাবে মাথা নাড়তে দেখে সে মজা পেয়েছিল নিশ্চয়, কারণ তখনই সে ফার্মেসির সামনে দাঁড়ানো একজনকে হাঁক পেড়ে ডেকেছিল – তপইন্যা, দেইখা যা। তপন বা তপইন্যা ‘কী হইছে’ বলে ভেতরে ঢুকতে সে এবাদুল্লাকে দেখিয়ে মজাটা উগরে দিয়েছিল – দ্যাখ্, কে আইছে? বাবারে বিছরায়।

তপইন্যা ওরফে তপন অবাক চোখে পাশে দাঁড়ানো এবাদুল্লাকে একনজর দেখে সে নিজেও যে মজা পাচ্ছে তার প্রমাণ দিতে বলে উঠেছিল – অবিনাশ কাকার লগে দেখা করবার আসছেন? উনি আপনেরে খবর পাঠাইছিল? কিন্তু … এখন তো দেখা অইব না।

কথা শুনে এবাদুল্লা কী ভেবেছিল কে জানে, সে আগের মতো নিচু গলায় জানতে চেয়েছিল, অবিনাশ বাবু এখন ডাক্তারখানায় বসেন না?

প্রশ্নটা যেন বেশ জটিল, তপনের পক্ষে জবাব দেওয়া মুশকিল, সে থতমত খেলেও বাড়তি মজার লোভে – তুই ক না ধনা, বলে ঝাঁকড়াচুলকে মৃদু ধমক দিয়েছিল। কথা শেষ হতে না হতেই – তুমি ধনা? ছুটুকালে দেখছি অবিনাশ কত্তার লগে, তুমার ভাইয়ের নাম মনা – বলে এবাদুল্লা যখন মুখোমুখি ধনাকে ভালো করে দেখবে বলে কুঁজো ঘাড় সোজা করে চোখ দুটো টানটান করেছিল, ধনা ওরফে ধনঞ্জয়ের মনে মজাটা আর মজা থাকেনি। সে জিজ্ঞাসা করেছিল – আপনে?

 এ কথায় এবাদুল্লা এপাশে-ওপাশে তাকিয়েছিল। ততক্ষণে পাঁচ-ছয়জন লোক ফার্মেসিতে ঢুকেছে। এবাদুল্লা

এর-ওর দিকে তাকিয়ে যেন তার বয়সী বা কাছাকাছি বয়সী কাউকে খুঁজছিল যাকে সে নিজের পরিচয় দিতে পারে। তার হয়তো তখন মনে হয়েছিল, ধনার বাবা এলাকার নামকরা হোমিও ডাক্তার অবিনাশ বাবু যদি কাছেপিঠে থাকতেন, পরিচয় দেওয়ার ঝামেলা থেকে তিনিই তাকে রেহাই দিতেন। এমনও হতে পারত, দেখামাত্র তাকে চিনে ফেলতেন। এদিকে ধনার মন থেকে মজা উবে যাওয়ায়, আর লোকটা তাকে বাবার সঙ্গে ছোটবেলায় দেখেছে বলার পর, সে রগড় বাদ দিয়ে যখন জানাল তার বাবা পনেরো বছর আগে মারা গেছেন, এবাদুল্লা অবিনাশ সাহার মৃত্যুতে ঘাবড়ে গিয়ে বা পরিচয় দেওয়ার কঠিন সমস্যা নিয়ে কী করবে ভেবে উঠতে না পেয়ে ধনার মাথার ঠিক পেছনের দেওয়ালে শুকনো বেলি ফুলের মালা-পরা অবিনাশ সাহার ফ্রেমবন্দি ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে গামছার পুঁটলিটাকে বুকে চেপে ধরেছিল।

ধনা, তপনসহ আর যারা ছিল তাদের তখন বদ্ধমূল ধারণা অবিনাশ সাহার মৃত্যুর খবরে সে জোর ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু কেন খাবে, মরার বয়স হয়েছিল, পঁচাত্তর-ছিয়াত্তর বছর কী কম! আর খবরটা যদি তার জন্য ধাক্কা খাওয়ার মতোও হয়, সে তবে এতদিন খোঁজ রাখেনি কেন? পনেরো বছর অগের ঘটনা – সোজা কথা! নাকি অনেক বছর আগে, পনেরো-ষোলো বা তারও আগে, অবিনাশ সাহার সঙ্গে তার ভালো চিন-পরিচয় ছিল?  হতে পারে পুরনো রোগী, চিকিৎসায় ফল পেয়েছিল। রোগী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, চাষাভুষা ধরনের লোকটা অবিনাশ সাহার ঘনিষ্ঠ কেউ হওয়ার কথা নয়।

ফার্মেসিতে ফাঁকা জায়গা কম, লোক বাড়ছিল। এ ওর কাছে যখন শুনছিল বুড়োটা অবিনাশ সাহার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে, অবাক হওয়ার পাশাপাশি লোকটার মাথার গণ্ডগোল নিয়ে কারো কারো সন্দেহ জেগেছিল, এমনকি মতলব-টতলব থাকা অসম্ভব নয় – এ-চিন্তাও কাউকে পেয়ে বসেনি কে বলবে! এ অবস্থায় অবিনাশ সাহার দেখা না পেলেও ফোকলামুখো হাড়জিরজিরে এক ঢ্যাঙা বুড়ো কিছুক্ষণ চোখ কুঁচকে এবাদুল্লাকে জরিপ করে ভিড় ঠেলে এক-দুই পা এগিয়ে বলে উঠেছিল – নাশপাত্তি। এবাদুল্লা চমকে মুখ ঘুরিয়ে লোকটার চোখে চোখ ফেলতেই সে আবার বলেছিল – নাশপাত্তি। বলে তীক্ষè নজরে এবাদুল্লার মুখে তাকিয়ে, সম্ভবত ডান ভুরুর জড়ুলটা পরখ করে হাহাকারের গলায় বলে উঠেছিল – আরে! পরপরই সে যা করেছিল তাতে লোকজনের কৌতূহল বেড়েছিল। সে প্রথমে এবাদুল্লার ডান হাত, পরে বাঁ হাত নিজের হাতে নিয়ে গলায় আবার একই আওয়াজ তুলেছিল – আরে! ততক্ষণে ভিড় করা লোকজনের নজরে পড়েছিল সে এবাদুল্লার বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের গা ঘেঁষা ছানা আঙুলটা টেনে ধরে আছে। চিকন গলায় সে তখন বলে চলেছিল – আমারে চিনছো? আমি শামছু, শামছু মুহুরি। কই আছিলা অ্যাতদিন? এইখানে কী করো! অবিনাশ ডাক্তার বাঁইচা থাকলে বয়স হইত পেরায় একশ, তুমি তারে বিছরাও!

ঘটনা আর লম্বা-চওড়া হয়নি। শামছু নামের লোকটা, যে এলাকায় মুহুরি বলে এক নামে পরিচিত, মানুষজনের কৌতূহল মেটাতে বলেছিল – জামতলার এবাদুল্লা, আমরা কইতাম নাশপাত্তি। এখন পথ ছাড়ো।

দুই

মুহুরি এবাদুল্লাকে জামতলায় তার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। দাড়ি-গোঁফে মুখ অনেকটা উলুঝুলু দেখালেও বউ হাজেরা বানু এক চোখে ছানি নিয়েও এবাদুল্লাকে দেখামাত্র ইয়া মাবুদ বলে দাঁতে দাঁত বাঁধিয়ে ফিট হয়ে গিয়েছিল। চোখে-মুখে পানি দিয়ে ফিট ভাঙাতে সে উঠে বসে ফের ইয়া মাবুদ বলে ঘোমটার আড়াল থেকে অবশ চোখে বারবার এবাদুল্লার মুখে তাকিয়েছিল। বড় ছেলে বছর পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশের ময়না এবাদুল্লাকে দেখে ফিট-টিট হলো না, তবে পঁচিশ বছর আগে তার নিজের যখন বড়জোর দশ-এগারো, বাপের চেহারা-সুরত ঠিক মনে না থাকলেও লোকটা যে তার বাপ এ নিয়ে কোনো দোটানা ছাড়াই তার মনে পড়ল এবাদুল্লার ছয়আঙুলি বাঁ-হাতটা তাকে খুব ধন্দে ফেলত – বাপের যখন ছয়টা আঙুল, তারও হয়তো নতুন একটা গজাবে। আর নাশপাতির কথা সে ভোলে কী করে! তার মনে আছে, গরিব হলেও বাপ রোজ নাশপাতি নিয়ে ঘরে ফিরত। কোথায় পেত – এ প্রশ্ন অবশ্য সে-সময় মাথায় খেলত না। তার এক বোন, এক ভাই তার  চেয়ে বেশ ছোট। বোন আমিনার বয়স তখন চার-সাড়ে চার বছর, আর ভাই তোতা কোলের। আমিনা মারা গেছে বছর পাঁচেক, বিয়ে হয়েছিল কাছাকাছি গাঁয়ে। সুখ পায়নি শ^শুরবাড়িতে, বাঁজা বদনাম নিয়ে কয়েক বছর মাটি কামড়ে পড়েছিল। মাত্র দুই দিনের জ্বরে মারা গিয়ে নিজে বাঁচল, অন্যদেরও বাঁচার পথ করে দিয়ে গেল। 

আশপাশের বাড়িঘর থেকে মেয়ে-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা উঠানে, দাওয়ায় জড়ো হয়েছিল। তবে সবাইকে টেক্কা দিয়ে যে পা ছেচড়ে চোদ্দো-পনেরো বছরের নাতির কাঁধে ভর দিয়ে এসে এবাদুল্লাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ জুড়ে দিয়েছিল সে মোয়াজ্জিন সবর। পুরো এক রমজান এবাদুল্লার নাশপাতি দিয়ে রোজা ভাঙার স্মৃতি তাকে এতই আকুল করে তুলেছিল, সে কী বলবে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না। ভাঙা গলায় – আমি সবর, মুয়াজ্জিন, চিনতে পারছো? রোজ ইফতারের কালে নাশপাত্তি দিয়া যাইতা, বলে সে একদৃষ্টে এবাদুল্লার ঢুলুঢুলু চোখে চেয়ে বহুদিন আগের পাকা মিষ্টি নাশপাতির গন্ধ-সুবাসে যেন আনমনা হয়ে গিয়েছিল।

নাশপাতির ঘটনা সবার জানার কথা না, অল্প বয়সীদের তো না-ই। বহু বছর আগে এবাদুল্লা তখন গরিবের গরিব, পেট পালতে যখন যা জুটত করত। ক্ষেত-জমিতে জনখাটা, নারকেল গাছের মাথা সাফাই, চায়ের দোকানে কাপ-প্লেট মাজা, ঘরের লাউ-কুমড়া নিয়ে হাটে বসা, বর্ষার সময় ঠেলাজালের শিং, টাকি, বেলে, পুঁটি নিয়ে মাছপট্টিতে একটু জায়গা পেতে এর-ওর হাতে পায়ে ধরা। এসবের মধ্যে কোন ফাঁকে তার মাথায় ভর করেছিল ফল-পাকুড় ফেরি করার চিন্তা। কুল, আমড়া, জলপাই, গাব, লটকন যখন যা সস্তায় পেত পাইকারদের কাছ থেকে কখনো নগদে কখনো বাকিতে কিনত। অল্প-স্বল্প যা কিনত, বিক্রি হয়ে যেত, তবে খাটনি ছিল ম্যালা, রোদ-বৃষ্টিতে হাঁটার খাটনি। রোজগার যা হতো তাতে এক বেলার চালের জোগাড়ও কঠিন ছিল। কিছু দিন যেতে সে শুধু কুলই ফেরি করত, টেনে টেনে হাঁক পাড়তে গিয়ে শুধু কুল বা বরই বলে মুখে সুখ পেত না, বলত কুলবরই।

কুল বা বরইতে তার থিতু হওয়ার কারণ এলাকার দুই ইশকুলে, বিশেষ করে মেয়েদের জুনিয়র ইশকুলের গেটে খাট্টা-মিঠা দেশি কুল ঝটপট বিক্রি হয়ে যেত। হাঁটার খাটনি বাঁচত, আর মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে কুল নেওয়ার পর নুনের জন্য হাত পাতত। এবাদুল্লা বুদ্ধি খাটিয়ে নুনের সঙ্গে মরিচগুঁড়ো মেশাত। চলছিল মন্দের ভালো। বিক্রিবাট্টার পর অল্প কিছু কুল সে আলাদা করে রাখত, ঘরে নিয়ে যাবে বলে। হাজেরা বানু দুই-একটা মুখে দিত, ময়না তেমন আগ্রহ দেখাত না, তবে আমিনা কোচড়ে করে নিয়ে বসে রয়েসয়ে খেত। হাজেরা মাঝে মাঝে বলত, বরই বেচে আর কত! সে বুদ্ধি দিত, বাজারে যদি একটা পান-বিড়ির দোকান দিতে পারত এবাদুল্লা, সঙ্গে চা-বিস্কুট। বউয়ের বুদ্ধি যে তাকে উসকে দিত না, তা না। সে অবশ্য দোকান বলতে খোলা জায়গা বা গাছতলায় বসার কথাই ভাবত। খুব যে ভাবত, তা না। কম হলেও হাজার টাকার মামলা। এদিকে আজব এক ঘটনা যে তার জন্য তৈরি হয়ে ছিল, সে কী করে জানবে! এক সন্ধ্যায় ঘরে ফিরতে হাজেরা একটা কুল হাতে নিতে গিয়ে থ মেরে গেল। এ কি, কুল এত বড় আর লম্বাটে হয়, আর এত মিষ্টি! হাজেরা থেকে ময়না, ময়না থেকে আমিনা। সবার এক কথা। এটা কী ফল, তারা আগে খায়নি। এবাদুল্লাকে ডাকতে সে অবিশ^াসী চোখে ছোটখাটো ঘটির আকারের ফলগুলি দেখল। কয়েক মুহূর্ত সে কারো কথার জবাব দিলো না, তারপর নিজেও একটা রস-টসটসে ফল মুখে দিয়ে হাজেরার দিকে তাকাল, ময়না আর আমিনার দিকে তাকাল। মুখে বলল, নাশপাত্তি। হাজেরা যতই তাকে জেরা করল – সে কি এখন থেকে নাশপাতি ফেরি করবে, দামি ফল, কোথায় পায়, আর সে-ই বা কী করে খরিদ করে – জবাবে এবাদুল্লা মুখে খিল এঁটে থাকল। কখনো কখনো হাজেরার মনে হতো খিল-আঁটা মুখে বুঝি চিকন একটা হাসির রেখা দুলে উঠেই মিলিয়ে গেল। হাজেরা ধন্দে পড়ল। ময়না বা আমিনা অবশ্য এত স্বাদের ফল পেয়ে মহাখুশি। তবে তারা নিশ্চয় ভেবে থাকবে ঘটনাটা কি একদিনেই শেষ হয়ে যাবে, নাকি আরো ঘটবে, রোজ রোজ?

সেই সন্ধ্যায়ই এবাদুল্লার জীবনে আচানক ঘটনার শুরু। সকাল-সকাল সে কুল কিনতে যেত, কুলই কিনত, কিন্তু এলাকার মানুষজনও যখন দেখল গরিবের গরিব এবাদুল্লা কুল ছেড়ে নাশপাতির মতো দামি ফল বিক্রি করছে, তারা ভুরু কোঁচকাল। এদিকে এবাদুল্লা আগে যেমন কুলবরই বলে টেনে টেনে হাঁক পাড়ত তা চালু রাখল। তার যুক্তি সে তো কুলই বিক্রি করছে। সে তখন ইশকুলের গেট ছেড়ে বাজারের এক কোণে একটা জুতমতো গাছতলা বেছে ডালা পেতে বসা শুরু করল। দুই দিন গেল না, তার নাশপাতির স্বাদ-গন্ধ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ল। অল্প সময়েই এবাদুল্লার ডালা খালি হতে লাগল। কী করা, এবাদুল্লা দুই ডালা, তিন ডালা-ভর্তি নাশপাতি নিয়ে বসা শুরু করল। খোঁজখবর নিয়ে নাশপাতির দর ঠিক করল, তাও শহরে যে-দামে বিক্রি হয় তার চেয়ে অনেক কমে। আসলে সে তো কিনত কুল, তার জবানিতে কুলবরই। লোকজনের তাতে কী আসে-যায়, তারা রসালো মিষ্টি ফল যার নাম শুনলেও অনেকে চোখে দেখেনি, আশ মিটিয়ে খেতে লাগল। তাদের ধারণা, ওগুলি  দেশি না, বিদেশি জাতের নাশপাতি, তাই এত রসালো। এবাদুল্লা ডালা ছেড়ে চাকা লাগানো ঠেলাভ্যানে তার কুলবরই নামের নাশপাতি বেচা-বিক্রিতে সকাল-সন্ধ্যা এক করে ফেলতে লাগল। বলার অপেক্ষা রাখে না, দ্রুত তার অবস্থার উন্নতি হতে থাকল। সে ঘরের চালে জলহস্তি মার্কা ঢেউটিন চাপাল, বাঁশের বদলে কাঁঠাল কাঠের কড়িবর্গা, জাম কাঠের খুঁটি। তরজার বেড়ায় এঁটেল মাটির পুরু পলেস্তারায় চুন-পানি পড়তে ঘরটা ঝলমল করে উঠল। উঠান থেকে তাকিয়ে চালের টিনের ঝকমকানি ও বেড়ার সাদা জৌলুসে হাজেরা বানু মনে মনে আওড়াল – আয়না জ্বলে, চক্ষে ধরে, চাওন যায় না, ঝিলিক মারে।

এবাদুল্লা নিজের মুখে সেই যে খিল দিয়েছিল, খোলার দরকার মনে করল না। নাশপাতিকে কুলবরই বলা চালিয়ে গেল। শুনে লোকজন হাসত, বরইয়ের মৌসুম শেষ, তারপরও এবাদুল্লা নাশপাতিকে কুলবরই বলে চালাচ্ছে। ঘরে প্রথম-প্রথম হাজেরা তাকে নানা ধরনের জেরা করে ফল না পেয়ে ততদিনে চুপ মেরে গেছে।

এদিকে লোকজন তো দেখছিল গরিবের গরিব এবাদুল্লা রাতারাতি কিভাবে নিজের অবস্থা বদলে ফেলছিল। তারা তখন মূল প্রশ্নটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিলো। কী করে সম্ভব! ব্যবসার গোমর এবাদুল্লা না হয় না-ই ভাঙল, কিন্তু এমন আজগুবি কারবারের কূলকিনারা করতে না পেরে তারা যেমন হতাশ হলো, তেমনি বুকে কিসের খচখচানিতে অস্থিরতায়ও পড়ল। তারা ঠিক করল জানা দরকার, যে করেই হোক। এক সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার মুখে এবাদুল্লাকে তারা ঘিরে ফেলল। প্রথমে এ-কথা সে-কথা,

শরীর-স্বাস্থ্য কেমন, ব্যবসার কী অবস্থা হেনতেন জানতে চেয়ে এবাদুল্লাকে তারা টেনে নিয়ে গেল একটা নির্জন ঘুটঘুটে জায়গায়। তারপর যে-জন্য তাকে পাকড়াও করা – কে দেয় তাকে নাশপাতি? নাশপাতিই যদি, সে কেন কুলবরই বলে?

এবাদুল্লার কাছে প্রশ্নগুলি নতুন না, ঘরে হাজেরা বানু সেই শুরু থেকে এসব নিয়ে অনেক জেরা করেছে, ঘরের বাইরের লোকজনও। কিন্তু সেই ঘুটঘুটে সন্ধ্যায় ঘিরে ধরা লোকজন নাছোড়, তার মুখ থেকে জবাব শুনবেই। কই পাস?

জাদু-মন্তর দিয়া নাশপাত্তি বইলা কী বেচস? তোর লগে আর কে আছে ক। জিন-ভূত থাকলেও ক। এ পর্যায়ে এবাদুল্লার নীরবতায় ত্যক্ত হয়ে একজন যখন একটা ঘুষি পাকিয়ে মুখে না বুকে বসাবে এ দোটানায় ঘুষির বদলে একটা বেমক্কা ধাক্কা দিলো, তখন অন্যদের গোটানো হাতগুলিও সচল হয়ে উঠল। কিল-ঘুষি-গাট্টা খেয়ে এবাদুল্লা একটা কথাই বলেছিল, সে তো কুলবরই আনে। কুলবরই নাশপাতি হয়ে গেলে সে কী করতে পারে!

সে-সন্ধ্যায় ছাড়া পেলেও ঘটনার রেশ চলছিল, আর তা শুধু নির্জন অন্ধকারে আটকে থাকেনি। এবাদুল্লার মন বলছিল, অবস্থা দিন দিন খারাপের দিকে যাবে। সে জায়গা বদল করে অন্য এলাকায় তার ঠেলাভ্যান নিয়ে বসতে শুরু করেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে সেখানেও জবাব-খোঁজা লোকজনের দেখা মিলতে সে আবার জায়গাবদল করেছিল, তারপর আবার, আবার। কী করবে, কারবার ছেড়ে ঘরে বসে থাকবে, নাকি রোজগারের অন্য ধান্দা করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তার তখন হাজেরার মুখে পান-বিড়ি-চা-বিস্কুটের দোকানের কথা মনে পড়েছিল। মনে পড়লেও মন থেকে সায় পাচ্ছিল না, সে ভয় পাচ্ছিল দোকান দেওয়ার পর যদি নতুন কোনো আচানক ঘটনা ঘটতে থাকে!

এমন সময় আজব ঘটনাটা ঘটল। খবর রটল এবাদুল্লার নাশপতি খেয়ে অমুক গ্রামের তমুকের দশ বছরের মেয়ে তিনদিন এক অজানা রোগে ভুগে মারা গেছে। ডাক্তার-কবিরাজের কিছু করার ছিল না, রোগই ধরতে পারেনি। খবর শুনে এবাদুল্লার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এ কী বিপদ! দুই দিন না যেতে খবর এলো আরো কারা কারা সেই অজানা রোগে মরতে মরতে বেঁচে গেছে। এবাদুল্লা এক রাতে হাজেরাকে বলল, আমি আর এইখানে না। আমি থাকলে তুমরার বিপদ।

বিপদ ঠিকই হতো। পরদিনই লাঠিসোটা নিয়ে অনেক লোক তার বাড়ি ঘেরাও দিয়েছিল, ঘরের ঝিলিক দেওয়া ঢেউটিন আর সফেদ বেড়া তাদের কারো কারো নজর গভীরভাবে টানছিল, আগুন দেওয়ার চিন্তাটা মাথায় খুব রোশনাই ছড়াচ্ছিল। কিন্তু যখন খবর পাওয়া গেল পাখি উড়ে গেছে, তারা অপেক্ষা করল, পাহারায় থাকল দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।

এবাদুল্লা ফিরল না। সপ্তাহ, মাস, বছর গেল। বছরের পর বছর। এদিকে অমুক গ্রামের তমুকের মেয়ে মরার যে খবরটা চাউর হয়েছিল, তার সত্যতা পাওয়া গেল না। কে বা কারা গুজবটা রটিয়েছিল পাত্তা মিলল না। এতে অনেকের আফসোস হলো, তারা ভেবে পেল না কেন এবাদুল্লার মতো নিরীহ লোককে বিনা দোষে গ্রামছাড়া করা হলো। আফসোস অন্য কারণেও – কত কাল তারা রসালো নাশপাতির স্বাদ  পায়নি! তবে অনেকের মনে খটকা থেকেই গেল নাশপাতির মতো নামিদামি ফলকে এবাদুল্লা কেন দেশি খাট্টা-মিঠা বরই বলত। 

তিন

হাজেরা বানু কতক্ষণ আর ঘোমটার ভেতর থেকে আড়ে আড়ে স্বামীকে দেখে? কিন্তু লোকটা যে কিছুই বলছে না, ঘরে এনে চৌকিতে বসানোর পর এদিকে-ওদিকে বারকয়েক চোখ ঘুরিয়ে কী খুঁজছিল কে জানে! ময়না আর তোতাকে দেখে নিশ্চয় অবাক হয়েছে। এদিকে ময়না এক কাণ্ড করেছে, সে তোতাকে বাপের বাঁ-হাতের ছয় আঙুলের গল্প বলেছিল, ময়নার ধারণা গল্পটা সে বিশ^াস করেনি। এবার প্রমাণটা সামনাসামনি পেয়ে যেতে ময়না এবাদুল্লার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বাঁ হাতটা নিজের হাতে নিয়ে তোতাকে বলল, কইছিলাম না? বিশ্বাস যাস নাই, অখন দ্যাখ। তোতা বিশ্বাস করেনি এমন কথা না বললেও ময়নার মনে পড়ল, ছোটবেলায় বাপের এই ছানা আঙুলটা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে মনে আশা জাগত, তার নিজের ডান বা বাঁ-হাতে ঠিক এমনই একটা আঙুল গজাবে। এক সুযোগে বাপের হাত ধরার সুযোগ পেয়ে সে হাতটা ধরেই থাকল, চিকন কঞ্চির শক্ত ডগার মতো আঙুলটার দিকে তাকিয়ে থেকে তার নাশপাতির কথা মনে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বোন আমিনার কথা। আমিনা মারা গেছে খবরটা নিশ্চয় বাপের জানা নাই, নাকি বাড়িতে আনার পথে মুহুরি বলে দিয়েছে?

 দিন দুই গেল। এবাদুল্লা প্রায় সময়ই ঘুমিয়ে কাটায়। মাঝেমাঝে কী হয়, সে তার বড় বড় চোখ ঘুরিয়ে ঘরের এপাশে-ওপাশে তাকিয়ে বিড়বিড় করে। হাজেরা বানু বলে, কী বলেন? দীর্ঘদিন অদেখা স্বামীকে তুমি বলতে তার বাধল। আপনি সম্বোধনে হাজেরার নিজেরই অস্বস্তি হলো, তবে এবাদুল্লার হাবভাবে কিছু বোঝা গেল না। আমিনার মরার খবর দিতে গিয়ে হাজেরার মনে হয়েছিল এবাদুল্লা নিশ্চয় চমকাবে, বা বন্ধ মুখটা খুলবে। মুখ সে খুলল না, তবে তীক্ষè চোখে কতক্ষণ চেয়ে থেকে চোখ বুজল, হাজেরা দেখল লোকটার চোখের কোলে বেত ফলের আকারের গোল গোল দুই বিন্দু ঘোলা পানি। কী করবে, চোখ মুছিয়ে দেবে, ভাবতে না ভাবতে এত দিনের অদেখা স্বামীর চোখের কোণে আঁচলের খুট ঘষতে গিয়ে দেখল তার হাতে জড়তা নেই। সাবলীলভাবে চোখ, কপাল, ডান ভুরুর জড়ুল হয়ে তার হাতটা লোকটার ছয়-আঙুলি হাতে গুঁজে দিতে দিতে বলল, কথা কন না কেন? আপনার ছেইলা দুইটারে দেখছেন, কত বড় হইছে। আপনে অনেক বুড়া হইছেন, আমিও। কই আছিলেন কইবেন না? আমি জানতাম আইজ হোক কাইল হোক, না আইসা পারবেন না।

হাজেরা বানু সংসারের নানা কথা শোনাল, যার সারকথা অভাব। ময়না এক মুরগির খামারে খেটেখুটে যা কামায় তাতে দুই বেলা ভাত জোটানো মুশকিল, ছোটজন তোতা বাবুগিরি করে বেড়ায়, বড়ভাইয়ের রোজগারে বাবুগিরি পোষায় না বলে বাড়িতে বড় একটা থাকে না, এলাকার মেম্বারের সাগরেদ হয়ে কী করে বেড়ায় সে-ই জানে। এদিকে ময়নার বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে, ছেলেটার জন্য বউ দেখা দরকার, কিন্তু উপায় কী! এবাদুল্লা শুনল কি শুনল না, তবে হাজেরার মন বলল শুনেছে।

বাড়িতে আপনজনকে কাছে পেয়েও এবাদুল্লার মুখে কথা নাই। অথচ প্রথম দিন মহামায়া হোমিও হলের বারান্দা ছেড়ে ভেতরে ঢুকে সে ঠিকই কথা বলেছিল – ধনঞ্জয়ের কাছে অবিনাশ সাহার খোঁজ করেছিল। নিচু গলায় বললেও কথা তো কথাই। ধনঞ্জয় যখন শুনল এবাদুল্লা তার বউ ও ছেলেদের সঙ্গে কোনো কথাই বলছে না, সে কৌতূহলী হয়ে এবাদুল্লার মুখোমুখি বসে লোকটা কেন তার বাবার খোঁজ করেছিল জানতে চাইল। তার বাবার সঙ্গে কত দিনের পরিচয়, ঘন-ঘন কি দেখা হতো, অসুখ-বিসুখে তার বাবার কাছে সে যেত, না এমনি – এসব খুচরা আলাপে দেখা গেল এবাদুল্লার হেলদোল নেই। বারবার চোখের পলক ফেলতে দেখে মনে হলো সে ধনঞ্জয়ের কথা মন দিয়ে শুনছে, কিন্তু জবাব দিতে মুখ খোলার দরকার মনে করছে না।

এবাদুল্লা যে মুখ বন্ধ রাখবে এমন প্রতিজ্ঞা করেনি তার প্রমাণ মিলল দিন কয়েক বাদে। প্রথমে হুঁ হ্যাঁ, তারপর একদিন হাজেরা বানুকে বলল উঠানে যাবে। হাজেরা উৎসুক হলো। পড়ন্ত দুপুরে এবাদুল্লা ঝুঁকে ঝুঁকে হেঁটে ঘরের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। পঁচিশ বছর আগে ফেলে যাওয়া দোচালা টিনের ঘরটা তার নিজের করা। এত বছরে টিনে মরিচা ধরবে জানা কথা, ধরেওছে। উঠানটা যেন আগের চেয়ে ছোট হয়ে গেছে, এদিকে-ওদিকে নানা জঞ্জাল, মাঝখানে হাত পাঁচ-সাতেকের মতো জায়গা কিছুটা পরিষ্কার। উঠানে দাঁড়িরে ঘরের দিকে চোখ ফেলতে পড়তি দুপুরের রোদটা যাই-যাই করেও যেন হঠাৎ তেতে উঠল। রোদকে দোষ দেওয়া যায় না – এই ঘর, বউ-ছেলেমেয়ে ফেলে তাকে পঁচিশ বছর আগে ভাগতে হয়েছিল, ফিরে যখন এলো তখন আসমানে রোদের তাত যেমনই থাকুক, সে যে অন্য তাতে পুড়ছিল এ-কথা বলে-কয়ে জানান দেওয়ার বিষয় নয়। মুখে সে কিছু বলল না। হাজেরা বানু বলল, ঘরটা করতে কত খাটনি গেছিল মনে আছে? আপনে যাওনের পর মাইনষ্যে কী কওয়াকওয়ি করত শুনবেন? কইত, মনের জোর আর নিয়ত থাকলে মাইনষ্যে কী না পারে! কুলবরইরে পর্যন্ত নাশপাতি বানাইতে পারে।

এবাদুল্লা শুনল কি শুনল না। সে আনমনা চোখে কিছুক্ষণ জংধরা ঢেউটিনের দিকে তাকিয়ে বউয়ের মুখে চোখ ফেরাতে হাজেরার মনে হলো সে কিছু বলবে। এবাদুল্লা বলল না কিছু, তবে পড়ন্ত রোদে তার চোখে এক টুকরা হাসি ফুটতে না ফুটতে মিলিয়ে যেতে দেখে হাজেরার আচমকা মনে পড়ল বহু বছর আগে নাশপাতি নিয়ে কথা তুললে এবাদুল্লার মুখে এ রকম এক চিলতে চাপা হাসি উঁকি দিতে না দিতে হারিয়ে যেত। সেই আভাঙা হাসি কিংবা হাসির মতো মুখের দু-একটা রেখার নড়াচড়া দেখামাত্র তার মনে হলো, এবাদুল্লা হয়তো এত বছর পর নাশপাতির ধাঁধা ভাঙবে। হতে কি পারে এতদিন পর ধাঁধা ভাঙতেই তার ফেরা! এদিকে হাজেরা বানু তো তাকে সংসারের অভাব-অনটনের কথা শুনিয়েছে। এখন অনটন দূর করতে সে যা ভালো মনে করবে করুক। পঁচিশ বছর আগে তো করেছিল।  

এ হলো হাজেরা বানুর ভাবনা। পঁচিশ বছর অদেখা স্বামীকে পেয়ে সে আকাশকুসুম অনেক কিছু ভাবতেই পারে। এবাদুল্লা কী ভাবছে জানার যখন উপায় নাই, ভাবাভাবিটা তাকেই করতে হচ্ছে। যদিও মাঝে মাঝে উটকো কিছু দুশ্চিন্তাও তাকে খোঁচায়। লোকটা এতদিন লাপাত্তা ছিল, নিশ্চয়ই অনেক দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল, সেখানেও কি কুলবরই বলে নাশপাতি ফেরি করত? যা-ই করুক, একটা ঠাঁইয়ের তো তার দরকার ছিল। কোথায় পেয়েছিল ঠাঁই? নতুন সংসার পেতেছিল? তেমন হলে ছেলেমেয়ে থাকা বিচিত্র না। সেই বউ, ছেলেমেয়ে ফেলে কী মনে করে পুরনো সংসারে ফিরল? দুশ্চিন্তাটা চেপেচুপে বুকে বুকেই রাখতে হয়, বলা যায় না, আর বলবেই-বা কাকে! বলা মানে এবাদুল্লাকে জেরা করা। যে-মানুষ নিজের লাপাত্তা হওয়া নিয়ে একবারও মুখ খোলেনি, তাকে এ নিয়ে কে জেরা করবে!

শুধু হাজেরা না, ময়নার মাথায়ও যে অন্য চিন্তা তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন সে এক রাতে মাকে বলল – পুলটিরির কাম আর না।

হাজেরা বলল – তাইলে কী করবি?

– নাশপাত্তি বেচুম। না না বরই, কুলবরই।

হাজেরা এতটাই চমকাল, সে পলকহীন কতক্ষণ ময়নার দিকে তাকিয়ে কী বলবে ঠিক করতে না পেরে বলল – নাশপাত্তির লাইগা তোর বাপ দেশছাড়া হইছিল।

– কুন কালের কতা! অখন কি কেউ দেশছাড়া করতে চায়?

– না চাউক। তুই আর তোর বাপ এক!

– চেষ্টা করতে দুষ কী!

– কী চেষ্টা করবি?

– কইলাম তো কুলবরই ফেরি করুম।

– আর মাইনষ্যে খরিদ করতে গিয়া দেখব নাশপাত্তি!

কথার জবাব না দিয়ে ময়না চুপ করে কী ভাবল।

চার

ময়না যে সত্যি সত্যি মুরগির খামারের কাজ বাদ দিয়ে এক সকালে

কাঁচা-পাকা বরইয়ের চ্যাপ্টা ডালা মাথায় নিয়ে বেসুরো গলায় কুলবরই বলে হাঁক পেড়ে গ্রামের এপথে-ওপথে হাঁটবে, হাজেরা বানু কল্পনাও করেনি। কুলবরই বলে হাঁক দিলেও মনে মনে সে নাশপাতি ছাড়া কিছু ভাবছে না, এ-কথা হাজেরার মতো আর কে জানে! বহু বহুদিন আগে তার নিজের চোখে যা দেখা তাতে ফাঁকিজুকি ছিল না, আর এখন যখন ময়না বাপের পথ ধরে ভাবছে একই ঘটনা আবার ঘটবে, তখন ছেলেকে সে কী বলে! একটা আচানক ঘটনা একজনের বেলায় ঘটলে অন্যজনের বেলায়ও ঘটবে, এমন চিন্তার কী যুক্তি? তারপরও হাজেরা বানু ভাবল, সেই যে এবাদুল্লার কুলবরই নাশপাতি হতে শুরু করল আর এলাকার মানুষজন দিনের পর দিন মন ভরে নাশপাতি খেল, সেটা যত আচানকই হোক, এবাদুল্লা নিশ্চয় এর গোমর জানত। এখন যদি গোমরটা ভাঙে!

 ময়নার দিনভর হাঁটাহাঁটিই সার। দেশি কুল, তাও ভালো জাতের হলে কেউ কেউ ফিরে তাকাত। তার কুল বা কুলবরই রোদের তেজে রসকষ খুইয়ে শুঁটকো হয়। এতে অবশ্য তার দুঃখ নাই, সব কটা যদি বিক্রিও হয়, কয়টা পয়সাই-বা! রাতে অবিক্রীত বরই ভাড়ার ঘরের মাচায় তুলে রেখে কিছুই হয়নি এমনভাবে সে শুতে যায়, তবে যে কাজটা তাকে করতেই হয় – রাতে বারকয়েক চক্কর দিয়ে পরখ করা। আরো একজন যে করে তা না বললেও চলে – হাজেরা বানু। পরদিন রংমরা, চিমসানো বরই ফেলে ময়না নতুন বরইয়ের ডালা মাথায় নিয়ে কুলবরই বলে হাঁক পাড়তে পাড়তে মনমরা পায়ে হাঁটে।  

এভাবে আর কত দিন! ময়নার পুঁজিপাট্টায় টান ধরল। ঘরে চাল-ডাল নাই, চেয়ে-চিন্তে, ধার-বাকিতে একবেলা ফেনভাত জোটাতে হাজেরা বানুর কাহিল দশা। এক রাতে ময়না সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঘরে ফিরেছে, হাজেরা এবাদুল্লার সামনে বরইয়ের ডালাটা রেখে বলল – এইগুলা বরই, না নাশপাত্তি? এবাদুল্লা শূন্যদৃষ্টিতে হাজেরা বানুর দিকে তাকিয়ে একটা আধপাকা বরই তুলে মুখে দিয়ে বলল – নাশপাত্তি। বলেই সে একের পর এক মুখে পুরতে লাগল। দেখাদেখি হাজেরা বানু একটা মুখে দিয়ে কষাটে স্বাদে মুখ বেঁকালো। আশ্চর্য, এবাদুল্লা মুখভর্তি বিচিসমেত বরই চিবোতে চিবোতে বলল – নাশপাত্তি মনে করলে নাশপাত্তি। হাজেরা বানু দেখল এবাদুল্লার মুখে হাসি – আভাঙা হাসি না, হাসিটা তার ঠোঁট, থুঁতনি হয়ে ঢুলুঢুলু চোখ পর্যন্ত পৌঁছে তিরতির করছে। কথা শুনে এতদিনে এই প্রথম লোকটার ওপর তার রাগ হলো, ঘরে নাই দানা, আর সে কী বলে!

এদিকে এবাদুল্লা মুখে একটা পর একটা পুরেই চলেছে। এ-অবস্থায় মনের রাগ-ঝাল মুলতুবি রেখে তার খাওয়া দেখাটাই যেন একটা কাজের কাজ। ময়না যে কোন সময় এসে দাঁড়িয়েছে, হাজেরা বানু খেয়াল করেনি, আর তোতা যার বাড়ি ফেরার ঠিকঠিকানা নাই, সেও কী ভেবে ময়নার গা ঘেঁষে অবাক হয়ে এবাদুল্লার খাওয়া দেখছে। তৃপ্তিতে যে সে খাচ্ছে তা তার বোজা চোখ ও চোয়াল-চিবুকের নড়াচড়ায় পরিষ্কার।

ভোর-ভোর হাজেরা বানুর ঘুম ভাঙল নাশপাতির মো মো সুগন্ধে। কত কাল আগে খেয়েছে, হুবহু সেই সুবাস।  ঘরটা মিষ্টি ঘ্রাণে মাতোয়ারা। উঠে বসতে প্রথমেই নজরে পড়ল এবাদুল্লার ঘাড়-মাথা চৌকি ছেড়ে কাত হয়ে ঝুলে প্রায় মেঝে ছুঁইছুঁই। ঠান্ডা, কাঠ-কাঠ ঘাড়-মাথা টেনে ওঠাতে গিয়ে নিষ্পলক, আধখোলা চোখে তাকিয়ে সে চেঁচিয়ে ময়নাকে ডাকল, তোতাকে ডাকল।

এবাদুল্লার মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়াল। খবর শুনে যারা ছুটে এলো, উঠানে পা দিতে না দিতে নাশপাতির চনমনে ঘ্রাণে হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। গন্ধমাতাল বাতাসে কেউ কেউ শ^াস টানতেও বুঝি বাধা পেল। তবু স্বাদ-গন্ধহীন বাতাসের বদলে তাজা-টাটকা ঘ্রাণ বুক ভরে টানতে গিয়ে তারা থমকে এ-ওকে দেখল। বয়স্করা যারা এসেছিল – শামছু মুহুরি, সবর হাজি – প্রাথমিক ধাক্কা সামলে ভাবল, তাই তো, মানুষটা তো  নাশপাতিই ছিল।

 বাড়ির কাছে গোরস্তান।

বাদ-আসর কবরে লাশ নামানোর সময়

আতর-লোবানের ঝাঁজ ছাপিয়ে নাশপাতির গন্ধবাহারে গোটা এলাকা মেতে উঠল। মনে হলো, সুগন্ধের বিশেষ কোনো উৎস নেই; বেলাশেষের ছায়াঅন্ধকার কবরস্থানের আকাশচারী গাছপালা, বেওয়ারিশ ঝোপঝাড়ের শ^াস-প্রশ^াস থেকেও গন্ধটা অদৃশ্য, অধীর ধোঁয়ার মতো হাওয়ায় পাক খাচ্ছে। সেইসঙ্গে জোট বেঁধে বিরতিহীন ঝিঁঝিঁ-তান, পাখপাখালি, প্রজাপতি, চেনা-অচেনা কীট-পতঙ্গের মাতামাতিতে গন্ধটা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। গাছ-গাছালির মৃদুমন্দ দুলুনিতে ঘ্রাণটা গোরস্তানের সীমানা টপকে পেরোতেই হাওয়ার টানে উত্তরে-দক্ষিণে, পূর্বে-পশ্চিমে, দূরে দূরে, এমনকি দলছুট কিছু ছন্নছাড়া, চটুল মেঘের ভাঁজেও গিয়ে মিশছে।

একদৃষ্টে যারা তাকিয়েছিল তারা ঝিঁঝি-ধরা চোখে কী দেখল ঠিক বলতে পারবে না, তবে মেঘের ভাঁজে ভাঁজে থাক-থাক আকাশে যা নজরে পড়ল তা যেন রামধনুর হলদে-লাল আবীররাঙা থোকা থোকা নাশপাতি – এই পাক খেয়ে দুলছে, এই আবার এবাদুল্লার মুখের ঝাপসা, ধোঁয়া-ধোঁয়া নকশা হয়ে ডুবছে, ডুবতে ডুবতে আবার …