ডাল বাগার দেওয়ার গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের মধ্যে। দেয়ালে দেয়ালে সে-গন্ধ প্রতিফলিত হয়ে পথ খুঁজছে বাইরে যেতে। রাসেলের গা গুলিয়ে ওঠে হঠাৎ। সংবাদটা শোনার পর থেকে সে দু-চোখের পাতা এক করতে পারেনি। অন্ধকারে কতবার চোখ মেলে তাকিয়ে থেকেছে, পাশ ফিরে মিলার নিশ্বাস পতনের ধ্বনি শুনেছে, তারপর এপাশে কষ্ট হলে অন্যপাশ ফিরে শুয়েছে।
সকাল আটটা বাজে। রাসেল উঠে জানালার গ্লাস সরিয়ে দেয়। এই মধ্য আশ্বিনে উত্তরের বাতাস যেন হকচকিয়ে ঘরে ঢুকে ডাল বাগারের গন্ধ নিয়ে লুটোপুটি খেলছে। এবার কি শীত আগেভাগে এসে পড়লো? রাসেল খাটে গিয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে। মিলাকে আগেই বলে রেখেছে দশটায় বের হবে। পথ বেশি না, জুমার নামাজের আগেই পৌঁছে যাবে শ্রীপুর। ভাড়াগাড়িটা দশটায় গেটে আসবে। ছুটির দিন না হলে অফিসের গাড়িটা নিতে পারতো। চাইলে যে পাওয়া যেত না তা নয়, তবে রাসেলের এতো কিছু করার মতো মনের অবস্থা ছিল না। মিলাই তার এক পরিচিতজনকে বলে গাড়িটা ভাড়া করেছে। সেও যেতে চেয়েছিল; কিন্তু রাসেলের ইচ্ছা না মিলা সেখানে যাক। মিলা আর জোর করেনি। মিলা তাকে কয়েকবার দেখেছে। ওদের তখন নতুন সংসার। একবার সে এলো নিজ হাতে সেলাই করা একটা নকশিকাঁথা নিয়ে। রাসেলকে ডাকতো ‘আব্বা’ বলে সেই স্কুলে পড়া থেকে। মিলা ছিল তার মা। তার কথা আর আন্তরিক ব্যবহারে মিলা অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছিল। এই মানুষটার জীবনটা সেই রূপকথার দুয়োরানির মতো! ছেলেকে নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। যেন রাজপুত্র! সবরি কলার মতো গাত্রবর্ণ আর বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। তবে তাকে দেখে মিলার মনে হয়েছিল, গভীর দুঃখে তার চোখের পাপড়ি ঝুলে থাকা কলার মোচার গা ছেড়ে বেরিয়ে পড়া নিঃসঙ্গ ঢাকনাটার মতো। বেসিনে চোখে-মুখে পানি দিতে গিয়ে অনেকক্ষণ ঝাপসা আয়নায় নিজের ঝলসে যাওয়া মুখটির দিকে তাকিয়ে ছিল। মিলা আড়চোখে তাকিয়ে সরে গিয়েছিল সেদিন।
টেবিলে খাবার দিয়েছি, খেতে এসো। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে মিলা ঘরে ঢোকে। রাসেল মাথার নিচে হাত দিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মিলা ওর কপালে হাত রাখে।
কী হলো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। গাড়ি এসে পড়বে। তোমাকে তো আবার ফিরতে হবে।
রাসেল কোনো কথা বলে না। উঠে বসে। মিলার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বুঝতে পারে একটু আগেও রাসেল কাঁদছিল। ওর মনটা যে কত নরম বিয়ের কিছুদিন পরই মিলা তা বুঝতে পেরেছিল। মিলা চোখ সরিয়ে নেয়। রাসেল উঠে ওয়াশরুমে ঢোকে।
সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে মিলা বলে, খুব বেশি দেরি করো না। তাড়াতাড়ি ফিরবে আর ছোট চাচা কি খবরটা জানে?
পা ল্যান্ডিংস্পেসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাসেল থমকে দাঁড়ায়। মাথার মধ্যে যেন বাজ পড়ে, নিজেকে সামলে নিয়ে মিলার দিকে ফিরে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে, তার জানা না-জানায় কী আসে-যায়?
নিজের বাবা, চাচাকে আজ এই মুহূর্তে বিচারকের আদালতে দাঁড় করিয়ে সে বিচার করতে বসবে না; কিন্তু সে-বিচার অলক্ষে হয়তো থেমেও থাকবে না। রাসেল গাড়িতে গিয়ে বসে।
ড্রাইভার সাহেব সাবধানে গাড়ি চালাবেন, মিলার মনে অজানা আশঙ্কা ভর করে। রাসেলকে নিয়ে গাড়িটা গলি ছেড়ে বড় রাস্তায় গিয়ে ওঠে। মিলা সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
রাসেল আজো বুঝতে পারে না সেটা কি তার বাবার প্রচণ্ড জেদ আর অহমকে থিতু রাখতেই বিয়েটাকে অস্বীকার করে মেনে নেয়নি, নাকি সত্যি …? একটা ঝাঁকুনিতে রাসেল সজাগ হয়ে বসে।
কী হলো ড্রাইভার সাহেব? কোনো সমস্যা?
স্যার, সামনে মনে হয় কোনো সমস্যা হয়েছে, ড্রাইভার সামনে তাকিয়ে থেকেই উত্তর দেয়। রাসেল একটু দূরে দেখে একটা ভারি জটলা – অ্যাম্বুলেন্স, পুলিশ। ড্রাইভারকে আরেকটু এগিয়ে যেতে বলে রাসেল পরিস্থিতির দিকে নজর রাখে। ফোনটা বেজে ওঠে। রাসেল ফোন ধরেই বলে, হ্যাঁ চাচা বলুন। আমি পথে – বলেই লাইনটা কেটে দেয়। বিরক্ত আর একধরনের অসম্মানজনক ঘৃণায় ওর মনটা ভরে ওঠে।
কাজের মেয়ের সন্তান, কাজের মেয়ের সন্তান!
অবৈধ, অবৈধ … রাসেলের কানের মধ্যে কে যেন গরম কিছু ঢেলে দিয়েছে, সমস্ত শরীর দিয়ে তাপ বেরিয়ে আসছে দপ্ দপ্ করে। আত্মবিস্মৃত হয়ে গাড়ির দরজা খুলে বাইরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভার বলে, স্যার উঠুন, সামনের গাড়ি আগাচ্ছে। রাসেল উঠতে গিয়ে ঘাড়ে ব্যথা পায়। দূর থেকে ভেসে আসে, বোন হতে পারে, ফুফু-খালা হতে পারে, হতে পারে প্রিয় বান্ধবী; কিন্তু এ-বাড়ির বউ কখনো নয়। গাড়ির গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে আসা কথামালা কাঁপতে থাকে, সরে যায় দূরে। সমাজের দর্পণটা সবসময় ভাঙা, তাই তাতে চোখ রেখে সুন্দরও কখনো অসুন্দর হয়ে এক পাল্লায় ওঠে। কেউ কেউ সে-দর্পণে চোখ রাখে আড়ালে। নিজের কুৎসিত চেহারা কখনো কখনো আড়াল করা হয়। ওই আয়না সুন্দরের দিকে তাক করে সমাজে ইল্যুশন তৈরি করে। প্রথমবার জোর করে তালাকনামায় সই নেওয়ার পর তার আরো দুবার বিয়ে হয়েছিল। কোথাও সে থিতু হতে পারেনি। মিলার কাছে নাকি বলেছিল, একটা কাঁটা, মেহেদি কাঁটা তাকে সর্বক্ষণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দগ্ধ করে। যে-কাঁটা মেহেদি দিয়ে সে বেড়া বসিয়েছিল নিজের চারপাশের জগতে, সেই কাঁটা আজ তাকে খুঁচিয়ে রক্ত ঝরায়।
রোদ পোহানো কালো রাস্তাটা অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। দুপাশে বিলের মাঝে থেকে থেকে সবজি ক্ষেতে পাতাকপির পাতার শিশির শুকিয়ে গেছে। বেলা বেড়ে চলছে ধীরে ধীরে। রাসেল গাড়ির গ্লাসটা একটু নামিয়ে দেয়।
ড্রাইভার সাহেব আমরা জুমার নামাজের আগে পৌঁছাতে পারবো তো?
হ্যাঁ স্যার, আর বড়জোর এক ঘণ্টা লাগবে।
বলতে গেলে জমিদারের মেয়ে হয়েও তার এই পরিণতি রাসেল মেনে নিতে পারে না। তার বাবাও ছিল ভীষণ গোঁয়ার, নিজের মেয়ের জন্য একবারও তাদের বাড়িতে আসেনি এবং পেছনের কারণ ছিল তার মা। তার মা যে ও-বাড়ির কেয়ারটেকার ছিল, এক অর্থে কাজের মেয়ে, সেটি ঠিক; কিন্তু একসময় অপরিহার্য বাস্তবতায় সাহেব আলী নিজের তরুণ-যুবা ছেলেদের মতামতের গুরুত্ব না দিয়ে তার মাকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তার মায়ের ঠাঁই হয়েছিল প্রাসাদ ছেড়ে মাটির ঘরে। সেসব কাহিনি গল্পের ঝাঁপি ভেঙে ডালপালা মেলে আছে বিস্তর। কতদিন সেই প্রসঙ্গে কথা উঠলেই রাসেল তাকে দেখেছে শামুকের মতো ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে। তাকে অপছন্দ করার মানুষ তাদের বাড়িতে কেউ ছিল না, বাবা ছাড়া। কিন্তু যাকে ভেবে, ভালোবেসে ভরসায় রেখে সে বিয়ে করলো, সে তার ভাইয়ের সিদ্ধান্তের ওপরে উঠতে পারলো না। এসবে রাসেলের কিছু যায়-আসে না; কিন্তু তার ‘আব্বা’ ডাক তাকে এক গভীর কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে সব সময় অসমর্থ হওয়ার অযোগ্যতায়। আজ সেই সময় থাকলে ঠিকই রাসেল স্বমহিমায় তাকে এনে সংসারের বেদিতে বসিয়ে দিত।
সেও কতবার তার বাবার কাছে অনুনয় করেছে তার এই পতিত সন্তানের জন্য একটিবার হলেও আমার বাবাকে অনুরোধ করতে, নতুন করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে। এমনকি তার মাও দীর্ঘ অভিমান ভেঙে মেয়ের জন্য শূন্য হাতে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় কুড়ি বছর পর; কিন্তু সাহেব আলীর মুখ থেকে প্রচণ্ড ক্রোধের অকথিত সংলাপ নাকি তার দীর্ঘকায় কৃষ্ণ শরীর থেকে অন্ধকারের মতো ঝরে ঝরে পড়েছিল। সেবার ফিরে এসেছিল মা একা, এবার মেয়েকে নিয়ে। রাসেলের মনের মধ্যে এসব কথার হাট বসে সমস্ত যাত্রাপথে। তবে মেয়ের সঙ্গে নাকি কথা বলতো মাঝে মাঝে শেষ বয়সে, যখন বিছানায় ক্ষণকালের জন্য শুয়ে ছিল। মেয়েকে দেখলে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তো। দ্বিতীয় সংসার থেকে যখন সে ছেলেকে নিয়ে ফিরে এলো, অধিকাংশ সময় সে-ই তার বাবাকে দেখাশোনা করতো। বাবার চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু মোছাতে মোছাতে বলতো, আব্বা, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।
সেই দিনটির কথা রাসেলের খুব মনে পড়ে। রাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতে বাড়ি গিয়েই শুনলো তৃতীয়পক্ষের উপস্থিতিতে একটা মীমাংসার চেষ্টা চলছে। তার দিক থেকে কেউ আসেনি, না নিজের ভাই, না তার সৎ ভাইয়েরা। সে একা নিজের দাবি নিয়ে এসেছিল অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে; কিন্তু সে জানতো না যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল সে একজন শিরদাঁড়াহীন মোলাস্কাস, বাইরেরটা একটা আবরণমাত্র, সামান্য প্রতিবন্ধকতায় নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। তার প্রতিরক্ষার সবচেয়ে বড় অস্ত্রকে ভ্রƒণাবস্থায় তার কথায় শেষ করে ফেলেছিল। রাসেল পরে শুনেছিল, তার প্রচণ্ড আপত্তি সত্ত্বেও চাচা তাকে অ্যাবরশনে রাজি হতে বাধ্য করেছিল। না, সে পারেনি। নিজের চোখের জল আঁচলে বেঁধে সেদিন তালাকনামায় স্বাক্ষর দিয়ে মায়ের কাছে ফিরে এসেছিল। সে-অভিমান ভরা নোনা জলে আবার তার বিয়ের স্নান হয়েছিল বছরদুই পর।
কিন্তু সে-বিয়ে অতীতকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাকে রক্তাক্ত করেছে প্রতিনিয়ত। সইতে হয়েছে নির্যাতন। তবু ছেলেটার মুখ চেয়ে সহ্য করে নিয়েছিল সব; কিন্তু একসময় সব ভেঙে পড়লো। আবার ঠাঁই হলো মায়ের কাছে। মাঝখানে মরে যাওয়া প্রেম নাকি আবার ডুবোচরের মতো জেগে উঠেছিল। রাসেল সেসব খবর পেয়েছিল কিন্তু ক্ষমা করতে পারেনি কোনোদিন নিজের বাবা আর চাচাকে। তার তৃতীয় বিয়ে নিয়ে তাকে শুনতে হয়েছে বিস্তর ধ্বনি। মেয়েমানুষের তৃতীয় বিয়ে! সেও কি সমাজ সয়? অবধারিত নিন্দে-মন্দ গিয়ে পড়ে মায়ের ঘাড়ে, তবু সে দমে যায়নি। জীবনকে দুধে-ঘোলে মাখিয়ে কখনো কাছ থেকে, কখনো দূর থেকে দেখেছে। তৃতীয় বিয়েটা অনেকটা নিজের পছন্দমতো নাকি করেছিল সামাজিক নিরাপত্তার অভাব বোধ থেকে। যে মা দু-পাখার মধ্যে আটকে রাখতো, সেও একসময় তাকে একা রেখে চলে গেলে নিজের দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে এসে চাপে।
ড্রাইভার ব্রেকে পা দেয়। বোধহয় তারা পৌঁছে গেছে। বাড়িতে খুব বেশি মানুষজনের আনাগোনা নেই বা হয়তো সবাই বিদায় জানিয়ে চলে গেছে। তার বারো বছরের ছেলেটা রাসেলকে দেখে কাছে এসে জোরে কেঁদে ওঠে।
ভাইয়া মা …
একটা চিঠি মনে হয় বহুদিন আগেই লেখা হয়েছে, রাসেলের হাতে দিয়ে ছেলেটা একদৃষ্টে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটার আর কেউ থাকলো না, রাসেল ওকে কী সান্ত্বনা দেবে ভেবে পায় না। পাশে নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখে।
মাইকে বেজে ওঠে কারো শুষ্ক কণ্ঠধ্বনি, মরহুম সাহেব আলীর কন্যা সাহানারা পারভিন আজ ভোর চার ঘটিকায় ইন্তেকাল করেছেন। মরহুমার জানাজার নামাজ জুম্মাবাদ …
রাসেল কাছে যেতেই কেউ একজন কাফন আলগা করে মুখটা দেখিয়ে দেয়।
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.